লৌহকপাট – ২.১

এক

কাঁচা আর পাকার মধ্যে যে ব্যবধান সেটা কালগত। কাল পূর্ণ হলেই কাঁচা লঙ্কায় পাক ধরে, কাঁচা মাথা পাকা চুলে ভরে যায়। সংসারে একটি বস্তু আছে যার বেলায় এ নিয়ম চলে না। তার নাম চাকরি। সেখানেও কাঁচা পাকে; কিন্তু কালধর্মে নয়, তৈলধর্মে। সরকারী, আধা-সরকারী কিংবা সওদাগরী অফিসে গিয়ে দেখুন, পক্ক-কেশ সিনিয়র যখন কাঁচা রাস্তায় হোঁচট খাচ্ছেন, তৈল-সম্পদে বলীয়ান কোনো ভাগ্যবান জুনিয়ার তখন অনায়াসে পাড়ি দিয়েছেন কনফার্মেশনের পাকা সড়ক। গিরীনদা বলতেন, চাকরি হচ্ছে পাশার ঘুঁটি। পাকবে কি পচবে, নির্ভর করছে তোমার চালের উপর

মূল্যবান কথা। চাল অবশ্যই চাই। কিন্তু তার সঙ্গে চাই প্রচুর তেল।

আমার সহকর্মী রামজীবনবাবু তৈল-প্রয়োগে অপটু ছিলেন; অক্ষক্রীড়াতেও দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। তাই কালপ্রভাবে তাঁর গুম্ফদেশে শ্বেতবর্ণের আভা দেখা দিল কিন্তু চাকরির কৃষ্ণত্ব ঘুচল না। সেজন্য রামজীবনের নিজের কোনো ক্ষোভ ছিল না। কোনো অভিযোগও কোনোদিন করতে শুনিনি কর্তৃপক্ষের নামে।

—’ওরা কি করবে?’ কর্তাদের পক্ষ টেনেই বরং বলতেন রামজীবন : ‘জায়গা কোথায়? যক্ষের মতো যাঁরা ঘাঁটি আগলে বসে আছেন, তাঁরা দয়া করে সরবেন, তবে তো, জেল-সার্ভিসে পেনশন্ অতি বিরল ঘটনা। পঞ্চত্বপ্রাপ্তির দুর্ঘটনা বরং শুনতে পাবে দু-একটা; পঞ্চান্নপ্রাপ্তির কোনো বালাই নেই, অন্তত পঁয়ষট্টি পেরোবার আগে। কালে- ভদ্রে দু-একটা পোস্ট যদি বা পাওয়া গেল, আগে বাবাজীবন, তবে তো রামজীবন।

বললাম, বাবাজীবনটি কে?

—বাবাজীবন কি একটি যে তোমায় বলবো, কে? শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে এখনও ওঁদের ক’জন বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছেন।—বলে ইঙ্গিতে পাশের ঘর দেখিয়ে দিলেন।

পাশের ঘরটি জেলর সাহেবের। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, তিনি চোখ বুজে বৈকালিক অফিসের দৈনন্দিন তন্দ্রাসুখ উপভোগ করছেন। চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁর খাস মেট কলিমদ্দি গাজী নিত্যকার বরাদ্দ মতো তাঁর কেশবিরল উত্তমাঙ্গে অঙ্গুলি চালনা করছে। টেবিলের তলায় বসে হারাধন পাহারা নিপুণ হাতে পদসেবায় নিযুক্ত। জেলর সাহেবের মুখের দিকে তাকালাম। বার্ধক্যের বলিরেখাগুলো যেন স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল। তার সঙ্গে স্পষ্টতর ভাবে নজরে পড়ল ওঁর গিলে করা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি, বহু যত্নে কোঁচানো দামী শান্তিপুরী ধুতি, আর আরশির মতো পালিশওয়ালা আধুনিক ডিজাইনের নিউকাট্। বাবাজীবনই বটে!

রামবাবুর দিকে ফিরে বললাম, আপনার নামকরণের তারিফ না করে পারছিনে। রামজীবন একটু সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নামকরণের আসল মানেটা ধরতে পারছো তো?

এবার আমারও সন্দেহ হল, কথাটার হয়তো কোনো গূঢ় তাৎপর্য আছে, যা আমার জানা নেই।

বললাম, আসল মানেটা কি রকম?

রামজীবন হেসে ফেললেন, এঃ, তুমি দেখছি একেবারে আনাড়ি! ঐ যে সিংহাসনটা ওঁরা দখল করে আছেন, ওটা এক পুরুষের নয়। বেশির ভাগই পৈতৃক, কারও কারও বা শ্বাশুরিক। ওঁরা ভাগ্যবান পুরুষ। তোমার মতো রাত জেগে একগাদা পরীক্ষাও পাস করতে হয়নি, আমার মতো অফিসে অফিসে ধর্না দিয়ে চাপরাসীর গলাধাক্কা খেতেও হয়নি। Application নেই, Interview নেই, Testimonial সংগ্রহের জন্যে হাঁটাহাঁটি নেই, চাকরি এল সোজা, সরল সংক্ষিপ্ত পথ ধরে অর্থাৎ Give him a chair and a table.

সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলাম, সেটা আবার কি পদার্থ? রামজীবন কি একটা ফাইল ঘাঁটছিলেন। বন্ধ করে সিগারেট ধরালেন। তারপর পা তুলে গুছিয়ে বসে বললেন, নাঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না! শোনো তাহলে। একেবারে গোড়া থেকেই বলি। মিডলটন সাহেবের নাম শুনেছ তো?

—আই. জি. ছিলেন এককালে?

—আই. জি. ছিলেন মানে? আই. জি. তো এখনও আছে, পরেও থাকবে। কিন্তু এ একেবারে আলাদা চীজ। ডাকসাইটে ইনস্পেক্টর জেনারেল, লেপ্টনান্ট কর্নেল মিডলটন। খাস সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল। কথা বললে মনে হবে মেঘ ডাকছে। ভেতরে ভেতরে আবার তেমনি আত্মভোলা আশুতোষ। যতবড় অপরাধই কর, একবার গিয়ে পড়তে পারলেই হল। প্রথমটা গঁ গঁ করে উঠবে। তারপরেই জল। সেবার অক্ষয় পাঠকের চাকরি গেল। রসদ-গুদামের ইনচার্জ। সব মাল ঘাটতি। দু চার দশ সের নয়, কয়েক মণ! স্পেশাল অডিট বসল। কড়া রিপোর্ট। পুলিসে দেবার মতো কেস। শেষ পর্যন্ত হাত-কড়া আর পড়ল না; যা কিছু গেল চাকরির উপর দিয়ে। অক্ষয়বাবু দেখলাম কিছুমাত্র ঘাবড়ায়নি। ডিমিসাল অর্ডারটা পকেটে করে চলে গেল কলকাতায়। তখনকার দিনে রাইটার্স বিল্ডিং-এর সামনের দিকে যারা বসতো তাদের পর্দানশিন জেনানা করে রাখা হয়নি! পুলিশ-পাঁচিলের আড়ালে বসে ইজ্জত রক্ষা করতে তাঁদের বোধহয় ইজ্জতে বাধত। শুধু মহাজন নয়, অভাজনরাও বিনা বাধায় যেতে পারত দক্ষিণের বারান্দায়। বেলা তখন দুটো-আড়াইটে হবে। আই. জি. প্রিজনসের অফিসের সামনে তুমুল গণ্ডগোল। সাহেব কাজ-টাজ ফেলে বেরিয়ে এসে দেখেন প্রলয় কাণ্ড। সকলের সামনে দাঁড়িয়ে অক্ষয় পাঠক। পেছনে ঘোমটা মাথায় একটি মহিলা, আর তার পেছনে লাইন ধরে বারোটা ছেলেমেয়ে। এমনি কাউমাউ জুড়ে দিয়েছে কার কথা কে শোনে! মিডলটন্‌ বলে উঠলেন, Who are you? কে টুমি?

—আই অ্যাম অক্ষয় পাঠক স্যার।

—ড্যাম! এটা কৌন্ প্রসেশন আছে?

অক্ষয় অত্যন্ত সহজ ভাবে জানাল, প্রসেশন নয়, সাহেব। এটি তোমার বৌমা আর এগুলো তারই কাচ্চা-বাচ্চা।

—গুড গড। চোখ কপালে তুললেন মিডলটন। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, এখানে কি চাই?

—চাই আর কি সাহেব? চাকরি যখন নিয়েছ, এগুলোও নাও। এই রাবণের গুষ্টি আমি খাওয়াবো কী দিয়ে?

পরে শুনেছিলাম গোষ্ঠীবর্গ সবটা অক্ষয়ের নয়। সাতটি ওর নিজের আর বাকীগুলো আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে ধার।

বললাম, আমি মনে করেছিলাম, রাস্তা থেকে। যাক্, তারপর প্রসেশনের কি গতি হল?

রামজীবন হেসে বললেন, সে তো বুঝতেই পাচ্ছ। পার্সনাল অ্যাসিস্টান্ট ছিলেন রায়সাহেব বিধু ঘোষ। জরুরী তলব পেয়ে ছুটে এলেন। আসা মাত্র, ঐ বারান্দায় দাঁড়িয়ে অর্ডার দিলেন মিডলটন, পাঠককে কাজে বহাল করে নাও, রায়সাহেব।

পি. এ. অবাক, বলেন কি স্যর! অর্ডার বেরিয়ে গ্যাছে, তাছাড়া চার্জ অত্যন্ত সিরিয়াস!

সাহেব বললেন, But don’t you think this is more serious! — বলে আঙুল তুললেন পাঁচটি ছেলে আর সাতটি মেয়ের দিকে। অক্ষয়বাবুর উপর একটি অগ্নিদৃষ্টি ছেড়ে বললেন, বাচ্চাডের কী খাইটে ডিয়াছ?

অক্ষয় নিরুত্তর।

—স্কাউড্রেল! বলে দু-পা এগিয়ে গেলেন মিডলটন। পকেট থেকে বেরোল মনিব্যাগ। “বৌমার” হাতে দু-খানা দশটাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, উহাডের সণ্ডেস খাইটে ডেবেন। তারপর আবার সেই অগ্নিদৃষ্টি পাঠকের মুখের উপর এবং সেই সঙ্গে এক মেঘগর্জন—আর চুরি করিও না। যাও।

অক্ষয়বাবুর প্রসেশন্ চলে গেল। খানিকক্ষণ সেই দিকে চেয়ে রইলেন মিডলটন। তারপর অনেকটা যেন অনুনয়ের সুরে বললেন পি. এ.-কে, Give him a cheap station, Rai Saheb!

গজেনবাবু মাধ্যাহ্নিক ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন। টুপিটা নেবার জন্যে অফিসে ঢুকে বললেন, খুব তো জমিয়েছেন দুজনে। খবর জানেন তো?

বললাম, কি খবর?

—আই. জি.-র ইনস্পেকশন সাতাশ তারিখে। সাহেবের কাছে ডি. ও. এসে গেছে। গজেনবাবু বেরিয়ে যেতেই অপ্রসন্নমুখে বললাম, এ আবার এক উৎপাত শুরু হল। রামবাবু হেসে বললেন, যা বলেছ! এখন ঐ উৎপাতটাই আছে, সে উত্তাপ আর নেই।

—উত্তাপ কি রকম?

—উত্তাপ নয়? আই. জি. আসছেন। কী থ্রীল্ ছিল এই ছোট্ট কথাটার মধ্যে। সেসব তোমরা ধারণাই করতে পারবে না। সকালের ডাক খুলে দেখা গেল টুর প্রোগ্রাম। ব্যাস্! মুহূর্ত-মধ্যে যেন ধাক্কা খেয়ে জেগে উঠল গোটা জেলখানা—বড় সাহেব থেকে আরম্ভ করে মেথর-দফাদার গয়জদ্দি ওস্তাগর! লেগে গেল সাফাই-এর ধুম। চালাও ঝাড়ু, ঢালো ফিনাইল, রাস্তায় নর্দমায়, ঘরে বারান্দায় যেখানে সেখানে লাগিয়ে যাও চুনের প্লাস্টার। মিডলটন সাহেবের ইনস্পেকশন! তার প্রথম ও শেষ কথা হল—সাফাই। কাজকর্ম কদ্দূর কি করেছ তোমরা, সে খবরে তাঁর দরকার নেই। কয়েদীরা খেতে পাচ্ছে, কি পাচ্ছে না, ও-সব নিয়েও মাথাব্যথা নেই। রসদ-গুদামের কোণে, লাইন দেওয়া বস্তার ফাঁকে উঁকি মেরে দেখবেন কটা আরসোলা বসে আছে; অফিসের আলমারি আর বই-এর র‍্যাকের পেছনে লাঠি চালিয়ে দেখবেন, কোথায় লুকিয়ে আছে টিকটিকি আর কুনোব্যাঙ। এ সব মারাত্মক জানোয়ারের হাত থেকে তবু পার আছে, কিন্তু মাকড়সার দেখা পেলে আর রক্ষে নেই। আগাগোড়া সব ব্যাড়! জেলরবাবুরা হপ্তাখানেক আগে থেকেই গোটা কয়েক C. D. Gang বানিয়ে ফেলতেন। কয়েদীরা আর সব কাজ-কর্ম বন্ধ রেখে বাঁশের ঝাঁটা বেঁধে দলে দলে মাকড়সা তাড়িয়ে বেড়াত।

প্রশ্ন করলাম, C. D. Gang-টা কি জিনিস?

—Cobwebs Destroying Gang, আমরা সংক্ষেপে বলতাম, C. D. Gang. মোটা রেমিশন বখশিশ পেত এদের চার্জে থাকত যে-সব মেট পাহারা। সত্যি, মাকড়সা জাতটা ভারি নেমকহারাম। আজ সন্ধ্যাবেলা বেটাদের জালটাল ছিঁড়ে, গোষ্ঠীসুদ্ধ বেমালুম উচ্ছেদ করে নিশ্চিন্ত হয়ে আছ; সাল সকালে গিয়ে দ্যাখ, বেশ একটি সূক্ষ্ম জাল টাঙিয়ে নতুন করে সংসার পেতে বসেছে। কাজেই C. D. Gang-এর কাজ চলত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। আই. জি. ওধারটা রাউণ্ড দিচ্ছেন, C. D.-রা ঝাড়ুবাঁধা বাঁশ ঘাড়ে করে ছুটছে ওধারে।

রামজীবনবাবুর মতো অতগুলো না হোক, অপেক্ষাকৃত হাল আমলের দু-চারটা ইনস্পেকশন আমিও দেখেছিলাম। এ মহাপর্বের প্রথম অধ্যায় ছিল জেলর এবং ডেপুটি বাবুদের সোর্ড-স্যালুট। আই. জি. এসে সামনে দাঁড়াতেই, ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ফেলে যাওয়া খানকয়েক মরচে-ধরা তরোয়াল নিয়ে বাবুরা যে কসরত দেখাতেন, যাত্রার দলের চেয়ে সেটা কম, উপভোগ্য ছিল না। এই আস্ফালন আমাকেও একদিন দেখাতে হয়েছে; কিন্তু তার কৌশলটা কোনোদিন আয়ত্ত করতে পারিনি। কেবলই আশঙ্কা হত, ‘প্ৰেজেণ্ট আর্মস্’ দেখাতে গিয়ে আমার নাসিকার কিঞ্চিৎ অংশও বুঝি উপরওয়ালাদের প্রেজেন্ট দিতে হয়! অদৃষ্টের জোর ছিল। নাসিকা অক্ষত আছে। সেই মধ্যযুগের তরোয়াল খেলা আজও চলেছে। বিভিন্ন জেলের প্যারেড গ্রাউণ্ডে বৎসরান্তে যখন তার হাস্যকর অভিনয় দেখি এবং হুঙ্কার শুনি, মনে মনে কৌতুক বোধ করে থাকি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের রসবোধের তারিফ করতে পারি না। যাক্ সে কথা।

রামজীবনবাবুকে প্রশ্ন করলাম, আপনার মিডলটনকে অসি-যুদ্ধ দেখাতে হত না?

—নিশ্চয় হত। তবে আমরা যেটা দেখাতাম, সেটা তোমাদের কালের ছেলেখেলা নয়, একেবারে খাঁটি এবং নিখুঁত সোর্ড-স্যালুট। পুরো সাতদিন ধরে মহড়া দিতে দিতে প্রাণ বেরিয়ে যেত। ভুলচুক হলে রক্ষা নেই। সার্ভিস রেকর্ডে কালো কালো দাগ!

—আপনার কপালে জুটেছে নাকি দু-চারটি?

—জোটেনি আবার, আরে, আমি তো কোন্ ছার! বড় বড় মহারথীরাও বাদ যাননি। এই যেমন ধর রায়সাহেব গণপতি সান্যাল। অত বড় বাঘা জেলর। নাম শুনলে এখনও আমাদের বুক ঢিব্‌টিব্ করে। তাঁর কাণ্ডটা শোনো। রাজসাহী সেন্ট্রাল জেলে এসেছেন মিডলটন। বড় একখানা সোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছেন রায়সাহেব। পেছনে আমরা চারজন ডেপুটি আর রিজার্ভ চীফ্ বলবন্ত সিং। আই. জি.-র গাড়ি এসে থামতেই হুঙ্কার দিলেন—স্লোপ্ আর্মস্! খড়্গ উদ্যত হল। মিডলটন্ নেমে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে কমাণ্ড দিলেন জেলর সাহেব—প্রেজেন্ট আর্মস্! হাত টান করে নামিয়ে দিলাম তরোয়াল। ব্যাস্, আর সাড়াশব্দ নেই। দু মিনিট তিন মিনিট যায়। হাত টাটিয়ে উঠল আমাদের। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি থম্‌থম্ করছে রায়সাহেবের মুখ।

বয়স হয়েছে। একে নার্ভাসনেস্, তার ওপর বুকের ভেতর প্যালপিটেশনের ধাক্কা। পরের বুলিটা আর মনে আসছে না কিছুতেই। সুপার চঞ্চল হয়ে উঠছেন। আই. জি-র মুখ অমাবস্যা। ব্যাপার গুরুতর দেখে, গলা ছাড়ল বলবন্ত সিং। কোনরকমে মুখ-রক্ষা হল, আর সেই সঙ্গে আমাদেরও প্রাণরক্ষা। কিন্তু রায়সাহেবের প্রাণ নিয়ে টানাটানি। অতবড় সেন্ট্রাল জেল থেকে বদলি হলেন যশোর ডিস্ট্রিক্ট জেলে।

রামজীবন সিগারেট ধরালেন। বললাম, চেয়ার টেবিলের গল্পটা তো শোনা হল না।

দেশলাই-এর কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, এইবার শোন। ধর, ইনস্পেক্‌শন ভালয় ভালয় উৎরে গেছে। মাকড়সা ট্রেচারি করেনি। সি. ডি-দের কাজ নিখুঁত। মিডলটন খুশি হয়েছেন। খোস-মেজাজে বেরিয়ে এসেছেন গেট পার হয়ে। সুপার সাহেবের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করে মোটরে উঠতে যাবেন, পাশ থেকে স্যালুট দিল একটি ছোকরা। পরনে লম্বা বাকী প্যান্ট, তার ওপরে মিলিটারী প্যাটার্ন হাফশার্ট। দুটোর কোনোটাই নিজস্ব নয়, সম্ভবত পৈতৃক সম্পত্তি। শ্রীমানের সঙ্গে তার ছোটভাইকেও একসঙ্গে উদরস্ত করতে পারে। মিডলটনের মুখে কৌতুক হাসি ফুটে উঠল। জেলর সাহেবের দিকে তাকাতেই, বিনীত কণ্ঠে বললেন, My son sir, কিংবা, My son-in-law, Sir.

— I see, is he going to school?

—না, সাহেব। ইস্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছি। ইংরেজি চমৎকার শিখেছে। Very eager to serve under you. দয়া করে পায়ে স্থান দিলে গরীব বেঁচে যায়। অনেকগুলো কাচ্চা- বাচ্চা।

সাহেব তাঁর বেতের লাঠিটা দিয়ে শ্রীমানের পেটে একটা খোঁচা মারলেন, বোধহয় বিদ্যার পরিমাণটা পরখ করবার জন্যে। তারপর বললেন, All right. Give him a chair and a table.

এক কথায় চাকরি হয়ে গেল। অর্থাৎ মাইনের সঙ্গে দেখা নেই। অফিসের একপাশে একটি চেয়ার ও একখানি টেবিলের ব্যবস্থা হল বাবাজীবনের জন্যে। বৎসরান্তে আবার এলেন আই. জি.। এবার গেটের বাইরে নয়, ভেতরেই হাজির করা হল শ্রীমানকে। পরনে নিজের সুট। পুত্র বা জামাতার অসামান্য কৃতিত্বের লম্বা ফিরিস্তি দিলেন জেলর সাহেব। পূর্ব বন্দোবস্ত মতো সুপারও যোগ করলেন দু-চার লাইন। পেটের উপর আবার সেই লাঠির খোঁচা। Admission Register লিখতে পার? প্রশ্ন করলেন মিডলটন।

—ইয়েস, স্যার।

—পয়লা অক্টোবর তিন মাস জেল হলে তার খালাস পড়বে কোন্ তারিখে? নির্ভুল উত্তর পাওয়া গেল। গাড়িতে উঠতে উঠতে সুপারের দিকে ফিরে আদেশ করলেন আই. জি.—’একটা রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবেন ওর কাজ সম্বন্ধে। জায়গা খালি হলে বিবেচনা করে দেখবো।’ যথাসময়ে রিপোর্ট চলে গেল। পাঁচ সাত মাস কিংবা এক বছর পরে অর্ডার এল, ‘বাবু অমুক চন্দ্র অমুককে অত তারিখ হইতে অস্থায়ী অ্যাসিস্টান্ট জেলর পদে নিযুক্ত করা হইল।’ মুরুব্বীর জোর রয়েছে। অস্থায়ী স্থায়ী হতে দেরি হল না। তারপর পৈতৃক বা শ্বাশুরিক আসনের দিকে টপাটপ্ এগিয়ে চললেন শ্রীমান। এমনি করেই চলছে। এক বাবাজীবন এগিয়ে যান, তো আর এক বাবাজীবন এসে তার শূন্য আসন দখল করেন। তাহলেই বোঝ, রামজীবনকে অপেক্ষা করতেই হবে।

ইংরেজ কবি কাব্যলক্ষ্মীকে বলেছেন, Jealous mistress। আমি কবি নই, ইংরেজও নই। আমার কাছে সত্যিকার জেলাস মিস্ট্রেস্ যদি কেউ থাকেন, তিনি নিদ্রাদেবী। অত্যন্ত কড়া মনিব। নিজের প্রাপ্য কড়ায় গণ্ডায় আদায় করেন এবং তাঁর উপর অনধিকার হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করেন না। আপনার বাৎসরিক পরীক্ষা আসন্ন। চোখের সামনে রাশি রাশি সর্যের ফুল শোভা পাচ্ছে। আর কোনো পথ না দেখে এগারোটার ঘুমকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন একটায়। মনে করলেন, খুব লাভ হল। কিন্তু, হায়, পরদিন যখন ঘুম ভাঙল, সেই সঙ্গে ভুলও ভাঙল আপনার। দেখলেন, ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটা ছাড়িয়ে আটটার দিকে ধাবমান। অর্থাৎ ভবী ভুলবার নয়। রাত্রির অবহেলার শোধ নিয়েছে রাত্রিশেষে।

আমার বাৎসরিক পরীক্ষা নেই; আছে সাপ্তাহিক নাইট-রাউণ্ড বা নৈশ চক্কর। তার ধান্ধায় বেরিয়েছিলাম রাত দুটোয়। জেলাস মিস্ট্রেস্ তাঁর দাবি ছাড়লেন না। মুক্তি দিলেন পরদিন বেলা আটটায়। ধরাচূড়া এঁটে হন্তদন্ত হয়ে অফিসে যখন পৌঁছলাম, জেলের চাকা তখন পুরোদমে চলছে। জেলর সাহেবের ঘরের সামনে দিয়ে পথ। শ্যেনদৃষ্টির কবলে পড়তেই কলকণ্ঠে বিপুল অভ্যর্থনা – Good morning, মলয়বাবু। এই যে আসুন; আসতে আজ্ঞা হোক্‌।

গিরীনদা বলেছিলেন, চাকরি জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজন হল একখানা মুখোশ। নিজের আসল মুখখানা কাউকে দেখিও না। অন্তত উপরওয়ালাকে তো নয়ই। তখন হেসেছিলাম। পরে বুঝেছি, এর চেয়ে মূল্যবান উপদেশ আর হতে পারে না। তাই জেলর সাহেবের আন্তরিক অভ্যর্থনায় পিত্ত যখন জ্বলে উঠল, একখানা মোলায়েম মুখোশ পরে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি একটুকরো কাগজ আর এক গোছা চাবি এগিয়ে দিয়ে বললেন, রামজীবনবাবু আসবেন না। এই নিন তাঁর চিঠি আর চাবি।

—কী হল রামবাবুর?

জেলরবাবু বিরক্তির সুরে বললেন, কি জানি মশায়; ডাইরিয়া না ডায়াবেটিস, কি একটা লেখা আছে ঐ চিরকুটে। আসলে এটা হচ্ছে মেণ্টাল শক। …আমি অপেক্ষা করে আছি দেখে মাথা নেড়ে বললেন, শোনেননি বুঝি? এবারেও হল না। সিউড়িতে চান্স পাচ্ছে ক্ষেত্তরদার ছেলে বংশী।

একটু চিন্তার ভান করে বললাম, রামজীবনবাবু মনে হচ্ছে ওঁর সিনিয়র!

—সিনিয়র হলে কি হবে? ‘কিন্তু’ আছে এর মধ্যে।

একটু থেমে আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে চেয়ে বললেন, দেখুন মশাই, আমি সিধে মানুষ। সোজা কথায় বুঝি চাকরি করতে এসে ওসব মহত্ত্ব-টহত্ত্ব দেখালে চলে না। এখানে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। কি বলেন?

সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলাম, সে তো নিশ্চয়ই।

—তবে? বাগান থেকে কয়েদী পালাল। সিপাই মরবে, মরুক। আমার আপনার কি এসে গেল? সিপাইকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের ফ্যাসাদ ডেকে আনবার দরকার কি? যাক্, ওসব যার কথা সেই বুঝুক। আপনি দেখুন খালাস-টালাস কি আছে। চটপট নিয়ে আসুন। সাহেব আসবার সময় হল।

সেই দিনই সন্ধ্যেয় অফিস শেষ করে গেলাম রামজীবনবাবুর বাড়ি। ঢুকেই সামনের ঘরটায় থাকেন। দেখলাম খাটের উপর বসে পা-দুটো ডুবিয়ে দিয়েছেন একবালতি জলের মধ্যে। পাশে দাঁড়িয়ে রামবৌদি মাথার উপর পাখার বাতাস করে চলেছেন। রামবৌদি কথাটা বোধহয় দ্ব্যর্থ-বোধক। রামদার স্ত্রী, তার সঙ্গে রয়েছে তাঁর শ্রীঅঙ্গের ইঙ্গিত।

—কি করছেন, দাদা?

—এই যে, এসো ভাই। মাথাটা ছাড়ছে না। একটা ফুটবাথ নিচ্ছি।

—সেই সঙ্গে আবার মাথায় হাওয়া?

—হ্যাঁ, একাধারে ডবল অ্যাক্‌শন্।

মহিলাটি দেখলাম গলদঘর্ম হয়ে পড়েছেন। বললাম, পাখাটা আমাকে দিন তো বৌদি। আপনি বরং একটু চা-টা-এর যোগাড় দেখুন।

রামবৌদি পাখা নামিয়ে রেখে আঁচলে মুখ মুছে বললেন, থাক্, আপনাকে আর হাওয়া করতে হবে না। আর দরকারও নেই। চায়ের সঙ্গে কি খাবেন বলুন তো? আপনার তো আবার মিষ্টি-টিষ্টি চলবে না। কাঁচালঙ্কা কিন্তু আমার ঘরে নেই।

রামবৌদি বাঁকুড়ার মেয়ে। আমার দেশ পদ্মার ওপার। খাদ্য সম্বন্ধে আমাদের এই মধুর বিরোধ নতুন নয়। বললাম, তা জানি! কাঁচালঙ্কার মর্যাদা বুঝতে আপনার অনেক দেরি। কড়াই-এর ডাল আর পোস্ত-চচ্চড়ি আছে তো? অগত্যা তাই নিয়ে আসুন।

রামজীবনদা হেসে বললেন, ওসব থাক্। ডবল অমলেট করে নিয়ে এসো দু-ডিশ। বৌদি কৃত্রিম রোষ দেখিয়ে বললেন, দু-ডিশ বৈকি। জ্বরের মধ্যে ডিম ভাজা! ওসব আমার দ্বারা হবে না বাপু।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, আপনি ভুল বুঝলেন, দাদা ওটা আমার মুখ চেয়েই বলেছেন। উনি জানেন, একখানা এলে হজমের ব্যাঘাত ঘটবে।

বৌদি হেসে চলে গেলেন।

বালতির ভিতর থেকে পা তুলে নিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে খাটের উপর গুটিয়ে বসলেন রামজীবনবাবু। ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করলেন, তারপর আফিসের খবর কি, বল তো?

মোটামুটি খবর দিলাম, এবং সেই সঙ্গে যোগ করলাম জেলর সাহেবের জ্ঞানগর্ভ উপদেশ। রামজীবনের মুখের হাসিটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। নিঃশব্দে চেয়ে রইলেন জানালার বাইরে। ঘরের সামনে একফালি সরু রাস্তা। তারপরেই খাল। বর্ষার তাড়নায় ফেঁপে ফুলে ভরে উঠেছে। কূল ছাপিয়ে এল বলে। কোথাও সোজা, কোথাও পাক খেয়ে ছুটে চলেছে তীব্র স্রোত। ওপার থেকে দুর্বার বেগে ধেয়ে এল বৃষ্টি। চক্ষের নিমেষে খাল পার হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল এপারের বাড়িগুলোর উপর। চারিদিকের অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, জানালাটা বন্ধ করে দিই?

—না থাক্—অনুচ্চ গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন রামজীবন। জল-ঝড়ের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বললেন, একটা কথা তোমায় বলবো। এতদিন বলি বলি করেও বলা হয়নি। দেখছিলাম, সে রাতটার সঙ্গে আজকের রাতের আশ্চর্য মিল। এমনি বর্ষাকাল। খালের জল ঘাট ছাপিয়ে উঠেছে। এমনি দুর্যোগ। তুমি যেখানে বসে আছ তার ঠিক পেছনে ঐ মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ে বৌটার কি কান্না! পাশে সেই কয়েদীটা ছবির মতো দাঁড়িয়ে। কোলে মাসকয়েকের একটি ঘুমন্ত বাচ্চা। আমি এই খাটের উপর ঠিক এমনি করে বসে। ভেবে চলেছি কী করবো, কী আমার কর্তব্য! তোমার বৌদি গেছেন বাপের বাড়ি। ছেলে- পিলেরাও গেছে সেই সঙ্গে। নির্জন বাড়িতে আমি একা। একটু পরামর্শ করবো, সে উপায়ও নেই। অথচ স্থির একটা কিছু করতেই হবে। দেরি করবার সময় নেই।

বৌদি নিজে আসেননি। মেয়ের হাতে পাঠিয়ে দিলেন চা এবং ডিমভাজা। দাদাকে বঞ্চিত করেন নি। কিন্তু উনি তখন অন্য লোক। অমলেটের দিকে নজর পড়ল না। ডবল বালিশের উপর পাশ-বালিশ, তার উপর মাথা রেখে ধীরে ধীরে বলে গেলেন সেই বর্ষারাতের অনুক্ত কাহিনী।

এই জেলেরই দু-বছর আগেকার ঘটনা। আমি তখন আসিনি। জেলরও ছিলেন অন্য লোক। শ্যালিকার বিয়ে উপলক্ষে দিন সাতেকের ক্যাজুয়াল ছুটি নিয়ে গিয়েছিলেন কোলকাতায় না বর্ধমানে। অ্যাকটিনি করছিলেন রামজীবনবাবু। মাইল দেড়েক দূরে জেলের বাগান। তার তদ্বির-তদারকের ভার জেলরের উপর। বৈকালিক ডিউটির একটি বড় অংশ প্রায়ই সেখানে কাটাতে হয়। তার জন্যে অ্যালাউন্স বরাদ্দ আছে মাসিক পাঁচ টাকা। যুদ্ধের বাজারে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ছ’টাকা চার আনা। অ্যালাউন্সের লোভে না হোক, কর্তব্যের খাতিরে রামজীবনও বাগান দেখতে যান। আঠারো কুড়ি জন কয়েদী রোজ সেখানে সকালে বিকালে কোদাল চালায়। তাদের চার্জে আছে একজন বেটনধারী সিপাই। সে একাধারে সান্ত্রী এবং কৃষি-বিদ্যা-বিশারদ। চাষবাসের খেদমত এবং কয়েদীবাহিনীর খবরদারি—এ দুটোরই ভার তার উপর।

সাতদিনের জেলর রামজীবন গেছেন বাগান-পরিদর্শনে। নতুন লোক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন সব খুঁটিনাটি। সিপাই সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। সন্ধ্যা হয় হয়। কয়েদীদের ফিরবার সময় হয়ে গেছে। মেট তাদের এ-ক্ষেত ও-ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করে জোড়ায় জোড়ায় বসিয়েছেন এনে পুকুরপাড়ে। গুনতি হল—দু, চার, ছয়, আট…। এ কি! একটা যে কম! দ্যাখ তো কোটা আসেনি—হুকুম করল পাহারাকে। পাহারা খাতার সঙ্গে নাম মিলিয়ে বললে, মেনাজদ্দিটা আসেনি। হাঁক-ডাক চলল মেনাজদ্দির নাম ধরে। কোনো সাড়া নেই। এখানে সেখানে খুঁজে দেখা হল। ফল একই। মেট ছুটে গেল, সিপাইকে খবর দিতে। রামজীবন তখন বাগানের ফটক পার হয়ে রিকশায় উঠতে যাচ্ছেন। সিপাই দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, রিকশা চলতে উদ্যত হলেই খটাস্ করে বুট ঠুকে লাগিয়ে দেবে স্যালুট। এমন সময় এল সেই ভয়াবহ রিপোর্ট—মেনাজদ্দি নেই। মাথার ভিতরটা ঝিম্ ধরে গেল রামজীবনের। সেই সঙ্গে মনে হল হৃৎপিণ্ডের কলকব্জাগুলো আর চলছে না। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন স্থাণুর মতো খেয়াল নেই, হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে এল সিপাই-এর চিৎকার শুনে—’জেলমে যাতা হ্যায় হুজুর।’ চমকে উঠে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। জলদি যাও। অ্যালার্ম দিতে বল এক্ষুনি।’ হঠাৎ মনে পড়ল বাকী কয়েদীগুলোর কথা। তাড়াতাড়ি বাগানে ফিরে গিয়ে তাদের চার্জ নিলেন। সিপাই ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে পথের বাঁকে। এ তো যে- সে দৌড় নয়, মরণ-দৌড়; কয়েদীটা একা যায়নি, তার সঙ্গে নিয়ে গেছে এই দরিদ্র লোকটার বাকী জীবনের রুটি। দেড় মাইল পথ পার হতে লাগল দশ মিনিট। সঙ্গে সঙ্গে জেল-গেটে বেজে উঠল অ্যালার্ম। রণ-রঙ্গে ধেয়ে এল লাঠি আর বন্দুকধারীর দল। তার সঙ্গে যোগ দিল পুলিশবাহিনী। বাগান আর তার আশ-পাশ জুড়ে শুরু হল প্রলয় নৃত্য। পলাতক কয়েদীর জন্য জান দিল কুমড়ো, কচু, ঝিঙে, পটল, আর মান দিল চারদিকের কতকগুলো কুটীরবাসী গৃহস্থ পরিবার। মেয়েদের আব্রু রক্ষার অজুহাত অগ্রাহ্য করে তাদের রান্না আর শোবার ঘরে, আঁস্তাকুড় আর শৌচাগারে চলল খানিক বেপরোয়া পুলিশী সন্ধান। কিন্তু মেনাজদ্দির খোঁজ মিলল না।

অ্যালার্ম শেষ হতেই সুপার এলেন। শুরু হল এনকোয়ারী পর্ব। গতানুগতিক রীতি অনুসারে তিনি যখন বাগানী সিপাইকে সাসপেণ্ড করবার হুকুম দিতে যাবেন, রামজীবন আপত্তি জানিয়ে বসলেন। দৃঢ়ভাবে বললেন, এ পলায়নের সমস্ত দায়িত্ব তাঁর। সিপাই জেলরকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল, কয়েদীর দিকে অখণ্ড মনোযোগ দেবার সুযোগ পায়নি। তারই সদ্ব্যবহার করেছে মেনাজদ্দি। বলা বাহুল্য, সুপার এ যুক্তি মেনে নিলেন না। আইন বলছে, কয়েদীর হেফাজত যার উপর ন্যস্ত, তার গতিবিধির জন্য দায়ী হবে সেই ওয়ার্ডার। জেলরের ইনস্পেকশন্ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, এবং শুধু সেই কারণে সিপাইকে তার আইন-নির্দিষ্ট দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া যায় না। সুপার মন্তব্য করলেন, তাঁর মতে রামজীবনের এই অহেতুক উদারতা দুর্বলতার নামান্তর মাত্র। এই রকম মনোভাব জেলর পদাধিকারী দায়িত্বশীল অফিসারের পক্ষে মারাত্মক, এবং সিপাইবাহিনীর মধ্যে ডিসিপ্লিন রক্ষার অনুকূল নয়।

উপরওয়ালার কাছ থেকে সরব তিরস্কার এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে নীরব উপহাস সম্বল করে রামজীবন যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন অনেক রাত। আরও অনেক রাত পর্যন্ত এই বিছানায় পড়ে ঐ কথাগুলোই তাঁর মনের মধ্যে তোলপাড় করে বেড়াতে লাগল। সত্যিই কি তাই? আইনের দৃষ্টি ছাড়া মানুষের চোখে কি আর কোন দৃষ্টি নেই? ন্যায়-অন্যায়ের একমাত্র মানদণ্ড ঐ জেলকোড কিংবা পিনালকোড? আমার মন কেউ নয়? আমার যে আইন-না-পড়া সহজ বিচারবুদ্ধি, তার কি কিছুই বলবার নেই?

জেলগেটে একটার ঘণ্টা শুনতে পেলেন রামজীবন। তারপর কখন এক সময় ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে এল তাঁর উত্তপ্ত স্নায়ুজাল। স্বপ্নের মধ্যে মনে হল কে তাঁকে ডাকছে, মৃদু কোমল কণ্ঠে—বাবা। গলাটা যেন তার বড় মেয়ে কল্যাণীর মতো। সাড়া দিতে যাবেন, হঠাৎ মনে পড়ল, তারা তো এখানে নেই। আবার সেই কুণ্ঠা-জড়িত কণ্ঠ। ধড়মড় করে উঠে বসলেন রামজীবন, কে?

—আমরা,-বাবা, দরজার বাইরে থেকে জবাব এল।

–কে তোমরা?

—দরজাটা খুলুন না? ভীরু কণ্ঠের কাতর অনুরোধ

রামজীবন জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেন। দরজার ওপাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একজন পুরুষ, পাশে একটি স্ত্রীলোক। তার দু-হাতে কাপড় জড়ানো একটা পোঁটলার মতো। তার ভিতর থেকে শিশুর কান্না শোনা গেল। চেপে বৃষ্টি এল এক পশলা। রামজীবন দরজা খুলতেই ওরা তাড়াতাড়ি দাঁড়াল এসে ঘরের মধ্যে। হ্যারিকেন উস্কে দিতে দেখা গেল লোকটার গায়ে কয়েদীর পোশাক। ভিজে সর্বাঙ্গে লেপটে গেছে। মেয়েটির পরনে যে শাড়ি তার থেকেও জল ঝরছে। রামজীবন রূঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তোমরা? কি চাই এত রাত্রে?

লোকটা জোড়হাত করে বলল, আমি মেনাজদ্দি। বাগান থেকে পালিয়েছি আজ সন্ধ্যাবেলা-

রামজীবন যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মেয়েটি বলল, ও ধরা দেবে, বাবা। ওকে জেলখানায় ফিরিয়ে নাও।

—ধরা দেবে? তা এখানে কেন? থানায় যেতে বল।

পোঁটলাসুদ্ধ বাচ্চাটা মেনাজদ্দির হাতে দিয়ে বৌটি বসে পড়ে রামবাবুর পা জড়িয়ে ধরল।

কান্নার সুরে বলল, ওরা যে খুন করে ফেলবে বাবা!

খুন না হলেও অভ্যর্থনার মাত্রাটা যে তার কাছ ঘেঁষে যাবে, একথা রামবাবুর অজানা ছিল না। জেলগেটে পাঠালেও বিশেষ তারতম্য হবে না, তাও তিনি জানতেন।

মেনাজদ্দির দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন, পালিয়েছিলি কেন?

উত্তর দিল তার বৌ—সব কসুর আমার, বাপজান। আমি খবর দিয়েছিলাম, বাচ্চাটা জ্বরে বেহুঁশ। ডাকলে সাড়া দেয় না। বড় ভয় হল। সোনার মার কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লাম—শেষকালে একবার দেখতে পেল না ছেলেটাকে! আমার জ্ঞান ছিল না, বাবা। খবর পেয়েই ও যে পালিয়ে আসবে, বুঝতে পারিনি।

রামজীবন নিঃশব্দে চেয়ে রইলেন। কি বলবেন ভেবে পেলেন না। বৌটি একটু থেমে আবার বলল, পায়ে তোমার জুতো আছে। সাজা যা দেবার তুমি নিজে দাও। জেল খাটিয়ে নাও যতদিন ইচ্ছা। দোহাই তোমার, থানায় পাঠিও না এই রোগা মানুষটাকে।

মিনতি-সজল চোখ দুটি তুলে ধরল রামজীবনের দিকে। মুখখানা একেবারে কচি। দারিদ্র্য এবং দুশ্চিন্তায় শীর্ণ স্নান। বোধহয় কল্যাণীর বয়সীই হবে মেয়েটা। দেখতে আরও ছোট দেখায়। ওর মুখের দিকে চেয়ে রামজীবনের হঠাৎ মনে এল একটা নিতান্ত অবান্তর কথা—মেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। এবার পাত্রস্থ করতে হবে। তারপর সে চলে যাবে পরের বাড়ি। কত দূরে কে জানে? কতদিন পরে পরে দেখতে পাবেন, তাও অনিশ্চিত।

মেনাজদ্দির দিকে চেয়ে তিক্তস্বরে বললেন, ব্যাটা, চুরি করেই যদি খাবি, বিয়ে করতে গিয়েছিলি কিসের জন্যে? না না, আমি কিছু করতে পারবো না। এসব পুলিসের ব্যাপার। থানায় খবর দিতে হবে।

বৌটার কান্না উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। আর কিছু বোধহয় বলতে সাহস করল না। শুধু নত হয়ে আরও জোরে চেপে ধরল রামজীবনের পা দুটো। গভীর রাত্রির অন্ধকারে তারই উপর ঝরে পড়তে লাগল তার বাধাহীন চোখের জল। মেনাজদ্দি বৌকে দেখিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, ও আসবার পরে আর চুরি করিনি, বড়বাবু

—চুরি করিসনি! জেল হল খালি খালি, কেমন? ঝাঁঝিয়ে উঠলেন রামজীবন।

মেয়েটি মুখ তুলে বললে, সত্যি কথা, বাবা। এবার ও চুরি করেনি। যে রাতে চুরি হল রায়বাবুদের বাড়ি, সেদিন জ্বরে ওর হুঁশ ছিল না। সমস্ত রাত পাখা করে ভোরবেলা একটু ঘুমের মতন দেখে আমিও কাত হয়েছিলাম। পুলিস এসে টেনে তুলল। দারোগা সাহেবকে কত করে বললাম, শুনল না। জ্বরো মানুষটাকে বেঁধে নিয়ে গেল মারতে মারতে। তারপর শুনলাম এক বছর জেল হয়ে গেছে।……আঁচলে চোখ মুছে বলল, এবার ভেবেছিলাম, এ দেশে আর নয়। খালাস হলেই আমরা ফুপার কাছে চলে যাবো। মস্ত বড় গেরস্ত। দু-বেলা তার জমিতে কিষাণ খাটলেও আমাদের তিনটি পেট স্বচ্ছন্দে চলে যায়। …খোদার মরজি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রামজীবনের পায়ে হাত রাখল মেনাজদ্দির বৌ। কিছুক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ মাথা তুলে প্রশ্ন করল, এবারে আবার কদ্দিন সাজা হবে? বা-বা।

রামজীবন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। প্রশ্নটা তাঁর কানে গেলেও মনে পৌঁছাল না। বললেন, কোথায় থাকে তোমার ফুপা?

–সে অনেক দূরে। ভাটিতে। দু-দিন দু-রাত লাগে নৌকায়।

—নৌকাভাড়া কত?

—তা তো জানি না, বাবা।

মেনাজদ্দি বলল, চার-পাঁচ টাকা লাগে কেরায়া নৌকায়।

রামজীবন দু-হাত পেছনে জড়ো করে ঘরময় পায়চারি করলেন কয়েকবার। পাশের ঘরে গেলেন। আবার ফিরে এলেন। একবার উঠে বসলেন খাটের উপর। তারপর নেমে দাঁড়ালেন লোকটার মুখোমুখি। হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, সেখানে গেলে পুলিসের হাত এড়াতে পারবি? খুঁজে ধরে আনবে না?

মেনাজদ্দির মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। বলল, ভাটিতে? পুলিশের বাবার সাধ্যি কি কাউকে খুঁজে বার করে বড়বাবু। চারদিকে খালি বড় বড় গাঙ্। এ-পার ও-পার নজর পড়ে না! তিরিশ-চল্লিশ কোশ দূরে থানা। কে কার খবর রাখে? ভাটি বড় জবর দেশ।

রামজীবন আবার পাশের ঘরে ফিরে গেলেন। নিয়ে এলেন নিজের ধুতি, কল্যাণীর একখানা শাড়ী আর ছোট ছেলের গোটা-দুই পুরানো জামা। ধুতিটা মেনাজদ্দির হাতে দিয়ে বললেন, পরে নে এটা। আর ঐ জাঙ্গিয়া-টাঙ্গিয়াগুলো ফেলে দিয়ে আয় খালের জলে।

কয়েদীটা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল; যেন বুঝতে পারেনি জেলরবাবু কি বলছেন। রামজীবন ধমকে উঠলেন, হাঁ করে দেখছিস কি? কথা কানে যাচ্ছে না?

কম্পিত হাতে কাপড়টা নিয়ে সে বাইরে চলে গেল। বাকি জামা-কাপড় এবং সেই সঙ্গে একখানা দশ টাকার নোট মেয়েটার হাতে দিয়ে বললেন, ঐ পুলের ধারেই কেরায়া নৌকার ঘাট। দু-এক টাকা বেশী দিলে এখনি রওনা হতে পারবে। ফুপার কাছে চলে যাও। এখানে এসেছিলে, এ কথা যেন কোনোদিন কেউ জানতে না পারে।

ততক্ষণে মেনাজদ্দি ফিরে এসেছিল। তার দিকে কট্‌ট্ চোখে তাকিয়ে বললেন, বুঝলি তো? সে শুধু শুধু ঘাড় নাড়ল কলের পুতুলের মতো। বৌটি মাথা লুটিয়ে দিল রামজীবনের পায়ের কাছে। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, দোয়া কর, বাপজান। ভালোয় ভালোয় গিয়ে যেন পৌঁছাতে পারি।

মেনাজদ্দি কি একটা বলতে যাচ্ছিল। রামজীবন আবার ধমক লাগালেন। হ্যারিকেনের মৃদু আলোকে দেখা গেল কয়েদীর চোখদুটো ছলছল করছে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। সমস্ত আকাশময় তার পুনরাগমনের আয়োজন। রামজীবন খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন। বিদ্যুতের আলোয় মনে হল বউটা ঐ দূর থেকে ফিরে তাকাল। তারপর আর কিছু দেখা গেল না। দরজা বন্ধ করে খাটের উপর স্থির হয়ে বসলেন রামজীবন। কিন্তু মনের ভিতরে চললো অস্থির দ্বন্দ্বের আলোড়ন—দায়িত্বশীল সরকারী কর্মচারী আমি। এ কি করে বসলাম! আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ; সরকারের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা! ছুটে গিয়ে আবার দরজা খুললেন। চিৎকার করে ডাকতে গেলেন, মেনাজদ্দি! ডাকা হল না। চোখের উপর ভেসে উঠলো একটি কচি মেয়ের অশ্রুসজল মুখ। কোলে তার রুগ্‌ণ শিশু। পাশে দাঁড়িয়ে একটা হতভাগ্য কয়েদী। ছেলের অসুখের খবর পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল জেলের বাগান থেকে। তারপর গভীর রাতে বউয়ের হাত ধরে ফিরে এসেছে তারই কাছে ধরা দেবার জন্যে।

বাকী রাতটুকু আর ঘুম এল না। কখনও বিছানায়, কখনও ঘরের ভিতর ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিলেন রামজীবন। সকাল সকাল গিয়ে কাজের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করলেন; সে চেষ্টা সফল হল না। থেকে থেকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে লাগলেন। সহকারী বিজনবাবু বললেন, আপনার কি অসুখ করেছে, স্যার?

—না, ঠিক অসুখ নয়। শরীরটা তেমন ভাল বোধ হচ্ছে না।

বিজনবাবু হেসে বললেন, আমাকে দু-দিন ছুটি দিন। বউদিকে নিয়ে আসি গিয়ে। অন্যদিন হলে এর একটা সরস ও সস্নেহ উত্তর দিতেন রামজীবন। আজ শুধু মৃদু হেসে চুপ করে রইলেন। বিজনবাবু বুঝলেন escape-এর ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি ভদ্রলোক। তাই একরকম জোর করেই ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।

আজ সকাল থেকে বৃষ্টি নেই। চারদিকে বর্ষণ-মুক্ত বর্ষার পরিপূর্ণ যৌবনশ্রী। রামজীবন খালের ধারে একটা ক্যাম্প-চেয়ারে পড়েছিলেন। অপরাহ্ণের রৌদ্রমুক্ত আকাশ গাঢ় নীল। এক ঝাঁক চিল উড়ে যাচ্ছিল। সেইদিকে তাকিয়ে মনে হল, আর একটু উঠলেই ওদের ক্লান্ত ডানায় নীল জড়িয়ে যাবে।

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন বিজনবাবু।

—কি খবর?

—খুব ভাল খবর, স্যার। মেনাজদ্দিটা ধরা পড়েছে। এইমাত্র দিয়ে গেল পুলিস। ধোলাই-এর চোটে ডবল হয়ে গেছে বেটা। চিনতেই পারছিলাম না। অনেক ডাকাডাকি করতে চোখ পিট-পিট করে তাকাল একবার। হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে এলাম। বাঁচবে কিনা কে জানে!

রামজীবন আস্তে আস্তে বললেন, কোথায় ধরা পড়লো?

—মাইল তিরিশেক দূরে নদীর মধ্যে কোথায়। ঘোড়েল তো কম নয়। বউছেলে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল নৌকো করে। পড়বি তো পড় একেবারে জলপুলিশের মুখে। কাপড়চোপড় বদলে ফেলেছিল; পায়ের কড়াটা খালি খুলতে পারে নি। তাতেই ধরা পড়লো।

একটু থেমে আবার বললেন বিজনবাবু, পুরোনো চোর; পালাবি, না হয় নিজেই পালা। আবার বউটাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। ঐ মেয়েমানুষ দেখেই নৌকো থামিয়েছিল পুলিশ।

রামজীবন তাঁর সহকর্মীর এই সরস কাহিনীতে যোগদান করবার চেষ্টা করলেন। মৃদু হেসে বললেন, বউ-ছেলেও বুঝি ধরে এনেছে ঐ সঙ্গে?

—আপনিও যেমন—মুখে একটা শব্দ করে বলে উঠলেন বিজনবাবু, বাচ্চাটা পথেই গেছে। মেয়েটাকেও কোথায় সরিয়ে ফেলেছে শুনলাম। ওরা বলছিল, পুরানো চোরের বউ হ’লে কি হয়, দেখতে নাকি খাসা। এরকম তৈরী শিকার হাতছাড়া করবে, অত বোকা ওদের মনে করছেন কেন?

রামজীবনের কাহিনী যখন শেষ হল বেশ রাত হয়েছে।

কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেল। তারপর বললাম, আপনার চাকরিটা যে এখনও টিকে আছে দাদা, এটা যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।

উনি হেসে বললেন, টিকে আছে শুধু তোমার জন্যে।

—আমার জন্যে!

—হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে একদিন দেখা হবে বলে।

—তা মন্দ নয়। কিন্তু আমার সঙ্গে তো দেখা হল অনেক পরে। তখন যারা ছিল তারা কিছুই জানতে পারেনি?

—না। তবে পুলিশ চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কিন্তু ঐ বি ক্লাসের মুখ থেকে রক্ত বেরিয়েছিল অনেক, কথা বেরোয়নি একটাও।

বললাম, তাহলে আপনার জীবনের এই গোপন কাহিনীর আমিই কি একমাত্র শ্রোতা।

—না; আর একজন আছেন।

–কে সেই ভাগ্যবান ব্যক্তিটি জানতে পারি?

–তোমার বৌদি।

সবিস্ময়ে বললাম, বৌদি! বৌদি জানেন সব?

—হ্যাঁ।

—কি বললেন শুনে?

—কিছুই বলেননি। পরে একদিন ঐ প্রসঙ্গ তুলে আপসোস করছিলাম, বড্ড ভুল করেছি। সেদিন ওসব ছেলেমানুষি না করে কয়েদীটাকে যদি পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিতাম কিংবা কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যেতাম জেলগেটে, এতদিন প্রোমোশনও পড়ে থাকত না, চাই কি সদ্য সদ্য পুরস্কার হয়তো জুটে যেত একটা। শুনে তোমার বৌদি গম্ভীর হয়ে বললেন, “হ্যাঁ; তবে সে পুরস্কার তুমি ভোগ করতে পারতে না।” বলেছিলাম, “কেন?” “ওটা আমার শ্রাদ্ধেই খরচ হয়ে যেত।” “তার মানে?” উনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, “এ রকম কাণ্ডের পর গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া আমার অন্য কোনো পথ থাকত কি?”

আমার মুখে আর কোনো কথা যোগাল না। শুধু বললাম, আপনি ভাগ্যবান দাদা। উঠতে যাচ্ছি, কোথা থেকে ছুটে এলেন বৌদি—একি, উঠছেন যে?

—বাঃ, বাড়ি যেতে হবে না! রাত কত হল খবর রাখেন?

—আমি খবর খুবই রাখি। আপনাদের যেন হঠাৎ খেয়াল হল মনে হচ্ছে

কাছে এসে স্বর নামিয়ে বললেন, বর্ষা রাত দেখে খিচুড়ি করছিলাম।

আমি জবাব দেবার আগেই দাদা সাগ্রহে বলে উঠলেন, খিচুড়ি করেছ নাকি? বৌদির উত্তরে কৃত্রিম রোষ—হ্যাঁ। কিন্তু সে খবরে তোমার কি দরকার? তোমার বার্লি তৈরি হচ্ছে। পাঁচ মিনিট সবুর কর।

রামজীবনবাবু ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, আমাকে কি আজও বার্লি খেতে হবে? —জ্বরো মানুষ আর কি খেয়ে থাকে?

দাদা আমতা-আমতা করে বললেন, জ্বরটা যেন নেই বলেই মনে হচ্ছে। মাথাটা তো একদম ছেড়ে গেছে। দ্যাখ তো মলয়, হাতখানা।—বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।

রামবৌদির মুখে কৌতুকহাসি ফুটে উঠলো-

আমি বললাম, তা ঠিকই করেছেন। হাত দেখার কাজটা যোগ্য লোকের হাতেই দিয়েছেন দাদা। আপনার খিচুড়ি পথ্যের ব্যবস্থা আমার মতো ডাক্তার ছাড়া আর কেউ দেবে না, বলে নীরব অনুনয়ের দৃষ্টিতে বৌদির দিকে তাকালাম। উনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *