লৌহকপাট – ১.১১

এগারো

স্বপ্ন দেখছিলাম। দার্জিলিং-এ আমার সেই বাংলো। বাইরের ঘরে ক্যাম্পচেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। বেলা গড়িয়ে গেছে। জানলায় দাঁড়িয়ে ডেকে যাচ্ছে কাঞ্ছী, বাবুজি বাবুজি। ঘুম কিছুতেই ভাঙছে না। কাঞ্ছীর হাসির ফোয়ারা” খুলে গেল, ছড়িয়ে পড়ল স্বপ্নময় মধুর ঝঙ্কার। …

ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। বিছানার পাশে বিশ্রী কর্কশ সুরে বেজে চলেছে অ্যালার্ম ঘড়িটা। রাত দুটো বেজে পনের। রাউণ্ডে যেতে হবে। নিতান্ত যে ক্রীতদাস তারও আছে গভীর রাত্রির বিশ্রামের অবকাশ। আমার নেই। সেই কথাটাই জানিয়ে দিল ঘড়িটা।

ফাল্গুনের শেষ। শীত চলে গেছে। রাত্রিশেষের কোমল দেহে লেগে আছে তার বিদায়ের স্পর্শ। কী মধুময় এই নিশীথ রাত্রির শয্যার আলিঙ্গন! ‘ক্লান্তি টানে অঙ্গ মম।’ কিন্তু তার চেয়েও প্রবলতর টান মহেশ তালুকদারের ডিউটি রোস্টারের চতুর্থ লাইন—”বৃহস্পতিবার লেট্‌ রাউণ্ড—ডেপুটি জেলর বাবু মলয় চৌধুরী।” কোনোরকমে শরীরটাকে টানতে টানতে বেরিয়ে পড়লাম, শেক্সপিয়র যাকে বলেছেন—crawling like a snail। আজ বুঝলাম, এই অনবদ্য বিশেষণটির এর চেয়ে যথাযথ প্রয়োগ আর হতে পারে না। কোনো রাউণ্ডগামী জেলর কিংবা তার ডেপুটির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি মহাকবির। যদি হত, বেচারা ইস্কুলের ছেলেগুলোর মাথায় এত বড় অপবাদের বোঝা চাপিয়ে যেতেন না।

রাউণ্ডে চলেছি। কিসের উদ্দেশ্যে আমার এই নৈশ অভিযান? কর্তব্যপরায়ণতা, সতর্কতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বড় বড় কথা খুঁটা দিয়ে যতই কেননা একে উঁচুতে তুলে ধরি, নিজের কাছে একথা লুকানো নেই যে, আমার আসল উদ্দেশ্য—শিকার সন্ধান। চাকরির উচ্চ মঞ্চে আরোহণের যতগুলো সোপান আছে, এও তার মধ্যে একটি। এই শিকার- সংখ্যাই হচ্ছে আমার কৃতিত্বের মাপকাঠি। গিয়ে যদি দেখি, আমার শিকারের দল, অর্থাৎ নিশাচর প্রহরীকুল সজাগ ও সতর্ক, তাদের মাথার পাগড়ি মাথার উপরেই আছে, চাদরত্ব প্রাপ্ত হয়ে দেহ আবৃত করেনি; তাদের পায়ের জুতো পায়েই শোভা পাচ্ছে, উপাধানে রূপান্তর লাভ করেনি, আমার সমস্ত পরিক্রমা ব্যর্থ হবে। আমার রিপোর্ট হবে একটি লাইন—Found everything in order. বলা বাহুল্য, এই সরল এবং সুরহীন রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের কর্ণে সুধা বর্ষণ করবে না, অর্জন করবে কুঞ্চিত নাসিকার অবজ্ঞা— লোকটা কি ওয়ার্থলেস! অর্থাৎ অন্যের গলদ আবিষ্কারের অক্ষমতাই হচ্ছে আমার নিজের গলদের বড় প্ৰমাণ।

কিন্তু অদৃষ্ট যদি প্রসন্ন হয়, আমার রিপোর্টের পাতা ভরে উঠবে বিচিত্র শিকার- কাহিনীর সরল বর্ণনায়। কারো হাতে লাঠি নেই, কারুর জামায় নেই বোতাম, কেউ হয়তো দাঁড়িয়ে গেছে দু’মিনিট অবিরাম টহল দিতে দিতে, কেউ বা নিজের সীমানা ছেড়ে দিয়ে গল্পের থলেটা খুলে ধরেছে সদ্য-মুলুক-প্রত্যাগত কোনো ভাইয়ার কাছে। এছাড়া থাকবে দুটো একটা sleeping while on duty—নৈশ প্রহরীর সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ—ঘুম।

ঘুম! তারই বা কত বিচিত্র রূপ! এতদিন জানা ছিল মুদ্রিত চক্ষুই নিদ্রাদেবীর আসন। খাট নাই, পালঙ্ নাই, খোকার চোখে বস। কিন্তু খোকার সে চোখ যদি চেয়ে থাকে, ঘুমপাড়ানী মাসী পিসি তো সেখানে বসতে পারেন না। এই কথাই তো শুনে এসেছি মা-ঠাকুরমার কাছে। রাউণ্ডে বেরিয়ে ধরা পড়ল, ছেলেমানুষ পেয়ে কী প্রতারণাই না . তাঁরা করে গেছেন। ঐ যে সিপাইটি লাঠি ঠুকে ঠুকে টহল দিচ্ছে, পা ফেলছে ঠিক সমান তালে, চোখ খোলা, দৃষ্টি শূন্যে নিবদ্ধ, কাছে এগিয়ে যান, শুনতে পাবেন ওর নাকের ডাক। পথ আগলে দাঁড়ান, ও সোজা এসে পড়বে আপনার ঘাড়ের উপর। মাথার উপর থেকে টুপিটা তুলে নিন, ও জানতে পারবে না। ও জেগে নেই। গভীর ঘুমে বিভোর।

ঐ পাঁচিলের ধারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে শিবনেত্র প্রহরী, লাঠিটা ধরে আছে নিখুঁত অ্যাটেনশনের ভঙ্গীতে, আমাকেই যেন সম্মান দেখাবার জন্যে, দেহ নিস্পন্দ, মাথাটি পর্যন্ত দুলছে না,—ওরও সমস্ত চেতনা নিদ্রাচ্ছন্ন।

এরা হঠযোগী নয়, চলন্নিদ্রাসন বা অন্য কোনো উৎকট আসনও অভ্যাস করেনি বিষ্টু ঘোষের আখড়ায়। কিন্তু এর পেছনে আছে দীর্ঘ দিনের সাধনা আর তার মূলে নিতান্ত প্রাণের দায়। সমস্ত জীবনে ‘একটি সম্পূর্ণ রাত্রিও যাদের কাটে না শয্যার আশ্রয়ে, নিদ্রাবশীকরণের এই দুরূহ প্রক্রিয়া তাদের বাধ্য হয়েই শিখতে হয়। এই বিদ্যার জোরেই এরা ধূলি নিক্ষেপ করে আমাদের হুঁশিয়ার চোখে এবং আমাদের মারাত্মক লেখনীর কবল থেকে মুক্তি পায়। মুক্তি পায় না তারা, এই জাতীয় ভ্রাম্যমাণ এবং দণ্ডায়মান নিদ্রা যাদের আয়ত্ত হয়নি, নিদ্রা যাদের কাছে শয়নসাপেক্ষ, অর্থাৎ কোনো যৌগিক বা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় না নিয়ে যারা সোজা সটান আশ্রয় করে ভূমিতল। কিন্তু ধূলি-নিক্ষেপের হাত থেকে সেখানেও যে আমাদের চক্ষুযুগল পুরোপুরি মুক্ত নয়, তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমাদের সহকর্মী মহীতোষদা।

ভালোমানুষ বলে মহীতোষবাবুর অখ্যাতি ছিল। সেটা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন পুরো তিন মাসের মধ্যেও তাঁর রাউণ্ডের জালে কোনো শিকার ধরা পড়ল না। মহীতোষ রাউণ্ডের সংখ্যা ও সময় বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু তাঁর কপাল ফিরলো না। তারপর একদিন তাঁর নজরে পড়ল, রাউণ্ডে বেরিয়ে প্রতিবারই একটা-না-একটা পোস্ট তিনি খালি দেখতে পান। অনুপস্থিত সিপাহীর অবস্থান সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে তার প্রতিবেশী ওয়ার্ডার এমন একটা জায়গার নাম করে, যেখানকার ডাক জৈবিক প্রয়োজনে অলঙ্ঘনীয়। একদিন তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট, আধ ঘণ্টা যায়। প্রতিবেশী সিপাহী কেমন অস্বস্তি বোধ করছে, কিন্তু তার বন্ধুর দেখা নেই। মহীতোষদা একটা গাছের গোড়ায় বেশ স্থায়ীভাবে বসলেন। ক্রমে প্রহরী বদলের ঘণ্টা পড়ল এবং কিছুক্ষণ পরে একদল নতুন সিপাহীও এসে গেল। পুরানো দলকে এবার ফিরে যেতে হবে। কিন্তু যার জন্যে তিনি অপেক্ষা করে আছেন, তার অগস্ত্য যাত্রার অবসান হল না।

তারপর সেই বিশেষ স্থানটিও খুঁজে দেখা গেল। কেউ নেই। মহীতোষবাবু নিরাশ হয়ে অগত্যা ফিরে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছেন, হঠাৎ গাছের উপর থেকে ঝুপ্ করে তাঁর মাথায় একটা কি পড়ল। এ কি? খাকী টুপি এল কোত্থেকে! প্রথমটা মনে হল ভৌতিক ব্যাপার। কিন্তু গভীর রাতে গাছের ডাল থেকে নিরীহ ভদ্রলোকের মাথায় টুপি বর্ষণ করে মজা দেখবার মত রসজ্ঞান ভূতেরও আছে কিনা সন্দেহ হল মহীতোষবাবুর। সন্দেহভঞ্জনে দেরি হল না। নিরুদ্দেশ সিপাহীর সন্ধান পাওয়া গেল। অর্থাৎ দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তিনি ‘উচ্চ বৃক্ষচূড়ে বাঁধি নীড়’ নির্বিঘ্নে এবং সুস্থদেহে নিদ্রা-সুখ উপভোগ করছেন। শিরচ্যুত টুপিটা অসময়ে বিশ্বাসঘাতকতা না করলে সে নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাবার আশু সম্ভাবনা ছিল না।

মহীতোষবাবু অতঃপর আবিষ্কার করলেন, ব্যাপারটা আকস্মিক নয়। তিনটি বৃহৎ শাখার প্রশস্ত সঙ্গমস্থলে কম্বল বিছানো এবং সেটা নিয়মিত নিদ্রার স্থায়ী ব্যবস্থা। কারো ব্যক্তিগত বন্দোবস্ত নয়, রীতিমত যৌথ কারবার। লভ্যাংশ সমান ভাগে বণ্টন করা হয়। অর্থাৎ প্রত্যেকটি সিপাহী পালা-ক্রমে এই নিদ্রাসুখ ভোগ করেন এবং তার শূন্য পোস্টের উপর যখন রাউণ্ড অফিসারের নজর পড়ে, পার্শ্ববর্তী বন্ধুরা কৈফিয়ত দেয়—call of nature, Sir.

জেল কর্তৃপক্ষের সৌভাগ্য, সকলেই মহীতোষবাবু নয়। পাহারাওয়ালার মধ্যে যেমন একদল থাকে বুনো ওল, রাউণ্ডওয়ালাদের মধ্যে তেমনি আছে দু-চারটা বাঘা তেঁতুল। তার সব চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আমাদের ‘গগন ডিপ্‌টি’। ভদ্রলোক পদে কেরানী, কিন্তু পরিচ্ছদে ডেপুটি জেলর। নাম গগন হালদার, সিস্টীরা বলে গগন ডিপটি। যদিও কেরানী হিসাবে ‘রাউণ্ড’ তাঁর অবশ্য করণীয় নয়, তাঁর অস্থাধিক উদ্যম ও উৎসাহ লক্ষ্য করে কোনো সুরসিক জেলর রাউণ্ডের তালিকায় গগনবাবুর নামটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। সেই অবধি তাঁর দাপটে সিপাহী-কুল কম্পমান। টহল দিতে দিতে দু-মিনিট যদি কারো পা দুটো থেমে যায়, লাঠিখানা জড়িয়ে ধরে চোখ দুটো যদি জড়িয়ে আসে তন্দ্রায়, অন্য বাবুদের কাছে কান্নাকাটি চলে, রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু গগন ডিপ্‌টির কাছে নিস্তার নেই। তাই তাঁর রাউণ্ডের পালা যেদিন পড়ে, সিপাহী মহলে হুঁশিয়ারির অন্ত নেই। সবাই সেদিন পুরোদস্তুর ভালো ছেলে। Everything in order। বলা বাহুল্য সেটা গগনবাবুর কাম্য হতে পারে না। তাঁর কলমের খোঁচায় দু-চারটা যদি ধরাশায়ী না হল, তাঁর ডেপুটিত্ব বজায় থাকে কেমন করে! কিন্তু এদিন দুর্ভাগ্য, সিপাহীরা ষড়যন্ত্র করেছে, তাঁকে সে সুযোগ দেবে না।

একদিন এক অভিনব কৌশল এল তাঁর মাথায়। গগনবাবু জানেন, আমাদেরও অজানা নেই, রাউণ্ড শেষ হলেই প্রহরীদের মধ্যে জাগে আরামের লোভ। যাক্ ফাঁড়া কাটল—বলে সবাই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কেউ কেউ হয়তো বুট খুলে একটু আরাম করে বসে, কেউ বা খানিক গড়িয়ে নেয় কোনো গাছের নীচে কিংবা বারান্দার কোণে। সেই দুর্বল ক্ষণের সুযোগ নিলেন গগনবাবু। একটা পরিক্রমা শেষ করে আধ ঘণ্টা লুকিয়ে রইলেন অফিসে। তারপর আবার শুরু হল তাঁর দিগ্বিজয়। এবার জাল ভরে গেল মূল্যবান শিকারে। গোটা-চারেক শিপিং, ছ’সাতটা সিটিং অ্যাণ্ড ডোজিং, তাছাড়া ডজনখানেক টুপিহীন মাথা আর বেল্টহীন কোমর। শাস্তির হিড়িক পড়ে গেল পরদিন সকালের অফিসে। গগন ডিপ্‌টির কৃতিত্বে ম্লান হয়ে গেল সত্যিকার ডিটির দল।

সেবার মাঘ মাসের মাঝামাঝি। পদ্মার তীরে খোলা মাঠের মধ্যে জেল। তার উপর বাঙলার শীত। হাড়ের ভিতর থেকে কাঁপুনি উঠে ছড়িয়ে পড়ে দেহের প্রতি অঙ্গে। রাত সাড়ে তিনটা। চারদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন। তার কণাগুলো ঝরে পড়ছে বৃষ্টিধারার মত, আর বিঁধে যাচ্ছে অস্থি-মজ্জায়। সর্বাঙ্গে কাপড় জড়িয়ে চোখ দুটো কোনো রকমে খুলে রেখে এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে কাঁপছে সিপাইয়ের দল। এই ভয়ঙ্কর নিশীথে, দীর্ঘ প্রাচীরের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে কে ও? আপাদমস্তক কম্বলে ঢাকা, যেন কুয়াশার সাগরে একটি ভাসমান ভেলা। সাত নম্বরের কোণ পার হতেই হাঁক দিল সতর্ক প্রহরী, আসামী ভাগতা হ্যায়। সেই ভয়াবহ বার্তা তীরের ফলার মত বিঁধল গিয়ে সকলের কানে বেজে উঠল হুইস্ এবং সঙ্গে সঙ্গে গেট-সেন্ট্রি বাজিয়ে দিল অ্যালার্ম। আশেপাশে যারা ছিল ছুটে এল লাঠি হাতে, বেগতিক দেখে ‘কম্বল’ ধাবমান হল। কিন্তু সিপাইরা ঘিরে ফেলল চারিদিক থেকে। কী যে সে বলল, কারো কানে গেল না। লাঠি চলল বেপরোয়া।

মিনিট কয়েকের মধ্যে কর্তারা যখন এসে পৌঁছলেন, ‘কম্বল’কে তার আগেই ধরাধরি করে তোলা হয়েছে হাসপাতালের বারান্দায়। চোখ মুখ ফুলে উঠেছে। চিনতে কষ্ট হয়। আর্তনাদ শুনে বোঝা গেল। কম্বলধারী পলাতক আসামী নয়, স্বনামধন্য রাউগুবিশারদ গগন ডিপ্‌টি।

পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। কি বলছিলাম? আমি রাউণ্ডে চলেছি। রাত দুটো বেজে পঁচিশ। খানিকটা পথ চলবার পর একবার চারদিক যখন তাকিয়ে দেখলাম, নিঃশব্দে ঝরে পড়ে গেল মুহূর্ত-পূর্বের পুঞ্জীভূত গ্লানি আর বিরক্তির বোঝা। এ কোন্ পৃথিবী? এর দিকে দিকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে উঠেছে বাসন্তী জ্যোৎস্নার রজত প্লাবন; নিস্তব্ধ রাত্রির সর্বদেহে সঞ্চার করেছে ‘শোভা, সম্ভ্রম ও শুভ্রতা’। দিনের আলোয় যা কিছু ছিল তুচ্ছ ও রূপহীন, জ্যোৎস্নার মায়াস্পর্শে তাকেই দেখছি সুন্দর ও মহিমাময়। ঐ চুন-বালি-খসা ভাঙা বাড়িটা যেন রূপকথার রাজপুরী। ঐ কাঁটা ঝোপটা যেন মায়াকানন। হঠাৎ কোথা থেকে ভেসে এল বাঁশির সুর। ক্লান্ত করুণ বেহাগের ব্যাকুলতা। কে ও? হৃদয়মথিত আকুল কান্না গলিত ধারায় লুটিয়ে পড়েছে ফাল্গুনী নিশীথিনীর বুকের উপর!

গেট পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি। ১২৭ ঠিক হ্যায়, হুজুর, তালা জালা সব ঠিক হ্যায়— বুট ঠুকে স-সেলাম রিপোর্ট জানাল ‘দো-সে তিন্কা’ সতর্ক প্রহরী। অর্থাৎ দুই এবং তিন নম্বর ওয়ার্ড মিলে আসামীর সংখ্যা ১২৭; এবং তারা সবাই উপস্থিত—এই কথা জানিয়ে দিল ভারপ্রাপ্ত ওয়ার্ডার। তাকিয়ে দেখলাম, ১২৭-এর একও নেই দুটো ব্যারাকের কোনো কোণে। চাটাইয়ের বেড়া আর বাখারির জানালা কবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! কয়েদীরা সব ছড়িয়ে আছে মাঠের এখানে-ওখানে, মিশে গেছে অন্য সব ওয়ার্ডের বন্দীদের দলে। তবে তালাগুলো সব বন্ধ আছে ঠিকই এবং তার শক্তি পরীক্ষাও চলছে যথারীতি। দু-ঘণ্টা অন্তর নতুন প্রহরী এসে শূন্য ঘরের তালা টেনে জানালা ঠুকে রিপোর্ট দিচ্ছে—সব ঠিক হ্যায়, হুজুর।

আরো এগিয়ে গেলাম। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নিদ্রিত মানুষ। মাঝে মাঝে ঠকাস্ ঠকাস্ বুটের শব্দ। সবার উপর গড়িয়ে পড়ছে অবিশ্রান্ত বাঁশির সুর। বারো নম্বরের কোণে মেহগিনি গাছের তলায় একটি ছোট বাঁধানো চত্বর। তারই উপর বসে যে ব্যক্তিটি এই সুরের জাল বুনে চলেছেন, তাঁর কাছে আমার আগমন অজ্ঞাত রয়ে গেল। আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর কখন এক সময়ে তাঁর পাশটিতে বসে পড়েছি এবং কখন সে সুর থেমে গেছে, কিছুই বুঝতে পারিনি। চমকে উঠলাম তাঁর কণ্ঠস্বরে—কি খবর ডেপুটিবাবু; বে-আইনী হচ্ছে, না?

মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলাম, তা একটু হচ্ছে বৈকি।

—বাঁশিটা কেড়ে নেবেন তো?

—নেওয়াই তো উচিত। কিন্তু নিতে পারছি কৈ?

—কেন?

—কেড়ে নেবার জোরটাই যে আপনি কেড়ে নিলেন। বড্ড কবিত্ব হয়ে গেল; কি বলেন?

—তা একটু হল। কিন্তু যা বললেন, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলবো এ পথে আসা আপনার ঠিক হয়নি। আপনি মিসফিট্।

আমি বললাম, ঠিক ঐ কথাটা আমিও আপনার সম্বন্ধে বলতে পারি, অনিমেষবাবু।

এ রাস্তা আপনার নয়।

—কেন?

—আপনি শিল্পী, আপনি রসস্রষ্টা। আপনার পথ সুন্দরের পথ, বিরোধের পথ নয়। রাজনীতির বন্ধুর পথে আপনি ক্রমাগত হোঁচট খাবেন, অভীষ্ট সীমায় কখনো পৌঁছতে পারবেন না।

অনিমেষ চুপ করে রইলেন। আমি একটু থেমে আবার বললাম, আপনি হয়তো বলবেন, “আমাদের পথে সঙ্ঘর্ষ নেই। মহাত্মাজী শান্তিকামী। তিনি বলেছেন, ইংরেজের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই, তার নীতির সঙ্গে আমাদের অসহযোগ।” কিন্তু ওটা শুধু কথার মার-প্যাচ। আসল ও দুটোর মধ্যে কোনো তফাত নেই।

অনিমেষ এবারও প্রতিবাদ করলেন না। তেমনি নীরবে বসে রইলেন।

আমি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা, আপনি এদের এই অহিংস অসহযোগ বিশ্বাস করেন? নিঃসঙ্কোচে উত্তর এল—না।

—এদের এই খদ্দর ফিলজফি?

—তাও করি না।

—হিন্দু-মোস্‌লেম ইউনিটি?

—না; সে বস্তুতেও আমার বিশ্বাস নেই।

আমি হেসে ফেললাম, তাহলে দেখছি, আপনার মত বিশ্বস্ত এবং অকপট সৈনিক এদের আর নেই।

অনিমেষ গাম্ভীর্য রক্ষা করেই বললেন, কারো মতবাদ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, মলয়বাবু। আমার কাছে মানুষের থিওরির চেয়ে অনেক বড় সেই মানুষটি। সেখানে আমার বিশ্বাস অন্ধ এবং অটল। সে-জায়গায় যদি কোনোদিন ভাঙন ধরে, সেইদিন এ রাস্তা ছেড়ে দেবো।

ঠিক দু-বছর পরের কথা। মহাত্মাজী তার আগেই ‘হিমালয়ান ব্লাণ্ডার’ ঘোষণা করে সম্মুখ সমর থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। যারা তাঁর এবং তাঁর অধিনায়কদের আহ্বানে স্যর আশুতোষের গোলামখানায় পদাঘাত করে বেরিয়ে পড়েছিল তাদের কানে আবার নতুন মন্ত্র বর্ষিত হচ্ছে—ছাত্রানাম্ অধ্যয়নং তপঃ। কিন্তু সে তপস্যা নতুন করে শুরু করবার পথ কোথায়, সে সম্বন্ধে নেতৃবৃন্দ নীরব। যারা ঘাটেও নহে, পারেও নহে, সেই ঘোর সন্ধ্যাবেলায় তাদের ডেকে নেবার কেউ নেই।

এমনি সময়ে একদিন ডালহৌসি স্কোয়ারের ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল অনিমেষের সঙ্গে। আমি তাঁকে চিনতে পারিনি। চিনবার কথাও নয়। তিনিই আমাকে ডেকে থামালেন। পরনে একটি জীর্ণ খদ্দরের পাঞ্জাবি, জুতো-জোড়া তালির কল্যাণে পুনর্জন্ম লাভ করেছে। গায়ের উজ্জ্বল রং তামাটে। বয়স বেড়ে গেছে অন্তত দশ বছর।

বললাম, কী করছেন আজকাল? কলেজে ভর্তি হননি?

—কই আর হলাম? মা মারা গেলেন। দুটো বড় বড় বোন গলার উপর, আর একটা ছোট ভাই। চাকরি খুঁজছি।

—চাকরি যখন করতে চান, বি.এ.-টা পাশ করলে সুবিধা হত না?

অনিমেষ হেসে বললেন, পাশ করতে চাইলেই তো আর করা যায় না। তাছাড়া পাশ করেই বা আর কি লাভ হত? স্বদেশী মামলায় জেল খেটেছি শুনে সবাই দরজা দেখিয়ে দেয়। গভর্নমেন্ট অফিসে তো বটেই, মার্চেণ্ট অফিসগুলো পর্যন্ত। আপনার খোঁজে আছে নাকি কিছু? পনের কুড়ি—যা দেয়, তাতেই রাজী আছি।

—আচ্ছা, চেষ্টা করবো।

ঠিকানা লিখে দিয়ে অনিমেষ আবার জনারণ্যে মিলিয়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ সেইদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

এই অনিমেষ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র, তাঁর বিধবা মায়ের এবং দু-তিনটি নিঃসহায় ভাইবোনের একমাত্র ভরসাস্থল। মার একান্ত কামনা ছিল, ছেলে বিদ্বান হবে, মানুষ হবে, সংসারের দুঃখ ঘোচাবে। এই আশা নিয়েই তিনি তাঁর শেষ সম্বল ছেলের কল্যাণে নিঃশেষ করেছিলেন। তারপর কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল। ছেলে কলেজ ছেড়ে আশ্রয় নিল জেলে, আর মায়ের আশ্রয় হল শয্যা। সে আশ্রয় তাঁর ঘুচল না। তারপর একদিন সংসার থেকে তিনি বিদায় নিলেন, সম্ভবত বিনা চিকিৎসায়। রেখে গেলেন দুটি নিরাশ্রয়া অনূঢ়া কন্যা আর একটি সহায়বিহীন শিশুপুত্র। একটি ভদ্র শিক্ষামার্জিত সুখী পরিবার বন্যার জলে ভেসে চলে গেল।

অনিমেষ একটা দুটো নয়। এমনি হাজার হাজার অনিমেষ এবং তাদের মুখাপেক্ষী আরো কয়েক হাজার নর-নারী শিশু এইভাবেই সেদিন তলিয়ে গেছে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙলার ঘরে ঘরে। কে তার জন্যে দায়ী? যাঁরা রাজনীতির উচ্চ মঞ্চে বিচরণ করেন, তাঁরা হয়তো বলবেন, এরা সব স্বাধীনতার বলি। বৃহৎ সাফল্যের স্রোতের মুখে এই সামান্য ক্ষতি তৃণের মতই ভেসে গিয়ে থাকে সকল দেশে, ইতিহাসের সকল অধ্যায়ে। স্বাধনীতাকামী পরপদানত দেশের এইটাই একমাত্র পরিণাম। অস্বীকার করি না। দেশের বৃহত্তর কল্যাণের গভীর তাৎপর্য মনে মনে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অনিমেষের অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণ মুখখানা এবং তাকে ঘিরে তিনটি অ-দৃষ্ট, অপরিচিত ও অসহায় কিশোর-কিশোরীর ম্লান মুখ বারংবার চোখের উপর ভেসে উঠতে লাগল।

একটা কথা জিজ্ঞেস করা হল না। অনিমেষের সেই অন্ধ বিশ্বাস কি আজও অটুট আছে? একটা ক্ষুদ্র ফাটলও কি দেখা দেয়নি কোনোখানে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *