ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

অনুসরণ

অনুসরণ

শেয়ালদা থেকে নৈহাটি—রানাঘাটের দিকে যেতে কয়েকটা স্টেশনের পর সোদপুর।

রাত প্রায় দশটা। একটা ফ্ল্যাটে একজন মহিলা দুশ্চিন্তায় ছটফট করছেন। এখনও তাঁর স্বামী ফেরেননি।

মহিলাটির স্বামী কলকাতায় একটি কলেজের প্রফেসর। সোদপুর থেকে কলকাতায় রোজই যাতায়াত করেন। ফিরে আসেন সন্ধের মধ্যেই। আজ একটা মিটিং ছিল বিকেলে। তা হোক। মিটিং আর কতক্ষণ চলে? এতক্ষণে ফিরে আসা উচিত ছিল।

অনেকে আছেন যাঁরা কাজের পরও বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দেন। ইনি কিন্তু সেরকম নন। নিজের কাজটুকু আর পড়াশোনা নিয়ে থাকেন।

সেই মানুষ এত রাত পর্যন্ত কী করছেন? ট্রেনেরও গণ্ডগোল নেই। কলকাতাতেও কোনো হাঙ্গামা হয়নি। টিভির খবরে তা হলে জানা যেত।

মহিলাটির কেমন যেন ভয় করতে লাগল। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।

এমনি সময়ে একটা রিকশা এসে দাঁড়াল। মহিলা জানলার কাছে ছুটে এলেন। উনি কি তবে রিকশা করে ফিরলেন? তা তো কথা নয়। বাড়ি থেকে স্টেশনে হেঁটে আসতে বড়ো জোর দশ মিনিট।

মহিলাটি একবুক উৎকণ্ঠা নিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয় রইলেন।

কলকাতায় মিটিং সেরে অধ্যাপক সুশান্ত ভট্টাচার্য সোদপুর ফেরার জন্যে যখন শেয়ালটা স্টেশনে এলেন তখন সন্ধে সাতটা বেজে পনেরো মিনিট। ভাগ্য ভালো সঙ্গে সঙ্গে নৈহাটি লোকালটা পেয়ে গেলেন। বেজায় ভিড় তবে এ ভিড় তাঁর গা—সওয়া। রোজই তো তাঁকে শেয়ালদা—সোদপুর করতে হয়।

কিছু একটা ভাবতে ভাবতে চলেছিলেন। সম্ভবত মিটিংয়ের কথাই ভাবছিলেন। কয়েকটা স্টেশন যাবার পর তিনি নেমে পড়লেন। প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই হঠাৎ তাঁর মাথাটা কীরকম ঝিমঝিম করে উঠল। তা সে মুহূর্তের জন্যে। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলেন ভুল করে সোদপুরের আগের স্টেশন আগরপাড়ায় নেমে পড়েছেন। তিনি তাড়াতাড়ি আবার ট্রেনে উঠতে গেলেন, কিন্তু ট্রেনটা তখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বোকার মতো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই খানিকটা হাসলেন। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিলেন, দ্যাখো কাণ্ড! রোজ দু’বেলা এই লাইনে যাতায়াত করি, আর আজ কিনা নিজের স্টেশনটাকেও ভুল হল!

এর পরেই তাঁর দ্বিতীয় ভুল। তিনি যদি একটু অপেক্ষা করে পরের ট্রেনে সোদপুর যেতেন তাহলে হয়তো সেই সাংঘাতিক ঘটনাটা ঘটত না।

তিনি ঠিক করলেন পরের ট্রেনের জন্যে হাঁ করে বসে না থেকে লাইন ধরে হাঁটবেন। সোদপুর তো পরের স্টেশন। কতটুকুই বা পথ।

তাঁর মতো বুদ্ধিমান লোকের একথাটা একবারও মনে হল না যে এই অন্ধকারে লাইন ধরে হাঁটাটা কতখানি বিপজ্জনক।

সুশান্তবাবু হাঁটতে শুরু করলেন। ঘড়িতে তখন আটটা বাজে।

তিনি লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছেন অন্যমনস্কভাবে। এলোমেলো কত রকমের চিন্তা…..

তিনি যেখান দিয়ে হাঁটছেন তার ডান দিকে মাঠ, বাঁ দিকে ঝোপ। ঝোপের পাশেই লাইন।

একসময়ে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সামনে আর রাস্তা বলে কিছু নেই। একটা জলা। কিন্তু রেললাইনটা কোথায় গেল? তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন। না, লাইনের চিহ্নমাত্র নেই।

এই মরেছে! এবার যাবেন কোথা দিয়ে?

তখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশে তারা ফুটেছে। হাতে টর্চও নেই যে পথ খুঁজে বের করবেন।

এতক্ষণে খেয়াল হল—এই যে তিনি লাইন ধরে সোদপুরের দিকে হাঁটছিলেন, এর মধ্যে একটি ট্রেনও যেতে দেখেননি।

আশ্চর্য!

যাক, ওসব ভেবে এখন আর লাভ নেই। এখন কোনোরকমে সোদপুর পৌঁছতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু কোথা দিয়ে যাবেন? পথ তো নেই। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবেন এমন একটি লোকও নেই।

এমনি সময়ে তাঁর চোখ পড়ল জলার দিকে। কেউ যেন বসে আছে। গায়ে একটা সাদা চাদর—জড়ানো। তিনি সাগ্রহে এগিয়ে গেলেন। হ্যাঁ, সত্যিই একজন জলার ধারে মাথা নীচু করে বসে আছে। তার বসার ভঙ্গি দেখে মনে হল লোকটার খুব দুঃখ। আর মাথা নীচু করে কিছু ভাবছে।

সুশান্তবাবুর পায়ের শব্দ পেয়ে লোকটা তাড়াতাড়ি উঠে চলে যাচ্ছিল, সুশান্তবাবু চেঁচিয়ে ডাকলেন, এই যে, ও ভাই!

মানুষটা দাঁড়িয়ে পড়ল।

সোদপুর যাব কোন দিকে?

মানুষটা কোনো কথা বলল না। শুধু ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বলল।

যাক, তবু একজন সঙ্গী পাওয়া গেল। সুশান্তবাবু লোকটার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন।

অন্ধকার রাত। মাথার ওপর শুধু মিটি মিটি তারা। দু’ধারে ঢোলকলমি আর বনতুলসীর ঝোপ। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। দশ হাত দূরে চাদর—জড়ানো লম্বা মানুষটা এগিয়ে চলেছে। মুখে কথা নেই।

সুশান্তবাবু ভাবেন, লোকটা কথা বলে না কেন? সংকোচ? পাশাপাশি গেলে তো তবু দু—চারটে কথা বলতে বলতে যাওয়া যায়।

ও ভাই, একটু আস্তে চলো না। দুটো কথা বলি। এটা কোন জায়গা?

লোকটা শুধু ঘাড় বেঁকিয়ে সুশান্তবাবুকে দেখল। কোনো উত্তর তো দিলই না, বরঞ্চ আরো জোরে হাঁটতে লাগল।

লোকটা তো খুব রসিক আছে! ও কি আমায় ভয় দেখাতে চায়? মনে মনে বললেন সুশান্তবাবু। তারপর তিনিও জোরে জোরে হাঁটতে লাগলেন লোকটাকে ধরবার জন্যে। ওকে তো ধরতেই হবে, নইলে এই অন্ধকারে কিছুতেই পথ খুঁজে পাবেন না।

একসময়ে মনে হল লোকটা নেই। কিন্তু—না—ওই তো লোকটা হনহন করে চলেছে। ওই যে অন্ধকারে ওর গায়ের সাদা চাদরটা দেখা যাচ্ছে। আর কিছু নয়, শুধু চাদর—জড়ানো লম্বা একটা মূর্তি দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে এগিয়ে চলেছে।

ও ভাই, একটু আস্তে হাঁটো। আমি পেছিয়ে পড়ছি।

লোকটা তবুও ফিরে তাকাল না। মনে হল লোকটা যেন সুশান্তবাবুকে এড়িয়ে যেতে চাইছে—পালিয়ে যেতে চাইছে।

লোকটা কি তবে চোর—ডাকাত? কে জানে বাবা!

তারপর? তারপর একসময়ে লোকটাকে আর পাওয়া গেল না। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

সুশান্তবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। একবার নিজেকেই যেন ঠাট্টা করে বললেন, কী সুশান্তবাবু, ভূত দেখছ না তো? পরক্ষণেই নিজের মনে হাসলেন, হ্যাঁ, সন্ধেরাতে বেলঘরিয়া— আগরপাড়া—সোদপুর অঞ্চলে ভূত!

কিন্তু এ কোথায় এলেন তিনি? ডান দিকে ছোটো ছোটো জলা আর মাঠ। বাঁ দিকে আমবাগান আর বাঁশঝাড়। অন্ধকারে অতিকষ্টে তিনি ঘড়ির দিকে নজর করলেন। রাত নটা। তিনি অবাক হলেন। এতক্ষণ ধরে হেঁটেছেন! শেষ পর্যন্ত এত হেঁটে কোথায় এসে পড়লেন।

এতক্ষণে তিনি ভয় পেলেন। চোর—ডাকাত—খুনে—ছিনতাইবাজ বা ভূতটুতের ভয় নয়, তাঁর ভয়—এইভাবেই কি সারা রাত একটা জলা আর মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?

এমনি সময়ে কাছেই যেন ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলেন। দূর থেকে শব্দটা এগিয়ে এসে মাটি কাঁপিয়ে পিছনের দিকে মিলিয়ে গেল। ট্রেনের শব্দ সারা জীবন ধরে অনেক শুনেছেন। কিন্তু কখনও এত ভালো লাগেনি। তিনি ধরে নিলেন নিশ্চয়ই খুব কাছে রেললাইন আছে—নিশ্চয়ই ওই আমবাগানটার পিছনে।

তখনই তিনি পড়ি—মরি করে ছুটলেন। পরনের কাপড় ধুলোয় কাদায় একসা। কাঁটাগাছের খোঁচায় খানিকটা ছিঁড়েও গেছে। সেই অবস্থাতেই তিনি লাইনের দিকে ছুটতে লাগলেন। লাইনটা পেয়ে গেলে আর ভাবনা নেই…..

আপ—ডাউন দুটি লাইন চলে গেছে সমান্তরালভাবে। অন্ধকারেও ঝকঝক করছে লাইন।

তিনি লাইনের ওপর এসে দাঁড়ালেন। দু’দিকে তাকালেন। কিন্তু স্টেশনের কোনো চিহ্নই দেখতে পেলেন না।

তবু তিনি লাইন ধরে হাঁটতে লাগলেন। অল্প দূর এগোতেই লাইনের ওপর সাদা মতো কী একটা পড়ে আছে দেখলেন।

ওটা আবার কি?

ভাবতে ভাবতে আরও দু’পা এগোতেই তিনি ছিটকে দু’পা পিছিয়ে এলেন। সাদা চাদর জড়ানো একটা দেহ লাইনের ওপর—আর মুন্ডুটা পড়ে আছে লাইনের বাইরে।

এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখামাত্রই সুশান্তবাবু ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। তাঁর চিৎকার বাতাসে মিশে যেতে না যেতেই লাইনের পাশ থেকে বিকট একটা শব্দ—সেটা অট্টহাসি না হুংকার বোঝা গেল না—রাতের স্তব্ধতা খান খান করে উত্তর থেকে দক্ষিণের আকাশের দিকে ধেয়ে গেল।

সুশান্তবাবু আর দাঁড়াতে পারলেন না। ‘কে আছো বাঁচাও’ বলে লাইনের ধারে বসে পড়লেন।

এই সময়ে কয়েকজন রেলের কর্মী লাইন ধরে আসছিল। চিৎকার শুনে তারা ছুটে এল। তাদের হাতে টর্চ। সুশান্তবাবুকে তারা উদ্ধার করল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনল।

তারপর একজন জিজ্ঞেস করল, কোনখানে লোকটা শুয়ে আছে?

শুয়ে কি? লোকটা লাইনে মাথা দিয়েছিল। দু’টুকরো হয়ে গেছে। একদিকে ধড় আর একদিকে মাথা। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন সুশান্তবাবু।

বলেন কী! কোথায়?

ওই তো! বলে সুশান্তবাবু আঙুল দিয়ে জায়গাটা দেখাতে গিয়ে থমকে গেলেন।

লোকগুলো লাইনের চারিদিকে টর্চের আলো ফেলে তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেল না। শুধু দেখা গেল যেখানে তারা দাঁড়িয়েছিল ঠিক তার পাশের ঝোপে একটা সাদা, ধুলোয় মলিন চাদর পড়ে আছে।

একমাত্র সুশান্তবাবু ছাড়া আর কেউই চাদরটার গুরুত্ব দিল না। সুশান্তবাবুই বিস্ফারিত চোখে চাদরটা দেখলেন। কিন্তু কাউকে কিছু বললেন না।

লোকগুলো সুশান্তবাবুর কথা কিছু বুঝতে পারল না। তারা মনে করে নিল যে কারণেই হোক সুশান্তবাবুর কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল।

সুশান্তবাবু একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখান থেকে সোদপুর স্টেশন কত দূর?

তারা বলল, আপনি উলটোদিকে চলে এসেছেন। একটু এগোলেই বেলঘরিয়া।

লোকগুলি সুশান্তবাবুকে সঙ্গে করে বেলঘরিয়া স্টেশনে পৌঁছে দিল।

সুশান্তবাবু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক তবু একটা স্টেশনে এসে পৌঁছেছেন। আবার ট্রেনে উঠতে হবে। আবার একটা স্টেশন আগরপাড়া। তারপর সোদপুর।

কিন্তু সেই রাত আটটা থেকে এখন এই পৌনে দশটা পর্যন্ত এই যে—সব ঘটনা ঘটে গেল, এর মানে তাহলে কী?

সুশান্তবাবু ব্যাপারটা চিন্তা করতে লাগলেন কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।

১৯৯৮, মার্চ, শুকতারা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *