লৌহকপাট – ৪.৭

সাত

সে কথা এখন থাক। অভিলাষবাবু যার জন্যে এত গরজ করে আমাকে টেনে নিয়ে এলেন, সেই ব্যাপারটা আগে বলে নিই।

যা অনুমান করেছিলাম তাই। আবার একটা নতুন ঝঞ্ঝাট সাধ করে সেধে আনবার প্রয়োজন বোধ করছেন ভদ্রলোক। উদ্দেশ্য সেই—’অন্যায়ের প্রতিকার’। অর্থাৎ পঞ্চাশ পেরিয়েও ইংরেজীতে যাকে ‘ম্যাচিওরিটি’ বলে, সেটা ওঁর আসে নি। হয়তো কোনো কালেই আসবে না। একবার সিপাইদের দুর্নীতি তাড়াতে গিয়ে নিজেই তাড়িত হয়েছিলেন, সে কথা আমার মনে আছে, উনি বোধহয় ভুলে মেরে দিয়েছেন। কিংবা অভিলাষবাবুরা যে জাতের লোক, ‘ঠেকে শেখা’ বলে কোনো শব্দ তাঁদের অভিধানে নেই। ‘অব্যাপারে ব্যাপারং’ সম্বন্ধে হিতোপদেশের সাবধান বাণী তাঁরা কোনো কালেই কানে তোলে না।

অভিলাষবাবু এবার যে কাণ্ডটা করতে চলেছেন, সোজা কথায় তাকে বলা যায় সরকারের ‘পলিসি’র গায়ে হাত। মারাত্মক অপরাধ। ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড-এ ‘আউটরেজিং মডেস্টি’ বলে ধারাটা আছে, প্রায় তার সমতুল। ‘পলিসি’ হল মন্ত্রীমণ্ডলীর অসূর্যম্পশ্যা অন্তঃপুরিকা, চাকরে-গোষ্ঠীর ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই সহজ কথাটা কিছুতেই ওঁর মাথায় ঢুকতে চাইল না। ঢোকাবার চেষ্টা করতেই অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘কিন্তু আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এই স্কীম ওঁদের আসল উদ্দেশ্যকেই পণ্ড করবে!’

—করুক। তাতে আপনার কী? ‘স্কীম’-এর সঙ্গে ‘ইমপ্লিমেনটেশান’ বলে যে আর একটা কথা আছে, সে কি এখনও আপনার মুখস্থ হয় নি? প্রথমটা ওঁদের এলাকা, দ্বিতীয়টা আপনার, সোজা বাংলায় যার নাম চোখ বুজে হুকুম তামিল করা। উদ্দেশ্য কী, সেটা সফল হবে না পণ্ড হবে—এসব অবান্তর প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানো আপনার কাজ নয়।

—এই জলজ্যান্ত গলদগুলো দেখিয়ে দেবো না?

—না।

–এতগুলো মেয়ের ভবিষ্যৎ যদি দেখতেন, কি রকম কান্নাকাটি করছে তারা।

–করুক না? ওঁরা বলবেন দুনিয়ার নিজের মঙ্গল কে কবে বুঝে থাকে? যার ভাল করতে চান, সে-ই সবচেয়ে বেশী বাধা দেবে। কান্নাকাটি শুনতে গেলে রাষ্ট্রের চলে না, বিশেষ করে যে রাষ্ট্রের ব্রত হল জনকল্যাণ

কথা হচ্ছিল, ‘সুপারে’র অফিস কামরায় বসে। টেবিলের উপর একটা খোলা ফাইল। তার ভিতরকার একটি সাম্প্রতিক সরকারী আদেশই ছিল আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। আদেশটি নারী-কয়েদী সম্পর্কে। সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধে বলা হয়েছে, এককালে ইম্‌প্রিজনমেন্ট, অর্থাৎ কারাদণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল দণ্ডিতের উপর রিট্যারিয়েশন প্রতিশোধ, বর্তমানে সভ্য রাষ্ট্রের শেষ কাম্য হল তার রিহ্যাবিলিটেশন, মুক্তির পর সমাজদেহে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তার জন্যে তাকে এমন একটি কার্যকরী বৃত্তি শিখিয়ে দেওয়া দরকার, বাইরে গিয়ে যার অনুসরণ করে সে সৎপথে জীবিকা-নির্বাহ করতে পারে।

এর পরেই আসল বক্তব্য : সরকার উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছেন, বিভিন্ন জেলে, বিশেষ করে ডিস্ট্রিক্ট জেলগুলোতে যেসব মেয়ে-কয়েদী থাকে, তাদের বেলায় ঐজাতীয় শিক্ষার কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। তার প্রধান কারণ, তারা সংখ্যায় এত অল্প যে ঐ ক’টি মেয়ে নিয়ে কোনো কুটির শিল্প গড়ে তোলা যায় না। এই সমস্যার একমাত্র সমাধান তাদের কুড়িয়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করা। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এই বৃহৎ সেন্ট্রাল জেলের একটি অংশকে পৃথক করে তৈরি হয়েছে বিস্তৃত জেনানা-ফাটক। তার ভিতরে নানা রকমের ওয়ার্কশপ, সবজি-বাগান, স্কুল, খেলা-ধূলার মাঠ, মায় সূতিকাগার (মাঝে মাঝে দু-একটি গর্ভিণী স্ত্রীলোকও আমদানি হয়ে থাকে) ও নার্স ট্রেনিং সেন্টার বা শুশ্রূষাকেন্দ্র ইত্যাদি।

সরকার আশা করেন, মেয়ে-কয়েদীরা যাতে করে এই ব্যাপক ব্যবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে ভবিষ্যতে কর্মঠ ও কুশলী নাগরিকে পরিণত হতে পারে, সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দেবেন।

অভিলাষবাবু যখন এই বিশেষ সেন্ট্রাল জেলের কর্ণধার হয়ে এলেন, তার আগেই বিভিন্ন জেল থেকে দুটি চারটি করে মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। মোট সংখ্যা পঞ্চাশের উপর। ওয়ার্কশপগুলো খুলবার আয়োজন চলছে।

তাঁর চার্জ নেবার দিনতিনেক পরের ঘটনা। মঙ্গলবার। জেনানা-ফাটকের সাপ্তাহিক প্যারেড। নতুন সুপারের প্রথম পরিদর্শন। মেট্রন এবং তার সহকারিণীরা ভোরবেলা থেকে তার আয়োজনে ব্যস্ত। স্বয়ং জেলার গিয়ে একবার তদারক করে এসেছেন। মাঠের ধারে গাছের ছায়ায় মেয়েরা লাইন করে দাঁড়িয়েছে। পরনে সদ্য-কাচা শাড়ি, তার উপর ফিমেল কুর্তা। বাকী কিট্স, অর্থাৎ জামা-কাপড়-চাদর-কম্বল সযত্নে পাট করে প্রত্যেকের পায়ের কাছে সাজানো, তার পাশে ঝকঝকে করে মাজা অ্যালুমিনিয়মের থালা-বাটি। সুপারের ‘ফাইল’-এ খোঁপা বা বিনুনি বাঁধা নিষিদ্ধ। মাথায় কাপড় দেবারও হুকুম নেই। তাই বলে রুক্ষ মাথায় থাকা চলবে না। সরকারী খরচে আয়না-চিরুনি এবং কিছুটা নারকেলের তেল সরবরাহ করা হয়। তার সদ্ব্যবহারে কোনো ত্রুটি হয় নি। গত কয়েকদিনের বরাদ্দ থেকে বাঁচিয়ে তেলের ব্যবহারটা বরং একটু অতিরিক্তই বলা চলে। মেট্রন বার বার করে শাসিয়ে দিয়েছেন, বড়সাহেব যখন সামনে দিয়ে যাবেন, সবাই যেন মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সেইটাই নিয়ম। নালিশ থাকলে তেমনি মাথা নীচু করে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে জানাতে হবে। চোখ তুলে তাকানো বেয়াদপি।

সপারিষদ অভিলাষবাবু সবেমাত্র লম্বা ‘ফাইল’-এর এক প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন, মেট্রনের বিচিত্র উচ্চারণের সামরিক বুলি—স্কোয়াড্ অ্যাটেনশন’ তখনও বাতাসে মিলিয়ে যায় নি—হঠাৎ এক বিপর্যয় কাণ্ড! কোথায় গেল ‘ফাইল’ আর কাপড়-চোপড় থালা-বাটির থাক! সব ভেঙে উল্টে দিয়ে নারীবাহিনীর প্রায় সবটা সক্রন্দনে ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল তাঁর পায়ের উপর। সকলে যে সে-পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না, তার কারণ এ নয় যে তাদের তরফে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল। তার কারণ, সুপার যত বড় লোকই হোন, তাঁর পায়ের সংখ্যা মাত্র দুই, এবং সেই দুটি চরণের পক্ষে একসঙ্গে শত হস্তের কবলে পড়া কোনোমতেই সম্ভব ছিল না।

চীফ হেড্‌ওয়ার্ডারের গর্জন এবং মেট্রন ও তার সহকীরিণীদের সবল হস্তক্ষেপে ভূলুণ্ঠিত বন্দিনীদের বহু কষ্টে টেনে তোলা হল। তারও বেশ কিছুক্ষণ পরে জানা গেল, এই সমবেত আবেদনের সুর ও ভাষা আলাদা হলেও বিষয় এক—সবাইকে অবিলম্বে যার যার ‘দেশের জেল’-এ পাঠিয়ে দেওয়া হোক। অভিলাষবাবুও সেই অনুমান করেছিলেন, এবং একে একে প্রশ্ন করে কারণ যেটা জানলেন, তাও তাঁর কাছে নতুন নয়। জেলে এলেও ঘর-সংসারের পাট তো আর শেষ করে দিয়ে আসে নি। সেখানে কেউ ফেলে এসেছে পাঁচ বছরের কচি বাচ্চা, কারও বা রয়ে গেছে বয়স্থা মেয়ে, রুগ্ন স্বামী, কিংবা বৃদ্ধ বাপ-মা। ওখানে থাকতে মাসান্তে কিংবা পক্ষান্তে একবার দেখা হত, লোহার জালে-ঘেরা গরাদের ফাক দিয়ে কথাবার্তাও হত দু-চারটা। এতদূরে আর সে সম্ভাবনা রইল না। আসবে কেমন করে? বুড়ো, কচি এবং মেয়েমানুষগুলোকে নিয়ে আসবে কে? সবচেয়ে বড় কথা, সে সঙ্গতি কই? বাড়ির সমর্থ পুরুষদের সে সময়ই বা কোথায়? সকলকেই উদয়াস্ত খেটে খেতে হয়, একদল পোষ্যকে খাওয়াতে হয়।

কোণের দিকে একটি কমবয়সী মেয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। তার ‘কারণ টা একটু অন্য ধরনের। মুখ ফুটে বলতে চায় না। দু-তিনবার জিজ্ঞাসার পর মেট্রনকে জানাল চুপি চুপি। মেদিনীপুর থেকে এসেছে; জাতে বাউরী। মরদটি তার লোক ভালো। তাহলেও পুরুষমানুষ, তার জোয়ান বয়স। দূরের বৌকে একদিন মন থেকে দূর করে দেবে না, কে বলতে পারে? একদিন নয়, দু-দিন নয়, তিন বছর। তারপর ফিরে গিয়ে দেখবে, তার জায়গা আর একজন এসে দখল করে বসেছে।

—তাই যদি করে, ওখানকার জেলে বসেই বা ঠেকাবে কেমন করে? প্রশ্ন করলেন অভিলাষবাবু, যদিও এর উত্তরটা তিনি জানেন। মেয়েটি জবাব দিল না। হয়তো লজ্জায়, কিংবা গুছিয়ে বলার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। বলতে পারল না, ঘরের সঙ্গে মানুষের যে বন্ধন, শ্রীঘরে আসবার পর সেটা আপনা থেকেই শিথিল হয়ে আসে। বিশেষ করে, সে মানুষ যখন মেয়েমানুষ, ঘর তার দিক থেকে বড় তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবু মাঝে মাঝে ও-তরফের একটুখানি চোখের দেখা, এবং এ-তরফের দু-এক ফোঁটা চোখের জল সে বন্ধনকে কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে। দীর্ঘদিনের অদর্শন ও অসংযোগ সেখানে দ্রুত ছেদ টেনে দিতে সহায়তা করে। মেয়েটি আরও বলতে পারত—এই দুর্ভাগা দেশে, বিশেষ করে সমাজের যে স্তর থেকে ওরা এসেছে ( জেনানা ফাটকে তাদের সংখ্যাই বেশি), স্ত্রী নামক পণ্যটি বড় সুলভ। ঘাটতি পূরণে দেরি হয় না। রাজসিংহাসনের মতো পুরুষের হৃদয় নামক আসনটিও বেশি দিন খালি থাকতে পারে না। রাখতে চাইলেও সংসার তার নানা প্রয়োজন নিয়ে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। সুতরাং একজন চোখের আড়ালে চলে গেলে, আরেকজন এসে তার জায়গা জুড়ে বসবে, তাতে আর আশ্চর্য কি? মেয়েদের জীবনে এই ‘জায়গা’টাই আসল। সেটি যদি চলে যায়, ফিরে গিয়ে পরিচিত গৃহকোণের সেই আশ্রয়টুকু না জোটে, তাহলে কোন্ কাজে লাগবে এই দূর কারাগার থেকে বয়ে নেওয়া তার কারিগরি বিদ্যার বোঝা?

অভিলাষবাবু এই কথাগুলোই ক’দিন ধরে মনে মনে নাড়া-চাড়া করে দেখলেন। তারপর গাঁটের পয়সা খরচ করে উঠলেন গিয়ে লালদীঘির উত্তর-পারে। বড়কর্তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন, এরা কয়েদী হলেও মেয়ে, এদের কাছে সামনের চেয়ে পিছনের টান বড়, আকাশ-বাতাসের চেয়েও বেশি সত্য মাটি। সেখান থেকে উপড়ে এনে যেখানে- সেখানে বসিয়ে দিলেই বাঁচবে এবং বাড়তে থাকবে, সে আশা করা যায় না। না, না, এ সেণ্টিমেন্টের কথা নয় (যদিও মেয়েদের বেলায় সে বস্তুটির দাম অনেক), এর প্রাক্‌টিক্যাল, অর্থাৎ বাস্তব দিকটাই বড়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদের ভবিষ্যৎ, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এদের জড়ো করা হচ্ছে, সেই রিহ্যাবিলিটেশনের প্রশ্ন। অর্থাৎ কাজকর্ম না হয় শেখানো গেল, তারপর?

বক্তব্যটাকে আরও বিশদ করবার চেষ্টা করেছিলেন অভিলাষবাবু। বলেছিলেন, পুরুষ-কয়েদীর কথা আলাদা, তাদের আমরা কিছু একটা শিখিয়ে দেবার চেষ্টা করি, তারপর মেয়াদ ফুরোলে গেটের বাইরে ছেড়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত। একটা রেলের পাস আর কিছু পয়সা হাতে দিয়ে বলি, চরে খাওগে। তারপর সে কী করে, কোথায় যায়, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু মেয়েগুলোর বেলায় তো তা বলা যায় না। পরের ভাবনাও ভাবতে হয়। পুরুষগুলো যেখানে-সেখানে পড়ে থাকতে পারে। রাত কাটাবার জন্যে মাথার উপর যা হোক একটা আচ্ছাদন যথেষ্ট। গাছতলাতেও বাধা নেই। কিন্তু এদের বেলায় বিধাতা সে সুবিধা দেন নি। কাজেই বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম প্রয়োজন একটি নিরাপদ আশ্রয়। নিজের ঘরের চেয়ে বাঞ্ছনীয় আশ্রয় আর কী আছে একটি মেয়ের জীবনে? আমরা যা কিছু করবো, সব সেইদিকে চেয়ে। চেষ্টা করবো, জেলে এলেও স্বামী- পুত্র, বাপ-মা-ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজনের সংস্পর্শে থেকে সে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে, তাদের কাছে ফিরে যাবার পথে কোনো রকম বাধা সৃষ্টি না হয়।

এই নতুন ব্যবস্থায় যে তা-ই হতে চলেছে, অন্য কেউ হলে উপরওয়ালাদের দরবারে সে কথাটা হয়তো একটু ঘুরিয়ে বলত। কিন্তু অভিলাষবাবুর ধরনটা চিরকালই খোলাখুলি, ইংরেজীতে যাকে বলে ব্লান্ট্। বলা বাহুল্য, কর্তারা সেটা মোটেই পছন্দ করেন নি। একজন মাঝারিগোছের মুরুব্বি ওঁর মতামত সরাসরি অগ্রাহ্য না করলেও স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এ বিষয়ে বর্তমান আদেশই বলবৎ থাকবে। বলেছিলেন, আরে মশাই, পুরো এক বছর লেখালেখির পর ফাইনান্স ডিপার্টমেণ্ট টাকা দিয়েছে। এখন যদি বলি দরকার নেই, তাদের কাছে মুখরক্ষা হয় কেমন করে?

এ হেন মোক্ষম যুক্তিও অভিলাষবাবুকে নিরস্ত করতে পারে নি। বিষয়টাকে আরও জোরদার করবার জন্য বক্তব্যগুলো লিখিতভাবে পেশ করতে মনস্থ করেছেন। একটা খসড়াও করে ফেলেছেন। আমার প্রয়োজন সেইখানে। কয়েকটা ফুলস্ক্যাপ কাগজ আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার কলম তা চিনি স্যার, একটু ছোঁয়া লাগিয়ে দিন।

বললাম, সে কলম বদলে গেছে অভিলাষবাবু। এর ছোঁয়ায় আপনার কাজ হবে না। বরং উল্টো ফল ফলতে পারে। তাছাড়া বুড়ো বয়সে সাধ করে কর্তাদের বিষনজরে পড়তে চাইছেন কেন?

—আপনিও এই কথা ভাবছেন!

—হ্যাঁ, নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।

অভিলাষবাবু স্পষ্টত নিরাশ হলেন। কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় চীফ হেড্‌ ওয়ার্ডার ঘরে ঢুকে সেলাম ঠুকে জানাল, জেনানা-ফাটকের ‘ফাইল’ রেডি।

—উঠিয়ে দাও। আজ আর সময় হবে না—

‘চীফ’-এর পিছনে মেট্রনকেও দেখা গেল। তার দিকে চেয়ে বললেন, তোমাদের নালিশ মানে তো ঐ একটি, শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। ওছাড়া আর কারও কিছু আছে নাকি?

—একটি মেয়ে বলছিল, তার কি একটা জরুরী নালিশ আছে।

–এখানে নিয়ে এসো।

উঠবার আয়োজন করছিলাম, দরজার দিকে নজর পড়তে আর ওঠা হল না। অজ্ঞাতসারে মুখ থেকে বেরিয়ে এল—কুসুম! মেট্রনের পিছনে যে মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ ভাবে ঘরে এসে ঢুকলো, সে কোনো জবাব দিল না। মেট্রনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। সহজ বিনীত সুরে বলল, আপনি ভালো আছেন? আমি জবাব দেবার আগেই অভিলাষবাবু হাত বাড়িয়ে তার টিকেটখানা নিতে নিতে বললেন, ওঁর সময় থেকেই আছ বুঝি এখানে?

কুসুম মৃদু হেসে বলল, না, মাঝখানে কিছুদিন বাইরে ছিলাম।

—আবার এলে যে! এ প্রশ্ন আমার। বিস্ময়ের ভাবটা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারি নি।

—আসতে হল। আঁচলের কোণটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে তেমনি হাসিমুখেই বলল কুসুম, যেন এই আসাটা নেহাৎ বেড়াতে আসার মতো।

—ওখানে থাকতে পারলে না বুঝি?

—কই আর পারলাম!

—লেডি ডাক্তার রাখলেন না?

—তিনি রাখতে চেয়েছিলেন, আমারই থাকা হল না।

—কী কেস্-এ এলে?

জবাব দিলেন অভিলাষবাবু—কেটি তো ভালোই দেখছি। একেবারে রাজসিক ব্যাপার—মার্ডার! আগে এসেছিলে কোন্ কেস্-এ?

—’সেটাও খুন।’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এবং তার মধ্যে দ্বিধা বা সঙ্কোচের চিহ্নমাত্র নেই। তবে নিজে করি নি, জড়িয়ে পড়েছিলাম—উনি সব জানেন।’ চোখের ইঙ্গিতে আমাকে দেখিয়ে দিল।

—এবার বুঝি নিজেই হাত লাগিয়েছ? হালকা সুরে বললেন অভিলাষবাবু। বহুদিনের পুরনো প্রবীণ জেল-অফিসার। এই জাতীয় খুনখারাপি ওঁর কাছে জল-ভাত। আমারও তাই। কিন্তু কুসুমের মুখ থেকে এবার যে জবাব এল, শুনে এবং তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম। এতক্ষণের সেই তরল সুর নয়। মুখের সে হাসি হাসি ভাবটাও সহসা কোথায় মিলিয়ে গেল। দু-চোখে আগুন ছড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চাপা কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, এবার নিজের হাতেই সাধ মিটিয়ে নিয়েছি।’

বলতে বলতে চোখ বুজল-গভীর আরামে, পরম তৃপ্তিতে আপনা হতেই যেমন করে ধীরে ধীরে নেমে আসে চোখের পাতা।

.

এই জেলেই কুসুমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা! সে দিনটা এখনও মনে আছে। ভারী মেয়াদ বলে কোন্ একটা ছোট জেল থেকে চালান হয়ে এসেছিল সেন্ট্রাল জেলে। নতুন আমদানী। তাই আমার অফিসে আনতে হয়েছিল, ভাষায় যাকে বলে ‘ভেরিফিকেশনে’র উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ জামা-কাপড় ইত্যাদি ওয়ারেন্টে যা লেখা আছে তাতে কোনো ভুল নেই, সুপারের সামনে এই তথ্যটি কবুল করিয়ে নেবার জন্যে। সকলের বেলাতেই সেই নিয়ম।

আমি মাথা নিচু করে কি লিখছিলাম, আচমকা নারীকণ্ঠের খিল্‌-খিল হাসি শুনে চোখ তুললাম। হাসিটা শুধু প্রগল্ভ নয়, অনেকটা নির্লজ্জ। ও দাঁড়িয়েছিল আমার মুখোমুখি, খানিকটা দূরে, দরজার ঠিক সামনে। কোনো কারণে সেদিন বিদ্যুৎ-সরবরাহ বন্ধ ছিল। আমার পিছনে দাঁড়িয়ে এক কয়েদী বড় একখানা পাখা নিয়ে আমাকে হাওয়া করছিল। তার দিকে আঙুল তুলে মেট্রনকে উদ্দেশ করে কলকণ্ঠে বলে উঠল, মিলেটার কাণ্ড দেখুন মাসিমা। পাখা-টাখা বন্ধ করে কীরকম চোখ করে তাকিয়ে আছে। গিলে খাবে নাকি? ওমা, একেবারে হুঁশ নেই!…. বলেই আবার সেই হাসি। মেট্রনের চাপা ধমক খেয়ে তার তোড়টা যেন আরও বেড়ে গেল। একঘর লোক। জেলর থেকে সিপাই, মেট—কোনো পদই বাকী নেই। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। যে-কাজে ওকে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেটা বন্ধ রেখেই তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা হল।

পাখা-চালানো কয়েদীটাকে মনে মনে বিশেষ দোষ দিতে পারি নি। কিছুক্ষণের জন্যে যদি তার বৈকল্য বা চিত্তবিক্ষেপ ঘটে থাকে, তার জন্যে দায়ী, যার দিকে তাকিয়ে সে ‘হুঁশ’ হারিয়েছিল তার প্রতি অঙ্গে সঞ্চরমাণ এক ধরনের অপর্যাপ্ত উদ্ধত যৌবন। কথাটা বোধ হয় স্পষ্ট হল না। যৌবন তো একটা বিশেষ বয়সে হয়। নারীদেহকেই আশ্রয় করে। কোথাও কোথাও তার উপচে-পড়া দুরন্ত বেগও দুর্লভ নয়। কিন্তু কুসুমের দেহে সেদিন যা দেখেছিলাম, তার মধ্যে এসব ছাড়িয়ে আরও কিছু ছিল, যা শুধু টানে না, টেনে নামায়। তার রেখায় রেখায় সর্বনাশের হাতছানি। অথচ রূপ বলতে যা বোঝায়, অঙ্গের সুষমা ও সৌষ্ঠব, তা তার ছিল না।

বিধাতার চক্রান্তেই হোক কিংবা ইচ্ছা করেই হোক, কাউকে টেনে নামাতে হলে নিজেকেও নামতে হয়। সে অলঙ্ঘ্য পরিণাম থেকে কুসুমও রক্ষা পায় নি। তার মায়ের বৃত্তি ধাইগিরি। বয়সকালে আরও কিছু করত, সেটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। ওদের বাড়িটা (অর্থাৎ ছোট একখানা চালাঘর এবং তার কোলে একচিলতে উঠোন) ছিল ছোট জেলা শহরের এক কোণে। মা ও মেয়ে মিলে সেখানে থাকত। বাবাকে কখনও দেখেছে কিনা মনে পড়ে না। যখন ছোট ছিল, অনেক রাত্রে কোনোদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে অন্য দু’একজনকে দেখেছে, যারা তাকে বাবার মতোই আদর করত। আরও একটু বড় হবার পর আর তাদের দেখতে পায় নি। তখন সে মায়ের সঙ্গে বেরোতে শুরু করেছে। মায়ের প্রকাশ্য ইচ্ছা বোধ হয় ছিল তার নিজের বিদ্যায় মেয়েকে তালিম দেওয়া। তার সঙ্গে আর কোনো গোপন মতলব ছিল কিনা কে বলতে পারে? মেয়ের কিন্তু সেই ‘আর কিছু’র দিকেই বেশি নজর। চারদিকের নানাবয়সী পুরুষের চোখে একটা বিশেষ দৃষ্টি এবং তার অর্থ তখন সে বুঝতে শিখেছে।

কুসুমের নামকরণ কে করেছিলেন, জানবার উপায় নেই। শিশু বয়সে হয়তো তার সার্থকতা ছিল, যেমন সব শিশুরই থাকে। যৌবনে পৌঁছতে না পৌঁছতেই যখন দেখা গেল ফুল হয়ে ফোটার চেয়ে আগুন হয়ে জ্বলার দিকেই তার গতি, তখন যেসব পতঙ্গের দল সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে শুধু একজনের কথা আমার জানবার সুযোগ হয়েছিল, তার, নাম অনাথ মল্লিক।

অনাথের চাকরি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে। পৈতৃক বাড়ি রয়েছে জেলা শহরে। অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল, বয়স তিরিশের কোঠায়। পাড়ার ব্যায়ামশালায় তৈরি সবল সুস্থ দেহ। বাপ-মা নেই। দুটি ভাই, দুজনেই চাকরিসূত্রে প্রবাসী। একমাত্র স্ত্রী নিয়ে সংসার। সুন্দরী বলে তার খ্যাতি আছে। নাক-চোখ-রং—কোনোটার তুলনা নেই, তবে বড্ড রোগা গড়ন। তার উপরে মাস পূর্ণ হবার আগেই প্রথম সন্তানটি নষ্ট হবার পর স্মৃতিকায় ভুগে ভুগে গায়ে আর মাংস নেই। তার মধ্যে আবার মা হতে চলেছে।

আগের বারে কুসুমের মা-ই খালাস করেছিল। এবার হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডের ‘ডাক্তারকে বলা আছে। পুরনো ধাই অবশ্য সঙ্গে থাকবে। কিন্তু প্রসবের রাত্রে তাকে পাওয়া গেল না। বিকালেই দূরে কোথায় ‘কল্’-এ বেরিয়ে গেছে। তার বদলে এল কুসুম শুধু এল না, রয়ে গেল কঙ্কালসার প্রসূতি এবং তার ক্ষীণজীবী নবজাতকের ভার নিয়ে। ডাক্তারই ব্যবস্থা করে দিলেন। মেয়েটির সেবাপরায়ণ সুনিপুণ হাত দুটিই কেবল তাঁকে আকৃষ্ট করে থাকবে, বাকী অঙ্গের সর্বনাশা আকর্ষণ হয়তো প্রৌঢ় ভদ্রলোকের নজরে পড়ে নি।

তাঁর না পড়লেও পড়ল আরেকজনের। আগুনের স্পর্শেই আগুন জ্বলে ওঠে। একদিনের অগ্নিস্রাবী যৌবন আরেকদিকের লালসা-বহ্নিকে উদ্দীপ্ত করে তুলল।

কদিন যেতে না যেতেই রূপহীনার কাছে হার হল রূপসীর। পতিগতপ্রাণা সাধ্বী স্ত্রীর পবিত্র আসন ছিনিয়ে নিয়ে গেল তারই স্বৈরিণী পরিচারিকা। দীর্ঘ দাম্পত্যবন্ধন, শিক্ষাদীক্ষা, নৈতিক আদর্শ, লোকলজ্জা, ভয়—কিছুই টিকল না। বহুদিনের অতৃপ্ত দীর্ঘসঞ্চিত ক্ষুধা রুগ্না ক্ষীণাঙ্গীর শীতল সঙ্গ যা মেটাতে পারে নি। তৃপ্তি খুঁজতে গেল স্থূল মাংসপিণ্ডের উত্তপ্ত উত্তেজনায়।

মাস দুয়েকের মধ্যে এবারকার বাচ্চাটিও মায়ের কোল ছেড়ে চলে গেল। প্রসূতি তখন চলতে ফিরতে পারে না, সবে উঠে বসে বিছানার উপর। সুতরাং ঝি-এর প্রয়োজন শেষ হল না। তার চেয়ে বড় প্রয়োজন তখন দেখা দিয়েছে অন্যখানে।

একদিন গভীর রাত্রে মনিবের গাঢ় আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে কুসুম বলল, এবার ঘরে যাও।

—কোন্ ঘরে? যেন বুঝতে পারে নি এমনি সুরে বলল অনাথ

–কোন্ ঘরে আবার! তোমার বৌয়ের কাছে। একলা পড়ে আছে বেচারা।

—থাক, তোকে আর অত দরদ দেখাতে হবে না।

—না সত্যি, যদি জানতে পারে?

—পারলেই বা, জেনে করবেটা কী?

—বাঃ, তাড়িয়ে দেবে না আমাকে?

—সে তাড়াবার কে? আমি তোকে রেখে দেবো।

—তুমিই বা আর কদ্দিন রাখবে? আর একটু ভালো হলেই তো—

—তখনও তোকে থাকতে হবে। তোকে আমি কোনোদিন ছাড়বো না।

বলে ওকে আরও কাছে টেনে নিল। কুসুম আর কথা বলল না। সেই বলিষ্ঠ নিবিড় বাহুবন্ধনে নিজেকে সঁপে দিয়ে চোখ বুজল। পুরুষের বাহুপাশে ধরা দেওয়া কুসুমের কাছে এই নতুন নয়। এর স্বাদ সে এর আগে আরও পেয়েছে। কিন্তু এই সবল পেষণের মধুর যন্ত্রণা এমন করে আর কোথাও উপভোগ করে নি। আজ হোক, কাল হোক, একদিন এখান থেকে চলে যেতে হবে, এ চিন্তা তার কাছেও দুঃসহ। এই উত্তপ্ত আশ্রয়টুকু যদি চিরদিনের হত!

এর দিন কয়েক পর অনাথ অফিস থেকে ফিরে চা খাচ্ছে। চাকর এসে জানাল, ‘মা’ তাকে ডাকছেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই স্ত্রীর ঘরে ঢুকে, মাঝে মাঝে যেমন করে, জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন আছ?

হৈমন্তী সে প্রশ্নের উত্তর দিল না, একটু উষ্মার সুরে বলল, কুসুমের আর দরকার নেই, এখনি বিদায় করে দাও।

কথাগুলোর মধ্যে যে উত্তাপ ছিল সেটা গায়ে না মেখে অনাথ বেশ সহজ ঠাণ্ডা সুরেই বলল, তার জন্য ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তুমি আগে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠো!

—না, ওকে আজই ছাড়িয়ে দিতে হবে।

ভিতরে যাই ঘটুক, মল্লিকের মুখে বা কথায় তখনও কোনো বিরক্তি বা উত্তেজনা প্রকাশ পেল না—’আজই কি করে দিই? মাইনে চুকিয়ে দিতে হবে তো। মাসের শেষ, অত টাকা কোথায়?’

দু-হাতে দু-গাছা বালা ছাড়া হৈমন্তীর দেহে তখন আর কোনো অলঙ্কার ছিল না। হঠাৎ তারই একটা খুলে নিয়ে স্বামীর দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, এই নাও। এটা বিক্রি করলেই বোধ হয় কুলিয়ে যাবে।

—মাথা খারাপ করো না হৈম—গম্ভীর ভর্ৎসনার সুরে এই ক’টি কথা বলেই অনাথ বেরিয়ে যাচ্ছিল, স্ত্রীর চিৎকারে ফিরে দাঁড়াল। হৈমন্তী এতক্ষণ শুয়ে শুয়েই কথা বলছিল, অকস্মাৎ উঠে বসে তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ও যদি আর একটা রাতও এ বাড়িতে থাকে, আমি মাথা খুঁড়ে মড়বো।

—তাই মর।

—কী বললে? আমি মরলে তোমার ভারি সুবিধে, পথের কাঁটা সরে যায়, না? বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল। অনাথ আর দাঁড়াল না।

কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে কুসুম আগাগোড়া সবটাই দেখল এবং শুনল।

তখন কিছু বলল না। সন্ধ্যার পর তার ছোট্ট পোঁটলাটা হাতে করে বাইরের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে বলল, আমি তাহলে যাই বাবু। মাইনের জন্যে তুমি ভেবো নি। মাস লাগলে মা এসে নিয়ে যাবে।

অনাথ প্রথমটা ওকে দেখতে পায় নি। নিবিষ্ট মনে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ চমকে উঠে বলল, কী বলছিস? না, তোর যাওয়া হবে না।

—থেকে করবোডা কী?

—কেন?

কুসুম এক পলক এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ঘরে ঢুকতে মানা করে দেছে।

—ঢুকতে হবে না তার ঘরে। তুই—তুই এমনি থাকবি। আমার কাছে থাকবি।

পরদিন থেকে শুরু হল নিত্য বিসংবাদ। যখন-তখন কথা-কাটাকাটি। ক্রমশ স্বামী-স্ত্রী কারও মুখেই আর বল্গা রইল না। দুজনের মধ্যে যে শালীনতার আড়ালটুকু ছিল, তাও ঘুচে গেল। দীর্ঘকাল রোগে ভুগে পর পর দুটি সন্তান হারিয়ে হৈমন্তীর আগে থাকতেই মাথার ঠিক ছিল না, তারপর নিজের চোখের উপর সংসারের মধ্যে বসে স্বামীর এই শোচনীয় বিবর্তন—সংযম ও সহিষ্ণুতার শেষ বাঁধ ভেঙে পড়ল। ওষুধ ঢেলে ফেলে, ভাতের থালা উল্টে দেয়, পাড়ার কোনো গৃহিণী ইনিয়ে-বিনিয়ে সহানুভূতি জানাতে এলে কড়া কথা শোনাতে ছাড়ে না। পুরনো ঠাকুর আগেই চলে গিয়েছিল, নতুন যে-ই আসে দু-দিনও টেকে না। ফলে সংসারের সব ভার আপনা থেকেই পড়ল গিয়ে কুসুমের হাতে। সে কদিন যাব-যাব করলেও যেতে পারল না।

হৈমন্তীর মা নেই। বাপ থাকেন অনেক দূরে, দক্ষিণ বাংলার কোনো দুর্গম গ্রামে। দু-পুরুষ-আগে একটা ছোটখাটো জমিদারী ছিল। ইদানীং প্রায় বিত্তহীন। সে প্রতাপ নেই, কিন্তু তার তাপটা রয়ে গেছে। হঠাৎ একটা উড়ো চিঠি পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ছুটে এলেন। কুসুম-ঘটিত ব্যাপারটা বেশ কিছুটা অতিরঞ্জিত হয়ে তাঁর কানে গিয়ে থাকবে। এসে যেটুকু দেখলেন, তাও কম নয়। তার উপরে মেয়ের শরীরের এই অবস্থা। অন্য কেউ হলে হয়তো মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার চেষ্টা করতেন। খুব সম্ভব ভূতপূর্ব জমিদারের উষ্ণ রক্ত সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। জামাতার সঙ্গে একবার দেখা করবারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। সোজা গিয়ে হাজির হলেন থানায়।

পুলিস এসে অনাথের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছুই পেল না। রুগ্না স্ত্রীর উপর ‘অপ্রেশান বা অত্যাচারের অভিযোগ হৈমন্তী নিজেই অস্বীকার করল। বাবা বোঝাতে চাইলেন, ঐ রকম একটা সোমত্ত ঝিকে যে তাঁর মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়িতে পুষে রাখা হয়েছে, এইটাই তো সব চেয়ে বড় অত্যাচার। দারোগা হেসে চলে গেলেন।

জামাইকে অন্য কোন উপায়ে ঢিট করা যায় কিনা, দু-একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে বসে সে বিষয়ে যখন পরামর্শ করছেন, তখন দেশ থেকে নিজেরই কোনো মামলা-সংক্রান্ত জরুরী টেলিগ্রাম পেয়ে তাঁকেও হঠাৎ চলে যেতে হল। মেয়েকে আশ্বাস দিয়ে গেলেন, ওদিকের ঝামেলা মিটলেই আবার আসবেন।

পুলিস কেস্ না নিলেও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান (শহরের একজন প্রবীণ উকিল) অনাথকে ডেকে উপদেশের ছলে খানিকটা সাবধান করে দিলেন। উড়ো চিঠি তাঁর হাতেও পড়ে থাকবে। অনাথ আগুন হয়ে ফিরল। শ্বশুরকে এবং মনিবকে তাতিয়ে তোলার ব্যাপারে সাক্ষাৎভাবে পাড়ার কয়েকটা ছেলে-ছোকরার হাত আছে, একথা সে জানত। কিন্তু তার পিছনে হৈমন্তী নেই, এটা সে মনে মনে মেনে নিতে পারল না। ঐ ছোঁড়াগুলোর সঙ্গে নিশ্চয়ই তার গোপন যোগাযোগ আছে। কেউ কেউ তার ওখানে আগে থেকেই আসে যায়। ওকে দাদা এবং সেই সুবাদে হৈমন্তীকে বৌদি বলে ডাকে। হয়তো তাদের কাউকেই এইসব কাজে লাগানো হচ্ছে। অসুবিধা কিছুই নেই। মেয়েমানুষের যেটা প্রকৃতিদত্ত মূলধন চোখের জল, তার খানিকটা খরচ করলেই হল। সঙ্গে সঙ্গে ‘ঠাকুরপোদের’ শিভালরি মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। কিন্তু আর নয়—তারই ঘরে বসে তার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র, এখানে সেখানে অপদস্থ করবার অপচেষ্টা এবং শেষ পর্যন্ত চাকরি ধরে টানাটানি কিছুতেই বরদাস্ত করবে না—আজই একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতে হবে।

চেয়ারম্যানের কাছ থেকে অনাথ যখন ছাড়া পেল, তার আগেই সন্ধ্যা উরে গেছে। অনেকখানি পথ, বাড়ি ফিরতে রাত হল। ঠিক শহর নয়, শহরতলী। পাশেই রেল লাইন। ফাঁকা ফাঁকা বাড়ি। এমনিতেই লোক-চলাচল কম। এখন রাস্তা একেবারে খালি। প্রায় বাড়িতে আলো নিভে গেছে। হৈমন্তী তখনও জেগে। তার ঘরের দরজা আধ-ভেজানো। ভিতরে আলো জ্বলছে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কী একটা লিখছিল। বাইরে থেকেই নজরে পড়ে। অনাথ দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই ধমকের সুরে বলল, চেয়ারম্যানকে কী লিখেছ আমার বিরুদ্ধে?

হৈমন্তী ঘাড় ফিরিয়ে স্বামীর দিকে একটা অবজ্ঞা-কুঞ্চিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার লেখায় মন দিয়ে বলল, কে চেয়ারম্যান?

—ন্যাকামো করো না। চেয়ারম্যান কে তা তুমি জানো। তাকে চিঠি লিখবার মতো সাহস তোমার এল কোত্থেকে?

—আমার দায় পড়েছে তাকে চিঠি লিখতে।

—না লিখলে আমার সংসারের খবর তার কানে যায় কেমন করে?

—সংসারের খবর মানে? এবার উঠে বসল হৈমন্তী, ঐ মাগীটাকে নিয়ে যে ঢলাঢলি চালিয়েছ সে খবর কার জানতে বাকী আছে, শুনি?

—ইতরের মতো মুখ-খারাপ করো না। গর্জে উঠল অনাথ।

হৈমন্তীর মুখেও পালটা গর্জন—ইতর আমি না তুমি? তুমি বলে এখনও লোকের কাছে মুখ দেখাও, অন্য কেউ হলে—তীব্র উত্তেজনায় বাকীটা আর বলা হল না।

অনাথ কিছুমাত্র দমে না গিয়ে বলল, আমার যা খুশী তাই করবো। তোমার না পোষায় চলে যাও, বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।

হৈমন্তী তখনও হাঁপাচ্ছিল। কোনোরকমে দম নিয়ে ক্ষীণ-কণ্ঠে বলল, বেশ, তাই যাচ্ছি। তার আগে, অ্যাদ্দিন যা করি নি, তাই করবো। পাড়ার দশজনকে ডেকে

—খবরদার! রুখে উঠল অনাথ। কারও কাছে যাবে তো তোমারই একদিন কি আমারই একদিন।

—আমি যাবো, কী করবে তুমি?

দরজার দিকে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই অনাথ একটা বাহু ধরে এক ঝটকায় তাকে খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। হৈমন্তীর শীর্ণ দুর্বল দেহ প্রথমে খাটের পাশে এবং তারপর গড়িয়ে মাটিতে পড়ল। আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

তীব্র বিহ্বল দৃষ্টি মেলে অনাথ শুধু তাকিয়ে রইল স্ত্রীর দিকে। ঐ সঙ্গে সেও যেন অসাড় হয়ে গেছে। হঠাৎ চোখে পড়ল, কুসুম এসে ঝুঁকে পড়ে কি দেখছে। পরক্ষণেই কানে গেল তার ত্রস্ত-কণ্ঠ—ঠাকুর, শীগগির এক বালতি জল নিয়ে এসো।

জল এল। কোলের উপর মাথা রেখে কুসুমই ঘটির পর ঘটি জল ঢেলে চলল। কিছুক্ষণ পরে কী মনে হতে নাকের নীচে হাত দিল, সেই হাতটাই রাখল একবার বুকের বাঁদিকে, বাঁ হাতের কব্জিটাও টেনে নিয়ে দেখল। তারপর চোখ তুলে মনিবের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ঠোটে একটা বিকৃত ভঙ্গী করে নীরবে মাথা নাড়ল।

একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তারকে বলতে শুনেছি, ‘মায়ের কোলে যখন সন্তান আসে, যম তার শিয়রে ওত পেতে বসে থাকে। তাই যদি হয়, সব ক্ষেত্রেই সে শূন্যহাতে ফিরে যাবে, এতটা আশা করা যায় না। যেখানে মানুষে-যমে টানাটানি, কিছু ভাগ সে দেবতাটির হাতে পড়বেই। সুতরাং মায়ের (এবং ইদানীং তার নিজেরও) পেশার দৌলতে মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় কুসুমের একাধিকবার ঘটে গেছে। হৈমন্তীর নিমীলিত চোখ দুটি যে আর খুলবে না, এটা সে নিঃসন্দেহে বুঝতে পেরেছিল। তবু সম্ভবত মনিবকে প্রবোধ দেবার উদ্দেশ্যে তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, ডাক্তারবাবুকে একটা খবর দিলে হয় না?

কথাটা কানে যেতেই অনাথ হঠাৎ চমকে উঠল। খানিকটা ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কি দেখল। তারপর ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

কুসুম আর কিছু বলল না। হৈমন্তীর মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে কাঁধ আর হাঁটুর নীচে হাত দিয়ে শীর্ণ হালকা দেহখানা অনায়াসে তুলে নিয়ে খাটের উপর শুইয়ে দিল। পায়ের কাছে গুটিয়ে রাখা চাদরটা ধীরে ধীরে গলা পর্যন্ত টেনে এনে মুখটা ঢাকতে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত সেইদিকে নিঃশব্দে চেয়ে রইল। তারপর তাড়াতাড়ি ঢাকা দিয়ে দিল।

আমার পাঠক-পাঠিকাদের, বিশেষ করে পাঠিকাদের ওষ্ঠাগ্রে একটি সন্দিগ্ধ হাসির কুঞ্চন আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি। তাঁরা ভাবছেন, এই শেষের ছত্র দুটি আমার রচনা সন্দেহটা অযৌক্তিক নয়। তবু বলছি, না, এ আমার কল্পনা নয়, কুসুমই বলেছিল এবং সম্ভবত আমার মুখে অজান্তে ফুটে ওঠা কোনো বিস্ময়চিহ্ন লক্ষ্য করে একটা সকুণ্ঠ কৈফিয়তও জুড়ে দিয়েছিল ঐ সঙ্গে। তার নিজের ভাষায় বলেছিল, বেঁচে থাকতে একটিবারও সে আমার দিকে ভালো চোখে তাকায় নি, একটা কথাও কোনদিন ভালোভাবে বলে নি আমার সঙ্গে। তাই মরবার পর তার আসল মুখখানা দেখতে ইচ্ছা হল। দেখলাম সত্যিই রূপ ছিল মেয়েটার। কিন্তু কি কাজে লাগল সে রূপ!

এইটুকু বলেই কুসুম সে প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে কাজের কথায় চলে গিয়েছিল। পলকের তরে তাকাতে গিয়ে একটা মৃদু নিঃশ্বাস বেরিয়ে এসে যদি সেই মৃত্যু-শীতল মুখখানাকে স্পর্শ করে থাকে, সে নিজেই জানতে পারে নি। জানলেও সে তথ্যটুকু আমার কাছে অনুক্ত রয়ে গেছে। এ দৌর্বল্য যে তার পক্ষে একেবারে বেমানান, তার চরিত্রের এবং পূর্বাপর আচরণের সঙ্গে সঙ্গতিহীন, এ সহজ কথাটা আমি যেমন বুঝি, তারও না বোঝবার কথা নয়। তাকে আর যা-ই বলা যাক, নির্বোধ বলা চলে না।

.

অনাথ সেই যে গেল আর দেখা নেই। গেলই বা কোথায়? এদিকে রাত বেড়ে চলেছে। একটা দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ লাগে? তার জের অত সহজে মেটে না। সবচেয়ে বড় পর্বটাই যে বাকী। তার আয়োজন এখন থেকেই শুরু করা দরকার। কুসুম উঠে পড়ল। হঠাৎ মনে হল, সে কে? তার এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার কী প্রয়োজন? তার কাজ তো ফুরিয়ে গেছে। অনেকদিন আগেই গেছে। তবু এতদিন এখানে পড়ে থাকবার একটা অজুহাত ছিল। লোকের কাছে একটা পরিচয় ছিল। ঝি, অসুস্থ গৃহিণীর সেবাদাসী। আজ তাও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এইটাই কি তার একমাত্র পরিচয়? এর অন্তরালে—ভাবতে গিয়ে কুসুমের গোপন মনে এক ঝলক পুলক ছড়িয়ে গেল। আজ সব বাধা ঘুচে গেছে। এত শীঘ্র যে ঘুচবে, কে ভেবেছিল?

পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ল আপাদমস্তক চাদর ঢাকা হৈমন্তীর দেহটার উপর সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে একটা কোন্ অজানা ভয়ের কালো ছায়া ধীরে ধীরে উঠে এসে তার সমস্ত বুকটা গ্রাস করে ফেলল। ঐ মৃত্যুর সঙ্গে কোথায় যেন তারও একটা যোগ আছে। তৎক্ষণাৎ চোখ ফিরিয়ে নিল। এই অশুভ চিন্তাটাকে মন থেকে জোর করে ঝেড়ে ফেলতে চাইল— না না, এসব কী ভাবছে সে? ওর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? এ মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়। তাই কী? অনাথ কী তাকে ঠেলে ফেলে দেয় নি? হ্যাঁ, সে তো শুধু ওকে বাধা দেবার জন্যে। ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে গিয়ে লোকজন ডেকে একটা হাঙ্গামা বাধিয়ে না বসে এই জন্যে। মেরে ফেলতে সে চায় নি। মনে মনে সে উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ছিল না। পাড়ার লোকগুলো তো এমনিতেই অনাথের বিরুদ্ধে মুখিয়ে আছে, এরকম একটা সুযোগ পেলে তার উপর এক হাত নেবার চেষ্টা না করে ছাড়ত না সেই কথা ভেবে নিতান্ত বাধ্য হয়েই সে বৌয়ের গায়ে হাত তুলেছিল, তার ফল যে এমন সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়াবে কে ভাবতে পেরেছিল?

কিন্তু এর উল্টো দিকটাও ভাবল কুসুম—এ-কথা যদি লোকে বিশ্বাস না করে? যদি বলে, অনাথ তার স্ত্রীকে ইচ্ছা করে খুন করেছে? তাকেও এর মধ্যে জড়িয়ে ফেলা কঠিন নয়। বাবুর সঙ্গে তার গোপন সম্পর্ক জানাজানি হতে বাকী নেই। হৈমন্তীর বাবা এসে একবার এই নিয়ে হৈ-চৈ বাধিয়ে দিয়েছিল। কিছু অবশ্য করতে পারে নি। এবার এই মৃত্যুটাকেই হয়তো কাজে লাগিয়ে দেবে। পাড়ার ছোকরাগুলো বলে বসবে—ঐ বৌটাই ছিল ওদের পথের কাঁটা। দুজনে মিলে তাকে রাতারাতি শেষ করে দিয়েছে।

কুসুম এবার নিজের দিকটা আলাদা করে ভাবতে চেষ্টা করল। সত্যি সত্যি সে তো কোনো দোষ করে নি। তবে তার ভয় কিসের? সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, সংসারে ক’টা সত্যি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে? বেশির ভাগই তো মিথ্যার জয়-জয়কার। তার কঠোর দৃষ্টান্ত

এইটুকু বয়সেই কতবার তার চোখে পড়েছে। নিজেও সে ঘা কম খায় নি। সুতরাং আর নয়, এবার এখান থেকে তার বিদায়ের পালা। লোকজন এসে পড়বার আগেই তাকে চলে যেতে হবে। তখন এখানে থেকে সে করবেই বা কী? তাই বলে বাবুকে না বলে সে পালিয়ে যেতে চায় না, দেখা করে বলে-কয়েই যাবে।

অনাথ বাড়িতেই ছিল। কুসুমকে বেশি খুঁজতে হল না। ওদিকের ঘরে ও বারান্দায় না পেয়ে বাইরের ঘরে গিয়ে দেখল সে অন্ধকারে চুপ করে বসে আছে। মিনিটখানেক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, রাত যে কাবার হয়ে এল বাবু, এখন কি হাত-পা কোলে করে বসে থাকার সময়?

অনাথ সাড়া দিল না, যেমন ছিল তেমনই নিশ্চল হয়ে রইল। কুসুম আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই, যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল। মুখ তুলে বলল, কোথায় যাচ্ছিস?

—কোথায় আবার, বাড়ি!

—এই দুঃসময়ে তুইও আমাকে ছেড়ে যাবি কুসুম?

সহসা উঠে এসে ওর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, জানিস তো, তুই ছাড়া আপন বলতে আমার আর কেউ নেই। তার ওপরে চারিদিকে শত্রু। তোকে আমি কিছুতেই যেতে দেবো না। বলে আরও খানিকটা কাছে টেনে নিল।

এ আকর্ষণ কুসুমের কাছে দুর্নিবার। তবু বলল, আমি মেয়েমানুষ, আমাকে দিয়ে আর কতটুকুন কি হবে? তাছাড়া পাড়ার পাঁচজন এসে—

—কেউ আসবে না। মাঝখানে বাধা দিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল অনাথ।

—বাঃ, ঘাটে নিতে লোকজন লাগবে না?

অনাথ এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে শুধু বলল, একমাত্র তোকেই আমার দরকার কুসুম, আর কাউকে চাই না।

কথাটার তাৎপর্য বুঝতে না পেরে কুসুম বিস্মিত দৃষ্টি মেলে শুধু তাকিয়ে রইল। অনাথ তার বাহু ধরে জানালার ধারে নিয়ে গিয়ে একটা টুলের উপর বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসল তার মুখোমুখি। আলো জ্বালা হল না, তার প্রয়োজনও ছিল না। কৃষ্ণপক্ষের রাত। দূরে গাছপালার উপর থেকে হেলে-পড়া শীর্ণ চাঁদ জানলাপথে যে ক’টি চূর্ণ রশ্মি পাঠিয়ে দিয়েছিল, তাতেই তারা পরস্পরের মুখ দেখতে পাচ্ছিল। কুসুমের একটা হাত নিজের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে তার চোখে চোখ রেখে অনাথ তার পরিকল্পনার খানিকটা আভাস দিতেই সে চমকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল কয়েকটা ভীত- বিহ্বল শব্দ—”না না, এ আমি পারবো না।’ হাতটাও ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল। অনাথ ছাড়ল না, জোর করে তাকে টেনে এনে নিজের পাশটিতে বসিয়ে দিল। এক হাতে তার দেহ বেষ্ঠন করে আর এক হাতে চিবুকটা তুলে ধরে বলল, তোর কোনো ভয় নেই কুসুম। এতটুকু বিপদের আশঙ্কা থাকলে তোকে আমি এর মধ্যে টানতে পারি? তাছাড়া আমি তো তোর সঙ্গেই থাকবো। চল, আর দেরি করলে লোকজন উঠে পড়বে।

কুসুমের কাছ থেকে তখনও কোনো সাড়া না পেয়ে অনাথ তাকে ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ক্ষুব্ধ উদাস সুরে বলল, থাক, তোর যখন ইচ্ছে নেই, আমি জোর করতে চাই না। মনে করেছিলাম, এই ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলে কাল সকালেই আমরা এ-দেশ ছেড়ে চলে যাবো, তোকে নিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধবো। এ সাধ কি আমার আজকের? কবে কেমন করে তা সফল হবে ভেবে পাই নি। ভগবানকে কত ডেকেছি। কে জানত এত শীগগির সাড়া পাবো, এমন করে রাতারাতি আমার সৌভাগ্যের দ্বার খুলে যাবে। কিন্তু ভাগ্যদেবী যখন মুখ তুলে চাইলেন, যাকে ঘিরে এত আশা, এত স্বপ্ন, সে রইল মুখ ফিরিয়ে। যাক, তোকে আর আটকে রাখবো না। বাড়ি যেতে চেয়েছিস, তাই যা। আমার অদৃষ্টে যা আছে তাই হবে।

টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সেদিকে চেয়ে কুসুমের বুকের ভেতরটা হঠাৎ মুচড়ে উঠল। বলল, শোনো!

অনাথ ফিরে দাঁড়াল। কুসুম উঠে এসে ওর একান্ত কাছটিতে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, ঠাকুরটা যে সব দেখে ফেলেছে!

অনাথ যেন একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে দু-পা পিছিয়ে গেল। চোখের তারায় ফুটে উঠল ত্রাসের ছায়া। এই অবাঞ্ছিত লোকটাকে সে একেবারে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু কুসুম ভোলে নি। পুরুষের চেয়ে স্ত্রী চিরদিনই বেশি হুঁশিয়ার। পুরুষ চলে ভাবাবেগে, ঝোঁকের বশে তার দৃষ্টি শুধু সুমুখপানে, স্ত্রীজাতি কোনো অবস্থাতেই তার বাস্তব বুদ্ধি হারায় না। ডাইনে বাঁয়ে না তাকিয়ে পা বাড়ায় না।

ঠাকুরের খোঁজ করা হল। ঘরে বাইরে কোথাও তার পাত্তা নেই। কুসুম এদিক-ওদিক খানিকটা তাকিয়ে ঘরে এসে বলল, চলে গেছে।

—চলে গেছে!

—হ্যাঁ, জামা-কাপড় কিচ্ছু নেই।

শুনে যেন কিছুটা আশ্বস্ত হল অনাথ। বলল, ভয় পেয়ে পালিয়েছে। তার মানে ওর দিক থেকে কোনো আশঙ্কা নেই। ভালোই, না পালালেই বরং মুশকিল ছিল। চল আমরাও বেরিয়ে পড়ি। রাত আর নেই বলে কুসুমের কাঁধের উপর হাত রেখে হৈমন্তীর ঘরের দিকে অগ্রসর হল।

কুসুম তখনও দ্বিধাগ্রস্ত। কিছুতেই মনস্থির করতে পারছে না। চলছে আর ভাবছে, কী করবো! ‘একটা পা সামনে ফেলছি তো আর একটা পা পিছনে থেকে টানছে।’

ছেলেমানুষ নয় যে নিজের অবস্থাটা বুঝতে পারছে না। তার উপরে যে ঘরে যেসব পারিপার্শ্বিকের মধ্যে মানুষ, সংসারের আসল রূপটা আগেই অনেকখানি চেনা হয়ে গেছে। সেই রাত্রে অনাথ মল্লিক তাকে দিয়ে যা করাতে চাইছিল, তার মধ্যে ঝুঁকি অনেক, সহজ বুদ্ধি দিয়েই তা সে বুঝতে পেরেছিল। সেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ কতখানি বিপদসঙ্কুল, সে সম্বন্ধেও সে সচেতন ছিল না তা নয়। তবু কী ছিল ঐ লোকটার স্পর্শে, চোখে এবং কথায়, বিশেষ করে চোখ দুটিতে (একথা সে অনেকবার বলেছে), যার কাছে নিজেকে ধরে রাখা যায় না, সমস্ত অঙ্গ শিথিল হয়ে পড়ে, তীব্র স্রোতের মুখে অসহায় তৃণখণ্ডের মতো সারা মন ভেসে যেতে চায়। আসন্ন ভবিষ্যতের যে রমণীয় চিত্র সে কিছুক্ষণ আগে চোখের উপর তুলে ধরেছিল, তাও ওকে কম প্রলুব্ধ করে নি। তার মধ্যে একদিকে ছিল মদিরা, তার উদগ্র যৌবন যার জন্যে তৃষ্ণার্ত, আরেকদিকে ছিল স্নিগ্ধ বারি, যার স্পর্শে চির-গৃহলোলুপ নারীর শাশ্বত পিপাসা তৃপ্ত হয়।

এতগুলো প্রবল আকর্ষণ কুসুম সেদিন রোধ করতে পারে নি। তারা বিধাতা তাকে যেসব বৃত্তি ও প্রবৃত্তি দিয়ে গড়েছিলেন, হয়তো তার মধ্যেই না-পারার বীজ নিহিত ছিল। তাই সব কিছু ছেড়ে, সব বিপদ মাথায় নিয়ে সেদিন অনাথের সঙ্গেই সে নিজের ভাগ্যকে জড়িয়ে ফেলেছিল।

অনাথ মল্লিকের বাড়ির পিছনদিকে রেললাইন, মাঝখানে কোনো বসতি নেই। একটা অযত্নরক্ষিত বাগান আর কিছু ঝোপঝাড়, জঙ্গল। তার পাশ দিয়ে একফালি পায়ে চলার পথ রেলপথের গায়ে গিয়ে পড়েছে। শহরের প্রথম ট্রেন আসে ভোর পাঁচটার কিছু আগে, মফঃস্বলের বেশির ভাগ লোক তখন বিছানায়। স্টেশন দূরে নয়, ঘন ঘন হুইসিল্‌ দিতে দিতে এগিয়ে যায়, সেদিনও তাই যাচ্ছিল। যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গেল। গাড়ির লোকেরা ভাবল, সিগন্যাল নামে নি। ‘রেল-বাবুদের বোধ হয় ঘুম ভাঙেনি’—মন্তব্য করলেন কে একজন।

ড্রাইভার ব্রেক কষেই নেমে পড়েছিল। এঞ্জিনের পিছনেই যে কামরা, তার তলায় একবার উঁকি মেরে বিরস মুখে মাথা নাড়তেই ফ্যায়ারম্যান পাশ থেকে প্রশ্ন করল, সাবাড়?

অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ড্রাইভার কথা বলল না। সঙ্গীর হাতে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাড়াতাড়ি এঞ্জিনে স্টার্ট দিল। গাড়িটাকে ধীরে ধীরে কয়েক গজ পিছনে নিয়ে গিয়ে আবার থামিয়ে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে নেমে বলল, একেবারে দু-টুকরো হয়ে গেছে।

বিকৃত ওষ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল একটা আপসোস-সূচক শব্দ এবং তার সঙ্গে ‘সোয়ের’ Swear বা শপথ-জাতীয় বুলি, ওদের দোষ বা বিরক্তি প্রকাশের প্রচলিত বাহন। এক্ষেত্রে তার লক্ষ্য বোধ হয় সে নিজেই। কয়েক সেকেণ্ড আগে দেখতে পেলে এ দুর্ভোগটা এড়ানো যেত, কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে?

ফায়ারম্যানের বয়স বেশি নয়। এগিয়ে গিয়ে খণ্ডিত দেহটাকে ভালো করে ঠাহর করে বলল, মেয়েছেলে! ড্রাইভার ঝাঁঝিয়ে উঠল, না, মেয়েছেলে হবে কেন—তোর মতো একটা বুড়ো মদ্দ এসে লাইনের ওপর শুয়ে পড়েছে!

ততক্ষণে যাত্রীরাও অনেকে নেমে এসে ভিড় করেছে মৃতার চারিদিকে। নানা মুখে নানা ধরনের মন্তব্য—ইস্, একেবারে পেটের ওপর দিয়ে চলে গেছে চাকাটা!” ‘আহা, কাদের ঘরের বৌ গো!’ ‘কাঁচা বয়স মেয়েটার!’ ‘বাড়ির লোকেরা হয়তো কিছুই জানে না!’ ‘পুলিসে খবর দেওয়া দরকার।’

হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। একে ঠেলে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জনতা ফুঁড়ে এগিয়ে এল দুজন—একটি পুরুষ, অন্যটি স্ত্রীলোক। দুজনেই ছুটে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মৃতদেহের উপর। তারপর শুরু হল গগনভেদী বিলাপ। পুরুষটি বলছে, ‘এ তুমি কী করলে গো? তোমার মনে এই ছিল, একদিনও তো জানতে পারি নি?’ স্ত্রীলোকটি আর এক পরদা সুর চড়িয়ে বলছে, ‘তোমার সোনার সংসার ফেলে কোথায় চললে দিদিমণি? এত বড় সব্বোনাশ কেন করতে গেলে গো?”

গাড়িতে বোধ হয় একটি লোকও ছিল না—ছেলে, বুড়ো, তরুণ, তরুণী সবাই এসে দাঁড়িয়েছে রেললাইনের চারদিক ঘিরে। স্তব্ধ হয়ে দেখছে এই মর্মন্তুদ শোকোচ্ছ্বাস। মেয়েরা ঘন ঘন চোখ মুচছে। পুরুষেরা কেউ কেউ ভাবছে, এই হতভাগ্য লোকটার জীবনে কত বড় শূন্য সে রেখে গেল, একটিবারও যদি জানতে পারত মেয়েটা, হয়তো এমন করে নিজেকে শেষ করে দিত না।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ পিছন থেকে বেশ উঁচু গম্ভীর গলার নির্দেশ শোনা গেল, ‘আপনারা সব সরে যান, আমাদের কাজ করতে দিন।’ সমবেত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল বক্তার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে একটা ফালি মতো পথ তৈরি হয়ে গেল। তার ভিতর দিয়ে এগিয়ে এলেন ইউনিফর্মধারী পুলিস অফিসার, পেছনে দুজন অনুচর। মিনিট কয়েক মৃতদেহের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে মাথার কাছে যে পুরুষটি বসেছিল তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কে হন আপনার?’

অশ্রুজড়িত কণ্ঠে উত্তর এল, ‘আমার স্ত্রী।’

–এটি কে? পাশের স্ত্রীলোকটির দিকে আঙুল তুললেন পুলিস অফিসার।

—ও? ও আমাদের ঝি।

অনাথকে আরও ক’টি প্রশ্ন করা হল এবং তার থেকে জানা গেল, গভীর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই দেখে পাশে স্ত্রী নেই। প্রথমে মনে করেছিল, হয়তো বাথরুমে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরেও যখন ফিরল না, উঠে পড়ে খুঁজতে শুরু করল। বাথরুমের দরজা খোলা। ঘর, বারান্দা, উঠোন সব ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। তখন স্ত্রীর নাম ধরে ডাকাডাকি করতে লাগল। তাতেই বোধ হয় ঝিয়ের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে-ও খানিকটা খোঁজাখুঁজি করল। বাড়ির বাইরে বাগান রাস্তা পর্যন্ত ঘরে এল দুজনে, পাওয়া গেল না। অনেকদিন রোগে ভুগে ভুগে ইদানীং মাথাটা কেমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গাড়ির হুইসিল শুনলে বলত, ‘রেল আমাকে ডাকছে!’ কখনও বলত, ‘কি মিষ্টি ডাক, শুনেছ?’ হঠাৎ সে কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। বাগান পার হয়ে ছুটে এসে দেখে যা ভয় করেছিল তাই। রেল ওকে ডেকে নিয়ে গেছে। ….

বলে আবার ডুকরে কেঁদে উঠল অনাথ মল্লিক। কুসুমও যেন তৈরি হয়ে ছিল, এমনি ভাবে সঙ্গে সঙ্গে সুর মেলাল।

ড্রাইভার স্বীকার করল, সে যখন দেখল লাইনের উপর সাদামতো একটা কি পড়ে আছে, তখন একেবারে কাছে এসে গেছে। ব্রেক কষতে কষতে ইঞ্জিনটা এগিয়ে গেল।

দারোগা এবার ‘ঝি’-এর দিকে নজর দিলেন। প্রথমে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন। তারপর ভিড় থেকে একটু তফাতে সরিয়ে নিয়ে মিনিট কয়েক জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। কী বুঝলেন তিনিই জানেন, ফিরে এসে অনাথকে বললেন, ‘আপনাদের দুজনকে একটু থানায় যেতে হবে।’

ঘটনাস্রোত এবার যে পথ ধরল, তার বিশদ বিবরণ কুসুমের কাছ থেকে পাবার কথা নয়। তার কাহিনী শুনবার পর যেসব তথ্য আমি ওদের মামলার ‘রায়’ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম, তার বিস্তৃত বর্ণনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। যেটুকু প্রাসঙ্গিক, সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

পলাতক ‘ঠাকুর’কে তাদের দেশোয়ালী আড্ডা থেকে পুলিসই খুঁজে বের করেছিল। সেরাত্রে সে দূরে কোথাও যায় নি। অত বড় দুর্ঘটনার পর সম্ভাব্য পুলিসী হাঙ্গামার আশঙ্কা করে পাশের জঙ্গলে গা-ঢাকা দিয়েছিল। অপেক্ষা করছিল, অন্ধকারটা একটু পাতলা হলেই চলে যাবে। হঠাৎ দেখল, ‘বাবু’ আর কুসুম দুজনেই ধরাধরি করে ‘মাইজী’কে রেললাইনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা খানিকটা এগিয়ে যেতেই সে আর দাঁড়ায় নি, বেরিয়ে উল্টো দিক দিয়ে শহরের আরেক প্রান্তে একেবারে তাদের ‘আড্ডা’য় গিয়ে উঠেছিল।

‘দুর্ঘটনা’র সময় যে মনিব-বাড়িতে উপস্থিত ছিল, একথা ঠাকুর অস্বীকার করে নি, এবং যা যা ঘটেছিল তার যথাযথ বর্ণনাই দিয়েছিল।

ময়না-তদন্তের রিপোর্টের সঙ্গে সাক্ষীর উক্তির কোনো অসঙ্গতি দেখা যায় নি। মৃতার হার্টের অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল, ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার ফলে মৃত্যু হওয়া অসম্ভব নয়। শরীরে কোনো প্রাক্-মৃত্যু আঘাত-চিহ্ন পাওয়া যায় নি। রেলের ক্ষতটা নিঃসন্দেহে ‘পোস্ট-মর্টেম’ অর্থাৎ মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পরবর্তী।

সরকারের তরফ থেকে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হলেও দায়রা আদালত সেটা গ্রহণ করেন নি। প্রথম আসামী অনাথ মল্লিককে দোষী সাব্যস্ত করলেন দুটো অপরাধে—অসতর্ক ও হঠকারিতামূলক কার্যের দ্বারা মৃত্যু ঘটানো, এবং তার প্রমাণলোপের অপচেষ্টা। দ্বিতীয় আসামী কুসুম দাসীর বিরুদ্ধে শুধু পরবর্তী অপরাধটা প্রমাণিত হল। দণ্ডের বেলায় অনাথের দ্বিতীয় ধারার মেয়াদ প্রথমটির সঙ্গে ‘কান্কারেণ্ট’ বা একযোগে চলবে বলে আদেশ দেওয়ায় দুজনের মধ্যে কার্যত কোনো তফাৎ রইল না। কিন্তু কারাদণ্ডের পরিমাণ এক হলেও, তফাৎ ঘটল কারাগারে এবং সেখানকার ‘স্ট্যাটাস্ বা পদমর্যাদায়। অনাথ মল্লিক শিক্ষিত ভদ্রলোক, সুতরাং ‘ডিভিশন টু’ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর সনদ নিয়ে সে চলে গেল কলকাতার কুলীন জেলে। কুসুম দাসী নিরক্ষর ‘ছোট জাত’, তার আশ্রয় হল মফঃস্বল সেন্ট্রাল জেলের তৃতীয় শ্রেণীর জেনানা ফাটক। উভয়ের দণ্ডই সশ্রম, কিন্তু শ্রম-বণ্টনে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। অনাথের সেই পুরনো কেরানীগিরিই বজায় রইল। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের অফিস থেকে উঠল গিয়ে জেলের অফিসে। কুসুমের যা পেশা, জেল তা যোগাবে কোত্থেকে? তার কাজ হল রোজ দশ সের করে গম পেষা। প্রসূতি ও শিশুর সেবা নিয়ে যার দিন কেটেছে, তার হাতে উঠল দেড়মণি জাঁতার হাতল। দু-দিন ঘুরিয়েই দু-হাতের তালু জুড়ে দেখা দিল বড় বড় ফোস্কা

সেই ফোস্কা-সূত্রেই তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। জেনানা-ফাটকের সাপ্তাহিক প্যারেডের জন্যে অপেক্ষা করবার ধৈর্য ছিল না, ‘বড় সায়েবের কাছে নিয়ে চল’ বলে এমন চেঁচামেচি বাধিয়ে দিয়েছিল যে মেট্রন তাকে সরাসরি আমার অফিসে হাজির না করে পারে নি। এসেই টেবিলের ওপার থেকে হাত দুটো প্রায় আমার মুখের কাছে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘মেরে ফেললেও আর জাঁতা ঘোরাতে পারবো না।’

কী একটা কাজে জেল-ডাক্তার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমার ইঙ্গিত পেয়ে সেই সুডৌল হাত দু-খানা নিজের হাতে নিয়ে টিপে টিপে পরীক্ষা করলেন। যতটা এবং যতক্ষণ প্রয়োজন, তার চেয়ে কিছুটা বেশিই দেখলেন মনে হল। তারপর বললেন, কিছু দিন ‘রেস্ট’ দিতে হবে। বিশ্রামটা আপাতত সাময়িক হলেও ভবিষ্যতে স্থায়ী হয়ে দাঁড়াবে, সেটা আমি তখনই অনুমান করেছিলাম। সে অনুমান মিথ্যা হয় নি। ফোস্কা শুকিয়ে যাবার পরেও ডাক্তার তাকে বরাবরের জন্যে ‘আনফিট্ ফর হুইট্‌গ্রাইন্ডিং’ অর্থাৎ গম-খাটনির অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। অন্য কোনো বিকল্প খাটনির ব্যবস্থা অবশ্যই হয়ে থাকবে। সেটা বোধ হয় কাগজ-কলম ছাড়িয়ে ‘হাতে-কলমে’ পর্যন্ত পৌঁছয় নি। তা যদি হত, তাই নিয়ে আরও দু-চারবার সে নিশ্চয়ই আমার অফিস পর্যন্ত ধাওয়া না করে ছাড়ত না।

ধাওয়া অবশ্য ক’দিন পরেই করেছিল। তবে খাটনির ব্যাপারে নয়, অন্য নালিশ নিয়ে। আগের দিনের মতোই একখানা চিঠি আমার সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, যেন কৈফিয়ৎ তলব করছে এমনি সুরে বলেছিল, আমার চিঠিতে এত কালি ফেলেছে কেন? চিঠিখানা তুলে নিয়ে দেখলাম, এখানে ওখানে দু-তিনটা লাইন বাদ দিয়ে বাকী সবটাই সেন্সরের ঘন কালিতে আচ্ছন্ন। মিনিট খানেক অপেক্ষা করে যখন হতাশ সুরে বলল,

‘এটা দিয়ে আমি কী করবো’, আমিও মনে মনে তার প্রশ্নে সায় না দিয়ে পারলাম না। তার মধ্যে বস্তু বলতে বিশেষ কিছুই ছিল না। বললাম, তুমি একটু বাইরে যাও। খবর নিয়ে পরে আবার ডাকবো।

সঙ্গে যে ফিমেল ওয়ারর্ডারটি এসেছিল, সে ওকে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে কোনো রকমে অফিসের বারান্দায় নিয়ে গেল। আমি আমার সেন্সর অফিসার মাধববাবুকে ডেকে পাঠালাম। গম্ভীর প্রকৃতির বয়স্ক লোক। বললেন, ওখানে যেসব কথা ছিল, আমি আপনার সামনে মুখে আনতে পারবো না স্যার।

—কী ধরনের কথা? অশ্লীল?

—ঠিক অশ্লীল নয়, তবে—একটু থেমে ইতস্তত করে বললেন, রীতিমতো লাভ্- লেটার। ও-জেল থেকে কেমন করে এল তাই ভাবছি। বোধ হয় কেউ স্মাগ্‌ করে পাঠিয়েছে।

লেখকের নামটা মাধববাবু কাটেন নি। কুসুমকে ডাকিয়ে এনে বললাম, অনাথ কে?

—আছে একজন।

–সেই একজনের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা আমাদের জানা দরকার।

–কেন?

—তাই বুঝে আমরা ঠিক করবো, চিঠির কতটা থাকবে আর কতটা কাটা যাবে।

কুসুম একটুখানি কি ভেবে নিয়ে বলল, ওর কাছেই তো আমি ছিলাম। আমাকে খু-উ-ব ভালোবাসে। (বলতে বলতে মুখখানা কোমল হয়ে এল। গলাটাও অনেকটা স্নিগ্ধ শোনাল) বাবু বলেছে, জেল থেকে বেরোলেই আমাকে নিয়ে কলকাতায় বাসা করবে। এই চিঠিতে বোধ করি সেই কথাই ছিল। কোন্ ড্যাক্রা সব কালি ঢেলে বুজিয়ে দিয়েছে দ্যাখো না! বলে সম্ভবত মাধববাবুকেই সেই দুর্বৃত্ত মনে করে তাঁর দিকে একটি অগ্নিকটাক্ষ নিক্ষেপ করল।

ফিমেল ওয়ার্ডার বোধ হয় হাসি চাপবার চেষ্টায় অন্য দিকে মুখ ফেরাল। মাধববাবুর চোখে মুখে বিরক্তি ও বিতৃষ্ণার ভ্রূকুটি আরও খানিকটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে অভিযোগকারিণীকে তখনকার মতো ভিতরে পাঠানো হল।

এর পরের চিঠিখানা মাধববাবু আমাকে দেখিয়েছিলেন। কুসুম যদি পড়তে পারত এবং ফিমেল ওয়ার্ডের একমাত্র বাসিন্দা হত, চিঠিটা বিনা সেন্সরেই তার হাতে দেবার নির্দেশ দিতাম। সে আগেই যে স্তরে গিয়ে পৌঁছেছিল, তার ‘নৈতিক উন্নতি’ নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন ছিল না। মাধববাবুর ওটা নিছক পণ্ডশ্রম। কিন্তু ওর সঙ্গে আরও মেয়ে থাকে—কয়েকজন তার মধ্যে উঠতি-বয়সী। এ চিঠি তাদেরও হাতে হাতে ঘুরবে। সে কথা আমাদের ভাবতে হয়েছিল। সুতরাং কুসুমের চিঠি পাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল নানা রকম উৎপাত। যাকে যখন যা মুখে আসে তাই বলে, কোনো কাজ করে না, তুচ্ছ কারণে চেঁচামেচি করে, কখনও বা গুম্ হয়ে বসে থাকে।

আবার একদিন এল আমার কাছে। মেট্রনের হাত ছাড়িয়ে ছুটে এসে পড়ল আমার পায়ের উপর। তিন-চারজনে টেনে তুলতে পারে না। সে কী আকুল কান্না! —আমাকে ওখানকার জেলে পাঠিয়ে দাও সায়েব। তাকে একবারটি না দেখলে আমি মরে যাবো।

আমি ধমক দিলাম, একথা বলতে তোমার লজ্জা করে না?

সে কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু করুণ কণ্ঠে বলল—তার পক্ষে যেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত—তুমি যদি আমার সব কথা জানতে সায়েব, তাহলে বুঝতে। না, তার কাছে আমার কোনো লজ্জা নেই।

এর পরেই সে আমার কাছে তার “সব কথা” খুলে বলবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল। মেট্রনকেও তাড়া দিয়ে দিয়ে পাগল করে তুলল। প্রথমটা আমি রাজী হই নি। তারপর মত বদলাতে হল। সেদিন তার যে অবস্থা, তাকে ঠিক প্রকৃতিস্থ বলা চলে না। পুরোপুরি মনোবিকার না ঘটলেও, কথায় বার্তায় আচরণে তার অনেকগুলো লক্ষণ সুস্পষ্ট। তার থেকে আমার একটা ধারণা হয়েছিল, ওর বহু অপরাধজড়িত তরুণ জীবনের যে অংশটা আড়ালে পড়ে আছে, তাকে খানিকটা উন্মোচিত করবার সুযোগ দিলে, উত্তেজিত ও অপরিণত মনের এখানে সেখানে যে-সব জট পাকিয়ে গেছে তার গ্রন্থিগুলো হয়তো খুলে যেতে পারে।

অভিলাষবাবুর ঐ চেয়ারখানাই সেদিন একটু ঘুরিয়ে নিয়ে বসেছিলাম। ও ছিল আমার পায়ের কাছটিতে। অকপটে শুধু নয়, গভীর আগ্রহভরে একটানা বলে গিয়েছিল তার শত দুষ্কর্মের দীর্ঘ ইতিহাস। বলতে পেরে যেন বেঁচে গিয়েছিল। জানি না, সেদিন কিসের আলোড়ন উঠেছিল তার অন্তর জুড়ে, যার তাড়নায় একজন অনাত্মীয় প্রবীণ পুরুষের কাছে যুবতী নারীর যে ব্রীড়াজনিত স্বাভাবিক সঙ্কোচ, সেটাও সে অনায়াসে অতিক্রম করে গিয়েছিল। আমাদের উভয়ের ভিতরে যে দুস্তর ব্যবধান, তাও তার দিক থেকে অণুমাত্র বাধা সৃষ্টি করে নি।

সে যেমন করে তার নির্লজ্জ প্রগল্ভ কাহিনীর রাশ খুলে দিয়েছিল, আমি তেমনি করে তার পুনরুক্তি করতে পারি নি। তার ভাষাকে কিঞ্চিৎ ভদ্র পোশাক পরাতে হয়েছে।

‘ঐ জেলে পাঠিয়ে দাও’ বলে কুসুম প্রথমটা যে ঝোঁক ধরেছিল, ক্রমশ তার বেগ পড়ে গেল। ও নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করত না। তা-ই হয়। মানুষের মনের প্রবৃত্তিগুলো জোয়ারের জলের মতো। আসে, যায়, একটানা বেশি দিন থাকে না। আর একটা কারণ ছিল। অনাথের চিঠিতে আর সে উত্তাপ ছিল না। ভাষা ও সুর—দুটোই আশ্চর্যরকম বদলে গিয়েছিল। উচ্ছ্বাস নেই, আবেগ নেই, গোপন প্রণয়ের আবিলতা নেই, আগাগোড়া শুধু বড় বড় উপদেশ। মাধববাবুর সেন্সরের কাঁচি তার কোনোখানেই দাঁত বসাবার জায়গা পেত না। প্রতিটি চিঠি একেবারে অক্ষত দেহে ফিমেল ওয়ার্ডে গিয়ে পৌঁছত। মেট্রন পড়ে শুনিয়ে দিত। কিন্তু যার চিঠিতে তার কোনো আগ্রহ ছিল না, শুনে যেত, এই পর্যন্ত। চিঠিগুলো হাত বাড়িয়ে নিতেও চাইত না। মেট্রন দিতে গেলে বলত, থাক, ও দিয়ে আমি কী করব?

তারপর অনেকদিন নির্বিবাদে কেটে গেল।

কুসুমকে বিশেষভাবে চোখে বা মনে পড়বার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি। ইদানীং তার ভিতরকার সেই বন্য ভাবটা আশ্চর্যরকম শান্ত হয়ে গিয়েছিল। নিজেও কোনো নালিশ নিয়ে ছুটে আসে নি, তার নামেও কোনো ‘নালিশ’ ছিল না। দীর্ঘকাল পরে আমার অফিসেই আবার তাকে দেখলাম। অনেকটা যেন স্তিমিত। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে একখানা খোলা চিঠি আমার টেবিলের উপর রাখল। বললাম, কী এটা?

—পড়ে দেখুন।

কয়েক বছর জেলে বাস করে কুসুমের ভাষার অনেকটা উন্নতি হয়েছিল। চিঠিটা তুলে নিয়ে লেখকের নামটা দেখে নিলাম। শ্রীঅনাথ মল্লিক। তার উপরে কয়েকটি মাত্র লাইন—

কল্যাণীয়াসু

কুসুম, এক-থোকে হঠাৎ খানিকটা ‘রেমিশন’ পেয়ে কালই আমি জেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। তোমারও বোধ হয় খালাসের বেশি দেরি নেই।

ভেবে দেখলাম তোমার পথ এবং আমার পথ এক নয়। তোমার জীবনের সঙ্গে নিজেকে আর জড়াতে চাই না। এতদিন পরে একটা নতুন দিকের সন্ধান পেয়েছি।

তোমার কাছে এই আমার শেষ চিঠি। হয়তো আর কখনও দেখা হবে না। আশীর্বাদ করি তুমি সুখী হও।

.

চিঠিটা মুড়ে টেবিলের উপর রাখতেই সে বলে উঠল, এখানে কি বরাবর থাকা যায় না?

—না, মেয়াদ শেষ হবার পরে একদিনও আমরা রাখতে পারি না।

—তাহলে আমি কোথায় যাবো?

এ প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তর ছিল—’জানি না’ কিংবা ‘আমাদের তা নিয়ে মাথা ঘামাবার কথা নয়’—কথাটা বোধ হয় মুখে বাধল, তাই পাল্টা প্রশ্ন করলাম, মা-র কাছে যেতে তোমার আপত্তি কী?

কোন্ মুখে যাবো? অ্যাদ্দিন আছে কিনা কে জানে? থাকলেই বা…. বলতে বলতে দুচোখ জলে ভরে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে দৃঢ়স্বরে বলল, আপনি বলুন, আমার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন? তা নৈলে কিন্তু আমি কখনো এখান থেকে নড়বো না, তাড়িয়ে দিলেও পড়ে থাকবো।

বললাম, খালাসের তো এখনও মাস কয়েক দেরি আছে, তখন দেখা যাবে কি করা যায়।

—কথা দিচ্ছেন তাহলে?

সঙ্গে যে ফিমেল ওয়ার্ডারটি ছিল, সে ধমকে উঠল, কাকে কি বলিস তার ঠিক নেই চল্…বলে এক রকম জোর করেই ওকে টেনে নিয়ে চলল। হঠাৎ টেবিলের উপর নজর পড়তে বললাম, চিঠিটা? কুসুম যেতে যেতে দরজার মুখে থমকে দাঁড়াল, দ্রুতপায়ে ফিরে এসে চিঠিখানা তুলে নিল এবং সঙ্গে সঙ্গে শত টুকরো করে জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সবেগে বেরিয়ে চলে গেল।

আমাকে বিশেষ চেষ্টা করতে হয় নি, অনেকটা আপনা হতেই কুসুমের একটা মোটামুটি ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ফিমেল ওয়ার্ডের একটি কয়েদী তখন আসন্ন – প্রসবা। মাস পাঁচেক আগে ছ’মাসের সাজা নিয়ে এসেছিল। জেলের মধ্যে আঁতুড়ের হাঙ্গামা তো কম নয়। সেটা এড়াবার জন্যে জেলর তার টিকেটে মোটা ‘রেমিশন’-এর সুপারিশ করেছিলেন, যাতে করে ও-পর্বটা বাইরে গিয়ে সমাধা হতে পারে; অর্থাৎ তার আগেই তাকে ছেড়ে দেওয়া যায়। অতটা ‘মাপ’ দেবার কোনো সঙ্গত কারণ না থাকলেও আমি রাজী হয়েছিলাম। কিন্তু বিধাতা বাধ সাধলেন। ডাক্তারের হিসাবমত নবজাতকটির যখন আসবার কথা, তার কিছুদিন আগেই তাকে পাঠিয়ে দিলেন। তাও এমন অকস্মাৎ যে লেডি ডাক্তার ডাকবার তর সইল না। তিনি যখন এসে পৌঁছলেন, শিশুটি তখন কুসুমের কোলে। প্রসূতিকে সুস্থ করে তুলতে ক’দিন সময় লেগেছিল। পর পর তিন চার দিন তাঁকে আসতে হল। না এলেও হত। কুসুম একাই সামলাতে পারতো। তার কাজ- কর্ম দেখে লেডি ডাক্তার এতটা খুশী হয়েছিলেন যে, খালাসের সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার হাসপাতালেই একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে বিশেষ বেগ পেতে হয় নি।

তার কিছুদিন পরে শুনলাম, তিনি ওখান থেকে হুগলী না হাওড়া কোথায় যেন বদলি হয়েছেন, এবং কুসুমকেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন।

.

সেদিন অভিলাষবাবুর অফিস থেকে যখন বেরিয়ে পড়লাম, তার ঘণ্টা দেড়েক পরেই আমার ট্রেন! কুসুম তখনও ওখানেই অপেক্ষা করছিল। আসবার সময় আর তার দিকে তাকাই নি। কিন্তু সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো সমস্ত পথ আমাকে অনুসরণ করে চলল। একবার ভাবলাম ফিরে যাই, জেনে আসি ঐ আগুনের ইতিহাস, এতগুলো বছর অন্তরের কোন্ নিভৃত কোণে ঐ অনির্বাণ শিখাটাকে সে জ্বালিয়ে রেখেছিল কেমন করে! তারপর নিজেকে বোঝালাম, না, ফেরা যায় না। কুসুম এবং তাকে ঘিরে যে জগৎ সেখান থেকে আমি চিরদিনের তরে সরে এসেছি। পিছনে যা রইল তা পিছনেই থাক। মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? এ শুধু ক্ষণিকের দুর্বলতা। একে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।

কোলকাতায় ফিরে নানা কাজের মধ্যে ডুবে গেলাম। কুসুম আবার ধীরে ধীরে মনের তলায় মিলিয়ে গেল।

হঠাৎ একদিন আমার বৈঠকখানায় অভিলাষবাবুর আবির্ভাব। বিস্মিত হলাম। চাকরি জগতে ভূতপূর্বের সঙ্গে বর্তমানের যে স্বাভাবিক বিচ্ছেদ, তার উপরে সেতু রচনা করবার ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনো তরফেই বড় একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে ভূতপূর্বের মাথায় যদি সাহিত্যের ভূত চাপে, বর্তমান তাকে সযত্নে এড়িয়ে চলবে, এইটাই প্রত্যাশিত। তাহলে কি উনি আবার নতুন কোনো ফ্যাসাদ ডেকে এনেছেন?

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, অভিলাষবাবু একটা খাকী রংয়ের খামে মোড়া বস্তু আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন, এই নিন।

—কী ওটা?

—আমি কিছু জানি না। শুধু পৌঁছে দেবার কথা, তাই দিয়ে গেলাম। উঃ, চীজ বটে একখানা! আপনি যে কি করে ওকে বরদাস্ত করতেন স্যার, আপনিই জানেন। আমি তো দুদিনেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। ওর জন্যেই বোধ হয় পালাতে হবে ওখান থেকে।

—কার কথা বলছেন?

—ঐ যে, আপনার কুসুম না কী! আমি বলবো ক্যাক্‌টাস্, ভীষণ কাঁটাওয়ালা ক্যাক্‌টাস্, আমরা যাকে বলি ফণীমনসা! বিচ্ছুও বলতে পারেন।

—খুব জ্বালাচ্ছে বুঝি?

—জ্বালাচ্ছে মানে! প্রাণ বের করে দিল। সেদিন এসে বলছে—’সায়েবকে একটা চিঠি দেবো।’ ‘কোন্ সায়েব?’ ‘কোন্ সায়েব আবার! আমার সায়েব সেদিন যিনি এসেছিলেন।’ বললাম, ‘বেশ তো। তার জন্যে আমার কাছে আসবার কী দরকার ছিল? মেট্রনকে বললেই চিঠির কাগজ পেয়ে যেতে।’ বললে, ‘চিঠি আমার লেখা হয়ে গেছে।

‘তাহলে অফিসে পাঠিয়ে দাও।’ উত্তরে কি বললে জানেন? ‘না, এ চিঠি আর কেউ পড়ে, তা আমি চাই না। এটা আমি আপনার হাতে দিয়ে যাবো।’ ‘আমার হাতে!” “হ্যাঁ, আপনি যেদিন কোলকাতা যাবেন, তাঁর কাছে পৌঁছে দেবেন।’

শুনুন কথা! আর কী টোন্! যেন কুইন ভিক্টোরিয়া হুকুম চালাচ্ছে!

—আর আপনিও তো দেখছি সেটা সঙ্গে সঙ্গে তামিল করতে ছুটেছেন?

—না ছুটে উপায় আছে, স্যার? এর পরে কি বললে, তা তো এখনও শোনেন নি!

—কি বললে?

বোঝাতে গিয়েছিলাম, আমার যাবার দরকার হবে না, ডাকে দিলেও চিঠি ঠিক পৌঁছে যাবে। কথাটা শেষ হবার আগেই রুখে উঠল—’আপনি নেবেন কিনা বলুন, তা নইলে আমি এইখানে আপনার সামনে মাথা খুঁড়ে মরবো।’….বুঝুন একবার। বুড়ো বয়সে শেষকালে খুনের দায়ে পড়বো?

চিঠিখানা কুসুমের নিজের হাতে লেখা, সে তথ্যটি গোড়াতেই জানা গেল। আর জানলাম, এই নতুন বিদ্যা তার নিজের ইচ্ছা বা আগ্রহে অর্জিত হয় নি, এর পেছনে সবটাই তার ‘মাসিমা’ অর্থাৎ লেডি ডাক্তার মিস দাসের চেষ্টা। চেষ্টাটা বিশেষ ফলবতী হয়েছে বলে মনে হল না। সে বিষয়ে কুসুম নিজেও সচেতন। বলছে, ‘আমার এই লেখা আপনি পড়তে পারবেন কি? না পারলেও আমি সে কথা জানতে যাবো না। আমার বুকের বোঝা আমি নামিয়ে দিয়েই খালাস। তা নাহলে সারাজীবন ধরে গুমরে গুমরে মরতাম।’ এতদিন পরে একটা পুরো নিঃশ্বাস পড়ল।

‘এবারে জেলে এসেই শুনেছিলাম, আপনি আর চাকরিতে নেই। কোথায় আছেন কেউ বলতে পারে না। কতদিন আপনার কথা ভেবেছি, কিন্তু এ জীবনে দেখা পাবো, তা কি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলাম? দেখে কী ইচ্ছা হয়েছিল জানেন? সেই সেদিনের মতো আপনার পায়ের কাছটিতে গিয়ে বসি, বলে যাই যত কথা জমে আছে বুকের মধ্যে, যা কাউকে বলি নি, আর কাউকে বলা যায় না। সে সুযোগ হল না। এ জীবনে কোনোদিনই হবে না। তাই সেদিন থেকে বসে এই চিঠিটা লিখেছি। লিখে মনে হল, এ চিঠি তো এরা পাঠাবে না। পাঠালেও কেটেকুটে একশা করে দেবে। তা যাতে না হয়, তার জন্যে কত কাণ্ড যে আমাকে করতে হয়েছে, শুনলে আপনি হাসবেন।….যাক সে সব বাজে কথা।‘

চাকরি-জীবনের প্রথম দিকে শিক্ষানবিশি-স্তরে চিঠি-সেন্সর নামক দুরূহ কার্যটি আমাকে কিছুদিন করতে হয়েছিল। সেই বিদ্যার জোরে ভাষা, বানান এবং লিপি বিন্যাসের কাঁটাবন ভেঙে চিঠিখানার মোটামুটি পাঠোদ্ধার কোনো রকমে করা গেল। কিন্তু গোটা চিঠিটার হুবহু উদ্ধৃতি শুধু অসম্ভব নয়, আমার পাঠককুলের কাছে রুচিকর হবে না, লেখিকার উপর অবিচার করা হবে। এ চিঠি একান্ত ভাবে আমারই জন্যে লেখা, প্রকাশের জন্যে নয়। আমি তাকে জানি, তার নিগূঢ় মনোরাজ্যের সন্ধান রাখি, তার বিধাতা তাকে যে-সব বিচিত্র উপাদান দিয়ে গড়েছেন, তারও পরিচয় পেয়েছি। সে কথা সে নিঃসংশয়ে জানে বলেই তার নারী-হৃদয়ের অন্তরালে প্রবৃত্তির যে উদ্দাম তাড়না, কামনার যে নগ্ন আবেগ, কোনোটাই সে গোপন করে নি। একদিন মুখে যতটা বলেছিল, তার চেয়েও বেশি, তার নিরাবরণ অন্তর্লোক অসংকোচে উদ্‌ঘাটিত করে গেছে। তার উপর কিছুটা সেন্সরের কলম না চালিয়ে উপায় নেই। ভাষার উপরেও যে ঘষা-মাজার প্রয়োজন ঘটেছে, সে কথা তো আগেই কবুল করেছি।

লেডি ডাক্তার মিস দাস কুসুমকে শুধু আশ্রয় ও মোটামুটি সচ্ছল জীবনযাত্রার সংস্থান করে দেন নি, তাঁর নিঃসঙ্গ প্রৌঢ় জীবনের অনেকখানি স্নেহও ওকে দিয়েছিলেন। অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো সেই স্নেহচ্ছায়ায় সুখে জীবন কাটিয়ে দিত। কুসুম তা পারে নি। সে সুখী ছিল না। মাসিমার প্রতি তার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। সে যে তাঁর নিজের মেয়ে নয়, এ কথা তিনি একদিনের তরেও বুঝতে দেন নি—এও তারই অকপট উক্তি। তবু সুখ’ যাকে বলে তা সে পায় নি। সংসারে সুখের চেহারা সকলের বেলায় এক নয়।

‘সেই লোকটা’ (চিঠির ভাষায়) গোপন প্রেমের যে ফেনিল সুরাপাত্র ওর পিপাসিত ওষ্ঠপ্রান্তে তুলে ধরেছিল, তার তীব্র স্বাদ কুসুমের শিরায় শিরায় পরিব্যাপ্ত হয়ে গেছে। তাকে আশ্রয় করে একটি অপরিণত নারীমন সেদিন যে-জীবনের স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল, দূরে গিয়েও সে দিনের পর দিন তারই উপরে নানা রঙের তুলি বুলিয়ে সেই জীবনকে আরও মোহময়, আরও লোভনীয় করে তুলেছে। মাধববাবুর সেন্সরের কালি তাকে ঢেকে রাখতে পারে নি, অতৃপ্ত রমণী-হৃদয়ের উদগ্র বাসনাকে আরও খানিকটা উসকে দিয়েছে। তারই মাদকরসে নিজেকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে যে দুঃসহ আনন্দ, কুসুমের কাছে তারই নাম ‘সুখ’। জেনানা ফাটকে বসে বসে সেই সুখের উপরেই সে একটি মনোরম স্বর্গ গড়ে তুলেছিল। তারপর যাকে অবলম্বল করে এত সাধের স্বর্গ-রচনা, তারই রূঢ় হাতের অপ্রত্যাশিত আঘাতে যেদিন সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, তখনও তার দুর্জয় মোহ কুসুমকে প্রচণ্ড আকর্ষণ করেছে। সেই দীর্ঘ-লালিত প্রলোভনের কবল থেকে নিজেকে টেনে সরিয়ে এনে মিস দাসের সহজ সুস্থ স্নেহময় গার্হস্থ্য জীবনের মধ্যে নিজেকে সে বসাতে পারে নি, হয়তো তেমন চেষ্টাও করে নি।

তার অকপট স্বীকারোক্তি চিঠিতেই দেখতে পাচ্ছি—’আপনি তো সবই জানেন। এটুকু বলতে আর বাধা কী? আপনার কাছে আমার লজ্জাই বা কিসের? সত্যি বেশ লাগত। কত কী যে ভাবতাম! সব ‘তাকে’ নিয়ে। ‘তাকে’ নিয়ে সংসার পেতেছি। কোথায় জানেন? কোলকাতায়। একদিন দুজনে মিলে গিয়েছি আপনাকে প্রণাম করতে। সে যেতে চায় না, বলেছে, কি ভাববেন তিনি? আমি যেন জোর করে ধরে নিয়ে গেছি। তারপর নিজের মনেই হেসে ফেলতাম। ওমা, আপনার ঠিকানাই যে জানি না!…. কোনো কোনো দিন সে আসত। সত্যি বলছি আপনাকে, আমার পাশে এসে বসত। দু-হাতে জড়িয়ে ধরে আমাকে পিষে ফেলত। তারপর…হঠাৎ দেখতাম সব মিথ্যা, সব ভুল। আমি একা, সে কোথাও নেই। তখন সমস্ত শরীরে আগুন ধরে যেত। সে যে কী জ্বালা আপনাকে বোঝাতে পারবো না।

এমনি করে কয়েক বছর কেটে গেল। কুসুমের রক্তধারায় সে দহন-জ্বালা হয়তো আপনা হতেই কিছুটা প্রশমিত হয়ে এল। আরও হত, অন্য কোনো কারণে না হলেও, মহাকালের অমোঘ বিধানে। কিন্তু হল না। বিধাতার হয়তো সে ইচ্ছা ছিল না। তাই তাঁরই হাতে লেখা ললাট-লিপি কুসুমকে টেনে নিয়ে গেল অন্য পথে, এক আকস্মিক, অভাবনীয়, ভয়ঙ্কর পরিণতির মধ্যে। চিঠির শেষ অংশ থেকে সেই কাহিনীটি উদ্ধার করছি।

রাত আটটা বেজে গেছে। শহরতলীতে একটা ‘কল্’ সেরে মিস দাস ঘোড়ার গাড়ি করে ফিরছেন। সঙ্গে কুসুম। ওঁর এক বান্ধবীর বাড়ির সামনে দিয়ে পথ, হঠাৎ কী মনে হল, গাড়ি থামিয়ে বললেন, সতীর সঙ্গে একটু দেখা করে যাই, তুই চলে যা।

‘গাড়িটা পাঠিয়ে দেবো তো?’ জানতে চাইল কুসুম।

—কী দরকার? আমি একটা রিক্শা নিয়ে নেবো

গাড়ি আরও কিছু পথ এগোতেই, কাছাকাছি কোনো একটা বড় বাড়ি থেকে কীর্তনের সুর ভেসে এল। কানে যেতেই কুসুম চমকে উঠল। এ গলা যে তার চেনা। ‘চেনা’ বললে কিছুই বলা হল না, তার মর্মস্থলে গাঁথা হয়ে আছে—তার চেতনার পরতে পরতে জড়িয়ে গেছে।

অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ল। হৈমন্তী তখন একটু সুস্থ হয়ে উঠেছে। বাড়ি থেকে ঘুরে আসবার নাম করে সন্ধ্যার দিকে মাঝে মাঝে ও ছুটি নিত। রেললাইন পার হয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করত। কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘সে’ এসে পড়ত। তারপর দুজনে হাত-ধরাধরি করে নির্জন মাঠের অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। দূরে একটা ছোট নদী ছিল, কোনো-কোনোদিন তার তীরে গিয়ে বসত। তারপর শুধু কথা। কথা যখন ফুরিয়ে যেত, তখন গান। কীর্তন নয়, ভালোবাসার গান। কী দরদ দিয়ে যে গাইত! আজও দু-কানে ভরে আছে। সেই গলা! সে কি কখনও ভোলবার? কুসুমের সমস্ত দেহমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।

গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নিয়ে নেমে পড়ল। কোনো বড়লোকের বাড়ি। মস্ত বড় গেট। তারপরেই বিস্তৃত আঙিনা। সবটা জুড়ে ফরাস পাতা, মাথার উপর সুদৃশ্য সামিয়ানা। লোক গিজগিজ করছে। বাঁ দিকটায় ভর্তি মেয়েরা, ডাইনে পুরুষদের ভিড়। সামনে সুসজ্জিত মঞ্চের উপর কীর্তনের দল। মাঝখানটার চারদিকে আলো করে সে বসে আছে। দূর থেকে এক পলক দেখেই কুসুমের বুকের রক্ত দোলা দিয়ে উঠল। এও কি কখনও সম্ভব? স্বপ্ন কি কখনও সত্য হয়? হয়। এই তো তার জলজ্যান্ত প্ৰত্যক্ষ প্রমাণ। দুচোখে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল কুসুম। দেখে আর আশ মেটে না। নতুন সাজে কি সুন্দর মানিয়েছে! পরনে দামী সিল্কের ধূতি-চাদর—উজ্জ্বল গেরুয়ায় রাঙানো। কাঁধ পর্যন্ত চুল, মাঝখান দিয়ে উঠে গেছে সযত্ন-রচিত সিঁথি। কপালে চন্দন-তিলক।

কুসুম মেয়েদের ভিড় ঠেলে আরও খানিকটা এগিয়ে গেল। গানের ফাঁকে ফাঁকে গায়কের ভাবগম্ভীর দৃষ্টি মাঝে মাঝে এদিকেও এসে পড়ছে। যদি একবার চোখাচোখি হয়ে যায়!

গান শেষ হল। সবাইকে প্রণতি জানিয়ে বিদায় নিলেন গায়ক। বাড়ির মেয়েরা এসে সসম্ভ্রমে এগিয়ে নিয়ে গেল অন্দরমহলে। আসর আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেল। কুসুম তখনও একপাশে দাঁড়িয়ে। একজন ভদ্রলোক, সম্ভবত ঐ বাড়ির কেউ, এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি গোসাঁইজীর সঙ্গে দেখা করতে চান?

আশেপাশের টুকরো কথা থেকে কুসুম জানতে পেরেছিল, ঐ নামেই এখানে ওর পরিচয়। বলল, হ্যাঁ।

—আজ তো দেখা হবে না। এখন ওঁর বিশ্রামের সময়। কাল বিকেল পাঁচটায় আসবেন, দেখা হবে।

কুসুম আর কিছু বলল না। লোকটি সরে যেতেই সকলের অলক্ষ্যে বাড়ির ভিতর গিয়ে ঢুকল। দালানের সামনে একটি ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে দেখা। তাকেই জিজ্ঞাসা করল, গোসাঁইজী কোন্ ঘরে আছেন, খুকী?

—ঐ ঘরে। এখন যাবেন না।

ততক্ষণে কুসুম সেই ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। দরজা ভেজানো। ঠেলা দিতেই খুলে গেল। সামনেই প্রশস্ত খাটের উপর পুরু ধবধবে বিছানা। মাথার উপরে ঘূর্ণমান বৈদ্যুতিক পাখা। গোসাঁইজী শুয়ে আছেন। মাথার কাছে বসে একটি মেয়ে তাঁর উন্মুক্ত প্রশস্ত বুকের উপর ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পায়ের কাছে আরও দুজন—মুখোমুখি বসে দু-হাতে পদসেবায় ব্যস্ত। সকলেই যুবতী, সুন্দরী এবং সুসজ্জিতা। একটি নীলাভ মৃদু আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো নেই।

শিয়রের কাছে যে মেয়েটি ছিল, কুসুমের উপর সকলের আগে তারই নজর পড়ে থাকবে। একটু রূঢ় স্বরে বলে উঠল, কী চাই আপনার?

‘কিছু একটা চাই বৈকি? সেটা আমার চেয়ে উনিই ভালো বলতে পারবেন’—চোখের ইঙ্গিতে গোসাঁইজীকে দেখিয়ে দিল। তিনি চোখ বুজে ছিলেন, পাতাদুটো যেন চমক লেগে খুলে গেল। মুখ থেকে বেরিয়ে এল—কে? সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসলেন।

কুসুম কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, চিনতে পারছ না কে? . ….আপনাদের আলোর সুইচটা কোথায়?

পরের প্রশ্নটা পায়ের কাছে যে মেয়ে দুটি বসেছিল তাদের উদ্দেশে। তারই মধ্যে একজন উঠে বড় আলোটা জ্বেলে দিল। গোসাঁইজী মুহূর্তকাল বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কপাল কুঞ্চিত করে বললেন, আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না!

কুসুম প্রথমটা হকচকিয়ে গেল। পরক্ষণেই খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, আমি কুসুম!

‘আপনি ভুল করছেন’—কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন গোসাঁইজী, ‘কুসুম বলে কাউকে আমি চিনি না। ও নামও কোনোদিন শুনি নি।’

কুসুমের সমস্ত বাক্শক্তি যেন এক নিমেষে হারিয়ে গেল। তাদের পরিচয়টুকু পর্যন্ত ‘সে’ এমন স্রেফ অস্বীকার করে যাবে, এ যে তার স্বপ্নেরও অতীত!

ততক্ষণে বাড়ির পুরুষেরাও এসে পড়েছেন। একটি যুবক এগিয়ে এসে ধমকের সুরে বলল, কে তুমি?

—যে-ই হই, তাতে আপনার কী?

—বটে! এখুনি বেরিয়ে যাবে কিনা বলো, তা না হলে—

‘উহুঁ, ওভাবে নয়’, করুণার্দ্র কণ্ঠে বাধা দিলেন গোসাঁইজী, ‘মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে- শুঝিয়ে নিয়ে যাও। পাগল-টাগল হবে বোধ হয়।’

‘পাগল!’ বিড় বিড় করে আপন মনে আউড়ে গেল কুসুম। মুহূর্তমধ্যে সত্যিই যেন তার মাথার ভিতরটা ওলট-পালট হয়ে গেল। সেই সঙ্গে তার দেহকোষে, তার মনের মজ্জায় মজ্জায় এতদিন ধরে যত জ্বালা জমা হয়ে ছিল—কুসুম জানে না সে কিসের জ্বালা, হয়তো অতৃপ্ত বাসনার, অবদমিত সম্ভোগ-লিপ্সার, ক্ষোভের, নৈরাশ্যের, বঞ্চনার, প্রতিহিংসার—সব যেন একীভূত হয়ে তার শিরায় শিরায় উদ্দাম হয়ে উঠল। কম্পমান মুঠি থেকে ব্যাগটা মাটিতে পড়ে গেল। কুসুমের নজর পড়ল তারই উপর। ক্ষিপ্রহস্তে তার ভিতর থেকে একটা কি যন্ত্র তুলে নিতেই গোসাঁইজী স্থান-কাল ভুলে ভয়ার্ত বিকৃত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন–কুসুম!

ততক্ষণে সেই ধারালো অস্ত্রটা সবেগে বসে গেছে তাঁর চোখের উপর। সঙ্গে সঙ্গে ফিকি দিয়ে উঠল রক্তধারা। তার উষ্ণ স্পর্শ ছড়িয়ে পড়ল কুসুমের মুখে বুকে গলায়। খানিকটা লোনা স্বাদ তার দীর্ঘ-তৃষ্ণা-পীড়িত ঠোট দুটিতেও জড়িয়ে গেল।

তারপর কি হল কুসুম জানে না, যখন জ্ঞান হল তখন সে থানায়। তিনদিন পরে জেলে বসে খবর পেল, গোসাঁইজী হাসপাতালে মারা গেছেন।

কুসুমের চিঠির শেষ ক’টি ছত্র আরেকবার পড়লাম—’তাকে খুন করবার মতলব আমার ছিল না। সেই সর্বনেশে চোখ দুটো, যা দিয়ে একদিন আমাকে ভুলিয়েছিল, হয়তো আরও কত মেয়েকে ভুলিয়েছে, তাই শুধু চিরদিনের তরে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম …তাই বলে যা করেছি তার জন্যে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমার সব জ্বালা জুড়িয়ে গেছে।

শেষ চিঠিতে সে আমাকে সুখী হবার আশীর্বাদ জানিয়েছিল। তার ফল ফলেছে। আজ সত্যিই আমি সুখী।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *