পাঁচ
সকৌতুক অনুভব করছিলাম, চাকরির অহিফেন এরই মধ্যে মগজে তার বিষক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। ছ’মাস আগেও এ অবস্থা ছিল কল্পনার অতীত। ভেবে হাসি পায়, বড়বাবু- সর্বস্ব কেরানীকুলকে কত না অবজ্ঞার চোখে দেখেছি। আর আজ আমার কি অবস্থা? বাক্যে ও চিন্তায় যাঁরা প্রায় সবটুকু অধিকার করে বসেছেন, তারা বড়বাবু না হলেও, বড়সাহেব বা ছোটসাহেব। বন্ধুবান্ধবদের মজলিশে ক’দিন আগেও যেখানে বিচরণ করতেন শ’, রবীন্দ্রনাথ, হ্যারল্ড লাস্কি কিংবা ইসাডোরা ডানকান, আজকাল সেখানে স্বচ্ছন্দে আসন লাভ করেছে জেল কোড, ফাণ্ডামেন্টাল রুলস্, আই-জি অথবা একাউণ্টেণ্ট জেনারেল। মনে মনে লজ্জিত হলাম।
কিন্তু এ লজ্জাবোধ কাটিয়ে উঠতেও আমার বেশী দিন লাগেনি, যখন দেখলাম, এই মানসিক রূপান্তর শুধু আমার মত ক্ষুদ্র চাকরিজীবীর পরিণাম নয়, বৃহৎ চাকরেদেরও ঐ একই পরমাগতি। তফাৎ যেটুকু, সেটা মাত্রাগত, প্রকারগত নয়; –কাইণ্ড নয়, ডিগ্রী। আমি যেখানে আই-জি কিংবা তাঁর পি-এ-কে নিয়ে আসর জমাচ্ছি, এঁরা সেখানে সার করেছেন, চী, পলিটিক্যাল কিংবা ফাইন্যান্স সেক্রেটারি। সেক্রেটারি-মহলও তেমনি মশগুল হয়ে আছেন কোনো এইচ-এম কিংবা স্বয়ং এইচ-ঈ-কে নিয়ে।
যাক্, এসব গেল পরবর্তী কালের কথা। সেদিন কিন্তু দার্জিলিং-এর শৈলবাসে আমার সেই ছোট্ট বাংলোখানির বারান্দায় বসে বিস্তীর্ণ উপত্যকার ওপারে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছিলাম বারংবার। সভয়ে উপলব্ধি করেছিলাম, চাকরিটা যেন একটা মহাকায় পাইথন, অসহায় হরিণশিশুর মত একবার যখন তার মুখগহ্বরে এসে পড়েছি, আর রক্ষে নেই। ধীরে ধীরে সে সবটাই গ্রাস করে ফেলবে।
শুধু কি তাই? এতদিনের চিহ্নিত পথ থেকেই যে স্খলিত হয়ে পড়েছি তা নয়, একটিমাত্র চঞ্চল ঝরণা আমার এই পাহাড়ী জীবনের ঊষর দিনগুলো মধুসঞ্চিত করে রেখেছিল, তাকেও হারিয়ে ফেলেছি। বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, আজ কদিন ধরে কাঞ্চী যে আসেনি, সেকথা তো কই একবারও মনে হয়নি? অথচ কটা দিন আগেও সমস্ত দেহ- মন উৎকর্ণ হয়ে থাকত, তার ঐ মোহিনী হাসির স্পর্শটুকুর লোভে।
কয়েকখানা বই সঙ্গে এনেছিলাম। তারই একটা টেনে নিয়ে বসলাম গিয়ে ভিতরের বারান্দায়। ডিসেম্বরের মধ্যাহ্ন। আকাশে রৌদ্র ঝলমল করছে, প্রাণপণে চেষ্টা করছে শীতের তীব্রতাকে সহনীয় করবার। কিন্তু মনে হচ্ছে সবটাই তার ব্যর্থ প্রয়াস; যেমন ব্যর্থ হচ্ছে আমার এই বই-এর পাতায় মনোনিবেশের চেষ্টা।
বাইরের দরজায় কড়া নড়ে উঠল। হাঁক দিলাম, কে? কোনো জবাব নেই। কড়াটা শুধু আরো জোরে সাড়া দিল দ্বিতীয়বার। পাশের ঘরে কেটার নাসিকাধ্বনি যে পর্দায় গিয়ে পৌঁচেছে, রীতিমত বলপ্রয়োগ ছাড়া তার নিদ্রাভঙ্গের কোন রকম ভরসা নেই। অতএব নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠতে হল।
—একি, তুমি!
কাঞ্ছীকে যেন নতুন রূপে দেখলাম। কালো ভেলভেটের ঘাগরার উপর গাঢ় চকোলেট রঙ-এর সার্জের ঊর্ধ্বাবরণ, যাকে ওরা বলে চোলা। লম্বা বেণী ঝুলছে পিঠের উপর। রক্তিম গণ্ডে, ওষ্ঠে, চঞ্চল চোখ দুটিতে কৌতুকোজ্জ্বল চাপা হাসি। একটা কিছু উপলক্ষ্য পেলেই উপচে ঝরে পড়বে। হাতে এক ঝুরি কমলালেবু। ভিতরে এসে ঝুড়িটা রেখে বললে, এই নাও। বড়ী আম্মা পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের বাগানের নেবু।
আমি সেই নধরকান্তি ফলগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। কাঞ্ছী মাথা দুলিয়ে বলল, উঁহু। যা খুঁজছ তা পাবে না। আমি নিজে হাতে গাছ থেকে পেড়ে এনেছি। কটা কাঁটা ফুটেছে, জানো? তিনটা। বড়ী আম্মা বকছিল, ডাল ভাঙছিস্ কেন? বললাম, কি করবো : তোমার বাবুজীর যে আবার বোঁটা আর পাতা না থাকলে নেবু পছন্দ হয় না!
কথাটা সত্যি। এ আমার এক অদ্ভুত ছেলেমানুষি খেয়াল। কমলার সঙ্গে যে বোঁটা আর পাতা লেগে থাকে, দার্জিলিং-এ এসেই তো প্রথম দেখলাম।
বললাম, কে বলল তোমাকে বোঁটা ছাড়া নেবু পছন্দ হয় না?
—আমি জানি।
—কি করে জানলে?
লম্বা বেণীটায় একটা দোলা দিয়ে বলল, বলবো না।
কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললাম, বেশ : চাই না তোমার নেবুর ঝুড়ি; ফিরিয়ে নিয়ে যাও।
—হুঁ। ফিরিয়ে নেবো বৈকি? বড়ী আম্মার চ্যালা কাঠ কি জিনিস জানো না তো? এই দ্যাখ—বলে বাঁ হাতের উপর থেকে জামাটা সরিয়ে দেখাল একটা লম্বা কালশিরে দাগ। বললাম, বেশ হয়েছে। সারাদিন দুষ্টুমি করবে; তার শাস্তি নেই?
—তাহলে তো তুমিও বাদ যাও না।
-কেন, আমি আবার কি করলাম?
—নেবু ফিরিয়ে নিয়ে যাও বললে কেন?
এর আর উত্তর নেই। মুহূর্তকাল অপেক্ষা করে ফেটে গড়িয়ে পড়ল তার হাসি। পাষাণের উপর আছড়ে ভেঙে পড়ল একরাশ বেলোয়ারী কাঁচের বাসন। আমি যেন সম্বিত হারিয়ে ফেললাম। আমার এই অদ্ভুত ভাবান্তর ও বোধ হয় বুঝতে পারলো না। হঠাৎ হাসি থামিয়ে আস্তে আস্তে কাছে সরে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি রাগ করলে বাবুজী?
তৎক্ষণাৎ উত্তর না পেয়ে অপরাধীর মত কুণ্ঠিত মৃদু কণ্ঠে বলল, সত্যি, এ রোগ আমার কিছুতে গেল না। কত যে বকুনি খাই—
ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছি। বললাম, সে জ্ঞান যদি থাকে তবে হাস কেন পাগলের মত?
—বা-রে, আমি কি ইচ্ছে করে হাসি? হাসি পেলে আমি কি করবো?
—আচ্ছা; এবার যখন হাসি পাবে, সোজা ছুটে যেও বড়ী আম্মার কাছে। এক ঘা চ্যালা কাঠ পিঠে পড়লেই হাসি পালিয়ে যাবে বাপ্ বাপ্ করে।
—ঈস্ : তাই বুঝি? তাতে আরো বেশী করে হাসি পায়।
সে জানি। উনিই তো আদর দিয়ে মাথাটা খেয়েছেন। দাঁড়াও; আজই বলে আসছি গিয়ে—
—যাও না? বুড়ী কি বলবে আমার জানা আছে।
—কি বলবেন?
—বলবে, আদর দিয়ে ওর মাথা তো আমি খাইনি; খেয়েছে আর একজন।
—সে আবার কে?
—আমি কি জানি—বলে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে পিছন ফিরে। দীর্ঘ বেণীটায় আবার একটা ঝাঁকানি দিয়ে চঞ্চল চরণে ঘরের দিকে চলে গেল। ঝুড়িটা আমার ভাঁড়ার ঘরে রেখে ফিরে আস্তে আস্তে বলল, শুধু মাথা চিবিয়ে খেয়ে তো পেট ভরবে না, ফল কটাও খেও। সবগুলোই যেন কেটাকে দান করে বসো না। যা ভুলো মন তোমার; হয়তো একটাও শেষ পর্যন্ত মুখে উঠবে না।
খুব খানিকটা উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, কে বললে মুখে উঠবে না, কাল এসে দেখো তুমি, ঝুড়ি একেবারে গড়ের মাঠ। … বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, তোমার সামনেই শুরু করছি।
উঠবার উপক্রম করতেই কলকণ্ঠে থামিয়ে দিল কাঞ্ছী—হয়েছে হয়েছে। আর উঠতে হবে না। খুব বুঝেছি।
একবার এদিক-ওদিক কি খুঁজলে। তারপর ছুটে গেল রান্নাঘরে এবং সেখান থেকে ভাঁড়ারে। একটা ডিশ নিয়ে এসে তিন-চারটে লেবু ছাড়িয়ে ডিশখানা আমার হাতে দিয়ে বলল, খাও।
কয়েকটা কোয়া তুলে নিয়ে বললাম, বাঃ, আমি বুঝি একা খাবো?
—আবার কে খাবে?
—কেন, তুমি?
কাঞ্ছী জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে মাটি খুঁটতে লাগল। একটি সলজ্জ মৃদু হাসি ভেসে উঠল আনত মুখের উপর। কয়েকটা কোয়া ওর হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বললাম, দেখি কার আগে ফুরোয়।
কাঞ্ছী কিন্তু ফলগুলো মুখে তুলল না। তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।
—কী হল? বলে ওর দিকে যখন চোখ তুললাম, দেখলাম, দুটি স্নিগ্ধ সলজ্জ চক্ষু আমার অলক্ষ্যে একদৃষ্টে আমার মুখের পানে চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই, সহসা এক ঝলক রক্ত এসে পড়ল তার মুখের উপর। সঙ্গে সঙ্গে এস্তা হরিণীর মত ছুটে বেরিয়ে গেল।
পাশের বাড়ি থেকে বড়ী আম্মার কাংস্য কণ্ঠ ভেসে আসছে। তর্জন-গর্জনে কলহের সুর। কিন্তু প্রতিপক্ষের কোন সাড়া নেই। থাকবার কথাও নয়। বড়ী আম্মার গবর্নমেন্টে অপোজিশন পার্টির বালাই নেই। একেবারে পুরোপুরি ডিকটেটরশিপ। দাম্পত্য কলহকে পণ্ডিতেরা বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু যে দম্পতির উত্তমার্ধে শোভা পাচ্ছেন বড়ী আম্মার মত ব্যক্তি, আর অধমার্ধের অস্তিত্ব একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক সেখানে কলহের রূপ বিপরীত, অর্থাৎ লঘুরম্ভে বহুক্রিয়া। এমন একাধিক দৃশ্যের দর্শক আমি নিজেই, যার সূচনায় ছিল একখানা দাড়ি কামাবার ব্লেড কিংবা শার্টের বোতাম, কিন্তু উপসংহারে দেখা দিয়েছে ব্যাণ্ডেজ এবং টিংচার আইডিন। সামান্য পিন্ প্রিসের বিনিময়ে খুন্তি কিংবা ডালের কাঁটা ডাক্তার থাপার দাম্পত্য-জীবনে বিরল প্রাপ্য নয়।
এই বৃদ্ধ নিরীহ ডাক্তারটির উপর আমার কেমন একটা সহজাত সহানুভূতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ প্রথম মনে হল ‘আহা বেচারা’ বলে যতটা করুণা তাকে দেখিয়েছি, ঠিক ততখানি বোধহয় ওর প্রাপ্য নয়। তুচ্ছ হোক, বড় হোক, কোন একটি নারী-হৃদয়ের অন্তস্তলে আমি বিচরণ করি, আমাকে আশ্রয় করে তার সুখ-দুঃখ বিরোধ ও শান্তি, আমাকে ঘিরে তার উৎকণ্ঠার অন্ত নেই—এই সত্য যে পুরুষ উপলব্ধি করেছে তার জীবনে, তার চেয়ে বড় সম্পদের অধিকারী কে? মনে হয় ডাক্তার সেই ভাগ্যবান পুরুষ- কুলের অন্যতম। তাই একজনের কাংস্য কণ্ঠের বিষ তাকে স্পর্শ করে না। কেননা সে জানে, অন্তরালে আছে সুধার ভাণ্ডার। তাই সমস্ত বিরোধ বিক্ষোভের মধ্যেও সে নিরুদ্বিগ্ন ও নির্বিকার। ব্যাণ্ডেজের বেদনা বহন করেও ভেসে থাকে একটি কৌতুকহাসি তার অদৃশ্য প্রায় চোখদুটির অন্তরালে।
ডাক্তারের এই নতুন রূপ আজই আমার কাছে বিশেষভাবে প্রতিভাত হল কেন? তবে কি ঐ অমৃতময় অনুভূতি আজ আমার অন্তরেও তার সোনার কাঠি বুলিয়ে গেল? আমিও কি
—আসামী আয়া, হুজুর!
চমকে উঠলাম। অদূরে দাঁড়িয়ে নিখুঁত সামরিক বেশধারী গুর্খা ওয়ার্ডার। সশব্দ সেলাম ঠুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গেল আসামী আয়া, হুজুর। অভ্যর্থনার প্রয়োজন এবং সেটা আমাকে গিয়ে করতে হবে এখনই।
.
কারা এই আসামী? আইন এবং আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অপরের ধনপ্রাণ নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলে যে ভাগ্যবানের দল তারা নয়। সমাজের বুকের উপর বসে মিষ্টি হাসির প্রলেপ দিয়ে শানায় যারা বিষাক্ত ছুরিকা, তারাও নয়। তাদের দেখা ক্বচিৎ পাবেন জেলের দরজায়। এখানে দলে দলে আসে তারাই আইনের খপ্পর থেকে টেনে তুলবার যাদের কেউ নেই। ভুটিয়া বস্তীর মাহাদুর তার দৈনিক পারিবারিক খাদ্য পচাই মদ তৈরি করেছে : নিরে ঘরে বসে। জানে না তার অপরাধ কোথায়। সিঁধেল চোর বংশী তিনখানা থালা চুরি করেছে সর্দার বাহাদুর লেডেনল’র বাংলো থেকে, বিক্রী করে কিনেছে সের পাঁচেক চাল আর একটিন সিগারেট। জেলঘুঘু ভক্তা পকেট-কর্তন ব্যবসায়ে সুবিধা হচ্ছে না দেখে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে পুলিসের কাছে, জেলে গিয়ে একটু গায়ে জোর করে নেবার উদ্দেশ্যে।
এরাই আমার আসামী। কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া পরে সার বেঁধে আসে যায়। এদেরই নাম ধাম বিবরণ, পিঠের তিল আর নাকের কাটা দাগ লিখে রাখি আমি চৌদ্দ-কলম-ওয়ালা চিত্রগুপ্তের খাতায়। তারপর খালাসের দিন যখন আসে, বাপের নাম আর হাঁটুর চিহ্ন মিলিয়ে ছেড়ে দিই জেল-গেটের বাইরে। এই হতভাগ্যদের উপলক্ষ্য করে রাষ্ট্রের কি বিপুল আয়োজন! এদের জন্য গলদঘর্ম হচ্ছে সুবিশাল পুলিস-বাহিনী, উদয়াস্ত কলম চালাচ্ছেন টাই-বাঁধা হাকিম আর তাঁর বিস্তীর্ণ এজলাসে গলা ফাটাচ্ছেন কালো কোট-পরা উকীল, আর ময়লা চাপকানধারী মোক্তারের দল, এবং ডাণ্ডাহস্তে ধাবিত হচ্ছেন অতিব্যস্ত জেলর সাহেব মৌলবী মোবারক আলি আর আমরা তাঁর অনুচরবৃন্দ।
তবু এরাই আমার লক্ষ্মী। এরা আসে বলেই আমার ঘরে আসে অন্ন। এরা ছিল বলেই আমি আছি। নইলে আজ কোথায় থাকতাম আমি, আর কোথায় থাকত আমার রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব?