ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

দিনটা ছিল দুর্যোগের

দিনটা ছিল দুর্যোগের

নতুন চাকরিতে ঢুকেছি। কলকাতায় মেসে থাকি। দেশের বাড়িতে মা, বাবা, ভাই—বোন। ছুটিছাটায় বাড়ি আসি। একদিন বাড়ি থেকে খবর এল মা ভীষণ অসুস্থ। আমি যেন এখুনি বাড়ি চলে যাই।

দু’দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। মায়ের অচৈতন্য অবস্থা। দিনে দু—তিন বার ডাক্তার আসছেন। এ—বেলা ও—বেলা ওষুধ বদলে দিচ্ছেন। আমার বোন অক্লান্ত সেবা করছে। বাবা কীরকম থমথমে মুখে বসে আছেন।

দুদিনের ছুটি ফুরিয়ে গেল। মায়ের অবস্থা কখনো একটু ভালো, কখনো মন্দ।

বোন আড়ালে আমায় ডেকে বললে, আমার বড্ড ভয় করছে। তুই আরও দু’দিন থাক দাদা।

বললাম, বুঝতেই পারছিস নতুন চাকরি। গিয়ে বলি, যদি আরও ক’দিন ছুটি দেয়।

তাহলে কাল ভোরেই চলে যা। ছুটি নিয়ে কিন্তু কালই আসবি। নইলে একা আমি থাকতে পারব না। বাবা তো কীরকম হয়ে আছে।

ভোর পাঁচটায় উঠে রওনা হলাম।

ভাদ্র মাস। সারা রাত্রি বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় কোথাও কোথাও জল জমে আছে। আকাশ এখনও কালো। যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে।

বোধহয় এইরকম দিন বলেই রাস্তায় একটা ঘোড়ার গাড়ি বা রিকশা নেই। অগত্যা হাঁটা শুরু করলাম। স্টেশন ক্রোশখানেক দূরে। পথে কোনো একজনকেও দেখতে পেলাম না। আশ্চর্য! যারা রোজ যাতায়াত করে তারাও কেউ নেই। তাদের ঘুম ভাঙেনি নাকি?

মনটা খুবই চঞ্চল। যদিও আজই ফিরব তবু কেমন যেন ভয় করছে—ফিরে এসে দেখতে পাব তো?

মনে পড়ল মাত্র তেরো দিন আগের কথা। তখনও মা দিব্যি ভালো ছিল। মেসে জলখাবারের ব্যবস্থা নেই বলে মা এক টিন মুড়ি আর নারকেল নাড়ু করে দিয়েছিল। বলেছিল, এবার যখন আসবি খালি টিনটা মনে করে আনবি। আবার মুড়ি দেব।

সেই এলাম কিন্তু মায়ের সঙ্গে কথা হল না। মা ঘুমচ্ছে তো ঘুমচ্ছেই।

হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে পিছনে তাকাতেই লাফিয়ে সরে এলাম। আর সেই মুহূর্তেই একটা ঘোড়ার গাড়ি কিছু প্যাসেঞ্জার নিয়ে টগবগিয়ে গায়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর একটু হলেই চাপা পড়ে মরতাম।

গাড়িটা যে আসছে, দূর থেকে তার শব্দ পাওয়া উচিত ছিল। বোধহয় অন্যমনস্কতার জন্যেই শুনতে পাইনি।

যাক, গাড়িতে লোক দেখে বুঝলাম, ডেলি—প্যাসেঞ্জাররা বেরোতে শুরু করেছে। কিন্তু কটা বাজল? যাঃ! ঘড়িটাও ফেলে এসেছি।

মরুকগে, জোরে জোরে হাঁটা শুরু করলাম। তখন এখনকার মতো শার্ট—ট্রাউজারের চল হয়নি। পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবি। কাঁধে একটা ব্যাগ। সাবধানে জলকাদা বাঁচিয়ে হাঁটছি। আকাশে মেঘ ডেকেই চলেছে।

কিন্তু আবার বাধা। খাকি রঙের হাফ—প্যান্ট আর গেঞ্জি গায়ে আমার বাল্যবন্ধু দুর্গাদাস সদা—ঘুম—ভাঙা চোখে ওদের রকে বসে দাঁতন করছে।

আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, এত ভোরে কোথায়?

অগত্যা আমাকে দাঁড়াতে হল আর মায়ের অসুখের কথা বলতে হল। বলতে গিয়ে আমার গলার স্বরটা মিইয়ে গিয়েছিল। ও আমার মাকে ভালো করেই চেনে। কতদিন আমাদের বাড়ি এসেছে। আমার কথা শুনে ও দুঃখ পেল। যেন একটু চিন্তিতও মনে হল। বলল, আজ না গেলেই ভালো করতে।

বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। তাহলে আজ বেরিয়ে কি ভুল করলাম? সামলে নিয়ে বললাম, কি করব? নতুন চাকরি।

আজই ফিরবে কিন্তু। ও আমাকে কেমন একরকম অপরিচিত গলার স্বরে হুঁশিয়ার করে দিল। আজ অবশ্যই ফিরবে।

ফিরব। চলি, বলে দ্বিগুণ জোরে হাঁটতে লাগলাম।

ওই যাঃ! দুর্গাদাসের কাছ থেকেও তো সময়টা জেনে নিতে পারতাম। খেয়াল হয়নি। আসলে সবই আজ কিরকম গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

না, হুঁশিয়ার হয়ে চলাফেরা করতে হবে। কেমন যেন মনটা করছে। আজ আমার নিজেরই কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।

ঠিক সময়েই স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। ট্রেন তখন ঢুকছে। তাড়াতাড়ি টিকিট কাটলাম।

পাশ থেকে পরিচিত একজন বললে, কি ব্যাপার! চুঁচড়োর টিকিট চাইলে যে?

চুঁচড়ো!

চমকে উঠে টিকিটটা দেখলাম। তাই তো! অন্যমনস্কভাবে চুঁচড়োর টিকিট কেটে বসেছি। তাড়াতাড়ি টিকিটটা বদলে হাওড়ার কেটে নিলাম।

আবার মনে খচখচানি, হঠাৎ চুঁচড়োর টিকিট কাটতে গেলাম কেন?

ততক্ষণে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেছে। গার্ড সবুজ নিশান নাড়ছে। আমি দৌড়ে যে বগিটা সামনে পেলাম তাতেই উঠে বসলাম। জানলার ধারে একটা সিটও পেয়ে গেলাম।

আমি যেই আরাম করে বসলাম অমনি মাথার মধ্যে যেন ইলেকট্রিক শক খেলাম। তাই তো কী ব্যাপার হল? স্টেশনে আসার পথে কার সঙ্গে কথা বললাম? ওই যে ছেলেটি খাকি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে দাঁতন করছিল, কে ও? আমার বন্ধু দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়? সত্যিই কি দুর্গাদাস?

কিন্তু—

ও তো অনেক দিন মারা গেছে! ও আর আমি এক ক্লাসে পড়তাম। কি করে যেন মরল…হ্যাঁ, গাছ থেকে পড়ে।

সবই তো স্পষ্ট মনে পড়ছে। তাহলে?

তা হলে যে ওর সঙ্গে মাত্র পনেরো মিনিট আগেও সামনাসামনি কথা বললাম? প্রত্যেকটি কথা এখনও মনে পড়ছে। ওর শেষ কথা—আজই ফিরবে কিন্তু…

তবে কি ও মারা যায়নি? নিশ্চয়ই মারা যায়নি। কী লজ্জার কথা—একটা জলজ্যান্ত মানুষকে এতদিন মৃত বলে জেনে রেখেছিলাম?

অবশ্য দোষ আমারও খুব নয়। এক ক্লাসের ছাত্র হলেও ও পড়ত অন্য স্কুলে। ওর বাড়িটাও ঠিক আমাদের পাড়ার নয়। ওর সঙ্গে যেটুকু দেখাশোনা হত তা ফুটবল খেলার মাঠে। খেলার পর কখনো কখনো একসঙ্গে গল্প করতে করতে ফিরতাম। এই পর্যন্ত।

ট্রেন তখন ছুটছে বলাগড়, জিরাট পার হয়ে ব্যান্ডেলের দিকে। এই ট্রেনে কত দিন গিয়েছি। কত চিন্তা মাথায় নিয়ে হাওড়া পৌঁছেছি। কিন্তু আজ হঠাৎ ওই দুর্গাদাস আমায় ভাবিয়ে তুলল। কবেকার কত কথা মনে পড়তে লাগল।

ওর বাবার ছিল ঘোড়ার গাড়ির কারবার। চারখানা গাড়ি ছিল। দারুণ তেজি ঘোড়া ছিল আটটা। মেমারি—বর্ধমান রাস্তাটা তখন দামোদরের বন্যায় ক্ষত—বিক্ষত। তাই ও—লাইনে যে বাস চলত তা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্গাদাসের বাবা সময় বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সাতগেছেতে একটা আস্তানা করে দুখানা গাড়ি লাগিয়ে দিলেন। বাকি গাড়ি খাটতে লাগল এই শহরে। তখনও সাইকেল—রিকশার চল হয়নি। দুর্গাদাসের বাবা গাড়ির ব্যবসা করে বেশ দু—পয়সা করে নিলেন।

দুর্গাদাস প্রায়ই বলত, জানিস, আমার খুব শখ বড়ো হয়ে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসা করব। বলতাম, ভালোই তো। ও হেসে বলত, তা বলে কোচোয়ান রেখে নয়।

তাহলে?

আমি নিজেই গাড়ি চালাব। বলে হাতটা তুলে এমনভাবে টাগরায় একটা শব্দ করে হ্যাট—হ্যাট করত যেন এখনই সে গাড়ি ছোটাচ্ছে।

ওর রকম দেখে আমার খুব হাসি পেত। তারপর একদিন আমাদেরই রাস্তায় ওকে দেখলাম ঘোড়ার গাড়ির ওপরে।

কোচোয়ানের পাশে খুব খুশমেজাজে বসে রয়েছে। আবার কোচোয়ানের হাত থেকে মাঝে মাঝে লাগামটা নিজের হাতে টেনে চাবুক ঘুরিয়ে নিজেই চালাচ্ছে।

আমায় দেখে গাড়ি থামিয়ে একমুখ হেসে চেঁচিয়ে উঠল, এই নন্তু, গাড়ি চালাবি? বললাম, না, ভাই। ভয় করে। ও হাসতে হাসতে বলল, ভয়! পাগল, একেবারে পাগল! বলে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

এসব কবেকার কথা! আজ হঠাৎই মনে পড়ল।

ট্রেন ব্যান্ডেলে এসে পৌঁছেছে। এক ভাঁড় চা খেলাম। হঠাৎ মার কথা মনে পড়ল। মা এখন কেমন আছে কে জানে! মনে মনে প্রার্থনা করলাম, ভগবান, এরই মধ্যে আমায় মাতৃহারা কোরো না।

ট্রেন ব্যান্ডেল ছাড়ল।

আবার মুখের ওপর এলোমেলো চুল এসে পড়ার মতো দুর্গাদাসের কথা মনে পড়তে লাগল।

… তখন ওদের ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসা আর নেই। একদিন শুনলাম দুর্গাদাসের মায়ের খুব অসুখ। বাঁচবেন কিনা সন্দেহ।

সেদিন খুব বৃষ্টি। আকাশ ঘনঘোর। আমি ছাতা মাথায় দিয়ে গুটিগুটি মাসিমাকে দেখতে গেলাম। আমি ছেলেমানুষ। জানি আমায় কেউ গণ্য করবে না। তবু এই বিপদে দুর্গাদাসের কাছে থাকতে ইচ্ছে করল। সেইজন্যেই আমার যাওয়া। তখনও আমি জানতাম না ছোটো ছেলে হলেও আমি ওদের কতখানি কাজে লাগতে পারি।

ব্যাপারটা এই—ডাক্তার সেদিন সকালে যে প্রেসক্রিপশান করেছেন সেই ওষুধ এখানে পাওয়া যাচ্ছে না। কাছের মধ্যে একমাত্র বর্ধমানে পাওয়া যেতে পারে। কাছে মানে তা চল্লিশ মাইল দূরে। বাস ছাড়া যাবার অন্য উপায় নেই। তাও কখন কোন বাস ছাড়বে তা কেউ স্ট্যান্ডে না গেলে বলতে পারবে না।

ওষুধটা আনা খুবই জরুরি। তখনই আনা দরকার। কিন্তু এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না যাকে বর্ধমানে পাঠানো যায়। মায়ের মাথার কাছে বসে আছে দুর্গাদাস। তার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

তখন আমিই বললাম, প্রেসক্রিপশনটা দিন। আমি নিয়ে আসছি।

সবাই অবাক হলেন, এই জলবৃষ্টিতে—

বললাম, দেরি করবেন না। দিন। ঠিক নিয়ে আসব।

আজ ভাবতে অবাক লাগে, তখন কতই বা আমার বয়স! কিন্তু কারো বিপদে সাহায্য করার জন্যে মনটা এমনই তৈরি হয়েছিল যে কোনো বাধাই গ্রাহ্য করিনি।

সেদিনই বিকেলের মধ্যে বর্ধমান থেকে ওষুধ এনে দিয়েছিলাম। দুর্গাদাসের মা ভালো হয়ে গিয়েছিলেন।

সেই দুর্গাদাস! ও কি সত্যিই বেঁচে আছে? তবে কি ওর মৃত্যুর খবরটা ভুল শুনেছিলাম?

কিন্তু…তারপর আর তো কখনো ওকে দেখিনি? যদি ও বেঁচেই থাকবে তাহলে তো একদিন—না—একদিন দেখতে পেতাম। ওর বাড়ির কাউকেই দেখিনি।

কী জানি? মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। ঠিক করলাম মেসে গিয়ে আমার দেশের কাউকে জিজ্ঞেস করব। অবশ্য যদি তার দুর্গাদাসের কথা মনে থাকে।

বেলা নটা।

তাড়াতাড়ি মেসে ঢুকছিলাম। এখুনি নেয়ে—খেয়ে অফিস যেতে হবে। সিঁড়ির মুখে বিজয়ের সঙ্গে দেখা। ও আমার দেশের ছেলে। একসঙ্গে পড়তাম।

আমায় দেখে ও চমকে উঠল। কী হয়েছে তোমার? চোখ বসে গেছে। মুখে—

বললাম, মায়ের খুব অসুখ।

তা হলে চলে এলে কেন?

বললাম, ছুটি নেব। আজই চলে যাব।

বিজয় চলে যাচ্ছিল। ওকে ডাকলাম। ইতস্তত করে বললাম, আচ্ছা, তোমার দুর্গাদাসকে মনে আছে? দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিজয় থমকে গেল। বলল, খুব মনে আছে। কিন্তু এতকাল পর হঠাৎ তার কথা? সে তো কবে মরে গেছে। মনে নেই আম গাছ থেকে পড়ে?

আমি শক্ত করে দরজার পাল্লাটা চেপে ধরলাম।

কিন্তু ওদের বাড়ির কাউকে দেখি না কেন?

দুর্গাদাস মারা যাবার পরই তো ওরা এখানকার পাট চুকিয়ে দিয়ে চলে গেল ওদের চুঁচড়োর সাবেকি বাড়িতে। ওর মা তার কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছিল এই রক্ষে।

কোনোরকমে টলতে টলতে ওপরে উঠে এসে শুয়ে পড়লাম। আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না।

বৃষ্টির আর বিরাম নেই। বৃষ্টির সঙ্গে আবার ঝোড়ো হাওয়া। অফিস থেকে বেরিয়ে, এমনি আমার ভাগ্য আগের ট্রেনটা একটুর জন্যে ধরতে পারলাম না। পরের ট্রেন ধরে যখন দেশের বাড়ির স্টেশনে পৌঁছলাম রাত তখন পৌনে এগারোটা। সমস্ত স্টেশন নিঝুম। দু—চারজন প্যাসেঞ্জার যারা নামল তারা ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি ছাতা নিতেও ভুলেছিলাম।

স্টেশন থেকে নেমে স্ট্যান্ডে এসে দেখি একটি গাড়ি বা রিকশাও নেই। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

সব্বোনাশ! এই বৃষ্টিতে বাড়ি পৌঁছব কি করে?

এদিকে মায়ের জন্যে মন ছটফট করছে। মা কেমন আছে কে জানে! গিয়ে দেখতে পাব তো?

একটা শেডের নীচে কোনোরকমে মাথা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বিদ্যুৎ চমকাল। ক্ষণিকের সেই আলোয় দেখলাম দূরে তেঁতুলগাছটার তলায় একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

ছুটলাম। কাছে গিয়ে দেখি গাড়ি আছে, ঘোড়া দুটোও ভিজছে বটে কিন্তু গাড়োয়ান নেই।

নিশ্চয়ই কাছেপিঠে কোথাও আছে মনে করে ‘কোচোয়ান কোচোয়ান…’ বলে কয়েকবার চিৎকার করলাম। কিন্তু কেউ এল না।

আবার বিদ্যুৎ চমকালো। দেখলাম পুকুরের জল রাস্তায় উঠে সব একাকার করে দিয়েছে। কোথাও কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব নেই।

কী করব? কীভাবে বাড়ি পৌঁছব ভাবতে ভাবতে কান্না পেল। এত কাছে এসেও মাকে দেখতে পাব না?

এমনি সময়ে ঠিক পিছনে ছপাৎ ছপাৎ শব্দ। কেউ যেন রবারের জুতো পরে জলের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে। ফিরে দেখি মাথায় হুড—নামানো রবারের টুপি, গায়ে ওয়াটারপ্রুফ একটা লোক এসে দাঁড়াল।

উঠে পড়ুন, বলে যেন আদেশ করেই লোকটা কোচোয়ানের আসনে উঠে বসল। কত ভাড়া দিতে হবে, কোথায় নিয়ে যেতে হবে এসব কিছুই বলার সময় পেলাম না। গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে।…গাড়ি তো ছুটছে না, যেন উড়ে যাচ্ছে। শুধু চারটে চাকার ধাক্কায় রাস্তার জল দু’ভাগ হয়ে চারদিকে ছিটকে পড়ছে। এদিকে ঝোড়ো হাওয়া…

দশ মিনিটেরও কম সময়ে একেবারে বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। কোচোয়ান তার আসন থেকে নেমে এসে দরজা খুলে দিল।

আমি ভিজতে ভিজতেই পার্স খুলে টাকা দিতে যাচ্ছিলাম, কোচোয়ান বলল, আগে বাড়ি ঢুকুন। তারপর টাকা দেবেন।

দরজা ঠেলতেই বোন এসে দরজা খুলে দিল। মুখে উদ্বেগের ছাপ। এসে পড়েছিস! খুব ভাবছিলাম।

মা?

সন্ধেবেলায় অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল, এখন একটু ভালো। আয় ওপরে আয়।

দাঁড়া, ভাড়াটা দিই। বলে টাকা দিতে গিয়ে দেখি কোচোয়ান নেই! শুধু খালি গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়।

আরে! কোচোয়ান গেল কোথায়?

হাঁকডাক করেও তার সাড়া পেলাম না।

বোন বলল, নিশ্চয়ই চেনা কোচোয়ান। কাল সকালে ভাড়া নিয়ে যাবে। জামা—কাপড় ছাড়বি চল।

ওপরে উঠে এলাম। একটু পরেই নীচে গোলমাল। কে যেন কী বলছে!

কী ব্যাপার জানবার জন্যে নীচে নেমে এলাম। দেখি লুঙ্গিপরা, গেঞ্জি গায়ে, মাথায় গামছা জড়ানো একটা লোক। তাকে খুবই বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।

সে যা বলল তা শুনে আমরা তো হাঁ। ওই লোকটাই আসল কোচোয়ান। বৃষ্টিতে প্যাসেঞ্জার নেই বলে স্টেশনে ঘুমোচ্ছিল। তারপর গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাবে বলে এসে দেখে গাড়ি নেই!

নিশ্চয়ই কোনো গাড়ি—চোর গাড়ি নিয়ে পালিয়েছে ভেবে সে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এসে দেখে গাড়িটা এখানে পড়ে আছে। চোর উধাও।

যাই হোক, গাড়ি যে ফিরে পেয়েছে এতেই সে খুশি। গাড়ি নিয়ে কোচোয়ান চলে গেল। কিন্তু চোরের মীমাংসা হল না।

একটা কথা অস্পষ্টই থেকে গেল। যদি সে চোরই হয়, তাহলে আমাকে গাড়িতে ডেকে তুললই বা কেন? আর কেনই বা ভাড়া না নিয়ে চলে গেল?

বুঝলাম ছোকরাটা কোচোয়ানও নয়, চোরও নয়, কোনো মহৎ যুবক। তাকে আর কোনোদিন দেখতে পাব কিনা জানি না, তাই মনে মনে তাকে সকৃতজ্ঞ নমস্কার করলাম।

ঘুমোবার আগে কিছু একটা বই পড়া আমার অভ্যাস। আলমারি থেকে একটা পুরোনো গল্পের বই টেনে নিয়ে পড়তে গেলাম, ঠক করে কী যেন বুকের ওপর পড়ল। দেখি, মাথার হুড—নামানো রবারের টুপি আর ওয়াটারপ্রুফ গায়ে আঠারো—উনিশ বছর বয়েসের একটি যুবকের ছবি। ভালো করে দেখলাম ছবিটা আমার বন্ধু দুর্গাদাসের। কোনো এক সময়ে ছবিটা ও আমায় দিয়েছিল ওকে মনে রাখার জন্যে।

আশ্চর্য, ছবিটা এতদিন কোথায় ছিল? ভাবতে ভাবতে আর একটা কথা মনে হতেই শিউরে উঠলাম। ওয়াটারপ্রুফ গায়ে কোচোয়ানটি তা হলে কে?

১৯৯৬, জুন, শুকতারা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *