ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

বাইসনের শিং

বাইসনের শিং

কলকাতার রাস্তায় শীতের মরশুমে প্রতি বছর ভুটানিরা দল বেঁধে সোয়েটার, টুপি, মাফলার বিক্রি করতে আসে।

ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ধারে যারা বসে তাদেরই একজনের কাছ থেকে প্রতিবার কিছু না কিছু কিনি। লোকটি বৃদ্ধ। চোখে—মুখে সরলতার ছাপ আছে। ওর কাছে দাম সস্তা বলেই মনে হয়। জিনিসও খারাপ দেয় না।

এবারও একটা মাফলার কিনেছিলাম। সঙ্গে খুচরো টাকা ছিল না। ও আমার বউবাজারের বাসা চিনত। বলেছিল, একসময়ে বাসায় এসে টাকা নিয়ে যাবে।

শীত শেষ হতে চলল, ভুটানিরা ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। এখনও লোকটি দাম নিতে এল না কেন ভাবতে ভাবতে তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। দেখলাম ঘরের একটা জানলা একদম খোলা। আর দুপরের দমকা হাওয়ার সঙ্গে যে এক পশালা শেষ মাঘের বৃষ্টি হয়েছিল তাতে আমার টেবিলের কাগজপত্র চারিদিকে ছড়িয়ে ভিজে একসা হয়ে গেছে।

আমি কয়েক মিনিট দরজার কাছে বিভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। জানলা খোলা থাকলে বাতাসে কাগজপত্র উড়ে যাবেই—বৃষ্টির ছাঁটে ভিজেও যাবে। এ তো জানা কথা। কিন্তু জানলা তো খোলা ছিল না। এই ঘরটাতে আমি একাই থাকি। এবং যখনই বেরোই তখনই সব জানলা ভালো করে বন্ধ করে যাই। এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।

জুতোটা দোরগোড়ায় খুলে আমি জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম জানলার একটা পাল্লা তখনও বন্ধ রয়েছে। অন্য পাল্লার লোহার ছিটকিনিটা তোলা। ভেতর থেকে কেউ যেন একটা পাল্লা খুলে ফেলেছে। এরকম অসম্ভব ঘটনা কী করে ঘটল তা ভেবে পেলাম না।

জামাকাপড় না ছেড়েই অবসন্ন দেহে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। একবার ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। না, বৃষ্টি বা ঝোড়ো বাতাসে আর কিছু এলোমেলো হয়ে যায়নি। হ্যাঙ্গারে শার্ট দুটো ঝুলছে, খবরের কাগজটা দেরাজের উপরে যেমন ভাঁজ করা ছিল তেমনিই আছে। দেওয়ালে অনেকগুলি দেব—দেবীর ছবি। এগুলো সব যেমন ছিল তেমনটি আছে। ওপাশে দামী কাঠের ওপর মাউন্ট করা বাইসনের শিং জোড়াটাও এতটুকু নড়েনি।

দেব—দেবীর ছবিগুলো আমার নয়। ওগুলো বাড়িওলার। আমি সরিয়ে নিতে বলেছিলাম, বাড়িওয়ালা রাজি হননি। অগত্যা থেকেই গেছে। বাইসনের শিং জোড়াটাই আমার।

কিছুদিনের জন্যে নেপালে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরেছি গত সপ্তাহে। এখানে ফিরে পর্যন্ত লক্ষ করছি প্রায় প্রতিদিনই কিছু অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটছে। এতই সামান্য ঘটনা যে লোককে ডেকে বলার বা দেখাবার কিছু নেই। যেমন প্রথম দিন অফিস থেকে ফিরে তালা খুলতে গিয়ে দেখি তালা কিছুতেই খুলছে না। এমন কোনোদিন হয় না। শেষে রাস্তা থেকে কোনোরকমে একজন চাবিওয়ালাকে নিয়ে এলাম। সে আমারই চাবি নিয়ে তালায় ঢোকানো মাত্র তালা খুলে গেল। আশ্চর্য!

চাবিওয়ালা একটু হেসে চলে গেল।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে টাইমপিসটার দিকে তাকাতে দেখি ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। অবাক হলাম। কেননা প্রতিদিন সকালে উঠেই আমি সব আগে ঘড়িতে দম দিই। একবার পুরো দম দিলে তা অন্তত দুপুর পর্যন্ত চলে। কিন্তু সেদিনই দেখলাম ব্যতিক্রম। ভাবলাম, নিশ্চয়ই পুরো দম দেওয়া হয়নি। যাই হোক, নতুন করে দম দিতে লাগলাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই স্প্রিংটা কট করে কেটে গেল।

কী ঝঞ্ঝাট! এখন ছোটো ঘড়ির দোকান। উটকো খরচা তো আছেই, তার চেয়ে ঢের অসুবিধে, এখন বেশ কিছুদিন ঘড়িটা পাব না। রিস্টওয়াচ একটা আছে ঠিকই কিন্তু চোখের সামনে ঘড়িটা না থাকলে আমার চলে না। আসলে আমি একা থাকি। ঘড়িটাই যেন আমার সঙ্গী। রাতদুপুরে হয়তো ঘুম ভেঙে গেল। এই কলকাতা শহরেও নিঝুম রাতে সরু গলির মধ্যে চুন—বালি—খসা পুরোনো ঘরটার মধ্যে কেমন গা ছমছম করে। তখন টাইমপিসটার টিকটিক শব্দ শুনলে যেন মনে হয়—যাক, সচল কিছু একটা আমার ঘরে আছে।

আমি রোজ স্নানে যাবার আগে দাড়ি কামাই। রোজ দাড়ি না কাটলে চলে না। সেদিন খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি সেফটিরেজার নিয়ে শেভ করতে গিয়ে দেখি ব্লেড নেই। এমন কখনও হয় না। ব্লেড ফুরোবার আগেই নতুন এক প্যাকেট ব্লেড কিনে রাখি। যাক গে, হয়তো ভুলেই গেছি। তাড়াতাড়ি লুঙ্গির ওপর শার্ট চড়িয়ে ব্লেড কিনতে বেরোলাম। ব্লেড কিনে ফিরে এসে দেখি ব্লেডের একটা গোটা প্যাকেট আয়নার সামনেই রয়েছে।

ইস! এমন চোখের ভুলও হয়!

যাই হোক দেরি হয়ে গেছে বলে তাড়াতাড়ি দাড়ি কামাতে বসলাম। দুটো টান দিয়েছি, অমনি থুতনির নীচেটায় খচ করে কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল।

একে নতুন ব্লেড, তার ওপর তাড়াতাড়ি হাত চলছিল—কেটে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু রক্ত কিছুতেই আর বন্ধ হয় না। আমি তখন এমন নার্ভাস হয়ে গেলাম যে কোনোরকমে তুলো দিয়ে জায়গাটা জোরে চেপে ধরে শুয়ে রইলাম। ডাক্তারখানায় যাব সে শক্তিটুকুও ছিল না।

এসব ঘটনা কাউকে জানাবার নয়, তবু আমার কাছে রীতিমতো অস্বস্তিকর। সেদিন রক্তপাত দেখে ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল কিছু একটা অশুভ ঘটনা যেন ঘটতে চলেছে। আজ খোলা জানালা দেখে আরো ঘাবড়ে গেলাম। মনে হল অশুভ কিছু একটা প্রতিদিন যেন এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। অথচ কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না।

ক’দিন পর।

কোথা থেকে একটা বেড়াল এসে জুটেছে। সাদা লোমে ঢাকা বেড়ালটা দেখতে বেশ সুন্দর। খুব আদুরে। এসেই আমার পায়ে লুটোপুটি খেতে লাগল। বুঝলাম কারো বাড়ির পোষা বেড়াল। ভুল করে এখানে চলে এসেছে। এসেছে যখন থাক। দু’বেলা আমার পাতের এঁটোকাঁটা খেয়ে ও থেকে গেল। ভাবলাম ঘড়িটা তো দোকানে। এখন বেড়ালটাই আমার সঙ্গী হোক।

আমাদের এই গলির মুখে কতকগুলো রাস্তার কুকুর রাত্তিরে আড্ডা জমায়। অচেনা লোক দেখলেই এমন ঘেউ ঘেউ করে ওঠে যে বাছাধন পালাতে পথ পায় না। ফলে চোর—টোরের ভয় থাকে না।

রাত তখন কত জানি না। হঠাৎ কুকুরের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। এত রাত্রে কুকুরগুলো অমন করে ডাকছে কেন?

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। প্রথমে অন্ধকারেই দেখলাম সাদা বেড়ালটা পাগলের মতো একবার খোলা জানলাটার দিকে যাচ্ছে, একবার খাটের তলায় ঢুকছে। ওদিকে রাস্তার কুকুরগুলো ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে। কিন্তু এ চিৎকার অন্যরকম। অচেনা লোক দেখে তাড়া করে যাওয়া নয়—এ যেন কিছু একটা দেখে আতঙ্কে আর্তনাদ করে ওঠার মতো।

আশ্চর্য! কুকুরগুলো এত রাত্রে এই গলির মধ্যে এমন কী দেখল যে ভয়ে অমন করে ডাকছে!

তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বেলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালাম। আলো আর সেই সঙ্গে পরিচিত মুখ দেখে কুকুরগুলো শান্ত হল।

পরের দিন পাড়ার লোকদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছেন। আজ দিন দশ—পনেরো ধরে প্রতি রাত্তিরেই নাকি কুকুরগুলো ওইরকম বীভৎস সুরে ককিয়ে ককিয়ে ডাকে। কেন যে অমন করে ডাকে কে জানে! নিশ্চয়ই ভয়ানক কিছু দ্যাখে, কিন্তু সেটা কী বস্তু?

আমি বুঝলাম, অন্যদিনের ডাক আমি শুনতে পাইনি।

আমার ঘরটা পুরোনো, ভাঙাচোরা। রাতের বেলা আরশোলা, উচ্চিচংড়ে প্রভৃতি নানারকম পোকামাকড় ওড়ে। মাকড়সাগুলো তো রীতিমতো ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছে।

কী একটা জিনিস যেন পড়ে গেল—সেই শব্দে হঠাৎ গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বেলে দেখি আলমারির গায়ে ছাতাটা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, সেটা পড়ে গেছে। আর অমন ধীর শান্ত বেড়ালটা হঠাৎই বীর বিক্রমে বাইসনের শিং ধরে ঝুলছে।

শুধু ঝোলাই নয়, তার দুটো থাবা থেকে সরু সরু আটটা বাঁকানো তীক্ষ্ন নখ বের করে বাইসনের মুখটা আঁচড়াচ্ছে।

নিশ্চয়ই দেওয়ালে পোকামাকড় ধরবার জন্যে লাফাতে গিয়ে বাইসনের শিং—এ আটকে গিয়ে ঝুলছে—তা বলে নেপাল থেকে কেনা আমার অমন শখের বাইসনটার মুখ আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে?

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। উঠে, হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে ছাতাটা তুলে নিয়ে বেড়ালটাকে দু’—চার ঘা দিয়ে ঘর থেকে দূর করে দিলাম।

পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই চোখ পড়ল বাইসনের মাউন্ট করা মুখটার দিকে। হতভাগা বেড়ালটা মুখটাকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। একে বীভৎস মুখ, তার ওপর বেড়ালের নখের আঁচড়ে আঁচড়ে এখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

বাইরে থেকে নেপালে যারা বেড়াতে যায় তারা যে শুধু ইমপোরটেড গুডস অর্থাৎ বিদেশি জিনিসপত্তর, যেমন ছাতা, টর্চ, সেফটিরেজার, লাইটার, রেকর্ড—প্লেয়ার কেনে তা নয়, কিউরিয়ো থেকেও দুষ্প্রাপ্য পুরোনো আমলের জিনিস কেনার দিকেও ঝোঁকে।

নেপালে যে হোটেলে ছিলাম সেখানে সবার মুখেই শুনলাম, এখানে কোথাও বাইসনের মাউন্ট করা শিংসুদ্ধু মাথা পাওয়া যায়। দুর্দান্ত জিনিস। ভক্তপুরে নেয়ারি রাজাদের ঘরে নাকি বহুকাল ছিল। তারপর এখন নেপালের কিউরিয়ো শপে তার গতি হয়েছে।

কিন্তু কোন কিউরিয়োর দোকানে পাওয়া যায় তা সঠিক কেউ জানে না।

জিনিসটা যে কী, কেনই বা দুর্দান্ত, কীসের জন্যেই বা লোকের এত আকর্ষণ কিছুই জানি না। শুধু ওটা কেনার জন্যে পাগল হয়ে উঠলাম। নানা মঠ, মন্দির, প্যাগোডা দেখতে দেখতে একদিন একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ভক্তপুরে চলে এলাম।

‘ভক্তপুর’ নাম থেকেই বুঝতে পারা যায় একসময়ে জায়গাটায় ভক্তরা থাকতেন। তাঁরা হিন্দু কী বৌদ্ধ তা জানি না। তবে কাছাকাছি হিন্দুদের অনেক পুরোনো মন্দির দেখতে পেলাম।

ভক্তপুর জায়গাটা নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে পুব দিকে আট মাইল দূরে। এখানেই একসময়ে দুশো বছরেরও আগে নেয়ারি রাজারা বাস করতেন। তাঁদের রাজপ্রাসাদ এখনো আছে।

ঘুরতে ঘুরতে এখানে একটা কিউরিয়োর দোকান পেলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি, নানারকমের পুরোনো পুঁতির মালা, রুদ্রাক্ষের মালা, কারুকার্যকরা বড়ো বড়ো ছোরা, দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখার জন্য ভীষণদর্শন মুখ, এমনি অনেক জিনিস রয়েছে। আমি কৌতূহলী হয়ে এদিক—ওদিক কিছু খুঁজছি দেখে দোকানি জিজ্ঞেস করল—কী চাই?

আমি একে বিদেশি, তার ওপর এদেশের কিছু জানি না—সসংকোচে বাইসনের শিং—এর কথা জিজ্ঞেস করলাম।

দোকানদার আমার মুখে বাইসনের শিং—এর কথা শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আপনি কিনবেন?

এমনভাবে বলল যেন ও জিনিস কেনার অধিকার আমার নেই।

বললাম, দামে পোষালে আমি কিনব। আর আগে জিনিসটা দেখতে চাই।

লোকটি তখন একজন কর্মচারীর হাতে একগোছা চাবি দিয়ে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে বলল।

দোকান থেকে বেরিয়ে গলি—ঘুঁজি দিয়ে শেষে একটা বিরাট প্রাসাদের মস্ত কাঠের দরজার কাছে লোকটা এসে দাঁড়াল। এ চাবি ও চাবি দিয়ে গোটা পাঁচেক দরজা খুলে শেষে সুন্দর একটা সাজানো—গোছানো ঘরে এনে দাঁড় করাল।

ঘরটি পুরোনো কালের রাজা—রাজড়াদের জিনিসপত্রে ভর্তি। রাজসিংহাসন, রাজার মাথার ছাতা, বিরাট ঢাল, বাঁকা তরোয়াল, গোলাপপাস, আতরদান, ঝাড়লণ্ঠন এমন কত কী! হঠাৎ লক্ষ পড়ল দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে বিরাট এক মোষের মাথা। দেখেই বুঝলাম এইটেই সেই বাইসন!

বাইসন হচ্ছে আমেরিকার এক জাতীয় বুনো মোষ। মোষ যে এরকম ভয়ংকর হয় তা জানা ছিল না। চোখ দুটো লাল—যেন ক্রোধে জ্বলছে। মোটা মোটা দুটো বাঁকানো শিং।

বোঝা যায়, কোনো এককালে কোনো রাজা দুর্ধর্ষ এই জীবটিকে শিকার করেছিলেন। তারপর তাঁর এই বীরত্বপূর্ণ কীর্তিটাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যে গোটা মাথাটা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে যেমন ছিল তেমনি রেখে হরতনের আকারে একটা কুচকুচে কালো কাঠের ফ্রেমে মাউন্ট করে রেখেছেন। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, শিংগুলো এমন কিছু দিয়ে রং করা যা দেখলে যে কেউ মনে করবে এটা বুঝি সোনার।

একটা কথা ভেবে আশ্চর্য হলাম—আমেরিকার বাইসনের নাগাল নেপালের রাজা পেলেন কী করে!

সে কূটতর্ক থাক জিনিসটা দেখে আমার এত পছন্দ হল যে টাকার মায়া না করে কিনে ফেললাম।

হোটেলে সবাই এই দুষ্প্রাপ্য মহামূল্যবান জিনিসটা দেখে ঈর্ষায় ফেটে পড়ল। শুধু হোটেলের ম্যানেজার আমায় বললেন, বাবু, এটা তো কিনলে কিন্তু রাখবে কোথায়?

বললাম, কেন? আমার ঘরে।

ম্যানেজার হেসে বললেন, এ বাইসন যে সে ঘরে থাকে না। রাজপ্রাসাদ চাই। কত জনে নিয়ে গেছে, শেষে বিনা পয়সায় ফেরত দিয়ে বেঁচেছে।

আমি কোনো উত্তর দিইনি। বুঝলাম ম্যানেজার আমায় ঠাট্টা করছে।—আমার ঘর—বাড়ি যত ভালোই হোক, এ জিনিস মানাবে না।

কুসংস্কারে বা অলৌকিকত্বে আমার এতটুকু বিশ্বাস নেই। আমি ওটিকে কলকাতায় এনে আমার সেই ভাঙাচোরা ভাড়াটে ঘরে সযত্নে টাঙিয়ে রেখেছিলাম। তারপর থেকেই যে সব ছোটোখাটো ঘটনা ঘটছিল তা অস্বস্তিকর হতে পারে কিন্তু অস্বাভাবিক বা অলৌকিক বলে মনে করিনি। আজ বেড়ালটার নখের আঁচড়ে আঁচড়ে বাইসনের এমন মুখটা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় দুঃখ পেলাম।

কয়েক দিন পর।

অফিস—ফেরত ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দিকে গিয়েছিলাম সেই ভুটানিটার সন্ধানে। দেখি ওরা এ বছরের মতো পাততাড়ি গোটাচ্ছে। আমি যে লোকটির কাছ থেকে মাফলার কিনেছিলাম সে লোকটিও রয়েছে। কিন্তু সে তখন তার দেশীয় লোকদের সঙ্গে কী একটা বিষয় নিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় এমনই তর্ক করছিল যে আমায় দেখে লজ্জা পেল। আমি কিছু বলার আগেই সে ইশারায় আমায় বাড়ি চলে যেতে বলল। একটু পরে সে নিজেই গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে।

তখন সন্ধে হয়ে গেছে। তার ওপর লোডশেডিং। শেষ মাঘে হঠাৎ শীতটা যেন জাঁকিয়ে বসেছে। সর্বাঙ্গে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে অন্ধকার গলির মধ্যে দিয়ে সাবধানে হেঁটে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। পকেট হাতড়ে চাবি বের করে তালা খুললাম। সঙ্গে সঙ্গে গা—টা কেমন যেন ছমছম করে উঠল। এমন তো কোনোদিন হয় না।

আমি চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে জুতোটা খুললাম। দু’ হাতে দরজার দুটো পাল্লা ছড়িয়ে দিলাম। এবারে অন্ধকারে মেঝেতে পা ফেলতেই যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল। মেঝেতে সাদা মতো কী একটা পড়ে আছে। আর তার সামনে দুটো জ্বলন্ত চোখ। শুধু জ্বলন্ত নয়, জীবন্ত।

সেই জীবন্ত চোখ দুটো যেন অন্ধকারের মধ্যেও আমাকে চেনবার চেষ্টা করছে।

আমি ভয়ে চিৎকার করতে গেলাম। কিন্তু স্বর বেরোল না। আমার মাথা ঘুরতে লাগল, পা টলতে লাগল। বুঝতে পারলাম আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি…আর ঠিক সেই সময়েই কে যেন বাইরে থেকে ডাকল—বাবুজি!

কেমন করে তারপর দশ—পনেরো মিনিট কেটেছে জানি না। হঠাৎই দেখলাম কারেন্ট এসে গেছে। আর ভুটানি লোকটি একদৃষ্টে মেঝের ওপর লক্ষ করছে। বেড়ালটা রক্তাক্ত অবস্থায় অবস্থায় মরে পড়ে আছে—তারই পাশে বাইসনের শিংসুদ্ধু মাথাটা কাঠ থেকে খুলে পড়েছে।

ভুটানি জিজ্ঞেস করল, বাবুজি, এ জিনিস কোথায় পেলেন?

দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্তস্বরে সব ঘটনাই বললাম।

ও বলল, বাবুজি, এ জিনিস ঘরে রাখবেন না।

বললাম, কী করব?

সে বলল—আমি ব্যবস্থা করব। তবে এখন নয়, রাত বাড়লে। আর বাবু, আজকের রাতটা আপনি এখানে থাকবেন না। আমি একাই থাকব।

অগ্যা প্রাণের দায়ে এক অচেনা ভুটানির হাতে ঘর ছেড়ে দিয়ে আমি এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেলাম।

পরের দিন সকালে এসে দেখি ঘরের সামনে লোকের ভিড়। বাড়িওলা ভোরে উঠে দেখেন ঘর খোলা অথচ আমি নেই। বুঝলেন চোর এসেছিল। তারপরই লোক ডাকাডাকি করেছেন। আমায় দেখে তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, কী মশাই! কাল কোথায় ছিলেন? এদিকে—

আমি সব কথাই চেপে গেলাম। শুধু বললাম, বিশেষ দরকারে কাল রাত্তিরে এক আত্মীয়ের বাড়ি থাকতে হয়েছিল।

—দেখুন দেখি! আর সেই সুযোগেই চোর এসে হানা দিল। কুকুরগুলোও ডাকল না মশাই! আশ্চর্য!

বাড়িওলা আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, কী কী জিনিস চুরি গেছে, ঠান্ডা মাথায় একটা লিস্ট করে ফেলুন। থানায় জানাতে হবে তো। বলে তিনি শশব্যস্তে ওপরে চলে গেলেন।

লিস্ট করার দরকার হয়নি। কেননা আমি ভালো করে দেখেছি, কিছুই চুরি যায়নি। যাবার মধ্যে গেছে বাইসনের শিংওয়ালা মাথাটা আর নিখোঁজ সেই ভুটানি লোকটি।

তাকে ধন্যবাদ সে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।

১৯৮৮, শুকতারা শারদীয়া

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *