1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৪৩

তেতাল্লিশ

ঘরে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল বিলিয়নেয়ার রন স্টুয়ার্ট। রানা বুঝল, ভাব নিচ্ছে ব্যাটা-দরজার জোরালো টোকা তার কানে না যাওয়ার কোনও কারণই নেই। পরনে সিল্কের সাদা শার্টের ওপর দামি টুইডের সুট। পায়ে কমোডো ড্রাগনের চামড়ার আরামদায়ক লোফার। জানালা পথে আসা আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে মাথার চকচকে রুপালি চুল। বোর্ডরুমে দুর্দান্ত লড়াই শেষে বিজয়ী হলে, বা করপোরেট প্রতিযোগীকে হারিয়ে দিলে যে সন্তুষ্টি থাকে ব্যবসায়ীর মুখে, এ মুহূর্তে তার মুখে সেই আত্মবিশ্বাসী মিটিমিটি হাসি।

‘তো তুমিই মাসুদ রানা? খুশি হলাম যে এসেছ। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’

রানার পর ঘরে ঢুকেছে বাক ওয়াকি ও ম্যাকগ্রার খুনি। করিডোরে রয়ে গেছে তৃতীয় লোকটা। পেছনে দরজাটা আটকে দিল বাক ওয়াকি। সঙ্গীকে নিয়ে দরজার দু’পাশে দাঁড়িয়ে গেল। হাতে পিস্তল। সতর্ক চোখে দেখছে রানাকে। ভাবছে, যে-কোনও সময়ে বিলিয়নেয়ারের ওপর খালিহাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে যুবক। নিজেও অন্তত তিনবার একই কথা ভেবেছে রানা, তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টে নিয়েছে। কথা বলল ঠাণ্ডা গলায়, ‘জেসিকা কোথায়?’

বাতাসে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নাড়ল স্টুয়ার্ট। ‘কাছেই কোথাও আছে। তবে চাইলেও তাকে খুঁজে পাবে না। ওয়াকির লোক লিয়ন বেনেট এখন তাকে পাহারা দিচ্ছে। তার হাতে আছে ধারাল ছোরা। কারও বুকে বা পেটে ওটা গেঁথে দিতে পারলে মজা পায়। অবশ্য দুশ্চিন্তা কোরো না। আপাতত নিরাপদেই আছে মহিলা। তবে কতক্ষণ নিরাপদে থাকবে, তা নির্ভর করছে তোমার ওপর। কাজেই বলে ফেলো কোথায় আছে সোনার কয়েন।’

‘জেসিকা ভাল না থাকলে তোমার পরিণতি হবে খুব করুণ,’ বলল রানা।

‘তুমি বরং নিজের পরিণতি নিয়ে ভাবো, বাপু,’ হালকা সুরে বলল রন স্টুয়ার্ট।

‘নিজের মহাবিপদ ডেকে এনেছ,’ বলল রানা। ‘মানুষ তার ইচ্ছেপূরণ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। আমিও তার বাইরে নই। কেউ বলবে না অনর্থক জীবন কাটিয়েছি। কিন্তু, তুমি যা চেয়েছ, তা তো পাবেই না, মরবে বেঘোরে।’

‘আমি ব্যবসায়ী,’ জবাবে বলল স্টুয়ার্ট। ‘ভাল করেই জানি কীভাবে সফল হতে হয়। তোমার মত মাথা গরম করে ভুল করি না। মনে রেখো, তুমি কিন্তু ভাল অবস্থানে নেই।’

‘বেন হ্যানন কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

‘হঠাৎ তার ভালমন্দে তুমি এত উদ্‌গ্রীব কেন?’ বিজয়ীর হাসি হাসল স্টুয়ার্ট। ‘তুমি আমাকে ধোঁকা দিতে পারোনি। জানতাম সে তোমার প্রিয় কেউ। চাতুরির বইয়ের প্রতিটি কৌশল আমার জানা। আমিই তৈরি করেছি ওগুলো।’

‘তার মানে সে বেঁচে আছে।’

এখনও। তাকে বাঁচাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে আমার লোক। আসলে, মিস্টার রানা, আমার দুনিয়ায় আছে মাত্র দুই ধরনের লোক। একদল তারা, যারা আমার কাজে আসবে। আর দ্বিতীয় দলের দরকার নেই বেঁচে থাকার। এখন যখন তোমাকে হাতের মুঠোয় পেয়েছি, তাই লাগছে না বুড়ো লোকটাকে। এবার তোমার বন্ধুকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেব। তার ভবিষ্যৎ এখন নির্ধারিত।’

‘একই কথা তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য,’ বলল রানা। ‘বেন হ্যাননের ক্ষতি হলে সোনার কয়েনের হদিস পাবে না।’

‘সে বাঁচল না মরল, তাতে আমার কিছু না। আমি শুধু চাই আমার পূর্বপুরুষের হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধন ফিরে পেতে।’

আমার পূর্বপুরুষের হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধন কথাটা বলতে গিয়ে চকচক করে উঠেছে স্টুয়ার্টের চোখ, দেখেছে রানা। চট্ করে বুঝে গেছে, লোকটা ভয়ঙ্কর এক ম্যানিয়াক। ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করবে নগ্ন লোভের কারণে।

‘একটা প্রশ্ন, স্টুয়ার্ট,’ সহজ সুরে বলল রানা, ‘জীবনে এত কিছু পেয়েও কয়েকটা কয়েনের জন্যে এতবড় ঝুঁকি নিচ্ছ কেন?’

তিক্ত হাসল স্টুয়ার্ট। ‘তোমার সেই কিছু কয়েন আমার জন্যে খুব জরুরি। নিজ বংশের সম্পদ। সতেরো শ’ ছেচল্লিশ সালে ফ্রান্সের রাজা পাঠান বনি প্রিন্সের কাছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে খরচ করার জন্যে।’

‘ও, তুমি এখন ইতিহাসবিদ,’ শুকনো গলায় বলল রানা।

‘আমি বনি প্রিন্স চার্লির একমাত্র উত্তরপুরুষ। ফ্রান্সের রাজা সাত সিন্দুকভরা সোনার কয়েন স্কটিশ সেনাবাহিনীকে দিলেও তা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল সাগর থেকে বারো মাইল দূরে প্রাচীন এক পাইন জঙ্গলে। এরপর আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এখন জানি তা কোথায় আছে। বর্তমান বিক্রয়মূল্য বড়জোর দশ মিলিয়ন পাউণ্ড। অবশ্য তুমি নিজে ভাল করেই জানো দামটা।’

রানা ভাবছে, উন্মাদটা কথা বলুক। তার বক্তব্য থেকে হয়তো বেরোতে পারে মুক্তির উপায়।

উত্তেজিত হয়ে পায়চারি শুরু করল স্টুয়ার্ট। আবেগ কাজ করছে তার মগজে। বলতে লাগল, ‘এ অবিশ্বাস্য! বছরের পর বছর অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে এদিকের এলাকার মাইলের পর মাইল জায়গা সার্চ করিয়েছি। কয়েকবার খোঁজা হয়েছে ক্লুনি’স কেভ। বলা হয় ইংরেজদের কাছে কুলোডেন যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর ওখানেই লুকিয়ে ছিলেন বনি প্রিন্স। ভেবেছিলাম ওদিকেই কোনও

ওদিকেই কোনও গুহায় সোনার কয়েন রেখেছেন। কিন্তু তেমন কোনও গুহার হদিস পাইনি। অবশ্য সেজন্যে হাল ছেড়ে দিইনি। এরপর ইতিহাসবিদদের কাজে নিলাম, যাতে তারা পুরনো চিঠিপত্র ঘেঁটে দেখে। তবে সেসব থেকেও কিছুই জানা গেল না।’

‘আমরা পেয়েছি স্রেফ কপালের জোরে,’ বলল রানা।

‘কয়েনের জন্যে এক পয়সাও খরচ করব না,’ থমকে দাঁড়িয়ে রানাকে দেখল স্টুয়ার্ট। ‘প্রাণে বাঁচতে হলে ওগুলো আমাকে দিয়ে দিতে হবে তোমার।’

‘আমি তো ভেবেছিলাম দুই-চার মিলিয়ন পাউণ্ড তোমার কাছে কিছুই না।’

‘কথা ঠিক,’ বলল স্টুয়ার্ট। ‘তবে তোমাকে দেব কেন? কী কারণে? বুদ্ধিমানের মত মেনে নাও যে হেরে গেছ তুমি। বরাবরের মত জিতে গেছি আমি। এর আর এদিক-ওদিক হয় না।’

রানার মন চাইল বলে দিতে: দূর, ব্যাটা, আসলে আমিও কিছুই পাইনি। তুই পারলে খুঁজে বেড়া! নির্বিকার চেহারায় স্টুয়ার্টের দিকে চেয়ে রইল ও।

‘জীবনে আমি সবসময় জিতে এসেছি,’ বলল স্টুয়ার্ট।

‘ওই ছবি তা হলে বনি প্রিন্সের?’ ফায়ারপ্লেসের ওপরের চিত্র দেখাল রানা। আঠারো শতকের এক লোক নাক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় পাউডারভরা পরচুলা। শিরস্ত্রাণের ডান কাঁধে লাল কেপ। ওটা দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে ওই লোক মহান এক নেতা। ছবির লোকটার চেহারা একেবারেই রন স্টুয়ার্টের মত। বিশ বছর বয়স বেড়ে গেলে লোকটা হতো বিলিয়নেয়ারের যমজ ভাই। রানা বুঝে গেল, দক্ষ কোনও চিত্রকরকে দিয়ে নিজের ছবি আঁকিয়ে নিয়েছে বাটপার স্টুয়ার্ট।

পোর্ট্রেটের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল বিলিয়নেয়ার, যেন দেখছে কোনও দেবতাকে। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। ‘তাঁর নীল রক্ত বইছে আমার ধমনীতে।’

‘তা-ই?’ হাসল রানা। ‘তা হলে তো তুমিও স্কটিশ হিরো।’ জবাব দিতে স্টুয়ার্ট হাঁ মেলতেই বলল ও, ‘কিন্তু দুঃখের কথা, স্কটিশ হিরো আসলে এক ইতালিয়ান কাপুরুষ। দলের সবাইকে বিপদে ফেলে মহিলার পোশাক পরে পালিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। তোমার মতই বুদ্ধিমান ছিল। তবে তার গর্ব করার মত কিছুই ছিল না।’

চোখে আগুন নিয়ে রানাকে দেখল স্টুয়ার্ট। ‘বাজে কথা বলবে না! মূল কথা হচ্ছে, সেই সাত সিন্দুকভরা সোনার কয়েন আসলে তাঁরই। আর সেগুলো এখন আমি ফেরত চাই।’

‘আমার কথামত চললে ফেরত পাবে,’ বলল রানা। ‘বদলে যা চাইব, সেটা দেবে।’

‘তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছ,’ রাগে লাল হলো স্টুয়ার্টের দুই গাল। ‘কেউ আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে, দেরি করি না তাকে সরিয়ে দিতে।’

‘তাই?’ বলল রানা। ‘কিন্তু মনে তো হচ্ছে না যে কিছু করার আছে তোমার।

ওর দিকে তর্জনী তাক করল স্টুয়ার্ট। ‘সময় লাগবে না তোমার পেট থেকে সব জেনে নিতে।

‘চেষ্টা করে লাভ হবে না,’ বলল রানা।

‘তাই? সেটা নিজেই দেখে নেব।’ তুড়ি বাজাল স্টুয়ার্ট। দরজার দু’পাশ থেকে এল বাক ওয়াকি আর তার সঙ্গী। যে- কোনও সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে রানার ওপর।

‘মিস থমসনকে নিয়ে এসো,’ নির্দেশ দিল স্টুয়ার্ট। ‘দেখা যাক বান্ধবীর গলা ফাঁক হতে দেখলে এই লোক কী করে।’

‘কার্পেটটা কিন্তু সুন্দর, বস,’ বলল বাক ওয়াকি। ‘ওটা রক্তে ভিজে গেলে আপনার ভাল লাগবে?’ –

‘তা হলে গরম পোকার দিয়ে মেয়েটার চোখ তুলে নেব।’ ফায়ারপ্লেস দেখাল স্টুয়ার্ট। ‘তারপর তাকে ফেলব আগুনের ভেতর।’

‘তাতে তোমারই ক্ষতি,’ নিচু গলায় বলল রানা। কথাটা শুনে থমকে গেছে স্টুয়ার্ট। ‘কারণ গুপ্তধনের ব্যাপারে ওকে সবই খুলে বলেছি আমি,’ জানাল রানা। ‘আমি মুখ না খুললে জেসিকা হচ্ছে তোমার সেরা ইনশু্যরেন্স। তুমি ওটা হারাতে চাইবে না। আর সেজন্যেই ওই মেয়ের চুলের ডগাও স্পর্শ করবে না।’

বাক ওয়াকি আর তার সঙ্গী চেয়ে আছে স্টুয়ার্টের দিকে। চোখ সরু করে রানাকে দেখছে বিলিয়নেয়ার। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘তুমি মিথ্যা বলছ। আগেই আমাকে বলেছ, রবার্ট উইলসন ছাড়া তুমি একমাত্র মানুষ যে কি না জানে কোথায় আছে সোনার কয়েন।’

‘সেটা সকালের কথা,’ বলল রানা। ‘তবে সকাল তো বহু আগেই বিদায় নিয়েছে। গ্রামে ফেরার সময় জেসিকাকে সবই জানিয়েছি।’

‘কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?’ জানতে চাইল রাক ওয়াকি।

‘ডিযঅনারেবল নামের একদল পশুর ব্যাপারে খোঁজ নিতে অন্য শহরে,’ বলল রানা। ‘জানলাম আমি একা নই, আরও অনেকে তাদের ব্যাপারে জানে। সতর্ক হয়ে উঠেছে কর্তৃপক্ষ। যে-কোনও সময়ে এখানে হানা দেবে। সে-সময় শুধু তোমরা নও, গ্রেফতার হবে তোমাদের নির্বোধ বস্ত্ত।’

রানা জানে, বাক ওয়াকির মত লোককে কর্তৃপক্ষের ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। তবে রন স্টুয়ার্ট ঘাবড়ে যেতে পারে। ঘটলও তা-ই। ফ্যাকাসে হলো বিলিয়নেয়ারের মুখ। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কী যেন ভাবছে। কয়েক মুহূর্ত পর আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে, বুঝলাম। তবে তাতে কী? তুমি মুখ না খুললেও মেয়েটার মুখ খোলাতে পারব।’

‘নির্যাতনে সবসময় সঠিক তথ্য মেলে না,’ বলল রানা। ‘মেয়েটা হয়তো শকের মধ্যে চলে যাবে। বা, ভয়ে আবোলতাবোল বলবে। তাতে তোমার কোনও লাভ হবে না।

‘নির্যাতনের ব্যাপারে তুমি বহু কিছু জানো, তাই না?’ টিটকারির হাসি হাসল স্টুয়ার্ট।

‘আমাকে এ বিষয়ে ট্রেইনিং দেয়া হয়েছে,’ বলল রানা। ‘জানি কীভাবে যন্ত্রণা দিতে হয়। আমাকে ওই কাজের মাস্টার বলতে পারো। আর সঠিক সময়ে তোমার ওপরেও ওই ট্রেইনিং প্রয়োগ করব।

‘তাই নাকি? বড় করে শ্বাস নিল স্টুয়ার্ট। রেগে গেলেও তার চোখে দ্বিধা আর ভয় দেখল রানা। ‘ঠিক আছে। আপাতত তোমার সঙ্গে খেলছি। অন্যকিছুও করব। ওয়াকি, তুমি ডানজন থেকে নিয়ে এসো বুড়ো হারামজাদাকে। সে নাকি কিছুই জানে না। তো তাকে খুন করলেও ক্ষতি হবে না আমার।’

মুচকি হাসল বাক ওয়াকি। ‘এবার ঠিক লাইন পেয়েছেন, বস্। খুশি হব বুড়োকে খতম করতে পারলে।’ সঙ্গীকে বলল সে, ‘কোয়ার্ট, তুমি এখানে পাহারা দেবে। দেখবে কোনও ধরনের ঝামেলা যেন না করতে পারে এই লোক।’

ডানজনে যেতে হবে না বুঝে খুশি হয়ে মাথা দোলাল অ্যালান কোয়ার্ট। রানার উদ্দেশে বলল বাক ওয়াকি, ‘নিরস্ত্র কাউকে জবাই করতে হলে সেরা লোক কোয়ার্ট। কাজ শেষ হলে উধাও হতেও দেরি করে না।’

বাক ওয়াকি দরজার দিকে যেতেই কেল্টিক কার্পেটের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবল স্টুয়ার্ট। ‘একমিনিট, ওয়াকি। ভাবছি, ভাল হয় রানাকে ডানজনে নামিয়ে দিলে। ওটার মেঝে রক্তে ভরে গেলেও ক্ষতি নেই। তুমি দেখবে, যেন বুড়ো হারামজাদা মরার আগে কথা বলার সুযোগ না পায় রানার সঙ্গে।

‘ঠিক আছে,’ বলল বাক ওয়াকি। ‘আপনিও আমাদের সঙ্গে আসবেন নাকি, বস্?’

টুইডের কোটের কবজি গুটিয়ে সোনার হাতঘড়ি দেখল স্টুয়ার্ট। ‘না, এখন নয়। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে।’

‘লাঞ্চ এনজয় করুন, বস্। মেন্যুতে আজকে কী আছে?’

‘পোচ্ড় স্যামন,’ মৃদু হাসল রন স্টুয়ার্ট।

রানার দিকে পিস্তলের নল ঘোরাল বাক ওয়াকি। এত কাছে নেই যে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অস্ত্র কেড়ে নিতে পারবে রানা। অত্যন্ত সতর্ক লোক বাক ওয়াকি। নিচু গলায় বলল, ‘সামনে বাড়ো, চুতিয়ার বাচ্চা!’

‘পরে তোমার সঙ্গে কথা হবে,’ স্টুয়ার্টকে বলল রানা।

ওকে ঘর থেকে বের করে করিডোরে আনল বাক ওয়াকি আর কোয়ার্ট। দরজার কাছেই আছে তৃতীয় ডিযঅনারেবল। ‘তুমিও সঙ্গে এসো,’ গ্রেগরি বেলকে বলল বাক ওয়াকি।

‘কোথায় যাচ্ছি?’

‘নিচে। ওখানে মজা হবে।’

বন্দির কাছ থেকে দূরে থাকার ট্রেইনিং আছে তাদের। ভাল করেই জানে, সামান্য ভুল হলেও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে মাসুদ রানা। ফলাফল হবে খুব খারাপ। দুশ্চিন্তা করতে গিয়ে দরদর করে ঘামছে কোয়ার্ট আর বেল। মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে বাক ওয়াকি। তার কোনও বিকার নেই। ইচ্ছে করলে ডানজনের দিকে যাওয়ার পথে গড়িমসি করতে পারে রানা, তবে বেন হ্যাননের সঙ্গে দেখা হবে ভাবতে গিয়ে কোনও কৌশল করল না। জেসিকার জন্যেও আছে দুশ্চিন্তায়। দুর্গের করিডোর ও হলওয়ের ঘোরপ্যাচে পড়ে এগিয়ে চলল আরও ভেতরের দিকে। আগের চেয়েও সতর্ক হয়ে গেছে তিন ডিযঅনারেবল।

‘একটা কথা জানো, রানা?’ হাঁটতে হাঁটতে বলল বাক ওয়াকি। ‘তোমাকে খুন করার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। সেই সময় বেশি দূরেও নেই। খুশি হব বস্ আমাকে কাজটা দিলে।’

‘তুমি বড়বেশি আশা করো,’ বলল রানা। ‘দলে তো তোমরা মাত্র চারজন।’

‘অন্যরাও পৌঁছে যাবে,’ বাঁকা হাসল বাক ওয়াকি। ‘কথা হয়েছে আমার পুরনো বন্ধু মৌরেন লরির সঙ্গে। লণ্ডন থেকে তার সঙ্গে এখানে আসছে আরও নয়জন। যে-কোনও সময়ে পৌঁছে যাবে। তোমাকে দেখলে খুশি হবে ওরা, মেজর।’

লোকটা সত্যি বলছে কি না জানা নেই রানার। তবে বাক ওয়াকির চোখে কোনও কপটতা দেখল না ও।

‘আমি দুটো ব্যাপার খুব অপছন্দ করি,’ বলল ওয়াকি। ‘তার একটা হচ্ছে তোমার মত নীতিবান অফিসার। তোমরা মনে করো অন্যরা যেন মানুষই নয়। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, কেউ আমাদের দলের কারও ক্ষতি করলে। তাকে প্রাণে বাঁচতে দিই না আমরা।’

‘তা হলে তো তোমরা আমাকে খুব ঘৃণা করো!’ বলল রানা। ‘কারণ আমার হাতেই মরেছে তোমাদের দোস্ত হ্যারি অ্যাণ্ডারসন। ডিযঅনারেবলদের দলের বাকি চোদ্দজনকে শেষ করতেও মন্দ লাগবে না আমার।

তিক্ত মুখে মাথা দোলাল বাক ওয়াকি। সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘তোমরা শুনলে শালার বোলচাল?’

‘ভাবছি এত নিচে তুমি নামলে কী করে,’ বলল রানা। ‘তোমার ফাইল দেখেছি। তুমি ছিলে পাথফাইণ্ডারদের স্টাফ সার্জেন্ট। দু’বার জিতে নিয়েছ এওএসসি পদক। অথচ, শেষমেশ গিয়ে নাক গুঁজলে ইঁদুরের দলে। এত পতন কীভাবে হলো তোমার? কপাল মন্দ ছিল, নাকি খুলে গেছে মগজের কয়েকটা বল্টু?’

‘তোমার কপাল খারাপ যে আরডাইক লকের তীরে আমার রাইফেলের গুলিতে খুন হওনি,’ বলল বাক ওয়াকি। ‘তবে এবার আমার হাতে মরবে চরম যন্ত্রণা পেয়ে।’

‘সঠিক লক্ষ্যে লাগাতে গিয়ে মিস্ করেছ,’ বলল রানা, ‘তোমার গোটা জীবনটাই মস্ত এক মিস্। মৃত্যুও এই ঘনিয়ে এল বলে।’

‘যা খুশি বলো,’ ঘড়ঘড়ে গলায় বলল বাক ওয়াকি, ‘তবে খুন করার আগে তোমাকে নিয়ে ফুর্তি করে নেব আমরা।’

পাথুরে প্যাসেজওয়েতে পেরেক গাঁথা বড় এক ওক কাঠের দরজা পেরোল ওরা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল বেযমেণ্টে। নানাদিকে গেছে কিছু দরজা। একপাশের সরু সিঁড়ি বেয়ে রানাকে নিয়ে প্রায়ান্ধকারে আরও একতলা নামল ডিযঅনারেবলরা। বদ্ধ পরিবেশ ভেজা-ভেজা। দেয়ালের পেরেক থেকে খুলে জ্বেলে নেয়া হলো দুটো ইলেকট্রিক লণ্ঠন। বাক ওয়াকি আর কোয়ার্টের হাতে থাকল ও-দুটো। উজ্জ্বল আলোর তাড়া খেয়ে হুড়মুড় করে হটে গেছে কালো ছায়া। সামনে ব্যাঙ্কের ভল্টের মত ভারী, চওড়া ইস্পাতের দরজা। রানাকে পিস্তলের মুখে রেখে দেয়ালের কাছে কোণঠাসা করল কোয়ার্ট আর বেল। ওদিকে চাবি বের করে একে একে চারটে ভারী প্যাডলক খুলল বাক ওয়াকি। ঠেলে সরাল দরজাটা। রানা বুঝল, মানুষকে বন্দি রাখতে গিয়ে নিজের আয়োজনে কোনও ত্রুটি রাখেনি রন স্টুয়ার্ট।

ভল্টের দরজার ওদিকে যেতে ইশারা করল বাক ওয়াকি নিজেই আগে ঢুকল সামনের ঘরে। রানাকে পিস্তলের মুখে রেখে ওর পিছু নিয়ে এল কোয়ার্ট আর বেল।

‘প্রায় পৌঁছে গেছি,’ রানাকে বলল বাক ওয়াকি। ‘আশা করি পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে খুশি হবে তুমি।’

পাথরের চৌকো, এবড়োখেবড়ো ব্লক দিয়ে তৈরি সুড়ঙ্গে ঢুকল ওরা। বাতাসে ফাংগাস ও পানির গন্ধ। বারো ফুট যেতেই সামনে পড়ল আরেকটা সিঁড়ি। ধাপ বেয়ে নেমে যেতে যেতে রানার মনে হলো, ওরা পৌঁছে গেছে দুর্গের ভিত্তির খুব কাছে।

ডিযঅনারেবলরা খুব সতর্ক। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখছে। ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে লোকগুলো, টের পেল রানা। সিঁড়ি থেকে নামার পর সামনে পড়ল শিকের তৈরি এক দরজা। ওটার তালা খুলে রানাকে ভেতরে ঢোকাল ডিযঅনারেবলরা। এবারের খিলান সহ সুড়ঙ্গটা আগেরটার চেয়েও সরু। দুলন্ত লণ্ঠনের আলোয় নড়ছে ভুতুড়ে ছায়া। বদ্ধ পরিবেশে আটকে আসছে শ্বাস। রন স্টুয়ার্টের দুর্গ নতুন হলেও পাতালে নামার পর এখন সবই মধ্যযুগীয় বলে মনে হচ্ছে রানার। বহুকাল আগে এভাবেই আটকে রাখা হতো বন্দিদেরকে। অন্ধকারে ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পেয়ে পেয়ে একসময় মরত মানুষগুলো। তার আগে বাঁচার জন্যে খুবলে খেত মৃত সঙ্গীর লাশ। এই ধরনের কারাগারে দিনের পর দিন অসুস্থ বেন হ্যাননকে কাটাতে হয়েছে ভাবতে গিয়ে ভয়ানক রাগ হলো রানার। বুকে ফুঁসে উঠছে রাগ।

‘হ্যাঁ, প্ৰায় পৌঁছে গেছি,’ মন্তব্য করল বাক ওয়াকি।

সামনে দেয়াল তুলে আটকে দেয়া হয়েছে পাথুরে সুড়ঙ্গ। রানা ভেবেছিল, পুরু শিকের কোনও দরজা দেখবে। কিন্তু চারপাশে তেমন কিছু নেই। নিচে চোখ যেতেই দেখল, বাক ওয়াকির পায়ের কাছের মেঝেতে লোহার পুরু শিক দিয়ে তৈরি ট্র্যাপডোর। নিচে ডানজন। আপাতত বড় একটা বল্টু দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে ট্র্যাপডোর। পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছে অ্যালিউমিনিয়ামের কলাপসিবল মই।

ডান পা ব্যবহার করে বল্টু খুলল বাক ওয়াকি। মেঝেতে লণ্ঠন নামিয়ে দু’হাতে তুলল ভারী ট্র্যাপডোর। গর্তের দিকে চেয়ে নিচে ঘুটঘুটে আঁধার ছাড়া আর কিছুই দেখল না রানা। জানার উপায় নেই কত নিচে মেঝে। গর্ত থেকে এল ভাপসা দুর্গন্ধ।

‘যিশু, কী বাজে গন্ধ, রে!’ বিড়বিড় করল গ্রেগরি বেল। ‘বুড়ো শালা বোধহয় এই গন্ধেই মরে গেছে!’

ট্র্যাপডোর মেঝেতে শুইয়ে রাখল বাক ওয়াকি। সাবধানে গর্তে নামাল লম্বা করে নেয়া অ্যালিউমিনিয়ামের মই। নিচের মেঝেতে ওটা ঠেকতেই ‘ঠং!’ শব্দ এল তলা থেকে। প্রতিধ্বনিত হলো আওয়াজটা। গলা ছেড়ে বলল বাক ওয়াকি, ‘অ্যাই, হ্যানন! জেগে ওঠ! তোর জানের দোস্ত এসেছে দেখা করতে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *