লাশ
এখন এই অবসরপ্রাপ্ত অলস দিনগুলিতে বসে বসে পিছনের ব্যস্ত দিনগুলির কথা ভাবি। সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় বুলবুলিতলায় থাকার সময়ে সেই ভয়ংকর দিনটির কথা। কেন যে সেদিন তাড়াতাড়ি বুলবুলিতলা থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল সে কথা এর আগে কোনোদিন কাউকে বলিনি। বলিনি নিজের লজ্জা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়ে। কেউ হয় তো ভাবতে পারে আমি খুব ভীতু ছিলাম। কিংবা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেকালের কোনো এক গ্রামে থাকতে থাকতে আমিও বুঝি তাদেরই মতো যুক্তি—বিজ্ঞান সাহসের পরিমণ্ডল থেকে দূরে ছিটকে পড়েছিলাম।
আসলে এসব কিছুই নয়। সব ঘটনা শুনে তোমরাই বিচার করে দেখো আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন বা ভীতু ছিলাম কিনা।
…মানুষের কত বিচিত্র রকমের জীবিকা আছে তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। আমার লেখাপড়া তেমন উঁচু মানের ছিল না। কোনোরকমে স্কুলের গণ্ডিটা পেরিয়েছিলাম। ওই অল্পবিদ্যে নিয়ে কলকাতা দূরের কথা—আমার গ্রামের বাইরে কোনো শহরে গিয়ে চাকরি জোটানো কঠিন ছিল। হাতের তেমন কাজও জানা ছিল না যা দিয়ে অর্থোপার্জন করতে পারি। তবে আমার কুড়ি—একুশ বছর বয়েস থেকে ছবি তোলার নেশা ছিল। আর অনেক কষ্টে কিছু টাকা জোগাড় করে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ক্যামেরা কিনেও ফেলেছিলাম। সেটা সঙ্গে নিয়ে মাঠে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। ভালো স্পট পেলে ফটাফট ছবি তুলতাম। এইভাবে আমাদের গ্রামে আমিই একমাত্র ভালো ছবি তুলতে পারি এমনি একটা খ্যাতি রটে গিয়েছিল। তবে আমার দু—পয়সা রোজগারের যে সুবিধে হয়েছিল তা মোটেই নয়। কেননা আমাদের এখানে পয়সা খরচ করে শুধু শুধু কেউ ছবি তুলতে চাইবে না।
তবে একটা ব্যাপারে প্রায়ই আমার ডাক পড়ত। সেটা হচ্ছে মড়ার ছবি তোলা।
সকলেই জানেন যে—মানুষ সারাজীবন একটি ছবিও তোলেনি, মৃত্যুর পর অন্তিমযাত্রার আগে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়—স্বজন তাদের প্রিয়জনটির স্মৃতি হিসেবে একটি ছবি তুলে রাখতে চায়। কিন্তু আমাদের সে সময়ে গ্রামে ছবি তোলার সুবিধে ছিল না। তাই স্মৃতি রক্ষার জন্যে মৃতের দু—পা আলতায় মাখিয়ে সাদা কাগজে ছাপ তুলে তার পর সেটা বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা হত। কিন্তু পায়ের ছাপ আর ছবি—তফাত অনেক।
তারপর আমার গ্রামের আশপাশের লোকেরা কেমন করে আমার সন্ধান পেল জানি না। যখনই আমার বাড়ির কাছ দিয়ে মড়া নিয়ে যেত—কেউ একজন আমার বাড়িতে এসে হাঁকডাক করত যেন এখুনি একবার ক্যামেরা নিয়ে শ্মশানে চলে আসি।
আমি আর দেরি না করে তখনই শ্মশানে চলে যেতাম। কেননা শ্মশানে গিয়ে মড়ার ছবি তুললে ভালো টাকা পাওয়া যেত।
দিনের বেলা একরকম চলত, কিন্তু রাতের বেলা হলেই মুশকিল হত। মুশকিল হাত আলো নিয়ে। তখনও আমাদের এখানে ফ্ল্যাশে ছবি তোলার ব্যবস্থা ছিল না। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে শ্মশানঘাটে শুধু বাঁশের ডগায় দড়ি বেঁধে একটি ডে—লাইট ঝুলিয়ে রাখা হত। তাতে ছবি তোলা যেত না। অগত্যা একটা মড়াও যেন বাদ না পড়ে সেইজন্য কলকাতা থেকে ফ্ল্যাশ বালব নিয়ে এলাম। এখন রাতে মড়া এলেও ছবি তুলতে অসুবিধা হয় না।
মড়ার ছবি তুলে বেশি টাকা উপার্জনের নেশা ক্রমে বাড়তে লাল। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসত না। এই বুঝি একটা মড়া চলে গেল। দূরে ‘হরি বোল’ শুনলেই তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসে থাকতাম যেন ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারি।
মড়াটা চলে যাবার আগেই শবযাত্রীর সঙ্গের কেউ একজন হাঁক দিত—সরকার বাবু! ক্যামেরা নিয়ে চলে আসুন।
—যাই—বলেই পরনের লুঙ্গি—গেঞ্জি বদলে ধুতি—শার্ট পরে ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। শ্মশানঘাটে গিয়ে ছবি তুলে আমার ফি গুনে নিয়ে চলে আসতাম। তবে বেশি রাত হলে একা একা ফিরতে সাহস হত না। বাকি রাতটুকু, শ্মশানে বটগাছতলায় মৃতদেহের রেজিস্টার রাখেন যিনি তাঁর ঘরে গল্প করে কাটিয়ে দিতাম।
এই ভাবে রাতবিরেতে ঘুম থেকে উঠে সাইকেল চালিয়ে শ্মশানঘাটে গিয়ে ছবি তুলতে—এমন কি শ্মশানে রাত জাগতে কষ্ট হলেও তা গায়ে মাখতাম না। মনকে বোঝাতাম টাকা উপায় করতে গেলে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। তবু তো এ আমার নিজের দেশ। শ্মশানঘাটটা সম্বন্ধে কিছু কিছু দুর্নাম শোনা গেলেও নিজের দেশের শ্মশান বলে ভয় করত না।
কিন্তু গিন্নিকে নিয়ে মুশকিলে পড়লাম। তিনি ঘুমকাতুরে। পাতা বিছানা পেলেই একবার গা গড়িয়ে নিতেন। বিছানায় গা ফেলা মানেই সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। আর ঘুমের ব্যাঘাত কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না। ফলে রাত্তিরে ডাকতে এলে তিনি খুব বিরক্ত হতেন। বিরক্ত হবারই কথা। অত রাত্রে আমি বেরিয়ে এলে তাঁকেই উঠে দরজা বন্ধ করতে হত। সে এক বিড়ম্বনা। বিশেষত শীতকাল হলে তো কথাই নেই। তার ওপর আছে ভয়। দূর থেকে ‘হরিবোল’ শুনলেই তিনি ছেলেমানুষের মতো কানে আঙুল দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতেন। আমি বেরিয়ে গেলে একা ঘরে ওর যে কী অবস্থা হত তা ভাবা যায় না।
শেষ পর্যন্ত গৃহিণী অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাকে রাত্তিরে মড়ার ছবি তুলতে বারণ করলেন। বললেন—কটা টাকার জন্যে অত রাতে শ্মশানঘাটে ছবি তুলতে যাও তাতে আমার ভালো লাগে না। ও তুমি ছেড়ে দাও।
বললাম—দুটো টাকা বেশি রোজগার হয়।
—অত লোভ কোরো না। দিনে যা রোজগার হয় তাই ভালো। শেষে রাত্তিরে শ্মশানে—মশানে গিয়ে কী হতে কী হয় কে বলতে পারে। তা ছাড়া ওই কাপড়েই শ্মশান থেকে বাড়ি এসে ঢোকো। বিছানায় বসো। মাগো!
আমি তাঁকে কত বোঝালাম। বললাম—শ্মশানঘাটে গিয়ে আমি তো মড়া ছুঁই না। যেখানে রাত কাটাই সেটা রেজিস্টারবাবুর ঘর। পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন। মানুষটিও ভালো। পুজো—আচ্চা করেন (মিথ্যে কথা)। দিন—রাত ওই ঘরে পড়ে আছেন।
স্ত্রী মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন—লোকটার বউ, ছেলে, সংসার নেই বোধ হয়। তাহলে আর কী সেখানেই গিয়ে থাকো গে।
ঠিক এই কথাটাই একদিন বললেন রেজিস্টারবাবু।
—কী দরকার সরকারবাবু, শুধু শুধু স্ত্রীর মুখঝামটা খেয়ে? আপনি বিছানাপত্তর নিয়ে আমার এখানেই চলে আসুন। দিব্যি থাকব দুজনে। সামনেই তো শান্তি হোটেল। দেখবেন খেয়ে থেকে দুয়েতেই শান্তি—বাড়ির চেয়ে বেশি শান্তি।
ভেবে দেখলাম—রেজিস্টারবাবু মন্দ বলেননি।
—তবে কিনা—
—এর মধ্যে আবার ‘তবে’ ‘কিন্তু’ আসছে কেন?
বললাম—অনেক কাল একসঙ্গে আছি তো। হঠাৎ চিরকালের মতো একেবারে ছাড়াছাড়ি—ও সহ্য করতে পারবে না।
—কী মুশকিলেই পড়লাম। চিরকালের মতো বলছেন কেন, একেবারে ছাড়াছাড়ির কথাই বা উঠছে কেন? ভালো না লাগলে ‘পুনমূর্ষিকো ভব’। আবার আগের মতো সংসারী হয়ে পড়বেন। আর একেবারে ছাড়াছাড়ি হবে কোন দুঃখে। সকালে এক ফাঁকে টুক করে বাজার করে বাড়িতে তো দিয়ে আসতেই হবে। না—না, ভাববেন না। সকালে বড়ো একটা মড়া আসে না।
একটু থেমে বললেন—সহ্য করতে পারবেন না বলছেন। জানেন না স্ত্রীরা স্বামীর না থাকা বরঞ্চ হাসি মুখে সহ্য করতে পারে কিন্তু ঘুমের ব্যাঘাত পারে না।
একটু ভেবে বললাম—তা ছাড়া অন্য একটা প্রবলেমও আছে।
—আবার কী?
—আমার স্ত্রী রাতে একলা শুতে পারে না। বিশেষ করে জোরে ‘হরিবোল’ দিয়ে মড়া নিয়ে গেলে।
—কী আশ্চর্য! একলা শোবেন কেন? আপনার একটি শ্যালিকা আছেন না?
—তা আছে।
—তবে আর কী, ওঁরা দুজনে শোবেন।
সেই মতো স্ত্রীকে প্রস্তাব দিতে তিনি বললেন—রাত দুপুরে একা সাইকেলে শ্মশানে যাওয়ার চেয়ে ওখানে থাকা ভালো। রেজিস্টারবাবু মদটদ খায় না তো?
বললাম—নাঃ ওসব নেশা ওঁর নেই।
‘শ্মশানবৈরাগ্য’ বলে একটা কথা অনেক দিন থেকে শুনে আসছি। কিন্তু জিনিসটা যে কী তা বুঝতাম না। আজ প্রায় পনেরো দিন হল শ্মশানেই বসবাস করা শুরু করেছি। এখানে তাঁর সঙ্গে থাকায় আমার চেয়ে রেজিস্টারবাবু যে বেশি খুশি তা ওঁর হাসি হাসি মুখ দেখলেই বোঝা যায়। ঘরটি মাঝারি সাইজের। একদিকে ওঁর চৌকি। সেখানে তাঁর বিছানাটি গোটানো। শোবার সময় বিছানাটা পেতে নেন। এপাশে আমার জন্যে একটা আমকাঠের চৌকি কেনা হয়েছে। বিছানাপত্র গৃহিণী নিখুঁত ভাবে গুছিয়ে দিয়েছেন। মনে হয় যাতে আমি অসুবিধের অজুহাতে হুটহাট করে বাড়ি চলে না আসি। আমি বোধ হয় একটু কুঁড়ে টাইপের। রোজ শোবার সময়ে বিছানা পাতো আবার ঘুম থেকে উঠে বিছানা গুটিয়ে রাখা এত পরিশ্রম আমার পোষায় না।
দরজা দিয়ে ঢুকতেই সামনে একটা টেবিল আর মুখোমুখি দুটি চেয়ার। টেবিলে রেজিস্টারবাবুর খাতাপত্র ফাইল। তিনি প্রায় সারা দিন টেবিলে সামনের চেয়ারে বসে থাকেন। যেন অফিসের ডিউটি দিচ্ছেন। ঘরের এক কোণে লণ্ঠন। সন্ধে হলেই অন্ধকার করে আসত। লণ্ঠনের পাশে একটা জলচৌকিতে দেশলাই। যেন আলো জ্বালাবার সময় অন্ধকারে দেশলাই খুঁজতে না হয়।
আমার বিছানার গায়েই উত্তর দিকে একটা জানলা। সেই জানলা দিয়ে কিছু দূরে গঙ্গা দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃতির দৃশ্য দেখব কী অল্প দূরেই পাঁচিল ঘেরা শ্মশান। বুলবুলিতলার বহুপরিচিত শ্মশান। দূর দূর গ্রাম থেকে লোকে মড়া নিয়ে আসে দাহ করার জন্যে। ফলে দিনে অনেক কটা মড়া পোড়ে। পোড়ার কটু গন্ধ আর ছাই উড়ে আসে জানলা দিয়ে। এটা আমার কাছে খুব অস্বস্তিকর। আমি অনেক রকমের মৃতদেহের ছবি তুলেছি বটে কিন্তু শ্মশানের এরকম নিকট প্রতিবেশী হয়ে দিন কাটাতে হয়নি। আরও অস্বস্তিকর পিছনের ঝাঁকড়া বটগাছটা। তার ডালে ডালে আবার শকুন বসে থাকে। সমস্ত পরিবেশটাই যেন কেমন—কেমন।
এরই মধ্যে শবযাত্রীরা হরিধ্বনি দিয়ে মড়া নিয়ে আসে। প্রথমেই নামায় অফিসঘরের সামনে। একজন একটা স্লিপ হাতে নিয়ে অফিসঘরে এসে ঢোকে। রোজস্টারবাবু স্লিপটা ভালো করে দেখেন। ওটাই আসল। ডাক্তারের দেওয়া ডেথ—সার্টিফিকেট। তারপর কতকগুলো মামুলি প্রশ্ন করে মৃতের নাম—ধাম রেজিস্টারে এনট্রি করেন। তারপর হয়তো ছবি তোলার কথা হয়। রেজিস্টারবাবু আমাকে দেখিয়ে দেন। হেসে বলেন—আপনাদের সুবিধের জন্য আমিই ওঁকে এখানে এনে রেখেছি।
ছবি তুলে দিই। নোট শুনে নিই। তিন দিন পর কপি নিয়ে যেতে বলি।
একটা মড়ার পর আবার কখন আসবে তার ঠিক নেই। এটা সময়টাই অখণ্ড অবসর। বিছানায় পা তুলে বসে উত্তর দিকের খোলা জানলা দিয়ে চোখ মেলে দিই। হু হু করে তা দিয়ে হাওয়া এসে ঢোকে। গা জুড়িয়ে যায়। গঙ্গার ওপারটা ফাঁকা। কিছু উদ্বাস্তুর বাসা। দেখি গোরু চরছে। নীদতে দু—তিনটে নৌকো। মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। এই উদাস ভাবটা বেশি হয় বিকেল বেলায়। একটা দিন শেষ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জীবন থেকে যেন খসে পড়ল একটি তারা। তখনই মনে হয় সংসারে কে কার। সব শূন্য। জানি না একেই কি বলে শ্মশানবৈরাগ্য!
গতকাল থেকে শুনছি ঘাটে একটা মড়া এসে লেগেছে।
কী সর্বনাশ! কার মড়া?
রেজিস্টারবাবুকে জিগ্যেস করলাম। তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন—কে জানে! অমন নাম—ঠিকানাহীন কত মড়াই তো ভাসতে ভাসতে এসে লাগে। বিশেষ বর্ষার সময়ে—গঙ্গা যখন ফুলে ফেঁপে ওঠে।
আশ্চর্য মানুষ তো! কোন দেশের কোন পরিবারের কার প্রাণের ধন! মরে গেল। মুখে একটু আগুন পেল না। ভাসতে ভাসতে চলেছে এ ঘাট থেকে ও ঘাটে। দুঃখের ব্যাপার! কিন্তু রেজিস্টারবাবুর দুঃখবোধ নেই। কেমন সহজে বলে দিল অমন নাম—ঠিকানাহীন কত মড়াই তো এসে লাগে! আচ্ছা, মড়ার হিসেব রাখতে রাখতে লোকটা কি একেবারে পাথর হয়ে গেছে!
একদিন বিকেলে ওঁকে ওঁর বাড়ি—ঘরের কথা জিগ্যেস করেছিলাম। জানলাম হুগলিতে ওঁর বাড়ি। সেখানে স্ত্রী পুত্র কন্যা আছে। ভালোই আছে। কিন্তু ওঁকে কোনো দিন স্ত্রী—পুত্রদের কাছে যেতে দেখলাম না। কোনোদিন এতটুকু মন খারাপ করতে দেখলাম না।
জিগ্যেস করলে বলেন—এখানে কাকে বসিয়ে যাই? সরকারি হিসেব তো!
—তা বলে বাড়িতে কে কেমন আছে খবর নেবেন না! উনি নিশ্চিন্তে উত্তর দিলেন—খবর তো পাই। বলেই ড্রয়ার থেকে মোটা সুতো বাঁধা একগোছা পোস্টকার্ড বের করে দেখালেন।
পরের চিঠির প্রতি আমার আগ্রহ নেই। আমি শুধু ঠিকানাটা দেখলাম—
শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রচন্দ্র মল্লিক
শ্মশানঘাট
বুলবুলিতলা (জেলা বর্ধমান)
এই ঠিকানা! আর কিছু নয়, শুধু শ্মশানঘাট! তাহলে আমারও বর্তমান ঠিকানা কি শ্মশানঘাট?
সারা দিনে কয়েকবারই ঘাটে—এসে—লাগা সেই পরিচয়হীন মৃতদেহটির কথা মনে হল। কী হতভাগ্য ওই বেওয়ারিশ দেহটির মালিক। এই যে শ্মশানঘাটে এসে ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে বেঞ্চির উপর বসে আছি—কখন মড়া আসবে—কখন ছবি তুলব! কিন্তু ভেসে আসা মৃতদেহটির ছবি কেউ তুলবে না। কেউ তুলতে বলবেও না। পুলিশ যদিও তোলে তবে তা তদন্তের জন্যে—বাড়িতে স্মৃতি হিসাবে রাখার জন্যে নয়। কী দুর্ভাগ্য বেচারির!
পরের দিনও শুনলাম মৃতদেহটি ঘাটে ঠেকে রয়েছে। বললাম—একটা নামধামহীন মড়া আজ দু—দিন ধরে ঘাটে এসে পচছে পুলিশ খোঁজ করবে না?
—পুলিশ! অবাক হলেন রেজিস্টারবাবু। এ অঞ্চলে পুলিশের টিকি দেখা যায় না। অবশ্য গ্রামের মধ্যে খুনখারাপি হলে তখন শহর থেকে জিপ হাঁকিয়ে বড়োবাবু সদলবলে আসেন।
বললাম—গ্রামে খুনখারাপি হলে তবে তদন্ত? আর জলে ভেসে এলে সেই লাশের তদন্ত হবে না?
রেজিস্টারবাবু বললেন—কে আর শুধু শুধু খোঁচাতে যায়? তা ছাড়া আগেই তো বলেছি বানে—বন্যায় অমন কত লাশ আসে কে তার ঠিকুজিকুষ্ঠীর খোঁজ রাখতে চায় বলুন।
মনে মনে বললাম—তা বটে। বাড়িতে ডাক্তার—বদ্যির চিকিৎসার মধ্যে ওষুধ—পত্তর খেয়ে মরার মধ্যে যে কৌলীন্য আছে, জলে ভেসে আসা লাশের তা তো থাকতে পারে না। কাজেই এসব লাশের ছবি ওঠার সৌভাগ্য হয় না। ভাবতে ভাবতে সত্যি সত্যি বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
সেই মৃদু শব্দে রেজিস্টারবাবু অবাক হয়ে বললেন—কী হল? বললাম, ওই লাশটার কথা ভাবছিলাম।
—ভাববার কি আর অন্য বিষয় পেলেন না? বলে তিনি একটু হাসলেন।
বিকেলে একটু গঙ্গার ধারে গিয়েছিলাম। গল্প করতে করতে রেজিস্টারবাবুও বেরিয়ে এসেছিলেন। উনি সাধারণত বেরোন না। কখন মড়া এসে পড়ে। তবু কাছেপিঠে যদি বেরোন অফিসঘরের দরজা খুলে রাখেন। ডোমকে বলে যান—কাছেই আছি। এখুনি ফিরব।
বললাম—এদিকে এলাম যখন চলুন লাশটা দেখে আসি।
দুজনে ঘাটের নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালাম।
কিন্তু—লাশ নেই।
—লাশটা গেল কোথায়?
—কোথায় আর যাবে? ভেসে গেছে। ও কি এক জায়গায় থাকার?
জিগ্যেস করলাম—কতদূর যেতে পারে?
রেজিস্টারবাবু হেসে উঠলেন।—আপনি দেখছি লাশটার প্রেমে পড়ে গেছেন।
লজ্জিত হয়ে বললাম—না—না, তা নয়। আমার ইচ্ছে ছিল লাশটার একটা ছবি তুলব।
—লাশের ছবি তো তোলে পুলিশে। আপনি তুলে কি করবেন—বাড়িতে টাঙিয়ে রাখবেন? তাও তো কালই দেখলাম পচে গলে ঢোল হয়ে গেছে, দুর্গন্ধে দাঁড়ানো যায় না।
মৃতদেহের ছবি সাধারণে তুললেও লাশের ছবি তোলে পুলিশ। কিন্তু পুলিশও যদি ছবি না তোলে?
এই উৎকট ভাবনায় সারারাত্রি ভালো করে ঘুম হল না। কেবলই মনে হতে লাগল—আহা বেচারির পরিচয় নেই বলে কেউ একটা ছবিও তুলবে না?
পরের দিন সকালেও এই চিন্তাটা লেগেই রইল। নিজেই অবাক হয়ে গেলাম—এসব কী চিন্তা করছি! পাগল হয়ে গেলাম নাকি?
রেজিস্টারবাবু বললেন—কী এত ভাবছেন বলুন তো। কাল রাত্তিরেও বিড়বিড় করছিলেন।
বললাম—ওই লাশটা আমাকে ছাড়বে না দেখছি।
—লাশ!
—হ্যাঁ। বলেই তখনই বেরিয়ে গেলাম। একটু পরে ফিরে এসে বললাম—লাশটা আবার ঘাটে ভিড়েছে। এবার একেবারে শ্মশানের গায়ে।
—আবার কোথা থেকে এসে ভিড়ল? তা লাশ লাশ করে আপনি দু—দিন ধরে যা করছেন, ও আর আপনাকে ছাড়বে না।
কথাটা নিতান্তই ঠাট্টা। তবু ঠাট্টা যে এতদূর সত্য হয়ে দাঁড়াবে কে ভাবতে পেরেছিল?
সেদিন সন্ধেবেলা থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। শ্মশানঘাট শুনশান। অন্যদিন যদিও বা দু—তিনটে মড়া পোড়ে, আজ কিন্তু একেবারেই নেই।
বেশ রাতে চাপা গলায় ‘হরিবোল’ দিয়ে একটা মড়া এল। শবযাত্রীদের একজনের হাতে লণ্ঠন। তাদের পায়ের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় বেশ দূরের কোনো গ্রাম থেকে আসছে।
অফিসঘরের সামনে মড়া নামিয়ে একটা ছাতা ধরে একজন বলল—ছবিওলাবাবু আছেন?
—আছেন।
—আচ্ছা, বাবাকে কিছুক্ষণের জন্যে আপনার রকে রাখতে পারি? নইলে বৃষ্টিতে—
শ্মশানঘাটে মড়া নিয়ে অপেক্ষা করার জন্যে ঢাকা শেড নেই। অফিসঘরের বাইরের রকের মাথায় ছাউনি আছে।
রেজিস্টারবাবু বললেন—তা রাখুন।
মৃতদেহটি উঠে এল অফিসঘরের রকে। আমি ফ্ল্যাশে ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হলাম।
আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। আবার ভারী বর্ষণ শুরু হল বলে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
হঠাৎ উত্তরের জানলা দিয়ে কী যেন চোখে পড়ল। বিদ্যুতের ক্ষণিক আলোয় দেখলাম একটা গরিলার মতো দেহ দু—পাশে হাত দোলাতে দোলাতে অফিসঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। সারা গা আর ঝাঁকড়া চুল থেকে জল ঝরছে।
আমি এতই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে কাউকে একটা কথা বলতে পারলাম না। কোনোরকমে ফ্ল্যাশে মৃতদেহের ছবি তুলে নিলাম। সে রাত্রে কেন জানি না শোবার আগে গঙ্গার ধারের জানলাটা বন্ধ করে রাখলাম।
প্রিন্ট হয়ে এলে খাম থেকে কপিগুলো বের করতেই চমকে উঠলাম—এ আবার কী!
মৃতের ছবিটা ভালোই উঠেছে কিন্তু জানলায় ওটা কার মুখ? কী ভয়ংকর! কী বীভৎস! গোটা শরীরটা ফোলা, একটা চোখ নেই। সেখানে একটা গর্ত। উঁচু উঁচু দাঁতগুলো বেরিয়ে এসেছে। যেন হাসছে। ভয়ে আর ঘেন্নায় ছবিটা মাটিতে ফেলে দিলাম।
রেজিস্টারবাবু বললেন—এটা তো সেই জলে ডোবা লাশটা! আপনিই দিনরাত ওর কথা ভেবে ভেবে ওকে ডেকে এনেছেন। এখন কী করবেন?
বললাম—কী করব মানে?
—এই ছবি পার্টিকে দেবেন নাকি?
—ওরে বাবা! মারতে আসবে।
—তা হলে? আবার একবার ছবি তুলে দেবারও উপায় নেই। জ্যান্ত মানুষ হলে না হয় ফের ডেকে আনা হত।
বললাম—আজই তো ডেলিভারি নিতে আসবে। পালানো ছাড়া উপায় নেই।
—পার্টিকে তো কিছু বলতে হবে।
—বলব ছবিটা নষ্ট হয়ে গেছে।
—তা মানবে?
—ছবি তো নষ্ট হতে পারেই। টাকা ফেরত পেলে তবু অনেকটা সইবে।
আমি তখনই অ্যাডভান্সের টাকা কটা রেজিস্টারবাবুর কাছে রেখে তলপি—তলপা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। স্ত্রীকে সত্যি কথা বললে ভয় পেয়ে যাবে। যা হোক একটা কিছু বানিয়ে বলতে হবে।
২০০৫, ফুলঝুরি (নিউ বেঙ্গল প্রেস)
—