1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ২৯

ঊনত্রিশ

মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডে শেষ হয়ে গেছে লড়াই। বন্দুক থেকে ধূমায়িত গুলির খোসা বের করে মাটিতে ফেলল রানা। এখন আর প্রয়োজন নেই দ্বিতীয় গুলির। মরা হাঁসের মত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আততায়ী। বুকের পাশে বরফে ছড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। সরাসরি নিষ্পলক চোখে মাথার ওপরের ধূসর মেঘের দিকে চেয়ে আছে সে।

কয়েক পা গিয়ে লাশের শিথিল মুঠো থেকে পিস্তলটা নিল রানা। ওটা গ্লক ২১। .৪৫ ক্যালিবারের অটোমেটিক। ইউকেতে সাধারণ মানুষের জন্যে নিষিদ্ধ। কৌতূহলী হয়ে উঠল রানা। লাল রক্তে চটচট করছে মৃতের গ্লাভ্স্। পিস্তলের ম্যাগাযিন বের করে রানা দেখল, এখনও চেম্বারে গুলি আছে। সবমিলিয়ে সাতটা গুলি খরচ করেছে আততায়ী। ম্যাগাযিনে আছে সাত রাউণ্ড। সেগুলো ব্যয় করা হলে বেঘোরে মরত জেসিকা আর ও।

পিস্তলটা আনকক করে জেসিকাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল রানা। বরফের মত ঠাণ্ডা মেয়েটার হাত। একটু সরে পোশাক থেকে ঝেড়ে ফেলল তুষার। আকস্মিক এ ঘটনায় মৃদু হাঁ হয়ে গেছে মুখ। বারবার দেখছে মৃত লোকটা আর রানাকে।

‘হায়, যিশু!’ ক’মুহূর্ত পর বলল, ‘খুনই করে ফেললে?’

‘এ ছাড়া উপায় ছিল?’

‘আগেও মানুষ খুন করেছ?’

‘অন্যকে বা নিজেকে বাঁচাতে,’ বলল রানা। ‘কপাল ভাল তোমার কোনও ক্ষতি হয়নি।’ দূরের গাছগুলোর দিকে তাকাল রানা। তুষারে পায়ের ছাপ ফেলে পুবে গেছে প্রথম লোকটা। ওদিকে বোধহয় আছে তার গাড়ি। ট্রেইলারে উঠে ম্যাকগ্রার খোঁজ নেবে, না লোকটার পিছু নেবে, দ্বিধায় পড়ল রানা। অবশ্য তখনই ওর মনস্থির করে দিল ইঞ্জিনের আওয়াজ। গর্জে উঠে রওনা হলো গাড়িটা। ট্রেইলারের বরফে ছাওয়া পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে উঠল রানা। ধাক্কা দিতেই ফটাস্ শব্দে ভেতর দিকে খুলল দরজা।

মেঝেতে শুয়ে আছে ম্যাকগ্রা। এখনও মারা যায়নি। ফাঁক করে দেয়া হয়েছে গলা। বুকে ছোরার কয়েকটা গভীর ক্ষত। অক্ষিকোটরে ঘুরছে দুই চোখ। রানা তার দিকে ঝুঁকে যেতেই ম্যাকগ্রা টের পেল, কাছেই কেউ না কেউ আছে। কথা বলে উঠতে চাইল। কিন্তু গলা থেকে বেরোল শুধু ঘড়ঘড় আওয়াজ। ঠোঁটের কোণে জমল রক্তভরা বুদ্বুদ। পরক্ষণে হুস্ আওয়াজে বেরোল ম্যাকগ্রার অন্তিম শ্বাস। মেঝেতে কাত হয়ে গেল মাথা।

এখানে রয়ে গিয়ে আর কোনও লাভ হবে না, বুঝে গেল রানা। শত চেষ্টাতেও আর মুখ খুলবে না লোকটা।

রানার মনে হলো, ওর উচিত ছিল প্রথম লোকটার পেছনে যাওয়া। অসময়ে বাজে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছে। পেছনে জেসিকার উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকাল।

অসুস্থ চেহারায় ম্যাকগ্রাকে দেখছে জেসিকা। বড় শহরের মারপিট বা খুনোখুনি নিজের চোখে আগে কখনও দেখেনি। যে-কোনও সময়ে দুই হাতে পেট চেপে ধরে বমি করে দেবে।

‘মারা গেছে,’ নিচু গলায় বলল রানা।

‘বুঝতে পেরেছি।’

‘এই লোকই কি বিলি ম্যাকগ্রা?’

মাথা দোলাল জেসিকা। ‘বহুদিন দেখা নেই। আরও মোটা হয়ে গিয়েছিল। তবে ঠোঁটের ক্ষত আগের মতই আছে। এই লোক যে ম্যাকগ্রা তাতে সন্দেহ নেই।’

ট্রেইলার থেকে নেমে পড়ল ওরা। থমথম করছে চারপাশ। মাঝে মাঝে হালকা হাওয়ায় ভর করে চোখ ও চুলে এসে পড়ছে তুষারকণা। আততায়ীর লাশের পাশে ঝুঁকে তার পকেট সার্চ করতে লাগল রানা। বরফে থকথকে রক্ত।

একটু দূর থেকে রানার কাজ দেখছে জেসিকা। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নাড়ল। ‘যখন ঠাট্টা করেছি, তখনও জানতাম না সত্যিই কাউকে খুন করবে তুমি।’

‘নিজের চোখেই তো দেখলে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে গুলি করেছি,’ মুখ তুলে জেসিকাকে দেখল রানা।

‘তোমার কাছে নল কাটা বন্দুক এল কী করে? ওটা তো আর কাক মারতে সঙ্গে করে নিয়ে আসোনি।’

‘বন্দুক কোথায় পেয়েছি সেটা জানতে চাও?’

‘না, তা জানতে চাইছি না।’

‘বেআইনি অস্ত্র সঙ্গে ছিল বলে গ্রেফতার করবে?’

‘না।’

‘শুয়োরটাকে গুলি করেছি বলে তোমার খারাপ লাগছে?’ লাশ দেখল জেসিকা। কী যেন ভাবছে। কয়েক মুহূর্ত পর আবারও মাথা নাড়ল। ‘খুন করতে গিয়ে মরেছে। এতে আমার মনে কোনও দুঃখ নেই। সঙ্গে এসেছ বলে ভাল লাগছে, নইলে খুন হতাম এদের হাতে। তবে এবার যে কী ঝামেলায় জড়িয়ে যাব, সেটা ভাবতে গিয়ে মন দমে গেছে। ইন্সপেক্টর আর সার্জেন্ট বলবে জরুরি তথ্য গোপন করেছি। বেসরকারি, বিদেশি এক লোককে জড়িয়ে নিয়েছি বেআইনি তদন্তে। আর এসব করতে গিয়ে খুন করে ফেলেছি সন্দেহভাজন খুনিকে।

‘আমরা এখান থেকে চুপচাপ বিদায় নেব,’ বলল রানা, ‘নাকি ভাবছ খবর দেবে তোমার পুলিশি বন্ধুদেরকে?’

তিক্ত হাসল জেসিকা। ‘জানিই তো না কী করা উচিত। এখনও আমার মাথায় ঢোকেনি আসলে কী ঘটল।’

‘আমরা আসতে দেরি করেছি,’ বলল রানা। ‘মাত্র কয়েক মিনিট আগে এলে জরুরি তথ্য দিত ম্যাকগ্রা। আগেই তাকে খুন করতে হাজির হয়ে গেছে আততায়ীরা।’

‘কিন্তু এই লাশ অন্য কথা বলছে,’ রক্তাক্ত লাশ দেখাল জেসিকা।

‘খুনের দায় কিন্তু আমি অস্বীকার করছি না,’ বলল রানা। ‘এবার নতুন করে তদন্ত করতে হবে। তুমি নিজে কী করবে বলে ভাবছ?’

‘আমি আবার কী ভাবব?’

‘এখন আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নষ্ট করার সময় নেই, জেসিকা। তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে।’

‘তার মানে, কাউকে কিছু বলব না? নাকের কাছে মানুষ খুন হলেও কিছু জানাব না?’

আততায়ীর পকেট সার্চ করে বাড়তি ম্যাগাযিন ছাড়া আর কিছুই পেল না রানা। মানিব্যাগ, ফোন বা কোনও আইডি নেই। এমনটা হবে আগেই জানত। এক পা পিছিয়ে যেতেই কাত হলো লাশের মাথা। আর তখনই তার ঘাড়ে রানা দেখল ঝাপসা এক উল্কি। ওটা মানুষের খুলি আকৃতির। ওটার বাম কোটর আর হাঁ করা চোয়াল জুড়ে ইংরেজিতে লেখা দুটো ডি। খুলির ওপর আঁড়াআড়িভাবে দুটো মিলিটারি ছোরা।

এই উল্কির ছবি আগেও দেখেছে রানা। ঝুঁকে ওপরে তুলল লাশের ডান বাহু। হ্যাঁচকা টানে খুলল রক্তাক্ত গ্লাভ্স্। জ্যাকেটের হাতা কনুই পর্যন্ত তুলেও দ্বিতীয় উল্কি পেল না।

ওকে দেখছে কৌতূহলী জেসিকা। ‘কী করছ, রানা?’

‘অস্বাভাবিক উল্কি খুঁজছি,’ একটু সরে নিজের ব্যাগ তুলল রানা। তলি ফুটো হয়ে গেছে ব্যাগের। পরে সেলাই করতে হবে। ব্যাগ থেকে কে-বার সার্ভাইভাল ছোরা বের করল রানা। ক্ষুরের মত ফলা দিয়ে চিরল আততায়ীর জ্যাকেটের হাতা থেকে শুরু করে কাঁধ পর্যন্ত। ভেতরে ফ্লিসের শার্ট। ওটা চিরতেই দেখা গেল বাহুর ওপরে বহু পুরনো দ্বিতীয় উল্কি। ওটা করোটির উল্কির চেয়েও ঝাপসা। ‘তো পাওয়া গেল,’ মন্তব্য করল রানা।

উল্কিটা দেখছে জেসিকা। ‘দুটো উল্কি। তবে তাতে কী?’

‘সাধারণ নয়,’ বলল রানা। ‘বাহুর উল্কি বলছে এই লোক আগে প্যারাশ্যুট রেজিমেন্টের সদস্য ছিল।’

‘উল্কিটা নকলও হতে পারে।’

‘অসম্ভব নয়। অনেকে মিলিটারিতে সুযোগ না পেয়েও নকল উল্কি এঁকে নেয়, যাতে সবাই তাদেরকে সম্মান করে। তবে এই লোকের ঘাড়ের উল্কি প্রমাণ করছে, আগে মিলিটারিতেই ছিল সে।’ ছোরা দিয়ে জ্যাকেটের কলার কাটল রানা। এবার করোটি আর ওটায় ডি লেখা অক্ষরটা পরিষ্কার দেখল জেসিকা।

‘ডি হয়তো তার নামের আদ্যক্ষর। হয়তো নাম ডেভিড, ডোনালসন বা ডোনাল্ড। হতে পারে না?’

‘না, এসবে অন্যকিছু আছে,’ ব্যাগে ছোরা রাখল রানা। ফোনের ক্যামেরা দিয়ে প্রতিটি উল্কির তিনটে করে ছবি তুলল। তারপর ছবি নিল লাশের মুখের।

ভুরু কুঁচকে ওকে দেখছে জেসিকা। ‘কী করছ, রানা?’

‘দুনিয়ায় খুব কম মানুষ এঁকে নেবে মিলিটারির এই উল্কি,’ বলল রানা, ‘আগে কখনও কারও ত্বকে দেখিনি। পরে

সব তোমাকে ব্যাখ্যা করে বলব। আপাতত এখান থেকে সরে যেতে হবে।’

‘ম্যাকগ্রার কী হবে?’ বলল জেসিকা। ‘ওকে তো এভাবে পচে যেতে দিতে পারি না।’

‘লাশ নিয়ে ভাবতে হবে না,’ বলল রানা, ‘যা শীত, ফ্রোজেন মুরগির মত জমাট হয়ে পড়ে থাকবে। পরের বছর গরম পড়লে গন্ধে হাজির হবে গ্রামের লোক। তখন কবরও দেবে।

‘তুমি তো ভীষণ নিষ্ঠুর লোক!’ বিরক্ত হলো জেসিকা। দেখতে পেল কোমরে গ্লক পিস্তল গুঁজল রানা। ‘আগেই তো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। আরও লাগবে কেন?’

‘বিপদের সময় না পাওয়ার চেয়ে বাড়তি অস্ত্র সঙ্গে থাকা ঢের ভাল,’ মন্তব্য করল রানা। ‘মনে হচ্ছে পরে এটা কাজে লাগবে।’ ছেঁড়া ব্যাগ পেছন সিটে রেখে টয়োটার স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে চেপে বসল রানা। ‘এই গাড়ি ভাড়া দেয়া কোম্পানি অনেক টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করবে।’

চিন্তিত চেহারায় পাশের সিটে উঠল জেসিকা। ‘তুমি বোধহয় আগেও অনেক গাড়ির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছ?’

‘দু’চারটা।’

গুলিতে ফেটে গেছে টয়োটার উইণ্ডস্ক্রিন। গাড়ির বডি ফুটো করে দিয়েছে কয়েকটা বুলেট। ইগনিশন চাবিতে মোচড় মেরে রানা আশা করল, চালু হবে ইঞ্জিন।

টয়োটা চাপা গর্জন ছেড়ে জেগে উঠতেই গেটের দিকে রওনা হলো রানা। তিনমিনিট পেরোবার আগেই ওরা গিয়ে পড়ল গ্রামের একপাশের পথে।

‘এবার?’ জানতে চাইল জেসিকা।

‘তোমাকে পৌঁছে দেব তোমার গাড়ির কাছে। মনে নেই কয়েক ঘণ্টা পর তোমার ডিউটি?’

ঘন ঘন মাথা নাড়ল জেসিকা। ‘অসম্ভব! ওখানে যাচ্ছি না। ফোন করে বলে দেব আমি অসুস্থ। মনে রেখো, এখন থেকে যা করার একসঙ্গে করব আমরা।’

‘তোমার এতটা ঝুঁকি না নেয়াই ভাল। মানুষ খুন হচ্ছে।’

‘তা হোক। এত সহজে আমাকে ঘাড় থেকে নামাতে পারবে না। হয় এসবে শেষপর্যন্ত থাকব, নইলে এখনই তোমাকে গ্রেফতার করব।’

‘আমাদের তো এ বিষয়ে আগেই কথা হয়েছে।’

‘যে-কোনও সময়ে সিদ্ধান্ত বদলে নিতে পারি।’

‘তা হলে গ্রেফতার করো,’ বিরক্ত হলো রানা। ‘সেক্ষেত্রে ইন্সপেক্টর মুরে আর সার্জেন্ট রিডকে ব্যাখ্যা করে সব খুলে বলতে হবে তোমাকে। …তবে, স্বেচ্ছায় তোমার সঙ্গে না-ও যেতে পারি।’

‘সে চেষ্টা করে দেখো!’

মেয়েটার কঠোর চোখ দেখছে রানা। ক’মুহূর্ত পর বুঝল, দরকারে ওকে গ্রেফতার করবে জেসিকা। সেক্ষেত্রে নিজেকে মুক্ত রাখতে গিয়ে হয়তো খুন করতে হবে মেয়েটাকে। ভাবনাটা আপত্তিকর বলে মনে হলো রানার।

‘আমরা এখন থেকে পার্টনার, ঠিক আছে?’ বলল জেসিকা।

‘তুমি তাই চাও?’

‘হ্যাঁ, সেটাই চাই। আমাকে ফেলে কিছুই করবে না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘আপাতত মেনে নিলাম।’

মিষ্টি হাসি দেখা দিল জেসিকার মুখে। ‘পার্টনার হিসেবে প্রথমে ওই লোকের উল্কির ব্যাপারে সব খুলে বলতে পারো।’

লক আরডাইকের বরফ ছাওয়া পথে এগিয়ে চলেছে রানা। মাথায় তুষারের ভারী ছাতি নিয়ে দু’পাশে পিছিয়ে পড়ছে সারি দেয়া পাইন গাছ। কথা গুছিয়ে নিয়ে বলতে লাগল রানা, ‘ডি আঁকা উল্কি খুব কম মানুষ ব্যবহার করে। নিজেদেরকে তারা বলে ‘ডিযঅনারেবল’। যদিও বেশিরভাগ মানুষ মনে করে এরা বাস্তবে নেই। এদেরকে নিয়ে বলা গল্পগুলো কাল্পনিক বলেই মনে করে।’

‘বাস্তবে থাকলে এরা আসলে কারা?’

‘এক্স-মিলিটারি,’ বলল রানা। ‘চরম অন্যায় করেছে বলে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে। একবার নিজের রেকর্ডে ডিডি স্ট্যাম্প লেগে গেলে রানির সামরিক বাহিনীতে চাকরির সুযোগ আর থাকে না।’

‘ডিডি,’ বলল জেসিকা। ‘ডিযঅনারেবল ডিসচার্জ?’

মাথা দোলাল রানা। ‘আর্মি, নেভি বা এয়ারফোর্স তাদের সদস্যদের জন্যে সেরা ট্রেইনিং, ইকুইপমেন্ট আর প্রচুর টাকা ব্যয় করে; কাজেই কেউ চায় না প্রশিক্ষিত সৈনিক বা অফিসার চাকরি থেকে বরখাস্ত হোক। তাই কঠোর সব শাস্তি দেয়া হয় অপরাধীকে শুধরে নেয়ার জন্যে। তবে কিছু পচা ডিমকে শেষে কোর্ট মার্শাল করতেই হয়। সেক্ষেত্রে পাছায় লাথি মেরে সামরিক বাহিনী থেকে বহু দূরে ছিটকে ফেলা হয় তাদেরকে। এই সিদ্ধান্তটাকে হালকা চোখে দেখা হয় না। ডিযঅনারেবল ডিসচার্জ যারা হয়, তাদের জীবন হয় নরকের মত। ভাল বেসামরিক চাকরিও ওরা আর কখনও পায় না। ডিযঅনারেবল ডিসচার্জ পাওয়া লোক পার্সোনাল সিকিউরিটি ইণ্ডাস্ট্রিতে ভাল করে না। বেশিরভাগ সময় অন্যদেশের মিলিটারিতে চাকরি নেয়। যেমন ফরেন লিজিয়ন। ধরে নেয়া হয় অসুস্থ মানসিকতার লোক ওখানে চাকরি করবে। অনেক সময় পেটের দায়ে এরা প্রাইভেট মিলিটারি কন্ট্রাক্টর বা মার্সেনারি হয়। নগদ টাকার জন্যে জড়ায় ড্রাগলর্ড বা ওঅরলর্ডদের নোংরা সব লড়াইয়ে। মৃত্যু হয় এদের খুব করুণভাবে। যারা ডিযঅনারেবল ডিসচার্জ হওয়ার পর কোথাও চাকরি খুঁজে পায় না, মদ খেয়ে বা মারামারি করে একসময় খুন হয়ে যায়। অবশ্য অন্য একটা পথ বেছে নিয়েছে একদল ডিযঅনারেবল ডিসচার্জ হওয়া এক্স- মিলিটারি।’

সামনে শক্ত বরফে ঢাকা পথ দেখে গাড়ির গতি কমাল রানা। ধূসর আকাশ ও দূরের বরফে ছাওয়া টিলার সঙ্গে মিতালি করেছে কুয়াশা। ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

‘আমি শুনছি, তুমি বলো,’ বলল জেসিকা।

‘একে অপরকে কীভাবে এরা খুঁজে নিল, বা কীভাবে দল তৈরি করল, কেউ জানে না,’ বলল রানা। ‘চাকরি থেকে অসম্মানের সঙ্গে দূর করে দেয়ার ব্যাপারটাকে মেনে নিয়ে এরা খুঁজে নিচ্ছে ভয়ঙ্কর সব চাকরি। একে অপরের বিরুদ্ধে লড়বে না বলে তৈরি করেছে নিজেদের ছোট একটা গ্রুপ।’

‘তুমি এসব জানলে কী করে?’

‘আর্মিতে শুনেছি। এরা এসেছে নানান রেজিমেন্ট থেকে। ড্রাগ্‌স্‌ বিক্রির দায়ে ফোর্স থেকে বের করে দেয়া হয়েছে কাউকে কাউকে। অন্যদের চাকরি গেছে যুদ্ধে বা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে বর্ণনাতীত হিংস্রতা দেখাবার জন্যে। চাকরি না থাকলেও নিজেদেরকে এরা মনে করে সম্মানিত। মূল কথা: এরা সত্যিই পচে যাওয়া একদল লোক।’

‘কী ধরনের কাজে যোগ দেয় এরা?’

‘টাকা পেলে আইন তোয়াক্কা না করে খুন, কিডন্যাপিং, ডাকাতি, ড্রাগ স্মাগলিং, হিউম্যান ট্রাফিকিঙের মত নোংরা সব কাজই করে। একবার দলে যোগ দিলে একজন ডিযঅনারেবলকে প্রমাণ করতে হয়, সে সত্যিই খারাপ। পরীক্ষায় পাশ না করলে কেউ যোগ দিতে পারে না ওই ভ্রাতৃসঙ্ঘে

‘কী ধরনের পরীক্ষা?’

‘সেটা তোমার না শোনাই বোধহয় ভাল।’

‘আমি শুনতে চাই,’ জেদ প্রকাশ পেল জেসিকার কণ্ঠে। ‘প্রথমে কোনও লোক, মহিলা বা শিশুকে হত্যা করতে বললে দ্বিধাহীনভাবে সেটা করতে হয়। নিরীহ মানুষটাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় গোপন পরিত্যক্ত কোনও বাড়ি বা ওয়্যারহাউসে। ওখানে সভা করে ভ্রাতৃসঙ্ঘ। নির্দেশমত সবার সামনে অসহায় মানুষটাকে প্রচণ্ড নির্যাতনের পর হত্যা করতে হয়। নতুন সদস্য বেশিরভাগ সময় খুনের কাজে ব্যবহার করে পিস্তল, ছোরা, হাতুড়ি, বেসবল-ব্যাট আর করাত। এ ছাড়া, খুন করা হয় শ্বাস আটকে, আগুনে পুড়িয়ে বা হাত-পা- গলা কেটে। তুমি কি আরও শুনতে চাও?’

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে জেসিকা। একহাতে চেপে ধরেছে মুখ। মাথা নাড়ল। ‘না, আর কিছু শুনতে চাই না।’

‘আগেই বলেছি, জানতে ভাল লাগবে না,’ বলল রানা। ‘ক্যামকর্ডারে ভিডিয়ো করা হয় প্রতিটি দৃশ্য। দলের কেউ বেইমানি করতে গেলে দল থেকে চাপ আসে— পুলিশের কাছে দেয়া হবে তার ভিডিয়ো। এই দল আসলে মাফিয়া সংগঠনের মতই ভয়ঙ্কর। পরীক্ষায় পাশ করলে উল্কি এঁকে নেয়ার পর ধরে নেয়া হয়, বাকি জীবনেও সে আর দল ত্যাগ করবে না।’

‘বেশি দিন হয়নি পুলিশে যোগ দিয়েছি,’ বলল জেসিকা। ‘আগে কখনও এমন ভয়ঙ্কর কিছু শুনিনি।’

‘বিশ্বে অশুভ মানুষের অভাব নেই,’ বলল রানা। ‘তুমি সৌভাগ্যবতী যে খারাপ কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। …আজ নিশ্চিত হলাম ডিযঅনারেবলরা সত্যিই আছে।’

‘মৃত লোকটা তা হলে তাদেরই একজন?’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘তা-ই তো মনে হচ্ছে। টপ ক্লাস রেজিমেন্টের চাকরি থেকে একসময়ে ছিটকে পড়েছে। তারপর টাকার জন্যে খুন করে বেড়াচ্ছিল সাধারণ মানুষকে।’

‘তার সঙ্গীও কি প্যারাশ্যুট রেজিমেন্টের লোক?’

‘হয়তো। গতরাতে লক আরডাইকের তীরে আমাকে পোচার ভেবে খুন করতে চেয়েছে এক স্নাইপার। হয়তো এদের দু’জনের ভেতর একজন সে। বা তাদের দলের অন্য কেউ। মনে হচ্ছে, চরম কোনও অন্যায় করতে গিয়ে একদল ডিযঅনারেবলকে ভাড়া করেছে পয়সাওয়ালা কেউ।’

রানার দিকে তাকাল জেসিকা। ‘আগে তো বলোনি লকের তীরে তোমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে!

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘আমার কপাল ভাল ছিল। তবে এরপর হয়তো ভাগ্য এত ভাল না-ও থাকতে পারে। যে- লোক পালিয়ে গেল, ফিরে নিশ্চয়ই রিপোর্ট দেবে: টয়োটা গাড়িতে চেপে হাজির হয়েছিল এক লোক। তার সঙ্গে ছিল এক মেয়ে। কাজেই ধরে নাও, এবার হন্যে হয়ে আমাদেরকে খুন করতে চাইবে ডিযঅনারেবলরা। আমার ধারণা: নানান প্রশ্ন তুলেছে বলে বেনকে খুঁজছে এরা এবং সেজন্যে প্রচুর টাকাও পাচ্ছে।’

‘হয়তো ভাবছ বেন হ্যাননকে ধরে নিয়ে গেছে তারা, তাই না, রানা?’ নরম সুরে বলল জেসিকা।

কোনও জবাব দিল না রানা।

নীরবতা নামল গাড়ির ভেতর। ভাবনার সাগরে ডুব দিল জেসিকা। তবে বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, ‘ঠিক আছে, ধরে নিলাম তোমার কথাই ঠিক। সেক্ষেত্রে আমরা এটা জানি, এদিকের এলাকায় অস্বাভাবিক কিছু করছে একদল লোক। কেউ না কেউ ভাড়া করেছে এসব খুনিকে। আর সেটা করেছে দামি কিছু পাওয়ার জন্যে। যেমন রবার্টের খুঁজে পাওয়া সেই সোনার কয়েনের গুপ্তধন। তবে এরা কারা, বা কাদের হয়ে কাজ করছে, এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই।’

একই কথা ভাবছে রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘আমরা প্রায় কিছুই না জানলেও একজন হয়তো জরুরি তথ্য দিতে পারবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *