অলৌকিক মাছ
।। এক ।।
নিষিদ্ধ বই
মধ্যপ্রদেশের যে অংশটা ডানদিকে চেপে দক্ষিণে ঝুলে গেছে সেখানে রয়েছে বস্তার। এরপরেই শুরু হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ। মাঝখানে গোদাবরী। এরপর কৃষ্ণা, কাবেরী, তুঙ্গভদ্রা আর পাহাড় থেকে আছড়ে পড়া নানা খরস্রোতা নদী।
এইভাবেই ওরা দুজন চলে এল দক্ষিণ ভারতে। ওদের কাছে নদী—পাহাড়ে ঘেরা এ এক আশ্চর্য জায়গা।
দক্ষিণমুখো নামতে নামতে বাঁদিকে পূর্বঘাট, ডানদিকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা যেন দক্ষিণ ভারতকে সুউচ্চ পাঁচিলের মতো আগলে রয়েছে।
জন আর ডেভিড—তেইশ—চব্বিশ বছরের দুটি যুবক এর আগে কখনও ভারতবর্ষে আসেনি। কোনোদিন যে আসতে হবে ভাবেওনি। তবু যে আসতে হল তার পিছনে ছিল ভয়ংকর একটা অ্যাডভেঞ্চারের তাগিদ। এ অ্যাডভেঞ্চার নতুন কোনো জায়গা আবিষ্কারের নয়, গুপ্তধনের সন্ধানও নয়। সন্ধান করতেই বেরিয়েছে ওরা। তবে এ সন্ধান আরও ভয়াবহ—আরও অলৌকিক কিছুর।
ওরা ওদের বাপ—ঠাকুর্দার কাছে ছেলেবেলা থেকে জেনে আসছে—ভারতবর্ষ হচ্ছে যথার্থ সাধু—সন্ন্যাসীর দেশ। মন্ত্রতন্ত্র, যাগ—যজ্ঞ, ভূত—প্রেত, পিশাচ—দানব বশ করবার অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ এই ভারতবর্ষ আর ঠিক তার মাথার উপর তিব্বত ছাড়া কোথাও তেমন দেখা যায় না।
তাই এই দেশটা দেখার ইচ্ছে ছিল ওদের অনেক দিনের। কিন্তু সুযোগ বা জুতসই উপলক্ষ্য এরা এতদিন পায়নি। এতদিন পর এক চিনদেশীয় বৌদ্ধ তান্ত্রিকের মুখে অলৌকিক তিনটি প্রাণীর কথা শুনে ওরা দুই বন্ধু ভাবনাচিন্তা না করেই সুদূর ডোভার থেকে বেরিয়ে পড়েছে ওই অলৌকিক প্রাণী তিনটের সন্ধানে।
টাকা—পয়সার অভাব নেই ওদের। তবু অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। আর আশ্চর্য ওদের বাবা—মা’রা। ছেলেরা অজানা—অচেনা জায়গায় অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরোলে বাধা দেয় না। শুধু ওদের ব্যাগের মধ্যে একটা করে কার্ড পুরে দেয় যাতে লেখা থাকে ওদের দেশের বাড়ির ঠিকানা। খুব খারাপও যদি কিছু ঘটে তাহলে অন্তত বাড়িতে খবরটা আসবে।
জন আর ডেভিডের মধ্যে জন একটু বেশি সাহসী। ভাবনাচিন্তা না করেই বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফর্সা রং, কটা চুল, নীলচে চোখ, ছিপছিপে গড়ন। আর ডেভিড স্বাস্থ্যবান। বিপদ বুঝলে এগিয়ে যাবার আগে দশবার ভাবে। হুট করে কিছু করে না। তবু দুজনের খুব ভাব।
ওদের হাতে ভারতবর্ষের ম্যাপ ছাড়াও দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রের ধারের ছোটো—বড়ো নানা জায়গার নকশা রয়েছে। কারণ তাদের লক্ষ্যস্থল সমুদ্রতীরবর্তী ছোটোখাটো কোনো নির্জন জায়গা।
ওরা দক্ষিণ দিকে নেমে আসছে। বাঁদিকে বঙ্গোপসাগর, ডানদিকে আরব সাগরের সবুজ জল, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। তিন—তিনটি সাগরের এমন মিলনস্থান আর কোথাও ওরা দেখেনি।
ওদের এই অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি শোনাবার আগে পিছনে যে একটি ঘটনা আছে সেটা আগে বলে নেওয়া যাক।
কলকাতার মিউরিয়েলদি থাকতেন লোয়ার সার্কুলার রোডে, এখন যার নাম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড। ওঁর বাবা ছিলেন ম্যাড্রাসি খ্রিস্টান, কিন্তু মা ছিলেন বাঙালি। মিউরিয়েলদি বিয়ে করেননি। শরীরটা তাঁর কোনোদিনই ভালো ছিল না। বাবা রেখে গিয়েছিলেন দু—খানা বাড়ি আর বেশ কিছু টাকা। সারা জীবন বই পড়েই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। প্রচুর ইংরেজি বই পড়তেন। বই পড়াতেই তাঁর আনন্দ ছিল।
আমি প্রায়ই অফিস থেকে ফিরে তাঁর কাছে যেতাম, আর ভূতের গল্প শুনতাম। ভূতের গল্প তিনি বানিয়ে বলতেন না। বলতেন ইংরেজি বই থেকে পড়ে। ভূতের গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে? বিদেশি ভূতের গল্প হলে তো কথাই নেই। তা ছাড়া তাঁর গল্প বলার ধরনটাও খুব সুন্দর। এমনভাবে বলতেন যেন চোখের সামনে সব ঘটনাগুলো দেখতে পেতাম। শুনতে শুনতে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠত।
তিনি আমাকে ছোটোবেলা থেকে দেখেছেন। নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন।
একদিন সন্ধেবেলা গিয়েছি। দেখি তিনি চুপচাপ শুয়ে আছেন। টিভি পর্যন্ত দেখছেন না। তাঁর বুকের ওপর একটা বহুকালের পুরোনো বই উপুড় করে রাখা। বইটা বোধহয় পড়ছিলেন। আমায় দেখেই বইটা লুকোবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না।
বললাম, কী বই ওটা? খুব পুরোনো তো।
মিউরিয়েলদি আমার দিকে ছেলেমানুষের মতো ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর কাছে ডাকলেন। আমি বিছানায় ওঁর পাশে গিয়ে বসলাম।
বললাম, ভূতের বই নাকি?
উনি গম্ভীরভাবে বললেন, হ্যাঁ।
তারপর বললেন, এ বইটা বাবা কেরালার টেলিচারিতে থাকার সময়ে কার কাছ থেকে যেন পেয়েছিলেন। সে আজ সত্তর—আশি বছর আগের কথা। বইটা নিষিদ্ধ। এর প্রথম পাতাতেই বড়ো বড়ো করে লেখা আছে—সাধারণ পাঠকের জন্যে নয়। কেবলমাত্র থিওজফিস্টদের জন্যে নয়। থিওজফিস্ট কাদের বলে জানো তো? ওই যারা গোপনে ভূত—প্রেত অলৌকিক শক্তির চর্চা করে, তাদের।
বাবা মরবার আগে বইটা আমাকে দিয়ে যান। বলে যান—এ বই কোথায় রাখব জানি না। তোমাকেই দিয়ে গেলাম। খুব সাবধানে রাখবে। অন্যের হাতে যেন না পড়ে। পারো তো এটা নষ্ট করে ফেলো।
এই পর্যন্ত বলে উনি একটু থামলেন। তারপর বললেন, নষ্ট করতে পারিনি। কোথায় যেন লুকিয়ে রেখেছিলাম। বহুকাল পর ট্রাঙ্কের তলা থেকে আজ বইটা খুঁজে পেলাম। সারা দুপুর ধরে পড়ছিলাম। বেশিক্ষণ পড়তে পারি না। অল্প অল্প করে পড়ছিলাম। এই সময়ে তুমি এসে পড়লে।
মিউরিয়েলদি আবার থামলেন।
বললাম, কী নিয়ে বইটা লেখা আমাকে বলতে বাধা আছে কি?
উনি বললেন, নিশ্চয়ই আছে। বইটাতেই নিষেধ করা আছে।
বললাম, ঠিক আছে। বই আমি পড়তে চাই না। তবে কী নিয়ে লেখা সেটা বলতে আপত্তি আছে?
মিউরিয়েলদি অনেকক্ষণ চুপ করে কী ভাবলেন। তারপর বললেন, তুমি আমার খুব স্নেহের পাত্র। ভূতের গল্প শুনতে ভালোবাসো সেই ছোটোবেলা থেকে। আমিও কত যে দিশি—বিদেশি ভূতের বই পড়েছি তার ঠিক নেই। তাই তোমাকে শুধু কী নিয়ে বইটা লেখা সেটুকুই বলছি।
মিউরিয়েলদি আবার একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, বিষয়টা তিনটে মাছ নিয়ে।
অবাক হয়ে বললাম, মাছ!
হ্যাঁ।
এরপর মিউরিয়েলদি আমায় যে অদ্ভুত ঘটনাটা বললেন সংক্ষেপে তা এইরকম—
কতকাল আগে কে জানে ভূমধ্যসাগরে প্রথম তিনটে অদ্ভুত ধরনের মাছ দেখা গিয়েছিল। মাছগুলো শুধুই যে আকারে বিরাট তাই নয়, মুখগুলো দানবের মতো। কিন্তু ছুঁচলো। মাছগুলোর বড়ো বড়ো দাঁত। চোখগুলো প্রায় বোজানো। মাঝে মাঝে পিটপিট করে তাকায়। তখন তাদের আরো ভয়ংকর দেখায়।
মাছ তিনটে একসঙ্গে থাকে। রং বদলায়।
প্রবাদ এই যে, মাছ তিনটে গ্রিসের তিন দেবতার প্রতীক—যেমন আমাদের তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর।
আবার কারো কারো মতে মাছ তিনটে দেবতার প্রতীক নয়, প্রতীক তিন শয়তানের।
যাঁরা বললেন তিন দেবতার প্রতীক তাঁদের মতে এই মাছ তিনটে যদি কেউ ধারে নিজেদের কাছে রাখতে পারে তা হলে সে একদিন মহা সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। আর যাঁরা বলেন শয়তানের প্রতীক তাঁদের মতে এই মাছগুলো যার কাছে থাকবে তার একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
বহু দুঃসাহসী জেলে সৌভাগ্যের আশায় এই মাছ তিনটিকে ধরার জন্যে সমুদ্রে সমুদ্রে মোটা মোটা জাল ফেলেছে। আবার যারা এসব প্রবাদে বিশ্বাসী নয় তারাও নিতান্ত কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে মাছ তিনটিকে ধরবার চেষ্টা করেছে জাহাজে চড়ে।
মাছ তিনটে এক জায়গায় থাকে না। এ সমুদ্র থেকে অন্য সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। যখন যে সমুদ্রে থাকে অভিজ্ঞ জেলেরা কিছু একটা দেখে বুঝতে পারে মাছগুলো এই সমুদ্রে আছে।
মাছগুলো বহুবার ধরা পড়েছেও। কিন্তু কেউই বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। ধরা পড়লে এদের সমুদ্রের কাছাকাছি রাখতে হয়। সমুদ্রের জল—বাতাস না পেলে এরা নাকি বাঁচে না। আর সেই সুযোগে একদিন—না—একদিন সমুদ্রে নেমে পালায়। সেইজন্যে যারা এদের ধরে তারা খুব সাবধানে রাখে।
মিউরিয়েলদি একটু থেমে আরও যা বলেছিলেন তা এই—
থিওজফিস্টরা বলেন, প্রেতাত্মা তো আছেই আর তারা যে শুধু ছায়া—শরীর নিয়েই ঘুরে বেড়ায় তা নয়। কেউ কেউ রীতিমতো মানুষের চেহারা নিয়ে সাধারণ মানুষের মতোই জীবনধারণ করে। তবে তারা লোকালয়ের মধ্যে থাকতে চায় না। পাহাড়ের ধারে, নির্জন নদী কিংবা সমুদ্রতীরে অথবা গভীর জঙ্গলে বা পোড়ো বাড়িতে সাধারণ মানুষের মতোই থাকে। তবে কারো সঙ্গে বড়ো একটা মেলামেশা করে না। এরা খুব হিংস্র প্রকৃতির হয়। কখনো কখনো সাধারণ মানুষ তাদের কাছে ভুল করে গিয়ে পড়ে। তখন অবশ্য তারা তাদের ক্ষতি করে না। তবে তারা যদি জানতে পারে লোকটা তাদের আসল রূপটা ধরে ফেলেছে তখনই তাদের মেরে ফেলে।
এই নররূপধারী প্রেতরা কিন্তু ওদের ওই জীবন পছন্দ করে না। তারাও মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু মুক্তি চাই বললেই তো মুক্তি পাওয়া যায় না। তারা মুক্তির জন্যে উপায় খুঁজে বেড়ায়। ওই মাছ তিনটেকে ধরে তাদের আদর—যত্ন করে রাখলে নাকি তাদের দয়ায় প্রেতাত্মাদের মুক্তি হয়—এইরকম বিশ্বাস অনেকের আছে। তাই জেলেদের মতোই এইসব প্রেতাত্মারা সমুদ্রের ধারে থেকে মাছ তিনটেকে ধরবার চেষ্টা করে। অন্য জেলেদের চেয়ে তাদের ক্ষমতা বেশি থাকে কেননা তারা মানুষ নয়।
মিউরিয়েলদি আরও জানালেন, বইটাতে লেখা আছে মাছ তিনটে নাকি সে সময়ে অর্থাৎ বইটা লেখার সময়ে ছিল আরব সাগরে। দুটি বিদেশি ছেলে ডোভার থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিল ভারতবর্ষে। তারা ম্যাপ দেখে, নকশা মিলিয়ে মধ্যপ্রদেশ থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ হয়ে নদী, পাহাড়, জঙ্গল ডিঙিয়ে এসে পড়েছিল একেবারে দক্ষিণে কেরালায়।
ব্যস। এই পর্যন্ত তোমাকে বললাম। বাকিটা লেখা আছে বইটাতে। সে বই সাধারণের পড়া নিষিদ্ধ। হঠাৎ যদি কেউ পড়ে ফেলে তাহলে তারও ভালো হয় না।
আর একটা কথা—কেউ যদি এই মাছ তিনটিকে তাদের নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া শোবার ঘরে বা বাড়ির মধ্যে দেখতে পায় তা হলে তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যু ঘটে।
।। দুই ।।
মিউরিয়েলদির শেষ ইচ্ছে
মাসখানেক কলকাতার বাইরে ছিলাম। ফিরে এসে মিউরিয়েলদির একটা চিঠি পেলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা তিন লাইন—
স্নেহের টুবলু,
আমার মৃত্যু আসন্ন। যত তাড়াতাড়ি পারো দেখা করো। বিশেষ কিছু বলার আছে—
সেদিনই সন্ধেবেলায় মিউরিয়েলদির বাড়ি গেলাম। দেখি কপালের ওপর বাঁ হাতটা রেখে তিনি বিছানার সঙ্গে মিশে পড়ে আছেন।
মাত্র এক মাস আগেও যাঁকে এত গল্প করতে দেখেছি, এরই মধ্যে তাঁর এই অবস্থা কী করে হল ভেবে অবাক হলাম। দু’চোখ বসে গেছে। মুখটা মড়ার মতো সাদা।
কাছে গিয়ে খুব ধীরে ডাকলাম, মিউরিয়েলদি!
দু—তিনবার ডাকার পর তিনি চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালেন।
কে? কে?
আমি টুবলু।
কে?
আমি টুবলু। এখানে ছিলাম না। আপনার চিঠি পেয়েই দেখা করতে এসেছি।
এতক্ষণে তিনি আমাকে চিনতে পারলেন।
ও! তুমি এসেছ! বোসো।
তারপর বললেন, আমার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। যদি এর মধ্যে কিছু হয়ে যায় তার জন্যেই তোমাকে ডেকেছি।
বলুন।
তাড়াহুড়ো কোরো না। বলছি। শুধু শুনে যাবে। কোনো প্রশ্ন করবে না। তর্ক করবে না। নিতান্ত তোমাকেই জানাতে ইচ্ছে করল বলেই ডেকেছি। বেশি কথা বলার শক্তি আমার নেই।
দম নেবার জন্যে একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, লাস্ট যেদিন এসেছিলে সেদিন সেই মাছের কথা বলেছিলাম। তিনটে অলৌকিক মাছ। মনে আছে?
বললাম, হ্যাঁ।
সেই মাছ তিনটে যে শেষ পর্যন্ত আমাকেই—
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু থামলেন। তারপর মনে জোর এনে বলতে লাগলেন—চারদিন আগে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে একটা শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি আমার পায়ের দিকের জানলাটা হঠাৎ খুলে গেল। তারপর একটা একটা করে তিনটে মাছ বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে ঘরে ঢুকে পড়ল।
জানলা দিয়ে মাছ ঢুকল?
মিউরিয়েলদি ধমকে উঠে বললেন, চুপ করো প্রশ্ন কোরো না।
আবার একটু থেমে বলতে লাগলেন, প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারিনি। হঠাৎ বিশাল বিশাল মাছ তিনটি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তার পরেই মনে পড়ল বইয়ে লেখা সেই মাছ তিনটের কথা। আমি চমকে উঠে বসলাম। মাছগুলো সার বেঁধে বিকট হাঁ করে চোখ পিটপিট করতে করতে আমাকে খেতে আসছে।
তখন আমি হাতজোড় করে তাদের বললাম, তোমরা যেই—ই হও আমাকে ভয় দেখাচ্ছ কেন? আমি তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি।
কিন্তু তবু ওরা শুনল না। মুখ হাঁ করে আমার বিছানার কাছে এগিয়ে এল। তখন আমি ‘যিশু, আমাকে রক্ষা করো’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে মাছগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটু থেমে বললেন, তারপর কি দেখলাম জান? ওই চেয়ারে যিশু বসে রয়েছেন। আর তাঁর কোলে আমি ছোট্ট মেয়েটির মতো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছি।
মিউরিয়েলদি থামলেন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে ওঁর। অনেকক্ষণ পর একটু সামলে নিয়ে বললেন, ভাবছি মাছগুলো কোথা থেকে এল? তাদের তো সমুদ্রে থাকার কথা। কেনই বা আমাকে আক্রমণ করতে এল? আমার মনে হয় ওদের কথা তোমাকে বলেছি এইটেই আমার অপরাধ!….আমি বুঝতে পারছি বইয়ের কথা অনুযায়ী মাছগুলো যখন আমায় দেখা দিয়েছে তখন আর তিনদিনের মধ্যে আমার মৃত্যু হবে। তা হোক। আমি যিশুর কোলে আশ্রয় পেয়েছি। কাজেই মৃত্যুকে আর ভয় করি না। শুধু একটি অনুরোধ—সেই বইটা আমার তোশকের তলায় আছে। কেউ জানে না। আমি চাই না বইটা পাঁচজনের হাতে পড়ে। তাই বইটা তুমি অতি অবশ্য আমার কফিনে দিয়ে দেবে। বলো আমার কথা রাখবে?
বলে তাঁর ঠান্ডা হাত দিয়ে আমার হাতটা চেপে ধরলেন।
বললাম, রাখব।
আশ্চর্য, ঠিক তিনদিনের মাথায় বেলা দশটার সময়ে মিউরিয়েলদি মারা গেলেন। আমি তখন সামনে বসে।
আত্মীয়স্বজনের কাছে খবরটা গেল। তারা এসে পড়ল। পাদ্রি এলেন। বাড়িতে ভিড় জমে গেল। ওদিকে কফিন তৈরি হচ্ছে। আমি চুপিচুপি ওঁর বিছানার তলা থেকে বইটা বের করে নিলাম। এই বইটা ওঁর কফিনে দিতে হবে।
বইটার পাতাগুলো মুড়মুড়ে হয়ে গেছে। বিদেশের কোন একটা প্রেসে ছাপা—পাতাটা ছিঁড়ে গেছে বলে পড়তে পারলাম না। ইংরিজি অক্ষরগুলো এখনকার বইয়ের অক্ষরের মতো নয়। কেমন যেন মোটা মোটা। বহুকাল আগের ছাপা তো।
আমি সাবধানে পাতা ওল্টাতে লাগলাম। পড়ব না পড়ব না করেও পড়তে আরম্ভ করলাম। এই বই পড়া নিষেধ। পড়লে নাকি চরম ক্ষতি হবে। তবু যেহেতু আমি বিজ্ঞানের যুগের শিক্ষিত ছেলে, তাই বইটা নিয়ে নিরিবিলিতে বসে পড়তে শুরু করলাম। পাতলা বই, শেষ করতে সময় লাগল না। জানি না এই নিষিদ্ধ বই পড়ার অপরাধে কী শাস্তি আমার হবে।
যখন পড়া শেষ হল তখন মিউরিয়েলদিকে কফিনে শোয়ানো হচ্ছে। আমি শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে একগুচ্ছ সাদা ফুলের আড়ালে বইখানাও কফিনে রেখে বাড়ি চলে এলাম।
বইখানিতে যা লেখা ছিল সেই ঘটনাই আজ লিখছি।
।। তিন ।।
অদ্ভুত ছাতা
জন আর ডেভিড নেমে আসছে দক্ষিণ ভারতে। মাছ তিনটে বর্তমানে কোথায় আছে তার একটা সুত্র তারা পেয়েছিল। সূত্রটার বাংলা করলে দাঁড়াচ্ছে—
দুটি সাগর যেথায় মেলে,
মহাসাগরে—
সবুজ জলের ধারা যাহার
হাঁটে তীরে তীরে।
ওরা মিলিয়ে দেখল, যে দুই সাগর মহাসাগরে মিলছে সে দুটো হচ্ছে আরব সাগর আর বঙ্গোপসাগর। তারা মিলছে ভারত মহাসাগরে। আরব সাগরের জল সবুজ। আর সেই মিলনের জায়গাটা হচ্ছে কেরালার একদম দক্ষিণে ত্রিবান্দ্রাম।
কিন্তু ত্রিবান্দ্রামে এসে তাদের মনে হল জায়গাটা বড়োই শহুরে। বেজায় লোকের ভিড়। এখানে ওই মাছগুলোর হদিশ পাওয়া যাবে না। তখন ওরা ঘুরতে ঘুরতে চলে এল আরও দক্ষিণে কোভালামে।
জায়গাটা একেবারে আরব সাগরের কূলে। বেশ নির্জন। জায়গাটা দেখেই ওদের মনে হল ঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছেছে। নির্জন হলেও উঁচু রাস্তার ওপর ছোটোখাটো রেস্তোরাঁ, হোটেল, দোকান সবই আছে। খড়ের টুপি, ঝিনুকের তৈরি নানারকম জিনিস বিক্রি হচ্ছে। ওরা সমুদ্রের ধার ধরে বালির ওপর দিয়ে পশ্চিমমুখো হেঁটে চলল।
তখন বেলা এগারোটা। বালি তেতে উঠেছে। রোদে চিকচিক করছে। সমুদ্রের তীর জনমানবশূন্য।
ওরা এগিয়ে চলেছে। এখন আর বাঁদিকে রাস্তায় দোকানপাট দেখা যাচ্ছে না। পথ যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে। তারপর শুরু হয়েছে নারকেল গাছ আর নারকেল গাছ। তা ছাড়া রয়েছে দারচিনি আর বড় এলাচের গাছ। একমাত্র আরব সাগরের মৃদু গর্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
ডেভিড কিছুটা হতাশ হয়ে বলল, এক এক সময়ে মনে হয় বুঝি আমরা মরীচিকার পিছনে ছুটছি।
জন বলল, সব কিছু অনিশ্চিত জেনেই তো আমাদের আসা। একেই তো বলে অ্যাডভেঞ্চার। নির্দিষ্ট জায়গা থাকবে, পৌঁছোতে হবে ঘড়ি ধরে, বড়ো হোটেলে খাবার—শোবার ব্যবস্থা থাকবে—তাহলে তো আর অ্যাডভেঞ্চার হয় না।
ডেভিড বলল, বাজে বকবক কোরো না তো। বেজায় খিদে পেয়েছে। একটা হোটেলে দেখেছিলাম রাইস আর ফাউল কারি পাওয়া যায়। একপ্লেট করে খেয়ে নিলে হত। এ দেশের এই খাবারটা মন্দ লাগে না।
জন বলল, আর একটু এগিয়ে দেখে আসি। তারপর ফিরে এসে হোটেলের ব্যবস্থা করব। তবে বন্ধু, এসব জায়গায় তোমার সাধের ফাউল কারি নাও জুটতে পারে।
কেন?
এটা তো টাউন নয়। দেখছ না জনমনিষ্যি নেই। এখানকার হোটেলে রাইস আর ফিশ জুটলেই যথেষ্ট মনে করতে হবে। আ—রে! ওটা কী? ওই যে দূরে বালির ওপর।
জিনিসটা একটা খোলা ছাতা।
লোক নেই, জন নেই, শুধু একটা ছাতা পড়ে আছে বালির ওপর। তাও সাধারণ ছাতা নয়, মস্ত বড়ো ছাতা। অত বড়ো ছাতা কেউ কখনো মাথায় দিয়েছে বলে মনে হয় না।
ওরা ছাতাটার দিকে এগোতে লাগল। দুজনের পিঠে বেশ ভারী কিটব্যাগ। কাঁধে ওয়াটার বটল। ফর্সা মুখ রোদে লাল টকটক করছে। মাথার চুল কপালে লুটোপুটি খাচ্ছে।
এখন ছাতাটা আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত ছাতা। কালো কাপড়ের গা দিয়ে চারিদিকে ঝুলছে সাদা কাপড়ের ফালি। এরকম সাদা কাপড়ের ফালি ঝুলিয়ে রাখার মানে যে কী ওরা তা বুঝতে পারল না। এটা কি ছাতার বাহার? এই যদি বাহার হয় তা হলে বুঝতে হবে ছাতার অধিকারীটি একটি আস্ত পাগল।
কিন্তু সেই পাগলটিই বা সমুদ্রের ধারে তাঁর ছাতাটি ফেলে রেখে কোথায় অন্তর্ধান করেছেন?
হঠাৎ মনে হল ছাতাটা মাঝে মাঝে একটু নড়ছে। ওরা লক্ষ করে দেখল ছাতাটা বাতাসে যে নড়ছে তা নয়। কেউ যেন ছাতার তলায় বসে মাঝে মাঝে নিজে নড়ছে আর ছাতাটাও সেই সঙ্গে নড়ছে।
কৌতূহলী হয়ে ওরা ছাতাটার দিকে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে ওরা তো অবাক। ছাতার নীচে দিব্যি একজন মানুষ ঘাড়—মুখ গুঁজে ছোটো ছোটো লাল কাঁকড়া ধরছে।
সমুদ্রের ধারে ওরকম অনেকেই কাঁকড়া ধরে। কিন্তু এই মানুষটি অদ্ভুত ধরনের। একে তো এতই রোগা যে মনে হয় সমুদ্রের হাওয়াতে উলটে পড়ে যাবে। তার ওপর অত বড়ো ছাতার বাঁটটা ডান—পা দিয়ে চেপে ধরে আছে। পায়ের নখও দেখবার মতো। লম্বা খাড়া খাড়া। কোনোকালে নরুণ ছোঁওয়ায় না। গায়ের রং যেন পুড়ে কালো হয়ে গেছে। কিন্তু তাই কি ওরা গা দেখতে পেল? গা দেখার উপায় নেই। এই গরমেও লম্বা গলাবন্ধ কোট। ঝুলটা এতই লম্বা যে তার ওপর দিব্যি বসে আছে। কোটের হাতাদুটো ঝুলে পড়েছে মণিবন্ধের নীচে পর্যন্ত। যেখানে কালো গ্লাভস দুটো হাতের চেটো, আঙুলগুলো ঢেকে রেখেছে। এ ছাড়া মাথায় কপাল পর্যন্ত ঢাকা ক্যাপ। চোখে গগলস। এইরকম ড্রেস, ওদের মনে হল, বদ্ধ পাগল ছাড়া আর কেউ পরতে পারে না।
তার ওপর ওই বিরাট বিচিত্র ছাতা। অত বড়ো ছাতা ব্যবহার করার একটি মাত্রই কারণ বোধ হয়—অমন চেহারাখানি কেউ যাতে চট করে দেখতে না পায়।
লোকটা গ্লাভস—পরা হাতে বালির মধ্যে থেকে এমনভাবে খপ খপ করে ছোটো ছোটো কাঁকড়াগুলো ধরছিল যে দ্রুত দৌড়েও বেচারিরা পালাতে পারছিল না।
লোকটা কাঁকড়া ধরছিল আর তার কাঁধের বিরাট ঝোলাটার মধ্যে পুরে ফেলছিল। পুরে ফেলবার আগে পুট পুট করে কাঁকড়ার দাঁড়াগুলো ভেঙে দিচ্ছিল। কাঁকড়াগুলো যন্ত্রণায় ছটফট করছিল।
জন আর ডেভিড সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা চমকে উঠে তাদের দিকে কালো চশমার মধ্যে দিয়ে এমনভাবে তাকাল যে ওরা থতমত খেয়ে গেল। আর তখনই ওরা আরও দুটি জিনিস আবিষ্কার করল। তার মধ্যে একটি—লোকটার সরু ছুঁচলো মুখ যেখানে এতটুকু মাংস নেই, স্রেফ চামড়ায় ঢাকা হাড়। আর দ্বিতীয়টি থুতনির নীচে কয়েকগাছি ছাগলদাড়ি।
কী চাই এখানে? মালায়ালম ভাষায় খ্যাঁকখ্যাঁক গলায় জিগ্যেস করল লোকটা।
যারা পর্যটক—বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায় তাদের নানারকম ভাষা মোটামুটি শিখে রাখতে হয়। জন আর ডেভিড যেদিন থেকে ঠিক করেছিল দক্ষিণ ভারত তাদের গন্তব্যস্থল তখন থেকেই তারা তামিল, তেলেগু ও মালায়ালম ভাষা কিছু কিছু শিখে নিয়েছিল।
জন বলল, কিছুই চাই না। বেড়াতে বেড়াতে এদিকে এসে পড়েছিলাম।
লোকটা অবিশ্বাসের সুরে বলল, বেড়ানোর আর জায়গা পাওনি, এখানে বেড়াতে এসেছ? আসা হচ্ছে কোথা থেকে?
জন মজা করে বলল, আজ্ঞে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপার থেকে।
লোকটা বোধহয় তার মানে বুঝল না। তবু খ্যাঁকখ্যাঁক করে বলল, বটে—বটে! তা হঠাৎ এখানে কেন? এখানে তো কেউ বেড়াতে আসে না। কী আছে এখানে যে এখানে বেড়াতে এসেছ?
লোকটা লোমহীন ভুরুতে ভাঁজ ফেলে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
ডেভিড চুপচাপ। তার যেন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। জনই হালকা সুরে বলল, আমরা ট্যুরিস্ট। সব জায়গাতেই ঘুরি। সব জায়গাতে ঘুরি বলেই তো এখানে এসে আপনার মতো একজনের দেখা মিলল। তা আপনি এই সব ছোটো ছোটো কাঁকড়া নিয়ে কী করবেন?
ঝাল—চচ্চড়ি করে খাব। আবার কী! তা এখানে উঠেছ কোথায়?
জন বলল, এখনও ঠিক করিনি। ফিরে গিয়ে করব।
লোকটা ভালো করে ওদের দুজনকে দেখে নিয়ে বলল, তা পয়সা খরচা করে এখানকার বাজে হোটেলে থাকতে যাবে কেন? আমার কাছেই থাকতে পারো যে ক’দিন ইচ্ছে।
জন ডেভিডের দিকে তাকাল। ডেভিড ইশারায় ‘না’ করল। জন ইংরিজিতে বলল, দেখাই যাক না গিয়ে।
ডেভিড চুপ করে রইল।
জন লোকটাকে বলল, তা মহাশয়, আমাদের মতো বিদেশিদের জন্যে আপনি এত কষ্ট করবেন কেন?
লোকটা বলল, তোমরা বিদেশি বলেই। তা ছাড়া আমি একা থাকি। তোমাদের মতো দু—দুটো তরতাজা ছেলে পেলে দুটো কথা বলে বাঁচব। নাও চলো। বলে লোকটা উঠে পড়ল। কাঁকড়া ভর্তি ব্যাগটা একটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। আর তখনই ওদের লক্ষ পড়ল ছাতার আড়ালে কাপড় চাপা দেওয়া আর একটা বেশ বড়োসড়ো ব্যাগ রয়েছে। সেটা সে দিব্যি তুলে নিল। ব্যাগটা যে বেশ ভারী তা বোঝা গেল।
লোকটা তার সেই বিরাট ছাতার আড়ালে একটা মাতালের মতো দু—পা ফাঁক করে অদ্ভুতভাবে হাঁটছিল। পায়ে ছেঁড়া ফাটা ভারী জুতো। বালির ওপর দিয়ে চলতে চলতে শব্দ হচ্ছিল ঘ—স—ঘ—স। ওরা যাচ্ছিল পিছু পিছু হাসাহাসি করতে করতে। হঠাৎ ডেভিড জনের হাতটা টেনে নিয়ে ইশারায় লোকটার কাঁধের বড়ো ঝোলাটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
জন চমকে উঠল।
ঝোলার মধ্যে থেকে সরু সরু গোটাকতক পা, একটা ল্যাজ দেখা যাচ্ছে। ওগুলো যে মরা কুকুর—ছাগলের তা ওদের বুঝতে বাকি রইল না।
কিন্তু ওই মরা কুকুর—ছাগল নিয়ে লোকটা কী করবে তা বুঝতে না পারলেও লোকটা যে মোটেই স্বাভাবিক নয় সে বিষয়ে ওদের সন্দেহ রইল না।
ডেভিড ফিসফিস করে বলল, এইরকম একটা লোকের সঙ্গে অজানা—অচেনা জায়গায় যাওয়া কি উচিত হচ্ছে?
জন বলল, দেখাই যাক না। তা ছাড়া ভয় কী—সঙ্গে তো এটা রয়েছে। বলে কোটের পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে ডেভিডকে দেখিয়ে নিল।
পিস্তল তো তারও কাছে আছে। তবু ডেভিড যেন ভয় পেল।
।। চার ।।
কে এই লোকটা?
আরও কিছুক্ষণ বালির ওপর দিয়ে হাঁটার পর সমুদ্রের ধার থেকে একটু ভেতরে কতকগুলো পাম গাছের আড়ালে যে বাড়িটার কাছে এসে ওরা দাঁড়াল সেটাকে বাড়ি বললে ভুল হবে। নিতান্তই টালির ঘর। তবে অনেকখানি জায়গা নিয়ে। টালির ঘর পাশাপাশি দুখানা। আর একটা ঘর একটু দূরে। ঘট দুটোয় যে জানলা আছে তা নিতান্তই ছোটো ছোটে। কেন ছোটো ছোটো জানলা তা ওরা বুঝতে পারল না। লোকটার সবই অদ্ভুত।
লোকটা সমস্ত পথ একটিও কথা বলেনি। বাড়ি এসে ওদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে দরজার তালা খুলে নিজে ভেতরে চলে গেল। তার বেশ কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে এল তখন ঝোলাগুলো নেই। ওরা বুঝতে পারল ঝোলার ভেতরের মহামূল্যবান জিনিসগুলো ওদের চোখের আড়ালে রেখে এল।
বাইরে বেরিয়ে এসে ওদের প্রথম ঘরটায় ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, তোমরা এই ঘরেই থাকবে। একটু রেস্ট নাও। তারপর খেতে দেব। বলে দরজাটা ঠেসিয়ে দিয়ে চলে গেল।
বেচারা ডেভিড। তার সেই কখন থেকে খিদে পেয়েছে। সে তো খিদের ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠল। সঙ্গে খানকতক বিস্কুট ছিল তাই খেতে লাগল।
ঘরে ঢুকে পর্যন্ত ওরা একটা পচা পচা গন্ধ পাচ্ছিল। এখন গন্ধটা কী—রকম উৎকট।
উঁঃ! নিশ্চয় ইঁদুর পচেছে। নাকে রুমাল চেপে ডেভিড বলল।
জন গম্ভীরভাবে বলল, পচা গন্ধটা কিন্তু লোকটার পিছনে পিছনে আসার সময়েই পেয়েছি।
ডেভিড বলল, ওর ওই ঝোলার মধ্যে কুকুর—ছাগলগুলো বোধহয় পচা ছিল।
না। জন বলল, পচা জন্তুর গন্ধ আলাদা।
ডেভিড বিস্কুট চিবোনো থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, তা হলে?
জন কী যেন ভাবতে ভাবতে বলল, অন্য কিছু।
প্রায় আধঘণ্টা পরে লোকটা দুটো শালপাতা এনে মাটিতে রাখল। তারপর চারখানা করে শুকনো রুটি আর কি এক ধরনের মাছভাজা দিয়ে গেল।
এবেলা এই খাও। ওবেলা ভাত রাঁধব। বাইরে জল আছে মুখ ধুয়ে নিও। বলে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ডেভিড বলল, উঃ কী গন্ধ! লোকটা ড্রেস বদলায়নি। যা পরেছিল তাই পরে আছে। হাতে গ্লাভস দুটোও শোভা পাচ্ছে।
জন বলল, এখন বুঝতে পারছ পচা গন্ধটা ওর গা থেকেই বেরোয়?
ডেভিড বলল, লোকটা বোধহয় কখনও চান করে না। অথচ কাছেই সমুদ্র।
ওরা শালপাতা দুটো কাছে টেনে নিল বটে কিন্তু খেতে পারল না। কেননা মাছভাজা বলে যেটা দিয়েছিল সেটা মাছই নয়। মাছ হলে তো কাঁটা থাকবে। এগুলোর কাঁটার বালাই নেই। কালো কালো নরম তুলতুলে। গা ঘিনঘিন করে উঠল।
ডেভিড বলল, এই যদি দিনের খাবার হয়, তাহলে রাত্রে না জানি আরও কী অপূর্ব খাবার জুটবে।
একটু পরে লোকটা ফিরে এল। ওরা যে কিছুই খায়নি তা দেখেও কিছুই বলল না। ওদের মনে হল লোকটা কম কথা বলে তার ওপর এখন কেমন অন্যমনস্ক। কিংবা অতিথির সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করতে হয় তা জানে না।
যাবার সময়ে লোকটা ওদের কতকগুলো নির্দেশ দিয়ে গেল।
আমি এখন ঘুমুতে যাচ্ছি।
তোমরা ঘরের মধ্যেই থাকবে।
যদি বা বেরোও ওইদিকে যে ঘরটা ওখানে কিছুতেই যাবে না। ওখানে আমার পুজোর ঘর।
রাত্রে আবার দেখা হবে।
লোকটা যেন হুকুম করে গেল। বলল ডেভিড।
আর লক্ষ করেছিলে ও যখন কথা বলছিল, কালো চশমার ভেতরে ওর চোখ দুটো কীরকম ঘোরাফেরা করছিল? যেন এখুনি কিছু করতে চায়।
কী করতে চায়? ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল ডেভিড।
জন তার উত্তর না দিয়ে ঘরটা ভালো করে দেখতে লাগল।
ঘরের মেঝেতে, দেওয়ালে অজস্র গর্ত। একটা বিছে কী স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে! দেওয়ালের কোণে কোণে ঝুল। বড়ো বড়ো মাকড়সা দেওয়ালের সর্বত্র বাসা বেঁধেছে। একটা দড়ি টাঙানো দেওয়ালের এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো। তাতে গুচ্ছের ময়লা কাপড়। একটা লম্বা কালো আলখাল্লা।
ডেভিড বলল, এখানে থেকে কাজ নেই। চলো পালাই। আমার যেন কেমন মনে হচ্ছে।
জন বলল, যেমনই মনে হোক, এসেছি যখন কষ্ট করে দু’দিন থেকে সেই মাছ তিনটের খোঁজ করি। আমার মনে হয় এই লোকটা হয়তো সন্ধান দিতে পারে। একবার শুধু মাছ তিনটেকে দেখা।
কিন্তু কী খাব? করুণ গলায় বলল ডেভিড।
জন বলল, সেই হোটেলগুলো তো খুব একটা দূরে নয়। শর্টকাট রাস্তা একটু খুঁজলেই পাব। চলো পেট ভরে আগে খেয়ে আসি।
খাবার কথায় ডেভিড খুব খুশি হল। তখনই দরজায় শেকল তুলে দিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল।
শর্টকাট রাস্তা ধরে গিয়ে ওরা একটা হোটেল ঠিক করল। সেখানে থাকা—খাওয়ার ব্যবস্থা।
পেট ভরে খাবার পর ডেভিড বলল, আর ওখানে গিয়ে কাজ নেই। লোকটাকে মোটেই ভালো লাগছে না।
জন বলল, দুটো দিন ওখানে থেকেই দেখা যাক না। তেমন বুঝলে হোটেলে চলে আসব।
আবার ফিরে এল ওরা।
চারদিক নিস্তব্ধ। লোকটা যে কোথায় ঘুমোচ্ছে কে জানে। ওরা এবার ভালো করে চারদিক দেখতে লাগল।
দূরের ওই বড়ো টালির ঘরটা নাকি লোকটার পুজোর ঘর। যাওয়া নিষেধ। কী পুজো করে এত গোপনে?
মরুক গে! বলে ওরা দুজন টালির ঘর দুটোর পিছনে চলে এল। হঠাৎ দেখল এক জায়গায় কতকগুলো শকুন উড়ছে। এখানেও তা হলে শকুন আছে!
কিন্তু শকুন উড়ছে কেন?
এগিয়ে গিয়ে ওরা যা দেখল তাতে চমকে উঠল। রাশি রাশি হাড় পড়ে আছে। কোনো কোনোটার গায়ে তাজা রক্ত লেগে। একটা মানুষের কঙ্কালও পড়ে আছে খণ্ড খণ্ড হয়ে।
এসব আবার কী? ডেভিড তাকাল জনের দিকে।
জন বলল, লোকটা খুনে। কিন্তু জীবজন্তুর হাড় কেন?
ডেভিড বলল, চলো আমরা ঘরে গিয়ে শুই। লোকটা যদি দেখে ফেলে তাহলে আর রক্ষে থাকবে না।
ওরা ঘরে ফিরে এল। একটা ছেঁড়া মাদুর ছিল। সেটাই পেতে শুয়ে পড়ল।
যতক্ষণ না ঘুম এল ততক্ষণ ওরা শুধু আলোচনা করতে লাগল—হাড়গুলো কীসের? মরা জন্তু—জানোয়ারগুলো এনে কোথায় রাখল? লোকটা কোথায় ঘুমোতে গেল?
ওদের ঘুম ভাঙল দরজা খোলার শব্দে। চেয়ে দেখল ঘর অন্ধকার। কখন সন্ধে হয়ে গেছে!
দরজাটা খুলে যেতেই একটু আলো এসে পড়ল। আলোটা কি শূন্যে ভাসছে?
একটু ঠাওর করতেই বোঝা গেল লোকটা গ্লাভস পরা হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকছে। সেই একই পোশাক, মাথায় কপালঢাকা টুপি, চোখে কালো চশমা। অন্ধকারে একেবারে মিশে গেছে। তাই শুধু আলোটাই দেখা যাচ্ছে।
দুপুরে বেরোওনি তো?
ডেভিডনা বলতে যাচ্ছিল, জন তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ, একটু বেরিয়েছিলাম।
লোকটা যেন বিরক্ত হল। বলল, কোন দিকে গিয়েছিলে?
যেখান থেকে এসেছিলাম সেই দিকে।
লোকটা একটু চুপ করে থেকে বলল, আমাকে না বলে পালাবার চেষ্টা কোরো না।
কথার স্বরে যেন ওয়ার্নিং—এর ধমক।
তোমাদের খাবার আনছি।
জন বলল, এত তাড়াতাড়ি খাব কী! এখন তো সবে সন্ধে।
লোকটা ওর ছাগলদাড়ি নেড়ে বলল, আমি তাড়াতাড়িই খেয়ে নিই। তোমরাও তাই খাবে। রাতে আমার অনেক কাজ। বলেই চলে গেল।
ওবেলার তুলনায় বলতে হবে ভালো খাবারই জুটেছিল। ভাতর আর ছোটো ছোটো কাঁকড়ার চচ্চড়ি। কিন্তু তাতে না আছে নুন, না আছে ঝাল।
কিন্তু ভাত—চচ্চড়ি কোথায় কখন রাঁধল?
যাই হোক রাতের খাওয়া তো চুকল। এখন? এখন গোটা রাত কী করবে? কত ঘুমোবে?
ঘুম না আসা পর্যন্ত ওরা নানারকম আলোচনা করতে লাগল।
লোকটা বলেছিল কথা বলার লোক নেই তাই নাকি এদের এখানে এনে তুলেছে।
এই কি কথা বলার নমুনা?
ডেভিড বলল, লোকটাকে মাছ তিনটের কথা জিগ্যেস করলে হয় না?
জন বললে, জিগ্যেস করলেও উত্তর দেবে না। দেখছ না লোকটা কথা বলে একটা একটা করে ঢিল ছোঁড়ার মতো। তা ছাড়া জিগ্যেস করব কখন?
একটু থেমে বলল, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে লোকটা আমাদের চোখে চোখে রাখছে।
ডেভিড বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
কিন্তু কেন?
।। পাঁচ ।।
প্রেতের ডাক?
গল্প করতে করতে আর সমুদ্রের ক্রমাগত ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে শুনতে কখন ওরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর মাঝরাতে হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল ডেভিডের। প্রথমে ও ঠিক বুঝতে পারেনি শব্দটা কীসের—কোথা থেকে আসছে।
শব্দটা খুব জোরে হচ্ছে তা নয়। কোনো মানুষের গলা থেকে ওরকম শব্দ হতে পারে না। তা হলে?
ডেভিড ভয় পেল। জনকে ঠেলে তুলল। ধড়মড় করে উঠে বসল জন।
কী হয়েছে?
ডেভিড নীচু গলায় বলল, একটা শব্দ ভালো করে শোনো।
জন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার ঘরে বসে শব্দটা কান খাড়া করে শুনল।
হুঁক—হুঁক—হুঁক—
মাঝে মাঝে থামছে আবার হচ্ছে।
কীসের শব্দ?
জন বলল, কোনো জন্তু—জানোয়ারের। হয়তো নিশাচর কোনো প্রাণীর। দাঁড়াও দেখছি। বলে উঠতে যাচ্ছিল, ডেভিড খপ করে ওর হাতটা চেপে ধরল, নড়ো না।
কিন্তু দুঃসাহসী জন জোর করে উঠতে যাচ্ছিল আর তখনই ওদের কানে এল আর একটা শব্দ—কেউ যেন ভারী জুতো পরে পা ঘেঁষটে ঘেঁষটে হাঁটছে তাদের জানালার ঠিক বাইরে।
যে হাঁটছে সে যে ওই লোকটা ছাড়া আর কেউ নয় তা বুঝতে বাকি রইল না। কেননা এখানে যখন ওরা লোকটার সঙ্গে আসছিল তখন বালির ওপর ওর জুতোর শব্দ এইরকমই হচ্ছিল।
জন আর ডেভিড নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। পায়ের শব্দটা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সমুদ্রের দিকে চলে গেল। ওরা আর ঘুমোতে পারল না।
পরের দিন দুপুরে দরজায় শেকল তুলে ওরা আবার বেরোল। এখন ওদের মাথায় ঘুরছে শুধু একটা কথাই—কাল রাত্তিরে যে অদ্ভুত শব্দটা শুনেছিল সেটা কীসের, কোথা থেকেই বা আসছিল?
হোটেলে ভাত খেয়ে (কেননা লোকটা যা খেতে দেয় তা খাওয়া যায় না) ওরা খানিকটা ঘুরল। কোনো পাখি—টাখির ডাক হলে হয়তো কোনো গাছে থাকতে পারে ভেবে ওরা গাছগুলো লক্ষ করতে লাগল। কিন্তু নারকেল গাছের ভিড় ছাড়া এখানে তেমন কিছু গাছ ছিল না। তেমন কোনো পাখিও চোখে পড়ল না।
ভাত দিতে আসার সময়ে লোকটা একটা কথাই জিগ্যেস করেছিল—রাতে কি তোমরা জেগেছিলে?
জন তখনই উত্তর দিল, না তো। বরং আমরা খুব আরামে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়েছিলাম। লোকটা যেন নিশ্চিন্ত হল।
সেই দিন রাতে ওরা ঠিক করল ঘুমোবে না। শব্দটা আবার হয় কি না শুনবে। সেই মতো আলো নিভিয়ে ওরা মাদুরের ওপর বসে রইল।
অনেক রাত্রে আবার সেই শব্দ হুঁক—হুঁক—হুঁক।
শব্দটা শুনেই জন পিস্তলটা খোঁজার জন্যে মোমটা জ্বালল। তারপর আলো নিভিয়ে পিস্তলটা হাতে নিয়ে জানলার দিকে এগিয়ে গেল। অন্ধকারে গা মিশিয়ে জন সাবধানে জানলার একটা পাট একটু ফাঁক করল। তারপর যা দেখল তাতে শিউরে উঠল। ডেভিডের হাতে টান দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে তাকেও দেখাল। তিনটে বড়ো বড়ো মাছ বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে সমুদ্রের দিকে দ্রুত ভেসে যাচ্ছে। তারা বারে বারে রং বদলাচ্ছিল—সেসব রং এতই উজ্জ্বল যে অন্ধকারেও জ্বলছিল। মাছগুলোর একটার মুখে একটা মানুষের কাটা হাত।
তারপরেই দেখা গেল কোট গায়ে, মাথায় কপালঢাকা টুপি সেই লোকটা ওই নিষিদ্ধ ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। কিন্তু লোকটা তো এত লম্বা নয়। এত অস্বাভাবিক লম্বা কি মানুষ হয়?
লোকটা কী একটা হাতে নিয়ে মাছগুলোকে তাড়া করল। মাছগুলো অমনি সমুদ্রের দিকে না গিয়ে সেই বড়ো ঘরটার দিকে ফিরে গেল। লোকটাও পিছু পিছু চলল। তারপরেই কোথায় যেন জলের মধ্যে ভারী কিছু পড়ার তিনবার শব্দ হল ঝপাং—ঝপাং—ঝপাং।
ডেভিড তখন কেমন একরকম হয়ে গেছে। কেবলই বলছে—কী দেখলাম! কী দেখলাম!
জন ডেভিডের হাত দুটো ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, Thank God! We are sucessfull! মনোবাঞ্ছা আমাদের পূর্ণ হয়েছে।
ডেভিড বলল, মাছগুলো কি সমুদ্রে গিয়ে পড়ল?
জন বলল, না বোধহয়। আমার মনে হচ্ছে চৌবাচ্চার মতো বদ্ধ কোনো জায়গার জলে পড়েছে। ডেভিড, আমি নিশ্চিত মাছ তিনটে এখন এই লোকটার ঘরেই আছে।
ডেভিড অবাক হয়ে বলল, মাছগুলো যে ভূমধ্যসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে আরব সাগরে এসে বর্তমানে ভারতবর্ষেই কারো কাছে আছে, এ তো বহুকাল আগে থেকেই শোনা। তা হলে এই লোকটার এখন বয়স কত?
জন বললে, তা ছাড়াও রহস্য এই যে, এই মাছ তো যে—সে লোকে ধরে রাখতে পারে না। তার অসীম ক্ষমতা থাকা দরকার। তা হলে এই লোকটা কে? এ কি সাধারণ মানুষ হতে পারে? ভারতীয় ঋষি—মুনিও নয়, চেহারা দেখেই তা বোঝা যায়। তা হলে?
ডেভিড বলল, আমরা আরও জানি, অনেক সময়ে প্রেতাত্মারা মানুষের আকার ধারণ করে থাকে। যারা শয়তানের আত্মা—হিংস্র প্রকৃতির তাদের সহজে মুক্তি হয় না। শোনা যায় এই মাছ তিনটেকে ধরে যদি যত্ন করে রাখতে পারে অর্থাৎ মাছ তিনটেকে খুশি করতে পারে তাহলে একদিন হয়তো প্রেতাত্মার মুক্তি হওয়া সম্ভব।
জন বলল, সে কথা সত্যি হলে ওই লোকটা একটা ভয়ংকর প্রেত ছাড়া অন্য কিছু নয়। আর আশ্চর্য এতকালের মধ্যেও তার মুক্তি হয়নি। তা হলে বুঝে দ্যাখো কী জিনিস লোকটা।
ডেভিড সভয়ে বলল, আমরা কি তাহলে সত্যিই একটা ভয়ংকর প্রেতাত্মার মুঠোয় রয়েছি?
কথা শেষ হতে না হতেই দরজায় দুমদাম শব্দ। কে যেন অধৈর্য ক্রোধে দরজা ঠেলছে। ডেভিড বিছানার তলা থেকে পিস্তলটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
জন ডেভিডকে পিস্তলটা পকেটে পুরে রাখতে বলে দরজার কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল, কে?
খোলো। একটা খ্যাসখেসে রাগি—রাগি গলা।
এক মিনিট চিন্তা করে জন দরজাটা খুলে দিল। দরজায় দাঁড়িয়ে লোকটা।
এত রাত্রে? জন রাগি—রাগি গলায় জিগ্যেস করল।
এত রাতে জেগে আছ কেন?
কোথায় জেগে আছি? দরজা ঠেললে তাই উঠে এলাম।
একটু আগে আলো জ্বালোনি?
জন একটু থতমত খেয়ে গেল। মুহূর্তে সামলে নিয়ে বলল, গায়ের ওপর দিয়ে বিছের মতো কী একটা যাচ্ছিল তাই মোমবাতি জ্বেলেছিলাম। তাতে হয়েছে কী? যা ঘরের ছিরি!
ঠিক আছে। কালই অন্য জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। বলেই লোকটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দুজনে আবার শুয়ে পড়ল। জন বলল, অন্য জায়গায় পাঠাবার মানে বুঝলে?
ডেভিড বলল, হ্যাঁ, কাল আমাদের ওই মাছেদের খাদ্য করে দেবে।
এমনি সময়ে আকাশে মেঘ ডেকে উঠল। ঝড়—বৃষ্টির পূর্বাভাস।
।। ছয় ।।
পরের দিন সকালে উঠেই ডেভিড বলল, আর দেরি নয়, চলো পালাই। এখনই পালানোর সুবিধে এই যে, লোকটা এখন ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু জন বলল, চলে যাবার আগে মাছ তিনটিকে ভালো করে দেখে যাব। মাছ তিনটে কোথায় আছে সেটা যখন জানা গেছে।
ডেভিডের থাকার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। ও জানে আজ লোকটা তাদের মারবেই।
জন বলল, দুপুরে লোকটার ঘুম বেশ গাঢ় হবে। তখনই মাছ তিনটেকে দেখে আমরা পালাব।
অগত্যা ডেভিডকে রাজি হতে হল। দুপুরে ওরা হোটেলে গিয়ে ভাত খেয়ে এল। তারপরে একটু গা গড়িয়ে নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল যখন তখন বিকেল। ইস! বড্ড দেরি হয়ে গেল। ওরা তাড়াতাড়ি ওদের কিটব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এল।
কিন্তু আকাশের অবস্থা এ কী! কেমন এক ধরনের ধোঁয়াটে মেঘ আকাশে দানা বাঁধছে। আবহাওয়াটা থমথমে। ঝড়ের পূর্বাভাস। কাল রাত্রেই মেঘ ডেকেছিল। কিন্তু ঝড়—বৃষ্টি হয়নি। আজ হবেই। আর সমুদ্রে ঝড় হলে সে যে কী ভীষণ তা তারা জানে।
তবু মাছ তিনটেকে ভালো করে দেখার জন্যে ওরা লোকটার সেই পুজোর ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল।
ঘরটার চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। ওরা হাইজাম্প দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সামনেই সেই ঘর। কিন্তু বড়ো বড়ো তালা লাগানো। দরজার কাঠও এত মজবুত যে ভাঙবার উপায় নেই। সে চেষ্টা করাও মূর্খামি।
কী আর করা যাবে? কিছু শোনা যায় কিনা ভেবে ওরা দরজায় কান লাগাল। স্পষ্ট শুনল জলের মধ্যে বিশাল কিছু যেন ঘোরাফেরা করছে। আর মাঝে মাঝে খট খট করে একটা শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দটা যে হাড় চিবোনো ছাড়া অন্য কিছুর নয় তা বুঝতে মিনিট পাঁচেক দেরি হয়েছিল।
এদিকে শোঁ শোঁ করে বাতাসের উন্মত্ত গর্জন। সমুদ্রও ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে।
মাছের হদিশ পেলেও সামনাসামনি মাছ দেখা হল না। সঙ্গে ক্যামেরা ছিল। সামনাসামনি দেখতে পেলে ছবি তুলে রাখত। সেটা হত ওদের কাছে মস্ত বড়ো প্রমাণ। কিন্তু তা হল না।
চলে যাবার জন্যে ওরা ঘুরে দাঁড়াল। চোখে পড়ল ওই বড়ো ঘরটার পিছনেই আর একটা ছোটো ঘর। ঘর না বলে কুঠুরি বলাই ভালো।
এখানে আবার কী আছে দেখার জন্যে ওরা সেই কুঠুরিটার দিকে এগিয়ে গেল। এমন নিশ্চিন্তভাবে ঘোরাঘুরি করছিল যেন ওরা ধরেই নিয়েছিল লোকটা আপাতত পৃথিবী থেকে উবে গিয়েছে। কতটুকুই বা জানতে পেরেছে সেই রহস্যময় লোকটা সম্বন্ধে? হঠাৎ এখুনি যদি সে এখানে এসে দাঁড়ায় তা হলে ওদের অবস্থা কী হবে সে বিষয়ে যেন ওদের ধারণাই নেই। বিপদ যখন টানে মানুষের তখন এইভাবেই মতিভ্রম হয়।
কুঠুরির দরজাটা ঠেসানো ছিল। সাবধানে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা।
সেই উৎকট পচা গন্ধ। আবছা অন্ধকার। মোমবাতি সঙ্গে নেই। পকেট থেকে লাইটারটা বের করে জ্বালল জন। কী আশ্চর্য! কাঁচামাটির সিঁড়ি ধাপে ধাপে নীচে নেমে গেছে।
এখানে কি গুপ্তধন আছে?
ওরা অন্ধকারেই সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। নরম ভিজে মাটি। পা স্লিপ করছিল। মাঝে মাঝে লাইটারটা জ্বালাতে লাগল।
এক জায়গায় এসে সিঁড়িটা শেষ হয়ে গেছে। জায়গাটা সমতল। কিন্তু স্যাঁতসেঁতে।
জন আবার লাইটারটা জ্বালল। ওই সামান্য শব্দ স্তব্ধ পাতালপুরীতে জোরে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। আর তখনই সেই আলোয় ওরা যা দেখল তাতে ওদের বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল।
My God! আর্তস্বর বেরিয়ে এল জনের গলা থেকে।
বহুকালের একটা শুকনো মড়া মাটিতে পড়ে আছে। তার চোখের কোটরে সাদা সাদা কী একরকম পোকা কিলবিল করছে। গায়ে কিছুই ছিল না। শুধু থুতনিতে রোঁয়ার মতো কয়েক গাছি চুল দেখে চিনতে পারল এই সেই রহস্যময় লোকটা।
উঃ! এই অশরীরীটার সঙ্গেই দুদিন কাটিয়েছি! ফিসফিস করে উঠল জন!
হঠাৎ কীসের একটা ঝাপটা লাগল ডেভিডের মাথায়। ভয়ে ডেভিড গোঙিয়ে উঠল….একটা মস্ত বড়ো চামচিকে।
কিন্তু ডেভিডের ওই সামান্য গোঙানিই কাল হল। হঠাৎ মড়াটা নড়ে উঠল। দু—বার কঙ্কাল শরীর নিয়ে এপাশ—ওপাশ করল। হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকিতে শব্দ হল খটমট—খটমট—
মাথাটা কয়েকবার উঠল—পড়ল। তারপর—তারপর কঙ্কালটা সোজা হতে লাগল….
জন ডেভিডের হাতে টান দিয়ে চাপা গলায় বলে উঠল—কুইক……
পড়িমরি করে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে কোনোরকমে ওরা ওপরে উঠে এল। পিছনে তখন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে দ্রুত শব্দ—খট—খট—খট—
একটা কঙ্কাল তাড়া করে ওপরে উঠে আসছে।
আবার হাইজাম্প। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙোল ওরা।
কিন্তু এ কী!
সমুদ্রের বুকে ঝড় উঠেছে। আরব—সাগরের সবুজ জল উন্মত্ত হয়ে আছড়ে পড়ছে বালির ওপর। সঙ্গে ঝড়। সে যে কী ভীষণ ঝড় যারা না দেখেছে তাদের বোঝানো যাবে না।
ওরা ছুটবে কি, চারদিক থেকে বালি এসে ওদের চোখে—মুখে বিঁধছে। তবু ওরা ছুটছে…পিছনে তাকিয়ে দেখল সেই ভয়ংকর মূর্তিটাও তাড়া করে আসছে—লংকোট নেই, টুপি নেই, হাতে গ্লাভস নেই, চশমা নেই।
ওরা জোরে ছুটতে পারছে না। বালিতে পা বসে যাচ্ছে। তবু ছুটছে তো ছুটছেই।
এদিকে বিশাল বিশাল ঢেউ এসে তটভূমিতে আছড়ে পড়ছে। তার ফেনাও এতদুর এসে ওদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে।
ওরা শর্টকাট রাস্তা ধরে সেই হোটেলের দিকে ছুটছে। উঁচু রাস্তায় উঠে ওরা দেখল চারিদিক শুনশান। তখনও সন্ধে হয়নি। এরই মধ্যে ঝড়র আর সমুদ্রের ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসের ভয়ে সবাই দরজা—জানলা বন্ধ করে দিয়েছে।
ওরা তখন নিজেদের হোটেলে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল।
শেষে দরজা খোলা হল। হোটেলের ম্যানেজার খুব ধমক দিল, এই ঝড়ে কেউ বাইরে থাকে!
সারারাত দুর্যোগের পর সকাল হল। এখন আর মেঘ নেই, বৃষ্টি নেই, ঝড় নেই। দিব্যি রোদ উঠেছে।
দেশে ফিরে যাবার আগে ওরা সমুদ্রের ধারে নেমে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ওদের গত দু—দিনের আশ্রয়টার সন্ধান করল।
কিন্তু কোথাও কিছু নেই। লোকটার সেই ‘ঠাকুরঘর’টি পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
মাছগুলো?
সেগুলোও বোধ হয় এই জলোচ্ছ্বাসের সুযোগে আবার অতল সমুদ্রে আশ্রয় নিয়েছে। কঙ্কালটাও বোধহয় সমুদ্রে ভেসে গিয়েছে। কে জানে এতদিনে মুক্তি পেল কি না।
হঠাৎ দূরে কিছু একটা ওদের নজরে পড়ল। একটা বিরাট ছাতা সমুদ্রের বাতাসে বালির ওপর দিয়ে প্রায় উড়ে যাচ্ছে। ছাতার নীচে কেউ নেই।
২০১৮, নভেম্বর, শুকতারা
__