1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ২৪

চব্বিশ

ফোর্ট উইলিয়াম থেকে জিনিসপত্র কিনে আবারও মিসেস ক্লার্কের কটেজে ফিরেছে রানা। সব মাল ঠিক আছে কি না দেখে নিয়ে কল দিল বেন হ্যাননের স্ত্রীর কাছে। ওদিক থেকে মিরাণ্ডা জানাল, যোগাযোগ করেনি বেন। দুশ্চিন্তা আর ভয়ে ঘুমাতে পারছে না সে। রানার ফোন পেয়েই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। তিনমিনিটের ফোনালাপে রানা বুঝল, গত দু’এক দিনে অন্যকিছু ভাবছে মিরাণ্ডা। তার কথা থেকেই বেরিয়ে এল সেটা।

‘আমি তোমাকে মন থেকে বিশ্বাস করি, রানা। নইলে তোমার কাছে সাহায্য চাইতাম না। তবে…’

‘বলুন, আমি শুনছি,’ রানা আঁচ করে নিয়েছে এবার কী বলবে মহিলা।

‘সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, রানা। ফোনের সামনে বসে থাকতে থাকতে খুব অসহায় লাগছে। মুখের রুচি হারিয়ে গেছে। সারারাত পায়চারি করি। তাই মনে হচ্ছে, এবার বোধহয় সময় হয়েছে স্বীকার করে নেয়ার, এভাবে বেনকে আমরা খুঁজে বের করতে পারব না। তাই মনে হচ্ছে দেরি না করে যোগাযোগ করা উচিত পুলিশের কাছে।’

‘আমি বেনকে খুঁজে না পেলে, ওই একই কাজ কীভাবে করবে পুলিশ?’ নরম গলায় বলল রানা।

‘ইন্টারপোলে জানাব। তারা হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে বের করে। লোকবলও তাদের অনেক। হেলিকপ্টার আছে। তাদের কুকুর হয়তো গন্ধ শুঁকে খুঁজে বের করতে পারবে বেনকে।‘

পুলিশ খুঁজতে শুরু করলে বেনের বিপক্ষ চট্ করে ডুব দেবে। তখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না বেনকে। সে বেঁচে আছে না মারা গেছে, তা-ও জানার উপায় থাকবে না। তা ছাড়া, রাজনৈতিক চাপ নেই বলে খুঁজতে গিয়ে গা করবে না ইন্টারপোল বা অন্যান্য সংস্থা। অথচ এ-কথা মিরাণ্ডাকে বলতে পারবে না রানা। আরও নরম সুরে বলল, বেনকে খুঁজে পাওয়ার খুব কাছাকাছি পৌছে গেছি, মিরাণ্ডা। ঠিক পথেই এগোচ্ছি।’

‘জানি না আমার এখন কী করা উচিত, রানা।’

‘সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে, মিরাণ্ডা। আপনি যা স্থির করবেন, আমি সেটা মেনে নেব। তবে নিজে বেনকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে হাল ছাড়ছি না।’

‘তো আরেকটা দিন অপেক্ষা করি,’ ফুঁপিয়ে উঠল মিরাণ্ডা। ‘তারপরও ওকে না পেলে যোগাযোগ করব ইন্টারপোলে। আমার খুব খারাপ লাগছে, রানা। ভয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি। কিছু করতে না পারলে হয়তো ভাবতে ভাবতে মরেই যাব।’

‘চব্বিশ ঘণ্টা পর যা ভাল মনে হবে, তাই করবেন, দীর্ঘশ্বাস চাপল রানা। ‘দিন-রাত যে-কোনও সময়ে কথা বলতে পারবেন আমার সঙ্গে। এদিকে আমি দেখি কতটা কী করা যায়, কোনও অগ্রগতি হলেই আমি প্রথমে আপনাকে জানাব। ঠিক আছে?’

ফোন রাখার সময়েও কাঁদছে মিরাণ্ডা। মনটা খারাপ হয়ে গেল, কল কেটে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। ধূসর আকাশ থেকে ভাসতে ভাসতে নামছে তুষারের তুলো। আবারও বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোল রানার। হাতে আছে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। এরপর ইণ্টারপোলে ফোন দেবে মিরাণ্ডা। তারা বেন হ্যাননকে খুঁজতে শুরু করলেই সতর্ক হয়ে উঠবে শত্রুপক্ষ।

হাতে সময় নেই। ইকুইপমেন্ট আর অস্ত্র প্যাকেট করে কটেজ থেকে বেরিয়ে এল রানা। চেপে বসল গাড়িতে। রওনা হলো চেনা পথে লক আরডাইকের দিকে। বারবার মনে হচ্ছে, ঠিক পথেই চলছে ওর তদন্ত। তবে খুনিরা পেয়ে যাওয়ার আগেই খুঁজে নিতে হবে সেই পোচার লোকটাকে।

শত্রুরা কারা তা জানা নেই রানার। তবে তারা নতুন কিছু করলে আর সেটা জানলে, হয়তো রানার জন্যে খুলে যাবে অন্য কোনও পথ। পোচারকে নিশ্চয়ই

পোচারকে নিশ্চয়ই খুঁজছে তারা। সেজন্যেই হয়তো তাদের সঙ্গে দেখা হবে রানার। ওর মন বলছে, অবশ্যই দেখা হবে সেই স্নাইপারের সঙ্গে। এবং তখন তৈরি থাকবে ও।

এবার আগের জায়গা পেরিয়ে গাড়ি রাখল রানা। চারপাশে পাইনের জঙ্গল। একটু দূরে লক আরডাইকের পশ্চিম তীর। পরিবেশটা যেন বরফের মত জমাট। উষ্ণ টয়োটা থেকে নেমে ওর মনে হলো, ও পৌঁছে গেছে ঠাণ্ডা কোনও নরকে। হাত-পায়ে লাগছে কনকনে হিমশীতল হাওয়া। জমা ভারী তুষার নিচু করে দিয়েছে পাইনের ডালপালা। মাঝে মাঝে ওপরে উঠতে চাইছে পাইনের ডাল। তখন ঝুপ করে বরফ ছাওয়া মাটিতে পড়ছে একরাশ পাউডারের মত তুষার। পথ করে এগোনো কঠিন। সাধারণ কেউ পায়ের ছাপ রেখে এগোত। ওগুলো দেখে যে-কেউ পিছু নিত তার। কিন্তু রানা সাধারণ কেউ নয়। কোনও চিহ্ন না, রেখেই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। একঘণ্টা পর রাতে যেখানে ওকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে, সেখানে পৌঁছে গেল।

দিনের আলোয় রানা পরিষ্কার দেখল কোথা থেকে এসেছে গুলি। রাতের ওই শুটার ছিল অত্যন্ত দক্ষ। অন্ধকারে কুয়াশাভরা ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়েও লক্ষ্যভেদে প্রায় সফল হয়েছিল। চারপাশ দেখে রানা বুঝতে পারল কোথায় ছিল শুটার। লকের ষাট গজ দূরের পশ্চিম টিলা থেকে এসেছে গুলি। ক্রসবোর লেযার রেঞ্জফাইণ্ডার ব্যবহার করে রানা জেনে নিল, গতরাতে গুলির সময় ও নিজে ছিল ঠিক দুই শ’ আঠারো গজ দূরে।

আরও আধঘণ্টা হেঁটে লক আরডাইকের তীরের টিলায় উঠল রানা। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেল স্নাইপারের ঘাপটি মেরে থাকার জায়গাটা। তুষারের ওপর দেবে আছে পায়ের ছাপ। সামান্য দূরে ছোট্ট গর্ত। আঙুল দিয়ে ওখানে খোঁচাতেই বেরিয়ে এল বুলেটের খোসা। রাইফেলের গরম ব্রিচ থেকে তুষারে পড়ে গর্ত তৈরি করেছে তামার ঝকঝকে শেল। নিচে লেখা ৩০৮ রেমিংটন। গুলিটা ছিল ন্যাটো ফোর্সের মিলিটারি ৭.৬২ রাউণ্ডের মত। এক হাজার গজ দূর থেকেও ওই গুলি ভেদ করবে যে-কাউকে।

বেঁচে আছে নেহায়েত কপালের জোরে—স্পষ্ট বুঝল রানা। দুই ইঞ্চির ব্যবধানে ছিল ওর জীবন, মৃত্যু। তুষারে খালি খোসাটা ফেলে মৃদু হাসল রানা, চারপাশে তাকাল। সেরা জায়গা বেছে নিয়েছিল শুটার। লক আরডাইকের পশ্চিম থেকে বরফে ছাওয়া তীরের বহু দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। নিজেও গুলির জন্যে ঠিক এই জায়গাই বেছে নিত রানা। ওর মনের ভেতর টিক-টিক করে চলছে অদৃশ্য এক ঘড়ি। চব্বিশ ঘণ্টাও নেই এদিকে সার্চ করতে পুলিশের সাহায্য চাইবে মিরাণ্ডা। মনের ওপর চাপ টের পেল রানা।

ব্যাগ থেকে বের করে পোশাকের ওপর পরে নিল ঘিলি সুট। ওটার কারণে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। শীতও কমেছে ভারী পোশাকের জন্যে। এখন নড়াচড়া না করলে তুষারের ভেতর ওকে দেখাবে ঝোপের মত। বসে পড়ে চারপাশে চোখ রাখল রানা। বারবার মনে এল অনিশ্চয়তা। যদি এদিকে না আসে পোচার? হয়তো এদিকে আর এলই না সেই শুটারটাও! তা হলে? অথচ, ঝড়ের বেগে ফুরিয়ে যাচ্ছে সময়। হয়তো জঙ্গলে বা পাহাড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে বেন! হয়তো বেঁচেই নেই!

মিরাণ্ডার কথাই হয়তো ঠিক। সার্চ করা উচিত এদিকের এলাকা। লোকবল আছে বলে সেটা ওর চেয়ে ভাল পারবে পুলিশ বাহিনী। চিন্তাগুলো অস্থির করে দিতে চাইছে রানার মন। সেগুলোর সঙ্গে লড়াই করে পার করল ঘণ্টাখানেক। তারপর লকের তীরে হঠাৎই দেখল কী যেন নড়ছে!

এখন আর জঙ্গলে একা নয় ও!

ক্রসবোর স্কোপের মাঝ দিয়ে তাকাল রানা। দূরের ওই লোকের পরনে কালো কুইন্টেড উইন্টার জ্যাকেট। শরীরটা ভারী। শীতের বাতাস এড়াতে মুখের ওপর ঝুঁকিয়ে রেখেছে হুড। তীর ধরে হেঁটে আসছে রানার দিকেই। ওই লোকই কি সেই পোচার? নাকি স্নাইপার? তবে হাতে ছিপ, মাছ বা রাইফেল নেই কেন?

কালো পোশাক পরা লোকটার ওপর স্কোপ তাক করল রানা। কয়েক পা গিয়ে থামছে সে। কাউকে বোধহয় খুঁজছে। অথবা অন্যকিছু। মুখের সামনে হুডের আড়াল থাকায় চেহারা দেখার উপায় নেই। কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে রানা বুঝল, এই লোক বেন হ্যানন নয়।

একটু পর উল্টোদিকে চলল সে।

রানার মনে হলো, গোপনে পিছু নেয়া উচিত।

স্নাইপার পযিশন থেকে নেমে টিলা বেয়ে নামতে লাগল রানা, খুব সতর্ক। বড় পাথর ও ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে আড়াআড়িভাবে চলেছে লোকটার দিকে। টিলা থেকে নেমে লক আরডাইকের তীর ধরে চলল রানা। গায়ের পোশাকের কারণে হয়ে গেছে পাতাভরা এক দানব। ধীর পায়ে হাঁটছে কালো পোশাক পরা লোকটা। নিজেকে গোপন করার চেষ্টা করছে না। ডানে-বামে দেখতে দেখতে লকের তীর ধরে হাঁটছে। নিঃশব্দে তার কাছে পৌঁছে গেল রানা। ষাট গজ দূরত্ব থাকতে বসে পড়ল মোটা এক পাইন গাছের পাশে। কাঁধে ক্রসবো তুলে স্কোপের মাঝ দিয়ে তাকাল আবার। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড লাগল বুঝতে, লোকটা আসলে পোচার, বেন হ্যানন বা স্নাইপার নয়। এক মহিলা। ভারী পোশাক পরলেও আড়াল করতে পারেনি নমনীয় দেহের বাঁক।

ঘুরে তাকাল মেয়েটা।

এবার পরিষ্কার তার মুখ দেখল রানা।

জেসিকা থমসন!

ওকে দেখেনি মেয়েটা।

ভুতুড়ে পোশাকে দেখা দিতে চাইল না রানা। পাইন গাছের ওদিকে সরে খুলে ফেলল ঘিলি সুট। বাণ্ডিল বানিয়ে রেখে দিল গাছের কাণ্ডের পাশে। ওটার ওপর রাখল ক্রসবো। কাজ শেষ হতেই হালকা চালে দৌড় দিল মেয়েটার দিকে। গলা ছেড়ে ডাকল: ‘জেসিকা!’

থমকে গিয়ে হুড তুলে ঘুরে তাকাল মেয়েটা। দাঁড়িয়ে আছে হাঁটু গভীর তুষারের ভেতর। রানাকে ছুটে আসতে দেখে অবাক হয়েছে। ভীষণ শীতে লাল হয়েছে তার গাল ও নাক। ভারী দস্তানা দুই হাতে। একটা হাত তুলে একরাশ কালো চুল সরাল কপাল থেকে। নাক থেকে ভুসভুস করে বেরোচ্ছে সাদা বাষ্পের মত কুয়াশা। রানাকে চিনতে পেরে ঝিলমিল করে উঠল তার দুই চোখ। কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আগেই বলল রানা: ‘তুমি এখানে, জেসিকা?’

ওকে অবাক করে বলল মেয়েটা, ‘তোমাকেই খুঁজছি। আমার মনে হয়েছিল এদিকেই পাব।’

‘কী জন্যে খুঁজছ?’ জানতে চাইল রানা।

‘তোমাকে জানাতে যে খুঁজে পেয়ে গেছি ওই পোচারকে,‘ বলল জেসিকা। ‘আমি এখন জানি সে আসলে কে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *