লৌহকপাট – ৪.৬

ছয়

সেকালে কবি এবং কথাশিল্পীর কাজ ছিল রাজার মনোরঞ্জন। একালেও তাই, তবে এক রাজার নয়, বহু রাজার। তখন তাঁর গুণাগুণের বিচার করত রাজ-দরবার, এখন করে জন-দরবার। এ বড় কঠিন ঠাঁই। ‘একটি শ্লোকে স্তুতি গেয়ে’ সে-’রাজার কাছে’ হয়তো কোনো নগরপ্রান্তে একখানি ‘কানন-ঘেরা বাড়ি’ ‘চেয়ে’ নেওয়া যেত। এ রাজার কাছে সে আশা দুরাশা মাত্র। বহু শ্লোকেও এঁর মন গলে না। কখনও কারও ভাগ্যে মন যদি বা গলে, হাত দিয়ে যৎকিঞ্চিৎ দক্ষিণার বেশি আর কিছু গলে না। তবে একটা জিনিস মেলে, ‘ফাংশান’ নামক নাচ-গান-হাস্য-কৌতুকের আসরে একখানি উচ্চাসন, দীর্ঘ উৎসব-সূচীর শীর্ষদেশে একটি নাম—’সভাপতি’ কিংবা ‘প্রধান অতিথি’। ঐ সঙ্গে একটি গাঁদা কিংবা রজনীগন্ধার মালা। তাও ঠিক বিনামূল্যে নয়। বিনিময়ে বিমুখ এবং যথেচ্ছ আলাপরত শ্রোতৃমণ্ডলীর শির লক্ষ্য করে একটি কঠিন বস্তু ছাড়তে হয়, তার নাম ভাষণ

দৈবক্রমে ‘লেখকে’র গদি যেদিন লাভ করলাম, তারপর থেকে ঐ আসনটিতে আমার মাঝে মাঝে ডাক পড়ে থাকে। সেই সূত্রেই একটা কোনো উপলক্ষে মফঃস্বলের যে শহরটিতে আমাকে যেতে হয়েছিল, কয়েক বছর আগে আমি ছিলাম সেখানকার বৃহৎ জেলখানার কর্ণধার। সেই বহু-পরিচিত সু-উচ্চ পাঁচিলের পাশ দিয়ে পথ। গাড়িখানা যখন একরাশ ধুলো উড়িয়ে দ্রুতবেগে তাকে ছাড়িয়ে চলে গেল, নিজের অজান্তে একবার পিছন ফিরে তাকালাম। ঐ পাষাণ-বেষ্টনীর অন্তরালে জীবনের যে অধ্যায়টা একদিন ফেলে গিয়েছিলাম, তার ভিতরকার অনেকগুলো মুখ সহসা এসে মনের দুয়ারে ভিড় করে দাঁড়াল। দেখলাম, সেখানেও বহু ধুলো জমে গেছে। কোনোটিকেই ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। অথচ সেদিন এত বড় দুনিয়া থেকে আলাদা ঐ ঘেরা জায়গাটুকুই ছিল আমার জগৎ। ওর ভিতরে জড়ো-করা একদল বিশেষ শ্রেণীর জীব নিয়েই গড়ে উঠেছিল আমার মানসলোক। তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার ছোট ও বড় বহু সমস্যা আমার ধ্যান ও কর্মের প্রায় সবখানি দখল করে রেখেছিল। মাঝখানে এই সামান্য কটা বছরের ব্যবধান, এরই মধ্যে সেখান থেকে তারা সরে গেছে, কিংবা বলা যেতে পারে, হটে গেছে। আর কিছুদিন পরে ঐ ধূলি-মলিন অস্পষ্ট কায়াগুলো হয়তো একেবারেই লুপ্ত হয়ে যাবে।

গিরীনদা বলতেন, মানুষের মন বড় অকৃতজ্ঞ। আজ যারা তার খাদ্য যোগায়, সর্বক্ষণ তাকে সঙ্গ দেয়, তার ভাবনা-অনুভূতি আনন্দ-বেদনার সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকে, দু-দিন যেতে না যেতেই তাদের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। তখন সে কোনো নতুনের প্রেমে মশগুল। কালক্রমে সে নতুনও কোথায় মিলিয়ে যায়, দেখা দেয় ‘নতুন-তর’।

সত্যিই তাই। ‘মনের’ মন পাওয়া বড় দুষ্কর। সে চির-চঞ্চল। এক আসন থেকে আরেক আসনে সতত-সঞ্চরমাণ। কারও প্রতি পক্ষপাতিত্বের বালাই নেই। মধুকর-বৃত্তিই তার ধর্ম।

‘দুই বিঘা জমি’র ভূতপূর্ব মালিক হতভাগ্য ‘উপেন’ দীর্ঘকাল পরে সন্ন্যাসী-বেশে একদিন যখন তার ‘সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ’ সেই পুরনো মাটিতে ফিরে এসে দাঁড়াল, সবিস্ময়ে চেয়ে দেখল—’কোথায় তার সে জমি। কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন।’ সেদিন ক্ষোভে, দুঃখে-বেদনায় সেই ‘নিলাজ কুলটা ভূমিকে’ সে বারংবার ধিক্কার দিয়েছিল। আমার এই মনটা কি তার চেয়ে নির্লজ্জ নয়? তবু কোনো ধিক্কারের সুর আমার কণ্ঠে বাজল না। ক্ষোভ এবং বিস্ময়ের যে সূক্ষ্ম বাষ্পজাল ক্ষণেকের তরে মনশ্চক্রবালে দেখা দিয়েছিল, তাকেও উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। নিজেকে বোঝালাম পিছনপানে না তাকিয়ে নিয়ত এগিয়ে যাওয়াই তো সজীব মনের পরিচয়। অতীতের স্মৃতিভারে নুয়ে পড়াটাই মানসিক অবক্ষয় বা ‘ডেকাসেন্সের’ লক্ষণ

সোজা হয়ে বসে সামনের দিকে তাকালাম। পশ্চাৎমুখী ঝিমিয়ে পড়া চিন্তার স্রোতকে টেনে নিয়ে এলাম আসন্ন কর্মধারার পথে। যে কাজে এসেছি, যে গৌরবময় গুরু দায়িত্ব- ভার এই মুহূর্তে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে, তারই দিকে নিজেকে সজাগ করে তুললাম।

তবু চলতে চলতে অন্তরের কোন্ কোণে কিসের একটা কাঁটা যেন খচ্ খচ্ করে বিঁধতে লাগল। যে কালো পাঁচিলটাকে পিছনে ফেলে এলাম, সে যেন সমস্ত পথটা আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলল, দূরে ঠেলে দিতে চাইলেও গেল না।

যে প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে সভাস্থলে ছুটেছি, তার সুযোগ্য সম্পাদক আমার পাশেই বসেছিলেন। এতদিন ধরে তাঁদের এখানে যা কিছু গড়ে উঠেছে, এবং আজকের এই অনুষ্ঠানের যত কিছু আয়োজন, সবই যে তাঁর একক প্রচেষ্টার ফল, সেই সম্বন্ধে একটি দীর্ঘ ধারা-বিবরণী তিনি সগর্বে এবং সবিনয়ে আমার কর্ণমূলে পরিবেশন করে চলেছিলেন। আমি কিছুই শুনছিলাম না; মাঝে মাঝে শুধু মাথা নেড়ে দু-চারটা ‘ও’, ‘আচ্ছা’ ‘তাই নাকি’ যোগ করে যাচ্ছিলাম। মাঝপথে ঐ জেলের পাঁচিলটার অলক্ষ্য অনুসরণ বোধহয় আমাকে একটু আনমনা করে দিয়ে থাকবে। সম্পাদক সেটা লক্ষ্য করলেন। কি ভাবলেন জানি না, ক্ষণেকের তরে গাড়ির বাইরে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আপনার পুরনো কর্মস্থল ফেলে এলাম, দেখে যাবেন নাকি একবার?

—কী আর দেখবো? তাছাড়া সময়ই বা কই?

—তাই তো, কাল ভোরেই যে আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে। কত কাজ আপনার। কত জায়গায় যেতে হয়। এত ব্যস্ততার মধ্যেও একটি দিনের জন্যে আপনাকে আমরা পেলাম, সেটাই আমাদের পরম সৌভাগ্য।

স্তুতিবাদটুকু উপভোগ করলেও প্রতিবাদ-সূচক একটা কি জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই গাড়িটা সভামঞ্চের গেট্‌-এ এসে থামল এবং আমাকে নামিয়ে নেবার জন্যে কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিরা চঞ্চল হয়ে উঠলেন।

তারপর যেমন হয়ে থাকে, বারকয়েক আলো নেভা ও মাইক-বিভ্রাট। তারই মধ্যে সভার কাজ শেষ হল, শুরু হল নাটক। সেটা বেশ ভালোই লাগছিল, বিশেষ করে অভিনয়, সাজ-পোশাক এবং পরিচালনার ছোটখাটো ত্রুটিগুলো—মফঃস্বলের নাটমঞ্চে ঐগুলোই বেশি উপভোগ্য, ওখানে যাঁরা নিখুঁত’-এর আশা নিয়ে যান এবং না পেলে মন খুঁত খুঁত করেন তাঁদের ঠকতে হবে। খুঁতের মধ্যেই তো রস। ড্রপটা যদি দু-একবার মাঝপথে আটকে না যায়, চন্দ্রবাবুর দাড়ি কিংবা রসিকদাদার গোঁফ যদি আগাগোড়া স্বস্থানে অটুট থাকে, অভিনেতারা মাঝে মাঝে পার্ট ভুলে গিয়ে প্রশ্টারের পানে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে না তাকায়, তাহলে আর শখের থিয়েটার দেখে সুখ কোথায়? নাট্যকলার সঙ্গে এই সব মজাদার আনুষঙ্গিকগুলোকে সমভাবে উপভোগ করতে আমার কোনোদিন বাধে না। তাই এই জাতীয় অনুষ্ঠান থেকে বরাবরই যথার্থ আনন্দ পেয়ে থাকি।

আজও পাচ্ছিলাম, এবং মনের দিক থেকে মাঝপথে উঠে পড়বার কোনো তাগিদ ছিল না। কিন্তু এদিকে যে আবার ভি. আই. পি. সেজে বসে আছি, এই সব অসার বস্তুর পিছনে মন ও সময়ের একটি ক্ষুদ্র অংশের বেশি ব্যয় করা চলে না, পদ-মর্যাদায় বাধে। একটি অঙ্ক, শেষ হতে না হতেই আশেপাশের আসনগুলো ফাঁকা হতে লাগল। বৃহৎব্যক্তিরা একে একে সবিনয়ে বিদায় নিচ্ছেন। আমিও তো সেই দলে—সুতরাং আর বসে থাকাটা শোভা পায় না।

বিয়ে-বাড়ির সাধারণ ভোজের আসরে যদু-মধুদের মধ্যে বসে অতি-বিশিষ্ট অতিথি যদি শাকভাজা থেকে মিঠে পান পর্যন্ত গোটা পর্বটা চালাতে থাকেন, সেটা তাঁর পক্ষে অতিশয় বেমানান। পেটে ক্ষিদে এবং জিভে লোভ যতই থাক, মুখে লাজ না দেখিয়ে উপায় নেই। বাড়ির কর্তাও মনে মনে তাই চান। মহামান্য অতিথিকে আলাদা কোথাও বসিয়ে গোটা দুই সন্দেশ, একটু দই এবং তার সঙ্গে প্রচুর মৌখিক আপ্যায়ন দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেন। এই সব সাংস্কৃতিক আসরের রীতিনীতিও তাই। বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত খ্যাতিমান ব্যক্তির বেলায় সংক্ষিপ্ত ভোজের ব্যবস্থা। শুধু অগ্রভাগ, বাকীটা অর্থাৎ উদ্বোধন থেকে উপসংহার পর্যন্ত বিস্তৃত যে বৃহৎ, প্রোগ্রাম, তা রইল অবৃহৎ ইতরজনের ভাগে।

অতএব উঠে পড়লাম। উঁচু মহলের উদ্যোক্তাদের মুখে খুশির আভাস ফুটে উঠল। তাঁরাও যাবার জন্যে প্রস্তুত। আগেই যেতেন, ‘প্রধান অতিথি’কে ফেলে যাওয়াটা সৌজন্যে বাধছিল। এবং অপ্রধানজনিত আচরণে ভিতরে ভিতরে হয়তো অস্বস্তি বোধ করছিলেন। নীচের মহল, অর্থাৎ যারা সাক্ষাৎভাবে জড়িত— আয়োজক, শিল্পীগোষ্ঠী, তারা মনে মনে ক্ষুণ্ণ হল, যদিও মুখে সেটা প্রকাশ করতে সাহস করল না। ‘কষ্ট করে’ এতক্ষণ যে ছিলাম, সেটাই তো তাদের পরম ভাগ্য।

সামিয়ানার বাইরে বেরোতেই অভিলাষবাবুর সঙ্গে দেখা। মুখ থেকে আপনা হতেই বেরিয়ে গেল—আপনি এখানে!

তিনি হেসে বললেন—অবাক হবার কথাই। তবে যা মনে করছেন, তা নয়, বক্তৃতা শুনতে বা নাটক দেখতে আসি নি।

—সেই কথাই ভাবছি। ওসব দুর্বলতা তো আপনার কোনো কালেই ছিল না।

—দুর্বলতা নয় স্যার, বলতে পারেন অক্ষমতা। প্রথমটা বুঝি না, দ্বিতীয়টায় রস পাই না। এসেছি প্রাণের দায়ে। আপনাকে আমার ভয়ানক দরকার।

—আমাকে!

—হ্যাঁ, আপনি যা হয়েছেন তাঁকে নয়, আপনি যা ছিলেন তাঁকে।

বুঝলাম, ভদ্রলোক আবার একটা কোনো ফ্যাসাদে পড়েছেন।

অভিলাষবাবুর সঙ্গে পরিচয় আমার অনেক দিনের। একাধিক জেলে একসঙ্গে কাজ করেছি। উনি এক ধাপ নীচে ছিলেন আমার চেয়ে। সেটা নিছক অফিস-গত সম্পর্ক। তার বাইরে আমরা বরাবর বন্ধু। অবশ্য অফিসের বাইরে ওঁকে পাওয়াই ছিল দুরূহ ব্যাপার। ঢুকতেন সকলের আগে, আর বেরোতেন সকলের পরে। বেরনো মানে গেট পেরিয়ে কয়েক পা হেঁটে বাসায় গিয়ে বসা। সেটুকুও করতো ওঁর দেহ, মন থেকে যেত গেটের ভিতরে। অর্থাৎ কয়েক ঘণ্টার জন্যে জেল ছেড়ে এলেও জেল ওঁকে ছাড়ত না, সিন্ধবাদ হয়ে ঘাড়ের উপর চেপে বসে থাকত। ভদ্রলোকের চিন্তা-ভাবনা আলাপ-আলোচনার পরিধিটাকে তার চার দেয়ালের বাইরে বড় একটা যেতে দিত না, গেলেও তখনি আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসত।

নিজের সংসারের সঙ্গে অভিলাষবাবুর সম্পর্ক ছিল একমাত্র আর্থিক। সেটা চুকে যেত প্রতিমাসের পয়লা তারিখে—মাইনের টাকা কটি যখন স্ত্রীর হাতে এনে দিতেন। – বাকী যা কিছু, তার সব ভার ভদ্রমহিলা একাই বহন করতেন। না পারলে বা কোনোখানে আটকে গেলে স্বামীকে কখনও ঘাঁটাতেন না, জানতেন সেটা বৃথা—তাঁর সহকর্মীদের সাহায্য নিতেন। সেই সূত্রে ওদের পারিবারিক জটিলতার জট ছাড়াতে মাঝে মাঝে আমার ডাক পড়ত।

একদিনের একটি ছোট্ট ঘটনা মনে পড়ছে। সকালে অফিস যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, অভিলাষবাবুর আট বছরের মেয়ে পুঁটি এল ছুটতে ছুটতে। কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই গম্ভীর মুখ করে চুপি চুপি খবর দিল, ‘দাদা কাল বাড়ি আসে নি। মা বললে, তোর জ্যাঠামশাইকে বলে আয়। আর—’

পরের অংশটুকু আন্দাজে বুঝে নিয়ে বললাম—মাকে গিয়ে বল, আমি যাবার সময় দেখা করে যাব।

মাঝে মাঝে বাড়ি না-ফেরার পালা এই ‘দাদাটির পক্ষে নতুন নয়। সম্প্রতি যে পথ সে ধরেছিল, সেখানেও তাকে একা বলা চলে না। আশেপাশের বাড়িগুলো খুঁজলে কৈশোর থেকে যৌবনের প্রথমাঙ্কে যারা পা দিয়েছে, তাদের মধ্যে ঐ রকম ‘দাদা’ বেশ কয়েকটি পাওয়া যাবে। কেউ প্রকাশ্য, কেউ প্রচ্ছন্ন। কেউ একটু বেশি এগিয়ে গেছে, কেউ ততটা পেরে ওঠে নি। মৌলিক কারণটা প্রায় সাধারণ, অর্থাৎ সকলের বেলাতেই মোটামুটি এক।

জেলের মাটিতে, অর্থাৎ তাকে কেন্দ্র করে তৈরি যে উপনিবেশ, যার সরকারী আখ্যা জেল-কোয়ার্টার্স, সেইখানে ওদের জন্ম। জন্মাবার পরেই যে বাতাসে ওরা নিঃশ্বাস নেয়, বিশেষ অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখলে ধরা পড়বে, তার মধ্যে এক ধরনের বিষাক্ত বীজাণু ভেসে বেড়াচ্ছে। তারা আকারে ছোটবড়, প্রকারেও বহুবিধ, সমষ্টিগত নাম ‘ক্রাইম’। সংক্রমণের দিক থেকে যক্ষ্মা বা বসন্তের চেয়ে কিছুমাত্র কম মারাত্মক নয়। কারণ এদের আক্রমণ দেহস্তরে নয়, দেহকে ভেদ করে পৌঁছে যায় মনের মজ্জায়, বাসা বাঁধে চরিত্রের অস্থিমূলে। সেই বিষে যারা আক্রান্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে জর্জর, তেমনি একদল মসিচিহ্নিত প্রাণীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ও সংস্পর্শে ওখানকার ছেলেমেয়েগুলো মানুষ হয় অর্থাৎ বেড়ে ওঠে। কী হয়, সে কথা অনুক্ত থাকাই বাঞ্ছনীয়।

প্রশ্ন উঠবে—অতবড় পাঁচিল পেরিয়ে সংস্পর্শটা ঘটে কেমন করে? নানা ভাবে ঘটে। এক নম্বর—অলক্ষ্যে, মনস্তরে। নিজেদের অজ্ঞাতে ঐ ‘দাদাদের’ বাবা-কাকারাই জেল- ফটক থেকে প্রতি নির্গমে বীজাণুগুলো বয়ে নিয়ে আসেন এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিক প্রবণতা, আলাপ-আলোচনা, অভ্যাস ও আচার-আচরণের ভিতর দিয়ে সেই বিষ অন্তঃপুরে সঞ্চারিত হয়। বেচারা বাবা-কাকাদের দোষ দেওয়া যায় না। জেলকে ঘিরেই তাঁদের জীবন। সৌরমণ্ডলের কেন্দ্র ঐ কালো পাঁচিল এবং তার ভিতরকার জীবনধারা, তাঁরা হলেন গ্রহ-উপগ্রহ। পরিক্রমার বিরাম নেই। সূর্যোদয়ের বহু আগে শুরু, সূর্যাস্তের বহু পরে শেষ। মাঝখানে কিছুক্ষণ মাধ্যাহ্নিক বিরতি। তাও নির্বিঘ্ন বা নিরবচ্ছিন্ন নয়।

‘বেলা দ্বিপ্রহরে’ বাসায় ফিরে ধড়া-চূড়া ছেড়ে সবে দু-মগ জল মাথায় ঢেলেছেন কি ঢালেন নি, দরজার ওপার থেকে ফেটে পড়ল ‘গেট ফালতুর’ পরিচিত কণ্ঠ—’কাছারি সে টেলিফুক আয়া হুজুর’; কিংবা তার চেয়েও মারাত্মক মেসেজ—’একঠো ভিজিটর বাবু অফিসমে বৈঠল বা। অর্থাৎ তখনি আবার ছুটতে হবে। ভিজিটরবাবুকে বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখলে চাকরি নিয়ে টানাটানি।

‘রাত্রি দ্বিপ্রহরেও’ নিস্তার নেই। গাঢ় নিদ্রার নাসিকা গর্জন থমকে থেমে যাবে নাইট ডিউটি দেশোয়ালী জমাদারের বাঁজখাই গলার জরুরী আহ্বানে—’ডিভিজন সে বিশঠো আসামী চালান আয়া, জলদি আইয়ে।’ রাত দশটায় ট্রেন থেকে নেমেছে তারা। তিন মাইল পথ হাঁটিয়ে নিয়ে জেল-গেটে পৌঁছতে বারোটা তো বাজবেই।’ ছোট সাব ডিভিশনের এক-কামরাওয়ালা জেল। অত লোকের জায়গা নেই। কোর্ট থেকে আসা মাত্র রওনা করে দিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট কিংবা সেন্ট্রাল জেলে। ওয়ারেন্ট ইত্যাদি পরীক্ষা না করে ‘রিসিভ’ করা যাবে না। অতএব ‘বোলাও ডেপুটিবাবুকো’। কেননা এটা ডেপুটি জেলারের বিশেষ দায়িত্ব। রামের বদলে শ্যাম এল কিনা, দলিলপত্র ঠিক আছে কিনা—সব দেখেশুনে নিতে হবে তাঁকেই।

বন্দিশালার পরিধির বাইরেও যে একটা বিস্তীর্ণ জগৎ আছে, সেখানকার অতি সামান্য সাড়াই এদের কানে এসে পৌঁছায়। সব অকর্ষণ সব যোগাযোগ থেকে হাত, পা, চোখ, কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গুলো গুটিয়ে এনে এরা কর্মের মতো আত্মনিবদ্ধ। তারই মতো শ্লথগতি। একটা সুনির্দিষ্ট সংকীর্ণ পথ ধরে গুটি গুটি যাওয়া এবং আসার মধ্যেই দৈনন্দিন জীবন সীমাবদ্ধ। প্রাত্যহিক চিন্তাধারা এবং পারিবারিক কথাবার্তার বিষয়বস্তু যে সেই চিহ্নিত সীমাকে ছাড়িয়ে যাবে, তার সম্ভাবনা কোথায়? এদের যারা বংশধর, তারাও ঐ আবহাওয়ার ভিতরে বসে ঐভাবেই ভাবান্বিত হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্য কি?

দু-নম্বর সংযোগটা আরও স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ। সেখানে জীবাণুবহনের বাহন হল ‘জলভরি দফা’ নামক কয়েদীযূথ, জেল-কোড়-এর পরিভাষায় ‘ওয়াটার-ক্যারিং গ্যাঙ্’। নেহাৎ ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই তার সৃষ্টি। সেই ইতিহাসটুকু সংক্ষেপে ব্যক্ত করা যাক।

ইংরেজরাজ যখন জিলায় জিলায় ফৌজদারী আদালতের পত্তন করলেন, তার পিছনে একটা করে জেলও জুড়ে দিতে হল। দুয়ের মধ্যে সম্পর্কটা অঙ্গাঙ্গী হলেও, অবস্থানটা ঠিক পাশাপাশি হল না। জেল মানে বৃহৎ ব্যাপার। অনেক লোকের স্থায়ী আস্তানা, অর্থাৎ বড় বড় ব্যারাক, তাদের খাবার-দাবার, কাপড়চোপড়ের গুদাম, কাজ করবার খাটনী ঘর, হাসপাতাল এবং অনেক কিছু। এই গেল এক দিক। আরেক দিকে এই সব বিশেষ ব্যক্তিদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং খবরদারির আয়োজনটাও কম বিপুল নয়। সেখানেও অনেক লোকের সমাবেশ। সাধারণ রক্ষী থেকে মুখ্য শাসক, মাঝখানে নানা স্তর এবং বিবিধ শ্রেণী। কারাগার এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্যে পরিচালক-গোষ্ঠীর সর্বক্ষণের সান্নিধ্য প্রয়োজন। অর্থাৎ ‘জেল’ মানে শুধু বন্দিশালা নয়, তার চারদিক ঘিরে তার রক্ষক, পালক ও তদন্তকারীদের ছোট-বড় বাসস্থান। সব মিলিয়ে একটি নাতিবৃহৎ জনপদ। তার জন্যে জায়গা চাই, শহর যা দিতে অক্ষম, তাই কোর্টের পাশে, শহরের মধ্যে তার থাকা চলে না, সরে যেতে হল উপকণ্ঠে।

যে কোন বসতির প্রাথমিক প্রয়োজন জল। শহরে তার যোগান দেয় মিউনিসিপ্যালিটি। আজকের দিনে কোথাও কোথাও শহরতলীর ভারও সে নিয়ে থাকে। কিন্তু তখনকার দিনে শহরের বাইরে, বিশেষ করে জেলখানার মতো বৃহৎ গোষ্ঠীর রাক্ষুসে পিপাসা মেটাবার মতো সামর্থ্য কোনো পৌরসংস্থার ছিল না। জেলকে তাই পুকুর কেটে, পাতকুয়ো খুঁড়ে নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়েছিল। আভ্যন্তরীণ সরবরাহে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় নি। পাঁচিলের মধ্যে জনবলের অভাব ছিল না। কিন্তু মুশকিল দেখা দিল বাইরে। সেখানেও প্রয়োজনের পরিমাণ প্রচুর। সেটা নলকূপের যুগ নয়, তাহলে হয়তো এখানে সেখানে তারই গোটাকয়েক বসিয়ে দিয়ে কাজ চলে যেত। কিন্তু অনেকখানি দূরে একটা বা দুটো পাতকুয়ো থেকে পারিবারিক চাহিদামত জল-সংগ্রহের ব্যাপারটা কর্মীদের পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়াল। বাধ্য হয়ে সরকারই তার সুরাহা করে দিলেন। জেলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একদল জাঙ্গিয়া-কুর্তা-পরা ‘পানি-পাঁড়ে’। ঘরে ঘরে জলদানের পুণ্য কর্মটি তাদের ‘রিগারাস ইমপ্রিজনমেন্ট’ অর্থাৎ কঠোর কারাদণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হল। যে-সব কয়েদীর মেয়াদ এক বছর বা তার চেয়ে কম, কিংবা দীর্ঘতর-মেয়াদী হলেও ওর বেশি যাদের বাকী নেই, তাদের ভিতর থেকে বেছে বেছে তৈরী হল ‘একস্ট্রা-মিউরাল গ্যাঙ’, অর্থাৎ প্রয়োজনমত তারা প্রাচীরের বাইরে যাবার অধিকারী। অতঃপর তারা পায়ে একটা করে লোহার মল পরে দলবদ্ধভাবে একজন সিপাই-এর জিম্মায় গেটের বাইরে জেলবাবুদের বাসায় বাসায় জল যোগাতে লাগল। ইংরেজি নামটা রইল খাতাপত্রে। সম্ভবত ঐ সিপাইরাই ওদের নতুন নামকরণ করল—’জলভরি’ বা ‘পানি-দফা’। কড়া আদেশ জারি হল—গোটা গ্যাঙটাকে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি ‘মার্চ’ করিয়ে নিয়ে যেতে হবে, কেউ কখনও কোনো অবস্থাতেই যূথভ্রষ্ট হতে পারবে না। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট কয়েদী তো বটেই, ভারপ্রাপ্ত সিপাইও দণ্ডনীয়।

এই ব্যবস্থা যেদিন প্রবর্তিত হল, তারপর দীর্ঘকাল চলে গেল, প্রায় সবখানেই শহর বেড়ে বেড়ে জেলকে তার আওতার মধ্যে নিয়ে এসেছে এবং তার জল সরবরাহের দায়িত্ব ক্রমে ক্রমে চলে গেছে মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষের হাতে। কোথাও কোথাও জেল- পল্লীর বাসায় বাসায় পাইপ বসে গেছে। কল ঘোরালেই জল। দূর থেকে বয়ে আনবার প্রয়োজন নেই। তবু ‘জলভরি’ রয়ে গেছে; যদিও জল আর তারা ভরে না। লম্বা কালো বড় বড় লৌহ-পিপার আংটায় বাঁশ চালিয়ে জোড়ায় জোড়ায় গোটা দলটা এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি মার্চ করে চলেছে—এই বহু পুরাতন দৃশ্যটি আর চোখে পড়ে না। গেট পর্যন্ত অটুট গ্যাঙ, বেরিয়েই দুজন একজন করে ছড়িয়ে পড়ে বাসায় বাসায়। কে কোন্ বাসার কয়েদী তাও ঠিক করা আছে। সেখানে তাদের অনেক কাজ। বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, বিছানা করা, আসবাবপত্তর ঝাড়া মোছা, রান্নাবান্নার যোগাড় দেওয়া এবং গৃহিণী যখন অন্যত্র আটকা থাকেন, তাঁর কচি শিশুটিকে আগলে রাখা। অনুগত গৃহভৃত্য, কিন্তু অবৈতনিক। সেদিক থেকে গৃহস্থ হয়তো কিঞ্চিৎ লাভবান, কিন্তু অলক্ষ্যে অগোচরে যে লোকসান ঘটে চলেছে, তার পরিমাণ ঐ ‘লাভে’র চেয়ে অনেক বেশি। সেটি হচ্ছে বহু নিষ্পাপ অপরিণত মনে ‘ক্রাইম’ নামক সংক্রামক ব্যাধির অনুপ্রবেশ। যেজন্যে জলভরি দফার সৃষ্টি হয়েছিল, সে দরকার মিটে গেছে। জলের বদলে আজ তারা জেলবাবুদের ঘরে ঘরে বিষ ভরে দেয়। শুরুটা প্রায়ই সামান্য। বারো বছরের ছেলের পকেটে হঠাৎ গোটা দুই সিগারেটের অবির্ভাব, তার সদ্য-যৌবন-প্রাপ্তা দিদির আঁচলে এক টুকরো উচ্ছ্বাসময় চিঠির আবিষ্কার কিংবা তাদের বাবার ব্যাগ থেকে কয়েক আনা পয়সার অন্তর্ধান। কোনোটারই হয়তো কোনো নিজস্ব গুরুত্ব নেই। বিচলিত হবার মতো কিছু নয়। কিন্তু এই তুচ্ছ সূচনাই বড় হয়ে হয়ে একদিন অনেক পরিবারের মূল ধরে নাড়া দিয়েছে, সে দৃশ্য আমি নিজের চোখে দেখেছি। অপরাধ ও অধঃপতনের পথ বড় মসৃণ। তার প্রথম ধাপগুলো আপাত-রমণীয় প্রলোভনের রঙে রঙিন। একটি বিশেষ বয়সের কাছে তাদের নিয়ত হাতছানি প্রায় অপ্রতিরোধ্য। অভিলাষবাবুর ছেলের মতো আরও কত ছেলে তার টানে ভেসে চলে গেছে, কে তার খবর রাখে?

এমনি একটি ‘ছেলের’—সম্ভবত তখন আর সে ‘ছেলে’ নেই—একখানি চিঠি আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। ‘লৌহকপাট’-এর অর্গল খুলে দিয়ে সবে তখন কারা- শাসক থেকে লেখকের পদে উন্নীত হয়েছি। অভিনন্দনের স্রোত বইছে। সকালের ডাক খুলতেই মধুস্রাবী ভাষায় রাশি রাশি মনোরম প্রশস্তি :-”আপনার দরদী মনের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলাম”, “আপনি অমানুষের ভিতরে মানুষের সন্ধান পেয়েছেন”, “সমাজের নীচের তলায় যুগ যুগ ধরে যারা মূক হয়ে ছিল, আপনি তাদের কণ্ঠে ভাষা দিয়েছেন” ইত্যাদি ইত্যাদি। একদিন একখানা অচেনা হাতের একপাতা চিঠির প্রথম কয়েক লাইনে চোখ বুলিয়েই প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। ক্ষুদ্র একটা ‘অন্তর্দেশীয়ের’ অন্তরে এত বড় মুষল লুকানো ছিল, কে ভেবেছিল?

চিঠিখানা আমার কাছে নেই। হুবহু প্রতিলিপি দিতে পারছি না। সুর এবং উক্তি অনেকটা এই রকম—রাস্তার মোড়ে যখন চোর ধরা পড়ে, তার কপালে জোটে পাইকারী মার। সত্যি চোর কিনা, কী চুরি করল, সেটুকুও কেউ ভেবে দেখে না। সেই লোকটাই যখন জেলে যায়, তাকে দেখে লোকে আহা-উহু করে, তখন সে কয়েদী—বন্দী। বন্দীর জন্যে মানুষের কত দরদ, কত চোখের জল! তার কারণ বুঝি। তারা যে কী ভয়ঙ্কর চীজ, সাধারণ লোকে জানে না। কিন্তু আপনি? আপনি তো জানেন, কতজনের কত সর্বনাশ করে তারা জেলে আসে। আসবার পরে যে সর্বনাশ করে, তা-ও আপনি দেখেছেন নিশ্চয়। ‘জেলখানার ছেলে’ বলে যে একটা আলাদা জাত আছে, তা কি আপনি শোনেন নি? তাদের ছোঁয়াচ পাছে নিজেদের ছেলেপিলের গায়ে লাগে, আশেপাশের ভদ্রলোকেরা সেই ভয়ে সজাগ, তাও আপনার চোখে না পড়বার কথা নয়। কিন্তু কেন তারা ‘মন্দ’ ছাপ মেখে গোড়া থেকেই ‘মন্দের’ পথ ধরে, সে খবরটা বাইরের লোকে না জানতে পারে, আপনিও কি না জানবার ভান করছেন? তা যদি না হবে, সেই সত্যি কথাটা স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করবার বাধা কোথায়? হয়তো সে সাহস আপনার নেই। কিংবা হয়তো মনে করছেন, তাতে করে বাহবা পাবার সুবিধা নেই। তাই জেলখানার চোর-ডাকাত, গুণ্ডা- বদমাশের কল্পিত দুঃখের বানানো কাহিনী দিয়ে আসর মাত করছেন, তারই হাতার মধ্যে বসে শুধু সেই কারণেই যারা মানুষ হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল, সেই হতভাগাদের ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেছেন।

বলা বাহুল্য, এই চিঠি পড়ে সেদিন বিরক্ত হয়েছিলাম। আত্মপ্রসাদের মোহে মন ছিল আচ্ছন্ন, তাই ভক্ত পাঠকের অতিরঞ্জিত স্তুতিবাদকেই আমার ন্যায্য পুরস্কার বলে ধরে নিয়েছিলাম। সেই স্পষ্ট-ভাষণকে মনে হয়েছিল রুষ্ট পাঠকের অন্যায় তিরস্কার। ধাতস্থ হবার পরে বুঝেছি—না, ওটা আমার প্রাপ্য ছিল।

একটা কথা সেই প্রথম জীবনে মনে হত, আজও হয়,—সরকারের কাছে তার প্রশাসনিক প্রয়োজনটাই আসল, যার কাছে মানুষের স্বার্থ ও ভালমন্দ অনায়াসে বলি দেওয়া যায়। তা যদি না হবে, জেল-পাঁচিলের চারদিক ঘিরে তার কর্মী-উপনিবেশ গড়া হত না। যক্ষ্মা বা বসন্ত হাসপাতালের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের তো কই তার হাতার মধ্যে মাথা গুঁজে পড়ে থাকতে বাধ্য করা হয় না। সংক্রমণের হাত এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে বাস করবার অধিকার সেখানে স্বীকৃত। সে অধিকার নেই শুধু কারা-কর্মীর। তার কারণ এ নয় যে, কারাগার নামক যে ক্রাইম-হাসপাতাল, তার সংক্রামকশক্তি ঐসব হাসপাতালের চেয়ে কিছুমাত্র কম, কিংবা সেটা কর্তৃপক্ষের অগোচর। তার কারণ, এখানে নিরাপত্তার রূপ আলাদা।

সেফটি নয়, সেফ্ কাস্টডি। শাসকের চেয়ে শাসিতের স্বার্থ বড়। তাদের জন্যেই দুর্ভাবনা। তাদের আগলে রাখা, আটকে রাখা—তারই প্রয়োজনে ইঁটের প্রাচীরের চারদিকে আবার মানুষের বেড়া। বিভিন্ন স্তরের মানুষ—অতবড় যন্ত্রটাকে চালাবার জন্যে যে সব রকম যন্ত্রীর দরকার—বেটন-ধারী, বন্দুক-ধারী তো বটেই, তার সঙ্গে ছোট-বড় কলম-ধারী। প্রথম দলের কিছু এবং শেষের দলের প্রায় সকলেই থাকে সপরিবারে। সরকারী দাক্ষিণ্যে ভাড়া দিতে হয় না। বরং কিছু উপরি-পাওনা আছে, আর্থিক নয়, সেবারূপী পাওনা, ইংরেজীতে যাকে বলে ‘স্যারভিসেজ’—অর্থাৎ ঐ ‘ওয়াটার-ক্যারিং গ্যাঙ’। তার আসল রূপটা যে কী, সে ‘লাভে’র কতটা যে ‘ক্ষতি’র ঘরে জমা হচ্ছে, তার হিসাব ওখানকার বাবুদের খাতায় হয়তো পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে তাঁদের কোনো কোনো পুত্র-কন্যার ভবিষ্যতের পাতায়। তারই একখানা একদিন পত্রাঘাতের আকার নিয়ে আমার কাছে এসে পড়েছিল, এইমাত্র যার উল্লেখ করেছি, আরও অনেক আমার আগে থাকতেই জানা।

পুঁটির মা আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। গিয়েই শুনলাম, এযাত্রায় তাঁর শ্রীমানটি একটু বেশি এগিয়ে গেছেন, অর্থাৎ জনকয়েক বন্ধুর সঙ্গে গতরাত্রে জেলে এসে গেছেন। কোনো সূত্রে ভোরবেলাতেই তার কাছে খবর পৌঁছে গেছে। ‘সূত্রটি’ যে তাঁর স্বামী নন, জিজ্ঞাসা না করেই বুঝলাম। অথচ অভিলাষবাবুই তখন ‘আমদানী সেরেস্তার ভারপ্রাপ্ত অফিসার। সারাদিন ধরে যারা জেলে এল—হাজত বা কয়েদী—সন্ধ্যার পর তাদের সব ওয়ারেন্ট তাঁকে পরীক্ষা করতে হয়, এবং অ্যাডমিশন রেজিস্টার-নামক একটি বিশাল খাতায় তাদের নাম, ধাম, বিবরণের লম্বা ফিরিস্তি মিলিয়ে নিয়ে শেষ পংক্তিতে সই দিতে হয়। মেলাতে গিয়ে—ইংরেজীতে যাকে বলে চেক করা— অভিলাষবাবু ওয়ারেন্ট এবং খাতার বুকে এমন সজোরে এবং লম্বা হাতে পেন্সিল চালিয়ে থাকেন—যে তাঁর ‘কাজে’র সঙ্গে যাদের পরিচয় নেই, তাদের মনে হবে সব কেটে-কুটে দেওয়া হয়েছে। একবার এক নতুন শ্বেতাঙ্গ জেল-সুপার ক্ষত-বিক্ষত খাতার দিকে চেয়ে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন—ইজ্ দিস্ অল রঙ্গ (wrong)?

অভিলাষবাবু ততোধিক বিস্ময়ে জবাব দিলেন, নো স্যার!

—দেন হোয়াই ক্রস্‌ড্ আউট?

এবার লজ্জিত হলেন অভিলাষ মজুমদার। মাথা চুলকে বললেন, আই হ্যাভ্ থরোলি চেক্‌ দা এন্‌ট্রিজ।

অফিসে পৌঁছেই আগের দিনের ওয়ারেন্ট-গুচ্ছের ভিতর থেকে যথারীতি পেন্সিলাহত ‘দীপঙ্কর মজুমদার’-কে টেনে বার করলাম। অভিলাষবাবুকে ডেকে দেখাতেই তিনি প্রথমটা কিছু বুঝতে পারলেন না, আর একটু নজর দিয়েই চমকে উঠলেন— ‘গুলে’! তারপর কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়েই বললেন, ও হতভাগার যে ঐরকম একটা পোষাকী নাম আছে, খেয়াল ছিল না।

—তবে বাপের নামটা দেখেও মনে পড়ে নি?

—যে ঝঞ্ছাটে আছি, নিজের বাপের নামই খেয়াল থাকে না, স্যার তো, এ তো ছেলের বাপের নাম।

বলেই ছুটতে ছুটতে চলে গেলেন নিজের টেবিলে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে তাঁর করণীয় কিছু নেই। ছেলের জেলে-আসার চেয়েও তাঁর কাছে বড় তাঁর জেলের ‘ঝঞ্ঝাট’।

অভিলাষবাবুর ‘ঝঞ্ঝাট’ প্রায় বারো মাসই লেগে থাকত, এবং তার বেশির ভাগ তাঁর নিজের তৈরি। দু-একটার উল্লেখ না করে পারছি না।

জেলের কয়েদী বা হাজতী আসামীদের সঙ্গে দেখা করতে হলে দরখাস্ত চাই। গেটের সামনে একটি করে বাক্স বসানো থাকে, দরখাস্ত-সংগ্রহের জন্যে, কোনো ফী দিতে হয় না। কিন্তু কোনো কোনো জেলে টহলদার সিপাইরা দর্শনপ্রার্থী জনসাধারণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কিঞ্চিৎ বেসরকারী ফী আদায় করে থাকেন। খবরটা উপর-মহলের অজানা নয়, কিন্তু এই দু-চার-আনার দস্তুরি নিয়ে কাউকে বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখা যায় নি। অভিলাষবাবু হঠাৎ এই দুর্নীতি দমনে তৎপর হয়ে উঠলেন। মস্ত বড় সাইনবোর্ড পড়ল জেলের সামনে—’দেখা করিতে পয়সা লাগে না। কেহ পয়সা চাহিলে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষের নজরে আনুন।

দিন কয়েক পরে দেখা গেল, রাতের অন্ধকারে ‘সাইনবোর্ড’ লোপাট। সান্ত্রীদের নিয়ে কদিন টানা-হেঁচড়া করলেন অভিলাষবাবু। কাউকে শাস্তি দেওয়া গেল না। সবাই বলল, দুর্ঘটনাটা তার ডিউটিতে ঘটে নি। নতুন সাইনবোর্ড টাঙানো হল এবং তার উপরে কড়া পাহারার ব্যবস্থা। ‘মোলাকাতি দস্তুরি’ সম্বন্ধেও কড়াকড়ি শুরু করলেন অভিলাষবাবু।

কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে নানা রকম দুর্নীতির ফিরিস্তি দিয়ে একেবারে খোদকর্তার বরাবর ঘন ঘন বেনামা দরখাস্ত পড়তে লাগল। তলায় তলায় গোপন তদন্তও চলল তার সঙ্গে। অভিলাষবাবু তখন ‘ওয়ার্ডার গার্ড’ নামক শাখার অফিসার-ইন-চার্জ। সিপাইদের ছুটির আবেদন, এবং তার বিলি—ব্যবস্থা ইত্যাদি তাঁর সেরেস্তার অন্তর্ভুক্ত। একদিন ‘কায়থি’ হরফে নাম লেখা একখানা খামের চিঠি এল জেলের ঠিকানায়। চিঠিপত্র বিভাগের কেরানী সেটা পড়তে না পেরে বড়সাহেবের কাছে নিয়ে গেল। হাতের লেখা দেহাতী কায়থিতে তাঁর কিঞ্চিৎ দখল ছিল। শিরোনামটা ভাল করে না দেখেই খুলে ফেললেন, এবং কোনোরকমে পাঠোদ্ধার করে সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

চিঠিখানা অভিলাষবাবুকে লেখা। লিখছে একজন সিপাই। ছুটিতে দেশে আছে, সেটা আরও কিছুদিন বাড়ানো দরকার।

সকাতর প্রার্থনা জানিয়েছে, ‘বাবু’ যদি মেহেরবানি করে সাহেবকে বলে ছুটির ব্যবস্থা করে দেন, তাঁর ‘পান খাবার’ যথারীতি ব্যবস্থাও সে ফিরে এসেই করবে। সে বিষয়ে কোন অন্যথা হবে না। সাহেব চিঠিখানা চেপে গেলেন, যদিও আগেকার কতগুলো বেনামী অভিযোগের সঙ্গে এটাকে যুক্ত করে তাঁর মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহের ছায়া পড়ল। কদিন পরে ঠিক ঐ ধরনের আরেকখানা চিঠি আসতেই সেটা গাঢ়তর হল। তার পরেই নিতান্ত অসময়ে অভিলাষবাবুর বদলির হুকুম। অনেক অসুবিধা ছিল, রদ করবার চেষ্টা করলেন—। হল না।

ব্যাপারটা আমি জানতাম। ওর সঙ্গে এ-ও জানতাম, ‘পান-খাওয়া’ নামক ব্যাধি থেকে অভিলাষবাবু সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। সবটাই সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। দুর্নীতি-উচ্ছেদ- কল্পে তাঁর অতিরিক্ত উৎসাহের ফল, স্বেচ্ছা-আমন্ত্রিত ফ্যাসাদ।

মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছি। এবার ফেরা যাক।

সভাস্থল থেকে বেরিয়ে অভিলাষবাবুর মুখে যখন শুনলাম, তিনি আমার সাহায্যপ্রার্থী, দীর্ঘকাল পরে হলেও প্রথমেই মনে হল, তিনি হয়তো আবার কোনো স্ব-রচিত ‘ঝঞ্ঝাটে র কবলে পড়ে থাকবেন। আমার প্রোগ্রাম বদলাতে হল। পরদিন সকালে স্টেশনের বদলে হাজির হলাম জেলখানায়। গিয়ে বুঝলাম, না এলেই ভালো ছিল। অভিলাষবাবুর প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে বিনা প্রয়োজনে আর একটা নির্মম কঠোর জীবন্ত সত্যের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে হবে কে ভেবেছিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *