ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

দেওয়ালে কীসের ছায়া?

দেওয়ালে কীসের ছায়া?

কলকাতা থেকে আশি কিলোমিটারের মতো দূরে মফসসল শহরটা। ইস্কুল আছে, কলেজ আছে, কোর্ট আছে, সিনেমা হল আছে, থানা আছে। আর আছে একটা হাসপাতাল। হাসপাতালটা শহরের একটু বাইরে। এখানে একসময়ে সাহেব মিশনারিরা থাকত। বেশ বড়ো বড়ো সাহেবি কায়দায় বাড়ি। এখন সেগুলো পুরোনো হয়ে গেছে। তারই একটাতে হাসপাতালটা।

হাসপাতালের পর থেকেই শুরু হয়েছে ধুলোভরা কাঁচা রাস্তা। তার দু—পাশে বাঁশঝাড়। সন্ধের পর ওদিকে লোক হাঁটে না বড়ো একটা। হাসপাতালটার দক্ষিণ দিকে গাছ—গাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা যায় মিশনারিদের আমলের বিরাট চার্চটা। উত্তর দিকে ভাগীরথী। আর হাসপাতাল থেকে ভাগীরথীর ধার পর্যন্ত সার সার কবরখানা। অধিকাংশই সে সময়ের সাহেবদের। কতকগুলো বাঙালি খ্রিস্টানদের।

এখন আর সাহেবরা নেই। কিন্তু কয়েক ঘর বাঙালি খ্রিস্টান আছে।

এই পাড়াতে একদিন এক বিধবা মহিলা এলেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটির বয়েস বছর তেইশ—চব্বিশ। নার্স। বদলি হয়ে এখানকার হাসপাতালে আসতে হয়েছে। এখানে নার্সদের কোয়ার্টারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই বাড়ি খুঁজতে হচ্ছিল এঁদের। একখানি হলেও চলে। তাও মেলে না। শেষে এই পাড়াতেই সাধ্যের অতীত ভাড়ায় রাজি হয়ে তাঁরা কোনোরকমে একটি ঘর পেয়েছেন। একটাই সুবিধে—হাসপাতালটা কাছে। নইলে ঘরটা মোটেই ভালো নয়। অন্ধকার চাপা ঘর। টিনের চালা। ছোটো ছোটো দুটি জানলা। বাড়িতে ঢোকার পথটাও অদ্ভুত। সামনে দিক দিয়ে নয়। পিছন দিক দিয়ে—ঝোপ—জঙ্গলের মধ্যে। এ ঘর যে লোকের বাসের জন্যে তা কিছুতেই মনে হয় না। হয়তো বাড়িওয়ালা অন্য কোনো কাজে ঘরটা ব্যবহার করত। কী কাজ কে জানে?

সন্ধের সময়ে ডিউটি দিয়ে মীনা ফিরে এসেছে। নতুন বাসা। বেচারি মা একাই সারাদিন গুছিয়ে—গাছিয়ে রাতের রান্না সেরে রেখেছেন।

সন্ধের পর দরজায় খিল এঁটে মা—মেয়ে গল্প করছে। এ পাড়ায় সর্বত্রই ইলেকট্রিক লাইট, শুধু এ বাড়িটাতেই আলোর ব্যবস্থা নেই। তাই লণ্ঠন জ্বালাতে হয়েছে। মা—মেয়ে গল্প করছিল নানা বিষয়ে। তবে বেশি আলোচনা করছিল বাড়িওয়ালার ব্যবহার নিয়ে। বাড়িওয়ালার নাম ভূদেব সাঁতরা। যেমন দেখতে তেমনি বিশ্রী ব্যবহার। সবসময়েই রুক্ষ কথাবার্তা—মারমুখো। ভদ্রতার বালাই নেই। বয়েস পঞ্চাশের একটু উপরে। একমাথা পাকা চুল। পুরু ঠোঁট—মোটা নাকটা। বেঁকে যেন মুখের ওপর ঝুলে পড়েছে। বাড়িভাড়ার অ্যাডভান্স যখন হাত পেতে নিল তখন তার সেই চওড়া থাবা আর মোটা মোটা ছড়ানো আঙুলগুলো দেখে মীনা আঁতকে উঠেছিল। মনে হয়েছিল এই হাতের বোধ হয় অসাধ্য কিছু নেই।

মীনা বলল, মামা আসবে বলেছিল। এলে ভালো হত। বাড়িওলা বুঝত আমাদের পুরুষ গার্জেন আছে।

মা বললেন, ছুটি পায়নি বোধহয়। ছুটি পেলে নিশ্চয়ই আসত।

মীনা হাসপাতালের গল্পও করছিল। বলছিল—কী বিশ্রী জায়গা! নোংরা। পেশেন্টদের দিকে কেউ ভালো করে তাকায় না। না ডাক্তার না নার্স। ক’জনই বা ডাক্তার—নার্স বা ক’জন। কিন্তু সবাই যেন কীরকম। এরা রুগিদের সারাবার চেয়ে যেন কে কখন মরল তার হিসেব রাখতেই ব্যস্ত। এই তো আজই দুটো ভর্তি হল—সাধারণ কেস। দুটো পেশেন্টই মরে গেল। না বাপু, এখানে আমি থাকতে পারব না।

মা বললেন, উপায় তো নেই। কিছুদিন থাকো। তারপর ট্রান্সফারের জন্যে না হয় লিখো।

হঠাৎ এই সময়ে মীনার চোখ পড়ল দেওয়ালে। একটা ছায়া। না, মানুষের কোনো লম্বা ছায়া নয়। ছোটো একটা ছায়া। যেন একজন কেউ চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে। ছায়াটা অল্প অল্প কাঁপছে। মীনা অবাক হয়ে দেখছিল। ঠিক একটা লোক। কিন্তু—না, একটা লোক তো নয়। দুটো—হ্যাঁ, স্পষ্ট দুটো। একটার ওপরে আর একটা শুয়ে আছে। না, শুয়েও নেই। একজনের বুকের ওপর বসে আছে।

মীনা সকৌতূহলে দেখছিল। হঠাৎ চমকে উঠল। আরে! ও যে শোয়া লোকটার গলা টিপছে!

—ওমা! মীনা বেশ ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু সত্যিই যে ভয়ের কিছু নেই তা ও ভালো করেই জানে। কেননা ওটা শুধুই দেওয়ালে আলোর ছায়া।

মা বললেন, কী হল?

—দেয়ালের দিকে তাকাও।

মা হাসলেন একটু। ঠিক যেন কেউ কারো গলা টিপে মারছে। আলো—ছায়ায় কত মজার মজার ছবিই তৈরি হয়।

মীনা বলল, দাঁড়াও দেখি, ছায়াটা কীভাবে হল।

বেশি দেখতে হল না। লণ্ঠনটা ছিল টেবিলের ওপর। আলনায় শাড়ি আর ব্লাউজটা ঝুলছিল এমনভাবে যে ঠিক ওইরকম ছায়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

এবার মীনা আলো কমিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। একটাই চৌকি। একটাই বিছানা। মা আর মেয়ে শুল পাশাপাশি। যেমন তারা বরাবর শোয়।

অকাতরে ঘুমোচ্ছিল মীনা আর তার মা। হঠাৎ মায়ের ঘুম ভেঙে গেল। কীসের যেন শব্দ! ঠুক—ঠুক—ঠুক। কেউ কি দরজায় শব্দ করছে?

হ্যাঁ, তাই তো। ওই যে আবার শব্দ—ঠুক—ঠুক—ঠুক।

মা উঠে বসলেন। না, ভুল শোনেননি। ওই আবার সেই শব্দ!

—মা! মীনার চাপা স্বর। ওরও ঘুম ভেঙে গেছে।

—কেউ কি দরজা ঠেলছে?

—বোধ হয়।

বলেই তিনি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন—কে?

