ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

শীতের রাতে ট্রেনে

শীতের রাতে ট্রেনে

সেবার পুজো পড়েছিল একেবারে আশ্বিনের শেষে। ঠিক পুজোর মুখে হাওড়া থেকে সন্ধের ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলাম। দিনকাল খারাপ, সঙ্গে কিছু টাকা পয়সাও আছে। ভেবে ছিলাম বেলাবেলি ট্রেন ধরব। কিন্তু সে আর হয়ে উঠলানা।

গাড়িতে বেশ ভিড়। কোথাও বসার জায়গা পাচ্ছি না। হঠাৎ একটা কামরা একদম খালি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ব্যাপার আর কিছুই না বগিটা আগে ফার্স্টক্লাস ছিল, চওড়া বেঞ্চ, হাতল লাগানো। সামনে করিডোর। সেটা যে এখন ক্লাস টু হয়ে গেছে সেটা কেউ লক্ষ করছে না। আমি তখনই সেই খালি গাড়িতে উঠলাম।

উঠলাম তো কিন্তু গাড়ির অবস্থা দেখে চক্ষু চড়কগাছ। চওড়া বেঞ্চি—কিন্তু গদি আর স্প্রিং কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। শুধু পেরেকগুলো উঁচু হয়ে আছে। বাংকগুলোর গদি উধাও। লোহার ফ্রেমটা শুধু কঙ্কালের মতো মাথার ওপর পড়ে আছে।

কী আর করি উঠেছি যখন তখন আর নামব না। নেমেই বা যাব কোথায়? কোনো রকমে কাগজ পেতে ফার্স্টক্লাসে বসলাম।

গাড়ি ছাড়ল একটু পরে। আর সঙ্গে সঙ্গেই আবিষ্কার করলাম শুধু গদি, স্প্রিং বা ফ্যান নয়, আলোর বালবগুলিও খুলে নেওয়া হয়েছে।

কী আর করা যাবে, অন্ধকার গাড়িতে চোখ বুজিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলাম। একসময়ে গাড়ি কখন ব্যান্ডেল পার হয়ে গেছে খেয়াল নেই। গাড়ি ত্রিবেণীর দিকে ছুটছে। আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। বড্ড একলা। এর মধ্যে গাড়িতে আর কোনো প্যাসেঞ্জার উঠেছে কিনা খুব আশা নিয়ে দেখতে উঠলাম। করিডোর দিয়ে চলেছি—আশ্চর্য, গোটা বগিতে একমাত্র আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। আমার গা ছমছম করতে লাগল। এ কী করে সম্ভব হল? গোটা ট্রেনে লোক ভর্তি আর এই বগিটাতেই কেউ উঠল না। সবাই কি এটাকে ফার্স্ট ক্লাস বলে ভুল করল?

হঠাৎ ল্যাভাটেরির দরজায় শব্দ হল। তারপর দেখি তার ভেতর থেকে আপাদমস্তক চাদরমুড়ি দিয়ে কেউ একজন বেরিয়ে আসছে। আমার কী মনে হল—তাড়াতাড়ি নিজের জায়গায় চুপ করে বসলাম। দেখি লোকটা দুবার করিডোর দিয়ে যাতায়াত করল তারপর আমার খুপরিতেই এসে ঢুকল।

অন্ধকারে মনে হল লোকটা যেন অল্পক্ষণ আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। তারপর আমার পাশে এসে বসল। আশ্চর্য! এতক্ষণ অন্ধকার কামরায় একলা ছিলাম বলে ভয় করছিল, আর এখন আমারই পাশে একজনকে বসতে দেখে কেমন আতঙ্ক হচ্ছে।

কীসের আতঙ্ক?

ঠিক জানি না। তার অস্তিত্বটাই আমার কাছে আতঙ্কের। সে যদি সিটে বসে নড়ত—চড়ত, যদি গা এলিয়ে বসত, যদি আমার সঙ্গে দু—একটা কথা বলত তাহলেও নিশ্চিন্ত হতাম। কিন্তু সে এসে পর্যন্ত দরজার দিকে মুখ করে আছে, আমাকে মুখ দেখাবে না। কিংবা ভাবছে কখন উঠে চলে যাবে। সে বোধ হয় বসার জন্যে আসেনি। তাহলে কী জন্যে অন্ধকারে আমার পাশে এসে বসল? সেও তবে আমার মতোই সঙ্গী খুঁজছিল? কিন্তু দেখে তো তা মনে হয় না।

আচ্ছা লোকটা অমন করে আপাদ মস্তক সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে আছে কেন? এখনো তো কার্তিক মাস পড়েনি। এত শীত?

লোকটা কি তবে অসুস্থ?

অসুস্থ মানুষ কি অমন সোজা হয়ে বসে থাকতে পারে?

ট্রেন ছুটছে। শহর আর নেই। এখন ছোটো ছোটো স্টেশন। দু’পাশে জঙ্গল। অন্ধকার, আমি ভয়ে জানলার দিকে মুখ করে বসে আছি। আমার মনে পড়ছে খালি—কামরায় এই রকম অস্বাভাবিক আবির্ভাব নিয়ে অনেক ঘটনা শুনেছি। এটাও কি সেইরকম কিছু?

আচ্ছা, লোকটা বাথরুমে ঢুকল কখন? ব্যান্ডেলে? দেখতে পাইনি তো?

অন্ধকার বলে?

কেউ কি গাড়িতে উঠেই বাথরুমে যায়?

তা ছাড়া বেছে বেছে কি কেউ অন্ধকার কামরাতেই ওঠে?

তাহলে?

তাহলে যে কী তা ভাবতেও আমি শিউরে উঠলাম। হঠাৎ একটা চাপা স্বর কানে এল।

—আপনার রুমালটা দেবেন?

রুমাল!

এতক্ষণ যা ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম তা যদি সত্যি হয় তাহলে কথা বলল কী করে?

ওরা কি মানুষের মতো কথা বলতে পারে?

যাই হোক তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমালটা বের করে কোনো রকমে ফেলে দিলাম।

সে রুমালটা নিয়ে হেঁট হয়ে কী করতে লাগল।

খুব কৌতূহল। পকেটে টর্চও ছিল। কিন্তু জ্বালতে সাহস হল না।

কিছুক্ষণ পরে গাড়িটা হঠাৎ মাঝপথে দাঁড়িয়ে গেল।

কী হল? চেন টানল কে?

তারপরেই সামনের দিকের একটা গাড়ি থেকে চিৎকার আর্তনাদ শোনা গেল। আমি চমকে উঠলাম। কী হল!

তারপরেই দেখি কামরাটা থেকে প্যাসেঞ্জাররা হুড়মুড় করে নেমে পড়ছে। তারা ছোটাছুটি করছে।—ডাকাত—ডাকাত—

দুমদাম করে বোম ফাটল। চিৎকার কান্না—রেলরক্ষীরা ছুটল রাইফেল হাতে।

কাঁপতে কাঁপতে আমিও সুটকেসটা আঁকড়ে ধরে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। অনেক টাকা সঙ্গে রয়েছে। গাড়িতে একা থাকা ঠিক নয়।

শেষ পর্যন্ত নেমে পড়লাম। চারিদিকে ধূ ধূ মাঠ। কোথাও এতটুকু আলো নেই। শুধু ভয়ার্ত প্যাসেঞ্জারদের টর্চের আলো মাঝে মাঝে চমকে উঠছে।

একবার ভাবলাম অন্য কোনো কামরায়—যে কামরায় লোক আছে, আলো আছে—সেখানে চলে যাই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল এসবে তো হাঙ্গামা হচ্ছে। তার চেয়ে আমার কামরাতেই অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে থাকি। আর তিনটে তো মাত্র স্টেশন, তার পরেই বাড়ি পৌঁছে যাব।

আমি আবার উঠে এলাম। নিজের খুপরিতে গিয়ে ঢুকলাম। কিন্তু সে লোকটা গেল কোথায়? আমি এবার সুটকেসটা হাতে নিয়েই উঠে টর্চ জ্বেলে কামরার সর্বত্র খুঁজলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম না। তাহলে?

হঠাৎ লক্ষ পড়ল মেঝেতে। যেখানে লোকটা বসেছিল সেখানে টর্চের আলো পড়তেই দেখলাম থকথকে রক্ত। আমার সর্বশরীর কেঁপে উঠল। রক্ত কেন? ভূতের কি রক্ত থাকে? না।

তাহলে ও তো মানুষ। হয় তো কোনো কারণে পা কেটে গিয়েছিল, রক্ত পড়েছে।

সেইজন্যেই কি রুমাল চাইল?

কিন্তু আমায় তো কিছু বলল না। টর্চও তো চাইতে পারত?

যাই হোক, এত রক্ত পড়েছে যার সে গেল কোথায়? সেও কি আমার মতো ভয়ে পালিয়েছে? আমার না হয় ভয়ের কারণ আছে। কিন্তু তার তো সঙ্গে কিছুই ছিল না। তাহলে?

আমার আবার ভয় করতে লাগল। আমি তাড়াতাড়ি নেমে অন্য গাড়িতেই চলে গেলাম।

ট্রেন ছাড়ল এক ঘণ্টা পরে। একসঙ্গে তিন—চারটে কামরায় হানা দেওয়া হয়েছিল। মাঝ পথে চেন টেনে ডাকাতরা পালায়। কেউ ধরা পড়েনি। তবে লাইনের ওপরে পুলিশ নাকি রক্তের ফোঁটা দেখেছে। নিশ্চয়ই কোনো ডাকাত চোট খেয়েছে। কুকুর আনানো হচ্ছে। বৃষ্টি না হলে ডাকাতরা ধরা পড়তই প্যাসেঞ্জাররা ভবিষ্যদ্বাণী করছে।

কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।

তাহলে এতক্ষণ আমার পাশে যে বসেছিল সেও—

কিন্তু সে আমার ক্ষতি করল না কেন?

১৯৮৪, সেপ্টেম্বর, শুকতারা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *