1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৩

তিন

স্থানীয় উচ্চারণে জানতে চাইল কেউ, ‘কে? এটা কি পিটার হ্যানন নাকি?’ লোকটার গলা ভারী হলেও ঠোঁট বোধহয় বিকৃত। তাই কথাগুলো শুনতে বিদঘুটে লাগছে।

কাকে যেন এভাবে কথা বলতে শুনেছে পিটার। তবে এখন মনে পড়ছে না পরিচয়টা। উইস্কির প্রভাবে কাজ করছে না মাথা। চট্ করে তাকাল কবজির ঘড়ির দিকে। রাত বারোটা। কয়েক মুহূর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল পিটার, ‘আমিই। আপনি কে?’

‘তা জেনে তুমি কী করবে, বাপু?’ চাপা হাসল লোকটা। ‘তার চেয়ে শোনো কী দেখেছি। তারপর থেকেই পাগল- পাগল লাগছে। কাউকে না বললে শেষে পেট ফেটে মরেই যাব। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিটার। ‘কে তুমি? কী বলবে? কী বিষয়ে? আমি কি তোমাকে চিনি? এখন কিন্তু অনেক রাত। আমি খুব ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়ব।’

‘এত কথা না বলে মন দিয়ে শোনো। আমি বলছি রবার্ট উইলসনের ব্যাপারে। ও কিন্তু দুর্ঘটনায় মরেনি। কথাটা বুঝতে পেরেছ?’

‘না, বুঝতে পারিনি,’ লোকটার বক্তব্য পিটারের কাছে অস্পষ্ট। ‘আসলে কী বলতে চাও?’

‘তুমি ভেবেছ আত্মহত্যা করেছে রবার্ট?’

‘তুমি কে?’ রেগে গিয়ে জানতে চাইল পিটার। ‘আমি কি তোমাকে চিনি? আগে কখনও দেখা হয়েছে?’ লোকটার কণ্ঠ এবং কথা বলার ভঙ্গি চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু মনে পড়ছে না।

‘ওরা ওকে খুন করেছে।’

‘কী বললে? আরেকবার বলো।’

‘কী বলেছি, ভাল করেই বুঝেছ,’ চাঁছাছোলা সুরে বলল লোকটা, ‘শুয়োরের বাচ্চাগুলো ওকে জঙ্গলে ধরেছে। তারপর নিয়ে গিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছে লকের পানিতে। যাতে ডুবে মরে।’ বড় করে শ্বাস ফেলল সে। ‘এবার তো সবই বুঝলে, নাকি?’

ফোনটা নিয়ে সোফার কাছে এল হতভম্ব পিটার। ধপ করে বসল গদির ওপর। লোকটার কণ্ঠ সিরিয়াস। কয়েক মুহূর্ত পর জানতে চাইল ও, ‘কিন্তু… তার মানে বলছ যে…

‘হ্যাঁ, রবার্টকে খুন করেছে। তবে আমি ছাড়া আর কেউ এই কথা জানে না। ঠাণ্ডা মাথায় খুন।

‘কিন্তু… কেন… কী কারণে?’

‘তা আমি জানব কী করে?’ তিক্ত হাসল লোকটা। ‘আমিও ওখানে ছিলাম। ধরতে গিয়েছিলাম স্যামন মাছ। আগের রাতে পেতে রাখা জাল তুলব, এমনসময় দেখি জঙ্গল থেকে বেরোল পাঁচজন লোক। প্রথমে ভাবলাম, ফিশারি ডিপার্টমেন্টের। আগেও ওই দপ্তরের লোক আমাকে ধরেছে। তাই ঝোপে লুকিয়ে ভাবলাম পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এরা আমাকে দেখল না, নিজেদের হারামিপনায় ব্যস্ত।’

ডানহাতে নাকের গোড়া চেপে ধরে চোখ বুজল পিটার। এখন কী বলা উচিত ভাবতে চাইছে। কয়েক মুহূর্ত পর জানতে চাইল, ‘তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছ?’

‘পরিবেশটা ছিল আবছা অন্ধকার,’ বলল লোকটা, ‘কিন্তু সব দেখেছি আমি পরিষ্কার। আরও কাছে এলে বুঝলাম, পঞ্চমজন ওদের দলের না। শক্ত হাতে তার দুই হাত চেপে ধরে রেখেছিল অন্যরা। ছুটে যাওয়ার জন্যে ছট্‌ফট্ করছিল রবার্ট। গলা ফাটিয়ে সাহায্য চাইছিল। কিন্তু পালাবার উপায় ছিল না। ঠেলে লকের তীরে নিয়ে এল। নিজের চোখকে অবিশ্বাস করব কী করে, মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্নে এসব দেখছি। আর তখনই ধাক্কা দিয়ে রবার্টকে লকে ফেলল। ঝপাস্ আওয়াজ হলো। লোকগুলোর দু’জনের হাতে ছিল আগায় হুক লাগানো নৌকার দুটো লগি। রবার্ট যতই তীরে উঠতে চাইল, ওর বুকে-পেটে লগির গুঁতো মেরে গভীর পানিতে ঠেলে দিল তারা। বারবার। প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিট… বা আরও বেশি সময় ধরে চলল ভয়ঙ্কর ওই নিষ্ঠুরতা। রবার্টকে বাঁচাতে চাইলেও আমার কিছু করার ছিল না। ভীষণ ভয় লাগল, দেখে ফেললে আমাকেও খুন করবে! কিছুক্ষণ পর নেতিয়ে গেল রবার্ট। উপুড় হয়ে ভাসতে লাগল পানিতে। ওরা লগি দিয়ে আরও ক’বার গুঁতো মেরে বুঝল, রবার্ট শেষ। শয়তানির হাসি হাসছিল হারামিগুলো। এরপর আবারও জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল তারা। আরও কিছুক্ষণ লুকিয়ে থেকে শেষে প্রাণের ভয়ে ছুটে পালিয়ে গেলাম সেখান থেকে।’

কথা শুনে শ্বাস আটকে ফেলেছে পিটার। কখন যেন কেটে গেছে মদের ঘোর। আনমনে ভাবল, সত্যিই খুন হয়েছে রবার্ট? দুঃস্বপ্ন দেখছে মা তো ও? বামবাহুতে চিমটি কাটল পিটার। ব্যথা লাগছে। ওদিক থেকে বলে চলেছে বিকৃত ঠোঁটের লোকটা। ‘রবার্টকে পানি থেকে তোলা উচিত ছিল। তবে আগেই জানি, ও মরে গেছে। ভীষণ ভয় পেয়েছি। বুকটা এমন ধড়ফড় করছিল, আরেকটু হলে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। লোকগুলো চলে যেতেই দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। তা হয়তো ভাল করিনি। তবে মনে হচ্ছিল ওখানে থাকলে মারা পড়ব। তারপর সকালে পাওয়া গেল লাশ। শুধু আমিই জানলাম, আর জানল খুনিরা… আসলে খুন হয়েছে রবার্ট। তারপর থেকে খচখচ করছে মন: কাউকে না কাউকে জানাতে হবে। তাই ফোন দিয়েছি তোমাকে।’

পিটার ভাবছে কী বলা উচিত। হঠাৎ মনে জাগল জরুরি প্রশ্ন: ‘আর ওই চারজন লোক, তারা কারা?’

ভীত কণ্ঠে বলল লোকটা, ‘দুঃখিত, হ্যানন, আমার আর কিছু বলা উচিত হবে না। আমাকেও তো বাঁচতে হবে।’

‘তুমি ওদেরকে চেনো, তাই না?’

ওদিকে নীরবতা, তারপর দ্বিধা করে বলল লোকটা, ওদের দু’জনকে। তবে আমি আর কিছুই বলব না।’

‘দয়া করে ওদের নামদুটো জানাও,’ বলল পিটার। ‘জীবনেও না,’ আঁৎকে উঠল বিকৃত ঠোঁট, ‘এরই ভেতর অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছি। এখন ফোন রেখে দেব।’

‘একমিনিট! ফোন রেখো না! প্লিয! আমাকে বলতে না চাইলে পুলিশকে জানাও তারা কারা। আরও ভাল হয় আমরা একসঙ্গে পুলিশের কাছে গেলে। তুমি রাজি থাকলে সকালে যেতে পারি ফোর্ট উইলিয়ামে পুলিশ স্টেশনে।’

‘মিস্টার হ্যানন…’

‘চুরি করে স্যামন মাছ ধরছিলে, তা গোপন রাখব। ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। মানুষ খুন ভয়ঙ্কর ব্যাপার। ‘তাই মাছের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে না পুলিশ।

‘দেখো, হ্যানন, মনে হয়েছে সত্যটা জানানো উচিত। ব্যস, এর বেশি আর কিছুই বলতে চাই না। এমনিতেই মনে হচ্ছে ফোন দিয়ে ভুলই করেছি। আরও বড় বিপদে পড়তে চাই না। এখন তুমি জানো কী হয়েছে রবার্টের। আর কিছু বলার নেই। তুমি নিজেও চুপ থেকো, নইলে খুন হয়ে যাবে। ভাল কাটুক তোমার রাত। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। গুড নাইট।’

লাইন কেটে যেতেই রিসিভারের দিকে তাকাল পিটার। চট্ করে মনে পড়তেই ১-৪-৭-১-৩ নম্বরে ডায়াল করল। যে-লোক কল করেছে, তার নম্বর চাই ওর। কিন্তু ফোন কোম্পানি থেকে বলা হলো, কলারের কোনও তথ্য দেবে না তারা।

এখন মাঝরাত। পিটার বুঝে গেছে, আর ঘুমাতে পারবে না। পায়চারি করতে লাগল লিভিংরুমে। বারবার মনে ঘুরছে একটা কথা: শয়তানি করে কেউ কষ্ট দিতে চাইছে ওকে?

মনে হয় না।

ভয় পেয়েছে রহস্যময় কলার।

নাটকীয়তা ছিল না তার কণ্ঠে।

তা ছাড়া মিথ্যা বলে লাভই বা কী তার?

পরবর্তী একঘণ্টা পায়চারি করল পিটার। ভাবতে লাগল: ডেভেলাপারদের গল্ফ কোর্স আর বড়লোকদের বাড়ির ঝামেলায় ফেঁসে গেছে ওরা। স্থানীয়দের অনেকেই রেগে আছে ওদের ওপর। তার ওপর আছে ইকোফ্ৰেণ্ডস্ দল। একটা গাছও কাটতে দেবে না বলে শপথ নিয়েছে তারা। কয়েক মাস আগে পিটারদের ফার্মে ফোন দিয়ে হুমকি দিয়েছে। গফ্ ও বাড়ির প্রজেক্টে সাহায্য করলে কপালে দুঃখ আছে ওদের। সেই ফোনের পর ফোর্ট উইলিয়ামে পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করেছে পিটার। এরপর সতর্ক ছিল কয়েক সপ্তাহ। ভেবেছিল যে-কোনও সময়ে ফার্মের গাড়ির চাকা ছুরি দিয়ে ফাঁসিয়ে দেবে কেউ। বা ঢিল মেরে ভাঙবে জানালার কাঁচ। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। পরে মন থেকে ভয় ও দ্বিধা কেটে গেল ওদের।

অনেকে ভেবেছে, জঙ্গল কাটার চেষ্টা করা হলে বড় ধরনের বিপদে পড়বে রবার্ট আর পিটার। একই কথা বলেছে ওদের ফার্মের ক্লার্ক অ্যানি ক্যাম্পবেল। প্রতিবাদকারীদের কেউ কেউ জঙ্গী মনোভাবও দেখিয়েছে। যখন-তখন হামলা করবে তারা।

অবশ্য জানালার কাঁচ ভাঙা বা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মেশিনপত্র নষ্ট করা এককথা, আর মানুষ খুন আলাদা কথা। গ্রামের অনেকেই জানত, কনস্ট্রাকশনের প্রজেক্টের সঙ্গে ওরা জড়িত। আর সেজন্যেই বোধহয়…

পায়চারি করতে করতে আনমনে মাথা দোলাল পিটার। হ্যাঁ, ওরা ওই প্রজেক্টে কাজ করছে বলেই হয়তো খুন হয়েছে রবার্ট!

ধড়ফড় করছে হৃৎপিণ্ড। পিঠ বেয়ে নেমে গেল শিরশিরে অনুভূতি। পিটারের মনে হলো, সতর্ক করা উচিত অ্যানি ক্যাম্পবেলকে। কিন্তু ফোন দিয়ে কী বলবে? হাতে তো কোনও প্রমাণ নেই। দমে গেল ওর মন।

এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলা উচিত?

আবারও নালিশ করবে পুলিশের কাছে?

কথা বলবে জেসিকা থমসনের সঙ্গে?

তাকে ফোন দিলে মেয়েটা হয়তো ভাববে, রাত-বিরেতে পাগল হয়ে গেছে ও। তা ছাড়া, এমনও হতে পারে যে ডাহা মিথ্যা বলেছে এই লোকটা।

অনেকক্ষণ পায়চারির পর পিটারের মনে পড়ল, বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকেই চাচার কাছ থেকে নানান ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে ও। কয়েক বছর আগে মানুষটা ছিল এসএএস ফোর্সের একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। আর্মি থেকে অবসর নিয়ে নিয়াপলিটান এক মহিলাকে বিয়ে করে খামার গড়েছে ইতালিতে। সে এমন এক মানুষ, যাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করা যায়।

হ্যাঁ, এখন চাচাকেই দরকার, ভাবল পিটার। খবর পাওয়া মাত্র চিলের মত উড়ে চলে আসবে মানুষটা। অ্যাড্রেস বুক ঘেঁটে বেন হ্যাননের নম্বর নিল। তাতে একটু শান্ত হলো ওর মন। সোফায় শুয়ে চুপ করে পড়ে থাকল। তারপর সকাল ছয়টা বাজতেই কড়া কফি তৈরি করে ফোন নিয়ে বসল।

ইতালিতে এখন বাজে সকাল সাতটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *