ভয় পেয়েছিলাম
বহুদিন পর নানা তীর্থস্থান ঘুরে শেষে আবার কী হল মৃগেন্দ্রনারায়ণ ফিরে এলেন নিজের দেশের জঙ্গলমহলের পরিত্যক্ত বাড়িতে।
ফেরার ইচ্ছে ছিল না। জীবনে যে কয়েকটি নৃশংস কাজ ধীরে—সুস্থে পূর্ণজ্ঞানে করেছেন তারই প্রায়শ্চিত্তর জন্যে—আর নিশ্চয়ই পুলিশের ভয়েও তিনি নিজের দেশ, রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়িঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। প্রায় ত্রিশ বছর বাইরে বাইরে ঘুরে আবার কী এক অদৃশ্য টানে তিনি স্বস্থানে ফিরে এলেন। না ফিরলেই বোধ হয় ভালো হতো।
যাই হোক এই তিরিশ বছরে তাঁর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। একমুখ দাড়ি, সন্ন্যাসীর মতো জটা, মসৃণ তেল—চুকচুকে ত্বকের জায়গায় খসখসে চামড়া, পরনে গেরুয়া আলখাল্লা। তিনি তাঁর বিরাট মহলে ঢুকে একবার চারিদিকে তাকালেন। সব খাঁ খাঁ করছে। অবশ্য এ শূন্যতা নতুন নয়।
বাড়ি ফিরে এসে কোমরে বাঁধা চাবি দিয়ে অনেক কষ্টে মর্চে ধরা তালা খুলে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। জানালাগুলো বন্ধ। ভ্যাপসা গন্ধ। একটা বেড়াল ঘরে আটকা পড়ে মরে পচে গিয়েছিল। তার কিছু লোম আর শিরদাঁড়াটা পড়েছিল, মৃগেন্দ্র বাঁ হাতে করে সেটা তুলে নিয়ে চোখের কাছে এনে দেখলেন। দেখে যেন খুশি হলেন। তারপর সেটা জানলা খুলে বাইরে ফেলে দিলেন।
ঘরের একপাশে বিরাট একটা আয়না। মৃগেন্দ্র আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নিজের চেহারা দেখে নিজেই আঁতকে উঠলেন। বোধহয় ভাবলেন—কী ছিলেন—আর কী হয়েছেন!
তারপরেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ভাবলেন—যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে। কেউ আর চট করে চিনতে পারবে না। যদি বা কেউ সন্দেহ করে তাহলেও তারা বুঝবে সেই নিষ্ঠুর প্রতিহিংসাপরায়ণ মৃগেন্দ্র আর নেই। তার বদলে এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ফিরে এসেছে।
তিনি বড়ো একটা বাড়ি থেকে বেরোন না। সারাদিন মহলের শূন্য ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ান। তাঁর মনে পড়ে কত সুখের দিনের কথা—সেই সঙ্গে কত দুঃখের দিনের স্মৃতি। ভাবতে ভাবতে তাঁর দু’চোখে কখনও জল ভরে ওঠে, কখনও আগুন জ্বলে ওঠে।
এখানে ফিরে এসে এক মাসও কাটল না, মৃগেন্দ্রনারায়ণ ছটফট করতে লাগলেন। এই শূন্য বাড়িটার মধ্যে মৃত আত্মারা যেন তাঁকে কেবলই ধিক্কার দিয়ে বলে—”এরই মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেল? সব ভুলে আজ তুমি সাধু হয়েছ? ছিঃ!”
মৃগেন্দ্র তাঁর হাত দুটোর দিকে একবার তাকালেন। তাই তো! হাত দুটো কি ঠুঁটো হয়ে গেল?
তারপর থেকেই আবার তাঁর খুনের নেশা জেগে উঠল। হিসেব করে দেখলেন পাঁচটা খুন করেছেন। এখনও অন্তত একটা বাকি। তা হলেই পুরোপুরি প্রতিশোধ নেওয়া হয়।
কিন্তু যাকে—তাকে খুন করলে তো হবে না। সাহেব হওয়া চাই। অথচ সাহেব মেলা ভার। দেশ স্বাধীন হবার পর সাদা চামড়ার দল তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়েছে সাগরপারে।
তবে একেবারেই কি দেশ সাহেবশূন্য হয়ে গেছে? না, তা হয়নি। দু—একটা নিশ্চয়ই আছে। খুঁজে বার করতে হবে। মৃগেন্দ্র সেই আশায় পথ চেয়ে রইলেন।
সুযোগ একদিন মিলেও গেল।
সেদিন মৃগেন্দ্র বেরিয়েছিলেন চাল—ডাল কিনতে। ইচ্ছে করেই দুপরের দিকে বেরিয়েছিলেন যাতে রাস্তায় লোকজন কম থাকে। শর্টকাট করে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, দেখলেন একটি উনিশ—কুড়ি বছরের ফর্সা ধবধবে মেয়ে—ছেলেদের মতো চুল কাটা, কটা চুল, পরনে ফুলপ্যান্ট, গায়ে শার্ট—একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বসে ছবি আঁকছে।
এই তো একটা ক্ষুদে মেম! মৃগেন্দ্রর দু’চোখ ঝিকিয়ে উঠল। তিনি খুব সন্তর্পণে মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়ালেন। মেয়েটি তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাল। মৃগেন্দ্র দেখলেন মেয়েটির কটা চোখে এতটুকু ভয় নেই। কেমন অবাক হয়ে দেখছে।
—তুমি যোগী? মেয়েটি ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে সশ্রদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল।
—হ্যাঁ, মেমসাহেব, আমি যোগী আছি।
মেয়েটি তখনই উঠে দাঁড়িয়ে মৃগেন্দ্রকে অভিবাদন করল।
—তুমি এখানে কী করছ?
—আমি আর্টিস্ট। জঙ্গলের ছবি আঁকছি।
—কই দেখি।
বলেই মৃগেন্দ্র ধপ করে মেয়েটির পাশে বসে পড়লেন। ভারী সুন্দর সেন্টের গন্ধ মেয়েটির গায়ে। একবার ভাবলেন, এখুনি গলাটা টিপে ধরেন। অতিকষ্টে লোভ সামলালেন। না—না খুন—খারাপির কাজ এরকম খোলামেলা জায়গায় করা ঠিক হবে না। তিনি অর্ধেক—শেষ হওয়া ছবিটা হাতে তুলে নিলেন।
—বাঃ! চমৎকার হচ্ছে।
প্রশংসা শুনে মেয়েটির দু’ চোখ চকচক করে উঠল।
—আপনার একটা ছবি আঁকতে দেবেন?
—আমার ছবি! মৃগেন্দ্র হা—হা করে হেসে উঠলেন।
—হ্যাঁ, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে একজন ইন্ডিয়ান যোগীর ছবি আঁকি।
—বেশ এঁকো।
—তা হলে দয়া করে বসুন। এক ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যাবে।
মৃগেন্দ্র বললেন—এখন পারব না। বাজার যাচ্ছি। তুমি বরঞ্চ কাল আমার বাড়িতে এসো দুপুর দুটোর সময়ে। ওই যে আমার বাড়ি—’জঙ্গলমহলে’।
মেম রাজি হল। মৃগেন্দ্র হেসে বললেন—আসবে কিন্তু। ঠিক দুটোয়।
—নিশ্চয়ই যাব।
—আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব।
ঘটনাটা বলছিলেন Jungle View Hotel-এর মালিক সুন্দর শীল। বয়েস ষাট—পঁয়ষট্টি। গাঁট্টগোট্টা চেহারা। মাথার তিন দিক ঘিরে টাক। খুব গল্প করতে পারেন।
আমি এসেছিলাম জঙ্গলের মাপজোখ করার কাজে। শুনলাম জঙ্গল এখন আর তেমন নেই। থাকবে আর কী করে? গাছ কেটে কেটে সাফ করে দিচ্ছে।
এখানে এসে যে এমন একটা হোটেল পাব ভাবতে পারিনি। বিরাট বাড়ি। বড়ো বড়ো ঘর। বোঝাই যায় সাবেক কালের বাড়ি। সারিয়ে—সুরিয়ে ভাড়া দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এত বড়ো হোটেল। কিন্তু প্রায় বেশির ভাগ ঘরই ফাঁকা। ছড়িয়ে—ছিটিয়ে চার—পাঁচজন। আমি সরকারি কাজে এসেছি জেনে একটু বিশেষ খাতির করে যে ঘরটি দেওয়া হয়েছে সেটি একেবারে একটেরে—আলাদা। অ্যাটাচড বাথ। দক্ষিণ খোলা। পশ্চিমের জানালা খুললেই দেখা যায় সেই বিরাট জঙ্গলটা। রাতের অন্ধকারে মনে হয় যেন কোনো অজানা রহস্য বুকে করে রুদ্ধ নিশ্বাসে কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে।
ঘরটায় যে—সব আসাবপত্র তার কোনোটাই হালফ্যাশানের নয়। দেখলেই বোঝা যায় সাহেবি আমলের—এমনকি বিরাট আয়নাটা পর্যন্ত।
হোটেলের মালিক সুন্দরবাবু বারেবারেই খোঁজ নিচ্ছিলেন আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা।
—অসুবিধে আর কী! আমি বলি, সন্ধের পর থেকে একেবারে চুপচাপ এক। গল্প করার লোক নেই।
সুন্দরবাবু বিনয়ে গলে গিয়ে বলেছিলেন—আপনাদের মতো মানুষের সঙ্গে গল্প করা কি সবার সাধ্যে কুলোয়?
যাই হোক, সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বিভিন্ন গাছের নাম আর সংখ্যা ডায়েরিতে লিখে সন্ধের ঢের আগেই হোটেলে ফিরে এসে নিজের ঘরটিতে ঢুকলাম। এখন হাতে কোনো কাজ নেই। তাই চুপচাপ ঘরটা দেখি। বড়ো বড়ো জানলা। কাচের শার্সি, নকশা কাটা মেঝে, উঁচু শিলিং। না জানি এ ঘরে কোন সাহেব বা কোন জমিদার বিলাসে ডুবে থাকত! এই যে বিরাট আয়নাটা—এটাই কি কম পুরোনো? এইসব ভাবতে ভাবতে রাত নটা বেজে যায়। হোটেলের ঠাকুরটি গরম গরম মাংস—ভাত দিয়ে গেল। সাড়ে নটার মধ্যেই খাওয়া শেষ।
এরই মধ্যে চারিদিক থমথম করছে। জন—মানুষের সাড়া নেই। শুধু মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে কী একটা পাখির অদ্ভুত ডাক। শুনলে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়।
দশটা বাজতেই আমি জানলা—দরজা বন্ধ করে মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভাবলাম—যা নির্জন জায়গা—মানে মানে কটা দিন কাটলে বাঁচি।
সবে পাশ ফিরে শুয়েছি, দরজায় ঠুক ঠুক শব্দ।
চমকেউঠলাম। জায়গাটা যেরকম তাতে গভীর রাতে যে কোনো ঘটনাই ঘটতে পারে। ভূতের আবির্ভাবও অসম্ভব নয়। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
আবার কড়া নাড়ার শব্দ।
—কে?
—স্যার, শুয়ে পড়েছেন নাকি?
—না। যাই। বলে চটিতে পা গলিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।
—এলাম একটু গল্প করতে।
—আসুন ভালোই হল।
—আপনি তো দেখছি মশারি টাঙিয়ে—
—কী করব? মুখটি বুজে—তার ওপর যা মশা—
সুন্দরবাবু আমার বিছানায় পা তুলে বসে খোশগল্প শুরু করলেন। প্রথমে আমার ঘর—বাড়ির খোঁজখবর নিলেন—তারপর বমি করার মতো হড়হড় করে নিজের কীর্তি—কলাপের একঘেয়ে ফিরিস্তি দিয়ে গেলেন; শেষে আমি যখন এই বাড়িটার কথা জানতে চাইলাম তখনই শুরু হল আসল গল্প।
তিনি যখন জাঁকিয়ে বসে এ বাড়ির কথা শুরু করতে যাচ্ছেন, আমি তখন তাড়াতাড়ি বললাম—ভূতের ব্যাপার—ট্যাপার নয় তো?
উনি হা—হা করে হেসে উঠলেন।
—আপনার বুঝি ভূতের ভয় খুব?
আমি লজ্জিত হয়ে বললাম—তা নয়, এ জায়গাটাই এমন যে গা ছমছম করে।
উনি অভয় দিয়ে বললেন—না, মোটেই ভূতের গল্প নয়। তা ছাড়া এখানে কেউ কোনোদিন ও জিনিসটি দেখেনি।
এই বলে উনি এ বাড়ির ইতিহাস শুরু করলেন। বাড়িটায় শেষ পর্যন্ত যিনি ছিলেন তিনি হলেন এক পাগলা জমিদার। পাগল অবশ্য হয়ে গিয়েছিলেন যেদিন একদল মাতাল ইংরেজ হঠাৎ তাঁর বাড়ি আক্রমণ করে বাড়ির ছ’জনকে গুলি করে মেরে টাকাপয়সা লুঠ করে পালিয়েছিল। তারপর থেকেই শুরু হয় প্রতিহিংসা নেওয়া। একটির পর একটি করে পাঁচজন সাহেব মেরে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। বহুকাল পর সন্ন্যাসী হয়ে ফেরেন। ভেবেছিলেন মনের পরিবর্তন হয়েছে। আর রক্তপাতে রুচি নেই। কিন্তু—
বেলা দুটোয় মেমটির আসবার কথা ছবি আঁকতে। মৃগেন্দ্রনারায়ণ তাঁর ঘরে অপেক্ষা করছেন। কিভাবে খুন করবেন সে পরিকল্পনাও হয়ে গেছে। কোনো হাঙ্গামা নয়, শুধু একটুকরো কাতার দড়িতেই নিঃশব্দে কাজ শেষ হয়ে যাবে। টুঁ শব্দটি পর্যন্ত হবে না।
তারপর অবশ্য আর একটা কাজ থাকবে—লাশ সরানো। সেটা কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। বাড়ির পিছনে অঢেল পোড়ো জমি। কোদালও আছে একটা। এ বয়েসেও গায়ে যথেষ্ট শক্তি। সন্ধের অন্ধকারে মাটি কুপিয়ে মেয়েটাকে পুঁতে ফেলবেন। ব্যস! কারও সাধ্য নেই ধরে।
দেওয়ালে গির্জের মতো সাবেকি ঘড়িতে দেড়টা বাজল। মৃগেন্দ্রনারায়ণ ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত। খুন করার জন্যে আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারছেন না। হাতে কাতার দড়ির ফাঁস তৈরি। ঘরে ঢুকলেই—
পৌনে দুটো। রাস্তার দিকের জানালাটা একটু ফাঁক করে দেখতে লাগলেন।
কই? এখনও তো আসছে না? আসবে তো শেষ পর্যন্ত?
ওঁর খুব জলতেষ্টা পেল। চৌকির নীচ থেকে কুঁজো টেনে নিয়ে ঢকঢক করে এক গেলাস জল খেয়ে নিলেন। তাঁর কাঁচা—পাকা দাড়ি বেয়ে খানিকটা জল গড়িয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছলেন। ঘড়িতে টং টং করে দুটো বাজল। আর ঠিক তখনই দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ।
মৃগেন্দ্রনারায়ণের দু’ চোখ হিংস্র বাঘের চোখের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল।
—যাক, এসেছে তা হলে। মেয়েটা তো খুব পাংচুয়াল। হাজার হোক সাহেব—বাচ্চা তো!
মৃগেন্দ্রনারায়ণ সন্তর্পণে দরজা খুলতে এগিয়ে গেলেন।
ঘটনাটা শেষ করে সুন্দর শীলমশাই জোরে কয়েকবার হুঁকোয় টান দিলেন।
—এই হল এ বাড়ির একসময়ের মালিক, প্রাক্তন জমিদার—পাগল মৃগেন্দ্রনারায়ণের কাহিনি।
অনেকক্ষণ চুপ করে আছি দেখে শীলমশাই নিস্তব্ধতা ভাঙলেন।—কিন্তু বলছেন না যে?
—কি আর বলব? লোকটা ধরা পড়ল?
—সেও একটা ব্যাপার। পুলিশ মোটেই সন্দেহ করেনি মৃগেন্দ্রনারায়ণকে। কিন্তু মেয়েটির জুতোর ছাপ দেখে বুঝেছিল যে কোনো কারণেই হোক মেয়েটি এই বাড়িতে ঢুকেছিল। পুলিশও ঢুকল। দেখল সব ঘরই বন্ধ—ব্যবহার করা হয় না। শুধু একটি ঘরে বিছানা পাতা। পুলিশ তালা ভেঙে সেই ঘরে ঢুকল। হত্যার কোনো চিহ্নই নেই। হতাশ হয়ে পুলিশ ফিরে আসছিল—ইনস্পেক্টর নিশ্বাস টেনে বললেন—ভারী সুন্দর সেন্টের গন্ধ তো ঘরে! সাধুবাবা সেন্টটেন্ট মাখতেন নাকি?
তখনই খটকা বাধল। মৃত মেয়ের মাকে এই ঘরে আনা হল। তিনি বললেন—হ্যাঁ, এই সেন্টটাই আমার মেয়ে মাখত।
তখনই পুলিশ বুঝল, মেয়েটি এই ঘরে এসেছিল। তারপর আর সে ফিরে যায়নি। কিন্তু—সাধুবাবা কোথায়?
তাঁকে আর খুঁজতে হল না। তিনি তখন থানায় গিয়ে নিজেই ধরা দিয়েছেন।
—ধরা দিয়েছেন? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
—হ্যাঁ, বড্ড দেরিতে মৃগেন্দ্র জানতে পেরেছিলেন মেয়েটি মোটেই ইংরেজ নয়, একেবারেই ইন্ডিয়ান। পাঞ্জাবি মেয়ে। এখানকার এক অফিসারের কন্যা। সেই অনুতাপে ধরা দিলেন মৃগেন্দ্রনারায়ণ। তারপর সব ঘটনা বলে গেলেন—যাকে বলে স্বীকরোক্তি।
এই পর্যন্ত বলে সুন্দর শীল থামলেন। আমিও চুপ করে রইলাম।
একটু পরে সুন্দরবাবু হেসে বললেন—ঘটনাটা বোধহয় আপনার মনঃপূত হল না। কী করা যাবে—সত্যি ঘটনা তো তাই রংচং নেই। একটু থেমে বললেন—আর যাই হোক, এর মধ্যে ভূত—প্রেত অলৌকিকতার বালাই নেই। তাই না?
—তা বটে। কিন্তু—কিন্তু ঘটনাটা অবিশ্বাস্য।
—কেন? সুন্দরবাবুর ভ্রূদুটো লাফিয়ে উঠল।
—কেননা আপনি এমন অনেক কথা বললেন যা কারও জানার কথা নয়।
—যেমন?
—যেমন নিজের ঘরের মধ্যে যখন মৃগেন্দ্র মেয়েটির জন্যে অপেক্ষা করছে তখন তার মনের ভাব—জল খাওয়া—জানলা দিয়ে দেখা—এসব কি কেউ স্বচক্ষে দেখেছে?
—আরে মশাই, এসব তো মৃগেন্দ্র নিজেই পুলিশের কাছে বলেছেন। তারপর তো—বুঝতেই পারছেন—লোকমুখে মুখে ছড়িয়েছে।
আমি হেসে বললাম—ঘটনাটা যা শুনলাম সে তো বোধহয় ১৯৪৮—৪৯ সালের কথা। অর্থাৎ আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ব্যাপার। এতকাল ধরে যা জনশ্রুতি তাতে অনেক রং চড়েছে। কাজেই আমি বিশ্বাস করি না।
সুন্দর শীল একটু বিরক্ত হয়ে বললেন—তা আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন তাতে কিছু এসে যায় না।
এই বলে শীলমশাই হুঁকো হাতে উঠে পড়লেন।
ভদ্রতা করে ওঁকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ওঁর রাগ ভাঙাবার জন্যে হেসে বললাম—যাক, তবু ভূতের গল্প শোনাননি এর জন্যে ধন্যবাদ। সত্যি কথা বলছি শীলমশাই, ভূতের গল্প শুনলে এ বাড়িতে একা রাত কাটাতে পারতাম না।
শীলমশাই উত্তর দিলেন না। চটির শব্দ করতে করতে নীচে নেমে গেলেন।
রাত গভীর। কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। মাথার ওপর শুধু পুরনো ফ্যানটা একটা বিশ্রী শব্দ করে ঘুরছে।
শীলবাবুর মুখে ঘটনাটা শুনে বিশ্বাস না করলেও অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমোতে পারিনি। কেবলই সেই অচেনা না—দেখা মেয়েটির কাল্পনিক মুখ চোখের সামনে ভাসছিল। কিছুতেই মন থেকে ঘটনাটা দূর করতে পারছিলাম না।
আচ্ছা জ্বালাতন! যত গাঁজাখুরি গল্প শুনে এ তো হল ভালো!
মনে মনে গজগজ করতে করতে পাশ ফিরে শুলাম আর ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হল খুট—খুট। কেউ যেন খুব আস্তে কড়া নাড়ছে।
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। এত রাত্রে আবার কে এল? শীলমশাই নাকি?
না, আর শব্দ নেই। শোনার ভুল মনে করে শুতে যাচ্ছি—আবার সেই শব্দ খুট—খুট—খুট—
—কে?—একটা বিশ্রী খ্যাসখেসে স্বর গলা থেকে বেরিয়ে এল।
নিশ্চয়ই শীলমশাই নয়, তাহলে সাড়া দিতেন।
অগত্যা উঠতে হল। দেওয়াল হাতড়ে সুইচ অন করলাম। ভোলটেজ ডাউন। কোনোরকমে একটুখানি আলো জ্বলল। এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। খিল খুললাম। কী একটা অজানা ভয়ে বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডটা লাফাচ্ছে।
দরজাটা খুলে দিলাম। কেউ কোথাও নেই। শুধু অন্ধকারে ঢাকা সিঁড়িটা থমথম করছে।
আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। শব্দটা তো আমি নিজে কানে শুনেছি। একবার নয়, তিন তিন বার। তা হলে?
তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে ঘরে এসে ঢুকলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম—সেন্টের গন্ধ। সারা ঘরে সেন্টের গন্ধ ভুরভুর করছে। মনে হল এই মুহূর্তে দরজা দিয়ে কেউ সেন্ট মেখে ঘরে ঢুকেছে। ঢুকে এই ঘরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমি মশারির মধ্যে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কাঠ হয়ে বসে রইলাম।
বসেই রইলাম সকাল হওয়া পর্যন্ত যতক্ষণ সেন্টের গন্ধটা ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
চমক ভাঙল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। উঠে দরজা খুলে দিলাম।
দেখি হাসিমুখে শীলমশাই দাঁড়িয়ে।
—কী ব্যাপার! এত বেলা পর্যন্ত বিছানায়! ঘুম হয়েছিল তো?
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম—হ্যাঁ।
কিন্তু সেইদিনই আমি জঙ্গলমহল ছেড়ে ফিরে এসেছিলাম।
প্রকাশকাল : অজ্ঞাত
—