লৌহকপাট – ১.৪

চার

নিছক ধনাধিকারই ঐশ্বর্য নয়। ঐশ্বর্যের পরিচয় তার বহিঃপ্রকাশ। এক সিন্দুক কোহিনূর আর এক ডজন ময়ূর-সিংহাসন নিয়ে যদি আপনি হিমালয়ের কোনো নিভৃত গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করেন, পৃথিবীর ধনাঢ্যদের তালিকায় আপনার নাম অনুক্ত থেকে যাবে। কিন্তু রাতারাতি কালোবাজারের কৃপালাভ করে লেক-টেরাসে বাড়ি তুলুন চারতলা, আর সেই সঙ্গে কিনুন দু’খানা বুইক আর একটা রেসের ঘোড়া, আপনার রূপ, বয়স এবং ব্যাঙ্কব্যালান্স যতই বিরুদ্ধ সাক্ষ্য দিক, অনূঢ়া কন্যার জননীকুল এবং ইনকম ট্যাক্সের ফেউদের হাত থেকে আপনি একটি দিনও স্বস্তি পাবেন না। এমনি করে আপনার বাড়ি, গাড়ি, আপনার চালচলন, আসবাবপত্র, পোশাকপরিচ্ছদ এবং সকলের উপরে আপনার সালাঙ্কারা অর্ধাঙ্গিনী,—অভাবে, সুসজ্জিতা বান্ধবীদল—আপনার জয়ঢাক স্কন্ধে সমাজের বুকের উপর সরবে বিচরণ করছেন বলেই আপনি বড়লোক; রাম, শ্যাম, যদুর থেকে আপনি স্বতন্ত্র এবং উচ্চতর জীব।

ঐশ্বর্যের বাহন-সংখ্যা অগণিত। কিন্তু তার মধ্যে যে জন্তুটা আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি শোরগোল তুলছে, তার নাম মোটরগাড়ি। বেপরোয়া গতির নেশায় সে মাতাল হয়ে ছুটছে, তীব্র কর্কশ কণ্ঠে চরণ-সর্বস্ব পথচারীকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছে—তফাত যাও। সামনাসামনি যদি এসেছ, মৃত্যু অনিবার্য; আশেপাশেও যদি পড়ে যাও, কদম-লাঞ্ছনা থেকে নিস্তার নেই। এই মোটরগাড়িই হচ্ছে আপনার ও আমার মধ্যে উদ্ধত চাইনিজ ওয়াল।

দার্জিলিং-এ ঐশ্বর্যের অভাব নেই, অভাব শুধু তার এই শিঙওয়ালা বাহনটির। সেই একটিমাত্র কারণেই ধনী আর নির্ধনের মধ্যে ব্যবধান এখানে দুর্লঙ্ঘ্য নয়। অবজারভেটার হিলের চারদিকে বারকয়েক চক্কর দিয়ে ম্যালের যে বেঞ্চিটাতে এসে রোজ আমি বিশ্রাম করি, তারই অপর প্রান্ত অসঙ্কোচে অধিকার করেন এমন সব জাঁদরেল ব্যক্তি যাঁদের সঙ্গে এক-আসনে দূরে থাক, এক পাড়ায় অবস্থান অন্যত্র ধৃষ্টতা বলে গণ্য হবে আমা হেন ব্যক্তির পক্ষে। সেদিনও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। ওখানে আসন গ্রহণ করলেন বিশাল এক জবরজঙ্গ—বহুমূল্য রাইডিং ব্রীচেজ, তার উপর ততোধিক মূল্যবান কোট, চেস্টার মাফলার দস্তানার স্তূপ। সেখান থেকে যে আবেশময় সৌরভ বিকীর্ণ হচ্ছিল, তার কৌলীন্য সাগরপারের। এ হেন ব্যক্তির গোটা দেহটা দূরে থাক, টিকিটির সাক্ষাত্ত স্বপ্নাতীত, কলকাতা, বোম্বাই কিংবা নয়াদিল্লীর কোনো পাবলিক পার্কের বেঞ্চিতে। এতবড় অঘটন যে ঘটিত হল তার কারণ, এই রূপসী নগরীর ছায়াঘেরা পিচঢালা পরিচ্ছন্ন রাজপথ কলুষিত করবার জন্যে তাঁর আটখানা মোটরের একখানাও আমদানি করা সম্ভব হয়নি।

আগন্তুক চোখের একটা কোণ দিয়ে বারকয়েক আমার দিকে তাকালেন, তারপর রত্নখচিত রৌপ্যাধারে মহার্ঘ্য সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বিদেশী ভাষায় প্রশ্ন করলেন, মাপ করবেন, আপনি এখানে রোজই আসেন বুঝি?

—প্রায়ই আসি।

—কোথায় থাকা হয়, জানতে পারি কি?

—জেলে।

চমকে উঠলেন ভদ্রলোক। নিজের অজ্ঞাতেই বোধ হয় একটুখানি সরে গিয়ে সন্দিগ্ধভাবে তাকাতে লাগলেন আমার দিকে। আমি আশ্বাস দিলাম, ভয় নেই। গেটভেঙে কিংবা পাঁচিল ডিঙিয়ে আসিনি। হাতে ছোরাটোরাও নেই, এই দেখুন—

খটাস্ করে শব্দ হল। একজন পুলিসের সিপাই যাচ্ছিল সামনে দিয়ে। সম্ভবত আমার সরকারী পরিচয়টা জানে। বুক ঠুকে সেলাম দিয়ে গেল পুলিসী কায়দায়। ভদ্রলোক সেটা লক্ষ্য করলেন এবং একগাল হেসে বললেন, আপনি আচ্ছা লোক তো? আমি কি সেই কথা—কি মুশকিল—বেশ যা হোক—।

তাঁর অবস্থাটা উপভোগ করা গেল। এবার তিনি বেশ খানিকটা কাছে সরে এসে বললেন, দেখুন, একটা কথা বলবো?

—বলুন।

আমার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, অনেক দেশ ঘুরেছি। অনেক অদ্ভুত জিনিস চোখে দেখেছি। এমন কত গোপন রহস্যময় নিষিদ্ধ জায়গায় যাবার সুযোগ হয়েছে, যেখান থেকে ফিরে আসা ভাগ্যের কথা। কিন্তু আশ্চর্য, একটা জিনিস কখনো দেখিনি। সে হচ্ছে জেল। ঐ কুড়ি ফুট উঁচু পাঁচিলের আড়ালে কী আছে, বড্ড দেখতে ইচ্ছা করে; দেখাবেন একবার?

বললাম, সে আর শক্ত কি? আপনি ইচ্ছে করলেই হবে। আমার সাহায্য অনাবশ্যক।

—কি রকম?

—অতি সোজা ব্যাপার। এই যে বেঞ্চিটায় আপনি বসে আছেন, এরই উপর উঠে দাঁড়িয়ে দু-চারটা হুঙ্কার দিন, ইংরেজ নিপাত যাও। ডাউন উইথ ইম্পিরিয়ালিজম্। পুলিস কাছেই ঘুরছে। বাকীটুকুর ভার ওরাই নেবে।

তিনি জিভ কেটে বললেন, ও সর্বনাশ, তাই কখনো পারি? ডাউন উইথ গ্যানড্‌হিজম বরং বলতে পারি একশবার, আর বলেও থাকি দরকার মত।

পরিচয় পাওয়া গেল, উনি হচ্ছেন কোন্ দেশীয় রাজ্যের মহামান্য কুমারবাহাদুর। কয়েক লাখ টাকা বৃত্তি পান স্টেট তহবিল থেকে। গোটাকয়েক তোপও বোধ হয় হুঙ্কার ছাড়ে, যখন আসেন কলকাতা কিংবা নয়াদিল্লিতে।

পরদিনই তিনি আমার দীন কুটীরে পদার্পণ করলেন। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম এবং আমার একমাত্র কম্বাইণ্ড হ্যাণ্ড, একাধারে ঠাকুর-চাকর-বয়-বেয়ারা-মশালচি—”কেটা”র নাম ধরে হাঁকডাক শুরু করে দিলাম। কুমারবাহাদুর প্রস্তাব করলেন, ঘুরে এসে বসা যাবে এবং আপনার কেটার শ্রীহস্তে চা-পান করা যাবে। আগে চলুন, আসল মিশনটা সেরে আসি।

ছোট জেল। ঢুকেই প্রথমে নিয়ে গেলাম সেলগুলোর দিকে। সাত হাত লম্বা ও পাঁচ হাত চওড়া ঘর। একটিমাত্র গরাদ-দেওয়া লোহার দরজা। পেছনের দেয়ালে মাথার অনেকখানি উপরে ছোট্ট একটুখানি জানালার মত—যার পরিকল্পনা হয়েছিল সম্ভবত আলো-বাতাসকে ব্যঙ্গ করবার জন্যে। ঘরের সামনে দু-ধারে পাঁচিল-ঘেরা একফালি বারান্দা। তারপর আবার একটা কাঠের দরজা। সেলে যে রইল, তার মধ্যে আর এই প্রাণিজগতের মধ্যে ঐ একটিমাত্র সেতু। ওখানে যখন কপাট পড়ে, এ পৃথিবী তার কাছে জনমানবহীন।

হরেক রকম বন্দীর আস্তানা এই সেল্ বা “ডিগ্রী”—পাগল, কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত, কৃত- অপরাধ স্বীকার করেছে যারা, কারা-আইনের কোন মারাত্মক ধারা অমান্য করে শাস্তি পেয়েছে যারা নির্জন কারাবাস। প্রথম সেলটিতে থাকে একটি ছোকরা খুনী আসামী। যতীন তার নাম। স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে পুলিসের কাছে। কুমারবাহাদুর তীক্ষ্ণ উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছিলেন তার দিকে। সামান্য একটা ভূমিকা দেবার উদ্দেশ্যে শুরু করলাম, দিস্ পুওর ফেলো—

যতীন বাধা দিয়ে কুমারবাহাদুরকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, কে আপনি? ও-ও জেল দেখতে এসেছেন বুঝি? দেখুন, দেখুন। বেশ ভালো করে দেখবেন স্যার। চিড়িয়াখানা দেখেছেন তো কলকাতায়? জঙ্গল থেকে জন্তু-জানোয়ার ধরে এনে খাঁচায় পুরে কত আমোদ পাই আমরা। তার চেয়ে অনেক বেশী আমোদ পাবেন এখানে। নিজের জাতকে দেখবেন জন্তুর মত খাঁচায় বন্ধ। শুধু চোখের দেখা কেন? আপনার লাঠিটা দিয়ে খোঁচা মেরেও দেখতে পারেন, কী আওয়াজ বেরোয় আমাদের গলা থেকে—ঠিক যেমন চিড়িয়াখানার সিম্পাঞ্জি কিংবা হনুমানটাকে খুঁচিয়ে দেখে ছেলেগুলো!

এই তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের সুর হঠাৎ রুক্ষ কঠিন হয়ে উঠল যখন সে তাকাল আমার দিকে। বললে, ডেপুটীবাবু, আমাদের খাঁচায় ভরেছেন তাতে দুঃখ নেই। পায়ে ডাণ্ডা বেড়ি আর হাতে হাতকড়া দিয়ে ঝুলিয়ে রাখুন কড়িকাঠের সঙ্গে, সেটাও সইতে পারবো। কিন্তু দোহাই আপনার, পুওর ফেলো বলে লোকের কাছে সস্তা দরদ দেখিয়ে জুতোটা নতুন করে মারবেন না।

প্রভুভক্ত জমাদার ঝাঁকিয়ে উঠে কী একটা বলতে যাচ্ছিল তার কয়েদী-সায়েস্তা- করার ভঙ্গীতে। হাত তুলে থামিয়ে দিলাম। অনুচ্চ কিন্তু তীব্রতর স্বরে বলল যতীন— মানুষকে শুধু জানোয়ার বানিয়েই ক্ষান্ত হননি। তার দুর্দশাকে তুলে ধরছেন বন্ধুদের কাছে, তাদের কৌতুক আর আমোদের খোরাক যোগাবার জন্যে। কী নিষ্ঠুর আপনি!

শেষের দিকে গলাটা কেমন কোমল শোনাল। কোঠরগত তীক্ষ্ণ চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।

কুমারবাহাদুরের দিকে তাকালাম। তিনি যেন স্বপ্নের ঘোর থেকে জেগে উঠলেন। হঠাৎ এগিয়ে গেলেন যতীনের সেলের সামনে। গরাদের ফাঁক দিয়ে ওর হাত দুখানা জড়িয়ে ধরে পরিষ্কার বাঙলায় বললেন, আমাদের মাপ করো, ভাই। আমরা বড্ড ভুল করেছি—বলে হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে সোজা ছুটলেন গেটের দিকে। আমার জন্যে অপেক্ষা পর্যন্ত করলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *