ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

নিষেধ

নিষেধ

কেন যে হঠাৎ সুদূর দিল্লি থেকে মধুপুরে মিসেস অ্যান্টনিকে চিঠি লিখে বসলাম সে কথাটা ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাই।

লিখলাম—দিন দশেকের জন্যে নদীর ধারে মিস্টার গুহর সেই বাড়িটা ভাড়া পাওয়া যাবে কি?

উত্তর সঙ্গে সঙ্গেই পেলাম। মিসেস অ্যান্টনি লিখছেন—চেঞ্জে আসবে তো? তা ওটা কেন? ভালো বাড়ি আমার হাতেই আছে। মিস্টার গুহর বাড়িটা সংস্কারের অভাবে প্রায় অব্যবহার্য হয়ে গেছে।

উত্তরে লিখলাম—ঠিক চেঞ্জে যাবার জন্যে নয়। ওই বাড়িটার সঙ্গে আমাদের পরিবারের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হঠাৎই বাড়িটা একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনি অনুগ্রহ করে জানান কত ভাড়া লাগবে। টাকাটা পাঠিয়ে দেব। আর বাড়িটা মোটামুটি বাসোপযোগী (অন্তত একটি ঘর—কেননা আমি একাই যাব) করতে যা খরচ লাগবে তাও পাঠিয়ে দেব। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করবেন। আমি আবারও বলছি—হঠাৎই যাবার খেয়াল হয়েছে। দেরি হলে হয়তো মত বদলে যাবে।

মিসেস অ্যান্টনিদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের যোগ অনেক দিনের। আমরা যতবারই মধুপুর চেঞ্জে গিয়েছি, মিসেস অ্যান্টনিই বাড়ি ঠিক করে দিতেন। গুহ সাহেবের বাড়িটাই আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল। নদীর ধারে বাড়িটা। লোকের কোলাহলও নেই। শান্ত পরিবেশ। বাড়িটাও বেশ বড়ো। অনেকগুলো ঘর। চারিদিক ঘিরে বিরাট কম্পাউন্ড। তার অনেকটাই ঝোপজঙ্গলে ভর্তি হয়ে থাকত। গুহসাহেব কলকাতায় থাকেন। এখানে বড়ো একটা আসেন না। বাড়িটা দেখাশোনার ভার মিসেস অ্যান্টনিকেই দিয়ে রেখেছেন।

আগেই বলেছি, এ বাড়িতে আমরা সপরিবারে অনেকবার এসেছি। মাঝে কয়েক বছর আসা হয়নি। শেষ এসেছিল শুধু দিদি আর জামাইবাবু অসীমদা। মাসখানেক ছিল। তারপর কী যে হয়ে গেল! আর কেউ এমুখো হতে চায় না। মধুপুরের কথা উঠলেই বাবা গম্ভীর হয়ে যান। মা নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে। আমিও ঠিক করেছিলাম আর কখনও এখানে আসব না। ব্যস! মধুপুরের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ। তারপর হঠাৎই কী হল, মধুপুরে সেই বাড়িতে যাবার জন্যে মন ছটফট করে উঠল।

টাঙ্গা থেকে যখন বাড়িটার সামনে নামলাম তখন শীতের বেলা মিইয়ে এসেছে। মাঘের শীত বেশ জেঁকে বসছে। মিসেস অ্যান্টনি হাসতে হাসতে ওঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাদের সকলের কুশল সংবাদ নিয়ে চাবিটা দিয়ে বলে গেলেন—জলটল সব রেডি আছে। হাতমুখ ধুয়ে নাও। চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

গেট ঠেলে কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকলাম। এই সেই বাড়ি। তাহলে আবার এখানে আসতে হল।

তখন সূর্য ডুবছে। বাড়ির সামনে দীর্ঘ ইউক্যালিপ্টাস গাছের মাথায় পড়ন্ত সূর্যের ম্লান আলো। এমনি পড়ন্ত রোদ এর আগেও এই বাড়িরই কার্নিসে কার্নিসে, টানা বারান্দার পশ্চিমদিকের মেঝের ওপর কতবার দেখেছি। কিন্তু এমন মন—কেমন—করা ভাব কখনো হয়নি।

তালা খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। এটাই এবার আমার বেডরুম। কিছু কিছু প্লাস্টারের কাজ হয়েছে, হোয়াইট ওয়াশও হয়েছে। জানলায়, দরজায় নতুন ছিটকিনি লাগানো হয়েছে। একটা চৌকিরও ব্যবস্থা হয়েছে দেখে খুশি হলাম। বিছানাপত্তরও নিশ্চয় মিসেস অ্যান্টনিই দিয়েছেন। ঘরের কোণে জলভর্তি কুঁজোটি পর্যন্ত।

একটু পরে মিসেস অ্যান্টনির বাড়ি থেকে ডিমের ওমলেট, দু—স্লাইস পাঁউরুটি আর চা এল। খুবই খিদে পেয়েছিল। তাড়াতাড়ি প্লেটটা টেনে নিলাম।

দু’বেলা খাওয়ার ব্যবস্থাও মিসেস অ্যান্টনির বাড়ি। কাজেই শুধু উদ্দেশ্যহীন বেড়ানো আর মিসেস অ্যান্টনির বাড়ি আড্ডা দেওয়া ছাড়া আমার আর অন্য কাজ ছিল না।

দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। কোনো অসুবিধে নেই। অত বড়ো বাড়িতে একা থাকি, তাতেও ভয় পাই না। কিন্তু একটা কথাই বারে বারে মনে হচ্ছিল—কেন হঠাৎ এলাম? এমন কি আমার আসার খবর পর্যন্ত দেশের বাড়িতে জানাইনি। জানাইনি তার প্রধান কারণ—কেন এলাম তা তো পরিষ্কার করে কাউকে বোঝাতে পারব না।

সাত দিন কেটে গেল। আর মাত্র তিন দিন থাকব। কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আমার এই আসাটা একেবারে নিরর্থক নয়, নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু কী ঘটতে পারে সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।

মিসেস অ্যান্টনির বয়স হয়েছে। ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি—নাতনি নিয়ে তাঁর বেশ বড়ো সংসার। ওঁদের বাড়ি গেলেই মিসেস অ্যান্টনি পুরোনো দিনের কথা তোলেন। জিজ্ঞেস করেন—মা কেমন আছেন, বাবার বয়েস কত হল, হাঁটাচলা করতে পারেন কিনা। তারপরেই স্মৃতি হাতড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন—তুমি বোধহয় এখানে লাস্ট এসেছিলে যখন তোমার দিদি—জামাইবাবু এখানে ছিলেন।

কথাটা এড়িয়ে যাবার জন্যে সংক্ষেপেই উত্তর দিই—হ্যাঁ।

—তোমার জামাইবাবু মানুষটাও বেশ ভালো ছিলেন। যেমন হ্যান্ডসাম চেহারা, তেমনি হইচই করতে ভালোবাসতেন।

বললাম—অসীমদা সত্যিই খুব চমৎকার মানুষ। আমি তো যে ক’দিন এখানে ছিলাম—

বাধা দিয়ে মিসেস অ্যান্টনি বললেন—তবে উনি বোধহয় একটু ক্রেজি টাইপের ছিলেন।

—ক্রেজি! অস্বাভাবিক প্রকৃতির? না—না—

—আমি দুঃখিত। ক্রেজি বলাটা আমার ঠিক হয়নি। আসলে কিছু কিছু ছেলেমানুষি ছিল।

আমি হেসে বললাম—যত বয়স্কই হোক না কেন, সবার মধ্যেই অল্পবিস্তর ছেলেমানুষি থাকে।

—তা বলে নির্জন দুপুরে কোনো বয়স্ক মানুষ একা একা ইঁদুরের ল্যাজে দড়ি বেঁধে ঘোরায় না। বলে মিসেস অ্যান্টনি তাঁর সামনের পড়ে যাওয়া দাঁত দুটোর ফাঁক দিয়ে হাসলেন।

বললাম—সে হয়তো দিদিকে ভয় দেখাবার জন্যে। ইঁদুর, আরশোলা, মাকড়সায় দিদির খুব ভয় ছিল।

—তোমার দিদির হার্টের ট্রিটমেন্ট জামাইবাবু করিয়েছিলেন?

মিসেস অ্যান্টনির এই ধরনের জেরা আমার ভালো লাগছিল না। তবু একটু উঁচু গলাতেই বললাম—দিদির যে হার্টের অসুখ ছিল তা আমরাই কখনও জানতাম না।

—তা বটে। বলে মিসেস অ্যান্টনি একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।

—এই দ্যাখো না আমার অবস্থা। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। তবে না জানা গেল আমি হাই প্রেশারের রুগি হয়ে আছি। সে থাক, তোমার সেই সুন্দরী বোনটির খবর কি? কি যেন নাম?

—আমার পিসতুতো বোনের কথা বলছেন? মিন্টু?

—হ্যাঁ—হ্যাঁ। ওর বিয়ে—থাওয়া হয়েছে?

বললাম—না, চেষ্টা চলছে।

পিসেমশাই, পিসিমা মারা যাবার পর সেই কোন ছোটবেলায় মা—ই ওকে নিজের কাছে এনে রাখে। সেই থেকে ও আমাদের সংসারেই রয়েছে। দিদির চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোটো হলেও দিদি ওকে খুব ভালোবাসত। যখনই কোথাও যেত মিন্টুকে সঙ্গে নিয়ে যেত। দুই বোন ম্যাচ করে একই রকম শাড়ি—ব্লাউজ পরত। শুতোও দুজনে একসঙ্গে। এক কথায় ওরা শুধু দু’বোনই নয়, যেন দুই বন্ধু। দিদির বিয়ে দিতে গিয়ে বাবা প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। এখন দুর্ভাবনা মিন্টুকে নিয়ে।

ন’টা দিন কেটে গেল। কাল চলে যাব।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, পুরো একমাসের ভাড়া গুনলে, আর কটা দিন থেকে যাও। এই সময়টাই তো চেঞ্জের পক্ষে ভালো।

বললাম—না মাসিমা, ছুটি ফুরিয়ে গেল। কাল যেতেই হবে।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, এত তাড়াতাড়িই যদি যাবে তাহলে দিল্লি থেকে এত খরচ করে মাত্র দশ দিনের জন্যে শুধু শুধু এলে কেন?

কী উত্তর দেব? শুধু একটু হাসলাম। সে প্রশ্নের উত্তর আমিও তো খুঁজছি।

রাত তখন ন’টা।

শীতের রাত। এমনিতেই পল্লিটা নিঝুম। এখন এই রাত ন’টাতেই মনে হচ্ছে যেন একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। মনে হল যেন আমি কোনো মৃতের রাজ্যে বাস করছি।

মৃতের রাজ্য কথাটা মনে হতেই গা—টা কেমন ছমছম করে উঠল। এই ন’দিনের মধ্যে কোনোদিনই আমার এমন ভয় করেনি। হঠাৎ আজই বা কেন এইরকম একটা বিশ্রী অস্বস্তি হচ্ছে বুঝতে পারলাম না।

আমি একটা বই পড়ছিলাম। বইটা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব বলে উঠে দাঁড়ালাম। আলো নেভাবার আগে দরজাটায় ঠিকমতো খিল দিয়েছি কিনা দেখে নিলাম। জানলাগুলোও দেখে নিলাম ভেতর থেকে বন্ধ।

আলো নেভাতে যাচ্ছি—হঠাৎ মনে হল এই মুহূর্তে ঘরে আমি একা নই। এতক্ষণ ঘরের মধ্যে যে বদ্ধ বাতাসটা ছিল, হঠাৎ তার তাপমাত্রাটাও কেমন কমে গেল অস্বাভাবিক মতো। আমি শীতে কুঁকড়ে গেলাম। আর তখনই দেখলাম কেউ একজন প্রায় নিঃশব্দে আমার বিছানার দিকে এগিয়ে আসছে।

আমার সর্বাঙ্গ ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

তারপরই যা দেখলাম তাতে একই সঙ্গে ভয়, বিস্ময়, আনন্দ আমাকে একেবারে অভিভূত করে দিল।

দেখলাম—আমার দিদি, যে কয়েক বছর আগে এই বাড়িতেই হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল, সে আমার বিছানার এক কোণে তার সেই চির—অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে।

দিদির সেই সুন্দর মুখখানি এক স্বর্গীয় আভায় আরও সুন্দর লাগছিল। তাকে বাড়িতে যে প্রিয় শাড়িখানি পরে প্রায় ঘোরাফেরা করতে দেখতাম সেই শাড়িখানাই পরা, তার এলো খোঁপা ঠিক আগের মতোই কাঁধের ওপর যেন ভেঙে পড়েছে।

কয়েক মুহূর্ত আমি দিদির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি ভুল দেখছি কিনা মেলাবার জন্যে খুবই সচেতনভাবে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ লক্ষ করতে লাগলাম।

না, ভুল নয়। ভুল হতে পারে না। তার যে হাতখানি কোলের উপর রাখা তা কঙ্কাল নয়, জীবন্ত মানুষেরই হাত। তার চুড়ি, বিয়ের আংটি, কানের দুল সবই ঠিক ঠিক। শুধু গলায় কালো কারের সঙ্গে পাথরের যে লকেটটা সবসময়ে পরে থাকত সেই লকেটটা নেই। আছে শুধু কালো কারটা। পরিবর্তনের মধ্যে দিদি যেন একটু মোটা হয়েছে। কেননা ওর মেরুন রঙের ব্লাউজটা গায়ে টাইট হয়ে এঁটে আছ—যেমন কালো কারটা বৈষ্ণবীদের কণ্ঠীর মতো গলার সঙ্গে লাগা।

এবার স্পষ্ট করে দিদির দিকে তাকালাম। দিদি একটু হাসল। কিন্তু বড়ো ম্লান সে হাসি। তারপরই স্পষ্ট দেখলাম দিদি ধীরে ধীরে হাতটা তুলে কারটা একবার ছুঁল, যেন খোলবার চেষ্টা করল।

—দিদি! বলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। কিন্তু দিদি উত্তর দিল না।

আমি পাগলের মতো দিদিকে ছোঁবার জন্যে ছুটে গেলাম আর তখনই আলোটা নিভে গেল। বোধহয় লোডশেডিং হল। আমি অন্ধের মতো এগোতে গিয়ে অন্ধকারে দেওয়ালে দেওয়ালে ঠোক্কর খেতে লাগলাম। কোনোরকমে বিছানায় গিয়ে টর্চটা নিয়ে জ্বাললাম। কিন্তু দিদি তখন অদৃশ্য।

দিল্লি যাওয়া হয়নি। পরের দিনই সোজা চলে গেলাম দেশের বাড়িতে। এত বড়ো খবরটা মা, বাবা, মিন্টুকে না দিলেই নয়। দিদির অকাল, অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর থেকে ওদের মানসিক অবস্থা যাকে বলে অবর্ণনীয়, তাই।

যে উত্তেজনা নিয়ে খবরটা দিতে গিয়েছিলাম, বাড়ি ঢুকেই আর একটা খবরে উৎসাহটা যেন মিইয়ে গেল।

প্রথমেই দেখা বাবার সঙ্গে। বাবা হেসে বললেন, এই যে তুমি এসে পড়েছ! আজই তোমায় সুখবরটা লিখতে যাচ্ছিলাম।

যাক—তবু সুখবর।

বাবা বললেন, শেষ পর্যন্ত অসীমের সঙ্গেই মিন্টুর বিয়ে ঠিক করলাম। রীণা চলে যাবার পর থেকে এ ক’বছর ও তো পাগলের মতো কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত মিন্টুকেই চাইল। বলল, আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখতে চায়।

সুখবর বৈকি! অসীমদার মতো ছেলে দেখা যায় না। দিদির নিতান্ত দুর্ভাগ্য—এমন স্বামী পেয়েও এক বছরের বেশি ঘর করতে পারল না। চলে গেল হঠাৎই। সেই অসীমের সঙ্গে যদি মিন্টুটার—

—তবে তোমার মায়ের তেমন ইচ্ছে ছিল না। ওর যে কী অদ্ভুত ধারণা! তা যাক। এখন উনি রাজি হয়েছেন।

একটু পরে চা—জলখাবার খেয়ে সকলের সামনেই মধুপুরের ঘটনাটা হুবহু বলে গেলাম। বাবা ওঁর চিরাচরিত অবিশ্বাসী মন নিয়ে ঠাট্টার হাসি হেসে ইজিচেয়ারে গিয়ে শুলেন। কিন্তু মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল। আর দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল।

তারপর যখন গলায় লকেট ছাড়া কারটার কথা বললাম তখন মা হঠাৎ চমকে উঠল।

—লকেটটা ছিল না?

—না।

—কেন? শাড়ি থেকে আংটি পর্যন্ত সব রইল আর লকেটটা নেই! শুধু কারটা?

—হ্যাঁ। আর সেটাও আবার বোধহয় মোটা হবার জন্যে, গলায় আঁট হয়ে বসেছিল। দিদি একবার হাত তুলে সেটা খোলবার চেষ্টাও করল যেন—তখনই লোডশেডিং হয়ে গেল।

—ওগো শুনছ! বলেই মা হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল।

মায়ের অবস্থা দেখে বাবা চমকে উঠলেন।

—আমি যা ভয় করেছিলাম তাই। তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করনি, কিন্তু আজ এতদিন পর নিজে দেখা দিয়ে যা ঘটেছিল তা জানিয়ে গেল।

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

মা যেন উদভ্রান্তের মতো ড্রয়ার হাতড়াচ্ছে। অনেক খুঁজে একটা ইনল্যান্ড খাম পেল। সেটা আমার দিকে ছুড়ে দিল।

—তোমার বাবাকে দেখিয়েছিলাম। হেসেছিল। এখন তুমি পড়ে দ্যাখো।

চিঠিটা মধুপুর থেকে লেখা। বিশেষ কিছু নয়। শুধু কয়েক ছত্র।

—মাগো, খুব ভয় পেয়ে এই চিঠি গোপনে তোমায় লিখছি। এখানে এসে দেখছি মাঝে মাঝে ও যেন কীরকম হয়ে যায়—বিশেষ গভীর রাতে। আমায় কীরকম ভয় দেখায়। আমি প্রথম প্রথম ভাবতাম মজা করছে। কিন্তু কাল রাত্তিরে যা করল—কোথা থেকে একটা বেড়াল ধরে এনে তার গলায় ফাঁস—

আর লেখা হল না। ও আসছে।…

অর্ধেক লেখা চিঠিটা পড়েই আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। মনে পড়ল মিসেস অ্যান্টনির কথা।—নির্জন দুপুরে অত বড়ো মানুষটা ইঁদুরের ল্যাজে দড়ি বেঁধে ঘোরাত। তবে কি—

মা বললে, তখনই বলেছিলাম পোস্টমর্টেম করাও। কিন্তু তোমরা কেউ শুনলে না। আমি মা বলেই তার সব কথা বুঝতে পেরেছিলাম। আমার একটা মেয়ে গেছে, আর একটাকে কিছুতেই যেতে দেব না।

সেদিনই বাবা সম্মতি জানিয়ে অসীমদাকে চিঠি লিখে রেখেছিলেন। শুধু পোস্ট করার অপেক্ষা। মায়ের ওপর রাগ করে বাবা চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন।

দিল্লি ফিরে এসেছি।

মাস কয়েক পর কাগজে একটা খবর পড়ে চমকে উঠলাম। কলকাতায় কোন এক অসীম চৌধুরীকে পুলিশ খুনের অপরাধে গ্রেপ্তার করেছে। সে নাকি তার নব বিবাহিতা স্ত্রীকে গলায় কালো কারের ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করেছে। হত্যার কারণ জানা যায়নি। ছবিটাও দেখলাম। এ আমারই অতি প্রিয় জামাইবাবু।

আজ এক এক সময় ভাবি, মিন্টুর সঙ্গে যাতে বিয়ে না হয় সেই কথাই কি দিদি সেদিন রাত্তিরে ইঙ্গিতে জানিয়ে গেল? সেই কথা তাড়াতাড়ি জানাবার জন্যেই কি অদৃশ্য এক শক্তি সুদূর দিল্লি থেকে আমায় মধুপুরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল?

১৯৯১, শুকতারা শারদীয়া

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *