তিন
আমাদের মোক্ষদা-মাসীকে নিশিতে পেয়েছিল; আমাকে পেল হাসিতে। মাসীকে দেখেছি, নিশির ডাকে ঘুরছেন ফিরছেন, কিন্তু চেতনা নিদ্রাচ্ছন্ন। আমিও তেমনি লিখছি, পড়ছি, কাজ করছি, কিন্তু সমস্ত মনটা মোহাচ্ছন্ন। সে শুধু উন্মুখ হয়ে আছে একটি অলক্ষ্য ‘সুরের পানে, যে সুরের তুলনা নেই, কোনো যন্ত্রী যাকে রূপ দিতে পারেনি, পারবে না, যে-সুর শুধু মধুর নয়, মাদকতাময়। মাঝে মাঝে ওবাড়ির কোন্ মুক্ত দ্বারপথে ভেসে আসে তার একটুখানি রেশ। কিংবা হয়তো ওটা আমার মধুর বিভ্রম।
আত্মবিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছি। এ আমার কী হল? তবে কি কাঞ্ছীকে আমি মনে মনে—? পাগল! কাঞ্ছী কে? একটা পাহাড়ী গাঁয়ের মেয়ে। শিক্ষা নেই, সভ্যতার আলোকে বেড়ে ওঠেনি, সংস্কৃতির ছাপ লাগেনি ওর দেহ-মনে। কাঞ্ছী রূপসী নয়। যৌবনের যে মোহন স্পর্শ সব নারীকেই একটি সুষমা দান করে, সেটুকু ছাড়া আকর্ষণ করবার মত নিজস্ব কিছু নেই ওর দেহে। মুখখানি অনিন্দ্য নয়। দেখবার মত সুন্দর শুধু দুটি রক্তাভ কপোল। কিন্তু সেও তো পাহাড়ী তরুণীর সাধারণ সম্পদ। সুগৌর গণ্ডের প্রস্ফুট লালিমা দার্জিলিং-এর পথে ঘাটে অহরহ দেখতে পাচ্ছি। তবে? না; বিশ্লেষণ করে তো কিছু পেলাম না। কিন্তু হায়! এমন হাসি কে কবে হেসেছিল?
বাগানে কাজ করছিলাম। কখন তন্ময় হয়ে ডুবে গেছি কোন্ দূরশ্রুত হাসির ফোয়ারায়—
—অনুমান করছি, আপনিই মিস্টার চৌধুরী।
চমকে উঠলাম, পেছনে একেবারে পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে শ্বেতাঙ্গী মহিলা, মিসেস রয়, আমার বড় মনিব মিস্টার হ্যারল্ড রয়ের সহধর্মিণী।
বিনীতভাবে জানালাম, তাঁর অনুমান সত্য।
এঃ তুমি দেখছি একেবারে ছেলেমানুষ। আমার স্বামীর মুখে প্রায়ই শুনি তোমার কথা। মাঝে মাঝে এসো না আমার বাড়ি?
দেশীয় খ্রীস্টানের বিদেশিনী স্ত্রী—এই মহিলাটির সম্বন্ধে মনে মনে একটা বিরূপ ভাবই ছিল। দেখলাম, ভুল করেছি। তাঁর সস্নেহ অনুরোধে সানন্দে সম্মতি দিলাম। মহিলাটি সত্যিই খুশী হলেন। স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, তোমার বুঝি খুব ফুলের শখ? ঐ রোগটা আমারও ছিল একদিন। আজকাল প্রায় কাটিয়ে উঠেছি। কি ফুল লাগাচ্ছ?
বললাম, গোটা কয়েক ফ্লকস্ আর ডায়াস্থাসের চারা যোগাড় করেছি।
—আমার কাছে হলিহক্স্ আছে। পাঠিয়ে দেবো। ঐ পাঁচিলের ধারে ধারে দিও। চমৎকার ব্যাকগ্রাউণ্ড হবে।
পরদিন। বিকালের দিকে গেলাম মিসেস রয়ের বাড়ি। মিস্টার ছিলেন না, শুনলাম কিছুক্ষণ আগে মফঃস্বলে গেছেন। নির্জন বাড়িতে মিসেস একা সমাদর করে বসালেন, যেন কতকালের আপনার জন আমি। সুগন্ধি দার্জিলিং চা আর নিজে হাতে তৈরি কেক খেতে দিলেন। পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, আর দু’খানা খাও, আমার জিম বড্ড ভালবাসত…
একটু থেমে মৃদু সহজ কণ্ঠেই বললেন তাকে হারিয়েছি আজ দশ বছর। তুমি আর সে বোধহয় একবয়সীই হবে। বেঁচে থাকলে অ্যাদ্দিনে তোমার মত হ’ত। তারও বড্ড ঝোঁক ছিল পড়াশুনোয়। ভগবান দিলেন না…
কণ্ঠস্বরটা কেমন উদাস হয়ে এল শেষের দিকে।
এ দুঃসংবাদ আগেই শুনেছিলাম। ঐ জিমই ওঁদের একমাত্র সন্তান।
মিসেস রয় আগ্রহ করে তাঁর লাইব্রেরী দেখালেন। মূল্যবান সংগ্রহ। বললেন, একদিন খুব ঝোঁক ছিল। আর ভালো লাগে না। এসব বই যদি তোমার পছন্দ হয়, যখন খুশী এসে পড়বে। য’খানা খুশী নিয়ে যেও। কোনো সঙ্কোচ করবে না।
ছাড়তে চান না। ঘণ্টা কয়েক পরে যখন বিদায় চাইলাম, বললেন, আবার এসো। তুমি এলে; সন্ধ্যাটা বেশ কাটল।
আমার মনিব মিস্টার হ্যারল্ড রয় বিলাতফেরত ব্যারিস্টার। আসলে তিনি একজন ম্যাজিস্ট্রেট। জেলের এই খবরদারি তাঁর বোঝার উপর শাকের আঁটি—ক্ষীণ অ্যালাউন্সের সূত্র দিয়ে বাঁধা। এই অ্যালাউন্সের পরিমাণ সম্বন্ধে তিনি সর্বদা সচেতন। তাঁর মোট বেতনের অনুপাতে জেল বিভাগ তাঁকে যতটুকু দেয়, মোট সময়ের ততটা অংশই তিনি আমাদের জন্যে ব্যয় করেন। কাগজপত্রে যেখানে যেখানে তাঁর সই দরকার, তার পাশে একটা × কাটা চিহ্ন দিয়ে রাখতে হয়। এই তাঁর নির্দেশ। তিনি ঝড়ের মত আসেন এবং মোটা কলম দিয়ে কতগুলো সই-এর ঝড় তুলে দিয়ে ঝড়ের মত বেরিয়ে যান। একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাগজগুলো সরিয়ে নেন। একটু দেরি হলেই প্রশ্ন করেন, হাতে বাত ধরেছে কিনা, আর একটু তাড়াতাড়ি হলেই জিজ্ঞেস করেন, is there anything to hide? আমার সৌভাগ্য, এই কাগজ টানা কাজটা আমার ভাগে পড়েনি। তাহলে আমার প্রবেশনার জীবনের একদিনেই অবসান হত।
মিস্টার রয় আফিসে যতক্ষণ থাকেন, একেবারে পুরোদস্তুর সাহেব। কারুর সম্বন্ধে অনাবশ্যক কৌতূহল নেই। আফিস-সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া কারো সঙ্গে বাক্যালাপও করেন না। আমি রোজই তাঁর খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকি। কালেভদ্রে দু-একটা দরকারী কথা ছাড়া আমার দিকে কোনো মনোযোগ দেননি কোনদিন।
সেদিন হঠাৎ সই করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, তোমার প্রভিডেণ্ড ফাণ্ড আছে?
বললাম, না।
পরদিন অফিসে ঢুকেই দু’খানা কাগজ আমার হাতে দিয়ে বললেন, এখনি ফিল আপ্ করে দাও।
কাগজটা দেখলাম প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডে টাকা জমাবার দরখাস্তের ফর্ম্। কিন্তু আমার ক্ষুদ্র রোজগারের একটি পয়সাও জমাবার জন্যে অবশিষ্ট থাকে না। ভাগীদার অনেক এবং আমার উপর তাঁদের মনোভাব যাই হোক, আমার অর্থের প্রতি তাঁরা কখনও বিরূপ। নন্। ইতস্তত করছি দেখে, মিস্টার তাড়া দিলেন, কুইক্ কুইক্। ওতে আমারও একটা সই দরকার হবে।
সবিনয়ে বললাম, আপনি আমার জন্যে যে কষ্ট স্বীকার করেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডে টাকা রাখবার মত সঙ্গতি আমার নেই।
—কেন?
একটু ইতস্তত করে বললাম, আমার এই সামান্য আয়ের উপর দু’একটা আত্মীয় পরিবারকে নির্ভর করতে হয়।
—তাদের বঞ্চিত করতে তো তোমায় বলিনি।
—কিন্তু তাদের আর এই ফাণ্ডের দাবি মিটিয়ে বাকী যা থাকবে তাতে আমার খাওয়া চলে না স্যার।
—যদি না চলে খাবে না—অম্লান বদনে উত্তর দিলেন মিস্টার রয়, fill it in, quick!
ভেবে দেখলাম, প্রবেশনার মানুষ আমি। আর বেশীদূর অগ্রসর হওয়া সমীচীন হবে না। ফরমের ঘরগুলো পূরণ করে তাঁর হাতে দিলাম।
প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের নিয়ম অনুসারে মাসিক বেতনের প্রতি টাকায় এক আনা থেকে দশ পয়সা পর্যন্ত জমানো চলে। সে টাকা মাইনের বিল থেকে কেটে দিতে হয়। বলা বাহুল্য, আমি এক আনা হারেই কাটবার ব্যবস্থা করেছিলাম। উনি সেই অঙ্কটা বদলে দশ পয়সা হারে যা হয়, তাই বসিয়ে নিলেন।
আমি অনুনয় করে বললাম, একেবারে মরে যাবো স্যার।
—নেভার মাইণ্ড, বলে সই করেই উঠে পড়লেন। দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, My dear friend, আজ তুমি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছ নিশ্চয়ই। কিন্তু I can assure you, এমন একদিন আসবে যেদিন তুমি আমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করবে; সেটা অবিশ্যি আমি শুনতে পাবো না। কেন না আমি তার অনেক আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছি।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। মিস্টার রয় যথারীতি সই করছেন। হঠাৎ একটা কাগজের দিকে তাঁর নজর পড়ল। ট্রেজারী থেকে টাকা তুলবার কটিনজেন্ট বিল।
জেলের অধিবাসীদের ধর্মপ্রাণ করে তুলবার জন্যে সরকারী প্রচেষ্টার অন্ত নেই। সে উদ্দেশ্যে নিযুক্ত আছেন বিভিন্ন ধর্মের উপদেষ্টা—পাদরি পণ্ডিত এবং মৌলবী-সাহেবের দল। সপ্তাহান্তে একবার এসে নরকবাসী পাপাত্মাদের একসঙ্গে জড়ো করেন তাঁরা। উদ্ধারের মন্ত্র প্রচার করেন। অর্থাৎ কয়েদী বেচারারা ঐ একটি দিন কাজকর্ম ছেড়ে কিছুক্ষণ একত্রে বসে একটু খোশগল্প করবার সুযোগ পায়। এই উপদেষ্টা অবৈতনিক, কিন্তু একটা যাতায়াত ভাতা ভোগ করেন—সপ্তাহে আড়াই টাকা কিংবা ঐ রকম কিছু। সেইটাই বিল করে ট্রেজারীতে পাঠানো হচ্ছে ক্যাশ করবার উদ্দেশ্যে। অঙ্কের পরিমাণ মবলক সাড়ে বারো টাকা।
ব্যাপারটা মনিবকে বুঝিয়ে দিলাম। মিস্টার রয় কলম তুলে বললেন, কিন্তু আমি যে দেখেছি ফি রবিবার ঐ পণ্ডিত আর পাদরি লাফাতে লাফাতে আসে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে। ওদের আবার গাড়িভাড়া কিসের?
আমি বললাম, ওরা কি করে আসে সেটা আমাদের দেখবার কথা নয়। সরকার যখন ওদের রাহাখরচ মঞ্জুর করেছেন, ওটা ওদের প্রাপ্য।
মিস্টার রয় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, কে বললে ওটা ওদের প্রাপ্য? সরকারী অর্থের যাতে অযথা খরচ না হয়, সেটা দেখাই আমার কর্তব্য।
তারপর একটু ব্যঙ্গের সুরে বললেন, তোমার দেখছি ভয়ানক দরদ ওদের ওপর বখরা আছে বুঝি কিছু?
ঝাঁ করে উঠল মাথার ভিতরটা। কিছুদিন থেকে চাকরির মায়া ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসছিল। একটা দমকা হাওয়ায় আজ সেটা একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল। মুহূর্তে মনস্থির করে ফেললাম। রূঢ় জবাব মুখে এসে গিয়েছিল। কোনো রকমে নিজেকে সংযত করে ফিরে এলাম নিজের টেবিলে। একখানা কাগজ টেনে নিয়ে তাড়াতাড়ি কয়েক লাইন লিখে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দিলাম। কাগজখানা ওঁর সামনে রেখে বললাম, কাল সকালে ছেড়ে দিলেই কৃতজ্ঞ হবো। দেড়টার মেল ধরতে চাই।
মনিব কাগজখানা পড়ে পকেটে পুরলেন এবং তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন। বাকী কাগজ আর সই হল না।
.
কয়েকখানা চিঠির উত্তর দেবার ছিল। সন্ধ্যাবেলা বসবার ঘরে বসে তারই দু-একটা সেরে রাখছিলাম। দরজায় করাঘাত। খুলে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারি না। অত বড় মনিব সশরীরে আমার দরজায়। অভ্যর্থনা করতে ভুলে গেলাম। উনি সেজন্য অপেক্ষা করলেন না। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলেন। আমি একখানা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললাম, বসুন স্যার। তিনি ফিরেও দেখলেন না। ঘরের চারদিক ঘুরে দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখতে লাগলেন। একখানা ছবি দেখিয়ে বাঙলা ভাষায় প্রশ্ন করলেন, ইনি কে?
এই প্রথম বাঙলা শুনলাম মিস্টার রয়ের মুখে।
বললাম, আমার বাবা।
—বেঁচে আছেন?
—না।
—রক্ষা পেয়েছেন, বলে কটমট করে তাকালেন আমার দিকে। আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম।
একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, তোমার বয়স কত?
বয়স বললাম।
—আমার একটা ছেলে ছিল। ঠিক তোমার বয়সী। বেঁচে নেই। … ভগবানকে ধন্যবাদ দিই সেজন্য। …কেন বুঝতে পারছ?
আমি উত্তর দিলাম না।
—বেঁচে থাকলে সে হয়তো আজ তোমারই মত বেয়াদব তৈরি হত। বাপের বয়সী অফিস-মাস্টারের মুখের ওপর ছুঁড়ে মারত Letter of resignation!—বলে আমার সেই ইস্তফাপত্র কুটিকুটি করে ছিঁড়ে টুকরোগুলো আমার গায়ের উপর ছুঁড়ে ফেলে ঝড়ের মত বেরিয়ে গেলেন।