বাদুড়ের ঠোঁটে রক্ত
পর্বত না হলেও পাহাড়। একটি—দুটি নয়, অনেকগুলি। কোড়ো, মশক, বিহারীনাথ, শুশুনিয়া। পাহাড়ের বয়েস নেই। কত বছর কত যুগ—যুগান্তর ধরে এইসব পাহাড় ঘিরে রয়েছে জায়গাটাকে। কত কালের কত রহস্য স্তব্ধ হয়ে আছে ওই পাথরের বুকে।
এই সব পাহাড়গুলোর মধ্যে শুশুনিয়া নানা কারণে বিশেষ পরিচিত। বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় সাতাশ কিলোমিটার দূরে শুশুনিয়া।
বাঁকুড়া—পুরুলিয়া বা বাঁকুড়া—কেঞ্জাকুড়া রুটের যে কোনো বাসে উঠে ছাতনা। ছাতনা থেকে ট্রেকার। দশ—বারো কিলোমিটার পিচঢালা রাস্তা। দু’ধারে চড়াই—উৎরাই, রুক্ষ পাথুরে জমি। এ—পাশে ও—পাশে, দূরে—কাছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের শাল—পিয়াশাল—পলাশ—মহুয়ার জঙ্গল।
তারপর শুশুনিয়া—পূর্ব—পশ্চিমে প্রায় তিন মাইল। অন্তত কুড়ি—পঁচিশ মাইল দূর থেকে দেখা যায়। কেমন যেন গা—ছমছম করা জঙ্গলে ঢাকা।
পাহাড়ের উত্তর—পূর্ব দিকে মাইল পঁচিশ দূরে পুষ্করণা গ্রাম। আজ গ্রাম, কিন্তু এককালে ছিল রাজা চন্দ্রবর্মার রাজধানী।
শুশুনিয়া থেকে পুষ্করণা বা পধরা ছায়াসুশীতল শান্ত জায়গা। এখানকার যারা অধিবাসী তারা সাধারণত খেটে খাওয়া মানুষ। প্রকৃতির মধ্যেই তারা লালিত। ঝগড়াঝাঁটি নেই—অশান্তি নেই—রোগব্যাধিও নেই বললেই হয়। একমাত্র ভয় জন্তুকে। কখন কোন অতর্কিত মুহূর্তে নেকড়ে কিংবা পাহাড়ি চিতি ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়বে তার ঠিক নেই। অথচ পাহাড়ে ওদের যেতেই হয়। পাহাড়ে ওঠাটা ওদের বেড়ানো নয়—রুজি—রোজগারের ধান্দা।
পাহাড়ে ওঠার আগে ওদের অনেকেই যায় গুণিনের কাছে। মন্ত্র পড়ে শিবু গুণিন লাল সুতো বেঁধে দেয় হাতে। ত্রিসীমানা ঘেঁষবে না।
ঘেঁষুক না ঘেঁষুক গুণিনের ওপর এদের আস্থা খুব। শুধু বাঘই নয়—ভূত প্রেত পিশাচ ডাইনির প্রকোপ এমনকি বান—বন্যা, খরা, ভূমিকম্পর মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকেও গ্রামকে বাঁচায় এই গুণিনরা।
পঞ্চখ্যাপা গুণিনের বয়েস প্রায় নব্বই হল। একসময়ে নামকরা গুণিন ছিল। ‘খ্যাপা ওঝা বলেও ডাকত লোকে। ভূতসিদ্ধ ওঝা। গ্রাম—গ্রামান্তর থেকে ডাক আসত তার।
এখনো লোকে তাকে চায়। কিন্তু বয়েসের ভারে নড়তে পারে না। বিপদে—আপদে লোকে ছুটে আসে তারই কাছে। হাজার হোক পাকা মাথা তো! পঞ্চ্যখ্যাপা আজ আর বড়ো একটা কোনো বিধান দেয় না। দু—হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে বসে শোনে।
শুধু সেদিনই পঞ্চা অনেক দিন পর গ্রামের সবাইকে ডেকে জানাল—বাঘের ভয়ের চেয়ে ঢের বেশি ভয় আসছে। কী সে ভয় তা বলা যাচ্ছে না, তবে ভয়ংকর নাকি সেই ভয়। ভয়ংকর—
ব্যস। এইটুকু সাবধানবাণী। আর কিছু নয়। সেই সঙ্গে শুধু বলল, পাহাড়ের পশ্চিম দিকের যে অংশটা ঘর থেকে দেখা যায় সেদিকের জানালাটা কোনোদিন সন্ধের পরে কেউ যেন না খোলে।
সবাই চমকে উঠল। কেন? কী আছে পাহাড়ের পশ্চিম দিকে?
শিবু গুণিনও ছুটে এল গুরুর কাছে জানবার জন্যে। কিন্তু উত্তর পেল না।
এর বেশ কিছুদিন পরের কথা।
বহু প্রাচীন কাল থেকেই এই শুশুনিয়া পাহাড়ে খাদান খোঁড়ার কাজ চলে আসছে। খাদা খোঁড়া হচ্ছে পাহাড়ের গা ফাটিয়ে বড়ো বড়ো গর্ত করা। এই সব গর্ত থেকে পাথর তুলে এনে শুশুনিয়া গ্রামে পাথরের জিনিসপত্র, মূর্তি প্রভৃতি তৈরি করা হয়। যেমন তৈরি হয় থালা—বাটি, শিল—নোড়া, জাঁতা, রুটিবেলার চাকি, মেঝের টালি, ঠাকুর—দেবতার মূর্তি প্রভৃতি।
এই পাথর কেটে দ্রব্য—সামগ্রী তৈরি করাই এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের একমাত্র জীবিকা। এ গ্রামে ঢুকলেই শোনা যায় এক নাগাড়ে ছেনি—বাটালির শব্দ—খুট—খাট—ঘটাং—ঘট—পাথর ছেনা হচ্ছে।
প্রায় চোদ্দোশো ফুট উঁচু শুশুনিয়া পাহাড়ের এই দিকটা—অর্থাৎ পশ্চিম দিকটা বেশ ঢালু। পায়ের আঙুলের ওপর আয়ত্ত থাকলে হুড়মুড়িয়ে নামা যায়। কিন্তু এই দিক দিয়ে ওঠা বড়ো কঠিন। তবু এই তল্লাটের ছেলে—ছোকরাদের উঠতে হত অন্য দিক দিয়ে গাছের শক্ত শেকড়—বাকড় ধরে। জোয়ানরা ওঠে শুকনো ডালপালা কুড়োতে কিংবা ছাগল চরাতে। প্রচুর ঘাস, ঝোপঝাপ, জঙ্গল। কেউ বা খাদানের কাছে ঘোরাঘুরি করে। টুকরো পাথর কুড়িয়ে ঝুলিতে ভরে। এই পাথর দিয়েই কত সুন্দর সুন্দর হাতের কাজ হয়।
আর ছোটোরা? তারা সকাল থেকেই পাহাড়ের ওপরে। পাহাড়েই তারা ঘুরে বেড়ায়। গুলতি দিয়ে পাখি মারে। ইট ছুড়ে ছুড়ে বাঁদর তাড়ায়, নিরীহ খরগোশও মারা পড়ে তাদের হাতে। কখনও চড়ে বসে গোরুর পিঠে।
খালি—গা, ছেঁড়া প্যান্ট—শীতকালে বড়ো জোর সুতির জামা আর ছেঁড়া চাদর। ছেলেরা শখের যুদ্ধ করে নিজেদের মধ্যে লুকোচুরি খেলে, ইট মেরে নোনা আতা পাড়ে। এইভাবেই এদের জীবন কাটে। বাড়ি ফিরতে দেরি হলেও ওদের বাবা—মা ভাবে না। যাবে আর কোথায়? পাহাড়ে খেলছে।
অথচ ভয়ের কারণ যে একেবারে নেই তা নয়। শিবু গুণিনের লাল সুতো হাতে বাঁধা থাকলেও পাহাড়ি চিতির হাত থেকে নিষ্কৃতি নাও পাওয়া যেতে পারে। নিঃশব্দে কখন হিংস্র নেকড়ে পিছন থেকে এসে একটা ছেলেকে মুখে করে তুলে নিয়ে যেতে পারে। কিছুই অসম্ভব নয়।
তবু ভরসা এমন ঘটনা বড়ো একটা ঘটে না।
তবে একদিন কিছু একটা ঘটল।—
বেলা পড়ে এসেছে। জোয়ান—মরদরা কাঠের বোঝা, পাথরের বস্তা মাথায় করে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। ছেলের দলও ফিরে এল। ফিরল না শুধু বুধু দাসের আর রামাই কর্মকারের ছেলে দূটো—গোপাল আর শংকরা।
কী হল তাদের? অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠল বুধু দাস আর রামাই কর্মকার। সেই সঙ্গে তাদের প্রতিবেশীরা।
গোপালদেব অন্য বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করা হল। তারা বলল—একটু দূরে ওরা দুজনে শাবল দিয়ে খাদান খোঁড়ার খেলা করছিল। তারপর কোথায় গেল জানে না তারা।
দুজনেই অন্তর্ধান করল?
তা ছাড়া কী!
বুধু—রামাই ছুটল শিবু গুণিনের কাছে। শিবু বলল, বুঝতে পারছি না কী হতে পারে।
সবাইকে সে নিয়ে চলল পঞ্চা গুণিনের কাছে। সঙ্গে নিল প্রণামী স্বরূপ এক ভাঁড় মোষের দুধ। ছেঁড়া চাদর জড়িয়ে আগুনের সামনে বসে কাঁপছিল নব্বই বছরের গুণিন। কানে ভালো শুনতে পায় না। তবু কান পেতে শুনল। তারপর চুপ করে রইল। চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। মোটা মোটা আঙুলের ভোঁতা নখ দিয়ে কয়েকটা দাগ কাটল মাটির মেঝেতে। তারপরও চুপ।
কিছু বলো খ্যাপাবাবা। কেঁদে উঠল সকলে।
এবার মুখ খুলল বুড়ো। শুধু একটা কথাই বলল, ভয় এসে গেছে বাবা সকল। মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে।
ব্যস। তারপরেই চুপ।
কীসের ভয়, কে এসেছে মাটি ফুঁড়ে, কোথায় এসেছে কিছুই জানা গেল না তখন।
জানা গেল অনেক পরে।
কী ঘটেছিল সেদিন?
শুশুনিয়া পাহাড়ে খাদান খোঁড়া ব্যাপারটা চলে আসছে বহু কাল ধরে। এ অঞ্চলের মানুষকে এই পাথরই কেটে যেতে হয়। গোপলা, শংকরারা তা দেখে আসছে ছোটোবেলা থেকে।
এখন তারা একটু বড়ো হয়েছে। হাতের পেশি, বুকের ছাতি শক্ত হচ্ছে। ওরাও ভাবল খাদান কাটবে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়—অন্তত তেরো—চোদ্দো বছরের ছেলের পক্ষে। তবু ওরা ছাড়বার পাত্র নয়। বাড়িতে গাঁইতি, কোদালের অভাব নেই। তাই নিয়ে ওরা একদিন উঠল পাহাড়ে। অন্য ছেলেরা অবাক।
এরা দুজনে অন্যদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে ঢালুর মুখে একটা পলাশগাছের তলায় মাটি পরীক্ষা করতে লাগল।
জায়গাটা ওরা লক্ষ করেছিল অনেক দিনই। পাহাড়ের অন্য অংশের তুলনায় এ জায়গাটা যেন অনেক নরম। একটু যেন চাপা।
ওরা ভেবে নিল এ জায়গাটা খুঁড়লে নিশ্চয় কিছু পাওয়া যাবে। কী পাওয়া যেতে পারে? ঘড়া ঘড়া সোনার মোহর?
ভাবনাটা নিতান্ত গাঁজাখুরি নয়। ওরা ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছে কয়েকশো বছর আগে সাগর পার হয়ে বিদেশি সাহেবরা এদেশে এসেছিল বাণিজ্য করতে। কলকাতার কাছাকাছি নানা জায়গায় তারা থাকত। সাহেবরা সন্ধান পেয়েছিল এই শুশুনিয়া পাহাড়ের ভেতর কোথাও পোঁতা আছে রাজা চন্দ্রবর্মার গুপ্তধন। সেই সোনার মোহর হাতাবার জন্যে তাদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশি দস্যু পাহাড় খুঁড়ে নেমেছিল। কিন্তু তারা আর উঠতে পারেনি। এখানকার কিছু লোক সেই লোভীদের শায়েস্তা করার জন্যে গুহার মুখে পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছিল।
ওরা দুজনে কাউকে কিছু না বলে গাছের তলায় গাঁইতি চালাতে লাগল। কিছুক্ষণ থামে। বসে জিরিয়ে বিড়ি টেনে ফের গাঁইতি চালায়। একটু পরে ঝুর ঝুর করে পাথর খসে পড়তে লাগল। দারুণ উৎসাহে ওরা আরও জোরে গাঁইতি চালাতে লাগল। তারপর ভীষণ শব্দ করে বিরাট একটা চাঙড় ভেঙে নীচে পড়ে গেল।
ওরা অবাক হয়ে দেখল বেশ খানিকটা নীচে একটা ভাঙা ঘরের মতো কী যেন রয়েছে।
গোপলা বলল, বেশি নীচু নয়। আয় লাফ দিই।
শংকরা ফের একটা বিড়ি ধরাল। ইতস্তত করে বলল, কী করে নামবি? মইটই থাকলে হত।
মই বসে আছে! এইটুকু লাফাতে পারবি না?
শংকরা বলল, নীচে কী আছে অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। কীরকম বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে।
গোপলা বলল, আলো—বাতাস যায়নি কত কাল। তাই—
হঠাৎ এমনি সময়ে নীচের সেই অন্ধকার পাতালভূমির মধ্যে থেকে কেমন একটা শব্দ হল। কিছু যেন উঠে আসবার চেষ্টা করছে। ওরা চোখ বড়ো বড়ো করে গর্তের দিকে তাকিয়ে রইল। মুহূর্ত পরে পাখা ঝাপটানির শব্দ…তারপরেই কী যেন দ্রুত ওপরে আসতে লাগল। অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেছে কুচকুচে কালো রং। শুধু লালচে দুটো ছোটো ছোটো হিংস্র চোখ জ্বলছে।
বাদুড়…..বাদুড়…..সরে আয়।
বাদুড়কে ভয় পাবার কিছু নেই। খুব নিরীহ। বাদুড় তারা অনেক দেখেছে তাদের বাড়ির সামনে গাছে মাথা নীচু করে ঝুলে থাকতে। তবু কেন যে ওরা এত ভয় পেল—
গোপলার কথা শেষ হতে না হতেই কালো বাদুড়টা শংকরার ঘাড় লক্ষ্য করে এসে পড়ল। ভাগ্যি সেই মুহূর্তে শংকরা মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু হাতের থাপ্পড়টা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। বাদুড়টার পিঠের উপর গিয়ে পড়েছিল। ভিজে ভিজে কী যেন লেগে গেল ওর হাতের চেটোয়। গা ঘিন ঘিন করে উঠল।
উঃ, কত বড়ো বাদুড়! খুব বেঁচে গেলি।
শংকরা বলল, ভয় পাবার কী আছে? সামান্য বাদুড়ই তো।
না, সামান্য বাদুড় নয়। ওই দ্যাখ—
শংকরা দেখল, কিছুদূরে একটা গোরু চরছিল, বাদুড়টা তার গলায় কামড় বসিয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গলা। গোরুটা মরণ—যন্ত্রণায় ছুটে বেড়াচ্ছে।
গোপলা তখনই ইট মারতে লাগল বাদুড়টাকে। বাদুড় গলা আর ছাড়ে না। তখন গোপলা চেঁচিয়ে রাখালদের ডাকল। তারা ছুটে এল। এবার বাদুড়টা উড়ে গেল।…..
গর্তটার কাছে ফিরে এল গোপলা। বলল, দেখলি তো ওটা ভয়ংকর রক্তচোষা বাদুড়। এরকম বাদুড় এখানে কী করে এল কে জানে! নে, দুগগা বলে ঝাঁপ দিই।
শংকরা বলল, কিন্তু ওখানে যদি ওইরকম আরও বাদুড় থাকে?
গোপলা বলল, থাকলে ওটার সঙ্গে বেরিয়ে আসত। কিন্তু আমি ভাবছি—
কী ভাবছিস?
ওই পাথরের নীচে বাদুড়টা এতদিন বেঁচে ছিল কী করে? কী খেত? বলতে বলতেই গোপলা লাফ দিল। শংকরাও।
ওরা দুজনেই পড়ল যেখানে সেখানে মাটিটা ভিজে। গোড়ালি—ডোবা জল জমে আছে। অবাক হল ওরা। পাহাড়ের মধ্যে জল এল কোথা থেকে?
একটু ভাবতেই ওদের খেয়াল হল এই পাহাড়ে দুটো ঝরনা আছে। হয় তো তাদেরই কোনোটার জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে নেমে এসেছে।
যেখানে তারা নেমেছে সে জায়গাটা অনেকখানি। একটা বড়ো ঘরের মতন। ছাদ নেই। বোঝা যায় কোনো এক সময়ে ধসে গেছে। ঘরে ঢোকবার জন্যে মস্ত দরজা। আশ্চর্য! দরজাটা কাঠের নয়, নিরেট পাথরের। তবে অর্ধেক খোলা। কেউ যেন অর্ধেক খুলে রেখে কোনো দিন চলে গিয়েছিল। আর ফেরেনি।
ওপরের ফাঁক দিয়ে যতটুকু আলো আসছিল সেই আলোয় পথ দেখে জলে ছপাৎ ছপাৎ শব্দ তুলে ওরা সেই আধ—খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ফাঁক দিয়ে দেখল ভেতরে জমাট অন্ধকার। আর অস্বাভাবিক ঠান্ডা হাওয়া।
এই বদ্ধ জায়গায় হাওয়া ঢুকল কী করে কে জানে!
শংকরা ভয়ে ভয়ে বলল, আর ভেতরে ঢুকে কাজ নেই।
কেন? ধমকে উঠল গোপলা।
ভেতরে কী আছে কে জানে!
সেটাই তো জানতে হবে আমাদের। ঘড়া ঘড়া না হলেও এক ঘড়া মোহরও যদি পাওয়া যায়। নে ঠেল, দরজাটা আর একটু ফাঁক করা যায় কিনা দেখি।
দুজনে ঠেলল। কিন্তু এক চুলও নড়াতে পারল না।
তখন দুজনে কাত হয়ে ভেতরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে নাক টিপে ধরল। উঃ কী পচা গন্ধ!
কী অন্ধকার! কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। বলে ভয়ে শংকরা গোপলার হাত চেপে ধরল।
হাত ছাড়। দেশলাই জ্বালি।
ফস ফস করে তিন—চারটে কাঠি জ্বালাতে না জ্বালাতেই ঠান্ডায় নিভে গেল। ফের একটা জ্বালল। চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে কত কাল পর আলো ফুটে উঠল। এখানে জল জমে নেই। দুজনে সবিস্ময়ে দেখল ঘরের মধ্যে সার সার কয়েকটা লম্বা লম্বা লোহার সিন্দুক।
শংকরা এগোচ্ছিল বাঁ দিক ঘেঁষে। গোপলা খপ করে হাত চেপে ধরল।
সাবধান! পায়ের দিকে তাকা।
সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল কাঠিটা। আবার একটা কাঠি জ্বালতে হল।
ইস! এত মরা ইঁদুর! এখুনি মাড়াত।
ফুলে ফেঁপে সব ঢোল হয়ে আছে। আশ্চর্য এই—ইঁদুরগুলোর গায়ে কোথাও কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই। শুধু মুখের মধ্যে থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। কোনোটা তাজা রক্ত, কোনোটা শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে।
এত ইঁদুর এলই বা কোথা থেকে?
ওই যে দেওয়ালের গায়ে গায়ে গর্ত। গর্ত নয় সুড়ঙ্গ!
মারলই বা কে?
কাঠি নিভে গেল। আবার কাঠি জ্বালানো হল।
তাড়াতাড়ি কর। দেশলাই ফুরিয়ে গেলে আর বেরোতে পারা যাবে না।
দেশলাইয়ের ম্লান আলোয় আর একবার তাকাল লোহার সিন্দুকগুলোর দিকে। সিন্দুকগুলো আয়তনে খুব বড়ো। কিন্তু কোনো ডালাতেই তালা দেওয়া নেই। কেউ যেন তালাগুলো খুলে রেখে দিয়েছে।
শংকরাকে আর একটা কাঠি জ্বালতে বলতেই সামনের সিন্দুকের ভারী ডালাটা তুলে ধরল।
সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠে গোপলা পিছিয়ে এল। ভাঙাচোরা লম্বা একটা কংকাল।
আর একটা কাঠি জ্বাল।
সাহসে ভর করে গোপলা এগিয়ে গেল সিন্দুকের কাছে। মোহর দূরের কথা একটা ফুটো পয়সাও নেই। থাকার মধ্যে রয়েছে কংকালের বুকের ওপর পোকায় কাটা, উইধরা একটা কালো টুপি। যে টুপি সাহেবরা পরে।
একরকম রাগ করেই গোপলা টুপিটা তুলে নিল। আর ঠিক তখনই ঘরের মধ্যে কেমন একটা শব্দ হল, খট—খট—খট। যেন হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি। কংকালটা কী নড়ছে?
শংকরা শিগগির ওপরে ওঠ। বলেই গোপলা শংকরার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু যেখান দিয়ে নেমেছিল, অন্ধকারে সে পথ খুঁজে পেল না। পাহাড়ের ওপর বোধহয় তখন সন্ধে নেমে গেছে। দেশলাই—এর কাঠিও শেষ।
ওরা পাগলের মতো এদিক—ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। লম্বা সুড়ঙ্গটা এঁকেবেঁকে কোথায় কত দূরে গেছে কে জানে।
এমনি করে না খেয়ে না ঘুমিয়ে বোধহয় দু—তিন দিন গেল। শেষে তারা একদিন সকালে যেখান দিয়ে নেমেছিল সেই জায়গাটা খুঁজে পেল। পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে কোনোরকমে ওরা উঠে এল।
পুরো তিন দিন পর বাড়ির লোক তাদের ছেলেদের ফিরে পেল। সকলে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল।
গোপলাদের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে আর সাহেবের টুপি দেখে পাড়ার লোক অবাক হয়ে গেল। এমন দুঃসাহসী ছেলে দেখা যায় না।
গোপলা টুপিটা পরিষ্কার করে ঘরের মধ্যে যত্ন করে পেরেকে টাঙিয়ে রাখল।
এই ঘটনার দিন পনেরো পর থেকে সারা গ্রামে হঠাৎ একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কোথা থেকে একটা বড়োসড়ো বাদুড় এসেছে। যেখানে—সেখানে পাখা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে। গাছের পাখ—পাখালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা ফুটো করে রক্ত চুষে নিয়ে মেরে ফেলছে।
সেদিন সবে সন্ধ্যে হয়েছে। গোপী ঘোষের বাড়ি থেকে হঠাৎ একটা ভয়ার্ত চিৎকার শোনা গেল। লোকে ছুটে গেল। কী হয়েছে? গোপী ঘোষের বৌ সন্ধেবেলা গোয়ালে সেঁজেল দিতে গিয়ে দেখে মস্ত একটা বাদুড় সাদা গোরুটার গলা কামড়ে ধরে ঝুলছে। আর রক্তে মাখামাখি হয়ে গোরুটা ছটফট করছে।
পাড়ার লোকে এসে অনেক কষ্টে বাদুড়টাকে তাড়াল। কিন্তু গোরুটা ক’দিন পর শুকিয়ে মরে গেল। এমনি প্রায় রোজ। বাদুড়ের আক্রমণের হাত থেকে গোরু, ছাগল, মোষ কিছুই বাদ গেল না।
সেদিন তো আরও ভয়ংকর ব্যাপার।
কামারবাড়ির বৌ তার ছ’ মাসের ছেলেটাকে দাওয়ায় শুইয়ে রেখেছিল। হঠাৎ দেখে কোথা থেকে একটা কালো মোটা বাদুড় এসে তার মাথার কাছে পাখা ঝাপটাচ্ছে। যেন ঘুম পাড়াচ্ছে। তাড়া খেয়ে তবে পালাল।
এ তো গেল বাদুড়ের উৎপাত। তা ছাড়াও নতুন একটা উপদ্রব দেখা দিয়েছে।
সন্ধের পর হারু মাহাতো হাতে লণ্ঠন নিয়ে দোকান থেকে বাড়ি ফিরছিল। নির্জন পথ। দূরে শেয়ালের ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এই সময়ে এই পথ দিয়েই হারু মাহাতো রোজ আসে। কোনোদিন কিছু মনে হয় না। কিন্তু আজই হঠাৎ এক জায়গায় এসে গাটা কীরকম ছমছম করে উঠল। মনে হল খুব ঢ্যাঙা মতো একটা লোক যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে…..একটু পরেই চেহারাটা ফুটে উঠল। দেখল কোট—প্যান্ট পরা সাহেবের মতো কেউ। কিন্তু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ সাহেবটা মুখ ফেরাল। তাকে দেখেই হারু মাহাতো ‘বাবা গো’ বলে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। লণ্ঠনটা গেল নিভে।
ভয়ে গ্রামের লোক সন্ধে হতে না হতেই ঘরে খিল লাগিয়ে বসে থাকে। তবু নিস্তার নেই। রাত দুপুরে রাস্তায় চলা—ফেরার শব্দ পায়। কেউ যেন বুট জুতো পায়ে বাড়ির কাছে ঘুরছে। বাড়ি বাড়ি কিছু যেন খুঁজছে। কারো বাড়িতে হঠাৎ দেখা যায় বাদুড় ঢুকছে জানলা দিয়ে গভীর রাতে।
ভয়ে সন্ধে থেকেই মশারি টাঙাবার ধুম পড়ে গেল। কেননা কখন কোন মুহূর্তে নিঃশব্দে বাদুড়টা ঢুকে বসে থাকবে কেউ জানে না। আর তার নিঃশব্দ মরণ—চুম্বনের ফলে এক মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে রক্তহীন জীবনটি।
আরও আশ্চর্যের বিষয়একদিন একজন একটা বড়ো পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল বাদুড়টাকে। লক্ষ্য যে ব্যর্থ হয়নি তার সাক্ষী ছিল অনেকেই। কিন্তু অদ্ভুত ক্ষমতায় বাদুড়টা হাওয়ার মতো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।…..
এই তো অবস্থা।
ভয়ার্ত গ্রামবাসীরা দলে দলে ছুটল শিবু গুণিনের কাছে। শিবু বলল, ও আমার সাধ্যের বাইরে। খ্যাপাবাবার কাছে যাও।
কিন্তু খ্যাপাবাবার তখন উঠে বসার শক্তি নেই। কানে শোনে না তেমন। লোক দেখলে রেগে ওঠে।
তবু ওর পরামর্শ ছাড়া গতি নেই। তখন একাই শিবু গুণিন গেল যথারীতি এক ঘটি মোষের দুধ নিয়ে। একটু পরে ডাক পড়ল গোপলার। গোপলা—শংকরার কথা আগেই শোনানো হয়েছে পঞ্চানন গুণিনকে। ভয়ানক ভয়ের কথা সে আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। এখন শুধু গোপলাকে কাছে টেনে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ওটা দিয়ে দে বাপধন!
কোনটা দিতে হবে? কাকে?
তার উত্তর খ্যাপাবাবা দেয়নি। সব কথা এরা পরিষ্কার করে বলে না। এক—একটা বিশেষ বিষয় এরা ইঙ্গিতে বলে। সেই ইঙ্গিত বুঝে নিতে হয়। একবারের বেশি বলে না।
শিবু গুণিনই ধরতে পেরেছিল তার গুরুর ইঙ্গিত। সেইই বুঝিয়ে দিয়েছিল গোপলাকে। সাহেবের ওই টুপিটার জন্যেই এই রকমটা ঘটছে। মৃতের সঙ্গে দেওয়া জিনিস নিতে নেই। হয়তো টুপিটা সাহেবের খুব প্রিয় ছিল। ওটা দিয়ে দে।
বেঁকে বসল কিশোর গোপলা। বলল, না, কত ঝুঁকি নিয়ে ওটা এনেছি। ওটা আমার সাহসের প্রমাণ।
শিবু বোঝাল—সাহেব টুপিটা খুঁজে বেড়াচ্ছে কখনও ছায়ামূর্তি ধরে, কখনও বাদুড় হয়ে। ও ঠিক খুঁজে নেবে ওর জিনিস। কিন্তু হয়তো মরতে হবে অনেককে।
গোপলা বুঝল না। জেদ ধরেই রইল। কিছুতেই দেবে না।
নিরুপায় শিবু ওর হাতে নতুন করে একটা কালো সুতো বেঁধে দিয়ে সূর্যপ্রণাম করে চলে গেল।
তিন দিন পর—
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল গোপলার। ঠিক মাথার কাছে জানলার ধারে রাস্তায় ভারী পায়ের শব্দ—খস…খস…খস।
এত রাতে কে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
দুঃসাহসী গোপলা খুব সাবধানে জানলাটা একটু ফাঁক করল। দেখল দীর্ঘ একটা মূর্তি রাস্তার ওদিকে দাঁড়িয়ে যেন দেখছে তাদের ঘরটাকে। মুখ দেখা যাচ্ছে না।
ওটা কি মানুষ না অপদেবতা?
গোপলা তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে কাঁথা—কম্বলের মধ্যে মুখ গুঁজে চোখ বুজল।
পরের দিন গোপলা শিবুর কাছে গেল। বলল, শিবুকাকা, সাহেবের ও টুপি আমি রাখব না। দিয়ে দেব। কিন্তু কীভাবে দেব? ওখানে গিয়ে সেই কবরখানায় নেমে?
শিবু খ্যাপাবাবার কাছে উপায় জেনে এল। বলল, খ্যাপাবাবা বারণ করেছে ওখানে কখনও যাবে না। যার কাছে থাকবে ওই টুপি, সাহেবের প্রেতাত্মা তাকে মারবেই। খ্যাপাবাবার শেষ ইচ্ছে—টুপিটা ওর কাছে থাকুক। যার জিনিস সে নিজে এসে তার কাছ থেকে নিয়ে যাবে।
সবাই অবাক হল। এ আবার কী কথা! শুধু শুধু নিজের ঘাড়ে বিপদ টেনে আনা!
তবু মানতেই হল তার আদেশ। গোপলা টুপিটা দিয়ে গেল খ্যাপাবাবার হাতে।
সেদিন কৃষ্ণপক্ষের শনিবার।
নিশুতি রাত।
খ্যাপাবাবা জ্বরে বেহুঁশ। পাশের ঘরে ছেলে, ছেলের বৌ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এমন গভীর ঘুম তাদের কখনও হয় না। তবু তারই মধ্যে তারা শুনল ঠকঠক করে কীসের একটা শব্দ। এ ঘর থেকে ও ঘরে দেওয়ালে দেওয়ালে ঠোক্কর খাচ্ছে। কিন্তু ঘুম থেকে কেউ উঠতে পারল না।
ভোরবেলা ছেলের বৌ খ্যাপাবাবাকে মুখ ধোওয়াতে এসে চমকে উঠল। রক্তে বিছানা ভেসে যাচ্ছে। খ্যাপাবাবা নিথর হয়ে গেছে। বিছানায় কালো টুপিটা নেই।
২০০৪, জুন, শুকতারা
—