লৌহকপাট – ৪.৩

তিন

দূরত্বের একটা নিজস্ব মহিমা আছে। কাছে থাকতে যার দিকে একবারও ফিরে তাকাইনি, দূরে গেলে তাকেই মনে হবে অপরূপ। সামনে বসে যে আমার মনকে কোনোদিন নাড়া দিল না, একদিন দেখলাম, নাগালের বাইরে গিয়ে সে কখন মন জুড়ে বসে আছে।

কথাটা নতুন নয়, ভূতনাথবাবুকে দেখে নতুন করে অনুভব করলাম। জীবনের সাড়ে তিন ভাগ যাদের মধ্যে কাটিয়ে এলেন, আজ সেখান থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নেবার পর যখন পিছন ফিরে তাকাবার অবসর হল, তাদের দেহে নতুন রং লেগেছে। আসলে তারা যা ছিল তাই আছে, বদলে গেছে ওঁর চোখের রং।

তাঁর সঙ্গে যেদিন হঠাৎ দেখা, তারপর কয়েক মাস কেটে গেছে। ফতিমা-তোফাজ্জল আমার মনে ঝাপসা হয়ে এসেছে। এমন সময় একদিন তাঁর আকস্মিক আবির্ভাব।

ভূতনাথবাবুকে ঠিক মেজাজে পেতে হলে একা পাওয়া দরকার। আগের দিন তাই পেয়েছিলাম। এদিন আর হল না। আমার কাছে অন্য এক ব্যক্তি বসেছিলেন। আমাদের দুজনেরই চেনা। দুর্ধর্ষ বাঘ-শিকারী কালু চৌধুরী। বাদা-অঞ্চলের লোক। একদিন বহু রয়াল বেঙ্গলের প্রাণ নিয়েছেন। তারাও চেষ্টার ত্রুটি করেনি। নেহাত বরাতজোরে বেঁচে গেছেন। অক্ষত দেহে নয়; হাতে, পায়ে, পিঠের ডান দিকে প্রখর নখর ও তীক্ষ্ণ দংশনের গৌরবচিহ্ন অক্ষয় হয়ে আছে। বৈঠকখানার সংলগ্ন দক্ষিণের বারান্দায় বসে সেই সব ইতিহাস শুনছিলাম।

আষাঢ় অপরাহ্ণের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার বর্ষণ শুরু হয়েছে। সবুজ ছাওয়া প্রশস্ত ‘লন’ এবং তার তিন দিক ঘিরে কৃষ্ণচূড়া, বকুল ও আমগাছের নীচে অকাল সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার। একটানা জল পড়ার শব্দ। সিক্ত বাতাসে ভিজে মাটির গন্ধ। সব মিলে শিকার-কাহিনীর যে একটা নিজস্ব নেশা আছে, তাকে আরও গাঢ় করে তুলেছিল।

শুধু শিকারে নয়, তার বর্ণাঢ্য বর্ণনায় কালু চৌধুরীর জুড়ি মেলা ভার। তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ভারী জুতোর শব্দ এবং তার সঙ্গে এক ঝলক কড়া সিগারের গন্ধে সচকিত হয়ে উঠলাম।

কালু চৌধুরী এক সময়ে ছোটখাটো জমিদার ছিলেন। ব্যসন হিসাবে শিকারে যেমন বেরোতেন, তেমনি মাঝে মাঝে দু-চারটা দাঙ্গা-ডাকাতি, নারীহরণ ইত্যাদি অভিযানের অভ্যাসও ছিল। সেই দিক দিয়ে তিনি ভূতনাথ দারোগার পুরনো মক্কেল। আজ যদিও দুজনের ভিতরকার সে সম্পর্ক বদলে গেছে, একজন করছেন পেনসন ভোগ, আরেক জনের জীবনে এসেছে উদ্বাস্তু জীবনের অসংখ্য দুর্ভোগ, তবু ওঁকে দেখে চৌধুরীর মধ্যে একটুখানি আড়ষ্টতা দেখা দিল। ভূতনাথবাবু সেটা কাটিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন, নিজেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সহজ ও দরাজ গলায় বললেন, কিসের গল্প হচ্ছে? শিকারের? তা থামলেন কেন? চলুক না।

আমিও তাঁর প্রতিধ্বনি করে সময়োপযোগী উৎসাহ দিলাম। চৌধুরী একটু নড়েচড়ে বসে পূর্ব সূত্রে ফিরে গেলেন—’একটা জিনিস বরাবর দেখেছি। বাঘ আর বাঘিনী যখন জোড়ে থাকে, একটাকে কোনো রকমে শেষ করতে পারলে বাকীটার জন্যে আমাদের আর বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয় না।’

বললাম, কী রকম? বাকীটার তো আরও সাবধান হবার কথা।

—ঠিক উল্টো। সে তখন প্রতিশোধ নেবার জন্যে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নিজের প্রাণের দিকে তাকায় না, কাণ্ডজ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। হিংস্র প্রাণী মাত্রেই রিভেঞ্জফুল, ভয়ানক প্রতিহিংসা-পরায়ণ। তাঁর মধ্যে সবচেয়ে বেশী বাঘ।

—না।

প্রতিবাদের সুরটা এমন জোরালো যে আমরা দুজনেই একসঙ্গে বক্তার মুখের দিকে তাকালাম। ভূতনাথবাবু তেমনি দৃঢ়কণ্ঠে যোগ করলেন, তাকেও ছাড়িয়ে যায় মানুষ। যাক, আপনি বলুন!

চৌধুরী আবার শুরু করলেন—জোড়ার একটাকে মারবার পর শিকারীকেই বরং সব সময় হুঁশিয়ার হয়ে চলতে হয়। আর একটা যদি তখন ধারে-কাছে কোথাও লুকিয়ে থেকে থাকে (প্রায়ই তাই থাকে), যে মেরেছে তাকে চিনে রেখে দেয়। বাগে পেলে আর রক্ষা নেই। তাকে যদি হাতের কাছে না পায়, আক্রোশ গিয়ে পড়ে, যারা তার আপনজন, তাদের ওপর। বৌ, ছেলে, মেয়ে, কিংবা সঙ্গী-সাথী…

ব্যাপারটা আমার কাছে আশ্চর্য মনে হল। বললাম, আমার ধারণা ছিল, বাঘের কাছে সব মানুষই সমান শত্রু। তার মধ্যে আবার বাছ-বিচার করে নাকি?

—করে বৈকি। অবিশ্যি অন্য লোককে যে একেবারেই ছোঁয় না তা নয়। বিশেষ করে যেগুলো ম্যান-ইটার, মানুষের রক্তের স্বাদ যারা আগেই পেয়েছে। তবে প্রায়ই দেখা যায়, ক্ষতি যে করেছে তার ওপরেই শোধ নেবার চেষ্টা করে। তার জন্যে এমন মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে বসে, অন্য সময়ে, মানে স্বাভাবিক অবস্থায়, যা কখনও নিত না। এই সেবারে যেমন হল-

সুন্দরবনে ওঁর নিজেরই একটা শিকার-কাহিনী শোনালেন চৌধুরী। মানুষ-খেকো বাঘ নয়, অন্তত গোড়াতে ছিল না, কিন্তু ভীষণ দুর্দান্ত। মাসখানেকের মধ্যে গোটা সাতেক গরুমোষ চলে গেল তার পেটে। এতটা সাহস বেড়ে গেল যে দিনে-দুপুরে যেখানে সেখানে হানা দেয়। সাত-আট মাইল জুড়ে একটা মস্ত বড় অঞ্চল—সবাই তার ভয়ে তটস্থ। চাষ- বাস, হাট-বাজার বন্ধ হবার যোগাড়। খবর পেয়ে কালু চৌধুরী দুজন পুরনো সাকরেদ নিয়ে রওনা হলেন। এক গ্রামে শুনলেন, তার আগে আরও তিন-চারজন শিকারী পনেরো-ষোল দিন ধরে এখানে-ওখানে চেষ্টা করে গেছে। গাছের ডালে মাচা বেঁধে রাতের পর রাত কাটিয়েছে। বাঘের টিকিও দেখা যায়নি। অথচ ভোর হতে না হতেই খবর এসেছে, মাচা থেকে কয়েক পা দূরে উঠোন থেকে দুধেলা গাই নিয়ে পালিয়ে গেছে বাঘ। তার বিশেষত্ব হল, ‘কিল’-এর ধারে-কাছেও ঘেঁষে না। সেদিক দিয়ে অত্যন্ত নির্লোভ।

কালু চৌধুরী কয়েকটা গ্রাম ঘুরে, বেছে বেছে ক’টা ‘নাদুসনুদুস মোষের বাচ্চা সংগ্রহ করলেন। ওদিকে তখন ভয়ানক জলাভাব। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দু-একটা ডোবা খুঁজে বের করা হল। তার চারিদিকে ব্যাঘ্র মহারাজের বহু পদচিহ্ন। অর্থাৎ খাদ্য যেখান থেকেই জুটুক, পানীয়ের জন্যে ওখানে তাকে ঘন ঘন আসতে হয়। একটি সুবিধাজনক জায়গায় মোষশাবকটিকে বেঁধে, যতটা দূরে সম্ভব, অর্থাৎ রাইফেলের পাল্লার প্রায় শেষ সীমায় ঝোপঝাড়ের আড়ালে মাচা বাঁধলেন। বাইরে থেকে যেন কোনো রকমে বোঝা না যায়। কাঁটা ডালপালার শেষ টুকরোটা পর্যন্ত কুড়িয়ে নিয়ে দূরে ফেলে দেওয়া হল। পর পর দু-রাত গেল। বাঘ এল না।

আস্তানায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে পরের রাতটাও দেখবেন স্থির করে সবে দিবানিদ্রা সেরে উঠেছেন, এমন সময় এল এক মর্মান্তিক সংবাদ। গরু মোষ ছাগল নয়, বাঘের শেষ এবং সদ্যলব্ধ শিকার ঐ গ্রামেরই একটি বাইশ-তেইশ বছরের দুঃসাহসী জোয়ান ছেলে। জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়েছিল। একা নয়, যথারীতি দল বেঁধে। সঙ্গীরা ছিল অপেক্ষাকৃত ফাঁকার দিকে, ও একটু গভীর বনে ঢুকে পড়েছিল। বিশেষ কারও নজরে পড়ে নি। হঠাৎ তাদের কানে এল, প্রথমে সেই ছেলেটির চিৎকার এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঘের গর্জন। সবাই মিলে হৈ-হল্লা করে ছুটে গিয়ে দেখল একটা অর্ধেক কাটা গাছের গুঁড়ির খানিকটা দূরে ছেলেটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। প্রথমে ডাকাডাকি, তারপর নাড়া দিয়ে দেখা গেল, সব শেষ।

কালু চৌধুরী যখন গিয়ে পৌঁছলেন, তখনও ছেলেটার ঘাড়ের পাশ থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। পিছন দিকের একতাল মাংসই শুধু লড়ে যাই নি, হাড়গুলো গুঁড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ আঘাত আর মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান বোধহয় কয়েক সেকেণ্ড।

শিকারীর অভিজ্ঞ দৃষ্টি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে লাশ এবং তার আশপাশটা পরীক্ষা করলেন চৌধুরী। ঊরুর পিছনে আর একটা জখম চোখে পড়ল। সেটা দাঁতের। বাঘ যে অমিতশক্তিশালী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তার উপরে নররক্তের কিঞ্চিৎ আস্বাদন তার রসনায় পৌঁছে গেছে, তবু দেহটাকে ফেলে গেল কেন? চারিদিকটা আরও ভাল করে দেখা দরকার। এগিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ লোকগুলোর পিছন থেকে একটা আর্ত তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠ তাঁকে বাধা দিল। সবাইকে ঠেলে ফেলে ঝড়ের মতো ছুটে এসে মৃতদেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যে মেয়েটি, তার বয়স বোধহয় ষোল পেরোয় নি। কালো রং, নিটোল স্বাস্থ্য, বড় বড় দুটি চোখ। কয়েক মাস আগে ওদের বিয়ে হয়েছে। জল আনতে গিয়েছিল বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। ফিরবার পথেই খবর পেয়েছে। কাঁখের কলসী ফেলে দিয়ে মাঠ ঘাট জঙ্গল পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে এসেছে। সঙ্গীরা ধরে রাখতে চেষ্টা করেছিল, পারে নি। স্বামীর পিঠের উপর লুটিয়ে পড়ে তাদের স্বল্পস্থায়ী বিবাহ-জীবনের স্মৃতিভরা কত তুচ্ছ কথা বলে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। মাথার আঁচল খুলে পড়েছে, একরাশ এলো চুল ছড়িয়ে গেছে পিঠময়। মুখে কপালে চোখের কোণে অশ্রুধারার সঙ্গে মিশে গেল রক্ত। এ কান্নার যেন শেষ নেই। এ শোকের কোনো তুলনা নেই। একটা গোটা গ্রামের এতগুলো নরনারী তাদের সব কলরব সমস্ত উত্তেজনা ভুলে গিয়ে স্তব্ধ পাথর হয়ে গেছে।

কালু চৌধুরীও কিছুক্ষণ আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর এগিয়ে এলেন জঙ্গলের দিকে। শুকনো পাতার উপর খানিকটা রক্ত। এক জায়গায় নয়, মাঝে মাঝে ফাঁক রেখে রক্তের একটা লাইন চলে গেছে। অর্থাৎ আততায়ী অক্ষত দেহে যেতে পারে নি। তখন খোঁজ পড়ল ছেলেটার হাতে যে টাঙ্গী ছিল সেটা কোথায়? টাঙ্গী নেই। ভিড়ের মধ্যে একটা কলরব উঠল। এই গভীর শোকাবহ দৃশ্য এতগুলো লোককে মুহ্যমান করে রেখেছিল। শুকনো মুখগুলো হঠাৎ প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। সকলের কণ্ঠের একটা স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস।

সাবাস জোয়ান! প্রাণ দিয়েছে বটে, কিন্তু প্রাণ নিতে যে এসেছিল, তাকেও ঘায়েল না করে ছাড়ে নি। কী কব্জির জোর! টাঙ্গীটা এমন মোক্ষম জায়গায় বসিয়েছে, অতবড় বাঘের সাধ্য হয় নি খসিয়ে ফেলে। বাছাধনকে সেটা ঘাড়ে করেই পালাতে হয়েছে।

এরা সুন্দরবনের লোক। বাঘ, সাপ, কুমীর আর বুনো শুয়োর এদের নিত্যসঙ্গী। তার উপর মাঝে মাঝে আসে বন্যা, মহামারী। উঠতে বসতে মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি। যমের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয়। সেই লড়াইয়ের উত্তেজনা প্রিয়জন বিয়োগের বেদনাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে দেয় না। এই লোকগুলোও যখন দেখল এই মৃত্যুটা যত বড় করুণই হোক, কাপুরুষের মৃত্যু নয়, মুহূর্ত-মধ্যে নিজেদের টেনে তুলে চাঙ্গা হয়ে উঠল।

কয়েকজন যুবক এগিয়ে এসে শিকারীকে ঘিরে ধরল। টাঙ্গী নিয়ে বাঘ খুব বেশী দূর যেতে পারে নি, জখমের ফলে অনেকখানি কাবু হয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই, সবাই মিলে ধাওয়া করলে এখনই ধরে ফেলা যায়। এ সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না। চৌধুরী তাদের নিরস্ত করলেন। বহুদর্শী শিকারী। আহত বাঘ যে কী বস্তু, তাঁর জানা আছে। ধরা হয়তো যাবে, শেষ পর্যন্ত মারাও সম্ভব হতে পারে, কিন্তু প্রাণ দেবার আগে আরও দু-একটা প্রাণ সে না নিয়ে ছাড়বে না। তিনি মনে মনে অন্য কথা ভাবছিলেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ করা কঠিন। করলেও এরা রাজী হবে না, বিশেষ করে আত্মীয়স্বজন। তবু এই উত্তেজনার সুযোগ নিয়ে প্রস্তাবটা করে ফেললেন।

ছেলেটার বাপ বসেছিল ভিড় থেকে খানিকটা তফাতে একটা গাছের নীচে। তার মুখ থেকে একটা অস্ফুট শব্দও এতক্ষণ শোনা যায় নি। কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারই কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন চৌধুরী। বললেন, দেহটাকে যদি একটা রাত যেমন আছে ঠিক তেমনি ভাবেই রেখে দেওয়া যায়, তিনি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারেন। বাপ বিস্ময়ে বেদনায় মুখ তুলে তাকাল, কোনো উত্তর দিল না। এদিক-ওদিক চেয়ে প্রতিবেশীদের উদ্দেশে বলল, তোরা এখনও বসে আছিস? বেলা আর নেই, খেয়াল আছে?

তাই তো! আশেপাশে অনেকে সজাগ হয়ে উঠল। সৎকারের আয়োজন এখনই শুরু করা দরকার। শ্মশান নেহাৎ কাছে নয়। সামনে অন্ধকার রাত। কয়েকজন প্রৌঢ় ও যুবক উঠে পড়ল। একজন বয়স্ক লোক চৌধুরীকে একপাশে ডেকে নিয়ে চাপা গলায় বলল, সে হয় না বাবু। মড়া বাসী করতে নেই। দোষ হয়। ওটা আমরা পারবো না।

অনেকেই যাবার পথে পা বাড়িয়েছে, মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ বৌটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্যে এগোতে যাবে, এমন সময় কানে গেল তার দৃঢ় এবং স্পষ্ট কণ্ঠস্বর—’দাঁড়াও!’

সকলে থমকে দাঁড়াল।

কালু চৌধুরীও অবাক হয়ে দেখলেন, মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে, চোখে জল নেই, সমস্ত মুখখানায় যেন একটা স্থির সংকল্পের কাঠিন্য। ধীরে ধীরে তাঁরই কাছে সরে এসে তর্জনী তুলে বলল, ওকে এখানে রেখে দিলে এই রাতের মধ্যে বাঘটাকে মারতে পারবে?

ঐটুকু মেয়ের কাছ থেকে এরকম প্রশ্নের জন্যে চৌধুরী প্রস্তুত ছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারলেন না। কিন্তু পরক্ষণেই থতমত ভাবটা সামলে নিয়ে বললেন, পারবো কিনা ঠিক করে কি বলা যায়? যদ্দুর পারি, চেষ্টা করবো।

‘চেষ্টা!” হঠাৎ চমকে উঠলেন কালু চৌধুরী। তাঁর মুখের উপর যেন একতাল কাদা এসে পড়ল। ‘চেষ্টা না ছাই, চেষ্টা করলে কি আজ আমার—’

বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত কান্নায় মেয়েটি ভেঙে পড়ল তাঁর পায়ের কাছে। সেইদিকে চেয়ে চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী বলবেন, কোন্ কথা বলে তাকে সান্ত্বনা দেবেন ভেবে পেলেন না।

সহসা আবার তড়িৎস্পৃষ্টের মতো সে উঠে দাঁড়াল। দুচোখে আগুন ছড়িয়ে বলল, কিসের শিকারী তুমি? একটা বাঘই যদি না মারতে পারলে, এতগুলো বন্দুক দিয়ে কি করো?

ওর গুরুজন যারা ছিল, উঠে এসে মেয়েটাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। কেউ মৃদুকণ্ঠে তিরস্কার করল—ছিঃ ছিঃ, অমন করে বলতে হয়!

চৌধুরী যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। বললেন, ঠিকই বলেছে। ওর কোনো দোষ নেই। তোমাদের কাছে আমি একটিমাত্র ভিক্ষা চাইছি। আজকের মতো আমাকে একটা শেষ সুযোগ দাও। সমস্ত রাত রাখতে হবে না, ভোর চারটে পর্যন্ত থাক, তারপর এসে নিয়ে যেও।

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি বাড়ি যাও। কথা দিলাম, এ বাঘ না মেরে আমি ঘরে ফিরব না।

মেয়েটি চোখ তুলে তাকাল। চৌধুরী দেখলেন, তার ভিতর থেকে উপচে পড়ছে সরল কৃতজ্ঞতা। কি যেন বলতে গিয়ে বলল না। বোধহয় লজ্জা হল। তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিল। পরক্ষণেই সকলের দিকে চেয়ে অনেকটা যেন নির্দেশের সুরে বলল—চলে এসো তোমরা। -বলে আর দাঁড়াল না। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল। লোকগুলোও যেন মন্ত্রচালিতের মতো তাকে অনুসরণ করল।

কালু চৌধুরীর অনুমান, বাঘ এখানে বিশ্রাম করছিল, ছেলেটাকে আক্রমণ করবার কোনো মতলব হয়তো তার ছিল না। ও-ই হঠাৎ দেখতে পেয়ে টাঙ্গী চালিয়ে থাকবে। ক্ষেপে গিয়ে লাফিয়ে পড়ে তার ঘাড় মটকে দিয়েছে, এবং ছেলেটার মরণ চিৎকার আর লোকজনের শোরগোল শুনে লাশ না নিয়েই পালিয়ে গেছে। টাঙ্গীটা তার দেহের কোনোখানে বিঁধে রয়েছে। পরে যদি খুলেও গিয়ে থাকে, এই আঘাতের জ্বালা সে ভুলতে পারবে না। লোকজন সরে গেলে নিশ্চয়ই একবার শোধ নিতে আসবে। তাছাড়া মানুষের উষ্ণ রক্ত ক্ষণেকের জন্যে হলেও তার রসনা স্পর্শ করেছে। সে টানও কম নয়। তার চেয়ে প্রবলতর আকর্ষণ—প্রতিহিংসা। সে যে আসবেই সে সম্বন্ধে চৌধুরী প্রায় নিশ্চিত ছিলেন।

মুশকিল হল মাচা বাঁধা নিয়ে। বাঘ যদি সন্দেহ করে, ধারে-কাছে কোনোখানে শিকারীর বন্দুক ওত পেতে বসে আছে, প্রতিহিংসার তাড়না যত বড়ই হোক, আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হয়তো তাকে বাধা দেবে। সুতরাং একটা ক্যামোফ্লেজ দরকার, শিকারের চোখে ধুলো দেবার মতো খানিকটা গাছপালার অন্তরাল। হাতে সময় অতি অল্প। তার মধ্যে কোনো রকম করে একটা মাচা খাড়া করা হল। ত্রুটি রয়ে গেল অনেক। তখনকার মতো আর কোনো উপায় ছিল না।

রাতের মতো সামান্য কিছু মুখে দিয়ে একজন হুঁশিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং রাইফেল, টর্চ ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে সন্ধ্যার পর থেকেই মাচায় চড়ে বসলেন। সময় আর কাটতে চায় না। মুহূর্তগুলো যেন ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে, ঠেলে সরানো যায় না।

মাচায় বসে রাত কাটানো কালু চৌধুরীর জীবনে এই প্রথম নয়। সুন্দরবনের মশার পরিচয় আগেও অনেক পেয়েছেন। কাঠপিঁপড়ার দলবদ্ধ দংশন যে কি বস্তু, তার আস্বাদও জানা আছে। ওগুলোর কোনোটাই তাঁর গায়ে লাগে না। আজও লাগল না। শিকারকে তিনি শিকারীর দৃষ্টি দিয়েই দেখে এসেছেন। এল তো ভাল, না এলে সমস্ত রাত্রির ব্যর্থ প্রতীক্ষায় ক্লান্ত বা উত্ত্যক্ত হননি। নিতান্ত সহজ ভাবেই নিয়েছেন, কিন্তু আজ তিনি অধীর, অস্থির, অসহিষ্ণু। ঐ আশ্চর্য মেয়েটা তাঁকে চঞ্চল করে তুলেছিল। কখনও সেই দুটি দীপ্ত চক্ষু, কখনও সেই অশ্রুসিক্ত করুণ মুখখানা থেকে থেকে চোখের উপর ভেসে উঠছিল। নিজের মুখে তাকে কথা দিয়ে এসেছেন, তার স্বামীহন্তাকে শেষ না করে এখান থেকে তাঁর ছুটি নেই। আর মাত্র কয়েকঘণ্টা সময় তাঁর হাতে। যদি ব্যর্থ হন, কোন্ মুখ নিয়ে দাঁড়াবেন তার সামনে?

একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, সহকারীর মৃদু স্পর্শে সচেতন হয়ে উঠলেন। সামনের দিকে তাকিয়ে মনে হল, দূরে ঐ দুটো বড় গাছের মাঝখানে অন্ধকারটা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছিল, হঠাৎ আবার গাঢ় হয়ে উঠল। শুধু গাঢ় নয়, সচল। ধীরে ধীরে অত্যন্ত সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে। চৌধুরী রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সহসা সেই জমাট অন্ধকারের বুক চিরে দুটো অগ্নিগোলক দপ্ করে জ্বলে উঠল। তারই মাঝখানে নিশানা নিয়ে সমস্ত ইন্দ্রিয় সংহত করে তৈরি হয়ে রইলেন কালু চৌধুরী। এখনও পাল্লার বাইরে! আর একটু, আর শুধু এক ধাপ এগিয়ে এলেই গর্জে উঠবে রাইফেল। অব্যর্থ তার সন্ধান, অমোঘ তার শক্তি।

…হল না। অন্ধকার হঠাৎ মিলিয়ে গেল।

অস্ফুটকণ্ঠে একটা কুৎসিত গালাগালি উচ্চারণ করে (বোধ হয় নিজেরই উদ্দেশে) কপালের ঘাম মুছলেন চৌধুরী। সমস্ত মন ক্ষোভে নিরাশায় ভরে গেল। আর আশা নেই। যেমন করে হোক, টের পেয়ে গেছে।

ভোরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এখনই লোকগুলো লাশ নিতে আসবে। ঘায়েল বাঘকে বিশ্বাস নেই, কোথায় ওত পেতে বসে আছে কে জানে? যে আশা নিয়ে আসছিল, তার এই ব্যর্থতা হয়তো তাকে আরও মরীয়া করে তুলেছে। একটা ফাঁকা আওয়াজ করে তাড়িয়ে দেবেন কিনা ভাবছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে জঙ্গলের বাইরে থেকে একটা ভয়ার্ত শোরগোল কানে এল। তৎক্ষণাৎ গাছ থেকে নেমে পড়ে দুজনে ঊর্ধ্বশ্বাসে রাইফেল হাতে ছুটলেন। গিয়ে যা দেখলেন, শুধু করুণ বীভৎস ও মর্মস্পর্শী নয়, অতবড় বিস্ময় তাঁর বহুদর্শী শিকারী-জীবনে কোনোদিন চোখে পড়েনি, কোথাও ঘটেছে বলেও শোনেননি। বাঘ নামক জানোয়ারকে দেখবার চিনবার বহু সুযোগ তাঁর হয়েছে। তিনি জানেন, প্রতিহিংসা তার রক্তজ ধর্ম। তার বহু দৃষ্টান্ত তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁর চেয়েও অভিজ্ঞ অনেক শিকারীর মুখে শুনেছেন। কিন্তু সে যে এমন একটা আশ্চর্য নিপুণ রূপ নিতে পারে, একথা তাঁর জানা ছিল না।

চার-পাঁচজন সশস্ত্র পুরুষ বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার মাঝখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটি যুবতী মেয়ে, এখান থেকে কয়েকশ’ গজ ব্যবধানে জঙ্গলের মধ্যে যেমন করে পড়ে আছে একটি বলিষ্ঠ যুবক। এর কাঁধের উপরেও সেই একই নখরচিহ্ন, মাথাটা ঠিক তেমনি ভাবে এক দিকে ঝুলে পড়েছে।

চৌধুরীকে দেখে লোকগুলো যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। সকলে মিলে একই সঙ্গে ভয় ও উত্তেজনা মিশিয়ে যে বর্ণনা দিল তার থেকে বোঝা গেল, সমস্ত রাত মেয়েটা একবারও দু’চোখের পাতা এক করেনি। কান পেতে বসেছিল, কখন বন্দুকের আওয়াজ শোনা যাবে, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে দেখবে, বাঘটার চোখদুটো উড়ে গেছে, কিংবা সোজা বুকের মধ্যে ঢুকে গেছে বন্দুকের গুলি। ভোরের দিকে ওরা যখন খাটিয়া নিয়ে রওনা হল, কিছুতেই তাকে ধরে রাখা গেল না। ওকে মাঝখানে রেখে, টাঙ্গী হাতে সামনে দুজন, আর তিনজন চারদিকে চোখ রেখে বেশ হুঁশিয়ার হয়েই আসছিল। হঠাৎ এক ঝলক চোখধাঁধানো বিদ্যুৎ- চমকের মতো কোথা থেকে কী যেন ছুটে এসে লাফিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড মেঘ- গর্জন। কী যে হল, ঠাহর করবার আগেই দেখতে পেল তারা যেমন ছিল তেমনিই দাঁড়িয়ে আছে, মাঝখান থেকে শুধু একজন পড়ে আছে মুখথুবড়ে।

এতক্ষণ একটানা বলে যাচ্ছিলেন কালু চৌধুরী। এবারে হঠাৎ থেমে গেলেন। কয়েক মিনিট পরে মুখ তুলে বললেন, ঠিক চার দিনের মাথায় সেই বাঘ আমারই হাতে মারা পড়ল। ঘাড়ের উপর মস্ত বড় একটা ঘা। তাতে পচ ধরতে শুরু করেছে। আমাকে ঘিরে সবাই মিলে যখন বাহবা দিতে লাগল আমি লজ্জায় মরে গেলাম।

অতটুকু একটা মেয়েকে যে কথা দিয়েছিলাম, রাখতে পারিনি, তাকেও রাখা গেল না। ভূতনাথ এতক্ষণ নিঃশব্দে বসেছিলেন। তাঁর গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল, জানোয়ারটা নিশ্চয়ই বাঘিনী?

চৌধুরী মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। আপনি কেমন করে জানলেন স্যার?

—জানবো আর কেমন করে? আন্দাজ করছি।

সুরটা ‘আন্দাজে’র নয়। ওটা যে বাঘিনী, সে বিষয়ে মনে মনে নিশ্চিত হয়েই যেন প্রশ্নটা করেছিলেন। আমরা দুজনেই একটু বিস্মিত হলাম।

ভূতনাথ সেটা লক্ষ্য করে বললেন, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। কালুবাবুর বিদ্যা আমার জানা নেই। বনের বাঘিনীর খবর রাখি না। লোকালয়ে যে দু-একটি দেখেছি, তার থেকেই অনুমান করে নিয়েছিলাম।

ব্যাপারটা আরো রহস্যময় হয়ে উঠল। সে সম্পর্কে আর কোনো প্রশ্ন করবার আগেই কালু চৌধুরী ক্ষান্ত-বর্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে উঠবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। যে-কারণে বহুকাল অদর্শনের পর তিনি আমার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছিলেন, তাঁর সঙ্গেও শিকারের যোগ ছিল। অতগুলো বন্দুকের লাইসেন্স নিয়ে খানিকটা অসুবিধায় পড়েছিলেন। আমার সাহায্যে যদি কর্তৃপক্ষের অনুদার মনোভাব দূর হয়, সেই আশা নিয়ে আসা। আমার যতটা সাধ্য, সে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলাম। তিনি ধন্যবাদ নিয়ে বিদায় নিলেন।

চৌধুরীকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে এসে ভূতনাথের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, কি দেখছেন? আজ আর কোনো মতলব নিয়ে আসি নি। এমনিই এলাম।

—গাড়ি ধরবার তাড়া নেই তো?

—না, রাতটা মেয়ের বাড়িতে থেকে যেতে হবে। সেদিন থাকি নি বলে ভয়ানক রেগে গেছে।

—তাই বুঝি ছুটে আসতে হল?

—কী আর করি বলুন? তাছাড়া আপনার সঙ্গে বসে পুরনো দিনগুলোকে উল্টেপাল্টে দেখা, সে লোভটাই বা কম কিসে?

বলে হেসে উঠলেন।

আমি বললাম, তাহলে শুরু করুন। মুখপাত, মানে ইন্‌ট্রোড্রাকশন তো হয়েই আছে।

—কিসের?

—কেন, বাঘিনী? …বনের নয়, লোকালয়ের!

—ও, কিন্তু সে তো শিকার কাহিনী নয়। তার মধ্যে আর যাই থাক, থ্রিল পাবেন না।

—থ্রিলের চাইতে গভীর কিছু পাবো। কালু চৌধুরীকে তখন যে প্রশ্ন করলেন, তার থেকে মনে হচ্ছে উনি যে বাঘিনীর কথা শুনিয়ে গেলেন, আর আপনি যাদের দেখেছেন, দুয়ের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো মূলগত মিল আছে।

—আমার তো তা-ই বিশ্বাস। আপনি হয়তো মানতে চাইবেন না। সাহিত্যিক মানুষ! আপনার, শুধু আপনার কেন, সংসারে অনেকের চোখেই পুরুষের তুলনায় মেয়েজাতটা অনেক বেশী কোমল, স্নেহে, করুণায়, মমতায় অতি সহজে গলে যায়, ইত্যাদি। তাদের আরেকটা রূপ হয়তো আপনারা দেখেননি। বুকে যখন প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে, তখন ওরা যা পারে বা করে বসে, কাদের মোল্লারাও সেখানে হার মানবে।

অর্ধবিস্মৃতির ধূলি-মলিন আবরণ ভেদ করে একটি অস্পষ্ট নারীমূর্তি আমার চোখের উপর ভেসে উঠল। বললাম, এই জাতের একজনকে আমিও চিনি। তবে বাঘিনীর চেয়ে নাগিনীর সঙ্গেই তার মিল বেশী।

—আপনার কাশিম ফকিরের রূপসী বিবি কুটী বিবির কথা বলছেন তো? কিন্তু কাদেরের মতো সে-ও শেষরক্ষা করতে পারেনি।

আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে চেয়ে কথাটা আর একটু পরিষ্কার করবার চেষ্টা করলেন, -কাদের তবু নিজেকে অন্তত বোঝাতে চেয়েছিল, ফাঁসির দড়ি গলায় পরে সে তার বোনাইয়ের ওপর চরম প্রতিশোধ নিয়ে গেল। কুটী বিবির তো সে সান্ত্বনাও নেই। একদিন যার ওপরে ‘শোধ নেবো’ বলে বাইশ মাইল ছুটে গিয়ে থানার বারান্দায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, আরেকদিন তারই ‘গলা বাঁচাবার’ জন্যে উকিলের হাতে সর্বস্ব তুলে দিতেও তার বাধেনি।

—বোধ হয় সে-ও এক ধরনের শোধ নেওয়া, নিজের ওপরে নিজের প্রতিশোধ।

—তাই যদি হয়, সেখানে তার নাগিনীর খোলশ খুলে পড়ে গেছে, বেরিয়ে পড়েছে, আপনারা কাব্য করে যাকে বলেন, ‘চিরন্তনী নারী’। কিন্তু আমি যার কথা বলছিলাম, সে একেবারে জাত-বাঘিনী। যে প্রতিশোধ সে নিয়েছিল, সেটাও নিছক এবং নির্জলা জৈব প্রতিহিংসা।

বলতে বলতে ভূতনাথবাবুর চোখ দুটি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে গেল। হঠাৎ আবার প্রবল বেগে শুরু হল ধারা-বর্ষণ। আমি আমার চেয়ারটা আর একটু কাছে টেনে নিলাম। বর্ষামুখর অন্ধকারের দিকে ক্ষণকাল চেয়ে থেকে তিনি অনুচ্চকণ্ঠে বললেন, তার নাম ছিল, থাক, আসল নামটা না-ই বা বললাম। তার চেয়ে আপনি একটা নতুন নাম দিন।

বললাম, বনানী।

—বড্ড আধুনিক হয়ে গেল না?

—তা হোক, ওর মধ্যে একটা রহস্যের অন্ধকার আছে। আপনি শুরু করুন।

—বেশ।

.

ভূতনাথবাবুর প্রায় সব কাহিনীর গোড়াতেই একটা করে প্রারম্ভিক প্রশ্ন থাকে। ঠিক প্রশ্ন নয়, বলা যেতে পারে, কোনো অ্যাসাম্পশন বা কিছু একটা ধরে নেওয়া, যার আকারটা প্রশ্নের।

—ছেলেবেলায় ভূগোল পড়েছিলেন নিশ্চয়ই?

বললাম—পড়েছিলাম। মানে পড়তে হয়েছিল। পরীক্ষা নিতে চাইলে মুশকিলে পড়ে যাব। ইস্কুলে থাকতে ঐ ভূগোলটা বড় গোল বাধাত।

—তা হলেও বাংলাদেশের ম্যাপটা মোটামুটি মনে আছে তো? গোটা বাংলার কথা বলছি, আপনারা যাকে বলেন, আনডিভাইডেড্ বেঙ্গল। কথাটা আমি একেবারেই সইতে পারি নি। ওর মধ্যে একটা রাজনৈতিক মতলব আছে। ইংরেজদের ঐ ‘ডিভাইড্’ নামক কীর্তিটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। তা না হলে অংশ দিয়ে গোটা জিনিসের পরিচয়, এ কোন্ দেশী নিয়ম?

যাই হোক, সেই পুরনো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ম্যাপটা মনে করবার চেষ্টা করুন। বাঁ দিক দিয়ে নেমে এসেছে ভাগীরথী, আর ডান দিক দিয়ে পদ্মা-মেঘনা। দুটো ধারাই পড়েছে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে। মাঝখানে একটা বৃহৎ ব-দ্বীপ। আমাদের ভূগোলের মাস্টার বলতেন, ‘বদ্ দ্বীপ। মানুষগুলো সব বদ্। তোদের দিয়েই তো দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি ছিলেন মেদিনীপুরের লোক। ঐ ‘ব’-এর মধ্যে পড়েন না। আমরা সকলেই ‘ব’। রসিকতার ছলে বললেও কথাটা আমাদের লাগত। আমরা সামনে কিছুই বলতাম না, আড়ালে বলতাম ঘটি-মাস্টার।

এই ত্রিভুজের তলার দিকে অনেকগুলো সরু সরু সবুজ রেখা দেখতে পাবেন। সব গিয়ে মিশেছে বে অব্ বেঙ্গলে। যত দক্ষিণে যাবেন, তত বেশী। ওগুলো সব বড় বড় নদী। কোনো কোনোটা পদ্মা-মেঘনার চেয়েও বড়। এপারে দাঁড়ালে ওপার চোখে পড়ে না। কিন্তু ম্যাপে বা ভূগোলে কোনো নাম নেই। কাছাকাছি যারা থাকে, কিছু একটা বলে ডাকে। গাঁয়ের লোকের দেওয়া গেঁয়ো নাম। আপনার পছন্দ হবে না। ওরই একটা নাম – না-জানা নদীর ধারে সুপুরি, নারকেল, মাদার আর ঢাকাই ভেরেণ্ডার ঘন বনের আড়ালে খানকয়েক টিনের চালা নিয়ে একটি ছোট পরিবার। জনচারেক লোক। মাঝবয়সী বাপ, জোয়ান ছেলে, ছেলের মা আর বৌ। সে-ই হল আপনার বনানী।

হেসে বললাম, আমার বনানী হল কেমন করে?

—বাঃ, নামকরণের একটা প্রাপ্তি আছে তো! তার ওপরে অমন সুন্দর নাম। বাপ ছেলের নাম দুটোও কি আপনি দেবেন?

—না, ওখানে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

—বুঝেছি। তাহলে আমিই দিচ্ছি। ধরুন গোপী আর সুবল। সুখী গেরস্তই বলা চলে। অবস্থা সচ্ছল। নদীর চরে বিঘেকয়েক ধানজমি, তাতে সোনা ফলে। বছরের খরচ স্বচ্ছন্দে চলে যায়। তার ওপরে সুপুরি-বাগান, ওদেশের যেটা প্রধান খন্দ। এ ছাড়া গোপী বর্মনের কিছু কারবারও ছিল। চালানি কারবার। কখনও সুপুরি-নারকেল, কখনও ধান-চাল বোঝাই দিয়ে কয়েকজন বাঁধা লোক নিয়ে বড় বড় ছইওয়ালা নৌকোয় (ও অঞ্চলে বলে ঘাসি নৌকো) পাল তুলে চলে যায় শহরের দিকে। ফিরতে দু-তিন মাস লেগে যায়, কখনও কখনও তার চেয়েও বেশী।

এই চালানি ব্যাপারটা আসলে ছিল শিকারীর ‘ক্যামোফ্লেজ’, কালু চৌধুরী যার আড়ালে বসে বাঘের চোখে ধুলো দেয়। গোপীর বাহাদুরি আরও বেশী; সে দিত পুলিসের চোখে। আদত কারবারটা ছিল তার পিছনে, শিকারীর মাচার মতো অন্ধকারে ঢাকা। সেও এক ধরনের চালানি। তফাৎ শুধু এই, মাল রওনা হবার খবরটা পাওয়া যেত, সে মাল কোথায় গিয়ে পৌঁছল, তার হদিস মিলত না। তাছাড়া কারবারী লোকটি সব সময়েই নেপথ্যে। এই ধরুন, পানসি সাজিয়ে বাজনা বাজিয়ে বর চলেছে বিয়ে করতে। সঙ্গে দামী দামী জিনিস-পত্তর। তারপরে যে কি হল, কোনো পাত্তা নেই। এক গা গয়না পরে পাঁচটা তোরঙ্গ ভর্তি দান-সামগ্রী নিয়ে কনে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। শুভ লগ্নে নৌকো ছাড়ল, কিন্তু ঘাটে আর ভিড়ল না। জমিদারের নায়েব লাটের কিস্তির টাকা বোঝাই দিয়ে সদরের পথে বজরা ভাসালেন। সঙ্গে লাঠি-সোঁটা, বন্দুক, পাইক-বরকন্দাজ। সবসুদ্ধ কোথায় কেমন করে তারা অদৃশ্য হল, সে খবর এপারে ওপারে কোথাও গিয়ে পৌঁছল না।

পুলিসের জানা ছিল, এই সব ঘটনার প্রায় সবগুলোর পেছনেই রয়েছে একখানা ছিপ, তীরের মতো তার গতি, তার মধ্যে কয়েকটা মাত্র লোক এবং তাদের যে চালায় তার নাম গোপী বর্মন। কিন্তু রিভার পুলিসের লঞ্চ তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না। তাড়া করলেই চোখের উপর ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যায়। লঞ্চের সারেঙ্ আর খালাসিদের বিশ্বাস, লোকটা মস্ত বড় গুণিন, অদৃশ্য হবার মন্ত্র জানে। জল-পুলিসের সিপাই জমাদার, এমন কি কয়েকজন দারোগাবাবুকেও সেই কথা বলতে শোনা গেছে। ভূতশুদ্ধি, প্রেতশুদ্ধি সব রকম বিদ্যাই নাকি তার জানা আছে। তা না হলে বন্দুকের গুলি এড়ায় কি করে? একশ গজ দূর থেকে পাক্কা নিশানা নিয়ে রাইফেল ছুঁড়ে দেখেছে, লাগেনি।

একবার একখানা কাঁঠালের নৌকো মাল বিক্রী করে দেশে ফিরছিল। ধোপাডাঙার খাল পেরিয়ে বড় গাঙে পড়তেই কোত্থেকে একখানা ছিপ যেন বাজের মতো উড়ে এসে ছোঁ মারল।

আমার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, কাঁঠালের নৌকো! তাতে আর কত টাকা ছিল?

—তা কম কি? তিন-চার হাজার তো বটেই।

—বলেন কি! কাঁঠাল বেচে অত টাকা!

—সে সব কাঁঠাল আপনি দেখেন নি তাহলে। তার নাম ভাটির কাঁঠাল। এক-একটার ওজন আধমণ, ত্রিশ সের। কোয়াগুলো পাক্কা একপো, পাঁচ ছটাক। গালা নয়, মানে গালিয়ে রস করে দুধে মিশিয়ে খাবার জিনিস নয়। খাজা, কচ্ কচ্ করে চিবিয়ে খায়। ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, খুলনার ভাটির কাঁঠালের ভারি খাতির। তার কাছে রসগোল্লা কোন্ ছার। দেশী কাঠালের খন্দ শেষ হবার পর, অর্থাৎ শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে হাটে হাটে বড় বড় নৌকোর ভিড় লেগে যায়। ছোট্ট ছইটুকু বাদ দিয়ে বাকী জায়গা জুড়ে এক-একটা কাঁঠালের পাহাড়। গেরস্তের হাতে তখন পাট বিক্রির চকচকে নোট। এদিকে আউস ধানও ঘরে উঠে গেছে। দু-চার মাসের মতো খোরাকির ভাবনা নেই। ব্যস, আর কি চাই হাট-ফেরতা প্রত্যেকের কাঁধে একটা করে রাম কাঁঠাল, আর হাতে একসের দেড়সের ওজনের ইলিশ মাছ। …থানায় থানায় পুলিসের কাজ বেড়ে যায়।

—কেন? এর মধ্যে আবার পুলিস এল কোত্থেকে?

—খালি খালি কি আর আসে? ঐ কাঁঠাল আর মাছের টানে আসতে হয়। ঐ নিয়ে প্রথমে বাধে মানের লড়াই, দেখতে দেখতে সেটা আসল লড়াইতে গিয়ে ঠেকে।

—মানের লড়াইটা কি রকম?

—কি রকম? এই ধরুন, মাঝের পাড়ার মুন্সীসাহেব ইলিশ মাছ দর করছেন। জেলে বলেছিল তিন টাকা, উনি পাঁচসিকে থেকে সাতসিকে পর্যন্ত উঠেছেন, এমন সময় দক্ষিণ- পাড়ার চৌধুরী সাহেব ওধার থেকে বলে বসলেন, দু-টাকায় দিবি? ব্যস্ লেগে গেল।

‘টাকার গরম দেখাচ্ছ নাকি মিঞা-সাহেব?’

‘মনে কর তো, তাই। টাকা থাকলে তার গরমও থাকে।’

‘বটে!” দু-পক্ষেই লোক জড়ো হল। মুখোমুখি থেকে হাতাহাতি, তার পর লাঠি, সড়কি, বল্লম। আধঘণ্টার মধ্যে পাঁচটা জখম, একটা খুন।

—এ সব তো জানা ছিল না।

কেমন করে জানবেন? গাঁয়ে তো আর থাকতে হয়নি আমাদের মতো। ডিস্ট্রিক্ট্ টাউনের বাইরে কোনোদিন পা দেননি।

—তা দিই নি, তবে ঐ সব চীজ নিয়ে আমাকেও তো ঘর করতে হয়েছে।

—আপনি পেয়েছেন তৈরী ফসল। তার পেছনে যে জটিল ক্রিয়া-কলা—বীজ সংগ্রহ থেকে ঘরে তোলা—তার আঁচটুকুও গায়ে লাগেনি। সে-সব এই পুলিসের ঘাড়ে। যাক, এবার শুনুন।

ছিপের লোকগুলো যখন বড় নৌকোয় লাফিয়ে উঠল, ব্যাপারীরা লাঠি, সড়কি, ল্যাজা নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। বড় বড় গাঙ্ পাড়ি দিয়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরতে হলে ওসব সরঞ্জাম সঙ্গে রাখতে হয়। কিন্তু ডাকাতরা দলে ভারী, হাতিয়ারগুলোও মারাত্মক ফলে এদের একজন সঙ্গে সঙ্গে সাবাড় আর দু-তিনটা জখম। বাকী যারা ছিল, ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর মধ্যে। তারই একজন কোনো রকমে সাঁতরে গিয়ে ডাঙায় উঠেছিল। গোপী বর্মনের বাড়ির কাছাকাছি তার বাড়ি। রং-টং মাখা থাকলেও গলার আওয়াজ শুনে চিনতে পেরেছিল। পুরো একদিনের পথ হেঁটে কোন রকমে থানায় গিয়ে খবরটা জানিয়েছিল।

গোপীকে তখন পাওয়া যায় নি। পুলিস তাকে তাকে ছিল। দিন পনেরো পরে বাড়ি ফিরতেই ধরে নিয়ে হাজতে পুরে দিল। মাল-পত্তর টাকা-কড়ি কিছুই পাওয়া গেল না। যে লোকটি খবর দিয়েছিল, সেও কদিন পরে পিছিয়ে গেল। গাঁয়ের লোকে ভয় দেখিয়েছিল, গোপীর বিরুদ্ধে ‘সাক্ষী দিলে’ সে ‘বাণ মারবে’। ‘বাণ-মারা’ কি, জানেন তো?

—কথাটা শুনেছি, ব্যাপারটা যে কী, ঠিক জানি না।

—এক রকমের মন্তর। যাকে লক্ষ্য করে উচ্চারণ করা হবে, তার আর রক্ষা নেই, তেরাত্তির পেরোবার আগেই গুষ্ঠীসুদ্ধ মুখে রক্ত উঠে মারা যাবে। কাজেই ফরেদীকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।

সাক্ষী নেই, মাল নেই, মামলা দাঁড়াবে কিসের ওপর? আসামীকে আর হাজতে আটকে রাখা চলে না। রিভার পুলিসের ইন্সপেক্টর কালীপ্রসাদ মুখুজ্যে নিজেই তদন্ত চালাচ্ছিল। সবে প্রমোশন পেয়েছে। আশা করেছিল, গোপী বর্মনকে গেঁথে তুলতে পারলে রাতারাতি কনফারমেশন। আশাটা শুধু মনে মনে রাখেনি, একটা সাক্ষী হাতে পেয়েই বন্ধু-মহলে ছড়াতে শুরু করেছিল। কাজেই বুঝতে পারছেন, ওকে একেবারে আদাজল খেয়ে নামতে হল। হাকিমের হাতে-পায়ে ধরে কোনো রকমে আর চৌদ্দটা দিন জামিন বন্ধ রাখবার ব্যবস্থা করল। তারপর সেই রাত্রেই লঞ্চ নিয়ে রওনা হল আসামীর গাঁয়ের দিকে।

প্রথম কদিন নানাজনের কাছে খোঁজ-খবর নেবার চেষ্টা চলল। দেখা গেল, বর্মনদের আশেপাশের লোকজন কেউ বিশেষ খুশী নয়। কিন্তু আসল ব্যাপারে সব মুখ বন্ধ। তন্ত্র- মন্ত্রের কাছে পুলিস কোন্ ছার। ইন্টারোগেশনের নাম করে কালীপ্রসাদ বেছে বেছে কারও কারও ওপরে দু-চারটে ডোজ যা চালাল, তাকে হালকা বলা চলে না। কিন্তু হাজার হলেও বাণ-মারার তুলনায় সেগুলো কিছু নয়। আর কোথাও কোনো সুবিধে করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ধরল গিয়ে সুবলকে। সে আবার দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ! বাপের ধারা একেবারে পায়নি। ছেলেবেলা থেকেই একটু বোষ্টম-বোষ্টম ভাব। গলায় তুলসীর মালা, মাথায় লম্বা চুল। দিনের বেলা চাষ-আবাদ নিয়ে কাটে, সন্ধ্যার পর নামকীর্তন। বাপ তাকে ঘাঁটায় না। সেও বাপের কোনো খোঁজ রাখে না। মনে মনে বরং ঘৃণাই করে। শুধু ছেলে নয়, স্ত্রীর সঙ্গেও গোপীর যোগাযোগ অতি সামান্য। সে বেচারা তার নানা রকম অসুখ-বিসুখ নিয়ে বিব্রত। সারা বছর প্রায় শুয়েই থাকে। সংসার দেখে ছেলের বৌ, আপনার বনানী। শ্বশুরের সঙ্গে যা কিছু সম্পর্ক তারই, যদিও তার আসল ব্যবসাটা যে কী, সে সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানে না।

কালীপ্রসাদ গিয়ে প্রথমটা চেপে ধরল সুবলকে, তোর বাপ টাকা-কড়ি গয়না-গাঁটি রাখে কোথায়?

সে আকাশ থেকে পড়ল, আমি কেমন করে বলবো?

—কোথায় পোঁতা আছে দেখিয়ে দে। কাউকে কিছু বলবো না।

—জানলে তো দেখবো!

—তাহলে জেনে রেখে দে, তোর বাপ আর ফিরবে না।

সুবল চুপ করে রইল। বাপের ফেরা বা না ফেরা নিয়ে তার বিশেষ দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। কালীপ্রসাদ বলল, তুই না জানিস, তোর মা নিশ্চয়ই জানে।

—মা! রোগ-ব্যামো নিয়েই বাঁচে না, টাকাপয়সার খবর রাখবে কখন?

-–বেশ, তোর বৌকে ডাক। তাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি।

বনানীকে ডেকে আনা হল। লম্বা ঘোমটার ভিতর থেকে মাথা নেড়ে জানাল, সে কিছুই জানে না।

কালীপ্রসাদ এদিকে মরীয়া হয়ে উঠেছিল। এস. পি.-কে কথা দিয়ে এসেছে, যেমন করে হোক গোপীটাকে ফাঁসাবার মতো মালমশলা যোগাড় করে তবে ফিরবে। চৌদ্দ দিন মাত্র সময়। তার মধ্যে সাত-আট দিন চলে গেছে। আইন বাঁচিয়ে আর কাঁহাতক চলে? এবারে শেষ অস্ত্র ছাড়ল। পাড়ার কারও কারও কাছে শুনেছিল, ছেলের চেয়ে বৌয়ের সঙ্গেই বুড়োটার যোগাযোগ বেশি। এদের চোখে দেখেও মনে হল, বোষ্টম-মার্কা হাবা ছোকরাটা আসলে ভাল মানুষ, বৌটা বদমাশ। সেই হল মাথা। কাজেই কান টানলে মাথা আসে, এই থিওরী খাটিয়ে বৌয়ের সামনেই সুবলকে নিয়ে পড়ল। শুরু হল ধোলাই। পরের ঘটনা-কালীপ্রসাদের নিজের কথায় বলি।

“এসব তো আমাদের কাছে নতুন ব্যাপার নয়। আপনিও করেছেন, আমিও কম করিনি। বরাবর দেখেছি, বাড়ির পুরুষগুলোকে দু-চার ঘা লাগালেই মেয়েগুলো হয় পালায়, নয়তো ঘরের দরজা বন্ধ করে মড়াকান্না কাঁদতে বসে। এই রকম সামনে থাকতে বাধ্য করলে ছুটে এসে পা জড়িয়ে ধরে—আর মেরো না বাবু! এখানেও তাই আশা করছিলাম। কিন্তু যা দেখলাম সত্যিই তাজ্জব লেগে গেল দাদা। খানিকক্ষণ গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর যে কাণ্ডটা করল, আপনি ধারণাও করতে পারবেন না। এক লাফে এগিয়ে এসে ছোকরাকে আড়াল করে দাঁড়াল। কোথায় গেল ঘোমটা! একেবারে আমার নাকের উপর আঙুল উঁচিয়ে, যেন হুকুম দিচ্ছে এমন ভাবে বলল, মারধোর করবেন না, দোষ করে থাকে চালান দিয়ে দিন।”

কালীপ্রসাদ একেবারে ‘থ’। সত্যিই ধারণা করা যায় না। সময়টা দেখতে হবে তো? সতেরো-আঠারো সালের কথা। তখনও গান্ধী-যুগ শুরু হয়নি। ইংরেজ সরকারের পুলিসী-যুগ। আর ঐ মেয়েটাও লেখাপড়া জানা শহুরে মেয়ে নয়, অজ পাড়াগাঁয়ের নিরক্ষর চাষী-গেরস্তের বৌ। বাদা অঞ্চলের পাড়াগাঁ। ম্যাপে বাংলা দেশ হলেও, আসলে তার সঙ্গে কোন যোগ নেই। স্বদেশীওয়ালাদের ছায়াও সেখানে কেউ দেখেনি। তাদের কার্যকলাপের একটা ছোট ঢেউও গিয়ে পৌঁছায়নি ওর ধারে-কাছে।

কালীপ্রসাদের চরিত্রে আর যাই থাক, মেয়েমানুষের ওপর কোনো পক্ষপাতের বালাই ছিল না। দুর্বলতা তো নয়ই। ‘থ’-ভাবটা কেটে যেতেই এক ধাক্কায় বৌটাকে সরিয়ে দিয়ে সুবলকে ঘাড় ধরে টেনে আনল সামনের দিকে। মুচকি হেসে বলল, “চালান? বেশ তাই দিচ্ছি। তোমার সামনেই দিচ্ছি।’

দুটো সিপাইকে দাঁড় করিয়ে দিল বনানীর দু-পাশে, যাতে চলে না যায়, আর একজন আড়াইমণী জমাদারকে একটা বিশেষ ইশারা করে হুকুম দিল, ‘লেফট্-রাইট্ চালাও।’ জমাদার সুবলকে ঠেলে দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে নাল-লাগানো বুট দিয়ে তার বাঁ পা’টা চেপে ধরল। চিৎকার করে উঠতেই সেটা ছেড়ে দিয়ে বুট তুলে দিল ডান পায়ের উপর। এরই নাম লেফট্-রাইট।

ভূতনাথ দারোগার ‘কবিরাজী মুষ্টিযোগ’গুলো আমার জানা ছিল। ‘লেফট্-রাইট্’- এর কথা এই প্রথম শুনলাম। বললাম, এটাও কি আপনার আবিষ্কার?

—না, এটা কালীপ্রসাদ মুখুজ্যের পেটেন্ট।

—আপনাকে অনেকখানি ছাড়িয়ে গেছেন ভদ্রলোক। যাক, তারপর কি হল বলুন।

—একবার বাঁ পা, সেটা ছেড়ে দিয়ে আবার ডান—এলোপাতাড়ি নয়, দস্তুরমতো মার্চের তালে। সুবল পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিতরের কোন্ একটা ঘর থেকে চেঁচিয়ে চলেছে তার মা। বুড়ী বাতে পঙ্গু, নড়বার ক্ষমতা নেই। বনানীর মুখে শব্দ নেই, একফোঁটা জল নেই চোখের কোণে। এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে স্বামীর দুটো পায়ের দিকে। থেঁতলে ফেটে রক্ত-মাখামাখি। হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল। দু-চোখের ভেতর থেকে ঠিকরে এল আগুনের হল্কা। দু-পাশের সিপাই দুটো টের পাবার আগেই তীরের মতো ছিটকে পড়ল। তারা দুদিক থেকে টেনে ধরতে বেশি দূর এগোতে পারল না। সেখান থেকেই বাঁ পাটা বাড়িয়ে যত জোরে পারে আড়াইমণীর ঊরুর পেছনে বসিয়ে দিল লাথি।

কালীপ্রসাদের কাজটা এতক্ষণ ছিল একতরফা। প্রভোকেশনের অভাবে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। এবারে আর কোনোদিকে কোনো বাধা রইল না। চালান দেবার প্রস্তাবটা বনানীই তুলেছিল, তারই উপরে সেটা প্রয়োগ করা হল। যে সে ব্যাপার নয়। ‘অ্যাসটিং এ পুলিস অফিসার’! তার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ—’সরকারী কর্মচারীকে কর্তব্য কর্ম সম্পাদনে বাধাপ্রদান’ ৩২৩-এর সঙ্গে ৩৫৩।

গোপী বর্মনের ঘাট থেকে খানিকটা দূরে রিভার পুলিসের লঞ্চ আগে থাকতেই নোঙর করা ছিল। বনানীকে অ্যারেস্ট করে আপাতত সেখানে নিয়ে তোলা হল। ঐ রকম ডেঞ্জারাস আসামী, এতগুলো পুলিসের চোখের ওপর যে তাদেরই একজনকে লাথি মারতে পারে, আর্মড পুলিসের হেফাজত ছাড়া তাকে অন্যত্র রাখা নিরাপদ নয়। বিশেষ করে বর্ষারাত। বাড়িটাও গ্রামের একধারে। দু-পাশে বাগান, পেছনে মাঠ, সামনে নদী। পালিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

জনমানবহীন বিশাল নদীর মধ্যে কালীপ্রসাদের লঞ্চে সেই রাতটা তার কেমন করে কেটেছিল, সে কথা আর নাই বা বললাম। সে ইতিহাস, আপনি ওর নামকরণ প্রসঙ্গে যে কথাটি বলেছিলেন, ‘রহস্যের অন্ধকার’, তারই তলায় ঢাকা থাকে।

কী মনে করে জানি না, আমি হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, আপনি তাকে দেখেছেন?

—কেমন দেখতে জানতে চাইছেন তো! এক্ষেত্রে সেটা অবান্তর। সে নারী এবং তার দেহে যৌবন আছে, স্ত্রী-জাতির চরম সর্বনাশের পক্ষে এই দুটো ফ্যাক্টরই কি যথেষ্ট নয়?

এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমি দিতে পারি নি, ভূতনাথবাবু তাঁর কাহিনীর ছিন্ন সূত্রে ফিরে গেলেন—

‘পথি নারী বিবর্জিতা’—উক্তিটি বোধহয় চাণক্য পণ্ডিতের। কালীপ্রসাদ এবার এই শাস্ত্রবাক্যের আশ্রয় নিল অর্থাৎ যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে, তারপরে আর এই আপদটাকে সদরে টেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কেঁচো খুঁড়তে যদি সাপ বেরিয়ে পড়ে তখন মাথা বাঁচাবে কে? তাই ভোর না হতেই দুজন সিপাই ধরাধরি করে বনানীকে তার বনালয়ের এক কোণে ফেলে রেখে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল, জাঁদরেল জল-পুলিসের দল সামান্য একটা মেয়েমানুষের বাঁ পায়ের লাথি বেমালুম হজম করে পুরো স্পীডে লঞ্চ ছুটিয়ে ভেসে চলেছে শহরের দিকে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল কালীপ্রসাদ, যে মামলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠবার স্বপ্ন দেখেছিল, দুটোকেই মাঝপথে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে হল।

কালীপ্রসাদ ভুল করেছিল। তার আশঙ্কা ছিল, বনানী তাকে ফাঁসিয়ে দেবে। এ যে আলাদা জাত তা বুঝতে পারে নি। এরা নালিশ করে না। নিজের লাঞ্ছনার কথা অপরের কাছে তুলে ধরে দয়া ভিক্ষা এদের ধাতে নেই। আইনের আশ্রয় নেয় না, আইন তুলে নেয় নিজের হাতে। অত্যাচারের একটা মাত্র প্রতিকার ওরা জানে, তার নাম প্রতিশোধ। সদরে নিয়ে গেলেও সে উপরওয়ালার দরবারে কাঁদুনি গাইতে বসত না কিংবা বিচারপ্রার্থী হয়ে দাঁড়াত না ফরিয়াদীর কাঠগড়ায়।

এখানেও সে কোনো আত্মীয় বা প্রতিবেশীর দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল না। রাতের অন্ধকারে কী ঘটেছে না ঘটেছে, তার ওপরে আর একটা মোটা কালো পরদা টেনে দিল। নিজের লাঞ্ছনা তো বটেই, দৈহিক যন্ত্রণাও চেপে রাখল বুকের তলায়। যেন কিছুই হয় নি, এমন ভাবে নিজের দুটো হাতের উপর দুটো কঠিন রুগীর ভার তুলে নিল। শাশুড়ী তো আগে থেকেই অচল। এবার স্বামীও পড়ল সেই দলে। পায়ের ঘা রোজ রোজ বেড়ে চলল। তার সঙ্গে জ্বর। ডাক্তার বলতে যা বোঝায়, সে রকম কিছু ও-তল্লাটে কোথাও নেই, মানে তখন ছিল না। কবরেজ গোছের একজন ছিল। তার গাছগাছড়াই একমাত্র সম্বল। শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথাই ওঠে না। গাঁয়ের লোক জানত, সেখানে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। তা ছাড়া নিয়েই বা যায় কে? পুরোদমে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। নদীর দিকে তাকানো যায় না। নৌকা চলাচল বন্ধ

—ধারে-কাছে ওদের আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না?

—ছিল হয়তো, মুচকি হেসে বললেন ভূতনাথ, তবে আগেই বলেছি, গোপীর সঙ্গে কারোরই তেমন ভাব-সাব ছিল না। তার ওপরে সেদিন যে কাণ্ড ঘটে গেল! গাঁয়ের লোক আপনার আমার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তারা জানে, বাঘে ছুঁলে আঠরো ঘা, পুলিসে ছুঁলে তিন আঠারোং চুয়ান্ন। সুতরাং শতহস্তেন—

বনানী সারাদিন কাজ করে যায়। রাত হলেই কান দুটো পেতে রাখে দরজার বাইরে কখন শ্বশুর এসে চুপি চুপি ডাকবে। অনেক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, ঐ বুঝি এল। তাড়াতাড়ি উঠে এসে দেখে, কেউ না। এমনি করে দিনের পর দিন কেটে গেল। গোপী এল না। জেল থেকে ছাড়া পেল কিনা সে খবরটাও কেউ দিয়ে গেল না।

প্রায় মাস দেড়েকের মাথায় সুবল মারা গেল। ঘায়ে পচ ধরেছিল, দুর্গন্ধে ধারেকাছে যাওয়া যেত না। তার কয়েকদিন পরেই গোপী এসে হাজির। পুলিস মামলা চালায় নি। বেকসুর খালাস। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়েই সঙ্গে সঙ্গে আসতে পারে নি। ‘দরকার’ ছিল। কী ‘দরকার’, এরা কেউ জানতে চাইল না। এখানকার খবর সম্বন্ধে বনানী প্রায় চুপ করেই রইল। বুড়ি যা বলল তাও ভাসা-ভাসা। সুবলের প্রসঙ্গে কালীপ্রসাদের কথা উঠতে গোপী বলে উঠল, ধৰ্ম্মের কল বাতাসে নড়ে। শালা আমার যেমন সর্বনাশ করে গেল, নিজেও তেমনি সহজে রেহাই পায় নি। ঘুষের মামলায় পড়েছিল। চাকরি নিয়ে টানাটানি। শেষটায় ডিগ্রেড হয়ে গেছে। জল-পুলিসের ইনেস্পেক্টর থেকে কোতোয়ালীর দারোগা। শাঁস বলতে কিছু নেই। স্রেফ ডাঁটা…বলে বুড়ো আঙুলটা তুলে ধরেছিল বুড়ির সামনে। বনানী কাছেই কি একটা করছিল, কথাটা কানে যেতে হঠাৎ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কোন্ কোতোয়ালী?

বৌয়ের জ্ঞানের বহর দেখে গোপীর ভারি মজা লাগল। হেসে বলল, কোতোয়ালী আবার কটা থাকে রে বেটী? শহরের ওপর যে সদর থানা, তারই নাম কোতোয়ালী।

—ও, বলে বনানী চলে গেল। কথাটা তার মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। দিন কয়েক পরে মাঝরাত্রে গোপীকে একবার উঠতে হয়েছিল। বাগানের দিক থেকে ফিরে আসতে গিয়ে চমকে উঠল, ছেলের বৌয়ের ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে কেউ নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, মনে করল হয়তো বাইরে গেছে। তারপর লণ্ঠন নিয়ে খুঁজতে বেরোল–বাগানে, মাঠে, নদীর ধারে। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই।

পরদিন আর ব্যাপারটা চেপে রাখা গেল না। যেসব প্রতিবেশী অত্যন্ত দুঃসময়ে ভুলেও একবার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায় নি, তারাই এবার দলে দলে আসতে শুরু করল। গবেষণা চলল নানারকম। জলে ঝাঁপ দেবার সম্ভাবনাটা দু-একজনে তুললেও, বেশীর ভাগ সরাসরি নাকচ করে দিল। অনেক মুখরোচক গল্পও তৈরী হল—কোথায় কবে কার সঙ্গে তাকে দেখা গেছে, কতদিন থেকে এই কাণ্ড চলছে—ইত্যাদি। গোপী চুপ করে রইল। খুঁজতে বেরোবার কথাটা যে একবারও মনে হয়নি তা নয়, কিন্তু পঙ্গু স্ত্রীকে একা ফেলে যাওয়া অসম্ভব বলেই হোক, কিংবা যে বৌ ঘরে থাকতে চাইল না, তাকে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করে কী লাভ, এই ভেবেই হোক, বেরোনো আর হল না।

এখানে কিঞ্চিত বিরতি, নাটকের মাঝখানে যেমন ইন্টারভ্যাল। এরপর ভূতনাথবাবুর ভূমিকাও বদলে গেল। এতক্ষণ ধরে এ কাহিনীর সঙ্গে তাঁর যে সংযোগ, সেটা প্রত্যক্ষ নয়। পুলিশ ক্লাবে বসে সিগার টানতে কালীপ্রসাদ মুখুজ্যের বাহাদুরি জ্ঞাপনাচ্ছলে যেটুকু প্রকাশ পেয়েছিল, তার থেকে গোড়াপত্তন। তারপর বিভিন্ন সূত্র থেকে যে বিভিন্ন খণ্ডগুলো তার কানে এসেছিল, তাই মনে মনে জোড়া দিয়ে আমাকে শুনিয়ে গেছেন। পরবর্তী পর্ব তাঁর নিজস্ব সংগ্রহ। সেখানে তিনি তদন্তকারী পুলিস অফিসার। ঘটনাচক্রের কোন্ বিবর্তনে তাঁকে এই ভূমিকায় নামতে হয়েছিল সেকথা যথাস্থানে প্রকাশ পাবে। আপাতত একটা কথা বলা দরকার। সরকারী দপ্তরখানায় কী রিপোর্ট তিনি দাখিল করেছিলেন, তা আমি জানি না। আমি যেটা পেলাম, তার সুর ও প্রকৃতি আলাদা। তার মধ্যে তথ্যের সঙ্গে মেশানো এমন অনেক কিছু আছে, যা সরকারী রেকর্ডে নিশ্চয়ই স্থান পায় নি। এগুলো হয়তো তোলা ছিল তাঁর নিজস্ব রেকর্ড রুমের কোনো নিভৃত অন্তস্থলে। এতদিন পরে সেখান থেকে ধুলো ঝেড়ে বাইরে আনবার পর ধরা পড়ল, মানুষের মন নামক ব্যক্তিটি শুধু সংগ্রাহক নয়, স্রষ্টা। স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে তথ্যের বোঝা বয়ে এনে সাজাতে গিয়ে কখন যে তাতে হৃদয়ের রং লেগে যায়, সে নিজেই হয়তো জানে না। সুতরাং যদি কেউ প্রশ্ন করে বসেন, এটা তিনি কেমন করে জানলেন, ওটা কোথা থেকে পেলেন, আমাকেও বাধ্য হয়ে ঐ একটিমাত্র উত্তরের আশ্রয় নিতে হবে—আমি জানি না।

বনানী নদীগর্ভে ঝাঁপ দেয় নি, দিয়েছিল তার চেয়েও বিপদসঙ্কুল অনিশ্চয়ের মধ্যে। দশ-এগারো বছর বয়সে সে একবার মাসীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। শহরে। তার মেসো সেখানে মুদিখানার দোকান করত। তার কাছেই একটা পুলিসের আস্তানা। অত পুলিস এর আগে সে একসঙ্গে দেখে নি। মাসী বলত ‘ওটা কোতোয়ালী থানা। ওদিকে কখনও যাস নি।’ নিরাপদ দূরত্ব থেকে ভয়ে ভয়ে সেই নিষিদ্ধ জগতের দিকে চেয়ে থাকত। বিয়ে হল অনেক দূর, সাত সমুদ্র না হলেও তেরো নদীর পার। শহর-বাসের সেই ক’টা দিন এবং তার সঙ্গে জড়িত সেই অদ্ভুত বাক্যটা—কোতোয়ালী—মনের তলায় কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ শ্বশুরের মুখে আবার নতুন করে শুনবার পর ঐ নামটা তার রক্তে যেন দোলা দিয়ে গেল। এবারকার কোতোয়ালী তাকে একেবারে আলাদা এবং অনেক বেশি চড়া সুরে ডাক দিল। শুধু ডাক দিল না, দূর পল্লীপ্রান্তে নদীর ঘাট আর বাগানের বেড়া-ঘেরা গৃহস্থ বধূর স্নেহ-ভক্তি-কর্তব্যের বন্ধনময় একান্ত পরিচিত জীবনের মাঝখান থেকে উপড়ে টেনে নিয়ে এল। কোথায়, সে কথাটাও ভাববার অবসর দিল না।

মেসো নেই, মাসী তখনও আছে। বোনঝিকে দেখে সে বিশেষ খুশী হল না। একটা বাড়িতে মেয়েমানুষকে পুষবার মতো অবস্থাও তার নয়। সেদিক দিয়ে বনানী তাকে ভরসা দিল। একেবারে খালিহাতে সে আসে নি। নগদ বিশেষ কিছু না আনলেও কিছু গয়না ছিল। অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হল। তার জন্যে তৈরীই ছিল সে। আশ্রয় পাওয়া গেল।

সেই কোতোয়ালী তেমনি আছে, আরও হয়তো বেড়েছে খানিকটা। দশ বছর বয়সে তাকে ঘিরে যতটা বাধা-নিষেধ ছিল, আজ তার গণ্ডিটা অনেক বেশি প্রশস্ত। তখন সে দু-চোখ মেলে যত খুশি দেখত, তাকে দেখবার কারও গরজ ছিল না। আজ অন্যের দৃষ্টি এড়িয়ে ওখানে গিয়ে দাঁড়ানো বড় কঠিন। তবু যখনই সুযোগ পায়, গিয়ে দাঁড়ায়, একটি বিশেষ মানুষের গতিবিধি লক্ষ্য করে। এমনি করে ক’দিনের মধ্যেই বুঝল বনানী, যে তীব্র জ্বালা বুকে করে সে ঘর ছেড়েছিল, তাকে মেটাবার পথ তার সামনে খোলা নেই। তার চোখ দুটো যাকে এত কাছে থেকে অহরহ অনুসরণ করছে, আসলে সে অনেক দূরে। তবু মন মানে না। মাঝে মাঝে যখন নিরাশায় ভেঙে পড়ে ঠিক তখনই হয়তো চোখে পড়ে তার প্রায় সামনে দিয়ে সে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে ওঠে। হাতখানা আপনা হতেই চলে যায় জামা-কাপড়ের তলায়। স্পন্দিত হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে লেপটে আছে একটি বস্তু—কয়েক বছর আগে শ্বশুর এনে দিয়েছিল, তার কোন্ কামার বন্ধুর নিজের হাতে গড়া। বলেছিল, ‘আমাকে প্রায় বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়, ছেলেটা তো হাবা বোষ্টম, ওকে আমরা ভরসা নেই। জঙ্গলে ঘেরা বাড়ি, কার মনে কী আছে, এটাকে হাতের কাছে রেখো। দিনে বা রাতে শোবার সময় বালিশের তলায় রেখে শুয়ো।’

সেই ভয়ঙ্কর রাত্রেও ওটা বালিশের তলাতেই ছিল। একবারটি যদি যেতে পারত সে ঘরে! পুলিস দুটো পথ আগলে ছিল, যেতে দেয় নি। নিষ্ফল আক্রোশে বুকটা আবার জ্বালা করে ওঠে। চোখের উপর ভেসে ওঠে থেঁতলে পিষে যাওয়া দুখানা ক্ষত-বিক্ষত পায়ের পাতা। তার ওপর লাফিয়ে চলেছে একটা দাঁতাল শুয়োর। মাঝে মাঝে তার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছে। সে আর সইতে পারে নি। তারপর?

পরের দৃশ্যগুলো ভাবতে গেলে মাথার ভিতরে আগুন ধরে যায়। লঞ্চের ভিতরে আবছায়া অন্ধকারে ঢাকা সেই ছোট্ট কামরাটা। চারদিকে একপাল শকুন। সে নিশ্চয়ই মরে গিয়েছিল, আর সেই মরা দেহটাকে নিয়ে—আর ভাবা যায় না। মাথার ভিতরকার শিরাগুলো যেন জট পাকিয়ে যায়। তার মধ্যে হাতুড়ির ঘায়ে বাজতে থাকে তিনটি কথা—শোধ নিতে হবে, শোধ নিতে হবে।

মাসী সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল, এবং দিন দিন বেড়ে চলল সে সন্দেহ। কাঁচা বয়সে কপাল পুড়িয়ে বসে আছে মেয়েটা; একা একা কোথায় যায়, কোথায় জড়িয়ে পড়বে কে জানে? বাড়ি ফিরে এলেই বনানীকে একগাদা কৈফিয়তের মুখে পড়তে হয়। এটা সেটা বলে সে এড়িয়ে যায়। একদিন সেই খাপে মোড়া জিনিসটা মাসীর নজরে পড়ে গেল, বেরোবার মুখে কোমরে গুঁজে আঁচল চাপা দিতে যাবে, ঠিক এমনি সময়। বুড়ি চেপে ধরল, ‘এটা কি?” বনানী ব্যাপারটাকে হাল্কা করবার চেষ্টা করল, ‘তোমাদের দেশে যে-রকম গুণ্ডার উৎপাত, সাবধান হয়ে চলতে হয়।’

‘ও সব বাজে কথা রাখ।’ খেঁকিয়ে উঠল মাসী।

বনানীকে স্বীকার করতে হল, একটি বিশেষ জন ওর লক্ষ্য। কে সেই একজন সেটা অবশ্য ভাঙল না। মাসী শিউরে উঠল, ‘কি সব্বোনাশী মেয়ে গো!’ তারপর স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল, ওসব মতলব নিয়ে তার আশ্রয়ে থাকা চলবে না।

এ ছাড়া আর একটা মুশকিল কিছুদিন আগে থেকেই দেখা দিয়েছিল। মাসীর দোকানের ক’জন খদ্দের (তার মধ্যে থানার লোকও ছিল দুজন) তার এই বোনঝিটির উপর বড় বিশেষ নজর দিতে শুরু করেছিল। এখানে থাকা আর সত্যিই সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু কোথায় যাবে, আর তার অভীষ্ট ব্রতই বা সফল হবে কেমন করে?

মাসীর বাড়ি থেকে চলে যাওয়া স্থির, কেবল দিন-ক্ষণটা স্থির হয় নি, এমন সময় একদিন বিকালে নদীর ঘাটে গা ধুতে গিয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। ভাবও হল খানিকটা। দুই দিন পরে পিছন থেকে হঠাৎ কানে গেল, সেই মেয়েটি গা রগড়াতে রগড়াতে তার এক সঙ্গিনীকে বলছে, কালী-দারোগার কাণ্ড শুনেছিস? ময়নাকে তালাক দিয়ে সুধাটাকে ধরেছে। ধন্যি মানুষ বাবা! দু-দিন অন্তর মুখ না বদলালে চলে না!

—ভালোই তো। তোর পালাও একদিন আসবে।

বলে হেসে উঠল সঙ্গিনী। সে আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল, বনানীকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল। বনানী বুঝল, ওরা কী মেয়ে। তবু যেটুকু সন্দেহ ছিল, পুরোপুরি মেটাবার জন্যে প্রস্তাব করল, নতুন সখীর সঙ্গে তার বাড়িটা একবার ঘুরে আসবে। সখী রাজী হল না, নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেল। তারপর গা-ধোয়া শেষ করে ওরা দুজনে যখন খানিকটা এগিয়ে গেছে, বনানী অলক্ষ্যে তাদের অনুসরণ করল। গৃহস্থ-বসতি ছাড়িয়ে বাজার, তার শেষপ্রান্তে সরু গলির মধ্যে একটা বস্তি। তার মধ্যে ঢুকে গেল মেয়ে, দুটো। তখন সেখানে ভিড় নেই। কিন্তু বনানীর বুঝতে বাকী রইল না, আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই দেখতে পাবে, সকালবেলার ছেড়ে রাখা দোমড়ানো শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে মুখে পালিশ আর চোখে কালি মেখে গলির ধারে সারি সারি এসে দাঁড়িয়েছে শুধু তারা নয়, তাদের সঙ্গে আরও অনেকে। আরও রাত হলে হয়তো দেখা যাবে সেই দুদিন-অন্তর-মুখ- বদলানো-বিলাসী মহামান্য ব্যক্তিটির সঙ্গে, তার জীবনে আজ যে একক, তার সমস্ত বাসনা যার দিকে উদগ্র।

বাসায় ফিরে এসে সে রাত্রে সে কিছু খায়নি, সমস্ত রাত দু-চোখের পাতা এক করেনি, বার বার উঠে পড়ে শুধু জল গিলেছিল গেলাসের পর গেলাস। পরদিন ভোরেই কাপড়ের পোঁটলাটা হাতে করে গিয়ে বলেছিল, মাসী, আমি চললাম।

—কোন্ চুলোয় শুনি?

—দেখি কোথায় কোন্ চুলো জোটে। বলে আর দাঁড়ায়নি।

সেই মেয়ে দুটো নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বোঝাবার চেষ্টাও করেছিল, ‘এখনও বলছি, ফিরে যাও। এ বড় কষ্টের জীবন’। তবে বাড়িওয়ালীর কাছ থেকে সাদর অভ্যর্থনার অভাব হয়নি। কয়েকখানা গয়না তখনও ছিল। তার বলে ওরই মধ্যে বেশ ভাল ঘরেই জায়গা পেয়েছিল, তার সঙ্গে এক সেট ভালো জামাকাপড়ও জোটাতে পেরেছিল।

মাসী খোঁজ না নিয়ে ছাড়েনি। তার দোকানের যে ছোকরাটির মনে রং লেগেছিল, খবরটা এনেছিল সে-ই। বুড়ির কঠিন অসুখের নাম করে একদিন দুপুরবেলা ডেকে এনে দেখাটাও করিয়ে দিয়েছিল। মাসী দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, তোর মরণ হল না কেন?

‘মরণ তো হয়েছে মাসী’, বনানীর মুখে মৃদু হাসির রেখা, অনেক আগেই হয়েছে।’

মাসী বুঝতে পারে নি, তার মানে?

—মানে তুমি বুঝবে না। মরেছি আমি সেইদিনই। এটা তার জ্বালা। বলতে বলতে চোখ দুটোর ভিতর থেকেও একটা তীব্র জ্বালা ঠিকরে পড়েছিল।

একদিন দুদিন নয়, পুরো তিনটে মাস। সে কি কঠিন পরীক্ষা! মুখে রং ঘষে প্রতি সন্ধ্যায় গিয়ে দাঁড়াতে হয় দরজার সামনে। কখন এসে অন্য ঘরে গিয়ে ঢুকবে, কে জানে? কিন্তু সে আসে না, আসে অন্য লোক। তাদের ঠেকানো যায় না। ভিতরে ডেকে নিয়ে হাতেপায়ে ধরে কত কাণ্ড করে আত্মরক্ষা করতে হয়। সঙ্গিনীরা মুখ বেঁকিয়ে বলে, ‘আদিখ্যেতা! নাচতে নেমে আমার ঘোমটা!’ বাড়িওয়ালী বলে, ‘অত বাছাবাছি করলে তোর চলবে কেমন করে?’

বনানী চুপ করে থাকে। তার কথা যে কাউকে বলবার নয়। কেমন করে বলবে, সকলের চোখে সে বারনারী হলেও সংসারে শুধু একটি মাত্র পুরুষকেই তার প্রয়োজন। এর মধ্যে দু-একদিন যে সে না এসেছে তা নয়, কিন্তু হয় বনানীর ঘর পর্যন্ত পৌঁছায়নি, নয়তো তার দিকে ভালো করে না তাকিয়েই অন্য ঘরে গিয়ে ঢুকেছে।

অবশেষে দীর্ঘ তিন মাস প্রতীক্ষার পর দেখা দিল সেই ‘শুভরাত্রি’। বাঞ্ছিত জন মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।

বনানীর বুকের ভিতরটা নড়ে উঠল, যদি চিনতে পারে? জোর করে হাসি টেনে এনে বলল, দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন!

—তোমাকে যেন কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে!

—সে কপাল আর আমার হল কৈ? এতদিন ধরে আছি, একবারও তো গরীবের ওপর নজর পড়ল না।…… ওমা, সারারাত ঐখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি? বলে খিল্‌ খিল্‌ করে হেসে উঠল।

—তুমি তো বেশ কথা বলতে পার। হাসিটাও ভারি মিষ্টি।

বনানী স্মিতমুখে মাথা নুইয়ে পিছনে সরে গেল। সে-ও ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে।

অকস্মাৎ বিদ্যুৎ-শিখার মতো ঝলকে উঠল একখানা খাপ-খোলা ছোরা। নেমে আসবার আগেই সতর্ক পুলিসের ক্ষিপ্র সবল মুষ্টি সেটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল। নিরুপায় নারী তখন তার বিধাতা-দত্ত দুটি অস্ত্র—দাঁত আর নখ নিয়েই সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারের উপর।

অনেক রাত্রে সার্কেল ইন্সপেক্টর ভূতনাথ ঘোষাল পুলিস হাসপাতালে গিয়ে দেখলেন, কালীপ্রসাদ চোখ বুজে পড়ে আছে। মুখে একটানা গোঙানির শব্দ। কপালে, গণ্ডে, চিবুকে, কাঁধে গভীর আঁচড়ের রেখা। তার থেকে রক্ত ঝরছে। ডাক্তার আস্তে আস্তে বুকের কাপড়টা তুলে দেখালেন। অনেকটা জায়গা জুড়ে তীক্ষ্ণ দাঁতের চিহ্ন, মাঝখানে খানিকটা মাংস নেই।

সরকারী ব্যবস্থায় সব রকম চিকিৎসা সত্ত্বেও কালীপ্রসাদকে সুবলের পথ ধরতে হল। ঘা-গুলো সেপটিক হয়ে গিয়েছিল। মরবার কদিন আগে ভূতনাথবাবুকে বলেছিল, ‘দাঁতে আর নখে নিশ্চয়ই বিষ মেখে রেখেছিল রাক্ষুসী!’ ভুতনাথ মুখে কিছু বলেন নি, মনে মনে বলেছিলেন, ভুল করেছ ভায়া, ওরা বাঘিনীর জাত, বিষ নিয়েই জন্মায়, মাখতে হয় না।

দেশলাই জ্বালাবার শব্দে চমকে উঠে দেখলাম, ভুতনাথবাবু সিগারে আগুন দিচ্ছেন। আকাশের দিকে চেয়ে বললেন, বৃষ্টিটা ধরে গেছে, এবার ওঠা যাক। ক’টা বাজে?

আমি জবাব দিলাম, বনানীর কী হল?

—জানি না। অনেক খুঁজেছি। খুঁজতে হয়েছে। তদন্তটা আমার হাতেই দিয়েছিলেন সাহেব। পাইনি।

একটু থেমে বললেন, পেলে কালীপ্রসাদের শেষ খবরটা জানিয়ে দিতাম। সুবলের মৃত্যুর ক্ষোভ হয়তো খানিকটা মিটত।

আমি বললাম, আমার মনে হয় সে বেঁচে নেই।

—এখন সেই প্রার্থনাই করি। শুনেছি,মৃত্যুর পরে মানুষ প্রেতলোক থেকে সব কিছু জানতে পারে। তাহলে সেও জেনেছে। আত্মার কিছুটা তৃপ্তি হয়ে থাকবে, অবিশ্যি বাঘিনীদের যদি আত্মা বলে কিছু থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *