1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৪৯

ঊনপঞ্চাশ

তুষারঝড়ের মাঝে দুর্গ লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে পোলারিস যান। বারবার ডাইনে-বাঁয়ে লাফিয়ে গা থেকে ওদেরকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে হালকা গাড়িটা। টিকে থাকছে ওরা সিটবেল্টের গুণে। শীতল হাওয়ায় হাত-মুখ জমে যাচ্ছে। দুর্গের কাছে ধবধবে সাদা আলো দেখল রানা। একটু পর ডানে বাঁক নিয়ে দেয়ালের দিকে গেল রশ্মিটা। ওদিকেই দুর্গের টাওয়ার ও র‍্যাম্পার্ট।

হুইল ঘুরিয়ে পুব দেয়াল লক্ষ্য করে চলল রানা। দুর্গ পাশ কাটিয়ে উঠবে পাহাড়ের উত্তর দিকের ঢাল বেয়ে। আশা করছে, এই ঝড়ের ভেতর দুর্গ থেকে কেউ শুনবে না পোলারিসের ইঞ্জিনের বিশ্রী কর্কশ আওয়াজ।

দুর্গের পুব দেয়াল পেছনে ফেলে পাহাড়ি ঢালে পাথর ও গাছের শিকড়ে হড়কে যেতে চাইল গাড়িটার চাকাগুলো। যত ওপরে উঠছে রানা ও বেন, ওদের দেহ গেঁথে যাচ্ছে সিটে। মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরে রেখেছে রানা। উঠতে গিয়ে পিছলে যাচ্ছে গাড়িটা। দাঁতে দাঁত চেপে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠছে ওরা। একবার খসে গেলে বহু নিচে পড়ে খুন হবে। একটু পর অনেক নিচে দেখা গেল স্টুয়ার্টের দুর্গ। মনেই হলো না ওটা বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি মস্ত প্রাসাদ। দুর্গের জানালায় আলো দেখে দু’জন বুঝল, যথেষ্ট ওপরে উঠে এসেছে ওরা।

এবার সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজটা করতে হবে।

বেনের সিগনাল পেয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে আড়াআড়িভাবে চলল রানা। বহু নিচে দুর্গের উত্তর দিকের প্রাচীর। যেভাবে পাহাড়ে কাত হয়ে ঝুলে আছে গাড়ি, শিরশির করছে রানা আর বেনের ঘাড়ের পিছনটা। ইউটিলিটি ভেহিকেল পিছলে গেলে শত শত ফুট নিচের পাথুরে জমিতে গিয়ে পড়তে হবে।

রানাকে আবারও সিগনাল দিল বেন হ্যানন।

গতি কমিয়ে পাহাড়ের গায়ে থামল রানা। কী করতে হবে ভাল করেই জানে ওরা। নিজেদের ভেতর কোনও কথা হলো না। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল বেন হ্যানন। পোলারিসের পেছন থেকে নিয়ে পাহাড়ের গায়ে বিছিয়ে দিল কয়েক ফুট নীল কর্ড। দ্রুত কাজ করছে পোড় খাওয়া যোদ্ধা। কর্ডের এক প্রান্ত গুঁজল ভারী একটা বোল্ডারের নিচে। আবারও চেপে বসল গাড়ির সিটে। ব্যস্ত হাতে খুলছে কর্ড। এদিকে সাবধানে তেড়চাভাবে কয়েক গজ গিয়ে থেমেছে রানা। কাজটা এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে, এই শীতল হাওয়াতেও দরদর করে ঘামছে দু’জন। পাহাড়ি ঢালে মাকড়সার মত ঝুলছে গাড়িটা। একবার পিছলে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। খাড়া ঢাল বেয়ে এগোতে হবে অন্তত আরও এক শ’ গজ। এসময়ে পাহাড়ের গায়ে বোমা সহ নীল কর্ড পেতে দেবে বেন।

দ্বিতীয় বোল্ডারের নিচে কর্ড গুঁজল সে। পাহাড়ের খাড়া ঢালে বোল্ডারগুলোর মাঝে ধীরে ধীরে পেতে দিচ্ছে বোমা বাঁধা কর্ড। অনেক নিচে স্টুয়ার্টের দুর্গের গেই ও টাওয়ার। ওদের পরের কাজ হবে ওখানে।

পাহাড়ে ওঠা যেমন বিপজ্জনক, নেমে যাওয়াও সমানই ঝুঁকিপূর্ণ। বারবার পিছলে গেল চাকাগুলো। যে-কোনও সময়ে বোল্ডারে লেগে কাত হলেই শুরু হবে গাড়িটার ভয়ঙ্কর পতন। বেশ কিছুক্ষণ পর নামার সময় দুর্গের দেয়াল বামে দেখতে পেল ওরা। হেডলাইট নিভিয়ে দিল রানা। গিয়ার নিউট্রাল করে ইঞ্জিন বন্ধ করে শব্দহীনভাবে নেমে এল সমতল জমিতে। দুর্গের কোথাও কোনও জনমানবের নড়াচড়া নেই। আগের মতই ঝরঝর করে তুষার ঝরছে ছাতে ও উঠানে। এবার পরের কাজ।

দুর্গের গেটের বিশ গজ দূরে দেয়ালের ধারে থামল ওদের ইউটিলিটি ভেহিকেল। ওটা আর লাগবে না। লোড বে থেকে চটের ব্যাগ ভরা বোমা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা ও বেন। রানা পকেটে রেখেছে রেডিয়ো রিমোট ডেটোনেটর। মুখ তুলে দেখল, বহুদিন পর উত্তেজনার ছাপ পড়েছে ওর ওস্তাদের মুখে। কোনও কথা হলো না ওদের ভেতর। নীরবে গভীর তুষার মাড়িয়ে চলে গেল দেয়ালের পাশে গেটের কাছে। এখন দুর্গ থেকে ওদেরকে দেখতে পাবে না কেউ। সতর্ক চোখে গেটের ওদিকে চোখ রাখল রানা। উঠানে আছে কালো রঙের বাক্সের মত তিনটে মিটসুবিশি ফোর-হুইল- ড্রাইভ গাড়ি। ওগুলোর ছাতে ও বনেটে জমছে সাদা তুষারের চাদর। আগের জায়গায় রয়ে গেছে রানার চুরি করা পুরনো মরিস মাইনর। বেশিক্ষণ হয়নি দুর্গে এসেছে মিটসুবিশি জিপগুলো। রানা ও বেন বুঝে গেল, এরই ভেতর হাজির হয়ে গেছে বাক ওয়াকির অন্যান্য বন্ধুরা। সবমিলিয়ে তারা বোধহয় দশজন।

‘খুব ঠাণ্ডা রাত,’ বিড়বিড় করল বেন হ্যানন।

পকেট থেকে রিমোট ডেটোনেটর নিল রানা। ‘আপনি বোধহয় শরীর গরম করতে চাইছেন?’

‘আমি তো ভেবেছি তুমি ভুলেই গেছ হাত গরম করা উচিত।’

ওদের কাছে আছে বিশটা ডেটোনেটর ক্যাপ। একুশটা চ্যানেল। প্রথম চ্যানেলে ডায়াল করল রানা। মনে মনে বলল, কাজ হলেই হয়। পরক্ষণে টিপে দিল সেণ্ড বাটন।

চমৎকারভাবে কাজ করল ডেটোনেটর।

পাহাড়ের ওপরে পৌঁছে গেছে সিগনাল। ব্লাস্টিং ক্যাপ ফেটে যেতেই দপ করে আগুন জ্বলে উঠল নীল ডেটোনেটর কর্ডে। ওটা আসলে সাধারণ ফিউয। ফাঁপা শরীরের ভেতরে আছে বিস্ফোরকের গুঁড়ো। ঝড়ের বেগে পুড়তে শুরু করেছে বলে প্রায় একইসময়ে জ্বলে উঠেছে বারুদভরা এক শ’ গজ ফাঁপা কর্ড। দূর থেকে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনল ওরা। যেন বিশটা নয়, বিস্ফোরিত হয়েছে শক্তিশালী একটা আরডিএক্স বোমা। পাহাড়ের ওপরে রাতের আঁধারে ঝলসে উঠেছে উজ্জ্বল সাদা আলো। পরক্ষণে থরথর করে কেঁপে উঠল দুর্গের চারপাশ।

হাতে তৈরি বোমা হলেও তার শক্তিকে ছোট করার উপায় নেই। পাহাড়ের ঢালে লাফ দিয়েছে শত শত বোল্ডার। আকাশ থেকে মাটিতে পড়েই শুরু হয়েছে ভয়ঙ্কর অ্যাভালাঞ্চ। বড়-ছোট হাজার হাজার পাথরের খণ্ড গড়িয়ে নেমে আসছে দুর্গের প্রাচীরের দিকে। প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে পতনের গতি। শ্বাস আটকে ওদিকে চেয়ে রইল রানা ও বেন।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত পর দুর্গের ছাতে পড়ল গাড়ির সমান আকারের বড় একটা পাথরখণ্ড। ফেটে গেল ছাত। আকাশ থেকে বরফশিলার মত পড়ছে পাথর। মিসাইলের মত এসে লাগছে গেইল ও টাওয়ারের গায়ে। প্রাচীন আমলের মজবুত দুর্গ হলেও চুরমার হতো পাথরের আঘাতে। স্টুয়ার্টের দুর্গ তো সেই তুলনায় শোন্-পাপড়ি। নানাদিকে ছাত-দেয়াল ধসে পড়ছে বিকট আওয়াজ তুলে।

অবশ্য কাজ এখনও ঠিকভাবে শুরুই করেনি রানা ও বেন। ‘শুয়োরগুলো জেনেছে আমরা পৌঁছে গেছি,’ বলল প্রৌঢ় যোদ্ধা।

মাথা দোলাল রানা। ‘হ্যাঁ, ওদেরকে হতাশ করব না। চলুন, কাজে নামা যাক।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *