ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে

নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে

সেবার পুজোর সময়ে পুরী যাব বলে অনেক আগেই ট্রেনের রিজার্ভেশান করে রেখেছিলাম। কিন্তু পরে হোটেল বুক করতে গিয়ে কোথাও জায়গা পেলাম না। মহা মুশকিল!

তবু যেহেতু টিকিট কাটা হয়ে গেছে তাই ‘জয় জগন্নাথ’ বলে হাওড়া থেকে জগন্নাথ এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। আশা—পুরীতে নেমে পান্ডাদের ধরে কোথাও—না—কোথাও একটা জায়গার ব্যবস্থা করে নিতে পারব।

পান্ডারা ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সেসব জায়গা পছন্দ হল না। আমি এখানে অন্তত এক মাস থাকব। জায়গাটা সমুদ্রের কাছে না হলেও চলবে। কিন্তু ফাঁকা হওয়া চাই। এর আগে অনেক বারই পুরী এসেছি। সমুদ্রের ধারে অনেক হোটেলেই থেকেছি। কাজেই সবসময়ে সমুদ্র না দেখলেও চলবে। চাই একটু নতুনত্ব।

তা পুরীর এক পান্ডা আমার জন্যে একটা বাসা ঠিক করে দিল। বাসাটা পুরী টাউন থেকে কোনার্কের দিকে দু’ কিলোমিটার মতো দূরে।

জায়গাটা আমার বেশ পছন্দ হল। যেরকমটি চেয়েছিলাম সেইরকম নিরিবিলি। সামনে দিয়ে কোনার্কে যাবার কংক্রিটের রাস্তা। মাঝে মাঝে কাজুবাদামের গাছ। বেশ কিছু বাংলো প্যাটার্নের বাড়িও আছে।

আমার বাসাটিও একলা। দুখানি ঘর। ছিমছাম। সঙ্গে একটি কাজের লোক। সকালে—বিকেলে দু’ মাইল রাস্তা হেঁটে সমুদ্রের ধারে বেড়িয়ে আসি। হাতে থাকে ছড়ি আর টর্চ।

দিন সাতেকের মধ্যে পাড়ার কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। সকলেই বাঙালি। একজন শুধু ওড়িয়া। তিনিও ভালো বাংলা বলতে আর বুঝতে পারেন। ভদ্রলোকের নাম মহেশ্বর মহাপাত্র। আমি কলকাতা থেকে আসছি আর একজন রিটায়ার্ড অধ্যাপক জেনে তিনি খুব খাতির করলেন। তাঁর বাড়িতেই রোজ সন্ধেবেলা আড্ডা বসত। সকলেই বাঙালি প্রতিবেশী। সেখানে আমারও একটা চেয়ারের ব্যবস্থা হল।

প্রতিদিনই নানারকমের আলোচনা হতো। মহাপাত্র মশাই—ই এখানকার পুরোনো বাসিন্দা। বাঙালি প্রতিবেশী পেয়ে খুব খুশি। কিন্তু এমন এক—একজন উটকো লোক পাড়ায় এসে পড়ে, তাদের তিনি মোটেই সুনজরে দেখেন না। যেমন—

বলেই একটু থামতেন। বাকিটা শেষ করতেন অন্যরা।

ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা পিছনের দিকে ঠেলে কোনো একজন অনুপস্থিত ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে কেউ বলতেন—ওঁর কথা বলছেন তো? উনি তো একটা পাগল!

আর একজন বললেন—পাগল কেন হতে যাবে! আসলে সাধু—সন্ন্যেসী মানুষ তো। তাই ওঁদের জীবনধারার সঙ্গে আমাদের মেলে না। সেইজন্যেই কারো সঙ্গে মেশেন না।

অমনি আর একজন ফোঁস করে ওঠেন—সাধু না আরও কিছু! সাধুর বেশে নিশ্চয়ই কোনো চোর—ডাকাত। যে—কোনোদিন দেখবেন আমার—আপনার বাড়ি ডাকাতি হয়ে যেতে পারে।

ডাকাতির কথা শুনেই সবার মুখ চুন। কেননা ডাকাত পড়লে বাঁচাবার কেউ নেই। এখানে কাছেপিঠে কখনো পুলিশ দেখা যায় না। ওঁদের কথাবার্তা শুনে যেটুকু বুঝলাম তা এই—মাস কয়েক হল কাছেই একটা বাড়িতে একজন স্বামীজি গোছের লোক এসেছেন। যে বাড়িটি তিনি ভাড়া নিয়েছেন সেটা একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। চারিদিকে ঝোপজঙ্গল। এত জায়গায় এত বাড়ি থাকতে ওই বাড়িটাই কেন যে তাঁর পছন্দ হল এটাই রহস্য। বাড়িটা আবার নিজের পয়সায় সারিয়ে—সুরিয়ে বাসযোগ্য করে নিয়েছেন। কোনো ভাড়াটে নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচা করে এমন করে সারায় নাকি?

রোজ ভোর আর সন্ধেবেলায় কাঁসর—ঘণ্টা বাজিয়ে তিনি পুজো করেন। কী পুজো করেন কে জানে!

তিনি বড়ো একটা বাড়ি থেকে বেরোন না। সারা দিন একা একা কী করেন কেউ জানে না। যদিও বা এক—আধবার বেরোতে দেখা যায়—তা তিনি কারও দিকে ফিরে তাকান না। এমনি দাম্ভিক!

এ হেন একজন লোককে নিয়ে যে নানা কথা উঠবে তা তো স্বাভাবিক।

কয়েকদিন পর আরও কিছু রটনা কানে এল। অনেকেই নাকি ওই পথ দিয়ে যেতে যেতে শুনেছেন দিনে দুপুরে বা রাত্তিরে স্বামীজি কারো সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলছেন। কী কথা বলেন তার দু—একটা শ্রোতাদের কণ্ঠস্থ। যেমন—

–No no don’t go out.

–Don’t open the window.

–No fear. I am here.

মজার ব্যাপার এই কথাগুলো তিনি একাই বলেন। কারও উত্তর শোনা যায় না।

এই থেকে অনেকের ধারণা হয়েছে লোকটা সত্যিই পাগল। কিংবা—অন্য কোনো ব্যাপার।

অন্য ব্যাপার আর কী হতে পারে যখন, যার সঙ্গে তিনি কথা বলছেন সে অদৃশ্য!

শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

—কী বলতে চাইছেন মহাপাত্র মশাই? আমি জিজ্ঞেস করি।

উনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, কী বলতে চাই এখনো বুঝতে পারছেন না? উনি কোনো তান্ত্রিক কিংবা ওঝা। বাড়িতে ভূত পুষে রেখে দিয়েছেন। দরকার বুঝলেই আমার—আপনার পিছনে ভূত লেলিয়ে দেবেন।

সবাই শুনে স্তম্ভিত। এতটা কেউই ভাবেননি।

আমি অবশ্য কিছু না বলে হাসলাম। ভূত কুকুর—বেড়ল কিনা যে ঘরে পুষে রাখবে!

যাই হোক, খুব কৌতূহল হল। ঠিক করলাম একদিন স্বামীজির সঙ্গে দেখা করবই।

ঝোপের মধ্যে প্রায়—লুকনো পুরনো একতলা ছোট্ট বাড়িটা দেখেই মনে হল, এ বাড়িতে যিনি শখ করে থাকতে পারেন তিনি আর যাই হোন সাধারণ মানুষ নন।

তখন বিকেল চারটে। এরই মধ্যে জায়গাটা যেন রহস্যময় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।

দরজায় কড়া নাড়তেই স্বামীজি দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ালেন।

লম্বা, ফর্সা চেহারা। শক্ত শরীর। বড়ো বড়ো সুন্দর চোখ। ন্যাড়া মাথা। গায়ে গেরুয়া ফতুয়া, পরনে গেরুয়া রঙে ছোবানো ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। পায়ে কাঠের খড়ম।

এক নজর ঘরটা দেখে নিলাম। দেওয়ালের কোলঙ্গায় পর্দার মতো লাল সালুর আড়ালে তাঁর ছোট্ট ইষ্ট দেবতা। সে দেবতা কে দূর থেকে তা বোঝা গেল না। সামনেই ঘণ্টা, শাঁখ। ওদিকের দেওয়ালের কোণে মস্ত একটা ঝকঝকে ত্রিশূল। দেখে ভয় হয়। ওই ত্রিশূল দিয়ে স্বচ্ছন্দে মানুষ মারা যায়।

স্বামীজিকে বিনম্র নমস্কার করলাম। তিনিও গম্ভীরভাবে প্রতি—নমস্কার করলেন। আমায় দেখে এতটুকু অবাক হলেন না।

গুরুগম্ভীর স্বরে ‘আসুন’ বলে তিনি আমায় ঘরে নিয়ে এসে আসন পেতে বসতে দিলেন।

দেখলাম এ ঘরে তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই শোবার চৌকিটি ছাড়া।

—তা হলে আপনিই শেষ পর্যন্ত আমার কাছে এলেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আমাকে এর আগে দেখেছেন নাকি?

উনি একটু হাসলেন। বললেন, সবাইকেই দেখি, সবাইকেই চিনি। কে কী বলে তাও জানি। আপনার নাম তো অনিমেষ চৌধুরী?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কলকাতা থেকে আসছেন? রিটায়ার্ড প্রফেসার?

আমি তো স্তম্ভিত।

উনি একটু হেসে বললেন, অবাক হবার কিছু নেই। আমি ঘর থেকে কম বেরোলেও মোটামুটি পাড়ার খবর রাখি।

একটু থেমে বললেন, আপনি জানতে এসেছেন সত্যিই এখানে ভূত আছে কিনা। তাই তো?

আমতা—আমতা করে বললাম, লোকে নানা কথা বলে। তাই—

—ভালোই করেছেন। আড়ালে গুজগুজ—ফুসফুস না করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করাই উচিত। আপনার ভদ্রতা, আপনার সৎ সাহসের প্রশংসা করি। দাঁড়ান, আসছি।

বলে তিনি ভেতরে উঠে গেলেন।

একটু পরে একটা সাদা পাথরের গেলাসে বেলের সরবত নিয়ে এলেন।

—আমার এখানে চায়ের পাট নেই। সামান্য একটু—

বলে গেলাসটা আমার সামনে রাখলেন।

সরবত খাওয়া হলে তিনি বললেন, তাহলে আপনি আবার কথা সত্যিই শুনতে চান?

—যদি অনুগ্রহ করে বলেন, তাহলে কৌতূহল মেটে।

—অবশ্যই বলব। তবে একটা শর্ত—

—বলুন।

—যে কথা বলব তা এখানে কারো কাছে গল্প করবেন না। কথা দিন।

—দিলাম।

তারপর উনি শুরু করলেন ওঁর কথা। প্রথমেই বললেন, আমি বরাবরই যে সাধুজীবন যাপন করছি তা নয়। আমিও একদিন ঘোর সংসারী ছিলাম। তারপর শোকে—তাপে বিপর্যস্ত হয়ে সব ছেড়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

শুনে অবাক হবেন, তীর্থ দর্শনের চেয়ে দেশে যেখানে যত বড়ো বড়ো কবরস্থান আছে সেসব জায়গাতেই যেতে পছন্দ করতাম।

জিজ্ঞেস করলাম—কেন? আপনি কি ভূত—প্রেত নিয়ে গবেষণা করেন?

উত্তরে উনি হাসলেন একটু। বললেন—না। ভূত—প্রেতে আমার কোনো বিশ্বাসই ছিল না। আমি শুধু কবরের গায়ে লাগানো পাথরের ফলকের ওপর খোদা লেখাগুলো পড়তাম। কার কি নাম, কবে, কোথায় মারা গেছে ইত্যাদি। পড়তাম আর কল্পনা করতাম—কতজনকে কাঁদিয়ে এরা একদিন চোখ বুজেছিল। আবার, যারা সেদিন কেঁদেছিল তারাও হয়তো আজ আর কেউ নেই।

স্বামীজি আবার একটু থামলেন। তারপর বললেন, আসল কথা কি জানেন অনিমেষবাবু? আমি নিজে শোকার্ত স্বামী, শোকার্ত পিতা। তাই অন্যের শোক অনুভব করতে পারতাম। তা সে চেনাই হোক আর অচেনাই হোক।

একটু থেমে বললেন, কলকাতায় গেলে আমার সবচেয়ে বেশি আকর্ষণের জায়গা ছিল পার্ক স্ট্রিটের পুরনো সিমেট্রিটা। ওই পুরোনো কবরখানাটা আপনি দেখেছেন?

—দেখেছি। বাইরে থেকে।

—বাইরে থেকে কিছু বোঝা যাবে না। ভেতরে যাবেন। পাঁচিল ঘেরা বিরাট জায়গা জুড়ে কত—না গাছ। বোধহয় আমগাছই বেশি। তারই ঠান্ডা ছায়ায় নিচে নানারকমের মনুমেন্ট। তারই তলায় ঘুমিয়ে আছে কত মানবাত্মা। তারা ওখানেই শুয়ে আছে প্রায় দেড়শো বছর ধরে। অদ্ভুত জায়গা। যদি যান দেখবেন শান্তি পাবেন।

তা আমি সেখানে প্রায়ই যেতাম। আর ঘুরে ঘুরে পাথরের মনুমেন্টের গায়ে লেখাগুলো পড়ে মনে মনে সেই মৃত মানুষদের সঙ্গে আলাপ করে নিতাম। উঠে আসতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু পাঁচটার পরই গেট বন্ধ হয়ে যায়। ওখানে তখন আর কারও থাকার অধিকার নেই। এখন অবশ্য মানুষের ভয়—ডর—বিবেকবোধ কমে যাচ্ছে। তাই নিষ্ঠুর, লোভী এক শ্রেণির মানুষ রাতের অন্ধকারে পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকে কবরের ওপরের দামি দামি পাথরের ফলক ভেঙে নিয়ে যায়। প্রচুর টাকায় সেগুলো বিক্রি করে।

আমি খুব দ্রত কথা বলছি, আপনার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?

—কিছুমাত্র না। আপনি বলে যান।

—এখানে প্রায়ই আসতে আসতে সিমেট্রির দারোয়ানের সঙ্গে আমার বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল। লোকটি খুব ভালো। তবে মাঝে মাঝে ওর কাছে একজন অন্যদেশীয় লোক আসত। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া চেহারা। তার পরনে থাকত কালোরঙের কুর্তা আর ঢিলে পাঞ্জাবি। মাথায় পাগড়ি। চোখদুটো ছিল সাপের চোখের মতো হিংস্র। তাকে আমার মোটেই ভালো লাগত না। সেও যে আমায় পছন্দ করত না তা তার চাউনি দেখেই বুঝতে পারতাম। কিন্তু কেন লোকটা আমায় পছন্দ করত না তা আমি জানি না।

একদিন কবরখানায় ঘুরতে ঘুরতে একটা মনুমেন্টের কাছে এসে তার গায়ে লেখাটা পড়লাম।

১৮০১ সালে মেরিয়া লুইসা নামে কোনো একটি চোদ্দো বছরের মেয়ে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। তারা বাবা এখানে একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন।

মাত্র চোদ্দো বছরের মেয়ে! আহা!

সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের মেয়েটার কথা মনে পড়ল। সেও চোদ্দো বছর বয়েসে মারা গিয়েছিল। আমার মনে হল আমার মেয়েই যেন এখানে শান্তিতে শুয়ে আছে।

তারপর থেকে কলকাতায় এলেই আমি মেরিয়া লুইসার কবরের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম।

স্বামীজি এবার উঠে ঘরে আলো জ্বেলে দিলেন।

তারপর বলতে লাগলেন—একদিন বসে থাকতে থাকতে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সামান্য একটু শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম সুন্দরী একটি মেয়ে কবরের ফলকের আড়ালে দেখা দিয়েই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কী ব্যাপার!

তখনই উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিকে খুঁজলাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।

অথচ—আমি তাকে পরিষ্কার দেখেছি। ফর্সা টকটকে রঙ, কাঁধ পর্যন্ত পশমের মতো নরম কটা চুল, পরনে স্কার্ট, বয়েস বছর চোদ্দো। মুখে করুণ হাসি।

কে এই মেয়ে? মেরিয়া লুইসা নয়তো? এতকাল পরেও তার আত্মা কি নতুন দেহ ধারণ করেনি?

এ কী রহস্য!

স্বামীজি একটু থামলেন। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি নড়েচড়ে বসলাম।

—তারপর থেকে যখনই আমি পার্ক স্ট্রিটের ওই কবরখানায় আসি, ওখানেই আমি ব্যাকুল হয়ে বসে থাকি, যদি আর একটিবার তার দেখা পাই।

স্বামীজি আবার একটু থামলেন। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, অনিমেষবাবু, আপনার শুনতে ইচ্ছে করছে তো?

বললাম—নিশ্চয়ই।

—একদিন অমনি বসে আছি, হঠাৎ পিছনে শুকনো পাতার ওপর খসখস শব্দ। কেউ যেন এদিকে আসছে।

চমকে ফিরে দেখলাম সেই ভিনদেশি ভয়ংকর লোকটা আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমায় কর্কশ গলায় হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল—তুমি এখানে রোজ কী করতে আস?

তার বলার ভঙ্গিতে আমারও রাগ হল। বললাম—আমি কেন আসি তা তোমায় বলতে যাব কেন?

ও বলল, তোমার মতলব আমি বুঝি। তবে তুমি যা ভাবছ তা হতে দেব না। সাবধান!

বলে সে চলে গেল।

আমি তো অবাক। আমার আবার মতলব কী? আমি শুধু মেয়েটিকে দেখতে চাই।

ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে দারোয়ানকে সব কথা বলে জিজ্ঞেস করলাম—লোকটা কে হে?

দারোয়ান বলল, কিছুদিন ধরে আসছে। আমার সঙ্গে গল্প করে। ভেতরে ঘুরে বেড়ায়। ওঝার মতো ভূত—প্রেত নামায়, বশ করে।—এইসব তো বলে। আবার বিশ্বাস হয় না। তবে লোকটাকে আমারও ভালো লাগে না।

—তা হলে লোকটাকে ঢুকতে দাও কেন?

দারোয়ান খৈনি টিপতে টিপতে বলল, কী করব? যে কেউই তো ঢুকতে পারে। তবে পাঁচটা পর্যন্ত।

তারপর আর কয়েক দিন এসে কলকাতার বাইরে চলে যাই। অনেক দিন আর আসা হয়নি।

এই পর্যন্ত বলে তিনি থামলেন। বললেন, সন্ধে হয়ে গেছে। আমার নিত্যকর্মটি সেরে নিই।

স্বামীজি উঠে গেলেন। তারপর প্রায় পনেরো মিনিট ধরে শাঁখ—ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো করে ফিরে এসে আবার বলতে শুরু করলেন।

তিনি এরপর যা বলে গেলেন তা এইরকম—

প্রায় বছরখানেক পর স্বামীজি আবার একদিন সেই সমাধিক্ষেত্রে এলেন।

শীতকাল।

বেলা তখন প্রায় দুটো। রোদের তেমন তেজ নেই। দারোয়ান সে সময়ে ছিল না। হয়তো বিড়ি—টিড়ি কিনতে গিয়েছিল।

স্বামীজি তাড়াতাড়ি মেরিয়া লুইসার সমাধির কাছে এগিয়ে গেলেন। লুইসাকে দেখার জন্যে তিনি ব্যাকুল। কিন্তু যা দেখলেন তাতে তাঁর চক্ষুস্থির! সমাধিটা ভেঙে তছনছ। দামি পাথরের ফলক উধাও।

তিনি তখনই ছুটে এলেন দারোয়ানের কাছে। তখন দারোয়ান ফিরে এসেছে। তাকে জিজ্ঞেস করে স্বামীজি জানলেন—কয়েকদিন আগে রাত্রে চোর এসে সমাধি ভেঙে পাথর নিয়ে চলে গেছে।

স্বামীজি বিমর্ষমুখে আবার সেই ভাঙা সমাধির কাছে এসে বসলেন।

কতক্ষণ বসে রইলেন। তারপর ক্রমে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ল। একে শীতকালের বেলা, তার ওপর গাছে ঢাকা সমাধিক্ষেত্র। দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে এল। তিনি উঠব—উঠব করছেন, হঠাৎ দেখলেন সেই মেয়েটি একটা গাছের আড়াল থেকে চোখ মুছতে মুছতে তাঁর দিকে আসছে। অল্প ঘষা কাচের মধ্যে দিয়ে কাউকে যেমন আবছা দেখা যায়, একেও তেমনি দেখা যাচ্ছিল।

—লুইসা!

মেয়েটি খুব নীচু গলায় ইংরিজিতে অল্প কয়েকটি কথা বলল।

—থাকবার জায়গা ভেঙে দিয়েছে।

—ঘুরে বেড়াচ্ছি।

—একটা শয়তান আমার পিছনে লেগেছে।

—ভয় পাচ্ছি…

স্বামীজি স্পষ্ট তার কথা শুনে অবাক। একটু সামলে নিয়ে বললেন, আমি ছিলাম না…আজই এসেছি…কালই তোমার জায়গা নতুন করে গেঁথে দেবার ব্যবস্থা করব।

এমনি সময়ে দারোয়ান হাঁকল—বাবুজি! পাঁচটা বাজল।

—হ্যাঁ, যাই। স্বামীজি চেঁচিয়ে সাড়া দিলেন।

—শোনো লুইসা, ভয় পেও না। আমি কালই ব্যবস্থা করব।

উত্তরে মেয়েটি বোধহয় নিশ্চিন্ত হতে পারল না। দু’বার মাথা নেড়ে যেন বোঝাতে চাইল—এখানে আর থাকতে পারবে না। তারপর মিলিয়ে গেল।

সিমেট্টি থেকে চিন্তিত মনে বেরিয়ে এলেন স্বামীজি। হঠাৎ একটা কনকনে বাতাস মুহূর্তের জন্যে তাঁকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। তিনি অবাক হলেন। যদিও এটা পুরোদস্তুর শীতকাল তবু মুহূর্তের জন্যে এমন ঠান্ডা বাতাস বইল কেন?

তিনি হাঁটতে লাগলেন পার্ক স্ট্রিট ধরে। পার্ক স্ট্রিট থেকে ঢুকলেন রডন স্ট্রিটে।

জায়গাটা খুবই নির্জন। স্বামীজি হনহন করে হাঁটছেন তাঁর বাসার দিকে। এরই মধ্যে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন তাঁর পিছন পিছন আসছে। তিনি তখনই ঘুরে দাঁড়ালেন।

না, কেউ নেই।

কেন কে জানে তিনি একটু সাবধান হলেন।

এরকম হল আরও দু’বার। তিনি স্থির বুঝলেন, কেউ তাঁর পিছু নিয়েছে। কিন্তু তাঁর মতো নিঃস্ব মানুষ—যাঁর টাকাপয়সা কিছুই নেই, তাঁর পিছু নেবার কারণ কী?

আবার সেই পায়ের শব্দ—এবার বেশ স্পষ্ট। তিনি তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘোরালেন। দেখলেন বেশ দূরে একটা লম্বা মতো লোক। হ্যাঁ, কবরখানার সেই লোকটাই সতর্কভাবে তাকে অনুসরণ করছে।

কিনতু…সে তো বেশ দূরে রয়েছে। খুব কাছে পরপর তিন বার—সেটা তবে কার পায়ের শব্দ?

তিনি আর ভাবতে পারলেন না। তাঁর মতো মানুষেরও কীরকম ভয় করতে লাগল। তিনি আরও জোরে হাঁটতে লাগলেন যাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে পারেন।

একসময়ে তিনি বাড়ি এসে পৌঁছলেন। তাড়াতাড়ি তালা খুলে ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। আলো জ্বাললেন। জানালাগুলো খোলা ছিল, চটপট বন্ধ করে দিলেন।

তারপর রাত ন’টার পর সামান্য কিছু খেয়ে যখন মশারি টাঙিয়ে শুতে যাবেন, দেখলেন মশারির বাইরে ছায়া—ছায়া মূর্তি নিয়ে মেয়েটি দাঁড়িয়ে।

স্বামীজি চমকে উঠে বসলেন।

আরে সব্বনাশ! ও কী করে এখানে এল? তা হলে কবরখানা থেকে বেরিয়ে সেই যে কয়েকবার হালকা পায়ের শব্দ পাওয়া গিয়েছিল সেটা এরই।

—তুমি এখানে?

—তোমার সঙ্গে সঙ্গেই তো আসছি।

—কেন?

—বাঃ রে! আমি থাকব কোথায়? ওখানে চোরে আমার ঘর ভেঙেছে, শয়তান ফাঁদ নিয়ে আমায় ধরার জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই!

স্বামীজি মাথা চুলকে বললেন, কিন্তু তুমি মৃত, আমি জীবিত। একসঙ্গে থাকা সম্ভব কী করে?

মেয়েটি একটু হাসল। বলল—No problem uncle.

—তবু—স্বামীজি চিন্তা করতে লাগলেন।

—বেশ, তবে থাকো। কিন্তু থাকবেটা কোথায়?

তার উত্তর না দিয়ে কিশোরীটি রিনরিনে গলায় বলল, আমাকে নিয়ে থাকতে তোমার কি ভয় করবে?

স্বামীজি ঢোঁক গিলে বললেন, না—না, তোমাকে আর ভয় কীসের? তুমি তো আমারই মেয়েটার মতো।

—না আঙ্কেল, মৃত আত্মাকে সকলেই ভয় পায়। আমি আমার দাদাকে খুব ভালোবাসতাম। মরে গিয়েই দাদাকে দেখা দিলাম। ও তখন কাঁদছিল। কিন্তু আমাকে দেখেই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

স্বামীজি তখন বোধ হয় অন্য কথা ভাবছিলেন। সেই একই সমস্যার কথা তুললেন।

—তুমি থাকবে কোথায়?

—আমার শোবার জায়গা আমি করে নিচ্ছি। বলে মেয়েটি সুরুৎ করে চৌকির নীচে চলে গেল।

 এ এক অদ্ভুত অবস্থা। যে চৌকিতে স্বামীজি শুয়ে রয়েছেন তারই নীচে একটি প্রেতাত্মা! হোক সে কিশোরী তবু তো সে মানুষ নয়। তার দাদাও বোনকে দেখে ভয় পেয়েছিল।

অনেকক্ষণ ঘুমোতে পারেননি স্বামীজি। বারে বারেই চৌকির নীচে উঁকি দিয়ে দেখেছেন। না, কিচ্ছু নেই। ফাঁকা—যেমন ছিল। শুধু জায়গাটা বরফের মতো ঠান্ডা।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন খেয়াল ছিল না। হঠাৎ কীসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা আসছে মাথার দিকের জানালার কাছ থেকে। তিনি মশারির ভেতর থেকেই টর্চ জ্বাললেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠল।

দেখলেন কবরখানার সেই ভয়ংকর লোকটা দু’হাতে জানলার শিকগুলো উপড়ে ফেলবার চেষ্টা করছে…

স্বামীজি লাফ দিয়ে উঠে দেওয়ালের কোণ থেকে তাঁর ত্রিশূলখানা নিয়ে ছুড়ে মারলেন। জানলার শিকে লেগে ত্রিশূলটা ঝনঝন করে মাটিতে পড়ে গেল। আর ধুপধাপ শব্দ করে লোকটা ছুটে পালাল।

এরপরেও বার তিনেক ওই ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করছিল লোকটা—যাকে লুইসা বলে শয়তান। কিন্তু ঘরে ঢুকতে পারেনি। সবসময়ে স্বামীজি বাড়ি পাহারা দিয়েছেন।

ক’দিন পর স্বামীজি কলকাতা থেকে চলে এলেন বর্ধমান। বর্ধমান থেকে রানিগঞ্জ, আসানসোল, গোমো, তিনপাহাড়। যেখানে তিনি লুইসাকে নিয়ে পালাচ্ছেন সেখানেই শয়তানটা ধাওয়া করছে। লুইকাকে সে ধরবেই। কী করে সে সন্ধান পাচ্ছে সেটাই আশ্চর্য!

শেষে এখন পুরীর এই নির্জন জায়গায় আত্মগোপন করে আছেন স্বামীজি। তাঁর আশা—শয়তানটা এখানে ওঁদের কিছুতেই খুঁজে পাবে না।

কথা শেষ করে স্বামীজি থামলেন। আমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত।

—মেয়েটি কি এখনও এখানে আছে?

স্বামীজি একটু হাসলেন। বললেন, আছে বৈকি। তার তো আর কোথাও যাবার জায়গা নেই।

—কোথায় আছে?

—ওই ঘরে। বলে আঙুল দিয়ে পাশের ঘরটা দেখিয়ে দিলেন।

আমি ঘরটার দিকে তাকালাম।

—দেখতে চান ঘরটা?

বিনীতভাবে বললাম—খুব ইচ্ছে করছে।

স্বামীজি নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। ঘরটা সন্ধের পরও অন্ধকার।

আমার মনের কথা আন্দাজ করে স্বামীজি বললেন, ও অন্ধকারেই থাকতে ভালোবাসে।

তিনি ঘরে ঢুকেই সবুজ আলোটা জ্বেলে দিলেন। আমি এক পা এগোতেই ধূপের গন্ধের সঙ্গে এক ঝলক কনকনে বাতাসের ধাক্কা খেলাম। বুঝলাম, সে আছে।

একটা চৌকিতে সাদা ধবধবে চাদর পাতা। চাদরটা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মেঝে পর্যন্ত।

—এগিয়ে আসুন।

আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। আমার হাত দুটো আপনা থেকেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্যে জড়ো হয়ে গেল।

—লুইসা, জেগে আছ?

কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপর বিছানার চাদরটা একটু কেঁপে উঠল।

—লুইসা, আমার এক নতুন বন্ধু তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ইনি খুব ভালো লোক।

সঙ্গে সঙ্গে বিছানার চাদরটার ওপর দিয়ে যেন ঢেউ খেলে গেল।

স্বামীজি নীচু গলায় বললেন, আপনি দেখতে এসেছেন জেনে ও খুব খুশি।

কিন্তু তারপরেই চাদরটা যেন এক অদৃশ্য ঝড়ের ধাক্কায় এলোমেলো হয়ে গেল।

স্বামীজি সভায় বলে উঠলেন—কী হল লুইসা?

উত্তর শোনা গেল না বটে কিন্তু চাদরটা ওলোট—পালোট হয়ে গেল।

লক্ষ করলাম স্বামীজির মুখে ছায়া নেমেছে।

বললেন, যে কোনো কারণেই হোক ও ভয় পেয়েছে। কিন্তু বুঝছি না হঠাৎ কীসের ভয়?

আমি আর দেরি না করে বিদায় চাইলাম।

স্বামীজি বললেন, টর্চ এনেছেন তো?

বললাম—হ্যাঁ।

—আমি আপনাকে এগিয়ে দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। বোধ হয় সেই শয়তানটা এখানেও এসেছে। কাছেই কোথাও আছে। সাবধানে যাবেন।

খুব ভয়ে ভয়েই সেদিন নিজের আস্তানায় ফিরে এলাম।

পরের দিন বেলা দশটা নাগাদ স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কালকের ব্যাপারটা ভুলতে পারিনি। একবার খবর নেওয়া দরকার।

গিয়ে দেখলাম স্বামীজি খুব ব্যস্ত। জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করছেন। আমায় দেখে হাসলেন একটু।

—আসুন।

—কী ব্যাপার?

—এখান থেকেও উঠতে হল।

—সে কী!

স্বামীজি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ওই লোকটির সঙ্গে যে আমি পেরে উঠব না কাল রাত্তিরে তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। লোকটি শুধুমাত্র একজন ওঝা বা ওই ধরনের কিছু নয়। আমার ধারণা যদি ভুল না হয় তাহলে সে রীতিমতো প্রেতসিদ্ধ। এদের অসীম ক্ষমতা। এরকম লোক আগে দেখা যেত। তাদের পিশাচসিদ্ধও বলা হত। শ্মশানে, গোরস্থানে ঘুরে বেড়াত মৃত আত্মার সন্ধানে। এরা আত্মা চালান পর্যন্ত করতে পারত।

আমি অবাক হয়ে বললাম—সেটা আবার কী জিনিস?

—আমিও সঠিক জানি না। যতদূর জানি, এইসব প্রেতসিদ্ধরা একজনের মৃতদেহে অন্যের আত্মা ধরে এনে ঢুকিয়ে দিতে পারত। মৃতদেহ বেঁচে উঠত। চেহারায় এক মানুষ—কিন্তু মনে—প্রাণে অন্য। সে এক বিশ্রী ব্যাপার।

একটু থেমে বললেন, আমার মনে হয় এ লোকটাও সেই সম্প্রদায়ের। এতদিন পরেও লুইসার আত্মা নতুন জন্ম পায়নি, এটা স্বচক্ষে দেখে ওকে ধরবার জন্যে পিছু নিয়েছে। মেয়েটাও খুব ভয় পাচ্ছে। এখন তো দেখলাম লোকটা তার দুর্দান্ত শক্তির বলে এখানেও আমাদের সন্ধান পেয়েছে। কাজেই পালাতে হচ্ছে। জানি না শেষ পর্যন্ত কোথায় এমন নিরাপদ অশ্রয় পাব যেখানে লোকটা মাথা গলাতে পারবে না।

বেশিক্ষণ থাকিনি। চলে আসবার সময়ে স্বামীজিকে আমার দেশের ঠিকানা দিয়ে এলাম। বললাম—যদি সম্ভব হয় মাঝে মাঝে চিঠি দিয়ে আপনার আর লুইসার খবর জানাবেন।

উনি সম্মত হলেন।

বছর তিনেক কেটে গেছে।

মাঝে মাঝে স্বামীজির চিঠি পাই। তিনি লুইসাকে নিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত। কিন্তু পিছনে লেগেই আছে সেই প্রেতসিদ্ধ লোকটা। যেখানে স্বামীজি যাচ্ছেন, সেখানেই সে। তাই স্বামীজির চিঠির ছত্রে ছত্রে শুধু ভয়—কী করে, কোন নিরাপদ আশ্রয়ে গেলে মেয়েটা রক্ষা পাবে।

স্বামীজির কথা রেখেছি। কাউকে বলিনি তাঁর কথা। তা ছাড়া কেইবা বিশ্বাস করবে—কেউ একজন একটি কিশোরীর বিদেহী আত্মা সঙ্গে করে পথে পথে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন উদভ্রান্ত হয়ে?

তারপর একদিন—

ব্যান্ডেল চার্চে বেড়াতে গিয়েছি। হঠাৎ দেখা স্বামীজির সঙ্গে।

উনি আমায় আবেগে জড়িয়ে ধরলেন।

বললাম—আপনি এখানে?

উনি বললেন, চলুন গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি।

দুজনে নিরিবিলি গঙ্গার ধারে এসে বসলাম। উনি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, লুইসাকে আজ এতদিন পর ছেড়ে দিলাম।

আমি চমকে উঠলাম।

উনি শান্তভাবে বললেন, ভেবে দেখলাম এভাবে চলতে পারে না। সেই লোকটা আমাদের দুজনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। লুইসাও ভয় পাচ্ছিল। ও বুঝতে পারছিল, আমার কাছেও ও নিরাপদ নয়। তাই অনেক ভেবে আজ ওকে মা মেরির কাছে সমর্পণ করে এলাম। মা মেরি তো শুধু যীশুখ্রিস্টের মা নন, চরাচরে সমস্ত মানুষের মা। তাঁর কোলের চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আর তো কোথাও নেই অনিমেষবাবু। লুইসাও খুব খুশি।

এই বলে স্বামীজি চুপ করলেন। আর একটি কথাও বললেন না।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এল।

আমি ডাকলাম—স্বামীজি!

—বলুন।

—এবার আমি উঠি। অনেক দূর যেতে হবে।

—আাসুন। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন স্বামীজি।

—আপনি উঠবেন না?

—না। কোথায় আর যাব? ভাবছি এখন থেকে এখানেই কোথাও পড়ে থাকব। তবু তো মেয়েটার কাছাকাছি থাকতে পারব।

বলতে বলতে উনি হাত দিয়ে চোখের জল মুছলেন।

প্রকাশকাল : অজ্ঞাত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *