1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ২৩

তেইশ

স্যামন-পোচার বিলি ম্যাকগ্রার সঙ্গে কথা শেষ করে এইমাত্র জঙ্গলে ক্যাম্পার ভ্যানের কাছে ফিরেছে বেন হ্যানন। গাড়িতে উঠে গা থেকে খুলে ফেলল ঘিলি সুট। দেরি না করে গ্যাস স্টোভ জ্বেলে উষ্ণ করতে লাগল হিম-ঠাণ্ডা শরীর। ম্যাকগ্রার কথা শুনে মাথায় রাগ উঠে গেছে তার। বুকের বামদিকে শুরু হয়েছে চিনচিনে ব্যথা। ওষুধের শিশি থেকে বড়ি বের করে পানি দিয়ে গিলে নিল ওটা। এই ধরনের দুর্বলতা মেনে নেয়া তার জন্যে খুব কঠিন। ক’মাস আগেও ছিল পুরোপুরি সুস্থ। অথচ এখন ওষুধ ছাড়া বাঁচার উপায় নেই!

ধীরে ধীরে কমছে ব্যথা। বার্থে শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে বেন ভাবল, একটু বিশ্রাম নিয়ে সূর্য ওঠার আগেই পৌঁছে যাবে ফোর্ট উইলিয়ামে।

.

সারারাতের তুষারপাতে সাদা হয়েছে নির্জন আঁকাবাঁকা জঙ্গুলে পথ। ভোরের আগেই সতর্কভাবে ড্রাইভ করে এ৯২ মহাসড়কে পৌঁছে গেল বেন। রাতে লবণ ছিটিয়ে দিয়ে গেছে গ্রিটার ট্রাক। শীতার্ত পাইন অরণ্যের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে বহু দূরে গেছে কালো ফিতার মত টারম্যাক।

সূর্যোদয়ের আগেই সকাল আটটায় ফোর্ট উইলিয়ামে পৌঁছে গেল বেন। একবার ভাবল ভাতিজাকে দেখতে হাসপাতালে যাবে কি না, তারপর মাথা নাড়ল আনমনে। জেসিকার সঙ্গে আগে গেছে বলে মনে আছে, কোথায় পুলিশ স্টেশন। দশমিনিট গাড়ি চালিয়ে ওখানে পৌছে গেল সে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও এরই ভেতর পুলিশ স্টেশনের পার্কিং লটে এসেছে কয়েকটা গাড়ি। ডিউটিতে যোগ দিচ্ছে কেউ কেউ। ওর আসতে দেরি হয়ে গেল কি না ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়ল বেন।

শহরের একধারে ঝোপঝাড়ভরা এলাকায় ফোর্ট উইলিয়াম পুলিশ স্টেশন। ওটা গ্রাম্য থানা হলে দূর থেকে চোখ রাখত বেন। তবে চারপাশ দেখে বুঝে গেল, সে-উপায় নেই। থানার মেইন গেট পেরিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ল ভিজিটরদের পার্কিং লটে। এমন জায়গায় ক্যাম্পার ভ্যান রাখল, যেখান থেকে পরিষ্কার দেখবে দালানের সদর দরজা ও থানার মেইন গেট।

এখন কেউ এসে ‘এখানে কী করছেন’ জানতে চাইলে বেন বলবে: তার ভাতিজা হাসপাতালে আছে, তাই এসেছে ইন্সপেক্টর মুরে আর সার্জেন্ট রিডের সঙ্গে কথা বলতে। অবশ্য ভীষণ তিক্ত হয়ে আছে তার মন। কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে রীতিমত বিরক্তিই লাগবে।

সার্ভেইল্যান্সের জন্যে উপযুক্ত গাড়ি ক্যাম্পার ভ্যান। পেছনের সেটি ভাঁজ করলে পাশের জানালার লেসের পর্দার আড়াল থেকে পরিষ্কার দেখা যায় বাইরেটা। ক্রসবোর স্কোপ খুলে সোফার কুশনে বসে ষাট গজ দূরে থানার গেটে চোখ রাখল বেন। নব ঘুরিয়ে বাড়িয়ে নিল স্কোপের ম্যাগনিফিকেশন। কেউ গাড়ি নিয়ে থানায় ঢুকলে কাছ থেকে দেখতে পারে তার মুখ।

মিনিটতিনেক পর গেট পেরিয়ে স্টাফ পার্কিং লটে ঢুকল রুপালি এক ফোর্ড সেডান। এরপর এল সবুজ একটা কিয়া গাড়ি। দুই ড্রাইভারের একজন ত্রিশবছর বয়সী যুবক, অন্যজন সোনালি চুলের মধ্যবয়স্কা মহিলা। তারা গাড়ি থেকে নেমে যেতেই স্কোপের ক্রসহেয়ারে ধরা পড়ল তাদের মুখ। দু’জনের কাউকেই চেনে না বেন।

বুকে চিনচিনে ব্যথা ওকে মনে করিয়ে দিল, স্ত্রী মিরাণ্ডাকে ফোন দেয়া জরুরি। কে জানে, কতটা ভয় আর দুশ্চিন্তা মনে নিয়ে অপেক্ষা করছে বেচারি! ও ভাল আছে সেটা মিরাণ্ডাকে জানাতে হবে। ম্যাকগ্রার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করল বেন। মনোযোগ দিয়ে যন্ত্রটা দেখলেও মনস্থির করতে পারল না স্ত্রীকে কল দেবে কি না। আসলে ওর গলা শুনলেই আকুল হয়ে কাঁদবে মিরাণ্ডা। অনুরোধ করবে ইতালিতে ফিরে যেতে। তখন খুব কঠিন হবে দায়িত্ব পালন করা।

ক’মুহূর্ত দ্বিধা করে বেলফোর্ড হাসপাতালে কল দিল বেন। রিসেপশন ডেস্ক থেকে ফোন ধরল এক ক্লার্ক। বেনের প্রশ্নের জবাবে বলল, হাসপাতালেই আছেন ডাক্তার লরেন। মিনিটতিনেক পর ফোন ধরতে পারবেন।

ফোন কানে অপেক্ষায় থাকল বেন। তারই মাঝে দেখল পুলিশ স্টেশনে ঢুকল আরও কয়েকটা গাড়ি। প্রথমটা হলদে ফোক্সভাগেন বিটল। দ্বিতীয়টা বাদামি ল্যাণ্ড রোভার। তৃতীয় গাড়িটা, বেগুনি সুযুকি হ্যাচব্যাক। তিন গাড়ির ড্রাইভারের দু’জন মহিলা। অন্যজন পুরুষ। এদের চেহারা বেনের কাছে অচেনা।

আরও কয়েক মুহূর্ত পর লাইনে এলেন ডাক্তার লরেন। তাঁর গলার ব্যস্ততায় বেনের মনে হলো, হাসপাতালে পৌঁছেই

দশ ধরনের কাজে জড়িয়ে গেছেন মহিলা। নিজের পরিচয় জানিয়ে বেন জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন আছে পিটার। দুঃসংবাদের জন্যে তৈরি। অবশ্য ডাক্তার জানালেন, রোগীর শারীরিক উন্নতি যেমন নেই, তেমনি অবনতিও হয়নি। কথাগুলো শুনে আরও তিক্ত হলো বেনের মন। ডাক্তার লরেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘এই নম্বরে আমাকে পাবেন। পিটারের ভাল বা মন্দ, যা-ই হোক, আপনি যোগাযোগ করে জানিয়ে দিলে চিরদিনের জন্যে কৃতজ্ঞ থাকব।’

ডাক্তার লরেন কথা দিলেন, পিটারের বিষয়ে ফোনে বেনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন তিনি।

ফোন রেখে আবারও স্কোপের ভেতর দিয়ে মেইন গেটের দিকে চেয়ে রইল বেন। আটটা আটচল্লিশ মিনিটে পুবের টিলার আড়াল থেকে উঁকি দিল লালচে সূর্য। তারও দুই মিনিট পর গেট পেরিয়ে ঢুকল কালো রঙের দামি এক জাগুয়ার লাকযারি এস্টেট গাড়ি। ওটা গিয়ে থামল দালানের সদর দরজার সামনে। খুলে গেল ড্রাইভিং ডোর। জাগুয়ার থেকে বেরিয়ে এল এক লোক, হাতে ব্রিফকেস আর রেইন কোট। তাকে দেখে বুকে চিনচিনে ব্যথা বাড়ল বেনের। তীব্র রাগে থরথর করে কাঁপছে দেহ। পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে গেছে এক নম্বর টার্গেট: ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জন মুরে। সে ঢুকে পড়ল দালানের ভেতর। তার আগেই ভাল করে তার চেহারা দেখে নিয়েছে বেন। রাতে গভীরভাবে ঘুমাতে পেরেছে বলে ফুলে আছে লোকটার মুখ। পলকের জন্যে বেনের ইচ্ছে হলো, স্কোপটা ক্রসবোতে লাগিয়ে স্লটে তীর জুড়ে ফুটো করে দেবে হারামজাদার পিঠ। তবে ওটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, তাই নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। লোকটা থানায় ঢুকে যাওয়ায় তার গাড়ি কী মডেলের এবং নম্বর প্লেটে কী লেখা, মনে গেঁথে নিল বেন। ঝুঁকি নেবে না বলে প্যাডে গাড়ির নম্বর খসখস করে টুকে নিচ্ছে, এমনসময় এল লাল টয়োটা করোলা গাড়ি। ওটা থামল কালো জাগুয়ারের পেছনে। চোখে স্কোপ ঠেকিয়ে বেন দেখল, গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে ডানকান রিড। সে থানায় ঢোকার পর তার গাড়ির নম্বর প্লেটের তথ্যও প্যাডে লিখল বেন।

সকাল নয়টায় জেগে উঠল পুলিশ স্টেশন। আসতে- যেতে লাগল স্টাফ-কার। মাঝে মাঝে ভিজিটর্স পার্কিং লটে এল সাধারণ মানুষের ভেহিকেল। স্টোভে কালো কড়া কফি তৈরি করে মগে চুমুক দিতে দিতে দালানের ওপর চোখ রাখল বেন। দুই টার্গেট বেরিয়ে এলে পিছু নেবে। ধীরে ধীরে পার হতে লাগল সময়। ভিজিটরদের কার পার্কিঙে ক্যাম্পার ভ্যান দেখেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে এল না কেউ।

কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, জানা নেই। তবে ভ্যানে আছে যথেষ্ট খাবার ও পানি। ভেতরটা উষ্ণ করে রেখেছে স্টোভ। দরকারে ব্যবহার করবে ছোট্ট টয়লেট। প্রয়োজনে চুপচাপ পার করে দেবে পুরোটা দিন।

অবশ্য টার্গেট দু’জনকে আবারও দেখতে পেল বেন তিনঘণ্টা পর। একইসঙ্গে দালান থেকে বেরোল ইন্সপেক্টর মুরে আর সার্জেন্ট রিড। কোটের ওপর পরেছে রেইন কোট। আরও ফুলে গেছে মুরের মুখ। কী নিয়ে যেন আলাপ করছে তারা। আধমিনিট দাঁড়িয়ে থাকল গাড়ির সামনে। বরফ-ঠাণ্ডা হু-হু হাওয়া এলোমেলো করে দিল তাদের মাথার চুল। তারা কোথায় যাবে কে জানে, ভাবল বেন। দুই সিটের মাঝের সরু জায়গা পেরিয়ে বসে পড়ল ড্রাইভিং সিটে।

একমিনিট পেরোবার আগেই রওনা হলো জাগুয়ার। ওটাকে অনুসরণ করল লাল টয়োটা। গাড়িদুটো পুলিশ স্টেশন থেকে বেরোতেই ভিজিটরদের পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে এল ক্যাম্পার ভ্যান। মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান রেখে পিছু নিচ্ছে বেন।

বামে বাইপাসের রাউণ্ডঅ্যাবাউট লক্ষ্য করে চলল কালো জাগুয়ার। উল্টোদিকে গেল লাল করোলা। এবার কার পিছু নেবে ভাবতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ল বেন। কয়েক সেকেণ্ড পর মনস্থির করল, অনুসরণ করবে জন মুরের জাগুয়ারটাকে।

ধীর বেগে চলেছে ক্যাম্পার ভ্যান। ওটাকে পাশ কাটিয়ে গেল কয়েকটা গাড়ি। দূর থেকে জাগুয়ারের পিছু নিচ্ছে বেন। বাইপাসের ধারে উঁচু করে রাখা হয়েছে ঝুরঝুরে বরফ। ফোর্ট উইলিয়াম পাশ কাটিয়ে কয়েক মাইল যেতেই সামনে পড়ল আবাসিক এলাকা। পথের দু’পাশে সাদা ছাতের আধুনিক বাড়িগুলো যেন একে অপরের ক্লোন। জন মুরে আর বেনের মাঝের গাড়িগুলো চলে গেছে যে-যার গন্তব্যে। ব্যবধান আরও বাড়িয়ে জাগুয়ারের পিছু পিছু চলল বেন। ভয় পাচ্ছে, বেশি পিছিয়ে থাকলে সরু কোনও পথে হয়তো ঢুকে পড়বে কালো গাড়িটা। সেক্ষেত্রে ওটাকে আর খুঁজে পাবে না সে। কিছুক্ষণ পর সাদা বড় এক বাড়ির ড্রাইভওয়েতে গিয়ে ঢুকল মুরের গাড়ি। বাংলোর মত ভবনের চারপাশে চমৎকার করে সাজানো ফুলের বাগান। ড্রাইভওয়ের ওদিকে বন্ধ দুটো গ্যারাজ। আশি গজ দূরে পথের মোড়ে ভ্যান রেখে ইঞ্জিন বন্ধ করল বেন। গিয়ে ঢুকল পেছনের কম্পার্টমেন্টে। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখল, গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে গিয়ে ঢুকল জন মুরে।

বোধহয় লাঞ্চের জন্যে ফিরেছে ইন্সপেক্টর, ভাবল বেন। সেক্ষেত্রে হয়তো অপেক্ষা করতে হবে বহুক্ষণ। তার চেয়ে ভাল হয় বাড়িতে ঢুকে পড়া। মুরে একা থাকলে ভাল। আর তার সঙ্গে অন্য কেউ থাকলে তাকেও বন্দি করবে সে। মুরের স্বীকারোক্তি নেয়ার পর ফোনে ডাকবে রিডকে। জোর করে তার কাছ থেকেও আদায় করবে জবানবন্দি।

কিন্তু এরপর কী?

না, কিছুই ভাবতে পারছে না বেন। তার মন বলছে: জানোয়ারগুলোকে জঙ্গলে নিয়ে গলা কেটে কবর দেয়াই উচিত। ক্রসবোর স্লটে স্কোপ আটকে তূণ থেকে হান্টিং তীর নিয়ে অস্ত্রটা কক করল সে। সেফটি ক্যাচ অন করে ক্রসবো রেখে দিল ব্যাগে। ভ্যান থেকে নেমে পড়বে, এমনসময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল জন মুরে। উঠে পড়ল জাগুয়ার গাড়িতে। কথা বলছে মোবাইল ফোনে। ইঞ্জিন চালু করে পিছিয়ে এসে পথে পড়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল। তীরবেগে চলেছে। বেনের মনে হলো তাড়া আছে লোকটার। আবারও কালো গাড়ির পিছু নিল প্রাক্তন এসএএস যোদ্ধা।

একটু পর পেছনে পড়ল শহর। দু’পাশে তুষার ছাওয়া জঙ্গল। পুরনো ক্যাম্পার ভ্যান নিয়ে জাগুয়ারের কয়েক শ’ গজ পেছনে লেগে থাকল বেন। আশা করছে রিয়ারভিউ মিররে ভ্যানটাকে দেখলেও সতর্ক হবে না জন মুরে।

দেখতে না দেখতে পেছনে পড়ল দশ মাইল পথ। চারপাশে এখন বাড়িঘর বা দোকানপাট নেই। একটু পর আঁকাবাঁকা, সরু এক কাঁচা পথে পড়ল জাগুয়ার। কয়েক শ’ গজ যাওয়ার পর ঢুকল মরচে ধরা তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা বড় এক এলাকায়। চওড়া গেটের ওদিকে জংলা ঝোপের রাজ্য। জাগুয়ারটা চোখের সামনে থেকে বিদায় নেয়ায় আবারও এগোল বেন। একটু পর দেড় শ’ গজ দূরে ঢালু জমিতে দেখল থেমে গেছে কালো গাড়ি। ওটার পাশেই বাজপড়া মরা বড় একটা গাছ। সামান্য দূরে ধূসর পাথরের ছাত ধসে পড়া পুরনো এক চ্যাপেল।

বড় একটা কাঁটাঝাড়ের পেছনে ভ্যান রেখে নেমে পড়ল বেন। একহাতে কক করা ক্রসবো। অন্যহাতে ক্ষুরধার কে- বার ছোরা। কোমরের বেল্টে আটকানো তৃণে রয়েছে ক’টা তীর। খেলা জায়গায় ঝিরঝির করে বইছে কনকনে হাওয়া। বেনের নাকের দুই ফুটো দিয়ে ভুসভুস করে বেরোচ্ছে যেন রেল ইঞ্জিনের বাষ্প। প্রাক্তন যোদ্ধা আঁচ করতে চাইছে, কেন ওকে পরিত্যক্ত এই জায়গায় নিয়ে এল মুরে। তবে এসবের ভাল দিক হচ্ছে, লোকটা খুন হলেও কোনও সাক্ষী থাকবে না।

চারপাশের জমি দেখে নিয়ে ঝোপের মাঝ দিয়ে এগোল বেন। সামনেই তুষারে ছাওয়া ছোট ঢিবি পেরোলে ধসে যাওয়া সেই চ্যাপেলের পেছনদিক। বেনের ধারণা: ওখানেই আছে জন মুরে। আশা করা যায় নিঃশব্দে গিয়ে তাকে বন্দি করতে সমস্যা হবে না।

তারকাঁটার বেড়া টপকে ঢিবি বেয়ে উঠল বেন। দুই পা ডেবে যাচ্ছে গভীর নরম তুষারে। ঢিবির ওদিকে নিচু জমি। ঝোপ থেকে বেন দেখল, চ্যাপেলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জাগুয়ার। অন্যদিক থেকে এসেছে বলে বেন দেখতে পেল, ওই গাড়ির কয়েক গজ দূরে পার্ক করা হয়েছে রুপালি রঙের বড়সড়ো এক রোলস রয়েস। সে বুঝে গেল, পয়সাওয়ালা কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নির্জন এই এলাকা বেছে নিয়েছে মুরে।

এবার হয়তো বহু কিছুই জানব, ভাবতে ভাবতে ঢিবি বেয়ে নেমে ছাতহীন চ্যাপেলের পেছনে পৌঁছে গেল বেন। ভেতর থেকে এল গলার আওয়াজ। তবে কথাগুলো বড়বেশি অস্পষ্ট। খুব সাবধানে গিয়ে কবাটহীন জীর্ণ জানালা দিয়ে উঁকি দিল বেন। ধনুকের মত বাঁকা এক খিলানের নিচে আছে মুরে। তার সামনে যে-লোক দাঁড়ানো, তাকে আগে কখনও দেখেনি বেন। তার বয়স হবে পঞ্চাশ। পরনে দামি সুট। কাঁধে কাশ্মীরী শাল। ব্যাকব্রাশ করা চুল রোলস রয়েস গাড়ির মতই রুপালি।

কে এই লোক, কৌতূহলী হয়ে উঠল বেন।

কিছু জানতে হলে ঢুকতে হবে চ্যাপেলে। বাড়ির কোনা ঘুরে ছাত ধসে পড়া ঘরে নিঃশব্দে পা রাখল বেন। মুরে আর অচেনা লোকটার দিকে তাক করেছে হাতের ক্রসবো।

তৃতীয় কারও উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকাল তারা। বেনকে দেখেই বিটের মত লালচে হলো মুরের চেহারা। কড়া গলায় বলল সে, ‘তুমি এখানে কী চাও, বেন হ্যানন?’

মুরে আর লোকটার মাঝে ক্রসবো তাক করে ধরে সেফটি অফ করল বেন। বুঝে গেছে, রাগ দেখালেও বিস্মিত নয় পুলিশ অফিসার। অস্ত্র তাক করে দুই পা এগোল বেন।

‘বিরাট ভুল করছ, বেন হ্যানন,’ বলল জন মুরে।

আরেক পা এগোল প্রাক্তন যোদ্ধা। মৃদু মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ভুলটা তোমাদের, মুরে। রিড আর তোমার উচিত হয়নি আমার ভাতিজাকে ওভাবে আহত করা।’

‘তুমি কি পাগল হলে?’ বিরক্তির সঙ্গে বলল মুরে।

‘ফালতু কথা বাদ দাও,’ ধমক মারল বেন। ঝটকা দিয়ে ক্রসবো তাক করল মধ্যবয়স্কর বুকে। ‘তুমি কে?’

স্কটিশ উচ্চারণে কথা বলল অভিজাত লোকটা, ‘মিস্টার হ্যানন, আসুন আলাপের মাধ্যমে বিরোধ মিটিয়ে নিই। আগে অবশ্য আপনার উচিত অস্ত্রটা নামিয়ে রাখা।’

‘হাঁটু গেড়ে বসো,’ জবাবে দাঁতে দাঁত চেপে বলল বেন।

কথাগুলো শুনলেও নড়ল না মুরে বা লোকটা।

‘বাজে আচরণ করলে পরে কিন্তু পস্তাতে হবে, হ্যানন,’ সতর্ক করল মুরের সঙ্গী।

তখনই উড়ে এসে বেনের বুকে বসল লাল একটা পোকা। পরক্ষণে সে বুঝে গেল, ওটা দক্ষ কোনও মার্কস- ম্যানের লেযার সাইটের জ্বলজ্বলে লাল বিন্দু! নড়ছে না!

তাকে ফাঁদে ফেলতেই বেছে নেয়া হয়েছে এই জায়গা! ‘নিশ্চয়ই বুঝেছ তোমার কিছুই করার নেই?’ বলল মধ্যবয়স্ক। ‘তিনসেকেণ্ড সময় পাবে, অস্ত্র নামিয়ে রাখো। নইলে হাই-পাওয়ার রাইফেলের গুলিতে তোমার হৃৎপিণ্ড ফুটো করবে আমার সিকিউরিটি চিফ।’

বয়স হলেও সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত বেন হ্যানন। মুহূর্তে একপাশে ডাইভ দিল সে। আগে যেখানে ছিল, তার ক’ফুট দূরের মেঝেতে বিধল বুলেট। ধনুকের মত বাঁকা খিলানের আড়ালে সরে গেছে জন মুরে ও মধ্যবয়স্ক লোকটা। সাইলেন্সড্ রাইফেলের গুলির ‘খুক্’ শব্দে হৃৎপিণ্ডে যেন রক্ত জমাট বেঁধেছে বেনের। গড়ান দিয়ে উঠে ছুটে গেল একটু দূরের মরা গাছটার ওদিকে। কিন্তু ভাগ্যদেবী আজ বিরূপ। চোখের কোণে বেন দেখল, ঝোপের মাঝ দিয়ে আসছে চারজন লোক। হাতে উদ্যত পিস্তল।

এটা মৃত্যু-ফাঁদ, বুঝে নিল বেন। আর তখনই বুকের ভেতর শুরু হলো অস্থির করে দেয়া সেই পুরনো ব্যথাটা।

খুব কাছে পৌঁছে গেছে আততায়ীরা। তাদের একজন বলে উঠল, ‘আত্মসমর্পণ করো, হ্যানন! নইলে বেঘোরে মরবে!’

কপাল বেয়ে নেমে ক’ফোঁটা ঘাম ঢুকল বেনের চোখে। বুকের তীব্র ব্যথা যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে পাঁজরের হাড়। অবশ হয়ে গেছে বুক ও কোমর। ঘোলাটে চোখ বারবার পিটপিট করেও পরিষ্কার করতে পারল না দৃষ্টি। যেন এক ফুৎকারে ফুরিয়ে গেছে তার সব শক্তি। হতাশ হয়ে মুখ তুলে ধূসর আকাশটার দিকে চাইল বেন। আর তখনই সাঁই করে উঠে এল জমি। কয়েক মুহূর্ত পর অবাক হয়ে বেন বুঝল, কখন যেন পড়ে গেছে ও। পিঠের নিচে বরফে ছাওয়া শক্ত মাটি। ওকে ঘিরে ধরল চারজন সশস্ত্র লোক। তাদের বিশ্রী হাসি শুনে কেন যেন দুনিয়াটাকে ভীষণ নিষ্ঠুর বলে মনে হলো ওর। কে যেন এক ঝটকায় কেড়ে নিল হাত থেকে ক্রসবো, তারপর ছোরাটা। পকেট থেকে বের করে নেয়া হলো পোচার ম্যাকগ্রার ফোনটা।

চোখের সামনে ঝুপ করে কালো পর্দা নামার আগে বেন ভাবল: উচিত ছিল মিরাণ্ডাকে ফোন দেয়া!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *