ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

রহস্যকুঠির রানি

রহস্যকুঠির রানি

বড়োদিনের ছুটিতে ভাইপোটাকে নিয়ে মধুপুরে বেড়াতে যাব ঠিক করেছি। মধুপুরে কিছুদিন থেকে দেওঘর গিরিডিও নিয়ে যাব। দেওঘরের ত্রিকূট পাহাড়, গিরিডির উশ্রী প্রপাত ডাকু আজ পর্যন্ত দেখেনি। এবার না দেখালেই নয়।

ডাকুর তো আর রাতে ঘুম হয় না। কেবলই জিজ্ঞেস করে—কাকু, কবে মধুপুর যাব?

দিন যদি বা স্থির হল, তারপর থেকে ডাকু ব্যস্ত হয়ে পড়ল কী কী জিনিস সঙ্গে নেওয়া হবে তাই ঠিক করতে। হোক দশ দিনের জন্য তবু তো বাইরে যাওয়া।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত এক শীতের বিকেলে আমরা দুজনে মধুপুরে এসে নামলাম। ভেবেই রেখেছিলাম কোনো হোটেলে একটা রুম নেব। সেই মতো টাঙ্গাওয়ালা বেশ নামকরা একটা হোটেলে নিয়ে এসে আমাদের ছেড়ে দিল। কিন্তু হা মন্দভাগ্য! হোটেলে জায়গা নেই।

ম্যানেজার আরো সাংঘাতিক কথা শোনালেন—শুধু হোটেল কেন, একটা খালি বাড়িও পাব না। চেঞ্জারদের ভিড় এখন নাকি খুব।

আমি যখন নাছোড়বান্দা তখন উনি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললেন, একটা বাড়ির সন্ধান দিতে পারি। কিন্তু টিকতে পারবেন কি?

—কেন? ভূতের বাড়ি নাকি?

ম্যানেজার মাথা দোলালেন, লোকে তো তাই বলে। এক রাত্তিরের বেশি কেউ থাকতে পারে না।

ডাকু এই সময়ে আমার হাতে চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বললে, ওই বাড়িতেই চলো কাকু। ভূত দেখা যাবে।

আমি তখন ভালো মানুষের মতো ম্যানেজারকে বললাম, কী আর করা যাবে। ঠিকানাটা দিন। ভূতের বাড়িতেই ক’দিন কাটাই।

ম্যানেজার তখন কোথা দিয়ে কোথায় যেতে হবে বুঝিয়ে দিলেন। শহরের বাইরে নদীর ধারে এক কবরখানা। তারই পাশে বিরাট একটা গম্বুজওলা পুরোনো দোতলা বাড়ি। সেই বাড়িতে একজন মহিলা থাকেন। তিনিই বাড়ির মালিক। তিনি যদি রাজি হন তাহলে হয়তো একটা ঘর পেতে পারেন।

আমি হতাশার সুরে বললাম, যা শুনছি তাতে মনে হয় ভাড়া দেবেন না।

ম্যানেজার বললেন, দেখুন, সে আপনার কপাল। তবে উনি অনেককেই দিয়েছেন আর কেউ এক রাত্তিরের বেশি টিকতে পারেনি। হ্যাঁ, পুরো ভাড়াটা কিন্তু তিনি আগাম নিয়ে থাকেন।

—তাতে অসুবিধে নেই। বলে তখনই ডাকুকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম।

শীতের বেলা তখন শেষ হয়ে এসেছে। টাঙ্গাটা আমাদের এক জায়গায় নামিয়ে দিল। বলল, ওদিকে আর গাড়ি চলবে না। রাস্তা খারাপ।

অগত্যা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছলাম। আর নদীর পশ্চিম দিকে একরাশ বুনো ফুলের আড়ালে একটা পুরোনো সমাধিক্ষেত্রও আবিষ্কার করলাম। এবার বাড়িটা খুঁজতে হবে। ভাগ্য ভালো—বাড়িটাও খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। অনেকগুলো সার সার ইউকালিপ্টাস গাছের আড়ালে বাড়িটা যেন লুকিয়ে ছিল।

আমরা যখন ফটক ঠেলে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম তখন রীতিমতো অন্ধকার। শহরে ইলেকট্রিক থাকলেও এ পল্লিতে আলো অসেনি। এখানে যে অল্প কয়েক ঘর বসতি আছে তাদের প্রায় সবাই খ্রিস্টান। কিন্তু দেখেই বোঝা যায়, ওদের জীবনে জাঁকজমক বলে কিছু নেই। সারাদিন খাটেখোটে। তারপর সন্ধে হলেই যে যার বাড়ি ঢুকে খিল বন্ধ করে। কারো সঙ্গে কারো যেন যোগাযোগ নেই। ইলেকট্রিক আলোর জন্যে মাথা কোটাকুটিও করে না। যাই হোক, আমরা সেই বাড়ির বাইরের ঘরে ঢুকলাম। অন্ধকার ঘর।

আমি ডাকলাম—কেউ আছেন? সাড়া নেই। আবার ডাকলাম। এবারও সাড়া নেই। ব্যাগ থেকে টর্চ বার করে জ্বাললাম। সামনে আর একটা দরজা। সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। এবার লম্বা দালান। ওপাশে মনে হল ওপরে ওঠার সিঁড়ি। আমরা সেই দালানে ঢুকতেই একটা মস্ত জালে ঢাকা খাঁচার মধ্যে থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো মুরগি যেন ভয়ে কোঁকর কোঁ—কোঁকর কোঁ করে ডেকে উঠল।

ডাকু ফিসফিস করে বললে, এত মুরগি? বাড়িউলি কি মুরগির ব্যবসা করে, না খায়?

আমার তখন অন্য চিন্তা। সারাদিন ট্রেন জার্নি করে আসা—এখনো যদি একটু থাকার ব্যবস্থা না হয় তাহলে যাব কোথায়? তাই এবার একটু জোরে হাঁকলাম—কেউ আছেন?

হঠাৎ খুব কাছ থেকে একটা অদ্ভুত কণ্ঠস্বর শোনা গেল—বাইরের ঘরে বসুন।

গলার স্বরটা না পুরুষের না মহিলার। কেমন একটা বিশ্রী খ্যানখেনে। কিন্তু এপাশ ওপাশ তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না।

যাই হোক, আমরা আবার বাইরের ঘরে এসে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়েই রইলাম। কেননা, বসবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। টর্চ জ্বেলে দেখলাম—চারিদিকে শুধু ভাঙা দেরাজ, ভাঙা আলমারি, কতকগুলো ভাঙা চেয়ারও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আর সমস্ত মেঝেয় পুরু ধুলোর আস্তরণ। এ—ঘরে যে কেউ কোনো দিন আসে না সেটা বেশ বোঝা গেল।

এমনি সময়ে ভেতরের দরজা দিয়ে এক চিলতে ঘোলাটে আলো এসে পড়ল। একজন মহিলা হাতে সেকালের পেটমোটা একটা সেজবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর আপাদমস্তক কালো গাউনে ঢাকা। গলা থেকে একটা লম্বা ক্রস গাউনের ওপরে ঝুলছে। মুখটা অস্বাভাবিক সাদা। গালের দুই হনু খুব উঁচু আর সেইজন্যেই গালের নীচের অংশ একটু বসা। তিনি বেশ দীর্ঘাঙ্গী। কিন্তু কত বয়েস তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।

আমি তাড়াতাড়ি নমস্কার করে বললাম, আপনাকে বোধ হয় বিরক্ত করলাম—

ভদ্রমহিলা ওঁর সেই অস্বাভাবিক স্বরে গম্ভীরভাবে বললেন, কী বলতে চান বলুন।

দিন দশেকের জন্যে একটা ঘরের কথা বললাম, শুধু দুজন—আমি আর আমার এই ভাইপো—

এতক্ষণে ডাকুর দিকে ওঁর লক্ষ্য পড়ল। তিনি সেই পেটমোটা সেজটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে ডাকুকে দেখলেন। সেই মুহূর্তেই আমিও ওঁকে ভালো করে দেখলাম—বিশেষত ওঁর চোখ দুটো। সে চোখ যে কী তীক্ষ্ন—কী জ্বলন্ত তা না দেখলে বোঝা যায় না। তিনি সেই চোখের দৃষ্টি দিয়ে ডাকুকে যেন গিলে খেতে চাইছেন। আমি তাড়াতাড়ি ডাকুকে আড়াল করে দাঁড়ালাম।

—তা শেষ পর্যন্ত আমার বাড়ি কেন? ভদ্রমহিলা বিদ্রুপের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ভূত দেখতে নাকি?

—না—না, ভূত দেখতে কেন? আমি হাসবার চেষ্টা করলাম। কোথাও বাড়ি পাচ্ছি না। তাই—

কিন্তু মহিলাটি হাসলেন না। তীক্ষ্নস্বরে বললেন, অনেকেই তো এ বাড়িতে ভূত দেখতে আসে। আপনারাও যদি ভূত দেখার আশা করে আসেন তাহলে ঠকবেন। কেননা, ভূত এখানে টিকতে পারে না। বলে ভাড়ার টাকা গুনে নিয়ে ফিরে যাবার সময়ে আর একবার তাঁর সেই তীক্ষ্ন চোখের দৃষ্টি ডাকুর ওপর বুলিয়ে নিলেন।

যাই হোক, দোতলার একপাশে একটি ঘর তো পাওয়া গেল। অনেকগুলো জানলা। কোনো জানলাতেই গরাদ নেই। এই জানলায় দাঁড়ালে সমাধিক্ষেত্রটা বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। তবে একটাই অসুবিধে। এখানে খাবার ব্যবস্থা নেই। নিজে রাঁধো, নয় হোটেলে খাও।

নিজে আর কে রাঁধে! সন্ধের পর হোটেল থেকে খেয়ে বাড়ি ফিরেই খিল লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। একে প্রচণ্ড শীত, তার ওপর শরীরে ক্লান্তি। তাই ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হল না।

একসময়ে ঘুম ভেঙে গেল। দরজায় কে যেন খুটখুট করে কড়া নাড়ছে।

ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঘর অন্ধকার। কান খাড়া করে রইলাম। ভুল শুনেছি কি?

না, ভুল নয়। ওই কে আবার আস্তে আস্তে কড়া নাড়ছে।

এবার দেখি ডাকুও চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসেছে। টর্চ জ্বেলেছে।

আমি উঠে সাবধানে দরজা খুলে দিতেই কনকনে বাতাসে পর্দা দুলে উঠল। অমনি সেই বিশ্রী খ্যানখেনে স্বর—গুড মর্নিং।

দেখি কখন ভোর হয়ে গেছে। আর মিস দফাদার নিজেই ছোট্ট ট্রেতে দু—কাপ চা আর কিছু নোনতা বিস্কুট নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

আমরা অবাক। মিস দফাদার যে এভাবে চা—টা দিয়ে ভোরবেলায় আপ্যায়ন করবেন তা ভাবতে পারিনি। মিস দফাদার আবার একটু হাসবার চেষ্টা করলেন—চা—টা আপনাদের জন্যে। অনুগ্রহ করে ধরুন। আমি অবশ্য সব ভাড়াটেদের এমন আপ্যায়ন করি না।

আমি ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, আপনার এ সৌজন্য আমরা ভুলব না।

—ধন্যবাদ, এই বলে মিস দফাদার চলে যাচ্ছিলেন। আবার ফিরে দাঁড়ালেন। তাকালেন ডাকুর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটল। ওঃ! কী হিংস্র সে দৃষ্টি!

—গত রাত্রে নিশ্চয়ই কোনো কারণে আপনাদের ঘুমের ব্যাঘাত হয়নি?

—না—না—এতটুকু না।

—ভূতের ভয়?

আমি হেসে উঠলাম। ভূত আমি বিশ্বাস করি না।

মিস দফাদার আর দাঁড়ালেন না। হঠাৎ হনহন করে টানা বারান্দা ধরে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।

তিন—চারটে দিন কেটে গেল। মধুপুরটা মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। এবার দেওঘর যাবার কথা ভাবছি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করছি, ডাকু যেন কিরকম অন্যমনস্ক আর খিটখিটে হয়ে উঠছে। দুপুরবেলাটা কিছুতেই আমার সঙ্গে বেরোতে চায় না। বলে, ভালো লাগছে না। তুমি যাও। আমি একটু শুয়ে থাকি।

একা একা বেড়াতে ভালো লাগে না। তবু বেড়াতে হয়। মনে মনে ভাবি, ডাকুটার হঠাৎ হল কী?

সেদিন খাবার টেবিলে বসে ও হঠাৎ বলল, মিস দফাদার দিনের বেলায় বাড়ি থাকেন না।

—তুই কী করে জানলি?

ডাকু হঠাৎ রেগে গিয়ে বললে, সে আমি বলব না।

ওর এই আচরণে আমি একটু অবাক হলাম। সামলে নিয়ে বললাম, কোথায় যান?

—তা জানি না।

জিজ্ঞেস করলাম, তুই কি দুপুরবেলা ওদিকে যাস? ওদিকে মানে—মিস দফাদারের ঘরের দিকে?

ডাকু গম্ভীরভাবে বলল, যাই। এই পর্যন্ত বলে ও একটু থামল। তারপর কেমন ভাঙা ভাঙা গলায় বললে, রোজ দুপুরে আমায় কে যেন ওইদিকে যাবার জন্য ডাকে। আমি যেন না গিয়ে পারি না। সেদিন দেখি ওদিকের জানলার নীচে একগাদা মুরগির পালক পড়ে আছে। কেউ যেন গোটা মুরগিগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে।

এই কথাগুলো বলতে বলতে ওর চোখ—মুখ যেন কেমন হয়ে গেল। ও বিছানায় শুয়ে পড়ল।

আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। কে ওকে ওইদিকে যাবার জন্যে ডাকছে? কেন ডাকছে? আর সেই ডাকার সঙ্গে মুরগির কী সম্পর্ক? ডাকু কি সজ্ঞানে ভুল বকছে?

না, ভূতুড়ে বাড়িতে ক’দিন থেকেও ভূত দেখার সৌভাগ্য হল না। শুধু মিস দফাদারের আচরণগুলোই আমাকে একটু অবাক করছিল। অথচ তাঁকে সেদিন সেই সকালবেলায় চা দিতে আসার সময়ে যা দেখেছি তারপর আর চোখেও দেখিনি। না দেখলেও এইটে মনে হয়েছে যে তিনি ঠিক সাধারণ মহিলার মতো জীবনযাপন করেন না। এমন কি ডাকু একদিন গম্ভীরভাবে নতুন একটা খবর শোনাল—জান কাকু, মিস দফাদার বোধ হয় কিছু খান না। তাঁর কোনো রান্নাঘর নেই, উনুন নেই, স্টোভ নেই, কড়াই—খুন্তি কিচ্ছু নেই।

আমি ফের অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—তুই জানলি কী করে?

ও হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, আরো কত কী জানতে পারব!

ওর এই ধরনের কথায় আমার কেমন গা ছমছম করে। এইসব কথা বলার সময় ও কীরকম অস্বাভাবিক হয়ে যায়। এমন গম্ভীর চালে কথা বলে যেন মনে হয় কত বয়স্ক লোক কথা বলছে।

এবার এখান থেকে পাততাড়ি গোটাব ভাবছি আর ঠিক সেই রাত্তিরেই একটা ঘটনা ঘটল।

রাত তখন কত জানি না। শীতের রাত। পাহাড়ে শীত। সমস্ত জানলা বন্ধ। মাথা পর্যন্ত লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলাম। মাথার কাছে সব সময়েই থাকে দুটো টর্চ আর দুটো বড়ো ছুরি। কী জানি কখন কী দরকার হয়!

হঠাৎ কেন যেন ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি ডাকু নেই, দরজা খোলা।

আমি চমকে উঠলাম। ডাকু কোথায় গেল! ও তো রাত্তিরে বড়ো একটা ওঠে না। যদি বা ওঠে তাহলে আমায় ডাকে।

তা হলে?

এক লাফে বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সেই টানা বারান্দার ওপাশে মিস দফাদারের ঘরের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ওঁর ঘর থেকে আগুনের মতো কী যেন দাউ দাউ করে একবার জ্বলছে, একবার নিভছে। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের রংও বদলাচ্ছে—কখনো লাল, কখনো নীল, কখনো সবুজ। আমার মনে হল, এই গভীর রাত্রে এই বাড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাজিক দেখছি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সেই জাদুকরি আলোয় দেখলাম ডাকু বারান্দার দেওয়াল ধরে ধরে ওইদিকে এগোচ্ছে।

ডাকুকে চেঁচিয়ে ডাকতে সাহস হল না। ছুট্টে গিয়ে ওর হাতটা চেপে ধরলাম। আমাকে দেখে ডাকুর সে কী রাগ! জোর করে হাত ছাড়িয়ে সে ওই আগুনের দিকে যাবেই। তখন আমিও আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে ঘরে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

ওকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া মাত্র ও যেন কেমন নেতিয়ে পড়ল। আমি ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে লক্ষ করতে লাগলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তখন আড়াইটে।

হঠাৎ ডাকু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলতে লাগল—আমায় ছেড়ে দাও। ওগো আমায় ছেড়ে দাও। ও যে আমায় ডাকছে…ও আমায় আজ কবরখানায় নিয়ে যাবে বলেছিল। ওই যে ও দাঁড়িয়ে আছে…আমায় যেতে দিচ্ছ না বলে ও রেগে যাচ্ছে। ও বলছে—আমাকে ওর দরকার। ও আমাকে এখানে রেখে দেবে বছরের পর বছর। একটু থেমেই ডাকু হঠাৎ লাফিয়ে উঠল—ও বড্ড রেগে যাচ্ছে, আমায় ছেড়ে দাও—ওই যে ও একটা কবরখানায় চলল …

বলতে বলতে ডাকু বিছানা ছেড়ে উঠে এক টানে জানলা খুলে ঝুঁকে পড়ল, যেন এখনই ঝাঁপ দেবে। আমিও শীতের কনকনে বাতাস উপেক্ষা করে জানলার কাছে গিয়ে ওকে আগলে দাঁড়ালাম। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্বাঙ্গ ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। স্পষ্ট দেখলাম—কালো গাউন ঢাকা একটা চলমান মূর্তি কবরখানার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

পরের দিন সকালেই ঠিক করলাম, আজ না হলেও কাল মধুপুর ছাড়বই। আর এই যতটুকু সময় এ বাড়িতে আছি, কিছুতেই ডাকুকে কাছছাড়া করব না। কেননা, যে কোনো কারণেই হোক, আমার মনে হয়েছে ডাকুর জীবন বিপন্ন। ওই মিস দফাদার মানুষটি কিছুতেই স্বাভাবিক মানুষ নয়। ওর কিছু একটা মতলব আছেই।

সারাদিন ডাকুকে চোখে চোখে রাখলাম। আজ ওকে বড্ড বেশি শ্রান্ত ক্লান্ত লাগছে। বিছানা ছেড়ে উঠছে না। দুপুরের খাওয়া সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। দেখলাম হোল্ডলটার স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে গিয়েছে। এটা এখনি মুচিকে দিয়ে সারিয়ে নিতে হবে।

কিন্তু ডাকুকে ফেলে যাই কী করে? ভেবে লাভ নেই। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য যেতে হবেই। আর দেরি করলাম না। দেখলাম ডাকু বেশ ঘুমোচ্ছে। হোল্ডলটা নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়লাম।

তারপর থেকে প্রতি মুহূর্তে বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি। কেবলই ভয করছে, এতক্ষণে বুঝি ডাকুর কিছু একটা হয়ে গেল। কোনোরকমে স্ট্র্যাপটা সারিয়ে বাড়ি ফিরলাম। মুরগিগুলো আজ হঠাৎ একসঙ্গে ডেকে উঠল—কোঁকর কোঁ—কোঁকর কোঁ।

ঘরে ঢুকতেই চমকে গেলাম—ডাকু নেই।

—ডাকু! সাড়া নেই। কী হল? গেল কোথায়?

কিন্তু তখন আর ভাববার সময় নেই। এই ভয়টাই করেছিলাম। জানি না এর মধ্যে তার কী অবস্থা হয়েছে!

আমি তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম। তারপর ছুটতে লাগলাম মিস দফাদারের ঘরের দিকে। এদিকে আমি কখনো আসিনি। সার সার তালাবন্ধ অনেকগুলো ঘর। জনমানবের সাড়া নেই। আমি কেবলই মোড় বাঁকতে বাঁকতে বারান্দা দিয়ে চলেছি। বারান্দাটা যেন সাপের গতির মতো এঁকেবেঁকে গিয়ে—

হঠাৎ থামতে হল। এ যে সিঁড়ি দেখছি!

বাইরে যেন সন্ধে নেমে আসছে। বাড়ির মধ্যে অন্ধকার। আর এই সিঁড়ির মুখটা যেন—ভাববার সময় তখন আর নেই। আমি সেই অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। নামছি তো নামছি। যেন পাতাল—পুরীর পথে পা বাড়িয়েছি।

সিঁড়িগুলো এত সরু আর অন্ধকার যে প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছে এই বুঝি পা পিছলে পড়ে গেলাম। আর পড়ে গেলে যে কোথায় তলিয়ে যাব তা জানি না। তা ছাড়া যতই নামছি ততই যেন ঠান্ডা বাড়ছে। মনে হচ্ছে যেন বরফের দেশে চলেছি।

একসময়ে সিঁড়ি ফুরিয়ে গেল। কিন্তু এ কী! এ যে নরম মাটি! কাদা—কাদা, পিছল। অবাক হয়ে ভাববার সময়টুকু পর্যন্ত নেই। ডাকুকে খুঁজে বের করতেই হবে।

আমি শ্যাওলাধরা দেওয়াল ধরে ধরে এগিয়ে চললাম। কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। কীসের যেন শব্দ—দুম—দুম। কে যেন বন্ধ দরজা ঠেলছে। আর একটু এগোতেই চমকে উঠলাম।

কে একজন একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধ দরজায় ঘুসি মারছে। আর চিৎকার করে বলছে—এই যে আমি এসেছি।

—ডাকু! আমি ছুটে গিয়ে ডাকুকে জাপটে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে ওর অচৈতন্য দেহ আমার বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

আর সেই মুহূর্তে জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে যে দৃশ্যটি আমার চোখে পড়ল তা আমি কখনো ভুলতে পারব না। সেই পাতালপুরীর অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে একটা খাটিয়ার ওপর সাদা চাদর ঢাকা একটা—হ্যাঁ, দূর থেকে মৃতদেহ বলেই মনে হল—পড়ে রয়েছে।

হঠাৎ সেই মৃতদেহ নড়ে উঠল। চাদর খসে পড়ল। তারপর দুই হাত মাথার দিকে প্রসারিত করে, আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে সেই দেহ, কবরের মধ্যে থেকে যেমন প্রেতাত্মার উত্থান হয় তেমনি ভাবে সোজা উঠে বসল।

—মিস দফাদার! আমার অজান্তে গলা থেকে একটা ভয়ার্ত চিৎকার বেরিয়ে এল। তারপর কী করে যে ডাকুকে কাঁধের ওপর ফেলে সেই অন্ধকার সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসেছি তা বলতে পারব না।

নিজের ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে মুহূর্তের পর মুহূর্ত অপেক্ষা করেছি কখন ডাকুর জ্ঞান ফেরে! তারপর ডাকু একটু সুস্থ হলে সেই রাত্তিরেই চুপিচুপি বাড়ি থেকে পালিয়ে আমরা স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে মিস দফাদারের ঘরের দিকে চেয়ে দেখি, জানলার সামনে কালো গাউন পরা একটি মূর্তি কী যেন লক্ষ্য করছে!

আমি ডাকুর হাত ধরে প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম।

১৯৮৪, আরাধনা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *