তারাও আসে
এইরকম একটা বীভৎস দৃশ্য দেখতে আসার ইচ্ছে আমার মোটেও ছিল না। এলাম শুধু আমার বন্ধু পশুপতির একান্ত অনুরোধে।
থানার ও. সি. রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে আমার বেশ আলাপ ছিল। ওঁকে বললাম, ”আমার এক বন্ধুর খুব ইচ্ছে ডেডবডিটা একবার দ্যাখে। আপনার আপত্তি না থাকলে ওঁকে নিয়ে আপনার সঙ্গে যাই।”
রামেন্দুবাবু চোখ ছোট করে হেসে বললেন, ”ওইরকম একটা বাজে লোকের ডেডবডি দেখতে কারও ইচ্ছে করে!”
বললাম, ”আসলে আমার বন্ধুটি ওইসব নিয়ে অল্পস্বল্প চর্চা করে কিনা! সাধুজিকে ও চিনত।”
”তার মানে আপনার বন্ধুও ওইসব প্রেতচর্চা করেন?”
”হ্যাঁ, ওটা ওর এক ধরনের শখ আর কী!”
”বেশ, নিয়ে আসুন। আধঘণ্টার মধ্যে আমরা স্টার্ট করব।”
পশুপতি, যাকে বলে নিপাট ভালোমানুষ, তাই। বিয়ে—থাও করেনি। আত্মীয় বলতেও তেমন কেউ নেই। শহরের একটেরে একটা পুরোনো দোতলা বাড়ির নীচের তলায় থাকে। দোতলায় থাকে ভাড়াটে। বাড়িটা তার পিসিমার। পিসিমার কাছেই ও মানুষ হয়েছে। পিসিমার মৃত্যুর পর তাঁর মোটারকম সম্পত্তি পেয়েছে বটে, কিন্তু পিসিমার অভাবটা সে মর্মে মর্মে বোঝে। বাস্তব জীবনের কোনও অভিজ্ঞতাই তার নেই। এতদিন যা কিছু তার দরকার, সব পিসিমাই করে দিতেন। আজ পিসিমার অভাবে সে লক্ষ্মীছাড়া না হলেও ছন্নছাড়া। ভাগ্যিস দোতলায় ভাড়াটে ছিল। তাই দরকারে সাহায্য পেয়ে বেঁচে যায়।
বেঁটেখাটো মানুষটি। ছোট করে কাটা চুল। মোটা—মোটা আঙুলে চার—চারটে পাথর বসানো আংটি ঝলমল করে। পরনে আধময়লা ধুতি আর গায়ে ফতুয়া। ফতুয়ার পকেট দুটো অস্বাভাবিক বড়। আর সেই পকেট দুটোয় থাকে নানা রকমের ‘স্টোন’, লোহার একটুকরো পাত, একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস, একটা ছোট পেন্সিল আর একটা নোট বই। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে সে সামান্য মাইনেয় কাজ করে। এমন চাকরি না করলেও তার কিছু এসে যেত না। তবু যে সে করে, সেটা ওর পিসির আদেশ পালনের জন্যই। তিনি বলতেন, ”চাকরি কখনও ছাড়বে না বাবা। স্বোপার্জিত অর্থের সম্মানই আলাদা, তা টাকার অঙ্ক যাই হোক না কেন।”
আর পিসিমা ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সাড়ে ন’টায় অফিস রওনা করিয়ে দিতেন বলে আজও সে ঠিক সাড়ে ন’টায় পান চিবোতে—চিবোতে, পায়ে রবারের জুতো আর মাথায় ছাতা দিয়ে হেঁটে—হেঁটে অফিস যায়।
হেঁটে—হেঁটেই যায়, কেননা পিসিমা তাকে যথাসম্ভব ট্রামে—বাসে চড়তে নিষেধ করেছিলেন।
অফিসে প্রায়ই পাঁচজনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ”পশুপতিদা আমার হাতটা দেখে দিন।”
পশুপতি কাউকে ফেরায় না। পকেট থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা বের করে এক—একজনের হাত দেখে। মাঝে—মাঝে নোটবইটা বের করে কীসব অঙ্ক কষে বিধান দেয়।
হাত—দেখা, গ্রহ—নক্ষত্রের অবস্থান গণনা করা ছাড়া তার আর একটা শখ প্ল্যানচেট করা। এই শখটা ওর বেড়েছে পিসিমার মৃত্যুর পর। হরতনের মতো কাঠের প্ল্যানচেট নয়। ও প্ল্যানচেট করে কাপ দিয়ে। মেঝেতে চকখড়ি দিয়ে একটা বড় বৃত্ত আঁকে। বৃত্তের গায়ে A থেকে Z পর্যন্ত লেটারগুলো লেখা। বড় বৃত্তের মধ্যে একটা ছোট বৃত্ত। সেখানে বেশ পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন চা খাওয়ার একটা কাপ উলটো করে বসিয়ে তার ওপর আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে পরলোকগত অতিপরিচিত কোনও আত্মাকে স্মরণ করে। ঘরে তখন জ্বালিয়ে দেয় হালকা নীল আলো। কাছেই জ্বলে ধূপ। টুঁ শব্দটি নেই। একটু পরেই কাপটা নড়ে ওঠে। পশুপতি গলা খাটো করে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ”কে? পিসিমা?”
উত্তরে কাপটা আঙুলসুদ্ধু চলে যায় প্রথম ‘Y’—এর কাছে, তারপর E—র কাছে তারপর ‘S’। অর্থাৎ ‘YES’।
অথচ শুনেছি পিসিমা ইংরেজি লেখাপড়ার বিন্দুবিসর্গও জানেন না।
যাই হোক, এইভাবে পশুপতি প্রায়ই নির্জন ঘরে বসে রাতের বেলায় পিসিমাকে ডাকত। আর প্রশ্ন করে—করে উত্তর জেনে নিত। যেমন, কখনও জ্বর হলে জিজ্ঞেস করত, ”কোন ডাক্তারকে দেখাব? কী খাব?” কিংবা ”অফিসের অনেকেই বেশ কিছু টাকা ডবল করার জন্য ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ করে। আমিও করব কি?”
প্রশ্ন করার দু’মিনিট পরেই কাপটা আঙুল সমেত প্রথমে চলে যায় ‘Y’—এর কাছে, তারপর ‘E’—র কাছে, তারপর ‘S’। পশুপতি নিশ্চিন্ত মনে ১০ হাজার টাকা জমা করে দেয়।
একদিন পিসিমাকে ডেকে বলল, ”একজন তান্ত্রিক গোছের সন্ন্যাসী এসেছেন। আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। উনি প্রতি শনিবার ওঁর কাছে যেতে বলেছেন। সন্ন্যাসীকে দেখলে ভয় করে। নামকরা সাধু। ওঁর কাছে যাব কি?”
উত্তর পাওয়ার আগেই নাকি লোডশেডিং হয়ে যায়। তারপর পিসিমাকে আর ডাকা হয়নি।
এসব কথাই পশুপতি আমাকে অকপটে বলে। আমার মতো বিশ্বস্ত বন্ধু ওর আর নেই। বলা বাহুল্য, আমার এই আধপাগলা বন্ধুটির কাজকর্ম, কথাবার্তা বেশ উপভোগ করি।
ওর মুখেই সাধুর খবর শুনলাম। কোথা থেকে যেন এই অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন সাধুটি এসেছেন। শহরের বাইরে আস্তানা গেড়েছেন। নাম শঙ্করানন্দ। মাঝে—মাঝে বিশেষ দিনে গভীর রাতে সাধুজির কাছে, কিছু লোক আসেন। ভদ্রলোকই বলা যায়। গভীর রাতে সাধুজি নাকি প্রেত নামান। যাঁরা সেখানে যান তাঁদের প্রত্যেকের তিনটি করে প্রশ্নের উত্তর কোনও অশরীরী আত্মার কাছ থেকে পাওয়া যায়। আমার বন্ধুটিও প্রায়ই এই প্রেত নামানো চক্রে যোগ দেয়। ওর মুখেই শুনেছি, রাত দুটোর পর নির্দিষ্ট সময়ে একটা ছায়া—ছায়া মূর্তি ঘরের দেওয়ালে ভেসে ওঠে। তাকে যা প্রশ্ন করা হয় তার উত্তর সঠিক পাওয়া যায় সমাধিস্থ সাধুজির গলা থেকে।
সাধুজির ক্রিয়াকলাপে পশুপতির আগ্রহী হওয়ার প্রধান কারণ, প্রথম যেদিন সে অনাহূত গিয়েছিল তখন ধ্যানস্থ সাধুজি নাকি চোখ বুজেই তার নাম ধরে ডেকেছিলেন, ”এসো পশুপতি, তোমার অপেক্ষাতেই আছি।”
পশুপতি তো শিউরে উঠেছিল। আশ্চর্য! সাধুজি তার নাম জানলেন কী করে! শুধু নাম জানাই নয়, তার অপেক্ষাতেই আছেন! সাধুজি শুধু বাংলাতেই নয়, কাউকে হিন্দিতে, কাউকে ইংরেজিতেও সম্বোধন করেন।
তারপর থেকেই সাধুজির কাছে পশুপতির যাওয়া—আসা। কথায়—কথায় পশুপতি তাঁকে জানিয়েছিল, তার প্ল্যানচেট করার কথা। শুনে সাধুজি খুব খুশি হয়েছিলেন। পরে নাকি বলেছিলেন, তিনিও প্ল্যানচেট করবেন। তাঁর কাছে দারুণ একটা জিনিস আছে। সেটা শুধু পশুপতিকেই দেখাবেন।
শুনে পশুপতি আনন্দে, আবেগে একেবারে রোমাঞ্চিত হয়েছিল। কিন্তু পশুপতির দুর্ভাগ্য, তার এই ‘অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন’ সাধুজি—গত রাতে রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। রাতে কেউ কেউ নাকি দূর থেকে তাঁর মর্মান্তিক আর্তনাদ মাত্র একবার শুনতে পেয়েছিল। সকালবেলায় এসে দেখে দরজা খোলা। আর সাধুজি দরজার ওপর মরে পড়ে আছেন।
পুলিশ অবশ্য অনেক আগে থেকেই সাধুজির ওপর নজর রেখেছিল। তাদের মতে, সাধুজি এক নম্বরের ভণ্ড। কোনও বিশেষ মতলবে এখানে ডেরা বেঁধেছেন। তবে এখনও তেমন প্রমাণ পায়নি। প্রমাণ পেলেই হাজতে ঢোকাবে।
যাই হোক, আমরা যখন জিপ থেকে নামলাম তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে মাঠের শেষে একটা টালির ঘরে সাধুজির ডেরা। জায়গাটা নির্জন। লোকবসতি কম। পেছনে গভীর জঙ্গল।
ঘরের সামনে কিছু লোকের ভিড়। সবার চোখে—মুখে ভয়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল একজন কনস্টেবল।
ভেতরে ঢুকলাম। একখানি মাত্র ঘর। ঘরে কোনও আসবাবপত্র নেই। একটা বাঘছাল মেঝেতে পাতা। একটা কমণ্ডলু। গোটা পাঁচেক মড়ার খুলি। একটা বিরাট ত্রিশূল। ঘরের মাঝখানে কিছু পোড়া কাঠ। বোধ হয় হোমটোম কিছু করা হয়েছিল। পেছনে একটা দরজা। দরজাটা জঙ্গলের দিকে যাওয়ার। সেই দরজাটার ওপর পড়ে ছিল শঙ্করানন্দের বিশাল দেহ।
”দেখেছ পশুপতি, কী ভয়ংকর!” ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। কিন্তু পশুপতি তখন পাশে ছিল না। ঘরে সবাই যখন মৃতদেহ নিয়ে ব্যস্ত, ও তখন ঘরের অন্যদিকে কিছু যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অথচ সাধুজির মৃতদেহটি শেষবারের মতো দেখবার জন্যই নাকি তার আসা।
ও. সি. দেহটা হাতের বেঁটে লাঠি দিয়ে এদিক—ওদিক করে দেখে কিছু নোট করে নিলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, ”কী মনে হয়? মার্ডার কেস?”
ও. সি. একটা সিগারেট ধরিয়ে হালকাভাবেই বললেন, ”কে কীসের স্বার্থে মার্ডার করবে বলুন! মার্ডার করার পেছনে তো একটা মোটিভ থাকবে।”
”কিন্তু…”
”হয়তো প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল, বেরোতে যাচ্ছিল, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মরেছে। পোস্টমর্টেম করলেই বোঝা যাবে।” এই বলে কনস্টেবলদের মৃতদেহ গাড়িতে তুলে দিতে আদেশ করলেন।
ইচ্ছে করেই আমি আর কথা বাড়াইনি। কী দরকার?
ফেরার পথে রামেন্দুবাবু শহরের মুখে আমাদের নামিয়ে দিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলেন। আমরা একটা রিকশা নিয়ে নিলাম।
পশুপতিকে এতই গম্ভীর মনে হচ্ছিল যে, অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলতে পারলাম না। বুঝতে পারছিলাম সাধুজির এই হঠাৎ মৃত্যুতে ও খুব কষ্ট পেয়েছে।
একটু পরে বললাম, ”মনটা তোমার খুব খারাপ হয়ে গেছে, না?”
ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ”হ্যাঁ, তা তো স্বাভাবিক। ওঁর কাছে যেতাম। ওঁর স্নেহ পেয়েছিলাম। উনি আমায় অনেক গোপন কথাও বলেছেন। আর কিছুদিন ওঁকে পেলে আমিও অলৌকিক কিছু করতে পারতাম।”
রিকশাটা একটা ঝাঁকানি দিয়ে মোড় ফিরল। বললাম, ”সাধুজির মৃত্যুটা তোমার কীরকম মনে হয়?”
ও চট করে উত্তর দিল না। একটু ভেবে পালটা প্রশ্ন করল, ”তোমার কী মনে হয়?”
বললাম, ”ও. সি. তো বললেন প্রেশারে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে…”
বাধা দিয়ে পশুপতি বলল, ”ও. সি. তো কোনও গুরুত্বই দিলেন না। যা বললেন তা তো ওঁর অনুমান ছাড়া আর কিছু নয়।”
একটু থেমে বলল, ”স্বাভাবিক বা স্ট্রোকে মৃত্যু হলে কি কারও চোখ অমনভাবে ঠেলে বেরিয়ে আসে?”
বললাম, ”সে—কথা আমারও মনে হয়েছে।”
”তারপর খেয়াল করেছিলে বোধ হয় লোকগুলো বলছিল গভীর রাত্তিরে সাধুজির আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল।”
”হ্যাঁ, একবার।”
”হ্যাঁ, একবারই। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার চিৎকার করার সময়টুকুও পাননি।”
একটু থেমে ভাঙা—ভাঙা গলায় পশুপতি বলল, ”সাধুজির পাথরের মতো শরীরটা তো দেখলে। তা ছাড়া আমি বিশ্বাস করি, ঐশ্বরিক শক্তিতেও তিনি শক্তিমান। সেই মানুষ যদি সত্যিই আর্তনাদ করে থাকেন তা হলে বুঝে দ্যাখো কত না জানি ভয় পেয়েছিলেন।”
আমি রিকশাওয়ালার কান বাঁচিয়ে বললাম, ”তা হলে কি তুমি মনে করো এটা খুন?”
পশুপতি বিজ্ঞের মতো ঠোঁটের ফাঁকে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল, ”সেটাই তো রহস্য। অবশ্য আমি কিছু একটা অনুমান করতে পারি। তবে তা মাননীয় ও. সি. মহাশয়ের অনুমানের মতো নয়। আমার অনুমান, আমি জানি, একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক। কিন্তু সে—কথা বলা যাবে না। লোকে পাগল বলবে।”
মনে—মনে বললাম, ‘ঠিক কথাই। কেননা তুমি নিজেই তো একটা পাগল। কাজেই প্রলাপ ছাড়া তুমি আর কী বলবে!’
আমি আর ও—প্রসঙ্গে না গিয়ে বললাম, ”তা তুমি সারা ঘরে কী খুঁজে বেড়াচ্ছিলে?”
ও অমনই চটলজদি জবাব দিল, ”যা পাওয়ার জন্য আমি এখানে এসেছিলাম।”
”পাওয়ার জন্য?”
”হ্যাঁ, পাওয়ার জন্য। খুবই সামান্য জিনিস।”
বলে পশুপতি সিট থেকে একটু উঠে দাঁড়িয়ে ফতুয়ার সেই বিরাট পকেট থেকে জিনিসটি অতি গোপনে বের করে দেখাল।
”এটা আবার কী?”
”দেখতেই পাচ্ছ।”
হ্যাঁ, দেখতে তো পাচ্ছিলাম। একটা চায়ের কাপ। তবে সাধারণত যেমন সাদা কাপ হয়, সেরকম নয়। কুচকুচে কালো। তার গায়ে আবার একটা চোখ আঁকা। একটাই চোখ, কিন্তু কী ভয়ংকর সে চোখের চাউনি!
”এটা নিয়ে কী করবে?”
”কী করব তা জানি না। তবে সাধুজি আমায় বলেছিলেন এটা নাকি দারুণ শক্তিশালী মিডিয়াম। নির্জন ঘরে একা বসে এক মিনিট আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে থাকলেই একজন পাগলা সাহেবের ভর হয়। যা জানতে চাইবে তার উত্তর পাবে। মাঝে—মাঝে সে নিজে থেকেই কিছু উপদেশ, নির্দেশ দিতে পারে। এই কাপের সাহায্যে অসাধ্য সাধন করা যাবে। তবে মাসে মাত্র একদিন, অমাবস্যার রাতে।”
বলতে—বলতে পশুপতির গলা উত্তেজনায় কেঁপে উঠল।
একটু সামালে নিয়ে বলল, ”সাধুজি সম্প্রতি তিব্বত গিয়েছিলেন। সেখানে এক বৃদ্ধ লামার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। কাপটা সেই লামার।”
”লামার কাছ থেকে সাধু কাপটা পেলেন কী করে?”
”সাধুজিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি হেসে বলেছিলেন, ইচ্ছের জোরে।”
”ইচ্ছের জোরে!”
”হ্যাঁ, ব্যস, ওইটুকু কথা। বাকিটা বুঝে নাও।”
বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ইচ্ছে পূর্ণ করার জন্যে মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে। দুর্বল বৃদ্ধ লামা কি আর ওই দুর্দান্ত সাধুজির জোর সহ্য করতে পেরেছিলেন?
”কিন্তু সাধুজি বোধ হয় ওটা এতদিন ব্যবহার করতে পারেননি। ওটা ব্যবহার করেছিলেন কাল। অমাবস্যার আগেই। আর তারই পরিণতি এই।” বলেই পশুপতি আমার হাত থেকে কাপটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে পকেটে পুরে রাখল।
”কিন্তু কাপটা নিয়ে এসে কি ভালো করলে?”
”কেন? খারাপ কী?”
বললাম ”দ্যাখো, ওসব যদিও আমি বিশ্বাস করি না, তবু সত্যিই যদি কাপটার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা থাকে তা হলে হয়তো বিপদ ঘটতে পারে।”
”কী বিপদ?”
”তুমি হয়তো সেই পাগলা সাহেবের শক্তিকে সামলাতে নাও পারতে পারো।”
পশুপতি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, ”না পারবার কী আছে? আমি তো নিয়মিত কাপ চালি।”
”সে—চালায় আর এ—চালায় তফাত আছে। তুমি কাপের মিডিয়ামে তোমার পরিচিত বিশেষ একজনকে ডাকো। আর এই কাপ সম্বন্ধে যা শুনলাম—না ডাকতেই এক পাগলা সাহেব ভর করে। দুটোয় তফাত আছে।”
পশুপতি গম্ভীরভাবে বলল, ”সে আমি ম্যানেজ করব।”
”তা ছাড়া সাধুজির জিনিস তাঁর অনুমতি ছাড়া নিয়ে আসা ঠিক হল না।”
পশুপতি দাঁতের ফাঁকে হেসে বলল, ”এরকম অলৌকিক জিনিস কেউ কাউকে দান করে না। কৌশলে নিতে হয়। তা ছাড়া এটা তো এখন বেওয়ারিশ জিনিস। তাই না?”
আমি আর কথা বাড়াইনি। আমার কেমন যেন মনে হল এইমাত্র যেসব কথা পশুপতির মুখ থেকে শুনলাম এ যেন আমার বন্ধু পশুপতি নয়, অন্য কেউ।
তিনদিন পর।
রাত তখন বারোটা হবে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ”কে?”
উত্তর পাওয়ার দরকার হল না। দেখি, পশুপতি, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম।
”কী ব্যাপার? এত রাতে?”
ও কোনওরকমে বলল, ”তুমি একবার এসো।” মুকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একেবারে ফ্যাকাসে।
”কী হয়েছে?”
”আমার কেমন ভয় করছে।”
রাস্তায় একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা সেটায় গিয়ে উঠলাম।
ট্যাক্সিতে উঠে ও বলল, ”রাত দশটা নাগাদ হঠাৎ আমার ইচ্ছে করল কালো কাপটা চেলে দেখি। যদিও—জানি অমাবস্যা ছাড়া ওটা চালা নিষেধ।
”খড়ি পেতে, ধূপ জ্বেলে কাপটা মাঝখানে বসালাম। তারপর আঙুল ঠেকাতে—না—ঠেকাতেই কাপটা ভীষণভাবে নড়ে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কে এসেছেন?’
”উত্তরে কাপটা লেটারগুলো ছুঁয়ে—ছুঁয়ে যে নামটা জানাল তা দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। আমি ভাই কিছুতেই বুঝতে পারছি না, না ডাকতেই শঙ্করানন্দ এলেন কেন?”
আমি সাহস দিয়ে বললাম, ”তাতে ভয় পাওয়ার কী আছে?”
পশুপতি বলল, ”আছে। তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। আমি তো কম দিন প্ল্যানচেট করছি না! এবার করতে গিয়ে বেশ অনুভব করতে পেরেছি একটা কিছু বিপদ ঘটতে চলেছে। তাই বাধ্য হয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। ঘরে একা থাকতে ভরসা পাচ্ছি না।”
ওর বাড়ির সামনে এসে ট্যাক্সি থেকে নামলাম। বেচারি দরজায় তালা লাগাবারও সময় পায়নি। কোনওরকমে শেকল তুলে চলে এসেছে।
কিন্তু ভয় পাওয়ার কী আছে তা বুঝতে পারলাম না!
ঘরে ঢুকে দেখি হালকা নীল আলো জ্বলছে।
মেঝেতে সেই পরিচিত দৃশ্য। খড়ি দিয়ে বড় বৃত্ত আঁকা। বৃত্তের গায়ে A থেকে Z পর্যন্ত বর্ণমালা। আর কালো কাপটা কাত হয়ে পড়ে আছে।
”এটা এরকম ভাবে কেন? এটা তো উপুড় হয়ে থাকবে।”
পশুপতি বলল, ”উপুড় করা অবস্থাতেই ফেলে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি…”
দেখার আর কিছু ছিল। কালো কাপের গায়ে সেই ভয়ংকর চোখটা যেন রাগে জ্বলছিল। অদ্ভুত ব্যাপার।
সাহস দিয়ে বললাম, ”বোধ হয় জোর বাতাসে উলটে গেছে।”
মুখে বললেও মনে—মনে জানি অত বড় আর ভারী কাপ ঝড়েও ওলটাবে না।
”কী করা যায় বলো তো?”
বললাম, ”একবার আমার সামনে চালো তো। দেখি।”
পশুপতি বোধ হয় এইটেই চাইছিল।
”জানি না আর কারও সামনে আত্মা আসবে কি না। তবু দেখি।”
বলে কাপটা ছোট বৃত্তের ওপর ঠিক করে বসিয়ে ডান হাতের তর্জনীটা ছোঁয়াল।
অবাক কাণ্ড! আঙুল ছোঁয়ানো মাত্র কাপটা বৃত্তের মধ্যে প্রচণ্ড বেগে ঘুরপাক খেতে লাগল।
পশুপতি বিহ্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।
আমি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম, ”জিজ্ঞেস করো আপনি কে এসেছেন?”
এটা যে জিজ্ঞেস করতে হয়, পশুপতি এতই নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল, সেটুকুও ভুলে গিয়েছিল।
কিন্তু ও জিজ্ঞেস করার আইে কাপটা যেন ওর হাতসুদ্ধ টেনে নিয়ে প্রথমে ‘I’ অক্ষর ছুঁয়ে চলে গেল ‘K’ অক্ষরের কাছে; সেখান থেকে ফের ‘I’ অক্ষরের কাছে, সেখান থেকে মেঝেতে খসখস শব্দ করে প্রথমে ‘L’—ফের ‘L’—তারপর ‘Y’—
গ্রামারের সামান্য ভুল থাকলেও অশরীরীর বক্তব্যটা বুঝতে পশুপতির বাকি থাকেনি। ভয়ে কাপ ছেড়ে দিয়ে ও লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাপটাও অমনই আপনাআপনি কাত হয়ে পড়ে রইল।
”স্বচক্ষেই তো দেখলে ভাই। এখন কী করি? কে এসে শাসিয়ে গেল তাও বুঝতে পারলাম না।”
বললাম, ”তখনই বলেছিলাম ওটা সাধুর জিনিস। ওভাবে ওটা আনা ঠিক হয়নি। যাই হোক আমি ব্যবস্থা করছি।”
বলে পশুপতির উত্তরের অপেক্ষা না করে কাপটা কাগজে মুড়ে খিড়কি দরজা খুলে বাড়ির পেছনের ঝোপের মধ্যে ফেলে দিলাম।
পশুপতি আর্তনাদ করে উঠল, ”ইস, ওইভাবে ওটা ফেলে দিলে! ওটা যে মন্ত্রপূত…”
”নিকুচি করেছে তোমার মন্ত্রের। ওটা থাকলে তুমি আবার ওটা নিয়ে বসবে। আর ভয়ে হার্টফেল করে মরবে।”
মরার কথা শুনে পশুপতি বুঝি একটু শান্ত হল।
সে—রাত্রে অবশ্য পশুপতির কাছেই আমায় থাকতে হয়েছিল। দুজনেরই ভালো ঘুম হয়েছিল। মাঝরাতে শুধু একবার ব্যাঘাত হয়েছিল। হঠাৎ পশুপতি আমায় ধাক্কা দিয়ে চাপা আতঙ্কে বলেছিল, ”খিড়কির দরজা কে ঠেলছে।”
”ঠেলুক।” বলে পাশ ফিরে শুয়েছিলাম। তারপর এক ঘুমে রাত শেষ।
ক্যালেন্ডারে চোখ পড়তেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। আজ অমাবস্যা। পশুপতি আজ আবার সেই কাপটা নিয়ে চালতে বসবে না তো?
কাপটা অবশ্য আমি ফেলে দিয়ে এসেছি। কিন্তু সেটা কুড়িয়ে আনতে কতক্ষণ? এসব কাজে আবার সর্বনেশে আকর্ষণ থাকে। সে আকর্ষণ দুর্বল প্রকৃতির মানুষ সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে না।
যাই হোক, একবার খোঁজ নিয়ে আসতে দোষ কী?
এই মনে করে তখনই বেরিয়ে পড়লাম।
রাত তখন এগারোটা। ওদের পাড়াটা নিঝুম। শুধু গলির মুখে রাস্তার আলোটা যেন ভয়ে—ভয়ে কোনওরকমে তার কর্তব্য করে যাচ্ছে।
ওর বাড়ির সামনে এসে জানলার দিকে তাকাতেই দেখলাম, ঘরে হালকা আলো জ্বলছে। তা হলে পশুপতি আজও বসেছে।
দরজায় শব্দ করতে যেতেই দেখি দরজা খোলা। অবাক হলাম। দরজা খোলা কেন? এই বাড়িটার দোতলাতেও লোক আছে। কিন্তু দরজা বন্ধ করার দায়িত্ব পশুপতির।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। দোতলার সিঁড়ির মুখ অন্ধকার। পাশেই পশুপতির ঘর।
”এ কী! এ দরজাটাও খোলা।”
দরজা খুলে রেখেই পশুপতি কি কোথাও গেছে? আবার কি ও ভয় পেয়েছে?
ঘরে ঢুকে থমকে গেলাম। দেখি মাটিতে সেইভাবেই খড়ি পাতা। আর খালি গায়ে পশুপতি মেঝেতে পড়ে আছে। মুখটা বীভৎস।
তখনই দোতলার ভাড়াটেদের সাহায্যে পশুপতিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সারারাত যমে—মানুষে টানাটানি করে শেষ পর্যন্ত ডাক্তার ভরসা দিলেন, ”ভয় নেই।”
যাক, অন্তত আমার সৌভাগ্য, ঠিক সময়ে আসতে পেরেছিলাম বলেই বন্ধুকে বাঁচাতে পেরেছি। ডাক্তারের মতে হাই ব্লাডপ্রেশারের জন্যই এইরকম হয়েছে।
কিন্তু সুস্থ হয়ে পশুপতি যা বলেছিল তা অন্য কথা।
সাধুজির ওই কাপটার ওপর লোভ সে সামলে উঠতে পারেনি। তা ছাড়া মন্ত্রপূত কাপটা পড়ে থাকবে আস্তাকুঁড়ে। এ যে মহাপাপ! তাই সে কাপটা কুড়িয়ে এনেছিল। তারপর আজ অমাবস্যা বলেই কাপটা নিয়ে বসেছিল।
বসামাত্র কাপটা প্রচণ্ড জোরে নড়ে উঠেছিল। এত জোরে যে, পশুপতির হাত পর্যন্ত কাঁপছিল। কে এসেছেন—এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সেই একই কথা জানিয়ে দিল, ‘‘I KILL YOU.’’
তারপর কাপটা আঙুলটা ঠেলে সরিয়ে মেঝেতে একটা বিদঘুটে শব্দ করতে—করতে এগিয়ে আসতে লাগল তার কাছে। সে উঠে দাঁড়াবার আগেই কাপটা তার পা বেয়ে উঠে পড়ল। একটা শুধু ঠান্ডা হিমশীতল স্পর্শ…তারপর…তারপর আর কিছু মনে নেই।
যাক, পশুপতি এ—যাত্রায় বেঁচে গেল। কিন্তু কাপটা?
কাপটা অদৃশ্য। সেটা যে কোথায় গেল, জানতে পারা যায়নি।
তারপর অনেকদিন পর্যন্ত দুটি দুর্ঘটনা আমায় ভাবিয়ে তুলেছিল। সাধুজির মৃত্যু আর পশুপতির মৃত্যুর মুখ থেকে কোনওরকমে ফিরে আসা—এ—দুটি ঘটনার পেছনে কোন অদৃশ্য শক্তির হাত? দুই অপরাধীকে কি শাস্তি দিয়ে গেল কাপটার দুই সময়ের দুই অধিকারী? পশুপতির অপরাধ তুলনামূলকভাবে কম বলেই কি ও শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেল?
এসব প্রশ্নের উত্তর আজ পর্যন্ত খুঁজে পাইনি।
প্রকাশকাল : অজ্ঞাত
—