শব্দ থেমে গেল।

দু’মিনিট—তিন মিনিট—চার মিনিট—

আবার সেই শব্দ। ঠুক—ঠুক—ঠুক।

মা উঠছিলেন। মীনা কাপড় চেপে ধরল।

—কোথায় যাচ্ছ?

—দেখি কে?

—পাগল নাকি! চুপচাপ শুয়ে থাকো।

অগত্যা দুজনেই ফিরে এল বিছানায়। চুপচাপ শুয়ে রইল চোখ বুজিয়ে। কিন্তু ঘুম সহজে এল না। চার্চের ঘড়িতে ঠং—ঠং করে দুটো বাজল।

তিন দিন পর।

দরজায় ভালো করে খিল এঁটে মা আর মেয়ে চুপচাপ বসে। দুজনেরই মুখে ভয়ের ছাপ। রোজ রাত দুটোর সময়ে কে তাদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে যায়।

নীচু গলায় মীনা বলল, এ নিশ্চয়ই ওই বাড়িওয়ালার কাজ। ও লোকটাকে আমার মোটে ভালো মনে হয় না।

—কিন্তু আমাদের কাছে আসবে কেন?

—হয়তো মনে করেছে গয়নাগাঁটি কিছু আছে।

মা চুপ করে রইলো।

হঠাৎ মীনা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল—মা—মা—ওই দ্যাখ। বলে দেওয়ালের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল।

আশ্চর্য! সেই এক ছায়াছবি। একজন কেউ চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আর তার বুকের ওপর চেপে আর একজন দু—হাত দিয়ে গলা টিপছে।

কিন্তু—লণ্ঠনটা আজ অন্যদিকে রয়েছে। আর আলনার ওপর সব কাপড়ই পরিপাটি করে রাখা। ছায়া পড়ার উপায় নেই।

তবু ছায়া পড়েছে। এবার গামছা আর মশারির দড়ির। তা বলে ছবিও সেই একই?

রাত কি দুটো বেজেছে? ঘুম আসছে না। না মায়ের, না মেয়ের। এই ক’দিনেই কেমন যেন বদ অভ্যাস হয়ে গেছে—কখন সেই শব্দটা হবে ঠুক—ঠুক—ঠুক। ঘুমোব বলে শত চেষ্টা করলেও ঘুম আসে না কিছুতেই।

দুজনে শুয়ে আছে নিঃসাড়ে। কেউ কোনো কথা বলছে না। কথা বলার কিছু নেইও। শুধু অপেক্ষা করা।

ঢং—ঢং—

দুটো বাজল দুরে চার্চের ঘড়িতে। বহুকালের পুরোনো চার্চ। ঘড়িটা কিন্তু ঠিক ঠিক সময় দেয়। শব্দটাও বুড়ো লোকের গলার স্বরের মতো ভাঙাভাঙা ভারী—কর্কশ।

দুটো তো বেজে গেল কিন্তু দরজায় শব্দ কই? কান খাড়া করে রইল মা আর মেয়ে। না, কোনো শব্দ নেই।

—উঃ আর তো পারি না। মীনা যেন অধৈর্য হয়ে উঠেছে।—যা হবার তা হয়ে যাক। রোজ এই রাত জাগা—

মা হঠাৎ ওর গায়ে ঠেলা দিয়ে ফিসফিস করে বললেন—চুপ! শুনতে পাচ্ছ কিছু?

মীনা ভালো করে কান পাতল।

হ্যাঁ, একটা কীসের যেন শব্দ। দরজায় নয়। জানলার দিক থেকে আসছে—দূরে!

মীনার মা মশারির ভিতর থেকেই হাত বার করে জানলাটা খুলেন। ওপাশে লম্বা লম্বা পামগাছগুলোর পাশ দিয়ে হাসপাতালের আলো দেখা যাচ্ছে—ইলেকট্রিক লাইট। আর এদিকে নিস্তব্ধ গঙ্গার ধারে পুরোনো সমাধিভূমি। শব্দটা যেন সমাধিগুলোর কাছ থেকেই আসছে।

মীনা আর তার মা সেইদিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। কিছু দেখতে পেলেন না।

হঠাৎ মনে হল একটা কবরের মধ্যে থেকে ধোঁওয়া বেরোচ্ছে—কুয়াশার মতো সাদা ধোঁওয়া। ধোঁওয়াটা পাক খেতে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে ধোঁওয়াটা একটা মূর্তির আকার হল। লম্বা একটা মূর্তি। দুটো হাত ঝুলছে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত। ঘাড়টা হেলে পড়েছে একদিকে। তারপর সেই ভয়াবহ মূর্তিটা হাওয়া ঠেলে এগিয়ে আসতে লাগল জানলার দিকে। সেই সঙ্গে একটা অদ্ভুত গোঙানির শব্দ।

মীনা আর তার মা দেখছে। এ কি স্বপ্ন? এ কি চোখের ভুল? তা যদি হয় তাহলে হাসপাতালের আলোগুলোও কি ভুল দেখা?

না, চোখের ভুল নয়। ওই যে মূর্তিটা এসে পড়েছে। হ্যাঁ, এই জানলার দিকেই আসছে।

—বাবা গো! বলে মীনার মা সশব্দে জানলা বন্ধ করে দিয়ে মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে চোখ বুজলেন।

এই ক’দিনই প্রতিদিন রাত দুটোয় দরজায় শব্দর কথা যেমন বাড়িওলাকে বলা যায়নি তেমনি গত রাতের ঘটনাটাও বলা গেল না। মীনা আর তার মা দুজনেই পরামর্শ করলেন।

না। বলে দরকার নেই। কেননা তাতে লাভ নেই। বাড়িওলা বিশ্বাস তো করবেই না উপরন্তু রাগ করবে। ভাববে তার বাড়ির বদনাম রটাচ্ছে। ফলে ও বাড়ি ছাড়তে হবে। ছাড়তে তো হবেই কিন্তু হঠাৎ অন্য বাড়ি পাবে কোথায়?

সারা দিন কাটে একরকম। কিন্তু বিকেল থেকেই গা ছমছম করে। একটু পরেই সন্ধে নামবে। তারপর হবে রাত। সে যে কী ভয়ংকর!

সন্ধের পর অন্যদিনের মতো আজও ওরা গল্প করছিল। মা আজ দুপুরে বেরিয়েছিলেন বাড়ির খোঁজে। সেই বাড়ির কথাই বলছিলেন মেয়েকে। হঠাৎ শব্দ ঠক—ঠক—ঠক। কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে আস্তে আস্তে। হৃৎপিণ্ডটা একেবারে লাফিয়ে উঠল মীনার। এই সন্ধে রাতেই!

আবার শব্দ—ঠুক—ঠুক—ঠুক—

—কে?

—আমি। দরজা খোল।

—মামা! বলেই আনন্দে লাফ দিয়ে গিয়ে মীনা দরজা খুলে দিল।

—কী রে! সন্ধে থেকেই খিলটিল এঁটে ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি?

মীনার মা ভাইকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন।

—তুই কোথা থেকে? কী করে চিনে এলি?

—আমি তো বলেইছিলাম আসব। আজ একটা সুবিধে পেয়ে গেলাম। পাণ্ডুয়ায় এসেছিলাম ইনস্পেকশনে। সেখান থেকে চলে এলাম। রাতটা কাটিয়েই ভোরে আবার ছুটতে হবে। উঃ! বাড়ি নিয়েছ আচ্ছা জায়গায় বটে!

মীনার মা একটু হাসলেন। বললেন, কোথাও তো আর পেলাম না।

মীনা বললে, শুধু জায়গা? এমন রহস্যপুরী আর কোথাও খুঁজে পাবে না।

—রহস্যপুরী! কীসের রহস্য?

মীনা বলল, হাত—মুখ ধুয়ে আগে চা খেয়ে নাও। তারপর সব বলছি। তুমি পুলিশ ইনস্পেক্টর—দ্যাখো যদি রহস্যভেদ করতে পার।

মীনার মামা শার্ট—ট্রাউজার ছেড়ে পাজামা পরলেন। রিভলবারটা মীনার হাতে দিয়ে বললেন, সাবধানে রাখিস। লোডেড।

অনেক রাত পর্যন্ত মীনার মামা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব ঘটনা জেনে নিলেন। লণ্ঠনটা তিনি নানা ভাবে রাখলেন। কিন্তু দেওয়ালে আজ কোনো ছায়া পড়ল না।

মামা হাসলেন—দূর! তোদের সব ম্যানিয়া।

মীনা লজ্জা পেল। বলল, না, কখখনো না। ছায়া তো রোজ পড়ে না।

—তা হলে বোধ হয়, দরজায় কড়া নাড়া কী তোদের ওই কবরের ভূত কিছুই আমার ভাগ্যে জুটবে না।

—আর জুটে দরকার নেই। উঃ ঠাকুর! বলে মীনার মা চোখ বুজিয়ে নমস্কার করলেন।

রাত গভীর। মাটিতে বিছানায় শুয়ে মীনার মামা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। সারা দিনের পরিশ্রমের পর বিশ্রাম। কিন্তু মীনা আর মীনার মা—যদিও তারা আজ অনেক নিশ্চিন্ত—তবু তাদের চোখে ঘুম নেই। কখন দুটো বাজবে।

মীনার মা কী ভাবছিলেন জানি না। কিন্তু মীনা বোধ হয় ভাবছিল—আজ যেন কিছু হয়। তাহলে মামার মতো অবিশ্বাসী মানুষ বুঝে যেতে পারবে যে তারা ম্যানিয়াগ্রস্ত নয়। কিন্তু আজ কি আর কিছু ঘটবে? নাকি পুলিশ অফিসারের গন্ধ পেয়ে প্রেতাত্মা ফিরে যাবে?

মীনা এইব ভাবছে। এমনি সময়ে সেই পুরোনো চার্চের ঘড়িতে ঢং—ঢং করে দুটো বাজল। মীনা নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল।

দূরে কীসের একটা শব্দ—সোঁ—সোঁ—সোঁ—

মীনার মা বললেন, ঝড় উঠল নাকি?

—তাইতো মনে হচ্ছে।

—এই অসময়ে ঝড়! মীনার মা আবার মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে জানলাটা খুললেন। দেখলেন তাঁদের বাড়ির পিছনে যে বটগাছটা—শুধু সেইটেই ঝড়ে দাপাদাপি করছে। অন্য গাছগুলো স্থির।

—এ আবার কী!

মীনাও তখন মুখ বাড়িয়েছে। হঠাৎ দেখা গেল সেই ঝড়ের মধ্যে থেকে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে কালকের দেখা সেই মূর্তিটা একটা গোঙানির শব্দ করতে করতে জানলার দিকে এগিয়ে আসছে।

—বাবা গো! বলে মীনা বিছানায় পড়ে গেল।

মীনার মামা ধড়মড় করে উঠে পড়লেন।

—কী হয়েছে—কী হয়েছে বলে জানলার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তারপরই লাফিয়ে প্রায় রিভলবারটা নিয়ে দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।

মীনার মা চেঁচিয়ে বারণ করতে গেলেন কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। তিনি জানলা বন্ধ করতে ভুলে গেলেন—দরজাটাও রইল হাট করে খোলা।

আকাশে কৃষ্ণপক্ষের ঘোলাটে চাঁদ। চোখের সামনেই ওরা দুজনে দেখছে সেই অদ্ভুত দৃশ্যটা। জানলা থেকে মাত্র ক’ গজ দূরে—

ছায়ামূর্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন মীনার মামা। ডান হাতে বোধ হয় রিভলবার। মূর্তিটা একটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। বোধহয় সেইজন্যেই গুলি ছোড়া যাচ্ছে না। তারপর মূর্তিটা হঠাৎ বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে আসতে লাগল। এবার আর জানলার দিকে নয়, ওপাশ দিয়ে—এই ঘরটা ছাড়িয়ে। আর আশ্চর্য—মীনার মামা যেন চুম্বকের আকর্ষণে লোহার টুকরোর মতো চলেছেন তারই পিছনে। মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে আছে।

কততক্ষণ কাটল এইভাবে। হুঁশ নেই এদের কারো। হঠাৎ দূরে শব্দ হল দ্রা—ম। গুলি ছোড়া হল। ওই একবারই শব্দ।

ব্যস! তারপর সব চুপ।

জানলা খোলা, দরজা খোলা—মা আর মেয়ে বসেই আছে। বিহ্বল—স্তব্ধ। বোধশক্তিও বুঝি কারো নেই।

সকাল হতে না হতেই চেঁচামেচি—হইচই। খুন—খুন—

সবাই ছুটে গেল। দেখল বাড়িওয়ালা ভূদেব সাঁতরা তার নিজের বাড়ির দরজায় পড়ে আছে। বুকের কাছটা রক্তে ভেজা।

—তোর মামা কোথায় গেল? মীনার মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।

মীনা মায়ের মুখ চেপে ধরল। চাপা গলায় ধমকে উঠল—চুপ!

একটু পরেই পুলিশ এল। জিপ থেকে নামলেন স্থানীয় ইনস্পেক্টর। সঙ্গে মীনার মামা।

মীনার মামা পুলিশ অফিসারকে বললেন, আপনাকে তো সব ঘটনাই বলেছি। আবার বলছি—গুলি আমি করিনি। এ ভদ্রলোককে আমি চিনি না, কখনো দেখিনি। এখানে আমার দিদির বাড়ি এসেছিলাম মাত্র কাল রাত্তিরে।

পুলিশ অফিসার কোনো কথা না বলে মৃতদেহ পরীক্ষা করতে লাগলেন।

—আমি নিজে একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর। আমি বলছি আমি খুন করিনি। খুনের কোনো motive—ই থাকতে পারে না।

—আপনি নিশ্চই খুন করেননি। তাহলে খুন করল কে? ভূতে তো নয়। ইনস্পেক্টর একটু অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন।

মীনার মামা বললেন, ভূত কিনা জানি না। তবে সেই ছায়ামূর্তি আমায় টেনে নিয়ে এসেছিল এঁর বাড়ির দরজা পর্যন্ত। দরজায় দু’বার শব্দ করল। কে? বলে টর্চ হাতে ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। ‘বাবা গো!’ বলে একবার চেঁচিয়ে উঠলেন—সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমার হাত থেকে রিভলবারটা কে ছিনিয়ে নিল। তারপরেই গুলির শব্দ!

পুলিশ অফিসার আবার একটু হাসলেন। আপনার কথা আমরা বিশ্বাস করলেও কোর্ট বিশ্বাস করবে না।

মীনার মামার মুখ শুকিয়ে গেল। কোনোরকমে বললেন, কিন্তু দেখুন রিভলবারটাও আমার কাছে নেই।

এই সময়ে একজন পুলিশ ঝোপের ভেতর থেকে একটা রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে এল।

—দেখুন মিস্টার মিত্র, এটা আপনার কিনা।

—হ্যাঁ, আমার। কিন্তু আমি এটা ফেলে দিইনি।

পুলিশ অফিসার আবার সেই অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন।

বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। পরিষ্কার মার্ডার কেস। যে কোনো কারণেই হোক বাইরের এই পুলিশ ইনস্পেক্টরটি ভূদেব সাঁতরাকে বাইরে ডেকে এনে খুন করেছে। তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মীনার মামা আত্মরক্ষার জন্যে একমাত্র যে ঘটনা বলছে তা অবিশ্বাস্য—গাঁজাখুরি।

তবু—হাজার হোক পুলিশ ইনস্পেক্টর। স্থানীয় পুলিশ তাই ভাবতে লাগল একে বাঁচাবার কোনো উপায় বের করা যায় কিনা।

সারা দিন মৃতদেহ নিয়ে পোস্টমর্টেম ইত্যাদি করার পর পুলিশ অফিসার সন্ধের সময়ে সদলবলে আবার এলেন ঘটনাস্থলে। ভূদেব সাঁতরার বাড়ি তল্লাশি চালালেন। বাড়ির লোকদের নানা জেরা করা হল। কিন্তু নতুন কোনো সূত্র পাওয়া গেল না।

—আচ্ছা, চলুন আপনার দিদির বাসায়। পুলিশ অফিসার সদলবলে এলেন। সবাই বসল চৌকিতে। মীনা আর মীনার মা বসল মাটিতে। ভয়ে শুকিয়ে গেছে তাদের মুখ। এ আবার কী বিপদ! বেচারি মামা!

পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন—কোন জানলা দিয়ে আপনারা দেখেছিলেন?

মীনা জানলাটা দেখাল।

—এটা কি সবসময়ে বন্ধ থাকে?

—প্রায়ই।

পুলিশ অফিসার টর্চ ফেলে জানলাটা—জানলার বাইরেটা ভালো করে দেখলেন। নাঃ, কিচ্ছু নেই।

—আপনাদের লাইট নেই?

মীনা মাথা নাড়ল।

—শুধু ওই লণ্ঠন?

—হ্যাঁ—সঙ্গে সঙ্গে মীনা চিৎকার করে উঠল—ওই যে—ওই যে সেই ছায়া!

সবাই অবাক হয়ে দেখল দেওয়ালে একটা ছায়া পড়ছে—কেউ একজন শুয়ে আছে। আর তার বুকের ওপর চেপে আর একজন—

—এ ছায়া কোথা থেকে পড়ল? ইনস্পেক্টর ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চারিদিকে তাকালেন। না, এমন কিছু আলোর সামনে নেই যে তার ছায়া দেওয়ালে পড়তে পারে।

তা হলে?

লণ্ঠনটার পলতেটা হঠাৎ দপদপ করে উঠল। তারপরই নিভে গেল।

My God! ইনস্পেক্টর আপন মনেই উচ্চারণ করলেন কথাকটা।

পরের দিন স্থানীয় পুলিশ অফিসারের নির্দেশে সেই ঘরের মেঝে খোঁড়া হল। তাঁর দৃঢ় ধারণা এই ঘরে কোনো একসময়ে কাউকে ঘুমন্ত অবস্থায় গলা টিপে খুন করা হয়েছে। দেওয়ালে সেই ছায়াছবি স্পষ্ট করে তা বুঝিয়ে দিয়েছে।

মেঝে খোঁড়া নিষ্ফল হয়নি। পাওয়া গেল একটা মড়ার খুলি—শুধুই খুলি।

ধড়টা? সেটা বোধহয় ঘটা করে কবর দেওয়া হয়েছিল ওই ভাঙা কবরগুলোর পাশে। ট্রেনে কাটা—টাটা পড়েছিল—এমন একটা মিথ্যে রটনা করতে কতক্ষণ? বিশেষ—লোকটা যদি খুনির নিজেরই কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয় তা হলে সাধারণকে যা বোঝানো হয়েছে তারা তাই বুঝেছে।

কে খুন হয়েছিল, কেন খুন হয়েছিল, কবে হয়েছিল, কেন গলা টিপে মেরে পরে গলা কাটা হয়েছিল এসবের সঠিক উত্তর আজ আর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে খুনি যে কে তা বোঝাই যাচ্ছে। তার শাস্তিও সে পেয়ে গেল এতদিন পর মাত্র গত রাত্রে।

প্রকাশকাল : অজ্ঞাত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *