শরৎ ভাদুড়ীর দেশে ফেরা
কাঠমান্ডুতে কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে এসে আমার সৌভাগ্যক্রমে একজন বাঙালি অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল। নাম অরুণাংশু বসু। ভারি মিষ্টি স্বভাবের মানুষ। তবে পড়াবার সাবজেক্টটি তেমন শ্রুতিমধুর নয়। বিষয়টি হচ্ছে অ্যানথ্রপলজি বা নৃতত্ত্ব অর্থাৎ প্রাণীজগতে মানবজাতির উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তন বিষয়ক বিজ্ঞান। সাধারণত রুচিসম্মত ব্যক্তিদের বাইরের ঘর বা ড্রয়িংরুমটি যেমন সাজানো—গোছানো হয়, ঘরে ঢুকলেই ফ্লাওয়ার ভাসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ, দামি পুরু কভারের ঢাকা দেওয়া সোফাসেট, কারুকার্য—করা দামি কাপড়ের পর্দা, হাতের কাছেই টেলিফোন এইসব। কিন্তু অরুণাংশুবাবুর বাইরের ঘরে ঢুকলে গা ছমছম করে। ঘরে জোরালো আলোর ব্যাপারই নেই। টেবিলের কাছে একটা স্ট্যান্ড লাগানো আলো। তার মাথা থেকে ঝুলছে ঝালর দেওয়া রেশমের ঢাকনা। তারই ফাঁক দিয়ে ছায়া ছায়া স্নিগ্ধ আলো এসে পড়েছে প্রথমেই যার ওপর সেটা একটা পুর্ণবয়স্ক মানুষের প্রাচীন কঙ্কাল। লম্বায় ছ’ফুটেরও বেশি।
আমার দিকে তাকিয়ে প্রফেসর হেসে বললেন—কী দেখছেন?
বললাম—যাঁর কঙ্কাল তিনি নিশ্চয়ই খুব লম্বা ছিলেন।
প্রফেসর হেসে বললেন—হ্যাঁ, সে তো স্কেলিটনের হাইট দেখলেই বোঝা যায়। যেটা চট করে বোঝা যায় না সেটা হচ্ছে কঙ্কালটি পুরুষের নয়, একটি পাহাড়ি মেয়ের।
অবাক হয়ে বললাম—বলেন কী! কোনো বাঙালি তো নয়ই, কোনো ভারতীয় মহিলা সম্ভবত এত লম্বা দেখা যায় না।
প্রফেসর বললেন—সে জন্যেই এটা অনেক টাকা দিয়ে অনেক হাঙ্গামা করে কিনে এনেছিলাম।
একটু থেমে বললেন—শুধু এটাই নয়, ওই শোকেসের দিকে তাকিয়ে দেখুন—
দেখলাম। নানা আকারের মাথার খুলি এমনভাবে পরপর সাজানো রয়েছে যেন মনে হচ্ছে সবগুলোই দাঁত খিঁচিয়ে পাল্লা দিয়ে হাসছে। কিন্তু কাচের কেসে তালা দিয়ে বন্দি করে রাখা কেন? বেরিয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে নাকি? কী জানি। কিন্তু সে কথা আর জিগ্যেস করতে পারলাম না।
উনি তখন একটা ক্যাটালগ খুলে আমায় বোঝাচ্ছিলেন এগুলি কত জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে জোগাড় করেছিলেন আর সেগুলো কত পুরোনো। সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল যেটি সেটা হচ্ছে এমন একটি খুলি যেটা হাতের মুঠোয় ধরা যায়। কোথায় পেয়েছেন জিগ্যেস করলে উনি গর্বের সঙ্গে জানালেন আসামের গারো পাহাড়ের কাছে একটি শুকনো নদীর সোঁতায়। কোন জনগোষ্ঠীর করোটি এটি তিনি এখন তাই নিয়ে গবেষণা করছেন।
যাই হোক কঙ্কাল আর খুলি নিয়ে তাঁর জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা শোনার পর আমার কিন্তু অন্য একটা কথা মনে হল—ভদ্রলোক বোধ হয় প্রেততত্ত্বেও বিশ্বাসী। সেই ধারণা আমার দৃঢ় হল যখন আমি তাঁর বুককেসে দেখলাম রবার্ট ডাল আওয়েল—এর বিখ্যাত ‘Foot falls on the Boundary of Another World’ নামে বহু পুরোনো বইটি রয়েছে। এই ‘Another world’টি যে কোন world তা বুঝতে বাকি থাকে না। হাসতে হাসতে জিগ্যেস করলাম, অশরীরী আত্মাদের এই জগতে কি আপনিও ঘোরাফেরা করছেন?
উনি ছোটো করে হেসে বললেন—তা করেছি।
—ওই সব অশরীরীদের কথা আপনি বিশ্বাস করেন?
—হ্যাঁ করি বৈকি। তবে এখানকার লোকে যে ভাবে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে সেভাবে নয়। দেশি—বিদেশি বহু বই পড়ে একটা মতবাদ দাঁড় করিয়েছি।
বললাম—এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কীভাবে ভূত বিশ্বাস করে একটু বলুন না শুনি।
অরুণাংশুবাবু একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন—সে তো ইতিহাস। একদিনের একটা সিটিং—এ বলে শেষ করা যাবে না। সংক্ষেপে বলি—তন্ত্রমন্ত্রের কথা আপনারা সবাই শুনেছেন। আমাদের দেশে হিন্দু আর বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা নির্জনে এমন কিছু সাধনা করতেন যা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের বাইরে। মনে রাখবেন তন্ত্রশাস্ত্রের উৎপত্তি হিমালয় অঞ্চলে। অর্থাৎ কৈলাস, চিন, নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি জায়গায় বিদেশি আত্মার তত্ত্বে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বোধ হয় নেপাল, তিব্বত, ভুটানেই বেশি।
একটু থেমে বললেন—এসব তো তত্ত্বের কথা। কিন্তু বাস্তবেও এমন অনেক ঘটনা ঘটে যাতে গা শিউরে ওঠে। লক্ষ করে থাকবেন নেপালি, ভুটানিরা বাড়ির চারিদিকে পতাকার পর পতাকা পুঁতে দেয়। সেই পতাকায় লেখা থাকে বুদ্ধের অমৃত বাণী। এসব অঞ্চলে লোকেদের বিশ্বাস—বাতাসে পতাকাগুলি যত নড়ে বুদ্ধের বাণীও ততই ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। তখন আর অশুভ শক্তির আতঙ্ক থাকে না।
অরুণাংশুবাবু আবার একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন—কিছুকাল আগের একটি সত্যি ঘটনা বলি। শুনলেই বুঝতে পারবেন এখানকার ভৌতিক ব্যাপারটা কীরকম। ঘটনাটি আমায় বলেছিলেন আমার এক বন্ধু ডাক্তার কুমার। তিনি তখন সাদার্ন ভুটানের ডিসট্রিক্ট টাউন সারডং—এর হাসপাতালের এম. ও। তাঁর অভিজ্ঞতার কথাই আমাকে বলেছিলেন।
এই পর্যন্ত শুনে আমি নড়েচড়ে বসলাম।
অধ্যাপক সোজাসুজি ঘটনায় চলে গেলেন। বললেন—পাহাড়তলিতে সন্ধের মুখে একটা জিপ অ্যাকসিডেন্ট হল। জিপটা দুবার ডিগবাজি খেয়ে উলটে গেল—একেবারে turn upside down। তিনটি শ্রমিক মেয়ে ছিল। তিনজনেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে একেবারে spot dead। ডাক্তার কুমার নিজে পরীক্ষা করে দেখলেন তিনজনেরই জীবনের ক্ষীণ স্পন্দনটুকুও নেই। সে রাতটুকুর মতো লাশ তিনটে হাসপাতালের ল্যাবরেটরি ঘরে রাখার ব্যবস্থা হল। এই ফর্মালিটিটুকু করতে ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছিল। ততক্ষণ লাশ তিনটিকে কাপড় ঢাকা দিয়ে পাহাড়তলিতেই শুইয়ে রাখা হয়েছিল। আশ্চর্য এই যে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাবার সময় দেখা গেল তিনটির জায়গায় দুটি লাশ রয়েছে আর একটি উধাও। অতজনের সামনে দিয়ে কীকরে একটা গোটা লাশ উধাও হয়ে যেতে পারে তার মীমাংসা আজও করে উঠতে পারা যায়নি। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও নেই। মৃতদেহটা একেবারে ভ্যানিশ হয়ে গেল। সবচেয়ে লজ্জার কথা এ যুগে বসেও আজ পর্যন্ত আমি এর রহস্যভেদ করতে পারলাম না।
এই পর্যন্ত বলে অধ্যাপক বসু আবার থামলেন। তারপর গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
একটু পরে জিগ্যেস করলাম—কী ভাবছেন ড. বসু?
উনি অন্যমনস্কভাবেই বললেন—এ ঘটনা না হয় বেশ কিছুকাল আগের। আর এটা ঘটেছিল সাদার্ন ভুটানে, কিন্তু এইরকম ঘটনা যে ইদানীং আবার ঘটতে শুরু করেছে। আর সেটা ঘটছে প্রপার কাঠমান্ডুতে না হলেও কাঠমান্ডুর আশেপাশেই।
—বলেন কী! চমকে উঠলাম।
—হ্যাঁ। এরই মধ্যে কয়েকটা ঘটনার খবর পেলাম। শেষ নিঃশ্বাস পড়া আর দেহ সৎকার করা—এই সময়টুকুর মধ্যেই দেহ জেগে ওঠে। ঘর খালি থাকলে অল্পক্ষণ পরে এসে দেখা যায় মৃতদেহটি নেই। অনেক হৈচৈ, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও লাশের হদিশ পাওয়া যায় না।
জিগ্যেস করলাম—পুলিশ কিছু করতে পারছে না?
অধ্যাপক চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন।
বললেন—পুলিশের কথা বাদ দিন। ওরা চোর—ছ্যাঁচড়, খুনে ডাকাত ধরতে পারে। মৃতদেহ ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার রহস্যভেদ করা এদের কার্য নয়।
জিগ্যেস করলাম—তাহলে কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না?
উদাস স্বরে অধ্যাপক বললেন—কে নেবে। জ্যান্ত মানুষ নিয়েই লোকের সমস্যার অন্ত নেই, মরা মানুষের খোঁজ করতে যাবে এমন সময় কার কত আছে? তবে—
একটু থামলেন অধ্যাপক। তার পর বললেন—তবে আমি হাত গুটিয়ে বসে নেই। আমরা একটা ক্লাব করেছি, মুষ্টিমেয় কিন্তু সত্যিকারের কাজের লোক নিয়ে। তারা—বিশেষ করে অশিক্ষিত দীনদরিদ্র নির্বান্ধব খেটে খাওয়া পরিবারদের প্রতি নজর রাখে। সেই পরিবারে কেউ মারা গেলেই আমাদের খবর দেওয়া হয়। আমরা তখনই গিয়ে নিজেরাই খরচ করে তাড়াতাড়ি মৃতদেহ সৎকার করে দিই। অসুবিধে হয় যাদের কবর দেওয়া হয় তাদের নিয়ে। সেক্ষেত্রে আমরা পালা করে কবর পাহারা দিই যতদিন না বুঝতে পারি মৃতদেহটা পচতে শুরু করেছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম—তার মানে কী? আপনি কি বলতে চাইছেন পচাগলা মৃতদেহ অদৃশ্য হবার সম্ভাবনা কম?
অধ্যাপক বললেন—আপনি যা ভেবেছেন তাই। সবটাই অবশ্য আমার অনুমান। মৃতদেহ অদৃশ্য হবার যতগুলো কেস দেখলাম সবই তাই। অক্ষত অবিকৃত দেহ নিয়েই আত্মারা কোথাও চলে গিয়েছে। ডাক্তার কুমার যে শ্রমিক মেয়েটির কথা লিখেছিলেন সেও দুর্ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যেই যে অবস্থায় মারা গিয়েছিল সেই অবস্থাতেই অন্তর্ধান করেছিল।
—তাজ্জব ব্যাপার! তা আপনি ঠিক কী অনুমান করেছেন?
অধ্যাপক হেসে বললেন—অনুমান কখনও ‘ঠিক অনুমান’ হয় না। হ্যাঁ, সত্যিই আমি কিছু একটা ভেবে নিতে পেরেছি। আর আমি যা ভেবেছি তা অনেকাংশেই ঠিক। তবে তা আমি এখনই প্রকাশ করব না।
আমি বললাম—রহস্যটা তো এই যে, মাঝে মাঝে মৃতদেহ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আপনি বলতে চান কবর থেকেও।
অধ্যাপক বললেন—কবর থেকে লাশ অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা খুব ইমপর্টেন্ট নয়। কারণ ডাক্তারি পড়বার জন্যে হাসপাতালে গোটা কঙ্কালের খুব দরকার হয়। অথচ কঙ্কাল সাপ্লাই দেওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। বাধ্য হয়ে রাতের অন্ধকারে কবর থেকে মৃতদেহ তুলতে হয়। সেই দেহ অ্যাসিডে পচিয়ে গলিয়ে গোটা কঙ্কাল বের করে আনা হয়। অনেক টাকায় বিক্রি হয় সেগুলো। কাজেই আমাদের যে প্রবলেম তা অন্য। আমাদের প্রশ্ন গোটা গোটা বডিগুলো যাচ্ছে কোথায়? কে বা কারা নিয়ে যাচ্ছে?
ড. বসু থামলেন একটু। তারপর বললেন—একদিনের একটা ঘটনা বললেই আপনার কাছে রহস্যটা আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে।
উনি বলতে লাগলেন।
—আমার পরিচিত পান্ডার মৃতদেহ গভীর রাতে তারই ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাইরে দুর্যোগ বলে রাত্তিরের মধ্যেই সৎকার করা হয়নি।
পরের দিনই পান্ডার বাড়ি গেলাম। দেখলাম বাড়ির লোকেরা প্রিয়জনের মৃত্যুর জন্যে যতটা না শোকার্ত তার চেয়ে বেশি ভয়ে সিঁটিয়ে আছে যেহেতু মৃতদেহ সৎকার হল না। সৎকার তো হলই না উপরন্তু উধাও হয়ে গেল—অথচ বাইরের এমন লোক কেউ আসেনি যারা বাড়ির লোকেদের নাকের ডগা দিয়ে মৃতদেহ নিয়ে পালাবে। আর এতবড়ো লাশ তো একা একজন পিঠে তুলে নিয়ে পালাতে পারবে না। তাহলে?
আমি কিছুক্ষণ পান্ডার বাড়িতে থেকে আমার লাইনে কয়েকটা প্রশ্ন করে চলে এলাম।
বাড়ি এসে সেই একটাই চিন্তা—আস্ত একটা মৃতদেহ গেল কোথায়? কে বা কারা নিয়ে গেল? কেনই বা গেল? মৃতদেহ খুব একটা মূল্যবান নয় জানি, তবু তার কঙ্কালটা ভালো দামে বিক্রি হয়। তা না হয় হল, কিন্তু মৃতদেহটা হাওয়ায় ভেসে অদৃশ্য হয়ে কঙ্কাল—ব্যবসায়ীর ঘরে যেতে পারে না। তাহলে?
কোনো মীমাংসাসূত্র পেলাম না। বার বার সেই সাদার্ন ভুটানের সারডং—এর হাসপাতালে শ্রমিক মেয়েটির মিসিং ডেডবডি থেকে আরম্ভ করে ইদানীংকাল পর্যন্ত যতগুলো মিসিং বডির ঘটনা ঘটেছে সবগুলিরই তদন্তসূত্র এই একটি জায়গাতে এসেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। মৃতদেহটি কোথায় কী করে গেল? আর আগেই বলেছি মৃতদেহ অন্তর্ধানের ব্যাপারটি পুলিশি তদন্তের নাগালের বাইরে।
বলে প্রফেসর গোঁফের ফাঁকে একটু হাসলেন।
বললাম—তা কেন? বাড়ি থেকে একটা মৃতদেহ চুরি হয়ে গেলে সেটা ক্রিমিনাল অফেন্স হবে না?
—হ্যাঁ, অবশ্যই হবে যদি সেটা চুরি বলে প্রমাণিত হয়। আর চুরি প্রমাণিত হলেও পুলিশ বেশিদূর এগোতে পারে না। কোনো সূত্র বা কোনো প্রমাণই তারা খুঁজে পায় না। পাবে কী করে? এটা তো মোটেই চুরি নয়। কাজেই এই অন্তর্ধান রহস্য ভেদ করা পুলিশের কর্ম নয়। তা ছাড়া পৃথিবীতে এখনও এমন অনেক রহস্য থেকে গেছে যার সমাধান হয়নি। কোনোদিন হয় তো হবে না।
চিন্তিতভাবে বললাম—তাহলে উপায়?
অধ্যাপক উত্তর দিলেন না। মাথাটা ধীরে ধীরে নাড়লেন। সেই মাথা নাড়ার মধ্যে দিয়ে তাঁর হতাশাটাই ফুটে উঠল।
—তবে—
একটু ভেবে অধ্যাপক বলতে লাগলেন।—হ্যাঁ, যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমি কিন্তু পান্ডাজির মৃত্যুর পর তাঁর বডি অন্তর্ধান ব্যাপারে কিছুদূর এগিয়ে গেছি। না, আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। নিতান্তই দৈবাৎ। পান্ডাজির মৃত্যুর দিন দশেক পরে একদিন দুজন বিদেশি বন্ধুকে নিয়ে কাঠমান্ডুর উপকণ্ঠে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বন্ধু দুজন কাঠমান্ডুর পারিপার্শ্বিকতার ওপর কিছু রিসার্চ করছে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা চলে গিয়েছিলাম বাঘমতি নদীর ধারে। পাহাড়ের নীচ দিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সরু নদীটি। বন্ধুরা পটাপট কয়েকটা ছবি তুলল। আমি বসে আছি একটা পাথরের উপর। হঠাৎ দেখলাম অল্পদূরে একজন জোরে জোরে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। তার গায়ে একটা মোটা ফুল হাতা গেঞ্জি। পরনের কাপড়ের ওপর গামছা বাঁধা। তার চ্যাপটা গড়ন আর লম্বা মাথায় ছোটো ছোটো চুল দেখেই মনে হল লোকটি চেনা চেনা। তারপর নিশ্চিত হলাম যখন দেখলাম ছোটো চুলের মধ্যে থেকে পরিপুষ্ট টিকিটি সগর্বে মাথা উঁচু করে আছে। আর একটু বিশেষভাবে লক্ষ্য করতেই যখন দেখলাম লোকটি খুঁড়িয়ে হাঁটছে তখনই নিশ্চিত হলাম যে এ সেই মৃত পাণ্ডাই। আমি এতটাই চমকে গিয়েছিলাম যে স্থান—কাল ভুলে চেঁচিয়ে ডাকলাম—পান্ডাজি—পান্ডাজি—
আমার বিদেশি বন্ধুরা অবাক হয়ে বললে—উনি কি আপনার পরিচিত ড. বাসু?
ইতস্তত করে বললাম—তাই তো মনে হল।
—কিন্তু উনি তো সাড়া দিলেন না?
মনে মনে ভাবলাম—উনি যে সেই মৃত পান্ডা সে বিষয় সন্দেহ নেই। আর তাঁকে জীবন্ত মনে হলেও তিনি সাড়া দেবেন না এটাই স্বাভাবিক।
বন্ধুরা তখনও এই ‘অভদ্র’ লোকটিকে লক্ষ করছিল। অভদ্র তো বটেই। এত জোরে ডাকলেও সাড়া না দেওয়াটা অভদ্রতাই। হঠাৎ একজন বলে উঠল—দ্যাখো দ্যাখো ড. বাসু তোমার ফ্রেন্ড সামনে হাঁটছেন বটে কিন্তু ওইভাবে সোজা ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে কেউ হাঁটে?
এই পর্যন্ত বলে অধ্যাপক একটু থামলেন। আগের মতো গোঁফের ফাঁকে হেসে বললেন—কী বুঝলেন?
বললাম—ভাবিয়ে তুলেছে।
—আরও ভাবুন। লস্ট ডেডবডি জীবন্ত মানুষের মতো হাঁটছে! এ কী করে সম্ভব? কোন মন্ত্রে প্রাণ ফিরে পেল? অবশ্য আমি আর একটা বিষয় খোঁজ নিচ্ছি। দেখি।
বলতে বলতেই ডোরবেল বেজে উঠল। অরুণাংশুবাবু গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
—কী খবর হরগোপাল?
—আজ্ঞে খবর নিয়েছি। বুড়ো পান্ডা মারা যাবার দু—দিন আগে ওই অঞ্চলেরই রামেশ্বর পান্ডা ছাদ থেকে ঘুমের ঘোরে পড়ে গিয়ে মরেছে।
—ঠিক বলছ? অধ্যাপককে কেমন যেন উত্তেজিত দেখাল।
মাথা চুলকে হরগোপাল বলল—আজ্ঞে পুরোপুরি ঠিক বলিনি।
—সে আবার কী?
—রামেশ্বর রাত্তিরে ন্যাড়া ছাদ থেকে পড়ে মরেছে ঠিকই, তবে ঘুমের ঘোরে নয়—
অধ্যাপক থামিয়ে দিয়ে বললেন—বুঝেছি বুঝেছি। আর বলতে হবে না। মরেছে এই খবরটুকুতেই আমার কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেল। বলে হাসিভরা চোখে আমার দিকে তাকালেন!
—কিছু বুঝতে পারলেন? রহস্য উদঘাটন হচ্ছে?
—হচ্ছে বলেই তো মনে হচ্ছে।
—আর একটা খবর আছে স্যার।
—কী খবর বলো।
—শহরের মধ্যিখানে একটা মাঝারি হোটেলে দুজন মরমর। এতক্ষণে বোধ হয় হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক বললেন—আমার কাজ তো এখন নয় পরে। যদি তখন বেঁচে না থাকে।
কথাটা শুনে আমার গা শিউরে উঠল। দেখছি অধ্যাপকের কাজ মৃত মানুষদেরই নিয়ে।
—দুজনেই কিন্তু বাঙালি। দরজার কাছে পর্যন্ত গিয়ে হরগোপাল বলল। যেন হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল।
একটু চমকে উঠলেন অধ্যাপক।—বল কী?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—কলকাতা থেকে এসেছিল?
—আজ্ঞে না। কলকাতা থেকে কিছু দূরে একটা মফসসল টাউন থেকে।
—টাউনের নাম জান?
—তা তো জিগ্যেস করিনি। তবে দুজনেই দুজনের চেনা। হোটেলে উঠে পর্যন্ত ঝগড়া করে গেছে।
—ঝগড়া করেছে? কী নিয়ে ঝগড়া?
—বাথরুম নিয়ে। কমন বাথরুম কিনা।
—বুঝুন। দুজনেই এক জায়গার লোক। এক জায়গায় বেড়াতে এসেছে। একই হোটেলে উঠেছে। তারপর বাথরুম নিয়ে ঝগড়া। ছিঃ! তা অসুস্থ হলেন কী করে? আজেবাজে খেয়েছিলেন বুঝি?
হরমোহন বলল—আজ্ঞে না। যতদূর শুনেছি নেপালি লিকার শুধু টেস্ট করার লোভে দুজনেই ঢুকেছিলেন বারে। তারপর জেদাজেদি করে দুজনেই আকণ্ঠ পান করে গেছেন। তারপর সারারাত্রি বমি—
—তবে তো ফল ভুগতেই হবে। আচ্ছা হরমোহন ওনারা কোথায় থাকেন জানিয়ে যেও। আর যদি টেসে যান—যা আমি মোটেই কামনা করি না—তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খবর দিও।
হরমোহন চলে গেলে অধ্যাপক দরজা বন্ধ করে এসে বসলেন।
—আমি তো কালই দেশে ফিরে যাচ্ছি ড. বাসু। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব খুশি হলাম। মৃতদেহ অন্তর্ধান নিয়ে আপনার নীরব গবেষণা কতদূর এগোল জানাবার কৌতূহল রইল। যদি জানবার মতো হয় একটু জানাবেন। এই আমার কার্ড।
অধ্যাপকও তাঁর কার্ড দিয়ে সম্মতি জানালেন।
দেশে ফিরতে না ফিরতেই প্রফেসর অরুণাংশু বসুর টেলিগ্রাম এল।—”আপনাকে দুঃখের সঙ্গে জানাই বাঙালি ভদ্রলোক দুজনই সেদিন বিকেলে মারা গেছেন। আর—দুজনের একজনের বডি উধাও! খুব চিন্তায় আছি। মৃতদেহ উধাও হওয়ার ঘটনা তাহলে এখন শহরের মধ্যেও ঘটতে আরম্ভ করল। এই প্রথম একজন বাঙালি ভদ্রলোক অলৌকিক ব্যাপারের শিকার হলেন।”
খবরটা জেনে মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কী হচ্ছে এসব?
কিন্তু তখনও চমকে ওঠার মতো ঘটনা শোনা বাকি ছিল।
আমাদের এখানে দুজন পুরোহিতের বেশ নামডাক। একজন মৃগাঙ্কমৌলী ভট্টাচার্য আর একজন শরৎশশী ভাদুড়ী। দুজনের মধ্যে খুব রেষারেষি ছিল। সরস্বতী পুজোর সময় কে কটা পুজো করতে পারে। আর দুর্গাপুজোর সময়ে কে সেনবাবুদের বাড়ি থেকে ডাক পায় এই নিয়ে রেষারেষি। দুর্গা পূজায় শরৎ ভাদুড়ীই বেশির ভাগ সময়ে সেনবাবুদের বাড়ি থেকে ডাক পেতেন। কারণ তাঁর চণ্ডীপাঠ ছিল শোনার মতো। মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যও ভালো চণ্ডীপাঠ করতেন। তবে শরৎ ভাদুড়ীর মতো জলদগম্ভীর স্বর ছিল না। তা ছাড়া মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের শরীরে দুটো খুঁত ছিল। সামনের চারটে দাঁত ভাঙা বলে ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারতেন না। আর একটা চোখ ছিল ড্যাবডেবে লাল। দেখলে ভয় করত। আর সেই জন্যেই সর্বদা কালো চশমা পরে থাকতেন।
তবে সেনবাবুদের বাড়ি ধরতে না পারলেও এখানকার সবচেয়ে ধুমধামের বারোয়ারি পুজো নবজাগরণ সমিতির উনি পুরোহিত ছিলেন। তাঁর কদরও শরৎ ভাদুড়ীর চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। বারোয়ারি পুজোটা মৃগাঙ্কর একচেটিয়া হয়ে যাচ্ছে দেখে শরৎ ভাদুড়ীও হিংসেয় জ্বলতেন। তার কারণ সেনবাবুদের বনেদি পুজো। বহুকাল ধরে একই ধারায় একই নিয়মে পুজো হয়ে আসছে। দক্ষিণা সময় সময় কিছু বেশি দিলেও অন্যান্য পাওনাগন্ডার হেরফের হয় না। যা প্রত্যেকবার দেওয়া হত তাই নিয়মমাফিক বরাদ্দ ছিল। অন্যদিকে বারোয়ারি পুজো বলেই মৃঙ্গাঙ্কর পাওনাগন্ডা হত অনেক বেশি। ধুতি—শাড়িই যে কত পেতেন নিজেও তা জানতেন না। কিন্তু উপায় তো কিছু নেই। গায়ের জোরে মৃগাঙ্কর কাছ থেকে বারোয়ারি পুজোটা কেড়ে নিলেও দুটো পুজো একই সঙ্গে করা তো সম্ভব নয়। কাজেই মনের দুঃখ মনেই চেপে রাখতে হত।
তবে শরৎ ভাদুড়ীর দাম ছিল অন্যদিক দিয়ে। সন্ধিপুজোটা তিনি প্রচলিত মন্ত্র পড়ে করতেন না। করতেন একটা প্রাচীন পুথি থেকে পড়ে। পুথিটি তাঁর কোনো পূর্বপুরুষ যত্ন করে কাঠের সিন্দুকে রেখে দিয়েছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর অনেক দিন পর শরৎ ভাদুড়ীই সেটা উদ্ধার করে সন্ধিপুজা করতেন। মন্ত্রগুলো তাঁর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তবু তিনি অতি যত্নে অতি সাবধানে পুথিটি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সকলকে দেখানো কী দুর্লভ রত্নের অধিকারী তিনি।
মৃগাঙ্কও জানতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পুথিটা কোনো ছলে হাতিয়ে নেওয়া। কিন্তু হাতানো তো দূরের কথা, বহুবার বলেও শরৎ ভাদুড়ী পুথিটা তাঁর সামনে বের করেননি। এর জন্যেও শরৎ পুরুতের ওপর মৃগাঙ্কের রাগ ছিল।
যেমন রাগ ছিল তেমনি আবার ভাবও হত। হাজার হোক একই জায়গার লোক আবার দুজনেরই এক জীবিকা। এমনও হয়েছে ধাত্রীগ্রাম কিংবা নসরৎপুর কিংবা সমুদ্রগড় থেকে দুজনেই ডাক পেয়েছেন দুটো বড়ো বারোয়ারি পুজোর। একই সঙ্গে একই ট্রেনে দুজনে চলেছেন পাশাপাশি গল্প করতে করতে। তারই ফাঁকে একসময়ে মৃগাঙ্ক হয় তো নীচু গলায় জিগ্যেস করলেন—কত?
শরৎ ভাদুড়ী দু—হাতের দশটা আঙুল ছড়িয়ে দেখালেন।
—ভালোই। বললেন মৃগাঙ্ক।
—আপনার?
মৃগাঙ্ক বললেন—আরও দশ টাকা বেশি।
শরৎ ভাদুড়ী মনে মনে বললেন—শালা! ঢপ মারবার জায়গা পাও না? কোন গুণে আমার চেয়ে বেশি দেবে?
কিন্তু মুখে বললেন—তা ভালো।
তারপর নীচু গলাতেই বললেন—সোনাদানা?
মৃগাঙ্ক বুড়ো আঙুল তুলে দেখালেন।
এই ভাবেই একটি মফসসল শহরে দুই পুরোহিতের দিন কাটছিল। হঠাৎ কী শখ হল দেশভ্রমণে যাবেন। দুজনেই টাকাপয়সার হিসেবনিকেশ করে প্রস্তুত হলেন। একঘেয়ে পুরোহিতগিরি করে, নির্বোধ কতকগুলো মানুষকে ভুল উচ্চারণে মন্ত্রপাঠ শুনিয়ে পাপের বোঝা আর কত বাড়ানো যায়? তার চেয়ে দু—দিন তীর্থ দর্শন করে এলে মন্দ হয় না। মনটাও প্রফুল্ল থাকবে। আর তখনই স্থির করলেন তীর্থদর্শনেই যখন যাবেন তখন নেপালে বাবা পশুপতিনাথের কাছেই যাওয়া ভালো। পশুপতিনাথ দর্শন ছাড়াও একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্রও দেখা হবে।
তারপরই একদিন দুজনে ব্যোম ব্যোম করে নেপালে চলে গেলেন।
তখন কে জানত এই তীর্থদর্শন করতে যাওয়টা কাল হবে!
ক’দিন পর কাঠমান্ডুর কোনো হোটেল থেকে দুটি বাড়ির ঠিকানায় দুজনের মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছাল। সেই সঙ্গে ম্যানেজার দুঃখপ্রকাশ করে জানিয়েছেন—এই দুর্ভাগ্যজনক খবর শুনে দুজনেরই বাড়ির লোকের পক্ষে যেহেতু এত দূরের পথ তাড়াতাড়ি আসা সম্ভব নয় তাই বাধ্য হয়ে পুলিশের অনুমতি নিয়ে মৃতদেহ হিন্দুশাস্ত্র মতে সৎকার করে দেওয়া হয়েছে।
এই আকস্মিক দুঃসংবাদে আমাদের এখানে শোকের ছায়া নামল। দুজন বিদগ্ধ পুরোহিতকে হারিয়ে লোকে দিশেহারা হয়ে গেল। কিন্তু কীভাবে এদের মৃত্যু হল তা কেউ জানেন না। সঠিক খবর জানার জন্যে এতদূর থেকে এত ব্যয় করে অতদূরে যাওয়াটা সুবিবেচনার কাজ নয় বলে বাড়ির লোকেরা সে চেষ্টা করল না। বিশেষ করে যথন তাঁরা মারাই গেছেন।
কিন্তু কী কারণে মারা গেছেন তা একমাত্র আমি জানি। প্রফেসর বসু ভাগ্যিস টেলিগ্রামটা করেছিলেন। কিন্তু খটকা থেকেই গেল। একজনের বডি তো উধাও! সেটি কার বডি হোটেলের মালিক সে কথাটুকু চেপে গিয়ে কেবল এইটুকু লিখেছেন ‘মৃতদেহ’ হিন্দুশাস্ত্রমতে সৎকার করা হয়েছে। দু—বাড়িতেই একই চিঠি। কার মৃতদেহ সৎকার হওয়া তো দূরের কথা—পাওয়াই গেল না, সেকথা জানানো হল না।
তারপর একদিন সংসারের নিয়মে যেমন সকলেই শোক ভুলে যায়, মৃগাঙ্ক—শরৎ—এর পরিবারও ভুলে গেল। ভুলে গেল বড়ো অল্প সময়ের মধ্যে। সবচেয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা আমার। মৃগাঙ্ক ও শরৎ ভাদুড়ীকেই শুধু ভালো করে চিনতাম তা নয় তাঁদের পরিবারের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। অথচ সব জেনেও মৃত্যু—রহস্য নিয়ে মুখ খুলতে পারলাম না। কার বডি পাওয়া যায়নি তা অবশ্য এখনও আমি জানি না।
সপ্তাহ দুই পরে হঠাৎ একদিন আমাদের এই ছোটো মফসসলটি উত্তেজনায় কেঁপে উঠল। কারণ—শরৎ ভাদুড়ী নাকি ফিরে এসেছেন। প্রথমে কেউ বিশ্বাস করেনি। তাই আবার হয় নাকি? মৃত ব্যক্তি কখনও ফিরে আসে? তাও মৃত্যুখবর দিয়েছে কাঠমান্ডুর কোনো বড়ো হোটেলের ম্যানেজার স্বয়ং। কিন্তু তারপর একজন, তারপর বাজারে মুদিখানার দোকানে দোকানে অনেকেই বলতে লাগল তারা নাকি স্বচক্ষে শরৎবাবুকে দেখেছে।
—কোথায় দেখেছে?
কেউ বলে স্টেশনের দিকে, কেউ বলে গঙ্গার ধারে হাওয়া খাচ্ছিলেন, কেউ বলে ইটভাটার ইটের হাজার কত করে জিগ্যেস করছিলেন। অবাক কাণ্ড! যে মানুষ পুরুতগিরি ছাড়া অন্য দিকে মন দিতেন না, এমনকি বাজার পর্যন্ত করতেন না, তিনি করবেন ইটের দর! সেটা বরঞ্চ করতে পারতেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য।
আরও আশ্চর্যের কথা এই যে শরৎ ভাদুড়ী যদি ফিরেই আসবেন তা হলে সোজা নিজের বাড়ি না গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবেন কেন?
আমি নিজেই একদিন শরৎবাবুর বাড়ি গেলাম তাঁরা কী করছেন দেখতে। বড়ো ছেলে নিশিনাথ বললে—কাকা, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবার মৃত্যুসংবাদ হয়তো ভুল। তিনি হয়তো ফিরেও এসেছেন। তা বলে নিজের বাড়ি না এসে এখানে—ওখানে ঘুরে বেড়াবেন! রাত্তিরে ঘুমোন কোথায়? সেও কি রাস্তার ধারের রকে?
এ সবের উত্তর আমার জানা ছিল না। তবে ড. বাসুর টেলিগ্রাম পেয়ে আমি নিশ্চিত যে শরৎ ভাদুড়ী বেঁচে নেই। তাহলে এই শরৎ ভাদুড়ী কে?
সেদিন সন্ধেবেলা হরিহর চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে তাস খেলে ফিরেছি—বাইরের ঘরে ঢুকে মনে হল কেউ একজন অন্ধকারে চৌকির ওপর চুপচাপ বসে পা দোলাচ্ছে। চমকে উঠলাম।
—কে?
উত্তর নেই। ভয় হল চোর—ডাকাত নাকি? চোর—ডাকাত হলে অমন নিশ্চিন্তে বসে বসে পা দোলাবে কেন? হাতের লাঠি ঠকঠক করে কাছে রুদ্ধনিঃশ্বাসে এগিয়ে গেলাম। দেখি কালো চশমা পরা একটা লোক। আর অন্ধকারের মধ্যেও কালো চশমার ভেতর দুটো টর্চের বালবের মতো চিকচিক করে জ্বলছে চোখের মণিদুটো।
আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম—কে আপনি? এখানে কী করছেন?
উত্তর পেলাম না। তবু বুঝতে বাকি রইল না ইনি শরৎ ভাদুড়ীই।
আশ্চর্য, যিনি কোনো দিন আমাদের বাড়ি আসেননি, তিনিই আজ দরজা খোলা পেয়ে এ বাড়িতে ঢুকে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছেন কেন?
—ভাদড়ীমশাই! এই যে শুনছেন—
ভাদুড়ীমশাই উত্তর দিলেন না। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশ্রী পচা গন্ধে ঘর ভরে গেল। আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। তা হলে এতক্ষণ এই ঘরে যে বসে ছিল সে কি কোনো জীবিত মানুষ?
এ সব অবশ্য আমি কাউকে বলিনি।
একদিন তিন—চার জনে মিলে শরৎ ভাদুড়ীকে ধরে বাড়ি নিয়ে এল। বাড়ির ভেতরে— বাইরে কৌতূহলী লোকের ভিড়। কিন্তু—কিন্তু এই কি সেই শরৎ ভাদুড়ী? কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। শুধু অচেনা মানুষের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তাহলে কি শরৎ ভাদুড়ীমশাই পাগল হয়ে গেছেন?
নিশিনাথ লক্ষ করে বাবা বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। কিন্তু সসংকোচে, যেন চেনেন না। না চিনলেও নীচের ঘরে ঘরে উঁকি মেরে দেখেন। কিছু যেন খোঁজেন। একদিন নির্জন দুপুরবেলায় নিশিনাথ দেখল তার বাবা চোরের মতো একটা পরিত্যক্ত ঘরে ঢুকছেন। এভাবে ঢুকছেন কেন? নিশিনাথ লক্ষ করতে লাগল। দেখল ঘরের কোণে যে একটা পুরোনো কাঠের বাক্স আছে, বাবা সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর তালাটা ধরে টানাটানি করতে লাগলেন।
আশ্চর্য! কাঠের বাক্সটা তো তাঁরই। কতদিন তিনি এটা খুলেছেন। আবার বন্ধ করে তালা লাগিয়েছেন। তালার চাবিটা যে দেওয়াল আলমারির মধ্যে একটি কৌটোর ভিতরে রাখেন তা তো এই ক’দিনের মধ্যে ভুলে যাবার নয়। তা হলে অমন করছেন কেন?
এরপরই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটা শাবল খুঁজে নিয়ে এসে তালাটা ভেঙে ফেললেন। তারপর ডালাটা খুলে সেই দুর্লভ পুথিটা বের করলেন। পুথিটা হাতে পেতেই তাঁর চোখ দুটো ঝকঝক করে উঠল। এই পুথি নিয়েই তিনি পুজো করেন। তাহলে আজ এই রকম অস্বাভাবিক আচরণ কেন?
পুথিটা হাতে পেতেই বাবা উন্মাদের মতো ছুটলেন বাইরের দিকে। নিশিনাথ চেপে ধরল বাবাকে। কোথায় যাচ্ছেন?
শরৎ ভাদুড়ী উত্তর দিলেন না। পুথিটা দুমড়ে মুচড়ে ফতুয়ার পকেটে পুরতে গেলেন—নিশিনাথ ঝাঁপিয়ে পড়ে পুথিটা বাঁচাবার চেষ্টা করল। তখনই শুরু হল ধাক্কাধাক্কি। নিশিনাথ অবাক হল—এই বয়েসেও বাবার এত শক্তি এল কোথা থেকে!
পুথিটা জোর করে কেড়ে নিতেই ভয়ংকর ব্যাপারটা ঘটে গেল সেই মুহূর্তে। হঠাৎ শরৎ ভাদুড়ীর মুখটা বদলে মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের মুখ হয়ে গেল। শরৎ ভাদুড়ীর অমন শান্ত চোখ দুটির বদলে ফুটে বেরোল দুটো ড্যাবডেবে লাল চোখ। আর সামনের ভাঙা চারটে দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভটা বেরোতে লাগল লিকলিক করে।
—বাবাগো! বলে নিশিনাথ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আর মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য শরৎ ভাদুড়ীর দেহখানা আশ্রয় করে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
দু—দিন পরে শহরের বাইরে বাঁশবাগানের মধ্যে পাওয়া গেল শরৎ ভাদুড়ীর পচাগলা মৃতদেহ।
সব ঘটনা ড. অরুণাংশু বসুকে জানালে, তিনি সংক্ষেপে লিখলেন এটা এদেশে নতুন ব্যাপার নয়। প্রেততত্ত্ববিদদের মতে এক শ্রেণির দুষ্ট আত্মা দুরভিসন্ধি সিদ্ধি করার জন্যে কাছেই যে পছন্দমতো মৃতদেহ পায় তার মধ্যেই ঢুকে পড়ে। সবাই মনে করে মৃত ব্যক্তি বুঝি ফিরে এসেছে। তা নয়। তারপর একদিন প্রয়োজন ফুরোলে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়।
২০০৫, ভোরাই (নিউ বেঙ্গল প্রেস)
—