ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

অদৃশ্য ব্যাপার-স্যাপার

অদৃশ্য ব্যাপার-স্যাপার

একদিন—আধদিন নয়, প্রতিদিন। প্রতিদিন ঠিক একই সময়—এ যেন মৌ—এর একটা ভয়ংকর নেশা হয়ে উঠেছে। ওই ঘরটা ওকে টানবেই।

অথচ ঘরটার কোনো বিশেষ আকর্ষণ নেই। না সাজানো—গোছানো, না যায় দেখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। বরঞ্চ গোটা বাড়ির মধ্যে এই ঘরটাই সবচেয়ে পুরোনো। সে আমলের ভারী ভারী কাঠের কড়িবরগা। একটা কড়ি তো ভেঙে ঝুলছে। একটু ভূমিকম্প হলেই হুড়মুড়িয়ে পড়বে। দেওয়ালের এখানে—ওখানে পলেস্তারা খসে পড়ে নানা রকমের জন্তু—জানোয়ারের, কোথাও বা মানুষের মুখের আকৃতি ধারণ করেছে। একটা বই—এর থাক ছিল। সেখানে উই—এর লম্বা লাইন রেললাইনের মতো এঁকেবেঁকে দেওয়াল বেয়ে উঠে কড়িতে গিয়ে ঠেকেছে। বলা যায় আসল বাড়ি থেকে প্রায় সম্পর্কশূন্য একটা পরিত্যক্ত ঘর। সম্পর্কশূন্য অথচ একই পাঁচিলের মধ্যে। বসতবাড়ি আর এই পরিত্যক্ত ঘরের মধ্যে পড়ে আছে শুধু একটা উঠোন। উঠোনে মস্ত একটা কাঁঠাল গাছ আর কিছু বুনো ফুলের ঝোপ।

বাড়িতে লোক সর্বসাকুল্যে জনা পাঁচ—ছয়। কিন্তু দেশ থেকে আত্মীয়—কুটুমের আসা—যাওয়ার বিরাম নেই। মৌ হই—হট্টগোল পছন্দ করে না। কলেজে পড়ছে। তাই পড়াশোনা করার জন্যে ওই পরিত্যক্ত ঘরটাই বেছে নিয়েছে। একটাই সুবিধে হুটহাট করে কেউ এসে পড়ে না।

দিনের বেলা ওই ঘরে পুরোনো একটা চৌকিতে বসে পড়াশোনা করে—ঠিক আছে। কিন্তু রাত্তিরবেলাতে—ওই ঘরে একা—ওর দিদিরা বলে—রাত্তিরে ও ঘরে পড়ার দরকার কী? বাড়িতে ঘরের অভাব আছে?

বৌদি বলে—সত্যি ভাই মৌ, তোমার এটা খুব বাড়াবাড়ি। সন্ধের পর ওই কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে যেতেই আমার গা ছমছম করে তো তেপান্তরের প্রান্তে ওই পোড়ো ঘর। আর শুধু ওই ঘরটাই বা বলি কেন, এ বাড়িতে বউ হয়ে এসে পর্যন্ত তো টের পেয়েছি—একদিন— আধদিন নয়—

—ও সব কথা এই সন্ধেবেলা থাক না বৌদি। বলে উঠল মৌ—এর মেজদি।

মৌ—এর কাছে এসব কোনো কিছুই নতুন কথা নয়। সবই জানে সে। তবু সন্ধের পর থেকেই ওই দিকের ঘরটা ওকে টানে। ও না গিয়ে পারে না। ভয়—ডর বলে কিছু নেই। আছে শুধু কৌতূহল। কী যেন ঘটে ঘরটার মধ্যে…অদৃশ্য ব্যাপার—স্যাপার।….

সন্ধের পর মৌ তালা খুলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে যায়। কিন্তু আশ্চর্য দরজাটা সহজে খোলে না। কীসে যেন আটকে যায়। অনেক সময়ে বর্ষাকালে কাঠ বেড়ে গিয়ে আটকে যায় ঠিক। কিন্তু এ তো শুধু বর্ষাকালের ব্যাপার নয়—শীত—গ্রীষ্ম সব সময়ে। মনে হয় ঘরের ভেতর কেউ আছে যে চায় না ঘরের মধ্যে বাইরের কেউ ঢুকুক। তাই যেন দরজায় পিঠ সেঁটে আগলে আছে।

মৌ এসবই জানে। জানে দু—হাত দিয়ে দরজা ঠেলতে হবে। তবেই খুলবে। আর—

আর দরজা খুলতেই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ…ও চৌকাঠে দাঁড়িয়েই আগে বাঁ হাত বাড়িয়ে সুইচটা কোনোরকমে অন করে দেবে। ব্যস! আলো জ্বলতেই সব ক্লিয়ার।

একটা জিনিস মৌ ঠিক বুঝতে পারে না। সন্ধের পর দরজা খুলতে এত ঠেলাঠেলি কিন্তু দিনের বেলা তো এমন হয় না। তখন তালা খুলে একটু ঠেলতেই দরজা খুলে যায়। জানলাগুলো তখনও বন্ধই থাকে কিন্তু ওইরকম উৎকট ভ্যাপসা গন্ধ পাওয়া যায় না। তার বদলে পাওয়া যায় তামাকের গন্ধ। গন্ধটা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কেন এমন হয়? তামাকের গন্ধই বা কেন? তাও একদিন নয়। প্রতিদিন শুধু সকালে।

এসব কথা বৌদি বা দিদিদের বলে না। বললে হয় তারা হেসে উড়িয়ে দেবে; না হয় আরও বেশি করে ভয় পাবে। কী দরকার? তা ছাড়া মৌ বুঝে নিয়েছে এসব তার একান্ত নিজস্ব গোপন ব্যাপার। এই যেমন—

এই যেমন রোজকার মতো আজও এই মুহূর্তে ঘটতে চলেছে—

সন্ধেবেলা ঘরে ঢুকে ঘণ্টা দু—এক বেশ মন দিয়ে পড়া যায়। কোনো ব্যাঘাত হয় না। একদিন আলো জ্বেলে ঘরে ঢুকেই অন্যমনস্ক হয়ে পুব দিকের রং—চটা ছোটো ছোটো জানলাগুলো খুলে দিয়েছিল। সেদিন সে পড়তে পড়তে রীতিমতো ভয় পেয়েছিল। ঠিক কীসের যে ভয় তাও নিজেও জানে না। পুব দিকে এই ঘরের গায়ে গায়ে এমন কোনো বাড়ি নেই যে আলো জ্বলতে দেখা যাবে। আছে একটুকরো পোড়ো জমি আর একটা মজা পুকুর। জমিটাতে ঘেঁটুবন আর কয়েকটা ছাতিম গাছ। ওদিকে তাকালে গা—টা কেমন ছমছম করে। পুকুরের ওপাশে বাঁশবনের অন্ধকারে কালকাসুন্দে গাছের ফাঁকে ফাঁকে জোনাকির চোখ—পিটপিটানি। সেও যেন কেমন অস্বস্তিকর। মনে হয় ওরা যেন ভয় দেখাতে চাইছে। সবচেয়ে ভয় করে ওই পোড়ো জমিটাকে। যার নাম ‘পোড়া মাঠ’। জন্ম থেকে মৌ দেখে আসছে জমিটা অমনি পড়ে আছে। এখন জমির চাহিদা খুব। গ্রামের বড়ো বড়ো চাষিরা যাদের হাতে পয়সা আছে তারা শহরে চলে আসতে মরিয়া। খালি জমির সন্ধান পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এই শহরের মধ্যে জমিটার নাম কেউ করে না। ভারী আশ্চর্য তো!

মৌ ওর ঠাকমার মুখে শুনেছে আজ এই যে শহর—ঠাকমা যখন নতুন বৌ হয়ে বাড়িতে আসেন তখন এমনটি ছিল না। চারিদিকে বন—জঙ্গল। দিনের বেলাতেই শেয়াল ঘুরে বেড়াত ইতিউতি। কখনো ছিল ডাকাতের ভয়। গভীর রাতে মশাল জ্বালিয়ে রে—রে করে ডাকাতরা আক্রমণ করত গেরস্তবাড়ি। মেরেধরে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে মানুষ খুন করে লুঠপাট করে পালাত।

এ পাড়াতেই কোথায় একসময়ে নাকি ছিল প্রবল প্রতাপ এক জমিদারবাড়ি অনেকখানি জায়গা জুড়ে। একদিন ডাকাত পড়ল সেই বাড়িতে। তারা যখন লুঠ করতে পারল না তখন জ্বালিয়ে দিল অনেকের ঘরবাড়ি। তারপর বছরের পর বছর কাটল। আগুনে পোড়া বাড়িগুলো একদিন ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

সেই জায়গাটাই কি আজ ‘পোড়া মাঠ’?

মৌ—এর তা জানবার কথা নয়। সে শুধু নানা কথা শুনেছে ঠাকমার মুখে। তাদের আজকের এই বাড়ি—যে বাড়িতে বাস করছে তা এমন দোতলা কোঠা বাড়ি ছিল না। তখন সে বাড়িতে মৌদেরই কোন পূর্বপুরুষ থাকত, মৌ—এর ঠাকমাও তা বলতে পারেন না।

মৌ অন্যমনস্কভাবে ওই একদিনই রাত্তিরে ওই ঘরের জানলাগুলো খুলে ফেলেছিল। তার মতো মেয়েও সেদিন ভয় পেয়েছিল। কীসের ভয় তাও সে জানে না। শুধু এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস, ‘পোড়া মাঠে’ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ছাতিম গাছটা আর পুকুরের পাড়ে কালকাসুন্দে গাছের ফাঁকে ফাঁকে জোনাকির মেলা। ব্যস! মৌ তখনই জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল।

অথচ দিনের বেলা যখন জানলাগুলো খুলে পড়তে বসে তখন ‘পোড়া মাঠ’—এর দিকে তাকিয়ে থেকেও ভয় করে না।

আজ রাত্রে পড়তে পড়তে সেদিনের কথা মনে করে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ নজর পড়ল দেওয়াল—ঘড়ির দিকে। পৌনে নটা।

তাহলে তো আর দেরি নেই। মৌ সতর্ক হল।

আচ্ছা, এই দেওয়াল—ঘড়িটা কত দিনের পুরোনো? আজকাল গির্জের আকারের এই রকম বড়ো ঘড়ি দেখা যায় না। এই ঘরে টেবিল নেই, চেয়ার নেই, একটা পুরোনো চৌকি ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। তা হলে অত বড়ো ঘড়িটা কেন?

টক—টক—টক…ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। নটার দিকে। আর মাত্র সাত—আট মিনিট। একেবারে পাক্কা সময় নটা। টং টং করে ঘড়িতে নটা বাজবে আর শুরু হবে—

মৌ খুব ভালো করেই জানে নটা বাজলেই কী হবে। তাই সে নটা বাজবার আগেই ঘর ছেড়ে পালাবে। পালাতে বাধ্য হবে।

নটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট। মৌ তাড়াতাড়ি বইখাতা গুছিয়ে নিল। তড়বড় করে উঠে পড়ল চৌকি থেকে। অসাবধানে পেনটা পড়ে গেল হাত থেকে। চৌকির তলা থেকে কুড়োতে সময় লগল দু—মিনিট। তার পরই পড়িমরি করে চলে গেল দরজার দিকে। সুইচ অফ করতে হবে। দরজার—

ইস! তালাটা রয়ে গেছে চৌকির ওপর। তাড়াতাড়ি আনতে গিয়ে হোঁচট খেল। কোনোরকমে তালাটা নিয়ে এসে সুইচ অফ করে দরজা বন্ধ করার মুহূর্তে ঘড়িতে টং টং করে বাজল নটা। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে শুনল অনেকগুলো হালকা পায়ের অস্পষ্ট শব্দ। কারা যেন এল। বইখাতা বুকে আঁকড়ে ধরে মৌ এক দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরে এসে ঢুকল।

রান্নাঘর থেকে মা জিগ্যেস করল—পড়ার ঘরে তালা দিয়েছিস তো?

—হ্যাঁ। বলেই মৌ বইগুলো টেবিলে গুছিয়ে রাখতে লাগল।

ওপর থেকে মেজদি হাঁক দিল—পড়া হল?

নীচ থেকে মৌ উত্তর দিল—হ্যাঁ।

—তবে একটু চা কর না বোন।

মেজদির এই এক বদ অভ্যাস। যখন—তখন চা—এর দরকার হয়।

বৌদি রুটি বেলতে বেলতে রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে বলল—আমি করে দিচ্ছি ঠাকুরঝি।

এই মুহূর্তে মৌ—এর কেমন আচ্ছন্ন ভাব। চা করতে হল না। ভালোই হল। সে তখন ভাবছে কী আশ্চর্য ব্যাপার! এ বাড়িতে কেমন সুন্দর জীবিত মানুষের জগৎ। আর উঠোন পারে ওই ঘরটায় যেন মৃতের জগৎ।

মৃতের জগৎ—এটা তার কল্পনা নয়। বা হঠাৎ চোখে—পড়া কোনো বিশেষ ঘটনা নয়। এ ঘটনা রোজকার। বাঁধা সময় ধরে। আজ কত দিন ধরে ও এটা দেখে আসছে। দেখতে দেখতে রোজ ওই সময়ে ওই ঘরে থাকাটা নেশা হয়ে গেছে। প্রথম যেদিন এ ঘটনাটা দেখেছিল সেদিন রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। দিদিদের কাছে বলেছিল। তারা শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বৌদি বলেছিল—সন্ধের পর একা একা ও ঘরে নাইবা গেলে ছোটো ঠাকুরঝি। পুরোনো বাড়ি, পাশেই পোড়া মাঠ। তারপর ওই ঘরে নাকি তিন পুরুষ আগে কালীপুজো হত। নিশিপুজো। একবার নাকি বলি বেধে যায়। সবাই হায় হায় করে উঠেছিল। আর সেই বছরই ছোটো খুড়শ্বশুর মায়ের ওপর অভিমান করে গলায় দড়ি দেয়। আহা তরতাজা ছেলেটা। তার অপরাধ কী ছিল? না, বউ—এর কথা শুনে চলত। মা কিছু বললেও বউকে না জানিয়ে করত না। এই নিয়েই মায়ে—পোয়ে অশান্তি। সত্যি মিথ্যে জানি না ভাই, এখানে এসে অব্দি শুনে এসেছি। তারপর দিদিশাশুড়ির মুখে শুনেছি—

মৌ হেসে বলেছিল—চাটুজ্জেমশাই—এর কথা তো?

—হ্যাঁ। তুমি হাসছ বটে কিন্তু আমার সারা গা—এই দ্যাখো কীরকম কাঁটা দিচ্ছে।

বৌদি বলতে লাগল—কে এক কুটুম বাড়ির বৌ এসেছিল। এ বাড়ির তখন যিনি গিন্নি ছিলেন তিনি তাকে একা শুতে দিলেন না। দোতলার ঘরে নিজের বিছানায় নিজের পাশে শোয়ালেন।

তারপর—

মাঝরাতে নীচে কোন ঘরে যেন খটাস করে শব্দ। এত জোর শব্দ যে বৌটির ঘুম ভেঙে গেল। বুড়ি গিন্নিমা বললেন—ও কিচ্ছু না। চাটুজ্জ্যে মশাই মাছ ধরতে বেরোলেন। তুমি ঘুমোও।

কে এই চাটুজ্জ্যে মশাই আজ পর্যন্ত পরিবারের কেউ জানে না। তবু এখনও পর্যন্ত মাঝে মাঝে দোতলায় শুয়ে দুপুর রাতে দরজার খিল খোলার শব্দ অনেকেই শুনেছে। আমিও শুনেছি।

মৌ বলল—রাত দুপুরে চাটুজ্জ্যে মশাই বেরোতে চান বেরোন। তাই বলে খিল খুলবেন এমন শব্দ করে যে লোকের ঘুম ভেঙে যাবে! এ বড়ো অন্যায় বৌদি।

বৌদি বলল—এটা বুঝছ না কেন তিনি হচ্ছেন বাড়ির কর্তা। নিঃশব্দে কাজ করা কর্তাদের ধাতে নেই। সব সময়ে জানান দেন—তিনি ‘কর্তা’। যখন খুশি যা খুশি করবেন দাপটের সঙ্গে।

মৌ হাসি টিপে বলেছে—তা হলে কি ধরে নিতে হবে কবেকার কোন এক চাটুজ্জেমশাই আজও মনে করেন তিনিই এ বাড়ির কর্তা?

বৌদি গম্ভীর মুখে বললে—তা আমি জানি নে ভাই। তবে বলি, সন্ধের পর ও ঘরে নাই বা ঢুকলে?

মৌ হেসেই বলল—চাটুজ্জে মশাই না হয় এ বাড়ির কর্তা। এ বাড়িতেই অধিষ্ঠান করেন। তাঁর সঙ্গে আমার পড়ার ঘরের কী সম্পর্ক?

বৌদি একটু বিরক্ত হয়ে বলল—অতশত জানি নে। তবে উনি যদি বসতবাড়ির কর্তা হয়ে আজও থাকেন তাহলে তোমার পড়ার ঘরও ওঁর এক্তিয়ারের মধ্যে।

মৌ বিদ্রুপের সুরে বলল—পড়ার ঘর তো যারা পড়ে তাদের জন্যে। চাটুজ্জেমশাই কি তখন ওই ঘরে বসে চণ্ডীমঙ্গলের পুথি পড়তেন?

বৌদি চটজলদি উত্তর দিল—আজ না হয় তুমি ওটাকে পড়ার ঘর করেছ। তার আগে কী ছিল কে জানে। হয় তো চাটুজ্জেমশাই—এর বৈঠকখানা ছিল।

বৈঠকখানা!

কথাটা মৌ—এর মনের মধ্যে গিয়ে গাঁথল। ওই ঘরে প্রথম দিনের কথাটা মনে পড়ল।

…ঘরটা অনেক দিন ধরে বন্ধই ছিল। কোনো কাজে লাগত না। কলেজে পড়ার সময়ে মৌ আবিষ্কার করল সে বড়ো হয়েছে। পড়াশোনার চাপ বেড়েছে। এখন মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। তার জন্যে চাই নিরিবিলি পরিবেশ। তখনই ঠিক করে ফেলল ওই ঘরটাকেই সে পড়ার ঘর করে নেবে। সকলের হাঁকডাকের বাইরে থেকে একমনে পড়তে পারবে।

আগের দিন লোক দিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করে চৌকির ওপর মাদুর পেতে রেখেছিল মৌ। সকাল বেলায় মুখ ধুয়ে, চা খেয়ে বই—খাতা নিয়ে তালা খুলে ঢুকল ঘরে। ঢুকতেই মিষ্টি মিষ্টি অথচ কড়া একটা গন্ধ…কীসের গন্ধ মৌ ঠিক বুঝতে পারল না…অথচ যেন চেনা গন্ধ।

মৌ পুব দিকের জানলা দুটো খুলে দিল। সে আমলের ছোটো ছোটো জানলা। জানলার গায়েই পোড়া মাঠ। একেবারে নেমে গেছে পুকুরের ধারে। চোরকাঁটা, বনতুলসী আর ঝোপঝাপে ভর্তি মাঠটা। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ছাতিম গাছটা। ওদিকে দেখা যাচ্ছে তেলাকুচো লতার টুকটুকে পাকা ফল। পুকুরের ওদিকে আকন্দর ঝোপ। বাতাসে আকন্দ ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। সবচেয়ে ভালো লাগল এই সক্কালবেলাতেই সজনে গাছের ওপর দিয়ে সোনা রোদ গড়িয়ে পড়েছে মাঠের বুকে। এত সুন্দর যে মাঠ তাকে বলে কিনা পোড়া মাঠ!

সে দিনই সন্ধেবেলা এই ঘরটাই যেন কেমন কেমন। তালা খুলে দু—হাতে দরজার কপাট ঠেলে চৌকাঠে পা রাখতেই কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ। ঘরের মধ্যে জমাট বাঁধা অন্ধকারটাও যেন কেমন অচেনা।

ও তাড়াতাড়ি বাঁ হাত বাড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ডটা খুঁজে পেল। সুইচ অন করতেই ঘরটা আলোয় ভরে গেল। উঃ, কত কাল পর এ ঘরে ইলেকট্রিক আলো জ্বলল!

মৌ জানলা খুলতে গিয়েও খুলল না। পাশেই পোড়া মাঠ—ঝোপজঙ্গল। সাপ ঢুকতে পারে। ঠিক করল আগে জানলায় তারের জাল লাগিয়ে নেবে। তারপর—

মৌ খুব উৎসাহ করে পড়তে শুরু করল। তখন সন্ধে সাতটা। নিরিবিলিতে সকালের মতোই বেশ মন দিয়ে পড়ছিল। কিন্তু এই সন্ধেতে নিরিবিলিটা যেন বড্ড বেশি মনে হল। এত চুপচাপ ভালো লাগল না। কেবলই মনে হতে লাগল ওই যেন কীসের শব্দ হল…খুব আস্তে। না, ঘরের মধ্যে শব্দ নয়। ঘরের বাইরে। ও তৎক্ষণাৎ দরজাটার দিকে তাকাল। খোলা দরজাটা যেন হাঁ করে গিলতে আসছে!

আচ্ছা, দরজাটা কি খুলে রেখেই পড়তে বসেছিল?

হতে পারে।

মরুক গে। ভয় পাবার কি আছে? নিজেদের বাড়ি তো।

একটাই ভয়—বাইরে থেকে পাঁচিল টপকে যদি কেউ—

হ্যাঁ, যদি কেউ চুপি চুপি এসে তার মুখটা চেপে ধরে! চিৎকারও করতে পারবে না। চিৎকার করলেও বাড়ির কেউ শুনতে পাবে না।

না—না, এরকম কাল্পনিক ভয় পেলে পড়া হবে কী করে? তার চেয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো।

মৌ উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

এইবার নিশ্চিন্ত। এইবার পড়ায় মন বসবে।

মন দিয়েই পড়েছিল মৌ—তা ঘণ্টাখানেক। কিন্তু তারপরই ক্রমশ এই নির্জনতা কেমন ভারী হয়ে উঠতে লাগল। মনে হল যেন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

মন থেকে এইরকম অস্বস্তি দূর করে মৌ জোর করে পড়া মুখস্থ করার চেষ্টা করল। কিন্তু বারে বারেই মনে হতে লাগল এই ঘরে সে যেন আর একা নেই।

তখনই উঠে দাঁড়াল কী ঘটছে দেখার জন্যে।

কিন্তু চোখে কিছুই পড়ল না। শুধু হঠাৎ মাথার ওপর থেকে ঝুরঝুর করে বালি ঝরে পড়ল।

মৌ—এর মনে হল কেউ যেন তাকে ঘর থেকে চলে যেতে ইঙ্গিত করছে।

মৌ নিজেকে বোঝাল এ তার মনের ভুল। পুরোনো বাড়ি, বালি খসে পড়তে পারেই।

তবু গায়ের ভেতর কেমন করতে লাগল। ইচ্ছে করছিল চলে যেতে। কিন্তু যুক্তিহীন ভয়ের কাছে সে হার মানতে চায় না।

দেওয়াল—ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ল। নটা বাজতে দশ মিনিট। হঠাৎ পুব দিকের একটা জানলা খুলে গেল। ঝড় নেই, জোর বাতাস নেই, তাহলে কী করে খুলল?

তারপরেই ঘরের ভেতর অনেকগুলো খালি পায়ের হালকা শব্দ। কারা যেন ঢুকেছে ঘরে। যারা ঢুকেছে তারা চৌকিটার সামনে এসে দাঁড়াল। যেন মৌকে দেখে অবাক। এ আবার এই সময়ে এখানে মরতে এল কেন?

মৌ যেন স্পষ্ট বুঝতে পারল সে এখানে থাকে এরা তা চায় না। মৌ—এর গায়ে নিঃশ্বাসের গরম হাওয়া।…”যাও—যাও—”

ফিসফিস গলার সতর্কবাণী।

টং টং করে ঘড়িতে নটা বাজল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজাটা আপনি খুলে গেল।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল মৌ। ওদের জন্যে এখন ঘর ছেড়ে দিতে হবে।

বই—খাতা তুলে নিয়ে মৌ আলো নিবিয়ে তালা বন্ধ করার সময়ে ওদের মতো ফিস ফিস করে বলল—আপনারা কে তা জানি না। তবে আমি আসবই—রোজ আসব। এ আমার পড়ার ঘর। এ আমি মনের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছি।

মৌ তার প্রতিজ্ঞা রেখেছে। এখনও রোজ দু—বেলা এ ঘরে বসে পড়ে। তবে রাত্রিবেলা নটা বাজবার আগেই ওদের জন্যে ঘর ছেড়ে দিতে হয়।

ওরা কারা মৌ জানে না। জানতে চায়ও না। কী দরকার?

২০০৫, জুন, শুকতারা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *