খয়রামারির শ্মশানে
আজ পর্যন্ত অনেক জ্ঞানী—গুণী—ধনী লোক দেখেছি। দাতা, পরোপকারী লোকও কম দেখেনি। কিন্তু ব্রজমামার মতো অমন সাহসী লোক বড় একটা চোখে পড়েনি। এই সাহস জঙ্গলে ঢুকে বাঘের মুখোমুখি হওয়া বা চোর ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করা নয়। এ—সাহস অন্য ধরনের।
আমার বয়েস এখন সত্তর পেরিয়ে গেছে। রীতিমতো শহরে থাকি। ইলেকট্রিক লাইট, পাখা, ফোন, টি. ভি.—আধুনিক শহুরে—জীবনের সবকিছু সুবিধাই ভোগ করি। মরে গেলে ইলেকট্রিক চুল্লিতেই নিশ্চিন্তে পুড়ব, এ—ও জানি। কিন্তু জীবনের প্রথম কুড়ি বছর কাটাতে হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে গ্রামের অবস্থা কীরকম ছিল তা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।
ধুলো—ভরা রাস্তা, চারিদিকে বাঁশঝাড়, পুরোনো জমিদারের বিশাল বিশাল আমবাগান, কোথাও খাঁ—খাঁ মাঠ, এখানে—ওখানে ডোবা, খাল। সূর্য ডোবার আগেই রাস্তা জনশূন্য। সন্ধে হবার সঙ্গে সঙ্গে চক্রবর্তীদের আমবাগানে সমস্বরে শেয়াল ডেকে উঠত—হুক্কাহুয়া—হুক্কাহুয়া।
সেই ডাক আজকের তোমরা শোনেনি। শেয়াল আজ আর চোখেই পড়ে না।
শীতকালে গভীর রাতে দূরে ফেউ—এর ডাক শোনা যেত। সে এক অদ্ভুত ডাক— ফে—উ—ফে—উ। মনে হতো কোনও জন্তুর ভয়ে গলার স্বর বেরোচ্ছে না।
তা সত্যিই তারা ভয় পেত। বাঘ বেরোলেই পিছনে ফেউ লাগত। শেয়ালের মতো সেই জন্তুরা বাঘের পিছনে পিছনে যেত আর ওই অদ্ভুত ডাক ডেকে সবাইকে যেন সাবধান করে দিত—বাঘ বেরিয়েছে।
বাঘ তাড়া করলে ফেউ প্রাণের ভয়ে ছুটে পালিয়ে যেত।
এই বাঘ মারবার জন্যে বাইরে থেকে শিয়াল আসত। কিন্তু সহজে বাঘ মারা যেত না। উলটে বাঘের কামড়ে মরতে হত।
এ ছাড়া ছিল চোর—ডাকাতের ভয়। ভয়ই ছিল তখন গ্রামের মানুষের সব কাজের বাধা। সন্ধে হলেই ছাগল, গোরু সামলে যে যার ঘরে খিল দিয়ে থাকত।
এসব ছাড়াও আর একটা ভয় ছিল রাত্তিরে, যখন মড়া নিয়ে যেত। আমাদের বাড়ি থেকে শ্মশান অনেকদূর। বাড়ি থেকে যে কাঁচা—রাস্তাটা পশ্চিম দিকে বাঁশঝাড়, ডুমুরের ঝোপ—জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকে—বেঁকে বড় রাস্তায় গিয়ে মিশেছে, সেই রাস্তা দিয়ে অন্তত এক কিলোমিটার পথ হেঁটে গেলে ডানদিকে বাঁক নিতে হত। এখান থেকেই আর—একটা সরু রাস্তা বেরিয়েছে। তার একপাশে ধানজমি আর একপাশে খাল। এখানে আছে একটা পিরের দরগা। তার পাশে বিরাট জোড়া বটগাছ। সার—সার ঝুরি নেমেছে। দিনের বেলাতেও জায়গাটা অন্ধকার। এখানে এসে লোকেরা মড়া নামিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে। তারপর আবার যাত্রা। আরও অন্তত আধ কিলোমিটার হাঁটার পর খয়রামারির খাল। এখানেও যত রাজ্যের মড়া এনে পোড়ানো হয়। এই মড়া দেখলে খুব ভয় করত।
গভীর রাত্রে আর এক—একদিন দূর থেকে যখন শোনা যেতু ”বলো হরি, হরি বোল—” তখন মশারির নিচে শুয়েও কী জানি কেন ভয়ে বুক কেঁপে উঠত। মনে হতো মড়া নিয়ে বোধহয় এদিকেই আসছে। অনেক দূরে, জোড়া বটগাছের দিকে।
ছোটবেলায় আমরা গ্রামের মধ্যে এই ধরনের নানা ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকতাম।
তারপর যখন আমার বয়স সতেরো আঠারো হল তখন একদিন ও—পাড়ার ব্রজমামা ডেকে পাঠালেন। ব্রজমামার বয়স তখন ত্রিশ—বত্রিশ। ব্যায়ামপুষ্ট দেহ। চওড়া বুক। সে বুকের মধ্যে ভয়—ডর বাসা বাধতে পারেনি। কথায় কথায় প্রাণখোলা হাসি। বানে—বন্যায়, রোগে—মহামারিতে ব্রজমামা হাজির। এইজন্যে গ্রামের সকলেই ব্রজমামাকে শুধু ভালোবাসত না, খাতিরও করত। সবাই জানত বিপদে—আপদে ব্রজমামা ছুটে আসবেনই। বেশিরভাগ সময়েই খালিগা, পরনে লঙ্গি। খুব ইচ্ছে করত ওঁর সঙ্গে দুটো কথা বলতে। কিন্তু নাগাল পেতাম না। কেননা একদল ডাকাবুকো ছেলে সবসময়েই ওঁকে ঘিরে থাকত।
সেই ব্রজমামা হঠাৎ আমায় ডেকে পাঠালেন। আমি কৃতার্থ হলাম।
আমি যেতেই ব্রজমামা আমার কাঁধে হাত রেখে একমুখ হেসে বললেন,—তোকে খুঁজছিলাম। দেখি হাতের মাসল।
হাত শক্ত করে গুটিয়ে মাসল দেখালাম। উনি টিপে—টিপে দেখলেন। খুব যে খুশি হলেন তা মনে হল না। তবু বললেন,—ঠিক আছে। আজ সন্ধের পর আমি খয়রামারির শ্মশানে থাকব। তুই আসবি। একা আসবি।
চমকে উঠলাম। বলেন কী ব্রজমামা! সন্ধেবেলা খয়রামারির শ্মশানে আমি যাব! তাও একা!
কিন্তু তাঁর মুখের উপর না বলার ক্ষমতা কারো নেই।
ব্রজমামা অবশ্য আর দাঁড়ালেন না। তাঁর অনেক কাজ। কয়েকটি ছেলেদের সঙ্গে তিনি চলে গেলেন। চলে যাবার সময় শুধু একটি কথাই বলে গেলেন,—তাহলে সন্ধেবেলায় আবার দেখা হচ্ছে।
যাব কি যাব না এসব জিজ্ঞেস করার দরকারও মনে করলেন না।
সব শুনে মা তো প্রায় কাঁদো কাঁদো। বাবা গুম হয়ে গেলেন। কিন্তু ব্রজমামার মতো পরোপকারি জনপ্রিয় মানুষের কথা ঠেলা যে যাবে না। একথাও তাঁরা বুঝলেন।
সারা দুপুর শুধু ছটফট করেছি। বেলা যতই পড়তে লাগল, ততই বুকের কাঁপুনি শুরু হল। কেমন যেন মনে হল, আজই আমার জীবনের শেষ দিন। কেননা সন্ধেবেলায় একা একা নির্জন ওই বটতলা, পিরের দরগা দিয়ে খয়রামারি যাওয়া মানেই অপঘাতে মৃত্যু। কী নেই এখানে? লোকে দিনের বেলাতেই একা যেতে সাহস করে না, তো সন্ধেবেলা! তখন একমনে ঠাকুর—দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম— তোমরা যে যেখানে আছ, সন্ধের আগেই এমন কিছু করো যাতে আমার যাওয়া না হয়। ঝড় হোক, প্রচণ্ড বৃষ্টি হোক, ভূমিকম্প হোক। তোমাদের ইচ্ছেয় কী না হয় ঠাকুর! আমায় বাঁচাও।
কিন্তু নির্দয় দেব—দেবীরা সেদিন সতেরো বছরের একটি ছেলের কাতর প্রার্থনায় কান দেননি। অন্য অনেক দিনের মতোই নির্বিঘ্নে বেলা পড়ে এল।
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন,—যেতেই যখন হবে, তখন এখনি রওনা হও।
রওনা হতেই হল। বাঁ হাতে একটা লণ্ঠন আর ডান হাতে লাঠি। মা দুগগা দুগগা বলে চোখ বুজিয়ে ঠাকুর—দেবতাদের প্রণাম জানালেন। তারপর হঠাৎ ছুটে এসে আমার কানে কানে বললেন,—তেমন কিছু দেখলে রামনাম করবি ভুলিসনে যেন।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটছি। দু’পাশে বাঁশঝাড়, ডুমুরের বন,বনতুলসীর ঝোপ। বড় রাস্তায় পড়ে যেন খানিকটা হাঁপ ছাড়লাম। এখনও এক কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। মনের জোরে হাঁটতে লাগলাম। এদিকে বেলা পড়ে আসছে। তার আগেই বটতলায় পৌঁছতে হবে—একটা বটগাছে রক্ষে নেই, জোড়া বটগাছ।
একসময়ে সেখানেও পৌঁছে গেলাম। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। বটতলায় একটু বসে লণ্ঠন জ্বেলে নিলাম। তারপর আবার হাঁটা।
ভর সন্ধেবেলায় খয়রামারির খালের ধারে উঁচু জমিটায় এসে পৌঁছলাম। এই উঁচু জায়গাতেই মড়া পোড়ানো হয়। অনেকখানি জায়গা জুড়ে জমিটা। একটি টিনের চালাঘর। সামনে রক। শ্মশানযাত্রীরা মড়া নামিয়ে এখানে বিশ্রাম করে। শ্মশানের একদিকে একটা বেলগাছ। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। খালের ধারে একটা নিভে যাওয়া চিতা থেকে তখনও শুরু হয়ে ধোওয়া বেরোচ্ছে।
কিন্তু কোথায় ব্রজমামা? এই নির্জন অন্ধকার শ্মশানে একা আমি—সতেরো বছরের একটি ছেলে।
ডাকলাম,—ব্রজমামা!
সাড়া নেই।
কী ব্যাপার? আমায় আসতে বলে নিজেই এলেন না? কিন্তু ওই ধরনের ফালতু মানুষ তো উনি নন।
কী করব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম। একবার ভাবলাম, ফিরে যাই। আমি তো এসেছিলাম। উনি না এলে কী করতে পারি?
তারপর ভাবলাম, এদিকটা একটু ঘুরে দেখি। কিন্তু শ্মশান বলে কথা। শুধু ভয় নয়, কেমন গা ঘিনঘিন করে। এখানে—ওখানে ভাঙা কলসি পড়ে রয়েছে। ও—পাশে মড়া বইবার পরিত্যক্ত বাঁশের চালি। তারই পাশে ছেঁড়া তোশক, বিছানার ময়লা চাদর, তেলচিটে ফাটা বালিশ। এসবই মৃতদেহের সঙ্গে এসেছিল। এখন ফেলে দিয়ে গেছে। একটা কীরকম আঁশটে দুর্গন্ধ। নাক টিপে ধরলাম। বাড়ি গিয়ে শ্মশানে যাবার প্রায়শ্চিত্তের জন্যে স্নান তো করতেই হবে। হয়তো ভাতও মুখে তুলতে পারব না। এই আঁশটে গন্ধটা নাকে লেগে থাকবেই।
গুটি—গুটি এগোচ্ছিলাম ব্রজমামাকে খুঁজতে। লণ্ঠনটার জোরও তেমন নেই, তার ওপর মাঝে—মাঝে খালের ধার থেকে একটা দমকা হাওয়া উঠছিল—যে হাওয়াটা আমাদের ওদিকে পাওয়া যায় না।
এখানকার লোকে বলে—
”খয়রামারির খাল
দমকা হাওয়া উঠলে পরে
করবে নাজেহাল।”
এ সেই সব্বোনেশে দমকা হাওয়া।
আরও মুশকিল হয়েছে, দমকা হাওয়ায় মড়া পোড়ানো ছাইগুলো এদিকেই উড়ে আসছে।
—ব্রজমামা!
আবার সভয়ে ডেকে উঠলাম। কিন্তু কোথায় ব্রজমামা।
হঠাৎ শক্ত মতন কী যেন মাড়িয়ে ফেললাম। লণ্ঠনটা ভালো করে তুলে দেখতে যাব, হঠাৎ পিছন থেকে কে আমার পিঠে হাত রেখে বলে উঠল,—ওরে ওটা ভূতের হাত নয়, মানুষেরই আধপোড়া হাত। ভালো করে পোড়েনি। শেয়ালে মুখে করে এনেছে।
চেয়ে দেখলাম ব্রজমামা। হাসছেন।
—যাক, তাহলে ঠিকঠাক আসতে পেরেছিস। ভয় করেনি তো?
কী আর বলব। শুধু মাথা নাড়লাম।
—কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
ব্রজমামা হেসে বললেন,—বটতলা থেকেই তোর পিছু পিছু আসছি। শোন, কাল আমাদের সমিতিতে গিয়ে নাম লিখিয়ে আসবি। তোর বাবার সঙ্গে অবশ্য কথা বলে নেব।
বুঝলাম সাহসের পরীক্ষা দিয়ে তবেই আমি ওঁর সমিতির সভ্য হতে পেরেছি। তবে একটা কথা পরে জেনেছি। বাবা কিন্তু সেদিন আমায় একলা ছাড়েননি। দূর থেকে বাবা, ছোটকা আর ভোলা কৈবর্ত লাঠি—হাতে পিছু পিছু এসেছিলেন বটতলা পর্যন্ত। ব্রজমামাকে দেখে ওঁরা সরে যান। ব্রজমামা ভাগ্যি টের পাননি।
ব্রজমামার দলে নাম লেখাবার পর আমার প্রথম কাজ হল মড়া পোড়ানো। গ্রামে রোগের অভাব নেই, কিন্তু অভাব ভালো ডাক্তারের। ফলে চিকিৎসার অভাবে লোক মরে বেশি। মরে বেশি, কিন্তু মড়া নিয়ে যাবার লোকের খুব অভাব। প্রথমত অনাত্মীয়দের মড়া—কী রোগে মরেছে তার ঠিক নেই। সেই মড়া কাঁধে চাপিয়ে অতদূরে খয়রামারির খালে নিয়ে যাওয়া মোটেই সুখের ব্যাপার নয়। তার ওপর শ্মশানের তো ওইরকম বীভৎস ব্যাপার। জোড়া বটতলা ছাড়াও বেলগাছটারও দুর্নাম আছে খুব। লোকে বলে—
”শ্মশানের বেলগাছে
ব্রহ্মদত্যি পা ঝুলিয়ে আছে।
গায়ে যেন না লাগে পা
সাবধানে এড়িয়ে চলে যা।”
যত সাবধানে এড়িয়ে যাও না কেন, যদি কোনওরকমে তাঁর অদৃশ্য পদযুগল তোমার গায়ে লাগে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি দু’পা দিয়ে তোমার গলাটা সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ওপরে তুলে নেবেন।
এইসব কারণে লোকে সহজে মড়া নিয়ে যেতে রাজি হয় না। নানা ছলছুতো করে এড়িয়ে যায়। তখনই নিজের দলবল নিয়ে এগিয়ে আসেন ব্রজমামা। সেই দলে এখন আমিও একজন হয়েছি। যে ছেলে দূরে শ্মশানযাত্রীদের মুখে ‘বলো হরি, হরি বোল’ শুনে ভয়ে কানে আঙুল চাপা দিত, সেই—ই এখন মড়া পোড়াতে যাচ্ছে। একমাত্র ভরসা, ব্রজমামা পাশে—পাশে আছেন।
আমাদের গ্রামের একপ্রান্তে কাতীখেপী থাকত। আসল নাম কোনওকালে হয়তো ছিল কাত্যায়নী। তারপর ক্রমে—ক্রমে ওই নামটা যে কী করে কাতীখেপী হয়ে দাঁড়াল, তা বলতে পারব না। কুচকুচে কালো, মোটা, ঢ্যাবা—ঢ্যাবা চোখ, মাথায় রোঁওয়া—রোঁওয়া চুল। দেখলেই ভয় করে।
কাতীখেপীর নিজের বলতে কেউ ছিল না। বেজায় বদরাগি। তার কুঁড়েঘরের পিছনে একটা পেয়ারা গাছ ছিল। খুব দুঃসাহসী ছেলেরা পেয়ারা পাড়তে গেলে কাতীখেপী গালিতে ভূত ভাগিয়ে দিত,—মর মর, বাঁশবুকো, ওলাউটা—কবে খয়রামারি যাবি?
শুধু গাল দিতে দিতেই কাতী চুপ করত না। ইট—পাটকেল যা হাতের কাছে পেত, তাই ছুঁড়ে মারত। একদিন একটা ছেলেকে ইট ছুড়ে এমন মেরেছিল, যে মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। তাই শুনে ব্রজমামার মতো ধীর—শান্ত মানুষটিও কাতীখেপীকে তাড়া করে গিয়েছিলেন। কাতীখেপী বঁটি ছুড়ে এমন মেরেছিল যে ব্রজমামাকে একমাস বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল। কাতীখেপীর আরও গুণ ছিল। সুযোগ পেলেই লোকের বাড়ির ছাগলছানা, মুরগি চুরি করত। একবার একটা ছোটো ছেলে হারিয়ে গেল। লোকে বলাবলি করত—কাতীখেপীই ওকে চুরি করে কিংবা ভুলিয়ে—ভালিয়ে বাইরে বিক্রি করে দিয়েছে। এককথায় কাতীখেপী ছিল গাঁয়ের আতঙ্ক।
শোনা গেল, কাতীখেপীর নাকি কী রোগ হয়েছে। ব্রজমামার যতই রাগ থাক, তবু নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে একজন ডাক্তার পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তারকে কাতী এমন বাপান্ত করে গাল দিয়েছিল যে ডাক্তার পালিয়ে আসতে পথ পায়নি।
দু’দিন পর বেলা তিনটে নাগাদ বাবা এসে বললেন,—কাতীটা মরেছে।
শুনে সবাই যেন নিশ্চিন্ত হল।
কিন্তু,—বাবা বললেন,—ওকে ঘাটে নিয়ে যাবে কে? কেউ নাকি ওর ত্রিসীমানায় ঘেঁষছে না।
বললাম,—তা হলে কী হবে? ঘরের মধ্যেই পচবে?
বাবা বললেন,—তাই কী কখনও হয়? একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।
সেই দিনই সন্ধের মুখে ব্রজমামা ডেকে পাঠালেন। দক্ষিণপাড়ার একজন বুড়ো মরেছে, নিয়ে যেতে হবে। তার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই।
তবু রক্ষে, কাতীখেপীকে নয়। এই ভর সন্ধেবেলা মড়া বইবার জন্যে মা কিছুতেই ছাড়বেন না। কিন্তু যেতে আমাকে হলই—কেননা সমিতির নিয়ম অনুযায়ী আমাকে তিন সত্যি করতে হয়েছে, যখনই মড়া পোড়াবার ডাক আসবে, তখনই যেতে হবে।
জামা ছেড়ে, খালি গায়ে, কোমরে গামছা বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম। সমিতি থেকে ব্রজমামা আমাদের জনা—ছয়েক নিয়ে বুড়োর বাড়ি এলেন। বাঁশকাটা, চালিবাঁধা, নতুন কাপড় কিনে এনে মড়া ঢাকা দেওয়া ইত্যাদি করতে আরও প্রায় দু—ঘণ্টা কেটে গেল। তারপর হরিধ্বনি দিয়ে মড়া কাঁধে নিয়ে খয়রামারির পথ ধরলাম।
এই প্রথম আমি মড়া বইছি। চারজন কেঁদোর মধ্যে আমি একজন। অন্যদের অভ্যাস আছে। আমার নেই। বাঁশের চাপে কাঁধ টাটিয়ে যাচ্ছে। তবু পারছি না বলার উপায় নেই। মাঝে—মাঝে সকলের সঙ্গে আমিও চেঁচাচ্ছি,—বলো হরি, হরি বোল।
অন্ধকার হয়ে গেছে। একজনের হাতে লণ্ঠন। কাঁধে মড়া তুললেই পায়ের গতি বেড়ে যায়। সবাই যেন ছুটছে। যার হাতে লণ্ঠন, সে পিছিয়ে পড়ছে। তারপর সেও ছুটে কাছে আসছে। তার হাতের দোলানিতে লণ্ঠনটা দুলছে এপাশ—ওপাশ, ঠিক যেমন চালির ওপর বুড়োর মাথাটা দুলছে এদিক—ওদিক।
কখন বড় রাস্তায় উঠে এসেছি খেয়াল করিনি। এখনও অনেক পথ। একসময়ে ফের ঢালু কাঁচা রাস্তা। রাস্তা বড়ই খারাপ। এবড়ো—খেবড়ো। প্রতি পদে হোঁচট খাচ্ছি।
এর মধ্যে আমাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য একজন কাঁধ দিয়েছে। এমনি করে এক—একজন পালা করে কাঁধ দিচ্ছে। ফের আমার পালা।
ব্রজমামা বললেন,—গামছাটা বেড়ির মতো করে কাঁধে দিয়ে নে। লাগবে না।
তাই করলাম।
হনহন করে ছুটছি। এখানে—ওখানে বাঁশঝাড়, তেঁতুলগাছ, গাবগাছ। ওদিকে খাঁ—খাঁ মাঠ, কোথাও জলাভূমি। ঝোপে—ঝাড়ে জোনাকি জ্বলছে, ঝিঁঝিঁ ডাকছে।
হঠাৎ একটা ঝোপের মধ্যে থেকে কী একটা জন্তু মুখ বাড়াল। তার চোখদুটো জ্বলছে। আমার বুক কেঁপে উঠল। তার পাশেই আর—একটা, তার পাশে আরও একটা। শুধু তাকাচ্ছে না—দাঁত খিঁচিয়ে লাফিয়ে পড়বার তাল করছে।
আমি আবার ঝোপের ধারেই ছিলাম। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,—ব্রজমামা—
ব্রজমামা শান্ত গলায় বললেন,—খ্যাপা শেয়াল বোধহয়। ওদিকে তাকাসনে। বলেই গলার স্বর তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন,—বলো হরি, হরি বোল। সঙ্গে সঙ্গে সকলেই হরিধ্বনি দিল। আমরা খুব তাড়াতাড়ি সেই ঝোপটা পেরিয়ে এলাম।
কিন্তু আমার মন থেকে খটকা গেল না। শেয়াল অনেক দেখেছি। কিন্তু খ্যাপা শেয়াল কখনও দেখিনি। বেশ, তাই না হয় হল। তা বলে একসঙ্গে তিন—তিনটে খ্যাপা শেয়াল! একইসঙ্গে দাঁত খিঁচোবে!
খয়রামারিতে যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধে হয়ে গেছে। জনশূন্য শ্মশানঘাটের একদিকের কাঠের পোস্টে কাচে ঢাকা একটা কেরোসিনের ডিবে জ্বলছে টিমটিম করে। অল্প দূরে একটা চিতা সবে জ্বলতে শুরু করেছে।
আমাদের কাঠগুলো এনে এক জায়গায় জড়ো করবেন বলে ব্রজমামা কোদাল দিয়ে চুলো কাটতে লাগলেন। চুলো কাটা হলে ব্রজমামা অন্য চিতাটা দেখতে গেলেন। চিতার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন,—আরে, কাতী পুড়ছে! কিন্তু লোকজন গেল কোথায়?
তারপর চিতার চারপাশ দেখে বললেন,—চালি নেই। শুধু ফাটা বালিশ আর মাদুর, একটা বাঁশ। তাহলে বুকে বাঁশ দিয়েই মাদুর মুড়ে মাত্র দুজনে ঝুলিয়ে এনেছে। খেপীর কপাল দ্যাখ, চালিতে শুয়ে—শুয়েও আসতে পারল না।
তারপর আমাদের কাছে এসে চিতা সাজানোর তদারকি করতে লাগলেন। মৃতদেহ যাতে তাড়াতাড়ি পুড়ে যায়, সেটাই সবচেয়ে আগে লক্ষ রাখা উচিত। চিতার আগুন যেন মাঝখানে নিভে বা কমে না যায়। এইজন্যে চিতা সাজানোটাই কঠিন কাজ। নইলে মৃতদেহ আধপোড়া থেকে যাবে।
আমি এসবের কিছুই জানি না। আমার কাজ হল চিতার কাঠগুলো এগিয়ে দেওয়া। তারপর চিতা তৈরি হলে ব্রজমামা ভালো করে দেখে নিলেন। এবার বুড়োর মৃতদেহটি দুজনে ধরে খুব যত্ন করে চিতার উপরে শুইয়ে দেওয়া হল। তার ওপর আবার কাঠ সাজিয়ে দেওয়া হল। বুকে, দু’পাশে। অনেক কিছু ধর্মীয় আচার এই সময়ে করা হয়। কিন্তু এই বুড়োর জন্যে কে করবে এসব? কাতীখেপীরও কেউ করেনি।
সঙ্গে বুড়োর এক নাবালক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় এসেছিল। একগুচ্ছ পাটকাঠি জ্বালিয়ে কয়েকবার মৃতদেহটি পরিক্রমা করে সেই—ই বুড়োর মুখে ঠেকিয়ে দিল। ব্যস, মুখাগ্নি হয়ে গেল। এবার ব্রজমামা চিতায় আগুন দিলেন। বলো হরি, হরি বোল। আমরাও অমনি ব্রজমামার গলায় গলা মিলিয়ে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম,—”বলো হরি, হরি বোল।”
চিতা দাউ দাউ করে জ্বলছে লাগল। এবার বেশ কয়েক ঘণ্টার মতো নিশ্চিন্ত। আমরা একটু দূরে গিয়ে বসে রইলাম। আগুনের হলকা এখানেও আসছিল। সেইসঙ্গে ধোঁওয়া আর চামড়া পোড়ার গন্ধ। শুধু অবিচল ব্রজমামা। একটা বাঁশ হাতে করে আগুনের তাত অগ্রাহ্য করে চিতার দিকে তাকিয়ে। মাঝে—মাঝে বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে জ্বলন্ত কাঠগুলো ঠিক করে দিচ্ছিলেন।
হঠাৎ আমাদেরই একজন ভয়ে চিৎকার করে উঠল,—ওরে বাবা গো!
তার চিৎকারে আমরা পিছু ফিরে তাকালাম। ব্রজমামাও ছুটে এলেন। উঃ, কী ভয়ংকর! দেখলাম, জ্বলন্ত চিতার উপর কাতীখেপী সোজা হয়ে উঠে বসেছে। তার সর্বাঙ্গ পুড়ে বীভৎস হয়ে গেছে। সে দৃশ্য দেখে সবাই প্রাণভয়ে ছুটতে শুরু করেছে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভয়ে গা—হাত—পা কাঁপছে ঠকঠক করে। ব্রজমামা হুংকার ছেড়ে সবাইকে ডাকলেন।
—কোথায় পালাচ্ছিস ভীতুর দল? এখানে এসে চুপটি করে বোস।
একে—একে যদিও সবাই ফিরে এল, কিন্তু দাঁড়িয়ে রইল দূরে। শুধু কাতীখেপীর চিতার দিকে এগিয়ে গেলেন ব্রজামমা। আমাকে ডাকলেন,—এই ভোম্বল, এদিকে আয়।
ব্রজমামা তো বললেন,—এদিকে আয়, কিন্তু চিতার ওপর ওই যে মূর্তিখানি সাক্ষাৎ পিশাচের মতো খাড়া হয়ে বসে আছে, তার কাছে যাই কী করে? ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়তে কতক্ষণ?
তবু যেতে হল। ব্রজমামার আদেশ।
ব্রজমামা তাঁর হাতের বাঁশটা দিয়ে জ্বলন্ত কাতীখেপীর বুকে গুঁতো দিতেই দেহটা আবার চিতার ওপর পড়ে গেল।
—কীরে, ভয় পাচ্ছিস? ধ্যুত এ সব যা ভাবছিস তা নয়। চিতা ঠিকমতো না সাজিয়ে কোনওরকমে জ্বালিয়ে দিয়ে ওরা পালিয়ে গেছে। আগুনের তাপে মাসলে শিরে টান পড়ায় ওরকম হয়। ওসব কিছু নয়।
এসব কিছু তো নয়—কিন্তু আসবার সময়ে তিন—তিনটে শেয়াল যে একসঙ্গে দাঁত খিঁচোচ্ছিল, তাও কি কিছু নয়? তাই যদি না হবে, তাহলে ব্রজমামা সঙ্গে—সঙ্গে হরি বোল হরি বোল, করে উঠেছিলেন কেন?
ব্রজমামা আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানুটুকু দিয়ে ক্ষান্ত হলেই পারতেন। কিন্তু তাঁর সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। বললেন,—কাতী বেঁচে থাকতে যা করেছে, তা করেছে। কিন্তু মরার পর দেহটা যাতে ঠিকঠাক পোড়ে সেটুকু না করলে বেচারা স্বর্গে গিয়েও শান্তি পাবে না। বলেই কাতীর ওপর থেকে জ্বলন্ত কাঠগুলো নামাতে লাগলেন। বাধ্য হয়ে আমাদেরও হাত লাগাতে হল। তারপর এতটুকু ইতস্তত না করে চিতা থেকে কাতীখেপীর ঝলসানো দেহটা একাই টেনে তুলে এনে মাটিতে শুইয়ে দিলেন।
এবার আমাদের বললেন,—অর্ধেক কাঠ নামিয়ে ফেল। দেখিস আগুনে হাত না পোড়ে।
আমরা সেইরকম করলাম। তারপর ব্রজমামা কোথা থেকে একটা মোটা কাঠ এনে আড়াআড়িভাবে চিতার ওপর রাখলেন। বললেন,—মাজার নিচে মোটা কাঠের ঠেকা না দিলে এমনিই হয়। এরপর তিনি আবার কাতীখেপীর সেই বীভৎস দেহটা বুকের ওপর তুলে নিয়ে মা যেমন করে ঘুমন্ত শিশুকে যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে দেয়, তেমনি করে শুইয়ে দিলেন। কোমরটা রইল মোটা কাঠের ওপরে।
—নে, এবার কাঠগুলো ওর ওপর চাপিয়ে দে।
কত সহজেই না ব্রজমামা আদেশ করলেন। কিন্তু সেই সমস্ত জ্বলন্ত কাঠ, জ্বলন্ত চিতার ওপর সাজানো যে কী কঠিন, সে অভিজ্ঞতা কোনওদিন ভুলব না।
চিতা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। ব্রজমামা নিশ্চিন্ত মনে বললেন,—এবার শান্তিতে পোড় কাতী! শেয়াল—কুকুরে আর টানাটানি করবে না
২০০২, ডিসেম্বর, কিশোর ভারতী
—