1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ২৭

সাতাশ

ছোটবেলা থেকেই জঙ্গলে এই কুটিরটা বিলি ম্যাকগ্রার জীবনে বড় ভূমিকা রেখেছে। বছরের পর বছর এখানে এসেছে বাবার সঙ্গে। দু’জন মিলে শিকার করেছে স্যামন মাছ আর খরগোশ। শীতের ঠাণ্ডা রাতে এই কুটির ছিল একমাত্র আশ্রয়। আর বড় হওয়ার পর স্যামন পোচিঙের সময় এটাই হয়েছে জঙ্গলে রাত কাটাবার একমাত্র ঠাঁই। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ট্রেইলার ছেড়ে বাস করেছে সে এখানে। আর রবার্ট উইলসন খুন হওয়ার পর সে হয়ে গেল খুনের সাক্ষী। তখন নিজেও খুন হবে সেই ভয়ে এই কুটিরে আবারও এসে উঠল লুকিয়ে থাকতে হলে এটাই এই এলাকার সেরা জায়গা।

পিটারের চাচার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে কয়েকটা দিন। এরপর আর তাকে জঙ্গলে দেখতে পায়নি বলে মনে বেশ স্বস্তি পাচ্ছে ম্যাকগ্রা। ভূতের মত পোশাকে হাজির হওয়া বেন হ্যাননকে কেন যেন খুব ভয় লেগেছে তার। বুড়ো কেড়ে নিয়ে গেছে তার স্মার্টফোন। লোকটার শেষ কথা এখনও তার মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে: ‘আমার কথা শুনলে বলব: আপাতত এ এলাকা থেকে বহু দূরে চলে যাও। এদিকটা এবার হবে নরকের মত।’

তবে কোথাও যেতে হলে পকেটে টাকা থাকতে হয়। সেটা নেই ম্যাকগ্রার। তাই মাথা গুঁজে পড়ে আছে পাথরের কুটিরে। দিন-রাতের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিচ্ছে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর। এদিকে ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছে স্যামন মাছের সাপ্লাই। দিনে একবার জঙ্গলে ঢুকে জ্বালানি কাঠ জোগাড় করে আগুন জ্বেলে, নাকে-মুখে কিছু খাবার গুঁজে নিচ্ছে।

চুপচাপ কুটিরে বসে বা শুয়ে কাটছে বেশিরভাগ সময়। তাতে যে খারাপ লাগছে ম্যাকগ্রার, তা-ও নয়। বারবার ভাবছে রবার্ট, পিটার আর বেন হ্যাননের কথা। বিশেষ করে তার মনে গভীর ছাপ ফেলে গেছে বুড়ো। জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, সে এখন কী করছে। রক্তারক্তি কিছু করবে সে। খুন করবে রবার্টের খুনিদেরকে। পিটারকে যারা আহত করেছে, প্রতিশোধ নেবে তাদের ওপর। মাটির নিচে পুঁতে দেবে সবাইকে। অথবা, হামলা করতে গিয়ে বুড়ো হয়তো এখন আছে জেলখানায়। অবশ্য সে সফল হলেই ভাল হতো। নিরাপদে গিয়ে ট্রেইলারে উঠতে পারত ম্যাকগ্রা। লুকিয়ে থাকতে হতো না জঙ্গলে কুটিরের ভেতর। আসলে বাইরের কোনও খবর পাচ্ছে না বলেই এত উতলা লাগছে তার মন।

আরও একটা কারণে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। দু’সপ্তাহ পর সরকারি সহায়তার টাকা তুলতে তার যাওয়ার কথা ছিল ফোর্ট উইলিয়ামে। স্যামন মাছ ধরে এত টাকা পায় না যে বেকার ভাতার টাকাটা তার লাগবে না। আর ওই টাকা দিয়েই তো ট্রেইলারের মালিকের ভাড়া শোধ করে। আজ সেই টাকা তোলার দিন। জব সেন্টারে হাজির হয়ে প্রমাণ করতে হবে যে সে সত্যিই চাকরি খুঁজছে। নইলে টাকা দেয়া বন্ধ করে দেবে কর্তৃপক্ষ। সেক্ষেত্রে টাকার অভাবে পড়বে ম্যাকগ্রা।

পাথরের কুটিরে বসে হঠাৎই তার মনে পড়ল, টাকা তুলতে হলে আগে চাই সই করার সেই খাতা। ওটা দেখিয়েই সে প্রমাণ করে যে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছে। অথচ খাতাটা রয়ে গেছে তার ট্রেইলারে!

‘মরুক শালারা!’ গরম পোশাক পরে হন্তদন্ত হয়ে কুটির থেকে বেরোল ম্যাকগ্রা। আজই সইয়ের খাতা নিয়ে তাকে যেতে হবে ফোর্ট উইলিয়ামে। কাজটা একবার শেষ হলে কুটিরে ফিরে ভাববে এরপর কী করবে।

কুটিরের সামনে থেকে দরকারি জিনিসপত্র সুবারু জিপে তুলল সে। নোংরা কাপড় দিয়ে মুছে নিল গাড়ির উইণ্ডস্ক্রিন। তারপর সুবারু নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গিয়ে পড়ল দূরের রাস্তায়। সোজা ফিরছে সে কিনলোকার্ড গ্রামে।

গ্রাম থেকে আধমাইল দূরে পরিত্যক্ত মাঠে ট্রেইলারটা রেখে দিয়েছে ওটার মালিক। সেই খামারি একসময়ে ভেবেছে মাঠে তৈরি করবে মোবাইল হোমের ক্যারাভান পার্ক। অবশ্য পরে দেখল একমাত্র ট্রেইলারটা ভাড়া নেয়ার মত কেউ নেই। তাই প্রতি সপ্তাহের চুক্তিতে মোবাইল হোমটা যখন শেষমেশ ভাড়া নিল ম্যাকগ্রা, হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। ছাতফুটো কার্ডবোর্ডের পঁচিশ ফুট বাই দশ ফুটের বাক্সটা আর যাই হোক কারও আনন্দময় বাড়ি হবে না। চারপাশে জমে আছে নানান ধরনের জঞ্জাল আর ঝোপঝাড়। ভেতরেও গিজগিজ করছে আবর্জনা।

বরফে ছাওয়া এবড়োখেবড়ো মাঠের মাঝ দিয়ে এগিয়ে মোবাইল হোমের পাশে গিয়ে সুবারু রাখল বিলি ম্যাকগ্রা। গাড়ি থেকে নেমে দেখল, বরাবরের মতই মোবাইল হোমের দরজায় তালা না মেরেই চলে গিয়েছিল। তবে তাতে কোনও সমস্যাও নেই। চুরি করার মত কিছুই নেই ওটার ভেতর।

টান দিতেই ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ তুলল পলকা দরজা। বুটের তলা থেকে বরফ না ঝরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল ম্যাকগ্রা। হাতে নেই নষ্ট করার মত সময়। দেরি না করে সোজা গিয়ে ঢুকল বেডরুমে। ট্রেইলারের ভেতর পোড়া তেলের বাজে গন্ধ। এ ছাড়া আছে বাসি পোশাকের দুর্গন্ধ। বিছানা হিসেবে মেঝেতে ম্যাট্রেস পেতে ঘুমায় ম্যাকগ্রা। একপাশে কেবিনেট। অন্যদিকে পায়রার খোপের মত কিচেন। কাউন্টারের ওপর আধোয়া মগ ও মুচড়ে থাকা কয়েকটা ম্যাগাযিন। সব আগের মতই আছে।

‘মানুষ এখানে থাকে!’ বিড়বিড় করল ম্যাকগ্রা। একবার দেখে নিল হাতঘড়ি। বাজে বেলা আড়াইটা। ফোর্ট উইলিয়ামে পৌঁছে যাওয়ার জন্যে হাতে অনেক সময় পাবে। কিচেনের কাউন্টার থেকে সই করার খাতা নিয়ে পকেটে পুরল সে। ঘুরে রওনা হলো দরজার দিকে। কিন্তু কয়েক পা যেতেই তার গলা চিরে বেরোল চাপা আর্তনাদ। ভয় পেয়ে গেছে সে। এইমাত্র দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে দুই লোক। ডানদিকের লোকটার হাতে লম্বা ছুরি। ওটা দিয়ে ম্যাকগ্রার পেটে হালকা গুঁতো দিল সে।

প্রাণভয়ে পিছিয়ে এল ম্যাকগ্রা। এতই অবাক হয়েছে যে ঠিকভাবে কাজ করছে না মাথা। সামনে বেড়ে তার বুকে ছুরির ডগা ঠেকাল লোকটা। একমুহূর্ত পর নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে দু’হাত ওপরে তুলল ম্যাকগ্রা। এদিকে ছুরির পোঁচে তার হাতের তালু আর কড়ে আঙুল কেটে দিল আক্রমণকারী। সামনে বাড়ল তার সঙ্গী, ডানহাতে ছোরা। বরফ-ঠাণ্ডা স্টিলের পাত পুচ করে বিধল ম্যাকগ্রার ঘাড়ে। চরম আতঙ্কে তার গলা চিরে বেরোল জান্তব গোঙানি। এবং তখনই প্রথমবারের মত ম্যাকগ্রা বুঝল, কোনও কারণ ছাড়াই খুন করা হচ্ছে তাকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *