নেই তবু আছে
গ্রামে বা মফসসলে শহরের গলি—ঘুঁজিতে রাত দুপুরে কুকুরের ডাক শোনার অভ্যাস আমার আছে। তা বলে এতগুলো কুকুরের একসঙ্গে এমন পরিত্রাহি ডাক এর আগে কখনও শুনিনি।
নতুন জায়গা। গভীর রাত। চারিদিকে কেমন থমথমে ভাব। এ অবস্থায় এমনিতেই ঘুম আসছিল না। অনেক চেষ্টা করে দু’চোখের পাতা বুজিয়ে পুরোনো সব কথা ভাবতে ভাবতে সবে মাত্র ঘুম এসেছে অমনি শুরু হল কুকুরের ডাক। অনেক সময়ে রাত্তিরে ভিন পাড়ার কোনো কুকর অন্য পাড়ায় এসে পড়লে সেই পাড়ার কুকুরগুলো একসঙ্গে চিৎকার করে একসঙ্গে তাড়া করে। আবার গভীর রাত্রে অচেনা লোক পাড়ায় ঢুকলে কুকুরগুলো এমনিভাবেই সমস্বরে চিৎকার করে পাড়ার লোকেদের সজাগ করে দেয়। কিন্তু এ অঞ্চলে কুকুরগুলোর চিৎকারের সুরটা যেন অন্য ধরনের। কেমন যেন ভয়—পাওয়া গলা।
বুঝলাম কুকুর শুধু শুধু চেঁচায় না। নিশ্চয়ই তেমন কিছু দেখেছে। ছেঁড়া ময়লা কাপড় জামা পরা কিংবা আলখাল্লা পরা নিরীহ মানুষকেও রাত্তিরে পথ চলতে দেখলে কুকুর তাকেও তাড়া করে।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। কুকুরের ডাক যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। তারপরেই মনে হল কুকুরের ডাক আর এক জায়গায় থেমে নেই, এগিয়ে আসছে।
অবাক হলাম। একসঙ্গে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে কেন? আর আসছে আমারই বাড়ির সামনের ধুলো ভরা রাস্তা দিয়ে।
একবার ভাবলাম উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াই। কিন্তু কেন জানি না সাহস হল না। নতুন জায়গা। কী দেখব কে জানে! আর এ তো জানা কথাই—কোনো দোষ না করে শুধু দেখে কেনার অপরাধে অনেক সময়ে মানুষকে বিপদে পড়তে হয়।
আমি তাই বিছানায় বসে বসে তাকিয়ে রইলাম জানলার বাইরে কী যায় তা দেখবার জন্যে।
কিন্তু কুকুরগুলোর ডাক এগোতে এগোতে অত এগোল না। অর্থাৎ আমার বাড়ির সামনে আর এল না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল। এমনি সময়ে একতলার একটা ঘর থেকে হুংকার শোনা গেল—অ্যাই! কী হচ্ছে?
সঙ্গে সঙ্গে ওদের ডাক থেমে গেল।
হুংকার ছাড়ল শংকর। ক্ষমতা আছে ছোকরার। এক হাঁকড়ানিতেই কুকুরগুলোকে থামিয়ে দিল।
এবার আমি নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু দুটো জিনিস ভেবে পেলাম না। প্রথমত—এত কুকুর জুটল কোথা থেকে? দ্বিতীয়ত—যাকে ধাওয়া করে কুকুরগুলো এগোচ্ছিল, এক জায়গায় এসে থেমে গেল কেন? সেই বা গেল কোথায়? আমার মন বলল—যে আসছিল সে যেই হোক খুব শিগগির সে আবার আসবে।
যখনকার কথা বলছি তখন বনগাঁ এমন শহর হয়ে ওঠেনি। পার্টিশন হয়নি, তার আগে থেকেই পূর্ব বাংলার লোক পালিয়ে আসতে শুরু করেছে। নির্দিষ্ট জায়গা নেই। যেখানেই ফাঁকা জায়গা পাচ্ছে সেখানেই কলোনি গড়ে তুলেছে। বর্ডারের কাছাকাছি জায়গাগুলোর দিকেই তাদের লক্ষ্য বেশি। তাই রানাঘাট, গেদে, বনগাঁ, বসিরহাট এসব জায়গায় উদ্বাস্তুরা ভিড় করছে।
আমার এক আত্মীয় যশোরে থাকত। তারাও এদিকে চলে আসতে চায়। বনগাঁর কাছাকাছি একটা তৈরি বাড়ি হলে ভালো হয়। বাড়ি ঠিক করতে গিয়ে এই বাড়িটার সন্ধান পেলাম।
বাড়িটা বনগাঁ টাউন ছাড়িয়ে ইছামতী নদী পার হয়ে যশোর রোড ধরে গিয়ে হরিদাসপুরের কাছে। চারিদিকে শুধু বন আর মাঠ। যশোর রোডের দু’পাশে সারিবদ্ধ শিশু গাছ—কেউ কেউ বলে রেনট্রি। অর্থাৎ বর্ষার গাছ।
চারিদিক নির্জন। বাড়িটা পুরোনো। দোতলা। বাড়ির চারিদিকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে কম্পাউন্ড। কম্পাউন্ডের মধ্যে আম—কাঁঠালের গাছ অনেকগুলো। নানারকম বুনো ফুল ফুটে আছে। ফড়িং আর প্রজাপতির খেলা। গাছের ডালে ডালে পাখির কাকলি।
এমন একটা দোতলা বাড়ি খালি পড়ে থাকা কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। কোনো এক সময়ে কেউ ভবিষ্যৎ না ভেবে শখ করে তৈরি করেছিল, তারপর এইরকম নির্জন জায়গায় টিকতে না পেরে শহরে চলে গিয়েছিল। সে সময়ে এরকম অনেক বাড়িই খালি পড়ে থাকত। কারণ না ছিল কলের জল, না ইলেকট্রিক লাইট। থানা বলতে এক ক্রোশ দূরে বনগাঁয়ে। ছিল শুধু চোর—ডাকাত আর সাপের উপদ্রব। তাই কেউ আর সাধ করে এসব জায়গায় পড়ে থাকতে চাইত না।
বনগাঁ—এ আমার কয়েকজন জানাশোনা লোক ছিল। আমি বাড়ি খুঁজছি শুনে তাঁরা ওই বাড়িখানিই কেনার পরামর্শ দিলেন। তার কারণ উদ্বাস্তুদের চাহিদার মুখে এতখানি জায়গাসহ এমন মজবুত দোতলা বাড়ি এই দামে পরে আর পাওয়া যাবে না।
কিন্তু জিজ্ঞেস করেছিলাম জায়গাটা কি ভালো? অত নির্জন জায়গা—চারিদিকে শুধু বন আর বন। লোক—বসতি নেই বললেই হয়। চোর—ডাকাতের উপদ্রব—
তাঁরা বললেন—তা সত্যি ওই একটা ভয়ই আছে—চোর—ডাকাতের। আর ভয় সাপের। তা সাপ কলকাতার বাইরে কোথায় নেই মশাই?
তবে আপনাকে একটা কথা বলি, যতক্ষণ ও বাড়িতে শংকরনাথ আছে ততক্ষণ চোর—ডাকাতের ভয় নেই। ও বন্দুক রাখে।
—শংকর কে?
শংকর সম্বন্ধে ওঁরা যা বললেন সংক্ষেপে তা এই—
ওই বাড়িটার মালিক জগদীশ সামন্ত কলকাতায় থাকেন। তাঁর শালার ছেলে ওই শংকর। লেখাপড়া করল না, ভদ্রলোকের বাড়ির ছেলে হয়েও ভদ্রসমাজে মিশতে পারল না। পাড়ায় কেবল মারপিট আর বাজে আড্ডা। শেষে জগদীশবাবু তাকে ঘাড় থেকে নামাবার জন্যে বনগাঁর ওই বাড়িটার কেয়ারটেকার করে পাঠালেন।
পিসেমশাই অতি সদাশয় লোক। শংকরকে খাইখরচা ছাড়াও দিয়েছিলেন একটা বড়ো টর্চ আর তাঁর পুরনো একটা একনলা বন্দুক—সে বন্দুক এখন কেউ ছোঁয় না।
লাইসেন্সের একটা ব্যাপার আছে। লাইসেন্স জগদীশবাবুর নামে। আইনত শংকর তা ব্যবহার করতে পারে না। তবে বনগাঁর ওই জঙ্গলের মধ্যে দরকারের সময় যদি বন্দুকটা দু’একবার ব্যবহার করতেই হয় তার জন্যে সম্ভবত কোনো হাঙ্গামা হবে না। লাইসেন্স আছে কি না কেউ দেখতে আসবে না। জগদীশবাবু নাকি প্রথমে বন্দুকটি দিতে চাননি। কিন্তু শংকর যখন বলল ওখানে গভীর জঙ্গলে এক একদিন অদ্ভুত কোনো জন্তুর ডাক শুনতে পাওয়া যায়, তাদের পায়ের অস্বাভাবিক ছাপও নিজে চোখে দেখেছে, এমনকি জঙ্গলের মধ্যে চোখে পড়েছে গোরুর রক্তমাখা খণ্ড খণ্ড দেহও। তখন বন্দুকটা না দিয়ে পিসেমশাই—এর উপায় ছিল না।
বাড়িটা কেনা একরকম পাকা হয়ে গেল। প্রায় অর্ধেক টাকা অ্যাডভান্স দেওয়া হল। তবে আত্মীয়টি সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন তাঁদের ওখানকার বিষয়—সম্পত্তি সব বেঁচে দিয়ে এখানে আসতে। যে দু’তিন মাস দেরি হবে সেই ক’দিন যেন আমি ও বাড়িতে দখল নিয়ে থাকি। অর্থাৎ প্রায় পরিত্যক্ত বাড়িটা ঝাঁটপাট দিয়ে, ঝুল ঝেড়ে, কুঠো জ্বালিয়ে সাপক্ষোপ তাড়িয়ে আমি যেন বাড়িটা বাসপোযোগী করে রাখি। অর্থাৎ অনেক দিনের অব্যবহৃত বাড়িতে থাকতে গিয়ে যদি বিপদ—আপদ কিছু হয় তাহলে তা যেন আমার ওপর দিয়েই যায় এই আর কি।
সত্যি কথা কি ওই শংকরের ভরসাতেই আমি এ বাড়িতে একা থাকতে এলাম।
আমাকে দেখে শংকর খুশি না হলেও আমার কিন্তু ছেলেটাকে ভালোই লেগেছিল। বেপরোয়া সরল সহজ ছেলেটা। দু’চোখে বুদ্ধি আর সাহস যেন ফুটে বেরোচ্ছে। সে যখন জানল বাড়িটার মালিক হয়ে আমি এসেছি তখন থেকে এড়িয়ে থাকতে শুরু করল।
আমিই ওকে কাছে ডেকে এনে বললাম—আমার সঙ্গে কথা বলছ না কেন?
শংকর একটু চুপ করে থেকে বলল—আপনিই তা হলে বাড়িটা কিনলেন? কবে আমাকে উঠে যেতে হবে বলুন।
মনে মনে ভাবলাম—ও, এইজন্যেই রাগ?
বললাম—বাড়ি আমি কিনিনি। কিনেছে আমার এক আত্মীয়। আমি শুধু যোগাযোগ করে দিয়েছি। আপাতত ওরা না আসা পর্যন্ত আমি থাকব।
—সে কত দিন?
বললাম—তা মাস দুই তো বটেই।
শংকর যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল—তা হলে আরও দু’মাস আমি এখানে থাকতে পারব?
বললাম—স্বচ্ছন্দে। তুমি না থাকলে এই জঙ্গলের মধ্যে আমি কখনও একা থাকতে পারি?
শংকর যেন খুশি হল। নিজের মনেই বলল—যাক দু’মাসের মধ্যে নতুন জায়গা খুঁজে নিতে পারব। বলে দোতলার চাবিটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল।
আমি সেটা লুফে নিয়ে বললাম—নতুন জায়গা খুঁজে নেবে মানে? পিসেমশাই—এর কাছে ফিরে যাবে না?
শংসর তার একমাথা ঝাঁকড়া চুল প্রবলভাবে নেড়ে বলল—কখনোই না।
বললাম—কেন?
—সে আপনি বুঝবেন না। মা—বাপ হারা ছেলেকে যখন বাধ্য হয়ে কোনো আত্মীয়ের দয়ার ওপর থাকতে হয় তখন তার যে কী কষ্ট—
এই জঙ্গলে সাপখোপে ভরা ভয়ংকর জন্তু—জানোয়ারের মধ্যে আমাকে পাঠাবার উদ্দেশ্য তো আমাকে মেরে ফেলা। কিন্তু পারেনি।
বলে শংকর একটু থামল। দেখলাম ওর চোখে যেন আগুন জ্বলছে।
তারপর ফেরে বলতে লাগল—এখানে থাকতে থাকতে চাষিদের সঙ্গে ভাব করে নিয়েছি। তাদের ছেলেরাই আমার বন্ধু। রাস্তার কুকুরগুলো সব আমার পোষা। এই কম্পাউন্ডের মধ্যে যত বেজি আছে সব নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়। সাপের ভয় থেকে বাঁচায়। কাজেই পিসেমশাই—এর কাছে আর ফিরে যাব না। শুধু দুঃখ দু’মাস পর এদের ছেড়ে যেতে হবে।
আমি এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম—তুমি তো কম্পাউন্ডের মধ্যে আলাদা একটা ঘরে থাকো। আমার আত্মীয়রা যখন আসবে তখন তাদের বলে দেব যাতে তোমায় কেউ তুলে না দেয়। তা ছাড়া তুমি থাকলে তাদের উপকারই হবে।
শংকর কোনো কথা বলল না। শুধু একবার তাকিয়েই চলে গেল। যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। এইভাবেই শংকরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
আমি বই লিখি। আত্মীয়ের অনুরোধে এখানে আমি মাস দুই থাকব। ইচ্ছে নিরিবিলিতে একটা উপন্যাস শেষ করে ফেলব।
সারা সকাল নিজের কাজ করি। নিজেই রাঁধি, চা করি। আর সন্ধের সময় মাঝে মাঝে শংকরের সঙ্গে গল্প করি। একটা জিনিস লক্ষ করছি ও যেন খুব বেশি আমার সঙ্গে মিশতে চায় না। দোতলায় ওঠে না বললেই হয়। ও যেন আমাকে ‘মালিক’দেরই একজন বলে মনে করে। ঠিক নিজের লোক মনে করে মিশতে পারে না।
একদিন আমি সন্ধের পর নীচে নেমে নিজে থেকেই শংকরের সঙ্গে গল্প করলাম। সেই যে শুনেছিলাম ও নাকি এখানে মাঝে মাঝেই কোনো অচেনা জন্তুর অদ্ভুত ডাক শুনতে পায়; সেই জন্তুর পায়ের ছাপও দেখেছে, ক্ষতবিক্ষত গোরুর মৃতদেহও চোখে পড়েছে—এসব কি সত্যি? শংকরকে জিজ্ঞেস করব করব করেও সে কথা জিজ্ঞেস করতে পারিনি। কেননা কথাগুলো যার কাছ থেকে শুনেছিলাম, এখন জানলাম সেই পিসেমশাই—এর ওপর শংকরের কোনো শ্রদ্ধাই নেই।
তবু একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—শংকর, এখানে তো দেখি চারিদিকেই বন। এখানে কি তেমন কোনো ভয় আছে?
ও কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে যেন আমাকে বোঝবার চেষ্টা করল। তারপর শান্তগলায় বলল—বেশ কিছুদিন তো হল আপনি এখানে রয়েছেন। ভয়ের কিছু দেখেছেন?
বললাম—না।
—তা হলে শুধু শুধু ভয়ের কথা ভাবছেন কেন?
বললাম—সত্যি ভয় পেলে তোমার ভরসাতেও আমি কখনও এখানে আসতাম না। তবে কলকাতায় শুনেছি বনগাঁর এই জায়গায় আগে ইছামতী পার হয়ে ডাকাত আসত দলে দলে। কতজনের বডি পাওয়া গিয়েছিল এখানকার জমির তলায়। তাই এখানে নাকি অপদেবতার ভয় আছে।
শংকর হাসল একটু। বলল—ভালো ভাষায় ‘অপদেবতা’ বলছেন কেন? বলুন ভূত। ভূতেদের এই একটা মস্ত গুণ তাদের ভূত বললে তারা রাগ করে না। না দাদা, আমি তো এতদিন এই বাড়িতে একা আছি। ও জিনিসটি একদিনের তরেও দেখতে পাইনি।
তবে—
শংকর হঠাৎ থেমে গেল।
ব্যস্ত আগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম—তবে?
শংকর গম্ভীর গলায় বলল—তবে মানুষের জানার বাইরেও অনেক কিছু থাকে। জোর করে কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না।
বললাম—প্রথম দিকে একদিন গভীর রাতে কুকুরের ডাকে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল কোনো অচেনা জীবকে—মানুষও হতে পারে—কুকুরগুলো তাড়িয়ে নিয়ে আসছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এল না। থেমে গেল। তবু ডেকে যাচ্ছিল। শেষে তোমার ধমক খেয়ে চুপ করল। শংকর, সত্যিই কি কুকুরগুলো কিছু দেখেছিল? যদি দেখেই থাকে তা হলে হঠাৎ থেমে গেল কেন?
শংকর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু ভাবল। তারপর বলল—ওটা অবশ্য ভাববার কারণ। নতুন এসেছেন—লোকে জানে আপনিই বাড়ি কিনেছেন—বাড়ির মালিক। কাজেই হয়তো— যাক ও ভেবে লাভ নেই। আমি তো আছি।
শংকর বলল বটে—ভেবে লাভ নেই। কিন্তু নতুন করে চোর—ডাকাতের ভয়টা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।…..
তারপর একদিন—
আমি দোতলায় শুই।
অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল। বাগানের দিকের জানলাটা বাইরে থেকে যে যেন খোলবার চেষ্টা করছে। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, মশারির মধ্যে বিছানায় উঠে বসলাম। দেখলাম জানলাটা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে—আমি যেই টর্চ জ্বাললাম, সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলাম। একটা কালো লোমশ হাত চওড়া থাবা তুলে মশারিটা ধরবার চেষ্টা করছে।
আমি প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলাম—শংকর—
সঙ্গে সঙ্গে নীচে শংকরের ঘরের দরজা খুলে গেল। সেও অন্ধকারের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠল—কী হয়েছে দাদা?
তারপরেই ধুপ করে শব্দ। যেন খুব ভারী কোনো জিনিস ওপর থেকে নীচে পড়ে গেল।
শংকরের গলা পেয়ে আমারও সাহস হল। দরজা খুলে তরতর করে নীচে নেমে গেলাম। ততক্ষণে শংকর হাতে বন্দুকটা নিয়ে অন্ধকারেই বাগানের মধ্যে দিয়ে ছুটছে। কিন্তু কার পিছনে ছুটছে তা বোঝা গেল না। আমি অন্ধকারেই একা দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর দু’বার গুলির শব্দ হল। বোঝা গেল শংকর এমন কিছু দেখেছে যে গুলি ছুঁড়তে হয়েছে।
সেই অন্ধকারে বড়ো বড়ো গাছের নীচে মশার কামড় খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। শংকরের ফেরার নাম নেই। আশ্চর্য—জানলা দিয়ে ওইরকম একটা হাত স্ব—চক্ষে দেখা সত্ত্বেও এভাবে এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকাটা যে ঠিক নয়, এ বুদ্ধিটুকুও যেন লোপ পেয়েছে।
দেখতে দেখতে দেড় ঘণ্টা হয়ে গেল। শংকর ফিরল না। কোথায় কত দূরে গেল? একটা চোর ধরবার জন্যে এই রাত্তিরে একা এত ছোটাছুটি করার দরকারই বা কী? তা ছাড়া চোর তো কিছু নিতেও পারেনি।
দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে বাকি রাতটুকু বাগানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাটল। শেষে ভোরবেলা উষ্কোখুষ্কো চুল, লাল টকটকে চোখ আর ধুলোভরা পা নিয়ে কখন যেন উদভ্রান্তের মতো শংকর ফিরল।
বন্দুকটা পাশে রেখে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে হতাশার সুরে বলল—নাঃ কিছুতেই ধরতে পারলাম না। যতই কাছে যাই ততই অন্ধকারে হারিয়ে যায়। একা তো। সঙ্গে কেউ থাকলে বাছাধনকে ঠিক ধরে ফেলতাম।
—কতদূর গিয়েছিলে?
—ও—সাঁকো পেরিয়ে।
চমকে উঠলাম—বল কী! অত দূর?
—হ্যাঁ। খুব ঘুরিয়েছে, শালা। অন্য কেউ হলে জান ফেটে মরে যেত।
বললাম—তুমি তো দু’বার গুলিও ছুড়েছিলে?
শংকর হতাশ সুরে বলল—ছুড়েছিলাম তো। কিন্তু লাগল কই? ভয়ও পেল না এতটুকু। শুধু দৌড়তে লাগল। সে কী দৌড়!
বলতে বলতে হঠাৎ শংকর কীরকম হয়ে গেল। গলার স্বর বসে এল। দু’চোখ বড়ো হয়ে উঠল। আমি ওকে দু’হাত দিয়ে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে ডাকলাম—শংকর! শংকর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল লোকটা—লোকটা দোতলার জানলায় উঠল কী করে ভেবেছেন কী?
২০০৩, সাহানা শারদীয়া
—