লৌহকপাট – ২.৫

পাঁচ

সংসারে আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিটি কে? এ প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তর—আমি। আমার সঙ্গে আমার Love at first sight. প্রথম দর্শনেই আমি আমার প্রেমে পড়েছি। শেষ দর্শনেও সে প্রেম অটুট থাকবে। আমার রূপের উপর আপনি যতই বিরূপ হোন না কেন, আমার চোখে সে অতুলনীয়। এই ধরুন আমার প্রতিবেশিনী সু-দেবী। শুনতে পাই উনি যখন বাঁ-ফুটপাথ ধরে চলেন, পাড়ার ছোকরার দল উঠে যায় ডান ফুটপাথে। তবু দিনের মধ্যে কতবার উনি নিজেকে দেখেছেন ওঁর ঔ ড্রেসিং-টেবিলের বড় আয়নাটায়। সামনে থেকে, পাশ থেকে, পেছন থেকে ঘাড় ফিরিয়ে ঐখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাচ্ছেন নানা আভরণে, গোছাচ্ছেন নানা প্রসাধনে। তবু আশ মেটে না। অন্যের বিকর্ষণ যতই হোক, নিজের উপর ওঁর আকর্ষণ অফুরন্ত।

এই জন্যেই সংসারে আয়না জিনিসটার এত কদর। নানা আকারে নানা প্রকারে সকল যুগে সকল মানুষের ঘরে তার আনাগোনা। ধনীর প্রমোদ কক্ষ থেকে গরীবের মাটির দেওয়াল। সন্ন্যাসীর গৈরিক ঝোলা থেকে আধুনিকার ঝুলন্ত হ্যাণ্ডব্যাগ! শুধু মরজগৎ নয়, অমরলোকেও যার বিপুল চাহিদা। দেবার্চনার উপকরণে দর্পণ অপরিহার্য। এমন যে সার্বজনীন প্রিয় বস্তু, ঘটনাচক্রে সেও যে কত বড় অপ্রিয় রূপ নিয়ে দেখা দিতে পারে, নিজের চোখেই একদিন দেখলাম। সেই কথাটা রলবো বলেই এতখানি গৌরচন্দ্রিকা।

তখন আমি ডিস্ট্রিক্ট জেলে। জেলর ছিলেন স্বনামধন্য গণপতি সান্যাল। বড় বড় “সেন্ট্রাল” সমুদ্রে কৃতিত্ব দেখাবার পর শেষ জীবনে কোনো কারণে তিনি একটা ছোট “ডিস্ট্রিক্ট” নদীতে এসে হাল ধরেছেন। আমি তাঁর একমাত্র ডেপুটি। ঝড়-ঝাপটা যা কিছু আমার উপর দিয়েই যায়। উনি আড়ালে বসে সিগার টানেন আর উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেন, আপনার এই টয় (Toy) জেলের রকম-সকম আমার ঠিক ধাতস্থ হচ্ছে না। ওসব আপনিই চালান মশাই।

‘সুপার’ ছিলেন এক তরুণ আই. এম্. এস্.। আমাদের একঘণ্টার মালিক। রোজ ওই সময়টুকু কোনো রকমে কাটিয়ে সাহেবকে বিদায় দিয়েই সান্যালমশাই প্রস্থান করতেন তাঁর কুঠিতে। খুলে বসতেন হয়তো কোনও লোমহর্ষক রেলওয়ে উপন্যাস। চাকরিতে থেকেও নিরুদ্বেগ অবসরযাপন। বেশ চলছে দিন।

এমন সময় দেশী ম্যাজিস্ট্রেট বদলি হয়ে তাঁর জায়গায় এলেন এক বিলাতি সাহেব। লড়াই-ফেরতা মেজর। আসল নামটা মনে নেই। সবাই বলত ‘অ্যালুমিনিয়ম’ সাহেব। মেসোপটেমিয়া না বাগদাদের কোন ফ্রন্টে তাঁর মাথা ভেদ করে নাকি চলে গিয়েছিল মেশিনগানের গুলি। মিলিটারী হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন ধন্বন্তরি। ছোট্ট একটা অ্যালুমিনিয়মের চাকতি দিয়ে বন্ধ করলেন মাথার ফুটো। কিন্তু বাইরে ফাঁক জোড়া লাগলেও ভিতরে কোথায় একটা স্ক্রু আলগা রয়ে গেল। তার ফলেই বোধহয় মিলিটারীতে তাঁর অন্ন উঠল। মেজর থেকে হলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তা হোন্। কিন্তু ঢিলে স্ক্রুর প্রতাপে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম!

জেল কোডে বিধান আছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সপ্তাহে একবার করে ডিস্ট্রিক্ট জেল পরিদর্শন করবেন। এ হেন আইনের আবদার মেনে চলবার মতো ভালোমানুষ ম্যাজিস্ট্রেট চিরদিনই দুষ্প্রাপ্য। সপ্তাহে দূরে যাক, বছরে একটিবার জেলের দরজায় পদধূলি দেননি, এরকম কালেক্টরও বিরল নন। কিন্তু অ্যালুমিনিয়ম সাহেব মসনদে বসেই প্রথম নজর দিলেন জেলের দিকে, এবং বিপুল উৎসাহে শুরু করলেন তাঁর সাপ্তাহিক পরিদর্শন—সময় নেই, অসময় নেই। বেলা আড়াইটায় অফিস থেকে ফিরে সবে দু-মগ জল মাথায় ঢেলেছি, কিংবা আহারান্তে নিদ্রাকর্ষণের মহৌষধি খবরের কাগজটা সবে তুলে ধরেছি চোখের উপর, ব্যাস, জেল-গেটে বেজে উঠল ডবল ঘণ্টা। দু-মিনিটের মধ্যে ছুটে এল গেট- ফালতু—কালেক্ট্র সাব্ আ গিয়া! অর্থাৎ ছোটো আবার ধড়াচূড়া এঁটে। শুধু আমিই নই, জেলর সাহেবেরও রেহাই নেই।

এমনি একটা শীতকালের সকালবেলা। দুটো ঘণ্টা শুনে ছুটে গেলাম। সান্যালমশাই একটু আগে এসে গেছেন। শার্টের উপর খাকী সার্জের মিলিটারী কোট। কোটটি ওঁর প্রথম যৌবনের সঙ্গী, চাকরি-জীবনের সমবয়সী। মালিকের দৈহিক শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি বেচারা। হাত, ঝুল এবং ঘের—সব দিকেই পিছিয়ে পড়েছে অনেকখানি। তবু আজও তার কপালে পেনশন জোটেনি। মনিব যতদিন চাকরিতে আছেন, জুটবে বলেও মনে হয় না। শার্টের অবস্থাও’ প্রায় তাই। গলার বোতাম বশ মানেনি। ফলে গলগ্রন্থির গ্রন্থি কণ্ঠা থেকে নেমে এসেছে ইঞ্চি তিনেক। তার উপর কয়েকদিন ক্ষৌর-কার্যের অভাবে গণ্ডদেশ কদমফুল।

সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট কয়েক মিনিট কৌতুক-দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, Have you got a mirror? সান্যালমশাই যেমন করে তাকালেন বোঝা গেল, কথাটা ওঁর ঠিক বোধগম্য হয়নি। তখন প্রশ্নটার পুনরুক্তি হল আমাদের দিকে চেয়ে। তাৎপর্য বুঝতে পেরে আমি না-শোনার ভান করে একটু আড়ালে সরে গেলাম।

কথা হচ্ছিল, দু গেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ডাইনে বাঁয়ে অফিস। তার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে কৌতূহলী কেরানীকুল। তাদের দিকে নজর গেল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাংলা ভাষায় বললেন, আয়না আছে? আসরফ হোসেন ছুটে গিয়ে তার টেবিলের দেরাজ থেকে নিয়ে এল একটা হাত-আরশি। ম্যাজিস্ট্রেট সেটা এগিয়ে ধরলেন জেলর সাহেবের মুখের উপর। কৌতুককণ্ঠে বললেন, Have a look please!

জেলর সাহেবের ভারী মুখখানা আরও ভারী হয়ে উঠল। যেন রক্ত ফেটে পড়ছে গৌরবর্ণ গণ্ডদেশ থেকে। মিনিটখানেক অপেক্ষা করে সাহেব এবার আদেশের সুরে বললেন, Take it. একটুখানি ইতস্তত করলেন গণপতিবাবু। তারপর হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করলেন আরশি! পাশেই দাঁড়িয়েছিল গেট-কীপার, ওর হাতে সেটা গছিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলেন পাশের কামরায়। চারদিকে সিপাইশাস্ত্রী, কয়েদীদের মুখের চাপা হাসি নীরব হলেও অস্পষ্ট রইল না।

আমাকে একাই কালেক্টর সাহেবের অনুসরণ করতে হল। ঠিক অনুসরণ নয়, পশ্চাদ্ধাবন। অর্থাৎ তাঁর কাছে যেটা হাঁটা, আমার পক্ষে সেটা ছোটা। যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, পদস্থ লোকদের যদি জেলে পাঠানো হয়, কোথায় থাকেন তারা? আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বক্তব্যটা আর একটু পরিষ্কার করে বললেন, এই যেমন, ধর, রায়বাহাদুর, খানবাহাদুর, এই সব মেকদারের লোক।

বললাম, ওঁদের সেলেই (Cell) রাখা হবে। সাধারণ কায়েদীদের ব্যারাকে তো আর-

—Cell-এ! ঠিক বলেছ। That will be the proper place for these blocks. চল তো দেখে আসি জায়গাটা।

পাশাপাশি বারোটা সেল। অর্থাৎ সাত হাত লম্বা পাঁচ হাত চওড়া ঘর। সামনে পাঁচিল-ঘেরা সরু একফালি ইয়ার্ড। কামরাগুলো বেশীর ভাগই খালি। দু’চারটিতে লোক রয়েছে। ওদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বললেন সাহেব, এরা কারা?

—এরা কেউ পাগল, কেউ কুষ্ঠরোগী, কোনো কোনোটা মারাত্মক গুণ্ডা।

—তাই নাকি! খুশিতে নেচে উঠল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ছোট ছোট চোখ দুটো—চমৎকার Company হবে! ঠিক আছে।

একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলাম, আসবার কথা আছে নাকি ওঁদের কারও?

—যে কোনও দিন। And the whole lot of them! অবিশ্যি ওঁরা যদি বুদ্ধিমান হন, তাহলে হয়তো আনতে হবে না।

কৌতূহল দুর্নিবার। তবু এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করা সমীচীন হবে কিনা ভাবছি, উনি আবার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, দেখলাম, দাঙ্গা বন্ধ করতে হলে এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

কাছেই ছিল একটা বটগাছের বাঁধানো বেদি। চলতে চলতে তার উপর বসে পড়লেন সাহেব। সিপাইরা ছুটে এলো ধুলো ঝেড়ে জায়গাটা বসবার মতো করে দেবার জন্যে। হাত দিয়ে নিরস্ত করলেন। সেইখানে বসেই শুনলাম তাঁর দাঙ্গা নিবারণের অভিনব ‘পথের’ বর্ণনা।

ঊনচল্লিশ-চল্লিশ সালের কাহিনী। পূর্ব-বাংলার বুকের উপর দিয়ে তাল ঠুকে চলেছে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব। পাশের জেলায় তার শ্মশানলীলা শেষ হতে না হতে এখানেও শুরু হবার সম্ভাবনা দেখা দিল। শহর ও গ্রামাঞ্চল থেকে ঘন ঘন যে-সব জিগির ধ্বনিত হতে লাগল, তাঁর আক্ষরিক অর্থ ঈশ্বরের মহিমাজ্ঞাপক হলেও ভাবার্থ কল্পনা করে আমাদের প্রাণে আর জল রইল না। বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষদের মুখে উদ্বেগ এবং অন্তরে উল্লাস। কিন্তু ‘অ্যালুমিনিয়ম’ মানুষটি ছিলেন অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। বলে বসলেন, না, দাঙ্গা হতে দেবো না আমার এলাকায়।

জাত-ভাইরা অবাক। ক্ষ্যাপা নাকি লোকটা! উপদেশ নির্দেশের অভাব হল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ ক্ষ্যাপামির কাছেই সবাইকে হার মানতে হল। অ্যালুমিনিয়ম ছুটলেন এ গ্ৰাম থেকে ও-গ্রামে, এ শহর থেকে ও-শহরে। এখানে ওখানে বসালেন পুলিশ পিকেট। জায়গা বুঝে মার্চ করালেন গুর্খা রেজিমেণ্ট। তারপর একদিন জরুরী তলব পেয়ে তাঁর খাস কামরায় জড় হলেন জেলার সবকটি রায়বাহাদুর এবং খানবাহাদুর। সাহেব ‘খান’দের দিলেন ডানদিকের আসন, ‘রায়’দের বসালেন বাঁদিকে। নিজে মাঝখানে বসে কোনও রকম ভূমিকা না করেই বললেন, লুক হিয়ার মাই ডিয়ার বাহাদুরস্, সোলজার মানুষ আমি। বক্তৃতা দিতে শিখিনি। ও-জিনিস আমার কাছে আশা করবেন না। একটা মাত্র কাজের কথা শোনাবার জন্যে আপনাদের কষ্ট দিয়েছি। সেটা হচ্ছে এই—আমি দাঙ্গা হতে দেবো না। আমার ডিস্ট্রিক্টের কোথাও একটা সামান্য ঘটনাও যদি ঘটে, পুলিসের প্রথম কাজ হবে আপনাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা। চোর-ডাকাতদের কি করে জেলে নিয়ে যায়, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন। আপনাদেরও ঠিক তেমনি করে অর্থাৎ কোমরে দড়ি এবং হাতে হাতকড়া পরে সার বেঁধে পায়ে হেঁটে যেতে হবে জেলখানায়। আমার এস্. ডি. ও.-দের নির্দেশ দেওয়া আছে, জামিনের আবেদন সরাসরি নামঞ্জুর হবে।

অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাজে, ইংরেজিতে যাকে বলে matter of fact ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে গেলেন কালেক্টার সাহেব। তাঁর মহামান্য অতিথিরা মনে মনে স্বীকার করলেন লোকটার আর যাই দোষ থাক্, কপটতার অপবাদ তাকে দেওয়া চলে না। কল্পনানেত্রে নিজেদের অবস্থা দর্শন করে প্রবীণ শ্রোতাদের চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠল। সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে উপসংহার করলেন অ্যালুমিনিয়ম, আমি জানি, মন্ত্রিসভার অনেকে আপনাদের বন্ধু। সুতরাং শেষ পর্যন্ত জেলে আপনারা থাকবেন না, হয়তো আমাকেই সেখানে পাঠাবার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু তার আগে আপনাদের ঐ জেলযাত্রার প্রসেশনটা আমরা সবাই মিলে উপভোগ করে নেবো। সেটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। গুড্‌বাই!

রাউণ্ড শেষ করে সদলবলে যখন গেটের দিকে ফিরছি তিন নম্বর ওয়ার্ডে একজন ভদ্রবেশী কয়েদী এগিয়ে এসে ইংরেজিতে বলল, ‘নালিশ আছে, ইওর অনার।’

ইংরেজী শুনে কৌতূহল হল সাহেবের। দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, কে তুমি?

—আজ্ঞে আমি আপনার ফৌজদারী কোর্টের একজন মোক্তার।

—গুড গুড্‌! What brings you here?

মোক্তারবাবু নিজস্ব ইংরেজীতে তাঁর দুরবস্থার যে বর্ণনা দিলেন, তাকে সংক্ষেপ করলে এই রকম দাঁড়ায়—দুজন মক্কেল-সমেত একখানা রিক্শা চড়ে জরুরী মামলার তাড়ায় তিনি কোর্টে যাচ্ছিলেন। রাস্তার মোড়ে ট্র্যাফিক পুলিস পাকড়াও করে বসল। নরম হলে হয়তো ছেড়ে দিত। কিন্তু মোক্তারি কায়দায় আর্গুমেন্ট করতে গিয়ে যেতে হল থানায়, সেখান থেকে আদালতে। বিচারক ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট। ইদানীং দ্রুত ডিপোজালের জোরে প্রথম শ্রেণীতে প্রমোশন পাবার চেষ্টায় ছিলেন। আসামী ডকে উঠতে না উঠতেই রায় দিয়ে ফেললেন, দু-টাকা জরিমানা অনাদায়ে দু-দিন বিনাশ্রম কারাদণ্ড।

এসব মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের রেওয়াজ নেই। সেটাই সাধারণ রীতি। কিন্তু বর্তমান আসামীটি অসাধারণ, অর্থাৎ মোক্তার। সুতরাং আইনের ধারা উপধারা উল্লেখ করে সওয়াল শুরু করলেন। নজির-টজির দেখিয়ে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করলেন, মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টে এরকম কোনও বিধান নেই যে তিনজন মানুষ এক রিক্শায় যেতে পারবে না। অত নম্বর বাই-লতে শুধু বলা আছে যে, চার মণের বেশী ওজন কারও রিক্শাতে বইতে দেওয়া হবে না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সরকার পক্ষকে প্রমাণ করতে হবে যে অভিযুক্ত ব্যক্তির ওজন চার মণের অতিরিক্ত। উপযুক্ত দাঁড়িপাল্লা ছাড়া সে প্রমাণ সম্ভব নয়। অতএব—

এই পর্যন্ত শোনবার পর অনারারি হাকিম জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে করলেন পাঁচ টাকা আর তার বদলে জেলের মেয়াদ হল সাতদিন। সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী মামলার আসামী এসে ডক অধিকার করল।

মক্কেলরা ওঁর অংশের জরিমানাটাও দিতে যাচ্ছিলেন, মোক্তারবাবু বাধা দিলেন এবং ডক থেকে নেমে সঙ্গের পুলিসকে বললেন, আমি জেলে যেতে চাই।

কালেক্টর সাহেব ধীরভাবে শেষ পর্যন্ত শুনে বললেন, আপনার বীরত্বের প্রশংসা করি। But what can I do for you? আমাকে কি করতে হবে বলুন?

মোক্তারবাবু বললেন, আইনত আপনার কিছুই করবার নেই। Summary trial. এ সব কেস্-এ আপীলও চলে না। কিন্তু আপনি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। আপনার ফৌজদারি কোর্টে, বিশেষ করে অনারারি বেঞ্চে বিচারের নামে যে-সব জিনিস চলে, তারই একটা নমুনা আপনাকে দিলাম। এ-সম্বন্ধে আপনার ধারণা থাকা দরকার।

ধন্যবাদ জানিয়ে কালেক্টর সাহেব বিদায় নিলেন এবং অফিসে এসে আমার কাছ থেকে মোক্তারটির নাম বিবরণ সব সংগ্রহ করে নিয়ে গেলেন।

সেইদিন বিকালেই মোক্তারবাবুর ‘ফাইন-মেমো’ এসে গেল—জরিমানা আদায় হওয়ায় খালাসের হুকুম। উনি তো অবাক! কে দিল জরিমানা?

দিন দুই পরে রাস্তায় দেখা, ডেকে থামিয়ে বললেন, ব্যাপারটা শুনেছেন মশাই? আমার সেই হাকিমের বোধ হয় চাকরি গেল।

বললাম, চাকরি গেল মানে? চাকরি থাকলে তো যাবে! উনি তো শুনলাম অনারারি।

—ওই অনারারি চাকরির জন্যেই প্রাণ দিয়ে থাকে ওরা। কিন্তু সেটাও আর থাকছে না।

–কেন?

—সেদিন আপনার ওখান থেকে বেরিয়েই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সোজা একেবারে ওর কোর্টে গিয়ে হাজির। একখানা পাঁচ টাকার নোট বের করে দিয়ে বললেন, ‘নবীন মোক্তারের জরিমানা। আমার হাকিমের অবস্থা একবার ভেবে দেখুন। টাকা নেয় কেমন করে? না নিয়ে উপায় নেই। অনুনয় করে বললেন, টাকাটা আমাকে দিতে দিন স্যার। সাহেব নাছোড়বান্দা—তুমি কেন দেবে? এটা আমার দণ্ড।

—আপনার দণ্ড কেন, স্যার? মাথা চুলকে বলল হাকিম।

—তোমার মতো ম্যাজিস্ট্রেটের উপরওয়ালা হয়েছি বলে।

আয়নাঘটিত ব্যাপারের পরদিন জেলর সাহেব অফিসে এলেন না। এল একটা স্লিপ, তাঁর আরদালি মারফত। এক লাইন লেখা— সময় করে একবার দেখা করবেন।’ যেতেই হাতে দিলেন একখানা ছুটির দরখাস্ত। বললেন, আপাতত চার মাসই রইল। তবে এটা শেষ নয়, প্রথম কিস্তি।

আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম ওঁর মুখের দিকে। মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বললেন, আর ফিরতে চাই না মলয়বাবু

তখনও ওঁর চাকরি শেষ হতে বছর দুই বাকি। আর্থিক অবস্থা অকালে অবসর নেবার পক্ষে অনুকূল নয়। হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় যা করতে যাচ্ছেন, তার থেকে তাঁকে নিরস্ত করাই আমার কর্তব্য। কিন্তু তখনও কানে বাজছিল তাঁর শেষ কথাটার রেশ—আর ফিরতে চাই না মলয়বাবু। এমন একটা সুর ছিল তার মধ্যে, যার পরে কোনও কথাই আমার মুখে যোগাল না। দরখাস্তখানা হাতে করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কয়েক মিনিট পরে উনি আবার বললেন, চাকরি অনেক দিল হল। কথায় কথায় লালমুখের ড্যাম্ ফুল শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। সব নিঃশব্দে সয়ে গেছি। ওদেরই রাজত্ব, না সয়ে উপায় কি বলুন! কিন্তু বুড়ো বয়সে সবার সামনে এই বাঁদরনাচটা আর সহ্য হল না ভাই—

দরজার দিকে চেয়ে থেমে থেমে কথাগুলো বলে গেলেন সান্যালমশাই। চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, তাঁর দৃষ্টি দরজা পার হয়ে চলে গেছে বত্রিশ বছর আগে, যেদিন প্রথম তাঁর অঙ্গে উঠেছিল এই দাসত্বের আচ্ছাদন। সুখে দুঃখে এতগুলো দিন কেটে গেছে। জীবনে রঙীন মুহূর্ত যে একেবারে আসেনি তা নয়। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে ওঁর ঘৃণাকুঞ্চিত চোখের সামনে ভেসে উঠল যে-জীবনের ছবি, তার আগাগোড়া ছেয়ে আছে ‘শুধু দিনযাপনের, শুধু প্রাণধারণের গ্লানি।’

জেলর সাহেবের বাড়ির গেট পেরোতেই ছুটতে ছুটতে এল ওঁর সাত বছরের ছেলে পিন্টু। ফিফিস্ করে বলল, কাকাবাবু, মা আপনাকে ডাকছে।

সান্যাল-গৃহিণী কোনোদিন আমার সামনে বের হননি। হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে গেলে ঘোমটাটা টেনে দিয়েছেন কপালের নীচে। আজ আমাকে তাঁর কিসের প্রয়োজন বুঝতে কষ্ট হল না। পিন্টুর সঙ্গে খিড়কি দিয়ে ঢুকলাম। দরজার মুখেই উনি দাঁড়িয়ে। বারো থেকে পাঁচ বছরের তিন-চারটি ছেলেমেয়ে এসে ঘিরে দাঁড়াল। সবারই মুখে উদ্বেগের চিহ্ন। ছোট হলেও তারা বুঝতে পেরেছে একটা কিছু আসন্ন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোনও পারিবারিক অকল্যাণ। কোনও রকম ভূমিকা না করেই উনি অনুনয়ের কণ্ঠে বললেন, আপনি ওঁকে একটু বুঝিয়ে বলুন ঠাকুরপো। একটা মাথা গুঁজবার জায়গা পর্যন্ত করেননি। কোথায় গিয়ে উঠবো এতবড় সংসার নিয়ে? ছেলেগুলো কেউ মানুষ হল না। তিনটে মেয়ে পার হতে বাকী। জানেন তো সব।

জানি সবই। তার সঙ্গে একথাও জানি, ছোট বড় সব মানুষের জীবনে এমন এক একটা ক্ষণ আসে যার অদৃশ্য বাহু তাকে তার চিরাভ্যস্ত ‘জানা’ এবং ‘বোঝার’ সরল রাস্তা থেকে একটানে ছিনিয়ে নিয়ে যায় সমস্ত হিসাব-নিকাশের আওতার বাইরে। তেমনি একটা প্রলয় মুহূর্ত আজ দেখা দিয়েছে তাঁর স্বামীর জীবনে এবং তারই দুর্বার প্লাবনে ভেসে চলেছেন প্রবীণ প্রাজ্ঞ এবং পাকা জেলর রায়সাহেব গণপতি সান্যাল। কেউ তাঁকে আটকাতে পারবে না।

যে বুঝবে না তাকে বুঝিয়ে বলবার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সান্যাল-গৃহিণীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

.

রায়বাহাদুর এবং খানবাহাদুরদের বন্ধন-ভয় দেখিয়েই আ মিনিয়ম সাহেব নিশ্চিন্ত ছিলেন না। ক’দিনের মধ্যেই দাঙ্গার এক চমৎকার প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেললেন। তার নাম একজিবিশন, অর্থাৎ কৃষি-শিল্প প্রদর্শনী। কিন্তু আসর জমল যাদের নিয়ে তারা শিল্পীও নয় কৃষকও নয়, তারা কলকাতার বড় বড় দোকানদার। দলে দলে এসে বসল জমকালো স্টল সাজিয়ে। সেই সঙ্গে এল ম্যাজিক, সার্কাস, নাগরদোলা আর বাঈনাচ। ঘটা করে হল দ্বারোদ্ঘাটন। ম্যাজিস্ট্রেট কাঁচি দিয়ে ফিতে কাটলেন। তার আগে বক্তৃতা দিলেন পরিষ্কার বাংলায়। বললেন, এটা শুধু জিনিসপত্তর আর আমোদ-আহ্লাদের একজিবিশন নয়, এটা প্রেমের এবং ঐক্যের একজিবিশন। একজিবিশন কথাটার মানে হল—দেখানো। পাশাপাশি জেলাগুলোকে আপনারা দেখিয়ে দিন, তারা যখন একে অন্যের গলায় ছুরি বসাচ্ছে, আমরা তখন গলাগলি ধরে আনন্দ করছি।

গেট-দর্শনীর উল্লেখ করে বললেন, ‘আমরা অনেক রকম কর দিয়ে থাকি—আয়কর, পথকর, জলকর। তার ওপোর এই যৎসামান্য ‘বিপিন কর’—দু’আনা, বলে একজিবিশন কমিটির সেক্রেটারি বিপিন করকে দেখিয়ে দিলেন। চারদিকে হাসির রোল পড়ে গেল।

সম্প্রদায় বিশেষের বিজ্ঞ ব্যক্তিরা কিন্তু বেঁকে রইলেন মুখ গোমড়া করে। রাজনীতি ও ধর্মনীতি—উভয় মঞ্চ থেকে শোনা গেল তাঁদের আর্তনাদ। প্রথম দল একজিবিশন. নামক অনাবশ্যক বিলাসের মুণ্ডুপাত করে দরিদ্র জনসাধারণের জন্য বিপুল অশ্রুমোচন করলেন। দ্বিতীয় দল শ্মশ্রু আন্দোলন করে হুঙ্কার দিলেন গান-বাজনা, বাঈনাচ সব হারাম হ্যায়।

কিন্তু প্রদর্শনী বয়কট করলেও তার দর্শিকাদের প্রতি অতিশয় অগ্রাহ্য দেখাতে শুরু করলেন তাঁদের স্বর্ণচন্দ্র যুবক দল। মহিলা গেটের সামনেটায় নানারূপ অঙ্গভঙ্গীর একজিবিশন দেখিয়ে তাঁরা তাঁদের চিরন্তন ঐতিহ্যের পরিচয় দিতে লাগলেন। বিপিন করের কমিটি মৃদু প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বিনিময়ে লাভ করলেন ইষ্টকখণ্ড। তারপর হঠাৎ একদিন অবতীর্ণ হলেন এক ট্রাক লালপাগড়ি সহ স্বয়ং জেলা-শাসক। দর্শনমাত্র রোমান্স-সন্ধানী বীরবৃন্দ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলেন। যাঁরা পিছিয়ে পড়লেন, তাঁদের পৃষ্ঠদেশে পড়ল কিঞ্চিৎ মৃদু যষ্ঠি, এবং আশ্রয় জুটল সরকারী হাসপাতালে। আরেক দলের হাতে পড়ল লৌহবলয় এবং তাঁরা স্থানলাভ করলেন আমার লৌহতোরণের অন্তরালে।

তারপর যা হয়ে থাকে, রণক্ষেত্রে দেখা দিলেন কাগজওয়ালার দল। আইন বাঁচিয়ে দিনকয়েক গলাবাজি দেখালেন পুলিসী-জুলুমের প্রতিবাদে। আসর বিশেষ জমল না। শেষ দৃশ্যে দেখা গেল, যে-সব বীরপুরুষেরা মহিলা গেটের পাশে জটলা করতেন, তাঁরা এবং তাঁদের বন্ধুরা যথারীতি দু’আনা ‘বিপিন কর’ দক্ষিণা দিলো বড় গেটে ভিড় করছেন।

বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছিলাম এই মৃদু যষ্টির গোটকয়েক মৃদু তরঙ্গ নাকি ভেসে গিয়ে লেগেছিল মন্ত্রিসভার মসনদে। কর্তাব্যক্তিদের তলব পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট গেলেন কলকাতায়। সেখানে কি জাতীয় উপদেশ তাঁর মাথায় বর্ষিত হয়েছিল জানা যায়নি, তবে তার সবগুলোই যে ঐ অ্যালুমিনিয়ম চাকতির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ পেতে দেরি হল না। রাজধানী থেকে ফিরবার দিনকয়েক পরেই, তাঁর নির্দেশে ব্যাপকতর যষ্ঠি-চালনার পুনরাবৃত্তি হল জজকোর্টের প্রাঙ্গণে।

এবারকার লক্ষ্য ছিলেন জনৈক নারীহরণকারী মহাপুরুষের একদল ভক্ত। ঘটনা সামান্য। সেসন-কোর্টে যখন তাঁর বিচার চলছিল, অভিনন্দন জানাতে গিয়ে ভক্তবৃন্দ কিঞ্চিৎ বেসামাল হয়ে পড়েছিলেন। ফলে জজসাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের শরণ নিতে বাধ্য হন।

পর পর দু-বার এমনি উপযুক্ত এবং সময়োচিত ঔষধ প্রয়োগের ফলে দাঙ্গাবিকার প্রশমিত হল। আমি এবং আমার মতো হাজার হাজার নিরীহ প্রাণী এই ভেবে নিশ্চিন্ত হলাম যে আরও কিছুকাল দুনিয়ার দানাপানি কপালে আছে, হঠাৎ ছোরার মুখে পৈতৃক প্রাণটা বোধহয় দিতে হল না।

আজ ভাবছি, এমনি দু’-একটা পাগলা ‘অ্যালুমিনিয়ম’ যদি সেদিন জুটত পদ্মা, মেঘনা, রূপসা, কর্ণফুলীর তীরে, হয়তো বদলে যেত এই হতভাগ্য দেশের ইতিহাস; অন্তত মুছে যেত একটা কালিমা-লিপ্ত দীর্ঘ অধ্যায়, যার প্রতি ছত্রে জড়িয়ে আছে হত্যা-লুণ্ঠন, দাবানল আর নারী-নিগ্রহের দুরপনেয় কলঙ্ক।

.

মাঝখানে সামান্য কিছুদিন বিরতির পর ম্যাজিস্ট্রেট যথারীতি আবার তাঁর সাপ্তাহিক জেল পরিক্রমা শুরু করলেন। সেদিনটা ছিল রবিবার। রাউণ্ড শেষ করে সুপারের অফিসে বসে মন্তব্য লিখছিলেন পরিদর্শকের খাতায়। চাপরাসী একখানা কার্ড রেখে গেল। লেখা শেষ করে সাহেব আগন্তুককে ডেকে পাঠালেন। ঘরে ঢুকে গুড মর্নিং জানাল একটি গোবেচারী গোছের ছেলে। মাথায় উষ্কখুষ্ক চুল, চোখে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি।

—Are you coming from the Air? কার্ডখানা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সাহেব।

ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। সাহেব কার্ডের উল্টো পিঠটা তুলে ধরলেন তার সামনে। বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে AIR. লজ্জিত মৃদু হাসি ফুটে উঠল ছেলেটির মুখে। বলল, আমি অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে চাকরি করি।

—I see. তারপর? কি মনে করে? আমি গাইতেও জানি না, বক্তৃতা করতেও শিখিনি। আমাদের এই চৌধুরীকে বরং ধরে নিয়ে যেতে পার। He writes stories —বলে কৌতুক-দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।

ছেলেটি এসব প্রসঙ্গের জবাব দিল না। একখানা হাতে-লেখা দরখাস্ত এগিয়ে দিয়ে বলল, বড্ড বিপদে পড়ে এসেছি, স্যার। আপনি রক্ষা না করলে আমার আর উপায় নেই।

সাহেব দু-চার লাইন পড়ে কাগজখানা আমার হাতে দিয়ে বললেন, পড়, কি লেখা আছে। শুনতে শুনতে (এক ফাঁকে লক্ষ্য করলাম) ওঁর মুখের পেশীগুলো ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠল, ঘনিয়ে এল গাম্ভীর্যের ছায়া।

বিষয়টি বিস্ময়কর হলেও তখনকার দিনে বিচিত্র নয়। ছেলেটির নাম শশাঙ্ক সেন। চিটাগং কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে অল ইণ্ডিয়া রেডিওর কোনও স্টেশনে একটা চাকরি সংগ্রহ করে। খুব কপালজোের বলতে হবে। কেননা প্রথমে আর্মারি রেইড, তারপর আসানুল্লা হত্যা, এত বড় দুটো প্রলয় কাণ্ডের পর চট্টগ্রামবাসী সেন, রায়, বাঁড়ুজ্জেদের সরকারী চাকরি লাভ আর আকাশের চাঁদ পকেটস্থ করা ছিল একই বস্তু। কিন্তু কপাল তাকে খানিকদূর এগিয়ে নিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারল না। চাকরি পাকা হবার পালা যখন এল, সরকারী নিয়মে দরকার একটি পুলিশ রিপোর্ট। স্টেশন ডিরেক্টর চিটাগং ডি. আই. জি.’র শরণ নিলেন। উত্তরে এমন একটি শেল গিয়ে পড়ল তাঁর টেবিলে, যার একঘায়ে চাকরি পাকা হওয়া তো দূরের কথা, একেবারে ভূমিসাৎ।

স্টেশন ডিরেক্টর মশাই লোক ভাল ছিলেন। খতম-নোটিসের সঙ্গে পুলিসের চিঠিটাও শশাঙ্কর হাতে দিলেন। সে দেখল, যে-সব ভয়ানক ব্যাপারে তাকে জড়িত করা আছে, তার কোনোটার সঙ্গেই এ-জন্মে অন্তত তার যোগাযোগ ঘটেনি। যে-সব ভয়ঙ্কর ব্যক্তির উল্লেখ আছে তার অপকর্মের সঙ্গী বলে, তাদেরও সে বহু চেষ্টা করে মনে করতে পারল না। সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল শুধু চারটি প্রাণী-বিধবা মা, একটি বয়স্কা বোন আর গোটাদুই অপোগণ্ড ভাই, তার এই ক্ষীণ চাকরি-সূত্রটি আশ্রয় করে যারা ঝুলে আছে বিরাট অনশনের গহ্বরের মুখে।

শশাঙ্কর চোখের দিকে চেয়ে ডিরেক্টর সাহেব নোটিশটা আপাতত ফিরিয়ে নিলেন এবং ক’দিনের ছুটি দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলেন দেশে। বললেন, ওদের গিয়ে ধরো। দ্যাখ একবার চেষ্টা করে।

মনিবের উপদেশমত দিনসাতেক ধরে শশাঙ্ক শেষ চেষ্টা করে দেখল। পুলিসের বড় সাহেবের অফিসে ধর্ণা দিল কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারল না। অ্যাডিশনাল সাহেবের চাপরাসীর চাপদাড়ি দেখেই ফিরে এল, সাহেবের শ্রীমুখ দর্শন হল না। কিন্তু আসল হর্তাকর্তা এবং বিধাতা যিনি, অর্থাৎ এক নম্বর ডি. আই. ও., তিনি ওকে বঞ্চিত করলেন না। খাতির করে কাছে বসিয়ে স্নিগ্ধ-কণ্ঠে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ইংরেজ তাড়াবো, আবার তার চাকরিও করবো—এ দুটো তো একসঙ্গে হয় না শশাঙ্কবাবু। তার চেয়ে আপনার বোমাধারী বন্ধুদের স্মরণ করুন। তাঁরাই একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। বলে উচ্চহাস্য করে উঠলেন।

এমনি যখন অবস্থা, তখন এক উকিল-বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সব দেখে এবং শুনে তিনি পরামর্শ দিলেন, এক কাজ কর। কপাল ঠুকে চলে যাও পাগলা ‘অ্যালুমিনিয়মে’র কাছে। অঘটন ঘটাতে যদি কেউ পারে, ঐ লোকটাই পারবে। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলে হয় লাঠি নয় রুটি, দুটোর একটা জুটবেই।

সব কথা গুছিয়ে বলা শশাঙ্কের পক্ষে সম্ভব হবে না মনে করে উকিল-বন্ধু তার হয়ে এই দরখাস্তটা লিখে দিয়েছেন।

.

সাহেব প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা মন দিয়ে শুনলেন এবং পুলিস সাহেবের সই করা রিপোর্টটাও দেখলেন। তারপর শাণিত দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন শশাঙ্কর দিকে। দু-চারটি ভাল-পোশাক-পরা ইংরেজি কথা হয়তো মনের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছিল বেচারা, কিন্তু ঐ চোখের সামনে তারা আর বেরোতে সাহস পেল না। আমিও ভেবে পেলাম না, এ দৃষ্টির অর্থ কি! ছেলেটার হয়ে একটু ওকালতি করবো কিনা ভাবছি, হঠাৎ ঐ পুলিস-রিপোর্ট-খানা পকেটস্থ করে একলাফে উঠে পড়লেন ভদ্রলোক এবং ছুটে বেরিয়ে গেলেন গেটের দিকে। গেট খোলার দেরি সয় না। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই তাঁর গাড়িখানা একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। শশাঙ্কর এত সাধের দরখাস্ত পড়ে রইল টেবিলের উপর।

জানি যার বিরুদ্ধে এত বড় এবং এই জাতীয় গুরুতর অভিযোগ, ইংরেজ সরকারের দয়া বা অনুগ্রহ তার প্রত্যাশা করা অনুচিত। তবু তার উকিল বন্ধুটির মতো আমার মনেও কেমন একটা ক্ষীণ আশা দেখা দিয়েছিল, অ্যালুমিনিয়ম সাহেব হয়তো পুলিশের চশমা দিয়েই সবটা দেখবেন না।

ছেলেটিকে আমার অফিসে নিয়ে গিয়ে বসালাম। কিন্তু সান্ত্বনা দেবার মতো -কোনও কথাই খুঁজে পেলাম না। শুধু বোঝাবার চেষ্টা করলাম, সে একা নয়, হাজার হাজার শশাঙ্ক সেন ছেয়ে আছে এ দেশের ঘরে ঘরে।

সে কোনও কথাই বলল না। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাটিয়ে বলল, ওরা যা লিখেছে তার একটা কথাও যদি সত্যি হত স্যার, আমার কোনও ক্ষোভ ছিল না। কিন্তু সবটাই যে মিথ্যা। অথচ—

টেলিফোন বেজে উঠল জেল-গেটে। গেট-কীপার ছুটে এসে জানাল, কালেক্টর সাব সেলাম দিয়া।

—ছেলেটি কি চলে গেছে? ব্যস্তভাবে প্রশ্ন করলেন সাহেব।

—এখনও যায়নি স্যার।

—ওকে আজকেই চলে যেতে বল। He must report to his Director at once. জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, কোনও চিঠিপত্র দেবেন কিনা। তার আগেই রিসিভারটা নামিয়ে রাখার আওয়াজ শোনা গেল।

সেইদিন সন্ধ্যাবেলা লালদীঘির বেঞ্চিতে দেখা হয়ে গেল পুরাতন বন্ধু দুর্গাদাসবাবুর সঙ্গে। ডি. আই. বি. আফিসের হেডক্লার্ক দুর্গাদাস দত্ত। বললেন, অ্যালুমিনিয়মের কাণ্ড শুনেছেন?

—শুনিনি তো?

“কাণ্ডের” বর্ণনা দিলেন দুর্গাদাসবাবু।

অতিরিক্ত কাজের ভিড় সামলাতে না পেরে রবিবার সকালেও ওঁরা আফিস করছিলেন। এক নম্বর ডি. আই. ও. আলি সাহেবও উপস্থিত। ভাঙা গলায় কাকে ধমকাচ্ছিলেন। হঠাৎ সব চুপ। কি ব্যাপার! তাকিয়ে দেখেন, সামনে দাঁড়িয়ে স্বয়ং কালেক্টর। আলি সাহেবের টেবিলে একটা কাগজ রেখে বললেন, এটা তোমরা পাঠিয়েছিলে?

—ইয়েস স্যার।

—Let me see his papers, শশাঙ্ক সেনের ফাইল বের কর। বলে, বসে পড়লেন সামনের একটা চেয়ারে।

সে-যুগের চাটগাঁয় বাস করে টিকটিকির কবলে পড়েনি, বিশেষ সম্প্রদায় বাদ দিলে, এ রকম ছেলে কিংবা মেয়ে বোধহয় একটিও ছিল না। বয়স তার যাই হোক—পনের কিংবা পঁয়ত্রিশ। কিন্তু নিয়ম-মাফিক ফাইল থাকত শুধু রুই কাতলাদের বেলায়। তারই মধ্যে লেখা হত তাদের ঠিকুজী কোষ্ঠী, রোজনামচা। চুনো-পুঁটিদের আবার ফাইল কোথায়? তাদের ইতিবৃত্ত লুকিয়ে থাকত এ. এস. আই. বা ওয়াচারদের পকেটবুকে। এমনি একটা কিছুর উপর ভিত্তি করেই হয়তো রচিত হয়েছিল শশাঙ্ক সেনের রিপোর্ট।

পাগলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সে-কথা বলা যায় না। অতএব শুরু হল ফাইল-সন্ধান, যাকে বলা যেতে পারে বন্যহংসীর অনুসরণ। প্রথমে এ টেবিল ও টেবিলে একটু আধটু খোঁজাখুঁজি, তারপর আলমারির তাক। কিন্তু সাহেবের ওঠাবার নাম নেই। তখন রেকর্ড- রুমে ছাদ-সমান উঁচু র‍্যাকের উপর মই লাগিয়ে স্বয়ং ইনস্পেক্টর তাঁর তিনজন সহকারী নিয়ে পুরনো কাগজের গাদা হাতড়ে চললেন। ম্যাজিস্ট্রেট অপেক্ষা করে আছেন। ধৈর্য পরীক্ষায় ওদের কাছে হার মানবেন না, এই যেন তাঁর পণ। কিন্তু সব জিনিসের একটা শেষ আছে। একটা বাণ্ডিল দু’-তিনবার করে দেখেও সন্ধান-কার্য একসময়ে শেষ হল। সর্বাঙ্গে ধুলোর প্লাস্টার লাগিয়ে শুষ্কমুখে আলি সাহেব এসে দাঁড়ালেন ম্যাজিস্ট্রেটের টেবিলের পাশে। সাহেব একবার চোখ তুলে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত ইনস্পেক্টর। ধুলো ঘাঁটাই সার হল। তবে আমি এটা আগেই জানতাম। যা নেই বা কোনোদিন ছিল না, তা পাওয়া যায় না!

পুলিস রিপোর্টটা চেয়ে নিয়ে সেইখানে বসেই একটা মোটা কলম দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লিখলেন তার উল্টোপিঠে—’শশাঙ্ক সেনের কাগজপত্র সব দেখলাম। তার বিরুদ্ধে আপত্তিকর কিছুই পাওয়া গেল না। এখানে যে অভিযোগ করা হয়েছে সব ভিত্তিহীন। পুলিসের তরফ থেকে তার কলফার্মেশন সম্পর্কে কোনও বাধা নেই। স্টেশন – ডিরেক্টর এ বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত করেন জানালে বাধিত হবো।’

লেখা শেষ করে সেইখানে বসেই সেটা নিজে হাতে খামে ভরলেন, গালা আর মোমবাতি চেয়ে নিয়ে শীলমোহর করলেন তার উপর, এবং স্টেশন-ডিরেক্টরের ঠিকানা লিখে বাইরে গিয়ে ফেলে দিলেন ডাকবাক্সে।

.

সাত-আট দিন পরে আবার জেল ভিজিটের পালা। গেটে ঢুকেই বললেন, সেই ছেলেটি কনফার্মড হয়ে গেছে শুনেছ? ওদের ডিরেক্টরের চিঠি পেলাম কাল। বললাম, আমিও ওর চিঠি পেয়েছি। ও আসছে দু-চার দিনের মধ্যে।

—কেন?

—ঠিক জানি না। বোধহয় উপকারটা পেল, তার জন্যে নিজে এসে একবার—

–না, না। লিখে দাও খরচ-পত্তর করে আসতে হবে না মিছিমিছি।

—একটা কথা জিজ্ঞেস করবো…

সাহেব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন, বললাম, ওর সম্বন্ধে আপনি যা লিখেছেন, আমি জানি। কিন্তু প্রথম লাইনটা বুঝতে পারিনি। শুনলাম, ওর ফাইল-টাইল কিছু পাওয়া যায় নি। অথচ—

—লিখেছি সব পাওয়া গেছে, এই তো? তার কারণ বুঝলে না! যদি লিখতাম কাগজ পাওয়া গেল না, বাড়ি পৌঁছবার আগেই ঐ ইনস্পেক্টর লাফাতে লাফাতে ছুটত আমার পেছনে, দাঁত বের করে বলত, ফাইল পেয়েছি স্যার। এক শীট কাগজে গোটাকয়েক আঁচড় কাটতে কত সময় লাগে! দশ মিনিট? তারও কম। সে সুযোগ ওদের আমি দিতে চাইনি। একটু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হল। তাছাড়া উপায় ছিল না। এর পরে আবার কিছু একটা বানিয়ে ফেলবে, সে পথ বন্ধ করে দিলাম।—বলে ছেলেমানুষের মতো হো হো করে হেসে উঠলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *