লৌহকপাট – ৩.৪

চার

“যতই বলুন, one cannot go against Nature. রক্তমাংসের ধর্মটাও ধর্ম।” বলতে বলতে অফিসের পরদা ঠেলে বেশ খানিকটা উত্তেজিত ভঙ্গীতে ঢুকে পড়লেন ডাক্তার সাহেব। একটা নারী-ঘটিত মামলার রায় পড়ছিলাম। বন্ধ করে বললাম, কী হল আবার? কার কথা বলছেন?

—ঐ যে আপনার নিত্যানন্দ না কী নাম! দিন, দেশলাই দিন।

দেশলাইটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, নিত্যানন্দ নয়, সদানন্দ; ব্রহ্মচারী সদানন্দ। এই দেখুন, কত বড় জাজমেন্ট।

—আপনি দেখুন। ও-সব আমার অনেক দেখা আছে।

একটা চেয়ার টেনে বসে গোটা তিনেক কাঠি পুড়িয়ে সিগারেট ধরালেন ডাক্তার সাহেব। লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে খানিকটা ঠাণ্ডা হয়ে নিয়ে বললেন, আসল ব্যাপারটা কী বলুন তো?

—ব্যাপার রীতিমত জটিল। সারাজীবন ব্রহ্মচর্য করে, বুড়ো বয়সে একটা ঝিয়ের সঙ্গে-

—এর মধ্যে ‘জটিল’ কী দেখলেন। আমি তো দেখছি simple biological case । সেই কথাই বলছিলাম। সাধু-সন্ন্যাসীরা বলেন, নারী নরকের দ্বার। বেশ, মানলাম। কিন্তু আপনার দেহে রক্ত-মাংস যতক্ষণ আছে, ঐ দ্বারটি এড়াবার উপায় আছে কি? ব্রহ্মচর্যই করুন, আর গেরুয়াই ধরুন, ঘুরেফিরে ঐখানে এসেই হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে। সাপুড়েদের দেখেছেন তো? যতই সাবধান হোক, একদিন ঐ সাপের হাতেই প্রাণ দিতে হয়। তেমনি বড় বড় শিকারীর শেষ গতি হল বাঘের পেট।

—উপমাটা যে উলটো হল ডাক্তার সাহেব! সাপুড়ে আর শিকারীদের কারবারই হল ঐ নাগিনী-বাঘিনী নিয়ে। কিন্তু এঁরা যে স্ত্রী-জাতির ছায়াও মাড়ান না।

—আরে মশাই, ছায়া মাড়ান না বলেই কায়ার ঠেলা সামলাতে পারেন না। যাকে আমি কামনা করি, তাকে যখন হাতের কাছে পাই, তার জন্যে লোভ বলুন, হঠাৎ বাসনা বলুন, হঠাৎ উগ্র হবার সুযোগ পায় না। কিন্তু সে যখন বেড়ায় আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে কোনও বাঁধ, হোক না সে আমার নিজের হাতে তৈরী, তখন আমাকে আর মোহ-মুদ্‌গর মেরে ঠেকানো যায় না; তখনই আসে ঐ বাঁধ- ভাঙার উন্মাদনা, যার চেয়ে মারাত্মক জিনিস আর কিছু নেই।

আমি মৃদু হেসে বললাম, আছে।

—কী বলুন।

—ডাক্তার যখন ছুরি ফেলে ফিলজফি ধরে।

—ওঃ হো! ঠিক কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। চারটে অপারেশন আছে। দুটো তার মধ্যে বেশ গোলমেলে। পালাই।— বলে লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন ডাক্তার সাহেব।

বললাম, কী রকম দেখলেন বলুন।

—কী রকম আবার? তিন দিন হয়ে গেল। ঐ তো শরীর। একদম নেতিয়ে পড়েছে। কাল সকাল থেকেই নাকে নল চালিয়ে দুধ ঢালতে হবে। তাই বলে এলাম ডাক্তারকে।

—বলেন কী! তা হলে আমার কাজটা তো আজই সেরে নেওয়া দরকার।

—আপনার আবার কী কাজ?

—একটা হুমকি দিতে হবে, “অবিলম্বে হাঙ্গার স্ট্রাইক প্রত্যাহার না করিলে তোমাকে ফৌজদারী সোপর্দ করা হইবেক।”

—হুমকি দিতে হয় দিন, কিন্তু যা চীজ দেখলাম, বিশেষ কাজ হইবেক বলে তো মনে হয় না।

তবু ঐ হুমকি অর্থাৎ আইনানুসারে যথারীতি ওয়ার্নিং দেবার জন্যে সদলবলে হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ঠিকই বলেছেন ডাক্তার সাহেব। ব্রহ্মচারীর ক্ষীণ দেহ ক্ষীণতর হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। দিন তিনেক আগে নারী-ধর্ষণ মামলায় পাঁচ বছরের মেয়াদ নিয়ে তিনি আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। তারপর থেকে আর জলগ্রহণ করেন নি। অর্থাৎ জল ছাড়া আর কিছু গ্রহণ করেন নি। কিসের জন্যে তাঁর এই কঠোর অনশন, বার বার প্রশ্ন করেও জানা যায় নি। এইটুকু জানিয়েছেন, এটা তাঁর হাঙ্গার স্ট্রাইক বা প্রায়োপবেশন নয়, কারও বিরুদ্ধে তাঁর কোন ক্ষোভ বা অভিযোগ নেই। তবু আর একবার ঐ একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম। উনি ম্লান হেসে বললেন, জবাব তো আমি আগেই দিয়েছি স্যার। কারণটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত।

—কিন্তু আপনি যাকে ব্যক্তি বলছেন, জেলে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি গত হয়েছেন। এখানে ব্যক্তিগত বলে আপনার কিছু নেই।

ব্রহ্মচারী চুপ করে রইলেন। আমি আর একটু পরিষ্কার করে বললাম, আপনার দেহ মন দুই-ই এখন সরকারের দখলে। তবে মন জিনিসটা চোখে দেখা যায় না, ধরাছোঁয়া যায় না; ওর ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করবার অস্ত্র আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আপনার ঐ দেহটা সরকারী সম্পত্তি। যেমন করেই হোক ওকে বাঁচিয়ে রাখার দায় আমাদের।

ব্রহ্মচারী হাসলেন। নিজেকে দেখিয়ে কৌতুকের সুরে বললেন, কিন্তু এমন কিছু মূল্যবান সম্পত্তি নয় যে সে দায় পালন না করলে সরকারের বিশেষ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা।

—আপনি ভুল করলেন ব্রহ্মচারী মশাই। মানুষ দয়া বলে যাকে জানে, তাকে দায় বলেই পালন করে, লাভ-ক্ষতির হিসেব খতিয়ে দেখে না। সরকারের বেলাতেও সেই একই কথা।

সদানন্দ নিঃশব্দে চোখ বুজলেন। মুখে ফুটে উঠল গাম্ভীর্যের ছায়া। তার মধ্যে কয়েকটা বোধ হয় সূক্ষ্ম দ্বন্দ্বের রেখা। বৃথা অপেক্ষা না করে আমার আইন-প্ৰদত্ত অধিকার—অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশ দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করবার আদেশ জারি করতে যাচ্ছিলাম, এমন সময়ে উনি চোখ খুললেন এবং অনেকখানি দ্বিধা ও সঙ্কোচের সুরে বললেন, আত্মহত্যা করা বা জেলের আইল-শৃঙ্খলা অমান্য করে আপনাকে বিব্রত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার এই উপবাসের মূলে আর কিছু নেই, ছিল শুধু একটু চিত্তশুদ্ধির চেষ্টা। কিন্তু তা সফল হয় নি। তাই আর অনাবশ্যক ঝঞ্ঝাট বাড়াতে চাই না। একটা নিবেদন শুধু আছে আপনার কাছে। অনুমতি করেন তো বলি।

—বলুন না?

—চিরদিন—হ্যাঁ, চিরদিনই বলা যেতে পারে, গুরুগৃহ ত্যাগ করবার পর থেকেই আমি স্বপাক-ভোজী। অবশ্য ভোজের ব্যাপারটা এমন কিছু গুরুতর নয়। দু-মুঠো আতপ চাল, তার সঙ্গে দুটো ঝিঙে-কাঁচকলা ফুটিয়ে নেওয়া। আধ ঘণ্টার মামলা। সাধারণ কয়েদী হিসেবে যে কাজ আমাকে দেবেন, তার কোনও রকম ক্ষতি না করে

ব্রহ্মচারীর বক্তব্য শেষ হবার আগেই পাশে দাঁড়িয়ে আমার আইন-অভিজ্ঞ জেলর তাঁর কর্তব্য পালন করলেন। আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন জেল কোডের অমোঘ নির্দেশ—No prisoner is allowed to cook for himself। জেলখানায় স্বপাক নিষিদ্ধ। খানিকটা চাপা গলায় এবং দৃশ্যত আমার উদ্দেশে বললেও যাতে ব্রহ্মচারীর শ্রুতিপথ এড়িয়ে না যায়, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সজাগ ছিলেন জেলরবাবু। তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। সদানন্দ তাঁর অসমাপ্ত নিবেদন আর শেষ করলেন না। আমি যে মৌন হয়ে রইলাম তাকে সম্মতি মনে না করে জেলরবারু সমর্থন বলেই গ্রহণ করলেন। অপ্রিয় উত্তরটা আমাকে আর মুখ ফুটে দিতে হল না।

হাসপাতালের হাতা পেরিয়ে সবে সাধারণ এলাকায় ঢুকতে যাচ্ছি, আমার এসকর্ট- বাহিনীর বেড়া ডিঙিয়ে কোত্থেকে একটা লোক বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে সজোরে পা জড়িয়ে ধরল। অতি কষ্টে সিপাইদের হাত থেকে তাঁকে বাঁচানো গেল বটে, কিন্তু তারপরও সে পা ছাড়বার নাম করে না। ধমক দিতেই কেঁদে ফেলল। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কথা যেটুকু বেরুল, তার থেকে বুঝলাম ব্রহ্মচারী তার গুরুদেব, তিনি মানুষ নন শাপভ্রষ্ট দেবতা, এবং এই মামলাটা একেবারেই মিথ্যা! আসল বক্তব্যটা ছিল শেষের দিকে। উনি যখন এই জেলখানার অন্ন কিছুতেই গ্রহণ করবেন না, এবং স্বপাকও সম্ভব নয়, তখন এই সামান্য রন্ধন-কার্যটি যদি দয়া করে ওর হাতে ছেড়ে দিই গুরুর প্রাণরক্ষা হয়, শিষ্যও নিজেকে কৃতার্থ মনে করে।

বললাম, কিন্তু উনি তো নিজের হাতে ছাড়া কারও হাতে খাবেন না।

শিষ্যটি সবিনয়ে নিবেদন করল, সেইটাই তাঁর সাধারণ নিয়ম বটে, কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে কোনও কোনও শিষ্যের হাতে অন্ন গ্রহণ করতে আপত্তি করেন না। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি বুঝি সেই বিশেষ শিষ্যদের একজন?

বিনীত কণ্ঠে উত্তর এল, গুরুদেব আমাকে কৃপা করেন।

—কী কেস্-এ এসেছ তুমি?

—মারপিট।

—জমি নিয়ে?

—আজ্ঞে না, জমির আইল নিয়ে।

—কী নাম?

–সহদেব ঘোষ।

—গোয়ালা?

—হুজুর।

—তোমার সঙ্গে আর কজন আছে?

—আজ্ঞে তিনজন—ছেলে, জামাই আর সম্বন্ধী।

—কিন্তু উনি তো ব্রাহ্মণ! গোয়ালার হাতে খাবেন কি?

—তা খাবেন। ওঁর জাতবিচার নেই। যাকে স্নেহ করেন, বিশ্বাস করেন, সে মুচি হলেও খান। তা না হলে ব্রাহ্মণের হাতেও জলস্পর্শ করেন না।

—আচ্ছা তোমার কথা আমার মনে রইল। ভেবে দেখব।

সহদেব ঘোষ আমার পা দুটো আবার চেপে ধরল। যে কোনও সমস্যাই হোক তার মীমাংসা মুলতুবী রাখা ওদের স্বভাবের বাইরে। আইলের স্বত্ত্ব যেমন তৎক্ষণাৎ লাঠির জোরে সাব্যস্ত করে নিয়েছিল, থানা-আদালতের মুখ চেয়ে বসে থাকে নি, এখানেও তেমনি জেলের আইন-কানুন বা কর্তৃপক্ষের বিচার-বিবেচনার ভরসায় না থেকে গুরুসেবার অধিকারটা নিছক পা চেপে ধরার জোরেই আদায় করে নেবার ব্যবস্থা করল।

.

শাসনতন্ত্রের বিধানমাত্রেই অনম্য। শাসক তাকে প্রয়োগ করেন, কিন্তু নিজের খুশিমত ভাঙতে পারেন না, নোয়াতে পারেন না। কারা-শাসনের ভার যাঁর হাতে, তাঁর বেলায় এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কেননা, এখানে যাদের নিয়ে তাঁর কারবার, আইন পালনের চেয়ে লঙ্ঘনের দিকেই তাদের ঝোঁক বেশী। হয়তো সেই একই কারণে এখানকার যারা বাসিন্দা, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত কড়া আইনের শক্ত শৃঙ্খল দিয়ে বাঁধা। তাদের অশন, বসন, চলন, কথন, কর্ম, অবসর, সবখানি জুড়ে জেল কোডের বিস্তৃত অধিকার। খাদ্যবস্তুর পরিমাণ যেমন বাঁধা, তার নাম এবং সংখ্যাও তেমনি নির্দিষ্ট বস্ত্রের বেলাতেও তাই। আকার প্রকার সংখ্যা, সব বিধিবদ্ধ। তেঁতুলের বদলে আমড়া, কিংবা ধনের বদলে পাঁচফোড়ন যেমন অচল, জাঙিয়ার বদলে পায়জামা অথবা কুর্তার বদলে হাফশার্টও তেমনিই না-মঞ্জুর।

একটা পুরনো ঘটনা মনে পড়ল। এই সেদিন পর্যন্ত নারীকয়েদীরা যে শাড়ি পরত, তার জমিতে থাকত নীল রঙের ডোরা। উনিশশো বত্রিশ সনে সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স করে যাঁরা জেলে এলেন তার মধ্যে কয়েকজন হিন্দু বিধবা ডোরা-কাটা শাড়ি পরতে অস্বীকার করে বসলেন। কোনও এক জেলের শ্বেতাঙ্গ সুপার ক্ষেপে উঠলেন, তোমরা আইন অমান্য করে জেলে এসেছ, জেলে এসেও আইন অমান্য করবে তা চলবে না! তাঁকে যখন বোঝানো হল, এদের আসল উদ্দেশ্য আইন লঙ্ঘন নয়, শাস্ত্র-পালন, তিনি জেল-কোডের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, কিন্তু আমার শাস্ত্রে যখন সাদা থানের ব্যবস্থা নেই, তখন ওই নীলস্ট্রাইপওয়ালা শাড়িই পরতে হবে। মহিলারা বললেন, না। হুকুম হল, জোর করে পরিয়ে দাও।

শুরু হল সংঘর্ষ। কারা-বিভাগের শ্বেতচর্ম বড়কর্তাও সুপারের পক্ষ নিলেন—আইন অমান্য’ চলবে না। মন্ত্রিসভার তখনও জন্ম হয় নি; একজিকিউটিভ কাউন্সিলের যুগ। জেলের চার্জ ছিল জনৈক দেশীয় মেম্বারের হাতে। বিধবাদের শ্বেত বস্ত্র দাবির মধ্যে সিভিল-ডিসওবিডিয়েন্সের গন্ধটা তিনি ঠিক ধরতে পারলেন না। কিন্তু জেল-কোডের ধারা যে খাঁড়া উঁচিয়ে আছে, তাকে ঠেকান কি করে? একজিকিউটিভ অর্ডার চলবে না; আইন বদলাতে হল। অর্থাৎ সেই ধারাটির সঙ্গে যুক্ত হল একটি অ্যামেগুমেন্ট—হিন্দু বিধবাদের শাড়িতে স্ট্রাইপ থাকবে না।

অত দূর না গিয়েও সংঘর্ষ বাঁচাবার অন্য একটা পথ তখনও ছিল, এখনও আছে। কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা—অনেক ক্ষেত্রেই তার শরণ নিতেন। সেবার ইচ্ছে করেই নেন নি। সেটা হচ্ছে জেলকোডের ছিয়ানব্বই ধারা। বয়লারের মাথায় যেমন একটা করে সেফটি ভালভ থাকে, যার কাজ হল অতিরিক্ত বাষ্পের চাপ বের করে দিয়ে ইঞ্জিন সচল রাখা, তেমনি ওই ধারাটিই হচ্ছে কারাতন্ত্রের সেফটি ভালভ – সময় বিশেষ অতিরিক্ত আইনের চাপকে কিঞ্চিৎ হালকা করে দেবার যন্ত্র। বয়লারের ভালব বোধ হয় স্বয়ংক্রিয়। কিন্তু ছিয়ানব্বই ধারাকে চালু করতে হলে একটি বিশেষ ব্যক্তির আনুকূল্য প্রয়োজন। তাঁর নাম মেডিক্যাল অফিসার। তিনি যদি মনে করেন জেলের কোনও বিধি বা আদেশ ক্ষেত্র বিশেষে কয়েদীর দেহ কিংবা মনের পক্ষে হানিকর, তালিকা-মাফিক খাদ্য বা বস্ত্র কারও দৈহিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিকূল, তা হলে ওই বিশেষ ক্ষেত্রে সুপার তাঁর উপর-মহলের অনুমতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনটিকে শিথিল করবার ব্যবস্থা করতে পারেন।

বছর কয়েক আগেকার একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি। তখন জেলের আইনে ধূপপান সম্বন্ধে ভীষণ কড়াকড়ি। প্রথম শ্রেণীর কয়েদী (যাঁরা কালে-ভদ্রে আসেন) এবং হাজতী আসামী ছাড়া আর কারও কাছে বিড়ি সিগারেট কিংবা এক টুকরো তামাকপাতাও ছিল মারাত্মক নিষিদ্ধ বস্তু, জেল-কোডে যাকে বলে Prohibited article, সেই সময়ে কোনও নামজাদা সেন্ট্রাল জেলের মেডিক্যাল অফিসার একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর কায়েদীর টিকিটে দৈনিক দু-প্যাকেট সিগারেট সুপারিশ করে বসলেন। সুপার মানতে চাইলেন না। জেলের যা বরাদ্দ, তার উপরে কারও বেলায় কিছু বাড়তি খাদ্য—যথা মাছ, মাংস, মাখন, ডিম, দুধ, দই কিংবা ফলমূল, এ সবের ব্যবস্থা ওঁরা দিয়ে থাকেন। সেটা নতুনও নয় অপ্রত্যাশিতও নয়। কিন্তু এ যে নেশা। জেলের আইনে যাকে বলা হয়েছে নিষিদ্ধ বস্তু। সিগারেট যদি চলে মদ গাঁজা চণ্ডু চরসেই বা বাধা কোথায়? তাঁর মতে এটা ছিয়ানব্বই ধারার অপপ্রয়োগ।

মেডিক্যাল অফিসার বললেন, নেশার ব্যবস্থা কি সাধ করে করেছি! করেছি প্রাণের দায়ে।

—কী রকম?

—তবে শুনুন। দিন সাতেক হল এসেছে লোকটা। এসেই এ অসুখ, সে অসুখ। আমার দুজন ডাক্তার হিমসিম খেয়ে গেল। রোগটা যে কী, ধরতেই পারল না। আমি গিয়ে দেখি রুগী ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল। কী ব্যাপার? জিজ্ঞেস করতেই গরম মেজাজে শুরু করল লম্বা ফিরিস্তি। আমাদের শাস্ত্রে যে-সব বড় বড় রোগের বর্ণনা আছে, তার কোনোটার সঙ্গেই মেলে না। হঠাৎ আমার হাতের দিকে নজর পড়তেই থেমে গেল! মুখে কথা নেই, কিন্তু চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হাতে কী ছিল বুঝতেই পারছেন। সিগারেটের টিন। একটা চান্স নেওয়া গেল। ওই থেকে একটা বের করে এগিয়ে ধরলাম। পাগলের মতো ছুটে এসে কেড়ে নিল আমার হাত থেকে। ধরাতে দেরি সয় না। তারপর সে কী টান! আর-একটা দিলাম। দু-মিনিটে শেষ। চোখের সামনে চেহারা বদলে গেল। রীতিমত সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন লাগছে? “খুব ভালো, স্যার! কোনও অসুখ নেই আমার।” জিজ্ঞেস করলাম, ক’প্যাকেট চলত রোজ? একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, দেড় টিন। কোনোদিন পুরো দুটোও লেগে যেত।”….তা হলেই বুঝুন।

সুপার হেসে উঠলেন। ডাক্তার সাহেব ভয়ে ভয়ে বললেন, খুব বেঁচে গেছি মশাই। ওই বস্তুটি দিতে আর একদিন দেরি হলেই ও নির্ঘাত খুন করত! হয় নিজেকে, নয়তো আর কাউকে। তার মধ্যে আমারই সম্ভাবনা ছিল প্রথম নম্বর।

ছিয়ানব্বই ধারার আরও একটা বিচিত্র প্রয়োগ মনে পড়ে গেল। সে সম্বন্ধে দু-চার কথা বলেই এ অবান্তর প্রসঙ্গ শেষ করব।

চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট থেকে তিন মাসের জেল নিয়ে এল এক খোঁড়া পকেটমার। ফিরিঙ্গিপাড়ায় মাঝে মাঝে দেখেছি, টুপি উপুড় করে ভিক্ষা চাইছে পথচারীদের কাছে। জেলে যখন এল, পরনে তালি-মারা ট্রাউজার, ছেঁড়া শার্ট আর ময়লা হ্যাট। গায়ের রঙ তামাটে। নামটা বোধ হয় ডেভিস কিংবা ডেভিডসন। কথা বলে ইংরেজীতে, তবে তার সঙ্গে গ্রামারের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী। কিন্তু সকালবেলা লপসির থালা সামনে দিতেই ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মেটকে হুকুম করল, “নেটিভকা খানা নেহি খায়গা। ব্রেড-বাটার আউর টী লেয়াও।” মেট লোকটার কিঞ্চিৎ রসজ্ঞান ছিল। সাড়ম্বরে সেলাম ঠুকে বলল, বিলেতে অর্ডার গেছে সাহেব। আসতে দেরি হবে, ততক্ষণে লপসিটা খেয়ে লাও।

এর পর সাহেবের মেজাজ ঠিক্ থাকবার কথা নয়। হিন্দী এবং ইংরেজী মিশিয়ে মেটের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দিল। শ্বেতাঙ্গ জেলরের কাছে নালিশ জানাল মেট। শুনানি মুলতুবী রেখে তিনি আসামীকে নিয়ে গেলেন সুপারের অফিসে। তার ঘণ্টাখানেক পরে দ্বিতীয় শ্রেণীর দাবি জানিয়ে ডেভিডসনের দরখাস্ত চলে গেল চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। তার সঙ্গে রইল জেল-সুপারের সুপারিশ। আবেদনের উত্তরসাপেক্ষে ওর জায়গা হল ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডে, এবং শ্বেতাঙ্গ কয়েদীদের কিচেন থেকে তৃতীয় শ্রেণীর বাবুর্চি-কয়েদীরা পৌঁছে দিল বহুমূল্য বিলাতী খানা। পরদিন সরাসরি না-মঞ্জুর হয়ে ফিরে এল দরখাস্ত। মোটা লাল পেন্সিল দিয়ে গোটা অক্ষরে লিখেছেন সিভিলিয়ান সি. পি. এম. — He is a beggar and can’t get Division II. ডিভিশন টু।

দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠতে হলে কয়েদীর আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা এবং সেই সঙ্গে জীবনযাত্রার মান সাধারণ স্তরের উপরে থাকা চাই। ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। কিন্তু ঐ লাল পেন্সিলের লেখা দেখে জেলর সাহেবের লাল চোখ আরও লাল হয়ে উঠল। জেল-কোড বগলে করে ছুটলেন সুপার-বাহাদুরের কামরায়। শুধু সুপার নন, তিনিই আবার মেডিক্যাল অফিসার। লড়াই-ফেরতা দেশী আর. এম. এস.। ইংরেজ- সহকারের অনুরোধকে আদেশ বলে ধরতে শিখেছেন। সুতরাং ছিয়ানব্বই ধারা প্রয়োগ করে ডেভিডসনের পদোন্নতি বজায় রাখা হল।

এই পকেটমার সাহেবটির পিতৃ-পরিচয় আমরা পাই নি। যতদূর অনুমান হয় খঞ্জ পুত্রটিকে ঐ নাম ছাড়া আর কিছুই তিনি দিয়ে যেতে পারেন নি। কিন্তু সেটা যে কত বড় সম্পত্তি, হয়তো তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। ঐ নামের দৌলতে জেলে এসেও গদিআঁটা লোহার খাটে শুয়ে সরকারী কোট-পেণ্টলুন পরে এবং চেয়ার-টেবিলে চপ-কাটলেট চিবিয়ে তিনটি মাস মহা আরামে কাটিয়ে গেল ভিখারী ডেভিডসন।

সেদিন ডেপুটি এবং কেরানী বাবুদের সান্ধ্য-আফিসে ঐ নামমাহাত্ম্যই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াল। সিতাংশুবাবু আপসোস করলেন, বড্ড ভুল করেছি, দাদা। নামটাকে যদি গোড়া থেকেই চ্যাটার্জির বদলে চ্যাটারটন করে দেওয়া যেত, এতদিনে আর কিছু না হোক একটি পুলিস সার্জেন্ট অন্তত হতে পারতাম।

হৃদয়দা ওয়ারেন্ট চেক্ করছিলেন। চোখ না তুলেই বললেন, আমার মনে হয় নামের চেয়ে পোশাক-মাহাত্ম্যটা আরও বড়।

—পোশাক-মাহাত্ম্য?

—হ্যাঁ, আর তার প্রমাণ আমিও একবার হাতে হাতে পেয়েছিলাম।

—আপনি! একসঙ্গে পাঁচজনের কণ্ঠ।

হৃদয়দা ওয়ারেন্ট বন্ধ করে চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে বললেন, তখন কলেজে পড়ি। চুঁচড়ো থেকে প্রায়ই খেলতে আসতাম গড়ের মাঠে। সাড়ে সাতটায় একটা গাড়ি ছিল, তাতে করে ফিরে যেতাম। একদিন একটু রাত হয়ে গিয়েছিল। প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দেখি, গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। লাফিয়ে উঠে পড়লাম, সামনে যে কামরা পেলাম তাতে। থার্ড ক্লাস, কিন্তু একেবারে ফাঁকা। কারণ বুঝতে দেরি হল না। ওটা সাধারণত থার্ড নয়, ইউরোপিয়ান থার্ড। আমার পরনে ছিল ধুতি আর পাঞ্জাবি। গাড়িতে যে-কটি দেশী সাহেব-মেম ছিলেন, তাঁরা কেউ নাক সেঁটকালেন, কেউ চোখ কপালে তুললেন, কেউবা মুখ ফিরিয়ে বসলেন। একটি জামরঙের মেমসাহেব বেশ তেজ দেখাতে শুরু করলেন। শিভালরির সুযোগ পেয়ে এক ছোকরা মতন সাহেব এগিয়ে এসে একেবারে আমার নাকের ওপর ঘুষি বাগিয়ে হিন্দী ভাষায় কৈফিয়ৎ তলব করে বসল : “এ গাড়িতে কেন উঠেছ? জান না, এটা রিজার্ভড ফর্ ইউরোপীয়ানস্?” বললাম, তাই নাকি? আচ্ছা এক মিনিট সবুর করো। সঙ্গে যে পোঁটলাটা ছিল তাই নিয়ে ঢুকে পড়লাম বাথ-রুমে। ধুতি-পাঞ্জাবির ওপরেই চড়িয়ে দিলাম কাদা-মাখা হাফপ্যান্ট। স্যাণ্ডেল খুলে পরে নিলাম ফুটবলের বুট। বাড়ি থেকে স্টেশনে আসতে হত সাইকেলে। রোদ লাগে বলে দাদার একটা ফেলে-দেওয়া ছেঁড়া হ্যাট মাথায় দিয়ে আসতাম। সেটাও চিল পোঁটলার মধ্যে। পরে নিলাম। তারপর গ্যাটগ্যাট্ করে বেরিয়ে এসে একেবারে সেই মেমসাহেবর সামনে গিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, হ্যালো, হা-ডু-ডু!

আমাদের সম্মিলিত হাসির পর্দাটা বোধ হয় একটু বেশী চড়ে গিয়েছিল। লাল-মুখ জেলর যাবার পথে একবার উঁকি মেরে দেখে গেলেন।

যাক। আসল প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূর এসে পড়েছি। বলতে গিয়েছিলাম, সহদেব ঘোষ যখন তার দুটো হাতের জোরেই গুরুদেবের পাচক-সমস্যার সমাধান না করে ছাড়ল না, তখন বাকি যেটুকু, অর্থাৎ আতপ চাল, ঘি-কাঁচকলা এবং বৈকালিক দুধ আর ফলমূলাদির ব্যবস্থা, ঐ ছিয়ানব্বই ধারার আওতায় বসে আমি আর ডাক্তার সাহেব মিলে করে ফেললাম।

সদানন্দ চল্লিশোর্ধ্ব। ঘন ঘন উপবাস এবং (ডাক্তার সাহেবের মতে) ব্রহ্মচর্যরূপ বায়োলজিক্যাল কারণে শরীর একেবারে শুষ্কং কাষ্ঠং। ডাল ভাঙা, গম পেশা, কোদাল চালানো কিংবা তাঁত বোনা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই তাঁকে কয়েদী-রাইটার (vonvict writer) বানিয়ে দেওয়া হল। জেলের যারা বাসিন্দা, অন্যান্য দিকে তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি যতই থাক, আক্ষরিক বিদ্যায় বড়ই খাটো। তাদের চিঠিপত্র এবং হরেক রকম দরখাস্ত লিখে দেবার জন্যে ওদের মধ্যে থেকেই মুন্সী বেছে নিতে হয়। ব্রহ্মচারীর ওপর পড়ল সেই মুন্সীগিরির ভার।

কার হালের বলদ কেড়ে নিয়ে গেছে বাদীপক্ষের লোক, মেয়েদের ইজ্জত বাঁচানো দায় হয়েছে পাড়ার কোন্ গুণ্ডার হাত থেকে, খাজনার দায়ে কার বাস্তুভিটা নিলামে চড়েছে—এমনি ধারা যত অভিযোগ আসে আমার কাছে, প্রত্যেককে একখানা করে দরখাস্ত মঞ্জুরি করি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বরাবর। সে সব দরদ দিয়ে, তথ্য এবং যুক্তি দিয়ে লিখে দেন ব্রহ্মচারী। আর একটা জিনিস তাঁকে লিখতে হয়, জেল-আপীল। সাজা হবার পর উকিল মোক্তার লাগিয়ে ঊর্ধ্বতন আদালতে আপীল দায়ের করবার সামর্থ্য বা সুবিধা যাদের নেই তারা বিনা খরচায় আপীল করে জেল থেকে। রায়ের নকল পায় বিনা ফী-তে। সমস্ত নথিপত্র তন্ন তন্ন করে মন দিয়ে পড়েন ব্রহ্মচারী। তারপর আপীলকারীর বক্তব্য শুনে নিয়ে বহু যত্ন এবং পরিশ্রম দিয়ে তৈরী হয় তাঁর মুসাবিদা।

একদিন জেলা-জজ এলেন জেল পরিদর্শনে। কথা-প্রসঙ্গে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার স্টাফে কি কোনও উকিল আছে?

—উকিল!

—হ্যাঁ; মানে ওকালতি পাস, কিংবা আগে প্র্যাকটিস করত?

—কেন বলুন তো?

—জেল থেকে যে-সব আপীল যায়, সেগুলি লেখে কে?

—জেল স্টাফের কেউ নয়, লেখে একজন সাধারণ কয়েদী।

–কয়েদী! বিস্মিত হলেন জজ-সাহেব।

বললাম, হ্যাঁ; এবং তার ব্যবসা ছিল কথকথা আর গুরুগিরি, ওকালতি নয়। আপনি ই পাঠিয়েছেন তাকে।

—কী নাম বলুন তো?

—ব্রহ্মচারী সদানন্দ।

—ও-ও, সেই লোকটা? আপীল যা লেখে মশাই, পাকা উকিলও পেরে উঠবে না। অথচ মজা দেখুন, নিজের কেস্-এ সে কোনও ডিফেন্স দেয় নি।

—আপনার রায়ে পড়লাম সে কথা।

—আরও তাজ্জব ব্যাপার শুনুন, যা রায়ে লিখি নি। ওকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি দোষী না নির্দোষ, জোড় হাত করে বলল, প্রশ্নটা কি নিরর্থক নয়, ধর্মাবতার? জানতে চাইলাম, নিরর্থক কেন? জবাব দিল, যদি বলি দোষী, সে কথার উপর নির্ভর করেই তো আপনি আমাকে শাস্তি দিতে পারেন না, সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন হবে। আর যদি বলি আমি নির্দোষ, তাহলেও আপনি আমাকে ছেড়ে দেবেন না। সেখানেও ওই সাক্ষ্য-প্রমাণ। তবে আর এই অনাবশ্যক প্রশ্নের সার্থকতা কোথায়?

বললাম, এ লোক যে পাকা উকিলের মতো আপীল লিখবে, তাতে আর আশ্চর্য কি?

—কিন্তু ওকালতি-জ্ঞানটা ও নিজের কাজে লাগাতে চাইল না, এইটাই আশ্চর্য।

—শুনেছি, অনেক বড় বড় শিষ্য আছে ওর। তারাও তো একজন উকিল লাগাতে পারত।

—সে চেষ্টা তারা কম করে নি। কিন্তু আসামী ওকালতনামায় সই না করলে উকিল দাঁড়াবে কেমন করে? উকিল না দিক, নিজেও তো লড়তে পারত। সে দিক দিয়েও যায় নি। বাদীপক্ষের যা কিছু বক্তব্য সব আগাগোড়া শুনে গেছে, একটি কথাও বলে নি। অনেক মামলা করেছি মশাই, এ রকমটা দেখি নি।

এই পর্যন্ত এসে জজ-সাব কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, আপনাকে বলতে বাধা নেই, লোকটা সত্যিই দোষী কিনা, সে সম্বন্ধে মনে মনে আমি নিঃসন্দেহ হতে পারি নি। কোথাও কোনও রহস্য আছে নিশ্চয়, যা আড়ালেই রয়ে গেল। জুরির মনের কথাও বোধ হয় তাই। কিন্তু আমাদের রাস্তা একেবারে বাঁধা। এভিডেন্সের বাইরে এক চুল নড়বার উপায় নেই। সেখানে এমন কোনও খুঁত পাওয়া যায় নি, যার ওপর দাঁড়িয়ে জুরির পক্ষে দোষী ছাড়া অন্য ভাডিক্ট্‌ দেওয়া চলে। আর ওঁদের সঙ্গে আমারও একমত না হবার কারণ ছিল না।…..যাক, এবার উঠি কোর্টের সময় হল।

জুরি হবার সৌভাগ্য আমার কোনোদিন হয়নি। তবু রায় পড়ে আমারও ওই কথাই মনে হয়েছিল। কোথাও কোনও রহস্য রয়ে গেল, যা ভেদ করা যায় নি।

বাদীপক্ষের কাহিনী সরল ও সংক্ষিপ্ত। একটি কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ে একদিন সকালের দিকে কেঁদে পড়ল গিয়ে নবদ্বীপ থানার বড় দারোগার কাছে। তিনি জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? মেয়েটি বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে, আর কিছুই বলতে চায় না। তারপর এল এক মোক্ষম পুলিসী ধমক, যার উত্তর বলে উঠল, আমার ধম্মোনাশ করেছে কথক- ঠাকুর।

—কোন্ কথক-ঠাকুর? জানতে চাইলেন বড়বাবু।

—ওই মাঝের পাড়ার ব্রেহ্মচারী।

দারোগা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়েটার মুখের দিকে। তারপর বললেন, কোথায় করল তোমার ধম্মোনাশ?

—ওর বাড়িতে।

—তুমি সেখানে কী করছিলে?

—বাসন মাজতে গিয়েছিলাম।

—কী নাম তোমার?

—ময়না।

—ঠিকে-ঝি, না দিন-রাতের?

—ঝি নই আমি!

—ঝি নও, তবে বাসন মাজতে গিয়েছিলে কেন?

উত্তর দিতে গিয়ে একটু বোধ হয় ইতস্তত করেছিল মেয়েটি। তারপর আর-এক ধমক খেয়ে খুলে বলল ঘটনার বিবরণ।

ব্রহ্মচারীর বরাবরকার ঝি পাঁচীর মা ওদেরই পাড়ার লোক। আগের দিন সন্ধ্যে থেকে জ্বরে পড়েছিল; সকালে আর কাজে বেরোতে পারে নি। অন্য সব বাড়ি, যেখানে সে কাজ করত, তাদের জন্যে বিশেষ ভাবনা ছিল না। তারা একরকম করে চালিয়ে নেবে। কিন্তু কথক-ঠাকুর একা মানুষ। সেই সকালে বেরিয়ে যায়, দেড়টা দুটোর আগে ফিরতে পারে না। তারপর নিজে হাতে দুটো চাল ফুটিয়ে খায়। বাসন দু-খানা মাজা না পেলে বড্ড কষ্ট হবে বেচারার। ময়নার মা শুনে বললেন, তার জন্যে কী? ময়না গিয়ে মেজে দিয়ে আসুক না। একলা মানুষের ভারী তো বাসন! কথক-ঠাকুরের বাড়ি চিনত ময়না। দরজা খোলাই ছিল। রান্নাঘর থেকে বাসন তুলে নিয়ে কুয়োতলায় বসে যতক্ষণ কাজ করছিল কারও কোনও সাড়া পাওয়া যায় নি। তারপর যখন হাত ধুয়ে চলে আসবে, ঠাকুর এসে দাঁড়াল তার সামনে। বলল, আমার শোবার ঘরটা একটু গুছিয়ে দিয়ে যাও না! ঠাকুরের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় হল ময়নার। বলল, না, আমি যাই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। পা বাড়াতেই ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঠাকুর। বাঁ হাতে জাপটে ধরে ডান হাতে মুখ চেপে ধরল। তারপর টানতে টানতে নিয়ে গেল ঘরের মধ্যে। মুখ ছেড়ে দিতেই চেঁচাতে যাচ্ছিল ময়না, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর ফুটল না। ঠাকুরের হাতে ঝকঝক করছে মস্ত বড় কাটারি। সেটা রেখেই দরজায় খিল তুলে দিল।

দারোগা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর?

ময়না জবাব দিল না। বসে রইল মাটির দিকে মুখ করে।

—কোথায় সে ঠাকুর?

—কাপড়-গামছা নিয়ে চলে গেল গঙ্গার দিকে। আমিও অমনি ছুটে এলাম থানায়।

–গঙ্গার দিকে! লাফিয়ে উঠলেন দারোগাবাবু। টুপিটা মাথায় চড়িয়ে একজন সিপাই নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সহকারীকে বলে গেলেন, মেয়েটাকে আটকে রেখো।

ঘাটে পৌঁছেই নিরাশ হলেন বড়বাবু। একবুক জলে দাঁড়িয়ে সরবে গঙ্গার স্তব আবৃত্তি করছেন ব্রহ্মচারী। টুপীটা খুলে অসহিষ্ণু হাতে চুলগুলো ধরে একবার টানলেন। একটা কুৎসিত গালাগালি উচ্চারণ করলেন মেয়েটার উদ্দেশে, খবরটা আর একটু আগে দিতে পারল না। তারপর জল থেকে উঠতেই আসামীকে গ্রেপ্তার করলেন।

থানায় আসবার পর ব্রহ্মচারীকে যখন জানানো হল, তাঁর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, তিনি চকিত দৃষ্টিতে একবার তাকালেন মেয়েটির দিকে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন নিস্পন্দের মতো, তারপর বললেন, কোথায় যেতে হবে?

—কোর্টে। তার আগে থানার লক-আপ-এ।

—চলুন।

প্রত্যক্ষদর্শী এ-জাতীয় মামলায় বড় একটা সাক্ষী থাকে না, এ ক্ষেত্রেও ছিল না। কিন্তু পরোক্ষ সাক্ষ্যের অভাব হয় নি। অভিযোগকারিণীর সমর্থনে তার দেহ-পরীক্ষার ডাক্তারি রিপোর্ট তো ছিলই, তা ছাড়া মাতব্বর-গোছের দু-তিনজন পাড়ার লোক হলপ করে বলেছিলেন, মেয়েটা যখন কাঁদতে কাঁদতে থানার দিকে যাচ্ছিল, তখনই তার মুখ থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন তার লাঞ্ছনার কাহিনী, আর তার সঙ্গে আসামীর নাম এবং পরিচয়। সঙ্গে সঙ্গে আসামীর সন্ধানও তাঁরা করেছিলেন, কিন্তু তাকে পাওয়া যায় নি। আর একজনের সাক্ষ্যে জানা গেল, স্নান করে ফেরবার পথে তিনি দেখতে পেলেন, কথক- ঠাকুর হন্হন্ করে ছুটে চলেছে গঙ্গার দিকে। অনেক দিনের জানা-শোনা, কিন্তু বার বার প্রশ্ন করেও তার গন্তব্যস্থান বা ব্যস্ত হবার কারণ সম্বন্ধে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। হনহন করে গঙ্গায় ছুটে যাবার প্রয়োজন বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছিলেন সরকারী উকিল। তার উল্লেখ না করলেও চলবে।

এই কটি তথ্যের উপর নির্ভর করে আসামী দোষী সাব্যস্ত করা যায় কি না—বিচক্ষণ বিচারক সে প্রশ্ন এড়িয়ে যান নি। ময়নার মতো মেয়ের জীবননাট্যে ঐ মুহূর্তে অন্য কোনও নায়কের আবির্ভাব অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তেমন যদি কেউ এসে থাকে – প্রেমিক বা অত্যাচারী, যে বেশেই হোক,—তাকে নেপথ্যে সরিয়ে রেখে এই নিরীহ লোকটার বিরুদ্ধে এত বড় মিথ্যা অভিযোগ আনবার কোনও যুক্তি খুঁজে পান নি। অন্যান্য সাক্ষীদের অবিশ্বাস করবারও কোনো হেতু ছিল না। তা ছাড়া, অভিযোগের উত্তরে অভিযুক্তের নির্বাক ঔদাসীন্য— তার মধ্যে রহস্য যতই থাক–জজ বা জুরিদের মনে অনুকূল আবহাওয়ার সৃষ্টি করে নি। 

কিন্তু কী সেই রহস্য, বিচারক যা ভেদ করতে পারেন নি, জুরিরা যার সন্ধান পান নি, তার সম্বন্ধে কৌতূহল আমার যতই থাক, সেটা মেটাবার পথে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা এই চেয়ার। আমার ও আমার বন্দীর মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। সে দূরত্ব ঘোচাতে পারি এমন কোনো মন্ত্র আমার জানা নেই। সে যখন আমার সামনে আসে, তার চারদিকে জড়িয়ে থাকে কয়েদীর খোলস। ভেতরে যে মানুষ, তাকে আমি পাই না। আমি যখন তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই, সেও আমার নাগাল পায় না। যদি বা কেউ হাত বাড়ায়, সে হাতে ঠেকে শাসকের লৌহবর্ম। 

আমার সাহিত্যিক বন্ধুদের বলতে শুনেছি, আমি তো প্লটের রাজা! অপরাধী মানুষের অন্তর্লোকে যেমন ‘সাইকলজি’র ছড়াছড়ি, তার বহির্জীবনেও তেমনিই গড়াগড়ি যাচ্ছে ‘ড্রামাটিক সিচুয়েশন’। ট্যাপ করলেই রসের স্রোত। ধরে নিয়ে শুধু পরিবেশন করা। আমি প্রতিবাদ করি না, মনে মনে শুধু হাসি। স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে কবিরা নাকি বলেছেন, তাদের বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। কিন্তু এই কয়েদী-জাতটার শুধু বুক নয়, মাথা ফাটিয়ে দিলেও যে মুখ ফোটে মা–সে কথা যদি জানতেন আমার বন্ধুগণ! 

সহদেব ঘোষের গায়ে যে খোলসটা ছিল সেটা মাঝে মাঝে হঠাৎ খুলে পড়ত। ক্ষণেকের তরে বোধ হয় ভুলে যেত, সে জেলখানার লোক। এমনই একটা অসতর্ক মূহুর্তে একদিন চেপে ধরলাম : সেদিন যে বলেছিলে মিথ্যা মামলায় জেল খাটছেন তোমার গুরু, তার প্রমাণ দাও। হেসে ফেলল ঘোষের পো। সামনের দুটো দাঁত ভাঙা। বছর কয়েক আগে একটা মরা তালগাছ বাঁচাতে গিয়ে ওই ছুটিকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল। সে জন্য কোনো ক্ষোভ নেই সহদেবের মনে। গাছের মূল্য থাক বা না থাক, সেটা যে ওর পৈতৃক সম্পত্তি। সেই ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল গভীর বিস্ময় : প্ৰমাণ! প্রমাণ আমি কোথায় পাব হুজুর? 

তবে এতগুলো সাক্ষীর কথা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিচ্ছ কিসের জোরে? 

জোর আমার কিছুই নেই ধর্মাবতার, মিথ্যাবাদীও কাউকে বলতে চাই না। আমার চোখ যা দেখে, মন যা বলে, তাই আমি জানি। আদালতে দাঁড়িয়ে কোন্ সাক্ষী কী বলল আর না-বলল, তা দিয়ে আমার কিসের দরকার? 

যে ব্যাপারে, মানে যে ঘটনায় জড়িয়ে ওঁর সাজা হল, তার সম্বন্ধে তুমি কিছু জান? 

সহদেব দাঁতে জিব কেটে বলল, না হুজুর। 

আমি হেসে ফেললাম : কিছু না জেনেই, অতবড় একজন জজ বিচার করে যা স্থির করলেন, সেটা বলতে চাও ভুল? 

আমার উচ্চাঙ্গের হাসি দেখে সহদেব যে কিছুমাত্র অপ্রতিভ হয়েছে, তার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে থেকে হাত জোড় করে বলল, হুজুর, মুখ্যু মানুষ আমি, তায় জাতে গয়লা। গরিবের কথায় অপরাধ নেবেন না। আমার গুরুকে আমি দেখেছি সেই জোয়ান বয়স থেকে। আর জজ সাহেব তাঁকে দেখেছেন সবে দুটো দিন। তাও নিজের চোখ দিয়ে নয়, অন্য লোকের চোখ দিয়ে। তবু তাঁরই কথা আমাকে মেনে নিতে হবে, আর আমি যা দেখলাম, যা পেলাম – সব ভুয়ো? 

শিষ্যের মুখে এ-হেন যুক্তি শোনবার পর গুরুর মামলা-ঘটিত রহস্য- মোচনের সব আশায় জলাঞ্জলি দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ রইল না। 

মাস কয়েক পরে একদিন অসময়ে যেতে হয়েছিল জেলখানায়। বৈশাখের মাঝামাঝি। বেলা প্রায় দেড়টা। কিছুক্ষণ হল ভোজন- পর্ব সমাধা হয়েছে; এখন চলছে মাধ্যাহ্নিক বিরামের পালা। ওয়ার্কশপগুলো খালি। বড় বড় ব্যারাকে আরাম করছে কয়েদীরা। বেশীর ভাগই হাত-পা ছড়িয়ে গড়িয়ে নিচ্ছে খানিকক্ষণ। কোথাও কোথাও গোল হয়ে বসেছে দশ-পঁচিশের আসর। কারও বা ঝোলার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে লুকিয়ে-রাখা ময়লা তাসের প্যাকেট একটা গোপন কোণ বেছে নিয়ে শুরু হয়েছে বিন্তি বা টোয়েনটি- নাইনের জুয়ো। 

কান রয়েছে বাইরে, ইয়ার্ডের পানে, কোন্ দিকে শোনা যায় টহলদার সিপাহীর ভারী বুটের আওয়াজ। রুদ্র আকাশের অগ্নিবর্ষণ মাথায় নিয়ে টহল আর দিচ্ছে কে? পাগড়িটা খুলে বারান্দার কোণে কিংবা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেছে একটুখানি, কিংবা সুযোগ বুঝে বসেও নিচ্ছে কয়েক মিনিট। দুঃসাহস যাদের বেশী, তারা এরই মধ্যে দেয়ালে কিংবা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে পা দুটো। জানে না কখন নেমে এসেছে অবাধ্য চোখের পাতা। কতক্ষণ আর? হঠাৎ কখন কানের কাছে ফেটে পড়বে শ্লেষতিক্ত ব্যাঘ্রগর্জন : শো গিয়া! চোখ খুলেই দেখতে পাবে জমাদারের রক্তচক্ষু। ধড়মড়িয়ে উঠে বেল্‌ট্‌ আঁটতে আঁটতে বলবে, নেহি হুজুর, জরাসে আঁখ লাগ গিয়া। জমাদারের দয়া হলে এইখানেই শেষ। নয়তো ডিউটি-অন্তে যেতে হবে ওয়ার্ডার-গার্ডের ডেপুটিবাবুর কাছে। একদফা শুনানির পর অর্ডার-বুকে লেখা হবে রিপোর্ট : ডোজিং হোয়াইল অন ডিউটি। শাস্তির ডোজটা নির্ভর করবে দুটো জিনিসের উপর, দণ্ডিতের ম্যানার এবং দণ্ডদাতার মূড। 

বিশেষ একটি জায়গা আছে জেলখানায়, রৌদ্রদগ্ধ মধ্যাহ্নও যেখানে বিরামহীন কর্মমুখর। সেটি হচ্ছে এই বিরাট গোষ্ঠীর অন্নসত্রের যজ্ঞশালা। ভোর চারটেয় তার আরম্ভ, বেলা চারটেয় আহুতি। পূর্ণাহুতি নয়, সাময়িক বিরতি মাত্র। রাবণের চিতার মতো অগ্নি সেখানে অনির্বাণ; কখনও ধিকিধিকি, কখনও দাউদাউ। মোটা লোহার পাত দিয়ে তৈরী একটি অতিকায় বাক্স, যার পোশাকী নাম কুকিং-রেঞ্জ, কয়েদীরা বলে—বাইলট। ( কথাটা বোধ হয় বয়লারের কারা-সংস্করণ )। তার ডালার উপর সারি সারি গর্ত, ভেতরে জ্বলছে মোটা মোটা কাঁচা কয়লার চাঁই, ওপরে বসানো একটা করে প্রকাণ্ড পিপে-আকারের লোহার ডেক, যার ব্যাস চব্বিশ ইঞ্চি, দৈর্ঘ্য তিন ফুট। তার অর্ধেক অংশ ডুবে গেছে আগুনের মধ্যে, বাকী অর্ধেক জেগে আছে রেঞ্জের ওপর। এক-একটা ডেকে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ সের করে চাল কিংবা ডাল অথবা মন দুই করে তরকারি চাপিয়ে দিয়ে দু দিক থেকে খুস্তিনামধারী পাঁচ হাত লম্বা লোহার ডাণ্ডা চালায় যে সব কয়েদী, তাদের বর্ণ বা পরিধির সঙ্গে ওই ডেক- গুলোর বিশেষ তফাত নেই। তাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন ছুটি ব্যক্তি—কানায় লাগানো রাক্ষুসে কড়ার ভিতর দিয়ে প্রকাণ্ড বাঁশ চালিয়ে দিয়ে ৰাইলটের ছ পাশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যারা কাঁধে করে টেনে তোলে ফুটন্ত ভাত-ভর্তি ডেকগুলো, তারপর জলে- ভেজা সিমেন্টের মেঝের উপর দিয়ে বয়ে নিয়ে ঢেলে দেয় মাড়- নিকাশের অতিকায় ছাঁকুনির মুখে। যাকে-তাকে দিয়ে এ কাজ চলে না। এর পেছনে চাই এক দিকে যেমন অমিত গায়ের জোর, আর এক দিকে তেমনই যত্নায়ত্ত কৌশল, এবং সকলের ওপরে অবিচল সতর্কতা। কোনো একটার অভাব হলে যে বিপর্যয় ঘটে, তার নিদর্শন আমি নিজের চোখেই দেখেছি। একটা, তো এই সেদিনের ঘটনা। হঠাৎ পা পিছলে ডেক উলটে দিয়ে সেই যে পড়ল লোকটা, আর উঠল না। সহবন্দীরা স্ট্রেচারে করে ঝলসানো দেহটাকে পৌঁছে দিয়ে এল হাসপাতালে। তার পর ফিরে এল ঘাম মুছতে মুছতে। শুধু কি ঘাম? তার সঙ্গে বোধ হয় খানিকটা চোখের জল। সে কথা এখন থাক। 

সেদিন অসময়ে টেলিফোন এল জেলরবাবুর কাছ থেকে, ওই মানিক-জোড়ের এক মানিক হঠাৎ কী কারণে বিগড়ে গিয়ে বাঁশ ফেলে শুয়ে পড়েছে গুদামের বারান্দায়। জরুরী অবস্থায় কাজ চালাবার মতো দু-একজন যারা ছিল, সময় বুঝে কারও ঘাড়ে চেপেছে বাত, কারও বা হাঁটুতে নেমেছে রস। এদিকে চার ডেক ভাত ক্ৰমাগত খুস্তির ঘায়ে লেই হবার উপক্রম। খুন্তি থামলেই তলা থেকে উঠছে পোড়া গন্ধ। খবর পেয়ে জেলর এসে লোকটাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, জানতে চেয়েছিলেন কী তার অভিযোগ। উত্তরে প্রথমে কিছুই বলতে চায় নি, অনেক পীড়াপীড়ির পর জানিয়েছে, ‘বড়া সাব কো বোলেগা’। শাসন এবং তোষণ সমভাবে ব্যর্থ হবার পর, অন্য কোনো অশক্ত বা অনিচ্ছুক লোকের ঘাড়ে ডেক চাপানো বিপজ্জনক মে করে, গত্যন্তর না দেখে তিনি আমাকে স্মরণ করেছেন। 

রন্ধন-মহলের বারান্দায় আসামীকে আমার সামনে হাজির করতেই নিখুঁত মিলিটারী কায়দায় সেলাম করে বলল, নালিশ হ্যয় হুজুর। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, না। ওই ডেক যতক্ষণ না নামছে, ততক্ষণ কোনো নালিশ নেই। একটু যেন থমকে গেল লোকটা। চোখ দেখে বুঝলাম, এ উত্তর সে আশা করে নি। মিনিটখানেক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল আমার দিকে চেয়ে। তার পর সঙ্গীকে ইশারা করে ঘরের কোণ থেকে তুলে নিল বাঁশ। পর পর সব ডেকগুলো যখন নামানো হয়ে গেল, ডাকিয়ে এনে বললাম, বলো, কী তোমার নালিশ! গম্ভীর তাচ্ছিল্যের সুরে উত্তর এল : কুছ নেহি। —বলেই চলে গেল সামনে থেকে। জেলখানার বড় সাহেব আমি। একটা সাধারণ কয়েদীর এই উদ্ধত আচরণে অপরাধ নেবার কথা। নেওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু ওই ছ-ফুট-লম্বা শিশুটার মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে হেসে ফেললাম। ভেল-খাটা মানুষের সেই চিরন্তন অভিমান। এর পরের স্তরগুলোও আমার মুখস্থ। বিনা কারণে মেজাজ দেখানো, কাজ না করা, এবং শেষ পর্যন্ত হয়তো হাঙ্গার-স্ট্রাইক। এই গ্রন্থেরই দ্বিতীয় পর্বে এ নিয়ে একটা গবেষণামূলক লেকচার দিয়েছি। পুনরুক্তি দিয়ে নতুন করে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। পদোচিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললাম, কী নাম তোমার? 

গুলাব সিং। 

মিথ্যা কথা বলছে হুজুর। —সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানাল রন্ধনশালার মেট : ওর আসল নাম নসরুল্লা। 

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই মাথা নেড়ে বলল, জী, ওভি মেরা নাম হ্যয়। 

আমার অনুচরদের মুখে কিঞ্চিৎ চাপা হাসি দেখা দিল। জেলরবাবু বললেন, একই সঙ্গে গুলাব সিং আর নসরুল্লা! কোন্‌ জাত তুমি? 

উত্তরে যা শুনলাম, সে এক বিচিত্র ইতিহাস। গুলাব সিং আসলে শিখ। বাড়ি ছিল পাঞ্জাবের কোন্ গ্রামে। ওর বয়স যখন তিন বছর, বাপ চলে গেল ফৌজে, আর ফিরল না। থাকবার মধ্যে ছিল শুধু মা। বছরখানেকের মধ্যে সেও চোখ বুজল। চার বছরের শিশুর আশ্রয় জুটল এক প্রতিবেশী মুসলমান-পরিবারে। সেইখানেই সে মানুষ, এবং তাদেরই দেওয়া নাম ওই নসরুল্লা। আঠারো বছরে পড়তেই ফৌজে নাম লিখিয়ে বর্মা ফ্রন্টে চলে গেল গুলাব সিং। লড়াই মিটে যাবার পর ঘরে ফিরে দেখল, তার আশ্রয়দাতাও ওপারে পাড়ি দিয়েছেন। সংসারে আর কোনো বন্ধন রইল না। দিন কয়েক এখানে ওখানে টহল দিয়ে রোজগারের খোঁজে চলে এল বাংলা মুলুক। নকরিও জুটে গেল হুগলির এক চটকলে। কিছুদিন পরে পাশের বস্তির একটি মেয়ের সঙ্গে হল মন-জানাজানি, তাকে নিয়েই ঘর বাঁধল নসরুল্লা। কিন্তু সে ঘর তার টিকল না। শয়তানের নজর পড়ল ওর সুন্দরী বিবির উপর; আর সেও গোপনে সাড়া দিয়ে বসল। সন্দেহের জ্বালা বুকে নিয়ে ছটফট করে দিন যায় নসরুল্লার। একদিন অসময়ে কাজ পালিয়ে ঘরে ফিরে যা দেখল, তার পর আর মাথা ঠিক রাখা সম্ভব হল না। পাশেই ছিল একটা নেপালী পরিবার। ছুটে গিয়ে তাদের ঘর থেকে নিয়ে এল ভোজালি। আমরা রুদ্ধনিশ্বাসে অপেক্ষা করে রইলাম। তার পর চমকে উঠলাম।

এই পর্যন্ত এসে হঠাৎ থেমে গেল নসরুল্লা। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, দূরে একটা গাছের দিকে। 

দুনোকো কাট।—সহজ শান্ত সুরে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল নসরুল্লা। 

চমকে উঠেছিলাম; ‘কাট দিয়া’ শুনে নয় (আমার রাজ্যে ওটা নতুন নয়, অসাধারণ বস্তুও নয়), যে ভাবে, যে নিরুত্তাপ ঔদাসীন্যে কথাটা আউড়ে গেল, তাই দেখে। ভোজালির মুখে যেন উড়ে গেল দুটো হাঁস কিংবা মুরগির গলা।  

হাকিমের কাছে সব কম্বুরই কবুল করেছিল গুলাব সিং। চরম দণ্ডের জন্যে জন্যে তৈরীও ছিল মনে মনে। কিন্তু কোর্টের কী মরজি হল! দশ বছর জেল দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন জেলখানায়। মাসখানেকের মধ্যেই ছোট জেল থেকে চালান হয়ে এল বড় জেলে। ফৌজী চেহারা দেখে বড় জমাদার লাগিয়ে দিল চৌকায়। তার পর থেকে ওই ডেক বয়ে বয়ে কড়া পড়ে গেছে কাঁধের ওপর। তার জন্যে তার কোনো ক্ষোভ নেই। নালিশ যা ছিল, তাও আর জানাতে চায় না। 

বললাম, কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে জেলের যে নালিশ, তার বিচার এখনও হয় নি। 

উসকো বাস্তে হাম হাজির হয়, সাব।—অ্যাটেনশন হয়ে তৎক্ষণাৎ জবাব দিল নসরুল্লা। 

কতদিন ফৌজে ছিলে তুমি? 

পাঁচ বরষ। 

আজ এখানে যে কসুর তুমি করেছ, সে ঘটনা যদি ঘটত তোমার পল্টনের কুক-শেড়ে, বলতে পার কী হত সেই বাবুর্চীর? 

কোর্ট মার্শাল। 

তার পর? 

গোলি।—বলে বুকের উপর আঙুল রাখল গুলাব সিং। 

আর কিছু আমি বলতে চাই না। মনে রাখতে চেষ্টা কোরো- যেখানে আছ, এও তোমার সেই ফৌজ। 

নসরুল্লা জবাব দিল না। তার সেই মিলিটারী স্যালুট ঠুকে নিঃশব্দে জানিয়ে দিল, সে কথা ভুলবে না। 

গুলাব সিং মুখ ফুটে না বললেও তার নালিশের আসল বিষয়ট। জানতে চেষ্টা করলাম। গোপন সূত্র থেকে কয়েকদিন পরেই সমস্ত ব্যাপারটা পাওয়া গেল। 

ডেক-তোলা পল্টনের সৈন্য-সংখ্যা ছিল তিন। বাকী দুজনের নিয়মিত ডিউটি-বদল হতো। এ-বেলা যার খাটনি, ও-বেলা তার মাপ। কিন্তু নসরুল্লা ছিল কমন ফ্যাক্টর। ও-পাশে যেই থাকুক, এ- পাশের বাঁশ পড়বে তারই কাঁধে। তার কারণ, মেট নামক ব্যক্তিটিকে খুশী করবার যে সব আর্ট, সেগুলো সে আয়ত্ত করতে পারে নি কিংবা ইচ্ছা করেই করে নি। এ সব দিকে খেয়ালও বিশেষ ছিল না। হঠাৎ সে দিন কী মনে করে আপত্তি জানিয়ে বলে বসল : সব কাম বাইনাম্বারসে হোনা চাইয়ে। মেট এবং তার দলবল পল্টনিয়া বলে ওকে প্রায়ই ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। বাইনাম্বার শুনে তারই মাত্রা গেল বেড়ে। মেজাজ চড়ে গেল নসরুল্লার। বাঁশ ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল চৌকা থেকে। বাকী দুজন যারা ছিল, তার মধ্যে একটি মেটের ইঙ্গিতে ‘পেটমে দরদ হ্যয়’ বলে চলে গেল হাসপাতাল। একজন দিয়ে তো আর ডেক টানা চলে না। দেখা দিল, যাকে বলে, গুরুতর পরিস্থিতি। একটা বাইনাম্বার থেকে এক হাজার লোকের অনশনের উপক্রম। 

রন্ধনশালার দিকে যথোচিত নজর দিলেন কর্তৃপক্ষ। মেটকে যেতে হল ‘চক্কর’-পাহারায়; অর্থাৎ তার মেটগিরির এলাকা মানুষের ওপর থেকে সরে গেল দেয়ালের ওপর। নির্জন পাঁচিলের একটা নির্দিষ্ট অংশে উদয়াস্ত টহল দেওয়া—ওইখান দিয়ে কেউ না পালায়। তার দুষ্টচক্রে আর যারা ছিল, তাদের কেউ গেল ডাল ভাঙতে, কারও হাতে উঠল তাঁতের মাকু কিংবা বাগানের কোদাল। ডেকের লোক বাড়িয়ে দিয়ে নিয়মমত ‘সুস্থি’ বা বিশ্রামের ব্যবস্থা হল নসরুল্লার। দিন চারেক পরে চৌকা-মহলে রাউণ্ডে গিয়ে দেখি, বাঁশ হাতে দাঁড়িয়ে আছে গুলাব সিং, ঠিক সামনেই টগবগ করে ভাত ফুটছে, কখন তৈরি হবে তারই অপেক্ষায়। জিজ্ঞাসা করলাম, কী খবর, গুলাব সিং? এবার বাইনাম্বারসে কাজ হচ্ছে তো? সলজ্জ হাসির একটা ঝিলিক বিদ্যুৎচমকের মতো খেলে গেল তার মুখের ওপর। পরক্ষণেই গম্ভীর মিলিটারী কণ্ঠে সশ্রদ্ধ জবাব : জী সাব। 

সেদিন গুলাব সিংয়ের মামলা মিটে যাবার পর সদলবলে আপিসের দিকে ফিরছিলাম। ‘রাইটার’দের গুমটির কাছে আসতেই কানে গেল একটি পাঠরত উদাত্ত গভীর সুর- 

ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণ- 
স্তমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্। 
বেত্তাসি বেদ্যঞ্চ পরঞ্চ ধাম
ত্বয়া ততং বিশ্বমনস্তরূপ।।

ভগবদ্গীতার সেই বহুশ্রুত অমর শ্লোক। কিন্তু এই পরিবেশে এমন করে কোনোদিন শুনি নি। আপনা হতেই যেন যতি পড়ল আমাদের সমবেত গতিচ্ছন্দে। গীতা চণ্ডী কিংবা অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ আবৃত্তিই ছিল ব্রহ্মচারীর অবসরযাপনের সঙ্গী। এ খবর আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু সে আবৃত্তি যে এত মধুর, এমন স্বচ্ছন্দ-সুরময়, তার আবেদন যে এত অনায়াসে অন্তরকে স্পর্শ করে, সেটুকু জানবার সুযোগ হয় নি। মিনিট কয়েক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার পর হঠাৎ খেয়াল হল, আমার পদমর্যাদা এবং অনুচরবৃন্দ-সহ এই মাঝপথে থেমে গিয়ে গীতাপাঠ-শ্রবণ—এ দুয়ের মধ্যে কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি রয়ে গেছে। অতএব ক্যারাভান সচল হল। ‘সেল’-ব্লক পেছনে ফেলে এক নম্বর বাগানের পাশ দিয়ে বড় সড়কে গিয়ে পড়লাম। গুমটি অদৃশ্য হয়ে গেল। স্তব্ধ মধ্যাহ্নের রৌদ্রক্লান্ত গাছপালার ভিতর দিয়ে তখনও ভেসে আসছিল বহুযত্নে অধীত সু-উচ্চারিত দেবভাষার সুললিত ছন্দ— 

অনন্তবীর্যামিতবিক্রমত্তং 
সর্বং সমাপ্লোষি ততোঽসি সর্বঃ। 

বিশ্বরূপদর্শন যোগের এই শ্লোক কটি আমিও একদিন নিষ্ঠা এবং স্বত্নের সঙ্গে পাঠ করেছি। কিন্তু সে শুধু পাঠ এবং তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ অর্থবোধ। শব্দ ও অর্থের বন্ধন অতিক্রম করে পঠিত বস্তু যে সমূর্ত ও সপ্রাণ হয়ে উঠতে পারে, সে দৃশ্য আজ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম। 

“হে অনন্তবীর্য, তুমি অমিতবিক্রমশালী। তুমি সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত হইয়া আছ, অতএব তুমি সর্বস্বরূপ। তুমি ভিন্ন অন্য কিছুরই স্বতন্ত্র সত্তা নাই।” 

প্রথম দিকে ব্রহ্মচারীর গীতার আসরে শ্রোতার সংখ্যা ছিল সামান্য। তার প্রিয় শিষ্য সহদেব ঘোষ এবং তারই দু-একটি বন্ধু। ক্রমশ পাঠচক্র বিস্তৃত হল, এবং কয়েক সপ্তাহ যেতেই দেখা গেল, রবিবারের মধ্যাহ্ন-সমাবেশে শ্রোতার দল রাইটারদের গুমটি ঘর ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সামনেকার আঙিনায়-বেলগাছের ছায়ায় ঠাসাঠাসি ভিড়। তারা এসেছে বিভিন্ন ইয়ার্ড থেকে, এবং এই বে- আইনী ব্যাপারে—জেলকোডে যার নাম ‘ব্রেকিং ফাইল’ – স্থানীয় আইন-রক্ষকদের বিশেষ কোনো কড়াকড়ি নেই। ভিড়টা শুধু কয়েদীর নয়, কোণের দিকে সাদা পোশাকে বসে গেছে কোনো তিলকধারী দেশোয়ালী সিপাই কিংবা পঞ্চাশোর্ধ্ব জমাদার। ব্যাপারটা সরকারীভাবে আমার গোচরে আনলেন সরকার-নিযুক্ত অবৈতনিক ধর্ম-শিক্ষক, সাপ্তাহিক আড়াই টাকা রাহাখরচের বিনিময়ে যিনি আমার পাপমগ্ন পোষ্যদের কানে কিঞ্চিৎ ধর্মোপদেশ দান করে থাকেন। কয়েদীমহলে ধর্মের প্রতি ঔদাসীন্য যে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, সে জন্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি কিঞ্চিৎ উষ্মার সঙ্গে বললেন, জঘন্য অপরাধ করে যে লোকটা জেল খাটতে এল, সে যদি ধর্মশিক্ষক হয়ে দাঁড়ায়—। কথাটা সম্পূর্ণ হল না; বাকিটুকু মুখে একটা শব্দ করে হাতের ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলেন। পণ্ডিত মশায়ের ক্রোধ সঞ্চারের কারণ ছিল। লোকসংখ্যা তাঁর ক্লাসে বরাবরই কম। সম্প্রতি সেটা দু-তিনজনে এসে ঠেকেছিল। বিষয়টা যে গুরুতর সবিনয়ে স্বীকার করে যথারীতি প্রতিকারের আশ্বাস দিলাম। কিন্তু তিনি বিশেষ আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হল না। পরের সপ্তাহে তিনি এলেন না, তার বদলে এল তাঁর ছুটির দরখাস্ত। 

ব্রহ্মচারীকে ডেকে পাঠিয়ে বললাম, শুনেছি জেলে আসবার আগে আপনি কথকতা করতেন? 

উত্তর এল সলজ্জ হাসির সঙ্গে, জীবিকার জন্যে লোকে অনেক কিছু করে। আমিও করতাম। তবে ওটা কথকতা নয়, কথা বেচা। 

বললাম, এখানে অবশ্যি সে সুবিধে নেই। কিছুদিন বিনামূল্যে চালাতে আপত্তি কী? 

আমার ওপর আপনার অশেষ অনুগ্রহ। কিন্তু এ দায়িত্ব নেওয়া কি আমার পক্ষে উচিত হবে? 

অনুচিত মনে করছেন কেন? 

আমিও ওদের মতো কয়েদী। ওরা আমার কাছে আসবে কি? 

গীতাপাঠ শুনতে তো আসে, দেখছি। 

ব্রহ্মচারী যুক্তকর কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ওই পবিত্র গ্রন্থের ওপর যাদের শ্রদ্ধা আছে তারাই বোধ হয় আসে। পাঠটা এখানে নিতান্তই গৌণ। 

বললাম, আমিও ঠিক তাই চাই, ব্রহ্মচারী। ধর্মের ওপর যদি কারও অন্তরের টান থাকে, তারাই এসে বসুক আমাদের এই রবিবারের ধর্মসভায়। যাদের নেই, কিংবা বক্তব্যের চেয়ে বক্তার নাম-ধামের দিকে যাদের নজর বেশী, তাদের টেনে এনে কী লাভ? আমার বিশ্বাস, জোর করে অনেক কিছু করা যায়; কিন্তু মানুষকে ধার্মিক বানানো যায় না। 

ব্রহ্মচারী এ প্রসঙ্গের কোনো উত্তর দিলেন না। জোড়হাত করে বললেন, আমাকে কী আদেশ করছেন? 

যা করতে বলছি, ঠিক ‘আদেশে’র কোঠায় পড়ে না, বরং অনুরোধ বলতে পারেন। নতুন কিছু নয়। যা করছিলেন, ওইটাই একটু ব্যাপকভাবে করতে হবে। অর্থাৎ রবিবারের আসরটা গুমটি-ঘরের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যেতে হবে পাঁচ নম্বরের বারান্দায়। আর বক্তব্য বিষয়? সেটা আর আপনাকে কী বলব? সকলের না হলেও অনেকের যা মাথায় ঢোকে এবং মনটাও একটু ছুঁয়ে যায়, এমনি ধারা কিছু একটা বেছে নিলেই হল। 

আমার তরফে চেষ্টার কোনো ত্রুটি হবে না। বলে নমস্কার করে প্রস্থান করলেন ব্রহ্মচারী। 

একটা রবিবার পেরিয়ে যাবার দু-তিন দিন পর মাতব্বরগোছের কয়েকজন কয়েদী জেলরবাবুর আপিসে এসে জানালেন, তাঁরা আমার দর্শন প্রার্থী। প্রার্থনা মঞ্জুর হল। ওঁদের মধ্যে সবচেয়ে যিনি বিজ্ঞ, মুখপাত্ররূপে নিবেদন করলেন : বাইরে থেকে যে পণ্ডিতজী এসে থাকেন, তাঁকে আর কষ্ট দেবার প্রয়োজন নেই; এখন থেকে তাদের সাপ্তাহিক ধর্মোপদেশের ভারটা ব্রহ্মচারীর উপরেই ছেড়ে দেওয়া হোক। তাঁকে সমর্থন করলেন ডেপুটেশনের দ্বিতীয় মেম্বর, আমাদের গোশালার মেট : হ্যাঁ, হুজুর, ওই ব্যবস্থাই পাকা করে দিন। আহা! পাগলা ঠাকুরের গল্প যা শুনলাম, কেউ আর শুকনো চোখে উঠে যেতে পারে নি। 

পাগলা ঠাকুরের গল্প! 

পরমহংসদেবের কথা বলছে, স্যর। —সস্নেহ হাসির সঙ্গে বললেন মুখপাত্র : তাঁরই লীলা-প্রসঙ্গ আলোচনা করছিলেন ব্রহ্মচারী। 

হংস-টংস জানি না বাপু।—একটু বিরক্তির সুরে মন্তব্য করলেন মেট, সোজাসুজি বুঝি আমাদের পাগলা ঠাকুর। বিছানার তলায় কোথায় দুটো পয়সা পড়ে আছে; তার জন্যে সারারাত ঘুম নেই; এক হাতে টাকা আর এক হাতে মাটি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছ—টাকা মাটি, মাটি টাকা, তারপর সবসুদ্ধ গঙ্গার জলে ছুঁড়ে ফেলে তবে নিশ্চিন্দি। এ কি যে-সে পাগল! 

অথচ সেই টাকার জন্যে কী না হচ্ছে দুনিয়ায়! — দার্শনিক গাম্ভীর্যের সঙ্গে যোগ করলেন তৃতীয় ব্যক্তি, আমাদের দরজিশালায় পাহারা। টুপির চারদিকে লাল ফিতার বর্ডার দেখে বুঝলাম তিনি একটি দায়মলি, অর্থাৎ খুনের অপরাধে যাবজ্জীবন দণ্ড নিয়ে এসেছেন জেলখানায়। মেটের তখন রীতিমত ভাব এসে গেছে। সেই আবেগের সুরেই বলে চললেন, অনেকটা আপন মনে : মাঘ মাসের কনকনে শীত। কোঁচার খুঁট ছাড়া দ্বিতীয় বস্তুর নেই। রানীমা নিজে হাতে একখানা দামী শাল দিয়ে গেলেন। গায়ে দিয়ে কোথায় বাঁচবে, না, হাঁপ ধরে গেল ঠাকুরের। টান মেরে ফেলে দিয়ে প্রাণটা জুড়োয়।… কী সুন্দর করে বললে আমাদের বেহ্মচারী : মা যাকে দু হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে আছেন, শাল দিয়ে সে করবে কী? মাঘের শীত তার গায়ে লাগলে তো? 

জেলখানার জনমত যাই হোক, একজন কয়েদীকে সরকারীভাবে তাদের ধর্মশিক্ষক নিযুক্ত করা যায় না। সে এক্তিয়ারও আমার নেই। রিলিজিয়স্ টীচারদের নিয়োগকর্তা ডিভিশনাল কমিশনার। সে নিয়োগ ঘোষণা করে সরকারী গেজেট। ব্রহ্মচারীর পক্ষে এ-হেন পদলাভ কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু সপ্তাহান্তে পদহীন শিক্ষকের বেসরকারী আসন প্রায় স্থায়িভাবেই তার দখলে এসে গেল। দেখলাম, পণ্ডিতজী লোকটি সত্যই পণ্ডিত। ধন এবং মান দুটো যেখানে ধরে রাখা সম্ভব নয়, বুদ্ধিমানের মতো অর্ধং ত্যজতি সূত্র গ্রহণ করে প্রথমটা অর্থাৎ মাসিক দশ টাকার মায়া ত্যাগ করলেন। ছুটি ফুরিয়ে যাবার পরেও প্রতি রবিবারে তাঁর ‘কাজের চাপ’ কিংবা ‘শারীরিক অসুস্থতা’ নিয়মিতভাবে দেখা দিতে লাগল, এবং আমার গোশালার মেট ও তার বন্ধুদের পাগলা ঠাকুরের গল্প শোনায় কোনো বাধা রইল না। 

.

অনেক দিন আগে একটি ভ্রমণকারী ইংরেজ-দম্পতি আমার জেল দেখতে এসেছিলেন। কথায় কথায় স্ত্রী প্রশ্ন করলেন, যারা জেল খাটে, ডু দে আর্ন এনিথিং? বললাম, না। স্বামীটি সুরসিক। সহাস্যে প্রতিবাদ করলেন, হোয়াই, দে আর্ন দেয়ার ফ্রীডম! ঠিকই বলেছিলেন ভদ্রলোক। আমার এই পান্থশালায় অনির্দিষ্ট বাস নিষিদ্ধ। নির্ধারিত কাল শেষ হলে সবাইকেই যেতে হয়। একটি করে দিন যায়, আর সেই মুক্তির দিনটি এক ধাপ করে এগিয়ে আসে। জেলখাটা মানেই মুক্তি-অর্জনের সাধনা। সে দিন কারও দ্রুত আসে, কারও বা বিলম্বে। ডোরাকাটা জাঙিয়া কুর্তা এঁটে কোমরে গামছা জড়িয়ে দিনের পর দিন যাকে দেখে এসেছি মাকু চালাতে কিংবা লোহা পিটতে, হঠাৎ একদিন সকালবেলা আপিসে গিয়ে দেখলাম, সদ্য-কাচা ধুতি আর পাটভাঙা শার্ট পরে সে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার টেবিলের ও পাশটিতে। খালাস-দপ্তরের ডেপুটিবাবু ওয়ারেন্ট থেকে উচ্চকণ্ঠে মিলিয়ে নিলেন তার নাম-ধাম-বিবরণ। তার পর তার প্রসারিত হাতের ওপর গুনে দিলেন খোরাকির পয়সা আর সেই সঙ্গে একখানা রেলের পাস। সেলাম করো। – শেষ হুঙ্কার দিলেন বড় জমাদার। শেষবারের মতো পালিত হল তাঁর অমোঘ আদেশ। কেউ আবার সেলামের ঠিক ভঙ্গিটি এড়িয়ে গিয়ে মৃদু হেসে হাত দুখানা তুলল একবার কপালের কাছাকাছি। বোধ হয় জানাতে চাইল, এতদিন যে সম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে—শাসক আর শাসিতের সম্পর্ক—আজ তার অবসান; তাই রেখে যাচ্ছে একটি সসঙ্কোচ নমস্কার বিদায়-বেলার শ্রদ্ধা ও প্রীতির নিদর্শন। 

এমনই ভাবেই একদিন দেখা হয়ে গেল সহদেব ঘোষের সঙ্গে। অ্যাটেনশন নয়, নত হয়ে জোড় হাত করে দাঁড়িয়ে ছিল আমার টেবিলের ও-পাশে খালাসী-কয়েদীর নির্দিষ্ট জায়গায়। বড় জমাদারের হুকুম শুনে না ঠুকল সেলাম, না জানাল নমস্কার; কেঁদে উঠল হাউ হাউ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল পা দুটো, যেমন করে ধরেছিল আর-একদিন, আদায় করেছিল গুরুসেবার অধিকার। সেদিনের অভিজ্ঞতার পর, আজ আর বাধা দেবার চেষ্ট। করলাম না। খানিকক্ষণ পরে ও নিজেই উঠে বসল এবং চোখ মুছে বলল, আমার গুরুকে দেখবেন। আমার তো আর থাকবার উপায় নেই। ছেলেটা রইল; ওই দুটো ভাত ফুটিয়ে দেবে। 

বললাম, বেশ; তাই হবে। 

আর-একটা ভিক্ষা চাইছি যাবার সময়। জানি, না বললেও আপনি করবেন। তবু মন মানে না। আপনার কলমে যতখানি আছে, মাপ দিয়ে গুরুকে আমার তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন। 

কিন্তু আমার কলমের দাক্ষিণ্য পুরোপুরি বর্ষণ করবার আগেই হঠাৎ একদিন হুকুম এল : স্ট্রাইক দি টেন্ট। শুরু হল প্যাকিং। ওখানকার মেয়াদ আমার শেষ হল। কিন্তু ব্রহ্মচারীর মেয়াদ তখনও বছর তিনেক বাকী। চার্জ দেবার আগের দিন সমস্ত কয়েদীর স্পেশাল ফাইলের হুকুম দিলেন জেলরবাবু। শেষবারের মতো শুনতে হবে বাকী রইল কার কী নালিশ, অপূর্ণ রইল কার কোন্ আবেদন। শুনলাম, এবং যা শুনলাম, তার কতক মিটিয়ে আর বেশীর ভাগ মেটাবার বৃথা আশ্বাস দিয়ে আপিসে ফিরে এসেই ব্রহ্মচারীকে ডেকে পাঠালাম। সঙ্গের সিপাইটিকে ইঙ্গিতে সরিয়ে দিয়ে বললাম, কই, তুমি তো কিছুই চাইলে না ব্রহ্মচারী? কুণ্ঠানত চোখ দুটো হঠাৎ একবার চমকে উঠে তাকাল আমার দিকে। তার কারণ বোধ হয় যাবার দিনে আমার এই প্রথম ‘তুমি’ সম্বোধন। আমার মুখে ‘আপনি’ শুনতেই সে অভ্যস্ত। এই কথাটির মধ্যে যে দূরত্ব আছে, তার জন্যে সদানন্দের মনে মনে একটা গোপন দুঃখ ছিল, যা কোনো- দিন মুখ ফুটে না বললেও আমি টের পেয়েছি। তবু আমার রাজ্যে সে একক, সকলের চেয়ে স্বতন্ত্র, এই সুস্পষ্ট সত্যকে স্বীকৃতি দেবার জন্যেই বোধ হয় আমার মুখ থেকে আপনা হতেই ‘আপনি’ বেরিয়ে যেত। চলে যাবার ক্ষণে তেমনি আপনা হতেই আজ ‘তুমি’ বেরিয়ে গেল। 

ব্রহ্মচারীর শীর্ণ মুখের উপর ফুটে উঠল একটি জোরকরে-টেনে- আনা ম্লান হাসি। আমার প্রশ্নের সরাসরি জবাব পেলাম না। তার বদলে এল একটি সনিশ্বাস স্বগতোক্তি; না চাইতেই যা পেয়েছি, সে শুধু আমার অন্তর্যামীই জানেন। 

হয়তো তাই। দার্শনিক মানুষ; কী দেখেছে, কী পেয়েছে, সে-ই জানে আর জানেন তার অন্তর্যামী। আমার অ-দার্শনিক সাদা চোখে তা পড়বার কথা নয়। আমি জানি, ওর জন্যে যা করব ভেবেছিলাম, তা করতে পারি নি। ভেবেছিলাম, আরও কিছুদিন গেলে বাকী মেয়াদটা মকুব করবার সুপারিশ জানিয়ে একটা প্রস্তাব পাঠাব সরকারের কাছে। কোন্ ভরসায় এবং কোন্ যুক্তিবলে এ ইচ্ছা আমি মনে মনে পোষণ করেছিলাম, সেটা একটু বিশদভাবে বলা প্রয়োজন। 

বিচারককে যে রাস্তায় চলতে হয়, তার পরিসর অতি সংকীৰ্ণ, চারদিকে প্রসিডিওর-কোড এবং এভিডেন্স-অ্যাক্টের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেখানে হৃদয়বৃত্তির প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু সরকার নামক যে সর্বশক্তিমান যন্ত্র মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে, তার পথ অনেক প্রশস্ত। সেটাও আইনের প্লাস্টার দিয়ে গাঁথা কংক্রীট রোড, কিন্তু তার মাঝে মাঝে আছে নরম মাটির ফাঁক কিংবা কোমল ঘাসের আস্তরণ। আদালতের প্রধান লক্ষ্য অপরাধী নয়, তার অপরাধ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে, সে লঘু না গুরু, যে ব্যক্তিটি সে প্রশ্ন অবান্তর; বিচার্য বিষয় তার কৃতকর্মের লঘুত্ব বা গুরুত্ব। বিচারককে অন্ধ বলা হয়। আসলে তিনি অন্ধ নন, একচক্ষু। রেল-কোম্পানির একমুখী লণ্ঠনের মতো তাঁর দৃষ্টি ও শুধু একটি দিকে প্রসারিত-উপস্থাপিত অভিযোগের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পর্ক কী এবং কতখানি, সাক্ষ্যপ্রমাণের আলোয় তারই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। সে সম্পর্ক সাব্যস্ত হল কি না এবং কতটা সাব্যস্ত হল, এইটুকু দেখেই তিনি নিশ্চিন্ত। পিছনে দাঁড়িয়ে যে বিচিত্র মন, যে দুয়ে প্রেরণা, যে আবাস্থিক জটিলতা ওই লোকটিকে টেনে নিয়ে গেছে ওই বিশেষ অপরাধের আওতার মধ্যে, বিচারশালার একদর্শী লণ্ঠনের সন্ধানী আলো সেখানে পৌঁছয় না। 

কিন্তু সরকারের হাতে যে লণ্ঠন, সেটা চতুর্মুখ অপরাধের বে চিত্র আদালতে উদ্ঘাটিত হল, তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তার আলো ছড়িয়ে আছে ওই অপরাধী মানুষটার পেছনে সামনে, ডাইনে বাঁয়ে। সে কোথায় ছিল, কোথায় এসেছে, কেন এল এবং ভবিষ্যতে কোথায় যাবে, সব দিকে দৃষ্টি রেখে রাষ্ট্রকে চলতে হয়। বিচারক দণ্ড দিয়েই ক্ষান্ত; পরের অংশ অর্থাৎ দণ্ডিতের বোঝা পড়ল গিয়ে শাসকের ঘাড়ে। সে ভার বইতে গিয়ে তাকে তাকিয়ে দেখতে হয় কাঠগড়া এবং কারাপ্রাচীরের বাইরে, খুঁজতে হয় অপরাধ নামক ওই বিশেষ কার্যটির অন্তরালে লুকিয়ে আছে কোন্ রহস্যময় গোপন শক্তি, কোন্ সামাজিক পারিবারিক কিংবা পারিপার্শ্বিক ব্যাধির তাড়না! সেইখানেই শেষ নয়। সেই সঙ্গে দেখতে হয় তাদেরও, অপরাধী লোকটার চারদিকে যারা ছড়িয়ে আছে কিংবা একদিন জড়িয়ে ছিল।

তা ছাড়া, যাকে আমরা ক্রিমিন্যাল বলি, তার সবখানিই তো ক্রিমিন্যাল নয়। জেলের মধ্যে তার যে পরিচয়, তার বাইরেও তার একটা সত্তা আছে, যেখানে সে বৃহত্তর সমাজের জীব, মানুষের দরবারে একাধারে দাতা এবং প্রার্থী। সমাজকে সে কিছু দিতে চায়, কিছু আবার পেতেও চায় তার হাত থেকে। সেই আদানপ্রদানের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে দীর্ঘ অবরোধে যখন তার জীবন কাটে, সেটা শুধু তার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ক্ষতি নয়, সামাজিক অপচয় 

এই সব দিকে তাকিয়ে এবং এই কথা মনে রেখে আদালত যে দণ্ডবিধান করেন, রাষ্ট্র তাকে অনড় ও অব্যয় বলে মেনে নিতে পারে না। মানবগোষ্ঠীর সর্বব্যাপী স্বার্থের দিকে চেয়ে আইনপ্রদত্ত অবরোধ বা কারাবন্ধনের কবল থেকে কোনো কোনো বন্দীকে ফিরিয়ে আনতে হয় তার ফেলে-যাওয়া বৃহত্তর জীবনের মধ্যে; প্রয়োগ করতে হয় দণ্ডিতের দণ্ড হ্রাস করবার বিশেষ ক্ষমতা। আইনের দাবি অলঙ্ঘ্য হলেও চূড়ান্ত নয়। তার কারণ, আইনের চেয়েও মানুষ বড়। 

এই সূত্রে সুধীন ব্যানার্জি নামে একটি ছোকরা কয়েদীর কথা এসে পড়ল। সেটুকু শেষ করেই আসল প্রসঙ্গে ফিরে আসব। 

ঘন ঘন খানাতল্লাশ জেল-ডিসিপ্লিনের একটি প্রধান অঙ্গ। এমন অনেক জিনিস আছে, যেগুলো জেলের বাইরে নিতান্ত নির্দোষ, কিন্তু পাঁচিল পার হয়ে ভিতরে এলেই মারাত্মক। আপনার পকেটে একখানা ছুরি বা হাতে এক টুকরা দড়ি দেখলে আমি বিচলিত হব না। কিন্তু ওই দুটি তুচ্ছ বস্তু যখন বেরিয়ে আসে আমার কয়েদীর কম্বলের ভাঁজ কিংবা স্যাণ্ডালের সুকতলার তলা থেকে, তখন আর আমি নির্বিকার থাকতে পারি না। নস্যের মতো নিরীহ দ্রব্য সংসারে আর কী আছে? মানুষের সমাজে সবচেয়ে যারা নির্বিরোধ, যাদের আমরা বলি ব্রাহ্মণপণ্ডিত, তাদেরই ওটা নিত্যসহচর। পাত্রাধার তৈল কিংবা তৈলাধার পাত্র এই জাতীয় সূক্ষ্ম নৈয়ায়িক তর্কের সহজ মীমাংসার জন্যেই নস্যের প্রয়োজন, এই কথাই তো জানা ছিল। জেলখানায় এসে দেখলাম, নস্ত্য নামক মহাবস্তুর আর-এক মূর্তি, বড় বড় পণ্ডিতের কল্পনায় যা কোনোদিন আসে নি। এক দল ভারী-মেয়াদী দুর্দান্ত কয়েদী চালান হয়ে যাচ্ছিল এক জেল থেকে আর-এক জেলে। লোহার জালে ঘেরা সুরক্ষিত প্রিজন ভ্যান। চল্লিশ মাইল বেগে ছুটে চলেছে ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে। দু পাশে দুটি রাইফেলধারী সিপাই। হঠাৎ এক কয়েদীর দেহের কোন গুপ্ত স্থান থেকে বেরিয়ে এল একটি সুদৃশ্য নস্যের ডিবা এবং তারই সুগন্ধিচূর্ণে আচ্ছন্ন হয়ে গেল দু জোড়া সতর্ক চক্ষু। চোখের পলকে একখানা ক্ষিপ্র হাত তাদেরই একজনের পকেট থেকে তুলে নিল চাবির গোছা। দরজা খুলতে লাগল কয়েক সেকেণ্ড। সিপাইদের হল্লা শুনে ড্রাইভার গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছিল। খানিকটা গুঁড়ো চোখে পড়তেই পায়ের চাপ পড়ল ব্রেকের উপর। মিনিট কয়েক পরে তাকাবার মতো অবস্থা যখন ফিরে পেলেন সিপাইজীরা, দেখলেন, প্রিজন ভ্যান শূন্য এবং ফাঁকা মাঠের এখানে ওখানে দু-চারজন নিরীহ গোপালক ছাড়া জনমানবের চিহ্ন নেই। 

যথাসময়ে সার্চ বা তল্লাশি নামক অস্ত্রটি যদি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা হত, ওই ডিবাটি এত বড় একটা বিপর্যয় ঘটাতে পারত না। সুতরাং জেলকর্মীদের কর্মসূচির একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে ওই সার্চ। যখন-তখন ছোট-বড় দল নিয়ে এখানে-ওখানে হানা দিয়ে তারা খুঁজে বেড়ায়, জেল কোডের ভাষায় যার নাম prohibited article বা নিষিদ্ধ বস্তু। ওই বিশাল গ্রন্থের একটা গোটা পাতা জুড়ে রয়েছে তার দীর্ঘ তালিকা। অস্ত্রশস্ত্র, দড়ি, বাঁশ, টাকাকড়ি, হরেক রকম নেশার উপকরণ—এ সব তো বটেই, তা ছাড়াও ওই দলে পড়ে বই খাতা চিঠিপত্র কিংবা অন্য কোনো জিনিস, তার পেছনে যদি না থাকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা অনুমোদন। 

এমনি এক সার্চ-পার্টি একদিন সুধীন ব্যানার্জির কম্বলের তলা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এল খান দুই চিঠি, যার উপরে না ছিল জেল- অফিসের রবারস্ট্যাম্প, না পাওয়া গেল সুপারের স্বাক্ষর। মাল- সমেত আসামীকে আমার দরবারে হাজির করা হল। তার সঙ্গে লিখিত অভিযোগ—ফাউণ্ড ইন পজেশন অফ, আঅথরাইজড লেটারস্। হুখানা চিঠিই ওর চিঠির উত্তরে লেখা; এসেছে ওর মায়ের কাছ থেকে, এবং কারা-প্রবাসী পুত্রের জন্য মায়ের যে স্বাভাবিক ব্যাকুলতা — তার বেশী অর্থাৎ জেলের তরফ থেকে আপত্তি করবার মতো কিছুই নেই তার কোনোখানে। কাগজ দুখানা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী করে এল এগুলো? কাকে দিয়ে আনলে? 

অনুনয়ের সুরে উত্তর এল : অন্যায় করেছি সার্। এবারটির মতো মাপ করুন। 

আমার কথার জবাব দাও। 

সুধীন ক্ষণেকের তরে আমার মুখের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে বলল, এনেছে একজন সিপাই; কিন্তু তার কোনো দোষ নেই। আমিই তাকে আনতে বলেছিলাম। 

তোমার চিঠিও বুঝি সে-ই নিয়ে গিয়েছিল? 

মাথা নেড়ে জানাল, হ্যাঁ। 

বললাম, জেল থেকে চিঠি পাঠাবার নিয়ম কী, জান? 

জানি, আপিসে দিতে হয়। 

তা না করে, গোপনে লোক দিয়ে পাঠালে কেন? কী ছিল চিঠিতে? 

সুধীন নিরুত্তর। একটু জোর দিয়ে বললাম, বলো। 

উত্তর এল মৃদু ভীরু কণ্ঠে, তার সঙ্গে জড়ানো অনেকখানি সঙ্কোচ ও লজ্জা : মা বড্ড কান্নাকাটি করছিল আসবার সময়। আর কোনোদিন করব না, সার্। 

চোখের কোণ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছিল। তাড়াতাড়ি মুছে ফেলল। 

আমার প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর পেলাম না। কিন্তু এটুকু বোঝা গেল, সে চিঠিতে যা ছিল সেটা বিশেষ কিছু না হলেও এমন কিছু, যা শুধু মায়ের কাছেই বলা যায়, সরকারী সেন্সরের স্কুল দৃষ্টির সামনে তুলে ধরা যায় না; অন্তত একটি পনেরো বছরের ছেলের পক্ষে তা অত্যন্ত কঠিন। 

টিকিট উলটে দেখলাম, ৩০২ ধারার কেস। খুনের অপরাধে যাবজ্জীবন, অর্থাৎ কুড়ি বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন সেসন জজ। আপীলও না-মঞ্জুর হয়ে গেছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘খুন করেছিলে?’ অভ্যাসের বশে এ-জাতীয় প্রশ্ন অনেককেই করে থাকি। উত্তরে ‘না’ শুনে শুনে কানও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রেও তার পুনরুক্তির জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তাই বিস্মিত হলাম যখন কানে এল একটি মৃদু কিন্তু দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট উত্তর : ‘হ্যাঁ’। 

মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে গেল, কাকে খুন করেছ? 

দাদাকে। 

দাদাকে! নিজের দাদা? 

হ্যাঁ, সৎভাই। 

কেন? 

সুধীন উত্তর দিল না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল, ঠিক পাশটিতে দাঁড়িয়ে ছিল যে গার্ড, তার মুখের দিকে। সরিয়ে দিয়ে ওকে কাছে ডেকে নিলাম। হাতের ইঙ্গিতে লোকটিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দাঁড়াল আমার চেয়ারের হাতলের পাশে। কয়েক মিনিট তাকিয়ে রইল মুখের দিকে। তারপর হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল : আমার মায়ের অপমান সইতে পারি নি, সার্। শান্ত হবার সময় দিলাম। দ্বিতীয় প্রশ্নের আর প্রয়োজন হল না। দ্বিধাহীন সহজ সুরে সুধীন বলে গেল তার খুনের ইতিহাস। তা থেকে যে তথ্যটুকু সংগ্রহ করা গেল, তাকে মোটামুটি রূপ দেবার চেষ্টা করছি। 

সুধীনের মা ওর বাবার দ্বিতীয় পক্ষ। প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর বৃদ্ধবয়সে আবার যখন টোপর পরলেন ভদ্রলোক, তাঁর বড় ছেলের বয়স তখন বাইশ পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ নববধূর চেয়ে তিন-চার বছরের বড়। তা ছাড়া আরও চারটি ছেলে-মেয়ে। সবগুলোই নতুন মাকে বাইরে মেনে নিলেও মনে মনে সয়ে নিল না। বিশেষ করে তাঁর লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো রূপ শুধু ওদের নয়, আত্মীয়স্বজন সকলেরই চক্ষুশূল হয়ে উঠল। এক বছর পরেই সুধীন এল তাঁর কোলে, এবং তার বছর দুই পরে কর্তা হঠাৎ ওপারে যাত্রা করলেন। উইল একটা রেখে গিয়েছিলেন, এবং তার মধ্যে মা ও ছেলের স্বচ্ছলভাবে চলার মতো ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু প্রথম পক্ষের তরফ থেকে সেটাকে ভুয়ো প্রমাণ করবার জন্যে আদালতে মামলা দায়ের হল। তারপর যা হয়ে থাকে। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত এবং সেখান থেকে উচ্চতর আদালত ঘুরে এসে বছর বারো পরে লড়াই যখন থামল, তার আগেই মামলার আসল লক্ষ্য, অর্থাৎ উইল-বর্ণিত বিষয়-আশয় তৃতীয় পক্ষের হাতে চলে গেছে এবং তার সঙ্গে গেছে বনেদী পরিবারের লোহার সিন্দুকের সঞ্চয়—নগদ টাকাকড়ি এবং সোনা-দানা। 

সুধীনের মামার বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না। ধন জন দুয়েরই অভাব। বিপদের দিনে অসহায় বিধবাকে সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন একটি উকিল—ওর মায়ের দূর-সম্পর্কের কোন জ্ঞাতি-ভাই। যে-হেতু সে ব্যক্তিটি বয়সে যুবক, ওঁদের দুজনকে যুক্ত করে নিত্য নতুন মুখরোচক কাহিনী পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সে সবগুলোর রচনা এবং প্রচারের প্রধান অংশে ছিল সুধীনের বৈমাত্রেয় ভ্ৰাতা। সাহায্যকারী তার ইয়ার-বন্ধুর দল। মামলায় হেরে যাবার পর ওই অস্ত্রটাকেই তারা সমস্ত শক্তি এবং উৎসাহ দিয়ে নির্লজ্জভাবে কাজে লাগাতে লাগল। একদিন সন্ধ্যার পর কী একটা দরকারী কাজে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তার উকিল-মামা। কথা হচ্ছিল ভিতরের মহলে একটা বারান্দায়। এমন সময় হঠাৎ সেখানে হানা দিল বিনাতা-পুত্র এবং তার দলবল। সুধীন ছিল তার পড়বার ঘরে। হৈ-হল্লা শুনে ছুটে এসে দেখল, দাদার দুটি বন্ধু তার মামাকে দু দিক থেকে ধরে আছে, আর সবাই মিলে কুৎসিত চিৎকার করে যা বলতে চাইছে, তার অর্থ—এই মাত্র একটা অতি জঘন্য কাণ্ড তারা হাতে হাতে ধরে ফেলেছে। ও-তরফের সঙ্গে যুক্ত দু-একজন প্রতিবেশীও এসে পড়েছিলেন। তাঁদের একজনের মন্তব্য শোনা গেল : দুটোকেই থানায় নিয়ে যাও। দঙ্গলের ভেতর থেকে মহাকলরবে উঠল তার সমর্থন। সেই কদর্য দৃশ্যের একান্তে ঢু হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে নিঃশব্দে বসে আছেন তার মা। মনে হচ্ছিল যেন একখানা শ্বেতপাথরের গড়া মূর্তি। প্রবীণ প্রতিবেশীর প্রস্তাব শুনে নিশ্চল দেহটা যেন একবার নড়ে উঠল। সুধীনের দাদা তখন এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের ঠিক সামনে। হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে বলছে, কী হল? গায়ে হাত দিতে হবে, না, নিজেই উঠবে? মায়ের কোনো সাড়া নেই। মাথাটা আরও নুয়ে পড়েছে মাটির দিকে। জ্ঞান আছে কি না বোঝবার উপায় নেই। কে একজন বলে উঠল, হাত ধরে টেনে তোল। যত সব নষ্টামি। সেই মতলবেই বোধহয় আরও খানিকটা এগিয়ে আসছিল ওর দাদা। কিন্তু হাত বাড়াতে না-বাড়াতেই গর্জে উঠল রিভলভার। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, সব অন্ধকারে একাকার হয়ে গেছে। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যাবার পর চেতনারাজ্যে আবার যখন আলো জ্বলে উঠল, চোখ খুলে দেখল সুধীন, বারান্দার উপর পড়ে আছে একটা নিশ্চল দেহ। কপালের একটা ধার থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। সেইদিকে ভীতিবিহ্বল তীব্র দৃষ্টি মেলে তেমনই মূর্তির মতো চেয়ে আছেন তার মা। কানে গেল একটা ফিসফিস আওয়াজ : ‘এ কী করলি খোকা?’ আঙিনায় জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। 

সকলের অলক্ষ্যে কখন যে সে নিঃশব্দে সরে গিয়েছিল, মায়ের ঘরের আলমারির ভিতর থেকে তুলে এনেছিল গুলিভরা রিভলভার, কিছুই আর মনে তার পড়ে না। 

আপনি বলুন তো সার্, অন্যায় করেছি আমি?—উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল সুধীন। খানিকটা বোধ হয় তন্ময় হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ যেন ধাক্কা খেয়ে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। চেয়ে দেখলাম, সরল নিষ্পাপ দুটি কিশোর-চোখ সাগ্রহ প্রশ্ন তুলে তাকিয়ে আছে আমার মুখের পানে। নরহস্তা জানতে চাইছে, সে অন্যায় করেছে কি না! তবু সহজ উত্তরটা আমার জিভে এসে আটকে গেল। 

হ্যাঁ, একটা অন্যায় আমি করেছি।—এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল সুধীন, কিন্তু সে শুধু মার কথায়। আমার মাকে তো আপনি দেখেন নি, সার্! দেখলে বুঝতেন, তাঁর চোখের দিকে একবার তাকালে কিছুতেই ‘না’ বলা যায় না। 

জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, কী সে অন্যায়? তার আগেই জবাব পাওয়া গেল-কোর্টে দাঁড়িয়ে কতকগুলো মিথ্যা বলে এলাম। ইচ্ছে করে, মারব বলেই মেরেছি—এ কথা কিছুতেই বলতে দিলে না মা। বলতে হল, উকিলদের বানানো কথা – রিভলভার নিয়ে এসেছিলাম, লোকগুলোকে ভয় দেখাতে। দাদা ছুটে এসে হাত চেপে ধরল, কেড়ে নিতে চাইল রিভলভার। আমি ছাড়তে চাই নি। ধস্তাধস্তির সময় কখন গুলি ছুটে গেছে, আমি জানি না। যখন বলি, হাকিম আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একবার ইচ্ছে হল বলে দিই—এ সব মিথ্যা কথা; দাদাকে খুন করেছি আমি। বলতেও যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মার সেই চোখ দুটো, আর বলতে পারলুম না। কিন্তু জজসাহেব বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন, সব বানিয়ে বলছি। তাই এত চেষ্টা করেও মা আমাকে ছাড়িয়ে নিতে পারল না। 

মিনিট কয়েক বিরতির পর আবার শুনতে পেলাম, সুধীন বলছে—তার জন্যে আমার মনে কোনো কষ্ট নেই সার্। খুন করেছি, তার শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু যখন মনে পড়ে, কুড়ি বছর পরে ফিরে গিয়ে মাকে আর দেখতে পাব না, মাথাটা একদম খারাপ হয়ে যায়। 

শুষ্ক সান্ত্বনার সুরে বললাম, কেন, দেখতে পাবে না কেন?

মা কিছুতেই বাঁচবে না অতদিন। 

চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। এবার আর মুছে ফেলবার চেষ্টা করল না। কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর বললাম, মাকে লিখে দাও, মাঝে মাঝে এসে তোমাকে দেখে যাবেন। 

তা হয় না সার্। বড্ড সেকেলে বনেদী ঘর আমাদের। জেলখানায় মা আসতে পারে না। না আসাই ভালো। আমার এই পোশাক মা সইতে পারবে না। 

খুনের অপরাধে এই ষোলো বছরের ছেলেটাকে যাবজ্জীবন দণ্ড নিয়ে বিচক্ষণ বিচারক তাঁর আইন-প্রদত্ত কর্তব্য পালন করেছিলেন তার উপরে ছিল মহামান্য হাইকোর্টের সমর্থন। বিচারে নিশ্চয়ই কোনো খুঁত ছিল না। তবু সেদিন মনে হয়েছিল, এইটাই কি শেষ কথা? এর পরে আর কিছু নেই? সুধীন ব্যানার্জি খুনী। সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, দুনিয়ার মানুষের কাছে এই কি তার একমাত্র পরিচয়? তার বাইরে সে আর কিছু নয়? কোনোদিন কিছু ছিল না, কোনোদিন কিছু হতেও পারবে না? 

মনে হয়েছিল, যে যাই বলুক, আইনের এই সূক্ষ্ম চোখটাই সব নয়। মানুষকে দেখবার চেনবার আরও অনেক চোখ আছে। অনেক দিক থেকে দৃষ্টি ফেললে তবে তার পূর্ণ রূপ ধরা পড়ে। মানব-সমাজের পক্ষ থেকে সে দৃষ্টিপাতের দায়িত্ব সরকারের। হয়তো এই রকম একটা মনোভাব থেকেই একদিন সুধীনকে ডেকে বলেছিলাম, মাকে লিখে দাও লাটসাহেবের কাছে দরখাস্ত করতে। 

কিসের জন্যে সার্? 

তোমার খালাসের জন্যে।

সুধীন হাসল; একটুখানি ম্লান হাসি। তারপর বললে, আপনি ভাবছেন, এ-সব কথা তাকে মনে করিয়ে দিতে হয়? কোনো দিকে কোনো চেষ্টাই বাকী রাখে নি মা। লাট সাহেবের কাছেও পিটিশন করতে চেয়েছিল। কিন্তু উকিল-মামা বড় বড় উকিলদের সঙ্গে পরামর্শ করে এসে বললেন, এখনও তার সময় হয় নি। আরও কিছুদিন না গেলে কোনো ফল হবে না। 

হয়তো সেই কিছুদিন অপেক্ষা করেই আবেদন পাঠিয়েছিলেন উকিলবাবুরা, এবং যথাসময়ে তার ফলও দেখা দিয়েছিল। কারাবাসের আড়াই বছর পূর্ণ হলে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪০১ ধারা প্রয়োগ করে বাকী অংশটা মকুব করবার আদেশ দিয়েছিলেন প্রাদেশিক সরকার। আদেশ দেবার আগে যথারীতি তার চরিত্র এবং চালচলন সম্বন্ধে একটা রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছিলেন, এবং আমরা যে তার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিলাম সে কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। 

.

সুধীন ব্যানার্জির সঙ্গে ব্রহ্মচারীর কোথাও কোনো মিল নেই। অমিলের অংশটাই বরং অতিমাত্রায় ব্যাপক এবং গভীর। প্ৰথম জন হত্যা করেছিল মানুষ, দ্বিতীয় জন মনুষ্যত্ব। নরঘাতক একদিন ক্ষমা পেলেও পেতে পারে, কিন্তু নারীধর্ষকের মার্জনা নেই। সুধীনের তরফ থেকে মানবতার দুয়ারে আবেদন করবার অবসর ছিল। সংবেদনশীল মানবসমাজের পক্ষে সরকার সে আবেদন গ্রহণও করেছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মচারীর বেলায় সে অবকাশ কোথায়? সংসারের কাছে রোষ এবং ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই তার প্রাপ্য নেই। তবু যে সরকারী দাক্ষিণ্য লাভের জন্য সুপারিশ পাঠাবার কথা আমার মনে হয়েছিল, তার কারণ আমিও স্পষ্ট করে জানি না। হয়তো মনে করেছিলাম, জঘন্য অপরাধে দণ্ডিত এই সদানন্দের মধ্যে আর-একটা যে মানুষ আছে, যার পরিচয় আমি পেয়েছি, পেয়েছে আমার জেলখানার লোক, তাকে যদি দীর্ঘকাল ধরে এই পাঁচিলের আড়ালে পঙ্গু করে ফেলে রাখা হয়, তাতে কারও কোনো লাভ নেই। তার চেয়েও বড় কারণ, কোন্ যুক্তিবলে জানি না, আমার মনের কোণে একটা বিশ্বাস ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, ব্রহ্মচারী নির্দোষ। অপরাধের দণ্ড সে ভোগ করেছে, সেটা সে করে নি, করতে পারে না। সেদিন বিদায়-মুহূর্তে ব্রহ্মচারীর সেই স্বগত উক্তির উত্তরে আমার এই যুক্তিহীন বিশ্বাসটাই বাইরে বেরিয়ে এল। বললাম, কী পেয়েছ, তা তুমিই জান। আমি তো জানি, কিছুই দিই নি, দিতে পারি নি। যা হয়তো পারতাম, মনে মনে যা ভেবে রেখেছিলাম, সেটুকুও শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারি নি। চক্রান্তের জালে জড়িয়ে একটা নির্দোষ মানুষ জেলে পচতে থাকল, আর— 

হঠাৎ কেমন যেন বিচলিত হয়ে পড়ল ব্রহ্মচারী। চকিতে একবার আমার দিকে চেয়ে কথাটা শেষ করবার আগেই বলে উঠল, নির্দোষ! না না; নির্দোষ আমি নই। 

নির্দোষ নও!—যন্ত্রচালিতের মতো আবৃত্তি করে গেলাম। ব্রহ্মচারী সে প্রশ্নের আর জবাব দিল না; মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। 

জীবনে অনেক কারণে অনেক আঘাত পেয়েছি। কিন্তু সেই দিন যা পেয়েছিলাম, আজও বোধ হয় কাটিয়ে উঠতে পারি নি। 

.

জেলখানার লোক আমি। আমার সঙ্গে আমার বন্দীদের সম্পর্ক, যতক্ষণ তারা থাকে আমার পাঁচিলের মধ্যে। বাইরে এলে তাদের আলাদা রূপ। সেখানে তারা আমার কেউ নয়, আমিও তাদের কেউ নই। সুতরাং ব্রহ্মচারী-উপাখ্যান এইখানেই শেষ হবে, এইটাই ছিল সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। কিন্তু হল না। বছর তিনেক পরে, আমার মনের কোণ থেকে যখন সে নিঃশেষে মিলিয়ে গেছে, হঠাৎ আমার গৃহকোণে তার দেখা পেলাম। শুধু দেখা নয়, তার সঙ্গে পেলাম তার প্রমাণিত অপরাধ এবং তারও পূর্বেকার সুদীর্ঘ কাহিনী। এই কথাগুলো শোনাবার জন্যেই খালাস হবার কদিন পরেই আমার নতুন কর্মস্থলে তার আকস্মিক আবির্ভাব। কুশল-প্রশ্নাদির পর বলল, জেলে থাকতেই বলতে পারতাম; অনেক দিন বলবার আকাঙ্ক্ষাও যে না হয়েছে তা নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিরস্ত করেছি। 

বললাম, কেন? 

একটু ইতস্তত করে উত্তর দিল ব্রহ্মচারী, আপনার দয়ার ওপর নতুন করে আর-এক দফা অত্যাচার করতে মন সায় দেয় নি। 

কথাটা এক রকম করে বুঝলাম। পাছে আমার মনে হয়, সত্য কাহিনী বলবার ছলে এ শুধু নিজের অপরাধ ঢেকে রেখে সুবিধা বা অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা, তাই নিজের সম্বন্ধে সে আগাগোড়া মৌন থেকে গেছে। আজ আর সে আমার কয়েদী নয়। তাকে দেবার মতো অনুগ্রহ বা নিগ্রহ কোনোটাই আমার হাতে নেই। তাই বলবার যে বাধা ছিল, তাও চলে গেছে। 

কিন্তু সে কাহিনীর পুনরুক্তি করতে গিয়ে আমি যে মস্ত বড় বাধায় এসে ঠেকলাম! সেটা হচ্ছে তার ভাষা। সুনির্বাচিত সংস্কৃত শব্দের পরিমিত প্রয়োগ ব্রহ্মচারীর প্রতিটি বাক্যকে যে মার্জিত এবং মধুর রূপ দান করে থাকে, তার সামান্য অংশ আয়ত্ত করতেই আমার জীবন কেটে যাবে। তা হলে তো আর এ কাহিনী বলা চলে না। তাই নিরুপায় হয়ে এবং আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমার এই জেলের তৈরী অন্ত্যজ ভাষাতেই শুরু করে দিলাম। 

.

যে বংশে ব্রহ্মচারীর জন্ম, গুরুগিরি এবং পৌরোহিত্যই তাদের কৌলিক পেশা। তার বাবা হৃষীকেশ ‘আচার্য পর্যন্ত এই কুলধারা অব্যাহত ছিল। যজন, যাজন, অধ্যাপনা – এই ত্রিবিধ বৃত্তির অন্তত দ্বিতীয়টি তিনি সযত্নে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু পুত্রদের আমলে এসে কোনোটাই আর বজায় রইল না। প্রথম পুত্র মোক্তারি পাস করে শহরে গিয়ে পসার জমিয়ে বসল। দ্বিতীয়টিও শহরের কোনো বড় রাস্তার মোড়ে সাজিয়ে বসল মনিহারী দোকান। তৃতীয় এবং কনিষ্ঠ এই সদানন্দ তখন গ্রামের ইস্কুলে উপর-দিকের ছাত্র। হেডমাস্টার মুক্তকণ্ঠে তার ইংরেজী-জ্ঞানের প্রশংসা করেন। তাই শুনে গোপনে নিশ্বাস ফেলেন হৃষীকেশ। ছেলেদের সম্বন্ধে বাবার মনের এই অনুক্ত ক্ষোভটুকু সদানন্দের কাছে লুকনো ছিল না। নিজের অবর্তমানে গৃহদেবতা নারায়ণ-শিলার ভবিষ্যৎ ভেবে তিনি যে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন, তাঁর মুখের দিকে চেয়ে এটাও সে এক রকম করে বুঝতে পেরেছিল। হঠাৎ একদিন দেখা গেল তার অ্যালজেব্রা এবং গ্রামারের আড়ালে একখানা নতুন বইয়ের আমদানি হয়েছে। তার নাম নিত্যপূজা-পদ্ধতি। একটা ছুটির দিনের দুপুরবেলা সদ্য নিদ্রা- ভঙ্গের পর বড় বউঠাকুরানী যাচ্ছিলেন তার ঘরের পাশ দিয়ে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। বন্ধ দরজার আড়াল থেকে ভেসে আসছিল অনুচ্চ কণ্ঠের গুঞ্জরণ-–খর্বং স্থূলতনুং গজেন্দ্ৰ-বদনং লম্বোদরং প্রস্যন্দন-মদগন্ধ-লুব্ধ-মধুপব্যালোল গণ্ডস্থলং…। বামাকণ্ঠের হাসির শব্দে থেমে গেল গণেশের ধ্যান। দরজার এ পাশ থেকেই পরিহাসতরল কণ্ঠে বললেন বউদিদি, সাবাস! তুমিই দেখছি বংশের ধারা বজায় রাখবে ঠাকুরপো। যাই, নাপিত ডেকে পাঠাই। সামনের চুলটা কদমছটি করে পেছনে বেশ মোটা একটা – কী যেন বলে? 

গড়িয়ে পড়ল হাসির ফোয়ারা। সদানন্দের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। কিন্তু বউঠাকুরানীর অপেক্ষায় না থেকে সে নিজেই নাপিত ডেকে পাঠাল; এবং চুল ছাঁটবার পর পিছন দিকের পুষ্ট শিখাটি কারও নজর এড়াল না। তার পরদিন সকাল সকাল পড়া শেষ করে স্নান সেরে ওই বইখানাকে নিয়েই ঢুকল গিয়ে ঠাকুর- ঘরে। দৈনন্দিন রুটিনমতো হৃষীকেশ নদীতে স্নান সেরে কমণ্ডলু হাতে গঙ্গাস্তব পাঠ করতে করতে ফিরছিলেন। বাড়ি ঢুকেই কানে গেল ঘণ্টার শব্দ। ঠাকুরঘরের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। নিষ্পলক চক্ষে দেখতে লাগলেন কিশোর পূজারীর সেই অপটু হাতের দেব-পূজার প্রয়াস।

সন্দানন্দের চোখে পড়ল, বৃদ্ধ পিতার বহু-উপবাস-ক্লিষ্ট শীর্ণ মুখখানা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কী যেন বলতে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করলেন হৃষীকেশ। তারপর সহজ সুরে বললেন, আজ ইস্কুল নেই তোর?

—পূজোটা সেরে নিয়েই যাব। লজ্জিত মৃদু সুরে উত্তর করল সদানন্দ, মুদ্রাটা কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না, একটু দেখিয়ে দেবেন?

সেইদিন থেকে কুলবিগ্রহের নিত্যপূজার ভার নিল বালক সদানন্দ। দাদাদের তর্জন, বউদিদের পরিহাস, সহপাঠীদের বিদ্রুপ তাকে নিরস্ত করতে পারল না। প্রথম দিকে ত্রুটি- বিচ্যুতি যেটুকু ছিল, পিতার সাহায্যে দু-দিনেই কাটিয়ে উঠল। একটু একটু করে অন্যান্য পূজা-প্রণালীও যত্ন করে শেখালেন হৃষীকেশ। ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ হল না, কিন্তু পড়াশুনায় আগের মতো অখণ্ড মনোযোগ বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াল।

হৃষীকেশকেও অনেক অনুযোগ শুনতে হল ছেলেদের কাছে। স্বর্গতা জননীর উল্লেখ করে বললেন মোক্তারবাবু, মা বেঁচে থাকলে কি তাঁর কোলের ছেলেটার ভবিষ্যৎ এমন করে নষ্ট করতে পারতেন আপনি?

হৃষীকেশ প্রথমটা চমকে উঠলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, নষ্ট কাকে বলছ? ছেলের মেজাজ ফেটে পড়ল : পুরুতগিরি করতে গিয়ে লেখাপড়া যে গোল্লায় গেল, দেখতে পাচ্ছেন না?

হৃষীকেশ ধীরভাবেই বললেন, ওর দাদারা যদি লেখাপড়া করেও গোল্লায় গিয়ে থাকে, ও না হয় না করেই যাবে।

বছর দুই পরে সদানন্দের ইস্কুলের পড়া শেষ হল। পাস করে গেল ভালোভাবেই। জলপানির আশা করেছিলেন হেডমাস্টার। তা আর হল না। কিছুদিন আগে ব্যাধি আর বার্ধক্যের চাপে প্রায় অচল হয়ে পড়েছিলেন হৃষীকেশ। যজমান-বাড়ির ক্রিয়াকর্মে প্রায়ই গিয়ে উঠতে পারতেন না। সে দায়টাও এসে পড়েছিল সদানন্দের ঘাড়ে।

পরীক্ষার ফল বের হবার কয়েকদিন পরে তার ভবিষ্যতের ভাবনা যখন নতুন করে দেখা দিয়েছে সমস্ত পরিবারের মনে, এমনি সময়ে একদিন পাশের গ্রামের কোনও এক পুরাতন যজমানের বৃষোৎসর্গের অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। দীর্ঘ চেষ্টায় জ্ঞান ফিরল, কিন্তু সে শুধু ক্ষণেকের জন্যে। মনে হল, শেষবারের মতো কাকে যেন খুঁজছেন চারপাশে। ছেলেমেয়েরা কাছেই ছিল। ছুটে এসে ঝুঁকে পড়ল। একে একে সবার দিকে চেয়ে চোখ দুটো স্থির হয়ে দাঁড়াল কণিষ্ঠ পুত্রের মুখের ওপর ঠোঁট দুখানা নড়ে উঠল কয়েকবার, কিন্তু স্বর ফুটল না। চোখের কোণ বেয়ে বেরিয়ে এল কয়েক ফোঁটা জল। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক, রুদ্ধবাক মৃত্যু-পথযাত্রীর সেই দুটি আকুল চক্ষের শেষ আবেদন সদানন্দের কাছে আস্পষ্ট রইল না। কানের কাছে মুখ নিয়ে অশ্রুজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, বাবা, আপনার সব কাজ আমি মাথায় তুলে নিলাম। আপনি নিশ্চিন্ত মনে ভগবানের নাম করুন।

ক্ষণেকের তরে, মনে হল সেই যন্ত্রণা-বিকৃত রেখাকীর্ণ মুখের উপর ফুটে উঠল প্রশান্তির চিহ্ন। আশ্বাসময় গভীর তৃপ্তিতে চোখ দুটো বুজে এল, আর খুলল না।

শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে যাবার পর যথারীতি শহরে গিয়ে কলেজে ভরতি হবার তাগিদ যখন এল, সদানন্দ প্রস্তুত হয়েই ছিল, জবাব দিতে দেরী হল না—তা কী করে হয়? ঠাকুরপূজো কে করবে? তা ছাড়া এত সব যজমান শিষ্য—

—চুলোয় যাকগে যজমান শিষ্য। রুখে উঠলেন বড়দাদা, সারাজীবন চালকলা বেঁধে চলবে তোর? নিজের ভবিষ্যতের কথাটাও একবার ভাবছিস না?

সদানন্দ হেসে ফেলল : ভাবছি বৈকি। কিন্তু ভবিষ্যতের চেয়েও বড় ভবিতব্য। তাকে কেউ খণ্ডাতে পারে না।

বড়দাদা আর সইতে পারলেন না, উঠে চলে গেলেন। বউদিদি বললেন, তার মানে পড়াশুনা আর করবে না?

—করব, তবে কলেজে নয়।

—কলেজে নয় তো কোন্‌খানে?

—জায়গাটা তোমাদের পছন্দ হবে না।

—তবু বলো না একবার শুনি?

—টোলে।

বউদিদি হেসে উঠলেন : এইবার তা হলে ষোলো কলা পূর্ণ হল।

হৃষীকেশের এক সতীর্থ এবং বন্ধু ছিলেন সিলেটের কোন্ গ্রামে। মহা-মহোপাধ্যায় পণ্ডিত এবং টোলের অধ্যাপক। মাঝে মাঝে ওঁদের পত্র-বিনিময় হত। ঠিকানাটা বাড়িতেই ছিল। পিতৃবিয়োগের দুঃসংবাদ জানিয়ে তাঁরই আশ্রয় প্রার্থনা করে চিঠি লিখল সদানন্দ। সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল। দুঃখ প্রকাশ এবং যথারীতি সান্ত্বনা দিয়ে শেষের দিকে লিখলেন অধ্যাপক—‘ছাত্রাভাবে আমার চতুষ্পাঠী কিছুদিন হইল বন্ধ করিয়া দিতে হইয়াছে। উদরান্নের জন্য অন্য বৃত্তি গ্রহণ করিয়াছি। নিয়মিত অধ্যাপনার ব্যবস্থা নাই। তবু তোমার শিক্ষার ভার গ্রহণ করিলাম। তুমি তো আমার ছাত্র হিসাবে আসিবে না, পুত্র হিসাবে আসিবে। যত শীঘ্র সম্ভব চলিয়া আসিও।’

শুভলগ্ন দেখে একদিন সিলেটের পথে পা বাড়াল সদানন্দ। সঙ্গে রইল সামান্য পরিধেয় এবং তারই সঙ্গে সযত্নে জড়ানো গৃহদেবতা শালগ্রামশিলা। কয়েকজন শিষ্য এবং যজমান তার ভরণ-পোষণের ভার সমেত লেখাপড়া এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা করে দেবার প্রস্তাব করেছিলেন, সদানন্দ গ্রহণ করে নি। বিনীত কণ্ঠে জানিয়েছিল, আপনাদের দেবার মতো প্রাণ আছে, সামর্থ্যও আছে। কিন্তু আমার যে নেবার মতো যোগ্যতা নেই। সেইটুকু অর্জন করবার জন্যেই এটা আমার তীর্থযাত্রা। দুটো বছর সময় চাইছি। ফিরে আপনাদের কাজেই লাগব।

সন্ধ্যার দিকে অধ্যাপকের ঘাটে এসে নৌকা ভিড়ল। সেই দিনটি তার সমস্ত প্রীতি, মাধুর্য, বিস্ময় ও শঙ্কার শিহরণ নিয়ে আজও অম্লান হয়ে আছে সদানন্দের বুকের মধ্যে। হয়তো চিরদিন থাকবে।

এগিয়ে এসে সস্নেহ সমাদরে এই বিনয়-নম্র প্রিয়দর্শন ছেলেটিকে গ্রহণ করলেন সস্ত্রীক অধ্যাপক। দুজনকে প্রণাম করে হাসিমুখে উঠে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল দরজার সামনে। হঠাৎ শিউরে উঠল সদানন্দ, এবং সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল চোখের পাতা। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনদিকে তাকিয়ে অধ্যাপক-গৃহিণীর স্নিগ্ধ হাসিটিও অকস্মাৎ নিবে গেল। তার সঙ্গে বেরিয়ে এল একটি গভীর নিঃশ্বাস।

ভয়ে ভয়ে আর-একবার চোখ তুলল সদানন্দ। চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মুখের বাঁ দিক জুড়ে বিস্তৃত দাহচিহ্ন। কুঁচকে যাওয়া চামড়ার পাশ দিয়ে কয়েকটা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। তার উপরে স্থির হয়ে আছে একটি বিকৃত বিকল চোখ।

বাঁ দিকটা যেমন বীভৎস, মুখের ডান অংশটা তেমনই নিটোল সুন্দর। তার চেয়েও আশ্চর্য তার অপরূপ দেহশ্রী। একরাশ কালো কোঁকড়ানো চুলের আড়ালে নাতি প্রশস্ত কপাল। তার উপরে সযত্নে-রচিত কাঁচপোকার টিপ। গ্রীবার বাঁকটি অনবদ্য। সুগঠিত উন্নত বুক, সুঠাম পেলব বাহু। ক্ষীণ কোমর এবং যৌবনপুষ্ট নিম্নাঙ্গের চারদিক বেষ্টন করে বুকের উপর দিয়ে কাঁধের আড়ালে নেমে গেছে যে সাধারণ শাড়িখানা, সে শুধু অঙ্গাবরণ নয়, অঙ্গশোভা—এমন একটি বিশেষ ভঙ্গিতে জড়ানো, যাতে করে দেহকে আড়াল করেছে যতখানি, তার চেয়ে বেশী করেছে প্রকাশ।

কন্যার এই অপূর্ব অঙ্গবিন্যাস ও তপ্তকাঞ্চনবর্ণের দিকে চেয়ে বোধ হয় মহাদেবীর ধ্যান মনে পড়েছিল ন্যায়রত্নের। তাই তার নাম দিয়েছিলেন চণ্ডী। সদানন্দের চোখে সে ধরা দিল আর-এক রূপে। অপরাহ্ণের পড়ন্ত আলোয় ওই দ্বারলগ্না নারীমূর্তির দিকে তাকিয়ে বিচিত্র রোমাঞ্চে কেঁপে উঠল তার ভীরু হৃদয়। বিস্ময়, বেদনা এবং ভয়ের সঙ্গে জড়ানো আর একটা অনাস্বাদিত অনুভূতি, যাকে সে চেনে না। তার জাগ্রত যৌবনের দুয়ারে এই প্রথম নারীর পদক্ষেপ। কিন্তু পূজারীর শ্রদ্ধাপ্লুত পুলকে মন ভরে উঠল কই?

ওই নারীদেহ এবং দাঁড়িয়ে থাকবার প্রগল্ভ ভঙ্গি, বিশেষ করে ডান দিকের ওই মোহন চক্ষুটির নির্লজ্জ চটুল হাসি সদানন্দের গোপন অন্তর্লোকে কোন্ এক সুপ্ত প্রবৃত্তির ঘুম ভাঙিয়া দিল! কী কদর্য তার রূপ! নিজের অশুচি অন্তরের দিকে চেয়ে মনে মনে শিউরে উঠল। চোখ বুজে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করতে চেষ্টা করল। কিন্তু তাঁর দ্বার জুড়ে রইল ওই কদাননা, শোভনতনু, মোহিনী রমণী।

অপুত্রক-গৃহে পুত্রের স্থান পেল সদানন্দ। নিজের বাড়িতে তার ডাকনাম ছিল সদা। এখানে হল আনন্দ, আর চণ্ডীর মুখে আনন্দদা, কখনও বা আরও সংক্ষেপে নন্দদা। আবেগে, উচ্ছ্বাসে, সোহাগে জড়ানো সে ডাক যখন কানে যায়, সমস্ত দেহমূল যেন নড়ে ওঠে। শান্ত, গম্ভীর, সংযমশীল ব্যাকরণের ছাত্র সদানন্দ কিসের যেন উন্মাদনা অনুভব করে তার বুকের মধ্যে। এড়িয়ে চলতে চায়। গুরুনির্দিষ্ট নীরস পাঠের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে চায় একাগ্র মন। তার পর হঠাৎ এক সময়ে অনুভব করে, কখন সে মন মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেছে দুখানি সুকোমল চঞ্চল হাতের স্পর্শ-সুখের স্মৃতি-নেশায়, অজ্ঞাতসারে কামনা করছে সেই নিষিদ্ধ পঙ্কিল সুখের পুনরাবৃত্তি।

সে কামনা অপূর্ণ থাকে না। নির্জন ঘরে কখনও ঝড়ের মতো এসে পড়ে উদ্বেলিত প্রাণরসে-ভরা একটি যৌবন-মত্ত দেহ। পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে যায় অর্থহীন প্রলাপ। তারপর হঠাৎ সামনে এসে মুগ্ধবোধ বন্ধ করে দিয়ে তেমনই ঝড়ের মতো ছুটে যায়।

কোনও কোনও দিন চুপিচুপি এসে বসে পড়ে একান্ত কাছটিতে। গলা জড়িয়ে ধরে আশ্চর্য করুণ কণ্ঠে বলে, আমাকে তুমি দু চক্ষে দেখতে পার না, তাই না নন্দদা?

সদানন্দের শিরায় শিরায় উদ্দাম হয়ে ওঠে রক্তস্রোত, বন্যার বেগে ভেঙে যেতে চায় সংযমের বাঁধ। ইচ্ছা হয়, নিবিড় পেষণে লুঠে নেয় ওই উত্তপ্ত উদ্ধত বুকের সুধার ভাণ্ডার। হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে আসে। খানিকটা সরে গিয়ে বলে, বিরক্ত কোরো না, পড়তে দাও।

—না, দেবো না পড়তে কোঁকড়ানো খোলা চুলে ছন্দময় দোলা দিয়ে বলে ওঠে মোহিনী। ব্যবধানটুকু আবার ঘুচে যায়। বলে, আচ্ছা নন্দদা, এই সব অং বং পড়তে গেলে কেন তুমি? সুধার বর কেমন তিনটে পাস দিয়েছে। মস্ত বড় চাকরি পাবে এবার।

–কে সুধা?

—ও হরি! সুধাকে চেন না? ওই বোসেদের মেয়ে। কত ঘটা করে বিয়ে হল, তুমি আসবার ঠিক সাত দিন আগে। চাকরি পেলেই ওরা বাসা করবে, বলছিল সুধা।

বেশ, এবার একটু ওদিকে যাও দিকিন। জ্যাঠাইমা ডাকছেন।

চণ্ডীর কানে বোধ হয় সে কথা পৌঁছল না। কেমন উদাস কোমল হয়ে গেল কণ্ঠস্বর। আপন মনে বলে চলল, সুধা আর আমি একসঙ্গে তিন বছর পড়েছি শিবু পণ্ডিতের পাঠশালায়। সবাই বলত, চণ্ডীর কাছে সুধা দাঁড়াতেই পারে না। রূপেও না, গুণেও না। তারপর এই দশা হল। বাবা বললেন, এ মুখ নিয়ে আর পাঠশালায় যেতে হবে না। কারও বাড়ি গিয়ে একটু বসি, তাও পছন্দ করেন না। লুকিয়ে লুকিয়ে যেতে হয়। একলা একলা কি ভালো লাগে সব সময়? বলো নন্দদা, লাগে?

সদানন্দ উত্তর দিল না। এ দুর্ঘটনার ইতিহাস সে আগেই শুনেছিল। মামার বাড়িতে স্টোভ জ্বালতে গিয়ে হঠাৎ কী করে আগুন লেগেছিল মুখের বাঁ দিকটায়, তারপর কেমন করে ওই অত রূপ চিরদিনের তরে হারিয়ে ‘প্রাণটুকু শুধু ফিরে পেল হতভাগী’,—সব কথাই শুনিয়েছিলেন অধ্যাপক-গৃহিণী। কিন্তু নিজের মুখে সে কিছুই বলে নি। জীবনের এত বড় একটা বিপর্যয় তাকে যে কোথাও স্পর্শ করেছে তারও কোনও আভাস পায় নি সদানন্দ। উদ্দাম কলহাস্যমুখর চিত্তচঞ্চলার কণ্ঠে আজকার এ সুর একেবারে নতুন।

পরক্ষণেই আবার ফিরে এল সেই উচ্ছল কণ্ঠ : জানো নন্দদা, সুধার ছোড়দা ওই অশোকটা কী পাজী! বলে কি শুনবে?—’অনেক রাত্তিরে একবার আসিস চণ্ডী। দরজা ভেজানো থাকবে!’ কী অসভ্য!

সদানন্দের মনে হল, এই গোপন অভিসারের সমস্ত কলুষ-রস উপচে পড়ছে ওই মেয়েটার চোখ-মুখের প্রতিটি রেখায়। সেই নেশার মত্ততা ফুটে উঠেছে তার প্রতিটি অঙ্গে। হঠাৎ ছুটে এসে তার গায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে চিবুকে হাত দিয়ে বলল, মুখ গোমড়া করে রইলে যে বড়? হিংসে হচ্ছে বুঝি? সত্যি, ব্যাটাছেলেগুলো ভা—রি হিংসুটে! তবু অমন করে থাকবে? বেশ, চললাম আমি অশোকের কাছে। বলেই লুটিয়ে পড়া আঁচল কুড়িয়ে নিয়ে হাসির লহর তুলে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে চলে গেল।

নারীর সঙ্গে নদীর এবং যৌবনের সঙ্গে জোয়ারের মিল আছে—এটা কাব্যের কথা কবিরা বলেন, নদীর যেমন রূপ বদলায়, গতি বদলায়, তেমনি ক্ষণে ক্ষণে নব রূপ আর নতুন পথ নেয় নারী। তার হৃদয়স্রোত বেশীদিন এক খাতে বয় না। সদানন্দ কাব্যচর্চা করে না, নীরস ব্যাকরণের ছাত্র। তবু গুরুগৃহে মাস কয়েক কেটে যাবার পর এই রকম একটা অনুভূতি তার মধ্যে জেগে উঠল। মনে পড়ল তাদের গ্রামের নদীতে একবার বান ডেকেছিল। কোথা থেকে এর উদ্দাম জলোচ্ছ্বাস নির্লজ্জের মতো দু-তীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেঙে দিয়েছিল কঠিন মাটির বন্ধন, ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গৃহস্থের সম্ভ্রম ও আশ্রয়। তার পর দেখা গেল, সে প্রচণ্ড গতিবেগ আর নেই, পড়ে আছে শুধু একটা নিস্তেজ জলধারা। কিন্তু নদীর গতি কোনোদিন শেষ হয় না, শুধু তার দিক বদলে যায়। তাদের গ্রাম ছেড়ে নবগঙ্গাও চলে গেল দূরান্তরে। আর-এক গ্রামের বুক চিরে বয়ে চলল তার বিপুল স্রোত।

বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে অধ্যাপকের কয়েক বিঘা জমি ছিল। মাঝে মাঝে যখন তিনি শিষ্য-পরিক্রমায় বেরোতেন চাষবাস তদারক করবার ভার পড়ত সদানন্দের উপর। একদিন দুপুর-রোদে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে দেখল, চণ্ডী বসে বসে কী একটা সেলাই করছে। কিছদিন আগেও এমনি মাঠ থেকে ফিরে এলে সে পাখা নিয়ে ছুটে আসত, গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাওয়া করতে শুরু করত। ঘাম ঝরে গেলে কোনোদিন টেনে খুলে দিত গায়ের জামা। বাধা-নিষেধ, সঙ্কোচ-আপত্তি সব উড়ে যেত তার উচ্ছ্বসিত হাসির তোড়ে। আজ তার ওঠবার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। একবার শুধু চোখ তুলে দেখে সেই সেলাই নিয়েই ব্যস্ত হয়ে রইল। নিজের ঘরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এক গেলাস খাবার জল চাইল সদানন্দ। মৃদুকণ্ঠে সাড়া দিয়ে এবার উঠে দাঁড়াল চণ্ডী। জল গড়িয়ে নিয়ে গেলাসটা রাখল একটা টুলের ওপর। খাওয়া হলে তুলে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

সেই অপত্রিয়মাণ দেহের দিকে চেয়ে সদানন্দের মনে পড়ল তার গ্রামের নদী নবগঙ্গার কথা। তার মতো এই নারীও একদিন উত্তাল তরঙ্গ তুলে এসেছিল তার জীবনে, আশৈশব- গড়ে-তোলা কঠোর সংযমের বাঁধের উপর হানা দিয়ে তার অস্তিত্বের মূল ধরে নাড়া দিয়েছিল। আর একটু হলেই হয়তো সব ভেঙে পড়ত। কিন্তু তার আগেই সে সরে গেছে। পড়ে আছে শুধু ওই নির্জীব নিস্তরঙ্গ রূপধারা, এই মাত্র যে চলে গেল তার সম্মুখ দিয়ে। কিন্তু স্রোত সরে গেলেও মরে যায় নি। অনুকূল হাওয়ায় এখনও সেখানে উদ্দাম জোয়ারের আলোড়ন দেখা দেয়। আর-এক কূলে গিয়ে আছড়ে পড়ে তার ঢেউ।

কুলনাশিনীর এই নতুন অভিমান সদানন্দের কাছে গোপন ছিল না, বোধ হয় গোপন রাখতে সে চায়ও নি। চরম উপেক্ষায় নিতান্ত অবহেলাভরে নিজেকে সে সরিয়ে নিয়ে গেছে এই নীরস শুদ্ধাচারীর নিরুত্তাপ সংস্রব থেকে। সব দেখে, সব জেনেও একটি কথাও বলে নি সদানন্দ। সে যেন শুধু নিস্পৃহ দর্শকমাত্র, তার বেশী আর কিছু নয়। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, এই যে সে নির্বাক ঔদাসীন্যে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে আছে, এটা সংযম নয়—কাপুরুষতা, ক্ষমা নয়—অক্ষমতা। এগিয়ে গিয়ে পথ রোধ করাই পৌরুষের লক্ষণ। কেউ নেমে যেতে চাইলেই তাকে পাপের পথে ছেড়ে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া, ও তো শুধু ‘কেউ’ নয়। ওর সঙ্গে সম্পর্ক যদি নাও থাকে, যাঁরা তাকে স্নেহ এবং আশ্রয় দিয়ে আপনজনের অধিকার দিয়েছেন, সেই পরিবারের মান-সম্ভ্রম কুল-মর্যাদার দিকে চেয়ে তাঁদের এই বিপথগামিনী কন্যাকে রক্ষা করতে হবে।

এই সব যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাতে চেয়েছে সদানন্দ। কিন্তু এই কর্তব্যবোধের অঙ্কুশ তাকে সাময়িকভাবে সজাগ করে তুললেও কাজের পথে এগিয়ে যেতে পারে নি। মনের গহনে চোখ পড়তেই সন্দেহ জেগেছে, এর সবটাই হয়তো আত্মপ্রবঞ্চনা। যে-বস্তু তাকে চালনা করছে সে কি নিছক শুভাকাঙ্ক্ষী আশ্রয়দাতার প্রতি কর্তব্যবোধ, না তার সঙ্গে জড়ানো কোনও কামনাবিদ্ধ প্রবৃত্তির তাড়না? যে ধরা দিতে এসেছিল, যাকে অনায়াসে লাভ করা যেত নিজেই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আজ যদি সে অন্য কারও হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে থাকে, আমার অন্তরে এ যন্ত্রণা কেন? এরই নাম কি ঈর্ষার জ্বালা? একেই কি বলে পরাজয়ের গ্লানি? কিংবা আমি স্বেচ্ছায় তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি, এ কথা সত্য নয়। অক্ষম বলে তাকে ধরে রাখতে পারি নি। আমি হেরে গেছি, আর জয়ী হয়েছে ওই অশোক। আমার অত্যুচ্চ আদর্শের ধ্বজা আঁকড়ে ধরে অমি ছট্‌ফট্ করে মরছি, আর আমার এই অশক্ত মুষ্টির বন্ধন থেকে আমার কামনার ধন কেড়ে নিয়ে ভোগ করছে এমন একজন, রূপে গুণে বিদ্যায় চরিত্র-গৌরবে মহত্তর জীবনের মাপকাঠিতে যে আমার চেয়ে সর্বাংশে নিকৃষ্ট।

দুর্বল মুহূর্তে এই সব কথা মনে হত সদানন্দের। কোনও কোনও দিন সমস্ত রাত এপাশ ওপাশ করে কেটে যেত। কখনও উঠে গিয়ে কত রাত্রির চঞ্চল প্রহর পায়চারি করে কাটিয়ে দিত বাড়ির সামনেকার মাঠটায়।

এমনি এক বিনিদ্র রাত্রে সেই মাঠের ধারে একটা গাছের গোড়ায় বসে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, এই যে আজ সে দেশ ছেড়ে আত্মীয়-পরিজন সকলের একান্ত ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে চলে এসেছে, বরণ করে নিয়েছে এই অধ্যয়ন-কঠোর নিরানন্দ জীবনের দীনতা, তার একমাত্র উদ্দেশ্য স্বর্গত পিতার শেষ অভিলাষ পূর্ণ করে তাঁর আধ্যাত্মিক আদর্শকে রূপ দান করা। একটা চটুল-প্রকৃতি দুশ্চরিত্রা নারীর সঙ্গে নিজের পবিত্র, মহৎ-লক্ষ্য জীবনকে জড়িয়ে ফেলে আত্মহত্যা করতে সে আসে নি। সে নারী যে আজ তাকে স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়ে গেছে, এটা নিতান্তই বিধাতার আশীর্বাদ। সে একান্ত ভাগ্যবান। স্বর্গত পিতার পুণ্যবলই তাকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা করেছে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দু-হাত কপালে ঠেকিয়ে পিতার উদ্দেশে প্রণাম জানাল সদানন্দ। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। খণ্ড খণ্ড মেঘে ছেয়ে আছে শুক্লপক্ষের স্বচ্ছ আকাশ। তারই একখানার আড়াল থেকে হঠাৎ যেন ডুব-সাঁতার দিয়ে বেরিয়ে এল দ্বাদশীর চাঁদ। দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল জ্যোৎস্নার প্লাবন। হেসে উঠল সিক্ত-পত্ৰ গাছপালার দল। পাতার আড়ালে এখানে ওখানে শোনা গেল দু-চারটি হঠাৎ জেগে ওঠা কাকের ডাক। আলো দেখে মনে করেছিল, ভোর হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙতেই আবার নেতিয়ে পড়ল ঘুমের কোলে। বিশ্বপ্রকৃতির এই স্থির প্রসন্ন মূর্তির দিকে চেয়ে সদানন্দের সমস্ত অন্তর নির্মল আনন্দে ভরে উঠল। ইষ্টদেবতাকে প্রণাম জানিয়ে হৃষ্টমনে পা বাড়াল ঘরের দিকে।

কয়েক পা গিয়েই থমকে দাঁড়াল। এত রাত্রে কার ছায়া পড়ল ওই হিজল গাছের ধারে? শুধু ছায়া নয়, তার পেছনে কায়াও আছে, যার প্রতিটি রেখা ওর চেনা। একটিবার তাকিয়েই গভীর ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল, কিন্তু ফিরে যেতে পারল না। মুহূর্ত-পূর্বেকার সমস্ত সংকল্প ভাসিয়ে দিয়ে বুকের মধ্যে জ্বলে উঠল দুর্নিবার জ্বালা। কঠোর স্বরে বলল, দাঁড়াও। কায়া ধীরে ধীরে কাছে এসে দাঁড়াল, যেন কিছুই হয় নি এমনিভাবে অত্যন্ত সহজ সুরে বলল, কী বলছ?

—কোথায় গিয়েছিলে?

—তুমি বুঝি পাহারা দিচ্ছিলে বসে বসে? বলে হেসে উঠল চাপা হাসি।

—চুপ করো। হাসতে লজ্জা করে না?

—না, করে না। দীপ্ত-কণ্ঠে বলে উঠল চণ্ডী।

—এত অধঃপাতে গেছ!

—যদি গিয়ে থাকি, তোমার কী, তুমি সে কথা বলবার কে?

ডান চোখের ভিতর থেকে ঠিকরে এল অগ্নিশিখা। জ্যোৎস্নালোকে স্পষ্ট দেখতে পেল সদানন্দ। কিন্তু বলবার মত আর কোনও কথা খুঁজে পেল না। তার জন্যে অপেক্ষাও করল না নির্লজ্জ অভিসারিণী। দৃপ্তভঙ্গিতে দ্রুত পায়ে চলে গেল। তার পরেই শোনা গেল খিড়কির কপাট বন্ধ করবার শব্দ।

কম্বল-শয্যায় ফিরে গিয়ে আত্মস্থ হবার চেষ্টা করল সদানন্দ। ঠিকই বলেছে চণ্ডী—তুমি সে কথা বলবার কে? সত্যিই কেউ নয়। এ শুধু চণ্ডীর কথা নয়, কিছুক্ষণ আগে সে নিজেও তো মনে মনে এই সঙ্কল্পই গ্রহণ করেছে, এই পথেই চালিত করতে চেয়েছে তার ভবিষ্যৎ জীবনধারা। ওই মেয়েটা তার কেউ নয়। ওর শুভাশুভের সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। ওই পাপস্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাই তার সাধনা। সুষ্পষ্ট ভাষায় সেই একই কথা ও জানিয়ে দিয়ে গেল। সহজ এবং সুগম করে দিয়ে গেল, তার অভীষ্টসিদ্ধির পথ। তবে কিসের এ ক্ষোভ? কেন মনে হচ্ছে এটা তার অপমান, এটা তার পরাজয়? বুকের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত মুচড়ে উঠছে কিসের বেদনায়? কে যেন বলছে তার কানে কানে, যে ছিল একান্তভাবে তোমার, মনের গোপন গহনে একদিন মোহ- সঞ্চার করেছিল যার মোহনস্পর্শ, আজ সে তোমার কেউ নয়। তোমার জীবন থেকে সে হারিয়ে গেছে, আর তারই জন্যে তোমার অন্তর-জোড়া এই হাহাকার।

না, না। তীব্র প্রতিবাদের আঘাতে সমস্ত সত্তাকে সচেতন করে উঠে বসল সদানন্দ। এই দৌর্বল্যতাকে জয় করতেই হবে। ছিঁড়ে ফেলতে হবে এই মোহপাশ। সমূলে উপড়ে দিতে হবে আবাল্যশুদ্ধ অন্তরের এক কোণে দেখা দিয়েছে যে পাপের অঙ্কুর। সেই সন্ধ্যা থেকে যে কলুষ চিন্তা তাকে অবিরাম অনুসরণ করে চলেছে, চোখ বুজলে পাছে আবার : তার কবলে গিয়ে পড়তে হয়, তাই বাকী রাতটুকু জেগে কাটিয়ে দেবে এই হল তার সিদ্ধান্ত। শুধু জেগে থাকা নয়, নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়া কোনও ধর্মগ্রন্থের পবিত্র পরিবেশের মধ্যে।

কম্বল গুটিয়ে রেখে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বেলে গীতা খুলে বসল সদানন্দ। দ্বিতীয় অধ্যায়, সাংখ্যযোগ। মোহাবিষ্ট অর্জুনের প্রতি শ্রীভগবানের উদাত্ত বাণী : ক্লৈব্যং মা গমঃ পার্থ,–হে পার্থ, কাপুরুষতাকে আশ্রয় কোরো না। ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং তত্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ—ওঠো, হৃদয়ের এই তুচ্ছ দুর্বলতা ত্যাগ করো।

গোবর-নিকানো আঙিনার কোণে উত্তর ভিটাতে একখানা লম্বা ধরনের ঘর। খড়ের ছাউনি, মূলবাঁশের বেড়া, মাটির দাওয়া। পূর্বে-পশ্চিমে ছোট বড় দুটি কামরা। তাদের মাঝখানেও ওই ছ্যাঁচা বাঁশের দেওয়াল। ছোটটিতে থাকে সদানন্দ, বড়টি অধ্যাপকের। তারই পাশে আড়াআড়িভাবে আর একখানা পুবদুয়ারী চালাঘর। সেখানে থাকেন সকন্যা গৃহিণী। দু-দিন হল শিষ্যবাড়ি গেছেন অধ্যাপক। এখনও ফিরতে পারেন নি। নিজের ঘরে খোলা দরজার দিকে মুখ করে গভীর রাত্রির গীতাধ্যয়ন প্রথমে নীরবেই শুরু করেছিল সদানন্দ। তারপর কখন সেই পাঠ ক্রমশ মৃদু থেকে কিঞ্চিৎ উচ্চতর গ্রামে এসে গেছে, বোধ হয় বুঝতে পারে নি। হঠাৎ দরজায় কার সাড়া পেয়ে চোখ তুলতেই কণ্ঠ থেমে গেল। রুক্ষ দৃষ্টি মেলে বিস্ময় মেশানো বিরক্তির সুরে বলল, তুমি এখানে?

—ভয় নেই। মুখ টিপে হেসে জবাব দিল চণ্ডী, কেউ দেখে ফেলবে না। মা অঘোরে ঘুমুচ্ছে।

—ঘরে যাও, আমার কাজ আছে।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কোথায় গিয়েছিলাম, জানতে চেয়েছিলে। তাই বলতে এলাম।

—কোনও দরকার নেই—বইয়ের দিকে চোখ রেখেই বলল সদানন্দ।

—রাগ করেছ বুঝি?

সদানন্দ এ কথার কোনও জবাব দিল না। চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঠিক তার সামনেটায় মেঝের উপর বসে পড়ল চণ্ডী। কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে থেকে যখন কথা বলল, তার সেই চপল সুর কোথায় মিলিয়ে গেছে, তার জায়গায় ফুটে উঠেছে গভীর করুণ রেশ। বলল, আমার দিকে একবার চেয়ে দেখো।

সদানন্দ ক্ষণেকের তরে চোখ তুলেই আবার নামিয়ে নিল। বোধহয় সে দৃষ্টি সইতে পারল না। সেই সুরেই বলল চণ্ডী, আমি কুৎসিত। আমার মুখের দিকে চাইলে লোকে আঁতকে ওঠে। তাই বলে আমার এই রক্তমাংসের শরীরটাও কি মিথ্যা হয়ে গেছে? আমার কোনও সাধ নেই, লোভ নেই? সংসারে মেয়েমানুষ যা চায় তার কোনোটাই আমার জন্যে নয়?

সদানন্দের কাছে এ প্রশ্নের কোনও জবাব ছিল না। থাকলেও বোধ হয় দিতে পারত না। ক্ষণকাল অপেক্ষা করে আবার বলল চণ্ডী, আমার বয়সী যে সব মেয়ে, আমরা যারা একসঙ্গে বড় হয়েছি, একে একে তারা সবাই চলে গেল—ঘর পেল, বর পেল। আমি কী পেলাম? আমি কী পাব? কী নিয়ে কাটাব আমার সারা জীবন? কেউ ভেবে দেখেছে সে কথা? কেউ না। তাই আমার পথ আমি নিজেই বেছে নিলাম। অশোক আমার মুখের দিকে চায় না, চাইতে ভয় পায়। আমার মনের খবরও সে জানে না। সে চেয়েছিল আমার এই দেহ! আমি দিয়েছি। কেন দেবো না? আর কেউ তো তাও কোনোদিন চায় নি।

লজ্জাহীনা প্রগলভার দিকে ঘৃণারক্ত রূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সদানন্দ। শুধু ঘৃণা নয়, তার মধ্যে অপরিসীম বিস্ময়। পাপের এ কী অসঙ্কোচ স্বীকারোক্তি! বলতে ইচ্ছা হল : এ পথ ধরবার আগে, এই কলঙ্কের কথা মুখ ফুটে উচ্চারণ করবার আগে ওই পুকুর কি একবার চোখে পড়ে নি কলঙ্কিনী? বলতে ইচ্ছা হল, কিন্তু বলা গেল না কিছুই। দীর্ঘদিনের বাক্-সংযম রসনার গতি রুদ্ধ করে দিল। কিন্তু অন্তরের সমস্ত ঘৃণা এবং রোষ বেরিয়ে এল দুটি জ্বলন্ত চোখের ভিতর দিয়ে। সেই দিকে চেয়ে চণ্ডীর মনেও বোধহয় লাগল তার উত্তপ্ত স্পর্শ। উত্তেজিত দীপ্তকণ্ঠে বলল, কী দেখছ অমন করে? তুমি বলতে চাও, আমি নষ্ট হয়ে গেছি? হ্যাঁ, হয়েছি। কিন্তু তার জন্যে দায়ী কে?

সে কথা কেমন করে বলবে সদানন্দ? তাকে কিছুই বলতে হল না। চণ্ডীর নিজের মুখ থেকেই এল তার প্রশ্নের উত্তর, দায়ী তুমি।

—আমি!

–হ্যাঁ, তুমি!

এই আকস্মিক আক্রমণে সদানন্দের স্নায়ুকেন্দ্র যেন হঠাৎ বিকল হয়ে গেল। সেই বিমূঢ় মূর্তির দিকে চেয়ে বোধ হয় কিঞ্চিৎ দয়ার উদ্রেক হল নির্দয়ার। অনেকটা যেন সস্নেহ সমবেদনার সুরে বলল, সত্যি তোমার জন্যে দুঃখ হয়, নন্দদা। লোভ আছে, কিন্তু ভোগ করবার ক্ষমতা নেই, সাহস নেই। যার উপরে লোভ, তাকে আঁকড়ে ধরতে পার না! সেদিকে হাত বাড়াতেও ভয়। সেই না-পারাটাকে ফলাও করে বল—সংযম। আরও কী যেন একটা গালভরা নাম আছে তোমাদের শাস্ত্রে? ব্রহ্মচর্য না?—বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল।

সেই হাসির তীক্ষ্ণ ফলাগুলো কেটে কেটে বসে গেল সদানন্দের সমস্ত দেহের পরতে পরতে। ওই মধুবর্ষী রসনায় এত বিষ, কেমন করে জানবে সে? কিন্তু যতই বিষাক্ত হোক, ওই অভিযোগের প্রতিটি বর্ণ সতেজ ও প্রাঞ্জল। মিথ্যা বলে প্রতিবাদ করবার সাধ্য নেই, হীন বলে উপেক্ষা করবার শক্তি নেই। তাই বলে সয়ে নেওয়াও যায় না। নিষ্ফল ক্ষোভ এবং অক্ষম লজ্জায় মাথাটা আরও নুয়ে পড়ল বুকের ওপর।

সামনের দিকে আর একটু কাছে সরে এল চণ্ডী। আবেগভরা কণ্ঠে আবদার ঢেলে বলল, তুমি রাগ করলে! বাঃ, একটু ঠাট্টাও বুঝি করতে নেই? আচ্ছা যা বলেছি, সব ফিরিয়ে নিলাম। এবার হল তো? শোনো। একবার চেয়ে দ্যাখ না?…বেশ, এ পোড়া মুখ দেখতে না চাও, দেখো না। নিজের মনের দিকে চেয়ে বুকে হাত দিয়ে বলো তো—চণ্ডী তোমার কেউ নয়, কোনোদিন কেউ ছিল না! এই চোখেই কি দেখেছ তাকে এতদিন?…বিশ্বাস করো নন্দদা, যতই নেমে গিয়ে থাকি, আজও তোমারই আছি। তুমি আমাকে টেনে তোলো। একটিবার, শুধু একটিবার মুখ ফুটে বলো

পায়ের উপর আচমকা স্পর্শে চমকে উঠল সদানন্দ। পদ্মকোরকের মতো দুখানা হাত, নবনীর মতো কটি আঙুল, কবিরা যার নাম দিয়েছেন চম্পকাঙ্গুলি, একদিন যার মদির স্পর্শ নেশা ছড়িয়ে দিয়েছে সমস্ত চেতনায়, এই মুহূর্তে হঠাৎ মনে হল, কতগুলো কুৎসিত বিষধর সাপ জড়িয়ে ধরেছে তার পায়ের পাতা। দু-হাত পেছনে ছিটকে গিয়ে চিৎকার করে উঠল : ছুঁয়ো না, সরে যাও।

বিস্ময়বিহ্বল করুণ কণ্ঠে বলল চণ্ডী, সরে যাব! এ কথা তুমি বলতে পারলে নন্দদা? —দুশ্চরিত্র স্ত্রীলোকের ছায়া মাড়ালেও পাপ। যাও, বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। সমস্ত দেহটাকে একটা রূঢ় ঝাঁকানি দিয়ে ভয়াল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল চণ্ডী। যেন একখণ্ড জ্বলন্ত ইস্পাত। ডান দিকের চোখটা জ্বলে উঠল। তর্জনী তুলে বলল, দুশ্চরিত্র! বেশ, আমিও দেখে নেবো কোথায় থাকে তোমার চরিত্রের অহঙ্কার! যে পাঁকে আমি ডুবেছি, তোমাকেও সেখানে নামতে হবে। তা যদি না পারি—

বাকী কথাগুলো অসমাপ্ত রেখেই বিদ্যুৎ-চমকের মতো মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

.

চণ্ডীকে সে ভালোবাসে, একদিন নিজের মনকে এই কথাই বোঝাতে চেয়েছিল সদানন্দ। আজ মনে হল, সে শুধু ভাবের ঘরে চুরি। ভালোবাসা নয় : রূপজ মোহ, নারী- মেধের দুর্বার আকর্ষণ। সেই কলুষ স্পর্শ দিনের পর দিন তার দেহে-মনে যে ঝড় তুলেছিল তাকে শত চেষ্টাতেও শান্ত করতে পারে নি। মাঝে মাঝে আশঙ্কা হত, আজই হয়তো ঘটে যাবে তার শুদ্ধাচারী-জীবনের সেই চরম পতন, যার দাগ কোনোদিন মোছে না। বহু কষ্টে সে পতন রোধ করে গেছে, তারপর ঘটনা-স্রোত গেল অন্য পথে। সেই সঙ্গে সে আশঙ্কাও দূরে চলে গেছে, ফিরে এসেছে আত্মবিশ্বাসের জোর। চণ্ডীর সেই গভীর রাত্রির স্পর্ধিত প্রতিজ্ঞা—তোমাকেও নেমে আসতে হবে সেই পাঁকের মধ্যে—আজ আর তাকে বিচলিত করল না। কিন্তু পতনের ভয় না থাকলেও ওই মেয়েটা তার জীবনের মধ্যে এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে, এইখানে বসে তার গ্রন্থিমোচন কেমন করে সম্ভব? ওকে আশ্রয় করে যে বিপর্যয় ঘটে গেল তার অন্তর্লোকে, তারপর আর যাই হোক, বিদ্যার্থীর শান্ত সাধনার পথ খোলা থাকে না। অর্থাৎ গুরুগৃহবাস এইখানেই শেষ, এবার চলে যাবার পালা। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ঘর ছেড়েছিল, এখানে আর তার সিদ্ধির সম্ভাবনা রইল না।

মুগ্ধবোধ খুলে রেখে এই সব কথাই ভাবছিল সদানন্দ। অধ্যাপক ফিরে আসবার পর বিদায়ের প্রস্তাবটা কী ভাবে উপস্থিত করলে তাদের সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হবে না, অথচ ফললাভের পথ সুগম হবে, সেটাও ছিল চিন্তার বিষয়। এমন সময় এল তাঁর চিঠি। অন্যান্য কথার পর জানিয়েছেন, কোনো এক শিষ্যের বিশেষ অনুরোধে পক্ষকাল ভাগবতপাঠের ভার গ্রহণ করতে হয়েছে। মঙ্গলময়ের ইচ্ছা হলে ওই শুভ কাজ শেষ করেই তিনি গৃহযাত্রা করবেন। চাষবাস এবং স্থানীয় যজমানদের ক্রিয়াকর্মের দায়িত্ব সদানন্দের উপর অর্পণ করে তিনি নিশ্চিন্ত আছেন। ইত্যাদি।

দিনের বেশির ভাগ যতদূর সম্ভব বাড়ির বাইরেই কাটিয়ে দেবার চেষ্টা করে সদানন্দ। বাকী সময়টা থাকে নিজের ঘরে। দু-বেলা খাবার সময় দেখা হয় অধ্যাপক-পত্নীর সঙ্গে। দু-চারটি সাংসারিক কথাবার্তাও হয়। চণ্ডী থাকে নেপথ্যে। দৈবাৎ একদিন সামনে পড়তেই চোখাচোখি হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল দুজনেই। সদানন্দের মনে হল, কেমন যেন রক্তহীন পাণ্ডুর দেখাল মুখখানা। পরক্ষণেই নিজের মনকে সরিয়ে নিয়ে এল অন্য কোনও কাজের মধ্যে।

একদিন সন্ধ্যার পর অধ্যাপক-গৃহিণী তার ছোট ঘরটিতে দেখা দিলেন। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে একখানা জলচৌকি এগিয়ে দিল সদানন্দ। তিনি সেটি গ্রহণ করে বললেন, বোসো বাবা, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।

সদানন্দ তার কম্বলের আসনে বসে অপেক্ষা করে রইল। তিনি ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বললেন, কদিন থেকেই বলব মনে করছি। আজ-কাল করে হয়ে ওঠে নি। এদিকে ওঁরও ফেরবার সময় হল। তার আগেই সব ঠিকঠাক করে ফেলা দরকার। আর তো দেরি করা চলে না।

—কার কথা বলছেন? কিসের দেরি? বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করল সদানন্দ।

—দেরি বইকি বাবা। দু মাস পেরিয়ে তিন মাসে পড়ল। চোখমুখের চেহারা যা হয়েছে! বেরুতে দেওয়া যায় না। এর পরে জানাজানি হয়ে পড়বে। এই মাসের মধ্যেই একটা ভালো দিন দেখে দু-হাত এক করবার ব্যবস্থা করে ফেলতে চাই।

একটা কালো পরদা যেন উঠে গেল সদানন্দের চোখের উপর থেকে। বেরিয়ে পড়ল কুৎসিত দৃশ্যপট। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অন্তরাত্মা বিষিয়ে উঠল। বুকের ভিতরটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠল। হঠাৎ কোনও উত্তর দেবার মতো অবস্থা রইল না।

গুরুপত্নী মুহূর্তকাল অপেক্ষা করে বললেন, দেশের বাড়ি থেকে কাউকে আনাতে চাও? আমি বলছিলাম, ‘ভাইদের সঙ্গে যখন তেমন যোগাযোগ নেই, আর আমরাই যখন তোমার বাপ-মা, তখন—

তিক্ত কণ্ঠে বাধা দিল সদানন্দ : ও, সেই জন্যেই বুঝি ওই মেয়েকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিতে চান?

—ও মা! সে কি কথা! গলায় ঝুলিয়ে দেবো কেন? তুমি তো নিজেই ওকে পায়ে ঠাঁই দিয়েছ বাবা।

—পায়ে ঠাঁই দিয়েছি! আমি?

—তা-না হলে কি ওই অতবড় আইবুড়ো মেয়েকে এতটা মেলামেশা করতে দিই, না সব জেনে-শুনেও নিশ্চিন্দি হয়ে বসে থাকি?

—সব জেনে-শুনে! অনেকটা যেন আপন মনে আবৃত্তি করে গেল সদানন্দ। তার পর সুর চড়িয়ে বলল, কী জানেন আপনি? কতটুকু জানেন? আপনার ধারণা, ওর এই অবস্থার জন্যে দায়ী আমি?

—তুমি একা কেন দায়ী হবে বাবা? সন্তানের দায়িত্ব মায়েরও কম নয়।

—কী বলছেন আপনি! চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল সদানন্দ : এ সব ভুল, সব মিথ্যা। আমি এর কিছুই জানি না।

—জান না! বিস্ময়াহত শুষ্ক ক্ষীণ স্বরে বললেন চণ্ডীর মা, ও যে বললে—

—ও বলেছে এই কথা? মিথ্যাবাদী! শয়তানী! গর্জে উঠেই হঠাৎ থেমে গেল সদানন্দ। মনে পড়ল সেই গভীর রাত্রির দম্ভোক্তি : ‘দেখে নেবো কোথায় থাকে তোমার অহঙ্কার। এই ভাবে শোধ নিল শেষকালে!

গুরুপত্নী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন : এ তুমি কী বললে সদানন্দ? তোমাকে যে আমরা ছেলের চেয়েও আপনার বলে জেনেছি।

ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকল চণ্ডী। মাকে ধরে টেনে তুলে বলল, কী করছ এখানে বসে? চলে এসো।

মেয়েকে দেখেই আরও ভেঙে পড়লেন তিনি : এ তুই কী করলি সর্বনাশী! তোকে নিয়ে কোথায় যাব আমি?

—তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। যেতে হয় তো আমি একাই যাব। বলে আর কোনও কথা বলবার আগেই মাকে এক রকম টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল।

গুরুগৃহে সেই রাতটাই সদানন্দের শেষ রাত। কয়েকখানা পাঠ্যগ্রন্থ সম্বল করে নিশীথ- রাত্রির অন্ধকারে চিরদিনের মতো যখন বেরিয়ে এল, তখন এ কথা তার মনে হয় নি, সকলের অলক্ষ্যে এই যে পালিয়ে যাওয়া—এ শুধু কাপুরুষতা নয়, নিজের উপরে আরোপিত অপরাধের নীরব স্বীকৃতি। যে মিথ্যা কলঙ্কের ভয়ে সে গৃহত্যাগ করছে, সেটাই সকলের চোখে সত্য হয়ে উঠবে। এ-সব কথা সেদিন বিচার করে দেখবার অবসর হয় নি। শুধু মনে হয়েছিল, যে পরিকল্পিত জঘন্য অভিযোগ, যে হীন ষড়যন্ত্র অক্টোপাসের মতো অষ্টবাহু বিস্তার করে তাকে জড়িয়ে ধরেছে, তার কবল থেকে নিজেকে বাঁচাবার একমাত্র পথ দূরে চলে যাওয়া। তাই গিয়েছিল। তার পর যখন পূর্ণ দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকাবার অবসর হল, দেখতে পেল দূরে গিয়েও বাঁচতে পারে নি। সর্বাঙ্গে জড়িয়ে গেছে দলিতা নাগিনীর প্রতিহিংসার বিষ। অন্যের চোখে না পড়লেও নিজের চোখকে এড়াবে কেমন করে?

যে কারণে ওখান থেকে চলে আসা, ঠিক সেই কারণেই বাড়ি ফিরে যাওয়া চলে না। দুর্নাম এবং কলঙ্কের বিষদাঁত নিয়ে অক্টোপাস সেখানেও ধাওয়া করবে।

সেই দিন থেকেই শুরু হল সদানন্দের নিরুদ্দেশ ভ্রমণের দীর্ঘ সূচী। সে এক বিচিত্র জীবন! কখনও অনাহার কখনও ভিক্ষা। কোথাও সাদর আহ্বান, কোথাও বা রূঢ় প্রত্যাখ্যান। এমনি ভাবে কেটে গেল কতদিন। তার পর আশ্রয় জুটল নবদ্বীপে এক পুঁথি- পাগল পণ্ডিতের জীর্ণ বৈঠকখানায়। কাজ, তাঁর চেয়েও জীর্ণ পুঁথির পাঠোদ্ধার, তার অনুলিপি-লেখন এবং তারই ফাঁকে ফাঁকে কখনও মুগ্ধবোধ কখনও ভট্টিকাব্য কখনও-বা রঘুবংশ! সেই বৈঠকখানার অন্ধকার কোণ থেকেই একদিন বেরিয়ে এল নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত শ্রীসদানন্দ আচার্য কাব্য-ব্যাকরণ-স্মৃতিতীর্থ।

ব্রহ্মচারী সদানন্দ আচার্যের বৃত্তি ছিল ত্রিবিধ—যাজনিক ক্রিয়া, শিক্ষাদান এবং কথকতা। ক্রমে ওই তৃতীয়টিই প্রধান হয়ে দাঁড়াল। ওদিকেই দেখা দিল শক্তির বিকাশ। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল খ্যাতি। অর্থ হল, প্রতিষ্ঠা হল। কর্মজীবনে পুরুষ যা কামনা করে, যা পেলে নিজেকে মনে করে কৃতী এবং সফলকাম, সবই পেল সদানন্দ। সাধারণ জনের প্রীতি ও সম্মান, পণ্ডিতজনের স্বীকৃতি। তবু এই কর্মময় জীবনের কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেল। গৃহ? হ্যাঁ, গৃহ-বন্ধনের রঙিন আকর্ষণ নির্জন অবসরে দেখা দিত বইকি ব্রহ্মচারীর গোপন মনে। সে বন্ধনের মূল যে জায়গায়, যাকে আশ্রয় করে পুরুষ গৃহ-রচনা করে গৃহী হয়, সেখানটার কথা ভাবতে গেলেই তার চোখের উপর ভেসে উঠত একটি কুৎসিত কিন্তু অনিন্দ্য-তনু অতৃপ্ত-যৌবনার উগ্রমূর্তি। ওই একটি নারীই এসেছিল সদানন্দের জীবনে, দিয়েছিল তার উত্তপ্ত দেহ-মনের নিবিড় স্পর্শ। কিন্তু তার মধ্যে মধু নেই, গন্ধ নেই, নেই দীপশিখার স্নিগ্ধতা। নারী যে কল্যাণদাত্রী, আরও যে কত রূপ আছে তার—প্রেমময় সুধাময়, সে কথা সে পেয়েছে কাব্যের মধ্যে, অন্তরের মধ্যে নয়। গৃহিণী গৃহমুচ্যতে—মহাকবির এই বাণী রইল শুধু তার জ্ঞান এবং প্রচারের মধ্যে, জীবনের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠল না।

এমন করে অজ্ঞাতে কখন গড়িয়ে গেল বেলা। হঠাৎ চমক ভেঙে দেখতে পেল ব্রহ্মচারী, তার জীবনের আঙিনায় নেমে এসেছে অপরাহ্ণের ছায়া।

.

রাস-পূর্ণিমার উৎসব চলেছে নবদ্বীপে। কত যাত্রী এসেছে দেশদেশান্তর থেকে। রাস্তার দু-ধারে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে দেখছে দীর্ঘ শোভাযাত্রা, ভিড় করেছে মেলায়, মন্দিরে, স্নানের ঘাটে। পোড়ামাতলার মোড়ে বিস্তৃত শামিয়ানার নীচে সভার আয়োজন করেছেন উৎসবের উদ্যোক্তারা। কথকতা করবেন ব্রহ্মচারী সদানন্দ। তিলধারণের স্থান নেই কোনোখানে। সব স্তরের সব বয়সের নরনারী। মিশ্র কোলাহলে ভরে উঠেছে সভাঙ্গন। মঞ্চের উপর শীর্ণকায় দীর্ঘাঙ্গ ব্রহ্মচারীর গৈরিক আভাস দেখা যেতেই সব স্তব্ধ হয়ে গেল। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ঘিরে রয়েছেন তাঁর চারপাশে। ধীরে ধীরে আসন গ্রহণ করে স্মিত মুখে বিশিষ্ট দর্শকদের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন কোন্ কাহিনী শুনতে চান তাঁরা।

প্রভুর যা অভিরুচি—বিনীত কণ্ঠে উত্তর দিলেন জনৈক প্রবীণ শিষ্য। কয়েক মুহূর্ত বিশাল জনতার দিকে তাকিয়ে রইল সদানন্দ। তারপর শুরু হল কচ ও দেবযানীর অমর উপাখ্যান। অশ্রান্ত গতিতে এগিয়ে চলল অধ্যায়ের পর অধ্যায়। মহাভারতের মৌলিক বর্ণনার সঙ্গে যুক্ত রবীন্দ্রকাব্যের মাধুর্য ও কল্পনা, এবং তার মধ্যে জড়িত রইল ব্রহ্মচারীর নিজস্ব ভাষা, ভঙ্গি আর কণ্ঠের লালিত্য।

দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র কচ। দৈত্যগুরুর দ্বারে ভিক্ষাপ্রার্থী। যে সঞ্জীবনী বিদ্যা দেবতার অনায়ত্ত, দেবলোকের হিতার্থে তাই তাকে অর্জন করতে হবে। সেই দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছেন শুক্রাচার্যের কাছে। সমস্ত দৈত্যকুল তাঁর প্রতিকূল। দৈত্যগুরু তাঁর প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, দেবতনয়কে শিষ্যরূপে গ্রহণ করতে তিনি অনিচ্ছুক ও অসমর্থ। কিন্তু কচকে নিরস্ত করা গেল না। সমস্ত বিপদ-বাধা বরণ করে কঠোর তপস্যায় গুরুর অনুগ্রহ লাভের জন্য আত্মনিয়োগ করলেন। শুক্রাচার্যের স্নেহধন্যা তরুণী কন্যা দেবযানী। শুধু কন্যা নয়, প্রিয়শিষ্যা এবং আচার্যের দুর্লভ বিদ্যার অধিকারিণী। এই দৃঢ়কাম তরুণ দেবপুত্রের অপূর্ব ক্লান্তি, বিনয়-নম্র সুমিষ্ট আচরণ এবং অনমনীয় অধ্যবসায় তাঁর নারীহৃদয়কে স্পর্শ করল। অবাঞ্ছিত বিদেশীর উপর পড়ল তার প্রসন্ন দৃষ্টির স্নিগ্ধ আলোক। কন্যার অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে কচকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করলেন শুক্রাচার্য। শুরু হল বিদ্যার্থীর কঠোর জীবন। সহস্র-বৎসরব্যাপী দুস্তর সাধনা। নিরলস কর্মে এবং সুদুর্লভ অবসরে দেবযানী রইল তাঁর পাশে, প্রীতিময়ী প্রবাসসঙ্গিনী। পাঠগৃহে প্রাসাদের অলিন্দে, নির্জন বনছায়ায়, নিরালা নদীতীরে ছায়ার মতো দিল তাঁকে সঙ্গ এবং সাহচর্য।

অকস্মাৎ একদিন রাত্রির অন্ধকারে নিভৃত শয্যায় কচের দৃষ্টি পড়ল তাঁর গোপন অন্তরের পানে। কেউ জানে না, কখন কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে তারই উপরে অঙ্কিত হয়ে গেছে এক রূপময়ী দৈত্যবালার মোহিনী মূর্তি। নিমেষের তরে বিস্ময়ে পুলকে বেদনায় ভরে গেল তাঁর তরুণ মন। পরমুহূর্তেই ফিরে এল সেই কঠোর প্রতিজ্ঞা—যে ব্রত গ্রহণ করেছি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে বরণ করেছি এই শত্রুপুরীর লাঞ্ছনা, তার পরিপূর্ণ সাফল্যই আমার একমাত্র লক্ষ্য। তার পূর্বে নিজের সুখ দুঃখ শুভাশুভ কিছুই জানি না। কর্তব্যের কাছে হৃদয়বৃত্তির স্থান নেই।

এমনই করে কেটে গেল সহস্র বৎসর। গুরু প্রীত হলেন। দান করলেন বহুবাঞ্ছিত সঞ্জীবনী বিদ্যা। উদ্দেশ্য সিদ্ধির পর যাত্রার আয়োজন করলেন কচ। আচার্যকে প্রণাম করে বিদায় নিতে গেলেন দেবযানীর কাছে। কিন্তু সে-বিদায় কি এত সহজ? সেখানে যে রয়েছে সেই চিরন্তনী নারী, মাতৃরূপে প্রিয়ারূপে কন্যারূপে অনন্তকাল যে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে বহির্মুখী পুরুষের, স্নেহ দিয়ে প্রেম দিয়ে বাঁধতে চেয়েছে প্রিয়জনে, অশ্রু দিয়ে গাঁথা মায়াডোর জড়িয়ে দিয়েছে তার হাতে; কোমল বাহু প্রসারিত করে বলেছে, ‘যেতে নাহি দিব’। কিন্তু নির্মম পুরুষ সে ব্যাকুল ডাক কোনদিন শোনে নি। যে শুনেছে, তাকেও ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বৃহত্তর জীবনের প্রবল বাহু। পথপ্রান্তে ফেলে দিয়ে গেছে উপেক্ষিত স্নেহপাশ

এখানেও তারই পুনরাবৃত্তি হল। সেই বিদায়ের ক্ষণে দেবতার কাছে প্রেম নিবেদন করল দৈত্যকন্যা দেবযানী। যথারীতি ব্যর্থ হল তার আবেদন। নারী সব সইতে পারে। সংসারে এমন কোনও দুঃখ নেই, আঘাত নেই, যা সে যুগ যুগ ধরে বুক পেতে গ্রহণ করে নি। কিন্তু একটা জিনিস সে সইতে পারে না—প্রেমের প্রত্যাখ্যান। সে আঘাত যখন আসে, কেউ ভেঙে পড়ে, কেউ জ্বলে ওঠে নাগিনীর মতো। দেবযানি জ্বলে উঠল। হৃদয় ভরে অমৃতের ভাণ্ডার সঞ্চয় করে রেখেছিল যার জন্য, তারই উপরে ঢেলে দিল অভিশাপের বিষ—যে বিদ্যার অভিমানে প্রেমকে অবহেলা করছ, সে বিদ্যা তোমার ব্যর্থ হবে, সে শুধু ভার হয়ে থাকবে তোমার জীবনে।”শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।”

সভাভঙ্গের পর জনতার ভিড় হাল্কা হয়ে গেছে। অনুরাগী বন্ধু এবং শিষ্যদের কাছে বিদায় নিয়ে গৃহে ফিরছিল সদানন্দ। একাই চলেছিল গলিপথ দিয়ে। এগিয়ে দিতে চেয়েছিল কেউ কেউ। কাউকে সঙ্গে নেয় নি। মনের মধ্যে কেমন একটা একা থাকবার তাগিদ অনুভব করছিল। আনমনে পথ চলতে চলতে ভাবছিল, এইমাত্র যে কাহিনী সে শুনিয়ে এল; তার একটা ক্ষীণ সুর কোথায় যেন জড়িয়ে আছে তার নিজের জীবনের মধ্যে, কোথায় যেন একটুখানি মিল। শুধু কচের কথাই সে বলেনি, বলে এসেছে নিজের কথা। আর তার সঙ্গে—

রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সদানন্দ। ঠিক তার সামনে মুখোমুখি যে দাঁড়িয়ে আছে, সে কি সত্য, না শুধু চোখের বিভ্রম? এতদিন পরে আপনার অজ্ঞাতে স্মৃতির কোঠায় যার ছায়া পড়েছিল, সে কায়া হয়ে দেখা দিল কেমন করে! অথবা এ শুধু তার বিভ্রান্ত কল্পনা!

দু-হাতে চোখ রগড়ে আর-একবার তাকিয়ে দেখল ব্রহ্মচারী। না, ভ্রান্তি নয়, সত্যই সে দাঁড়িয়ে আছে। মুখের বাঁ দিকটা আঁচলে ঢাকা। ডানদিকের যেটুকু প্রকাশ, তার মধ্যে ভুল করবার অবকাশ নেই। কিন্তু এ কি সে, না তার মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে আছে কোনও প্রেত? কোথায় গেল চোখের সেই বিদ্যুৎঝলক, ওই কালো চোখের তারা থেকে যা ঠিকরে পড়ত একদিন? অপরাঙ্গে দৃষ্টি পড়তেই শিউরে উঠল সদানন্দ। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হল না, এই দেহই একদিন তরঙ্গ তুলেছিল তার রক্তধারায়।

—কেমন আছ? নিস্পৃহ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল চণ্ডী। সে বাণীর ঝঙ্কার নয়, কেমন একটা ভাঙা-ভাঙা ধার-ক্ষয়ে যাওয়া সুর।

—ভালো। তুমি?

—আমি? হাসির কুঞ্চনে আরও কুৎসিত দেখাল মুখখানা : যেমন দেখছ। বাসা কোথায়?

—মাঝের পাড়ায়।

—যাব একদিন। বলেই এগিয়ে গেল রাস্তার ধার ঘেঁষে।

একবার ইচ্ছা হল ব্রহ্মচারীর, ডেকে ফিরিয়ে বলে, না, আমার বাড়িতে এসো না তুমি। কোনও তরফেই তার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু বলা হল না।

তিন-চার দিন পরে প্রাতঃসন্ধ্যা সেরে বারান্দায় বেরোতেই একটা অপরিচিত লোক উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। শরীর ও পোশাক দুই-ই অপরিচ্ছন্ন। কৃত্রিম হাসির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল দুপাটি কদর্য দাঁত।

—আপনার কাছে এলাম।

—কে আপনি?

—আমাকে আপনি ঠিক চিনবেন না। তবে আমার ইয়ে—মানে, ঘরের মানুষটি আপনার অনেক দিনের চেনা। একটু থেমে ব্রহ্মচারীর সন্দেহ-কুঞ্চিত ক্রূর দিকে চেয়ে যোগ করল, চণ্ডীর কথা বলছি।

—চণ্ডী আপনার স্ত্রী?

—না না! জিব কেটে মাথা নাড়ল লোকটা : হাজার হলেও বামুনের মেয়ে। শুধু বামুন কেন, গুরুবংশের মেয়ে। তবে হ্যাঁ, একসঙ্গেই যখন আছি আজ কুড়ি বাইশ বছর, তখন বুঝতেই তো পারছেন, জ্ঞানী লোক আপনি। বলে আবার হেসে উঠল সেই কুৎসিত হাসি।

—আমার কাছে আপনার কী দরকার? রূঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল সদানন্দ। দরকার সামান্যই। মা মেয়ে দুজনকেই পুষতে হয়। যা দিনকাল, দেখুন না, কার বোঝা কে বয়!

—আর কিছু বলবার আছে আপনার?

—না, আর কিছু না। শুধু গোটা পঞ্চাশেক টাকা হলেই আপাতত-

—মাপ করবেন। আপনি এবার আসতে পারেন।

—আসব বইকি। তবে টাকাটা দিয়ে দিলে পারতেন ঠাকুরমশাই। আপনার ভালোর জন্যেই বলছি।

ব্রহ্মচারী ঘরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল, ফিরে দাঁড়িয়ে রুক্ষদৃষ্টি মেলে জানতে চাইল : তার মানে?

—মানে, আপনার সঙ্গে ওর আসল সম্পর্কটা তা হলে গোপনই থেকে যেত।

—কী বলতে চান আপনি?

—আজ্ঞে, সেটা আমার চেয়ে আপনিই ভালো জানেন। এখানে অবিশ্যি এখনও কেউ জানে না। কিন্তু জানতে কতক্ষণ? ভেবে দেখুন, তারপরে —

—জানেন, আপনাকে আমি পুলিসে দিতে পারি?

–পুলিস! বিকট শব্দ করে হেসে উঠল লোকটা : তাতে আপনার বিশেষ সুবিধে হবে না, পণ্ডিতমশাই। তাছাড়া করালী কুণ্ডু কারও চোখরাঙানোকে পরোয়া করে না। যাক, এবার তা হলে আসি। পেন্নাম।

হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছিল করালী। ব্রহ্মচারী ডেকে ফেরাল, শোনো। চণ্ডী পাঠিয়েছে টাকার জন্যে?

—না, তা ঠিক নয়। আমতা আমতা করে বলল লোকটা, তবে টাকার দরকার তারই। অসুখে পড়ে আছে। কদিন কাজে বেরোতে পারে নি। আমিও বেকার বসে আছি। সেয়ানা মেয়েটাকে

কথা শেষ করবার আগেই ঘরের মধ্যে চলে গেল ব্রহ্মচারী। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে পাঁচখানা নোট ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, আর কোনোদিন এসো না।

—না না, আর আসতে হবে না। নোটগুলো কুড়িয়ে নিয়ে কোঁচার খুঁটে বাঁধতে বাঁধতে বলল করালী, এতেই কাজ হবে।

কিন্তু পাঁচ-সাত দিন না যেতেই আবার এসে দাঁড়াল সেইখানটিতে। গড়গড় করে বলে গেল একঝুড়ি কথা, যার সারমর্ম—মা-মেয়ের কাপড় নেই, ঘরের বার হতে পারে না। গোটা দশেক ইত্যাদি। দশটা টাকা দিয়ে বিদায় করল ব্রহ্মচারী। তার কদিন পরেই এল মোটা অঙ্কের তাগিদ। ছ মাস থেকে বাড়িভাড়া বাকি। চণ্ডীকে অপমান করে গেছে বাড়িওয়ালা। বিশ্রী ইঙ্গিত করেছে বয়স্থা মেয়েটাকে জড়িয়ে। ভয়ানক কান্নাকাটি করছে ওরা। সন্ধ্যার মধ্যেই যেমন করে হোক বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।

“সত্যিই তো, ওদেরই বা দোষ দিই কেমন করে”–হতে পা নেড়ে বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বলল করালী, “আজ না হয় সব গেছে, আসলে তো অত বড় একজন নামকরা পণ্ডিতের মেয়ে! সেই কথা বিবেচনা করে আমিও মশাই ফেলে আসতে পারলুম না। ওদের ওখানে গিয়েই জড়িয়ে পড়লাম। সেই যে চেপে ধরল, আর ছাড়বার নামটি নেই। কী করি, বলুন? ঘাড়ে যখন এসে চাপল একটা মেয়েছেলেকে তো আর রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমারও তখন বিশেষ কোনেও ঝঞ্ঝাট নেই। বউ মারা যাবার পর আর সংসার করি নি। আপনার আর্শীবাদে অবস্থাও মন্দ ছিল না। তিনখানা বাড়ি ঢাকা শহরে। ভাড়া যা আসত—তিনটে তো মোটে প্রাণী–হেসে-খেলে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু হিন্দুস্থান পাকিস্তান হতেই সর্বনাশ ঘটল। তারপরেও অনেকদিন পড়েছিলাম। ওই মেয়েটা সেয়ানা হয়ে উঠতেই চলে আসতে বাধ্য হলাম। সে যাক গে। এবার কোনোক্রমে দায় উদ্ধার করে দিন। আর আসব না আপনার কাছে।

ব্রহ্মচারী কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কানে গেল, বলছে করালী, দায়টা তো আসলে আপনারই—

—কী বললে? গর্জে উঠল সদানন্দ।

—আজ্ঞে মানে

—মনে করেছ কতগুলো মিথ্যা কুৎসার ভয় দেখিয়ে বরাবর এমনই টাকা আদায় করে যাবে, না?

—আজ্ঞে না, ভয় দেখাব কেন? আমি বলছিলাম-

—যাও! মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দরজার দিকে আঙুল তুলে ধরল সদানন্দ।

—কী বলছেন?

বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।

করালী উঠে দাঁড়িয়ে রক্তচক্ষু মেলে বলল, এই কি আপনার শেষ কথা!

—হ্যাঁ, শেষ কথা। আর কোনোদিন যেন তোমাকে এখানে দেখতে না পাই।

—আচ্ছা! লম্বা চুলগুলোয় একটা উদ্ধত ঝাঁকানি দিয়ে বেরিয়ে গেল করালী। দিন তিনেক পরেই এল আবার বাইরে যাবার নিমন্ত্রণ। বর্ধমান অঞ্চলে পর পর গোটাকয়েক ধর্মসভায় ভাগবত-পাঠ শেষ করে কথকতার বায়না নিয়ে যেতে হল মুর্শিদাবাদ। সেখান থেকে মালদা হয়ে নবদ্বীপ ফিরতে মাস পেরিয়ে গেল।

ফিরে আসবার কয়েকদিন পর। অন্ধকার রাত। দশটা বেজে গেছে। বিশ্রামের আয়োজন করছিল ব্রহ্মচারী। দরজার কড়া নড়ে উঠল। একটু বিরক্তির সঙ্গে খুলে দিয়ে হ্যারিকেনের আলোটা উঁচু করে ধরতেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল—তুমি!

—খুব অবাক হয়ে গেছ, না? দরজা পার হয়ে ভিতরের দিকে পা বাড়াল চণ্ডী।

—তুমি বোধহয় জান না, এ বাড়িতে আমি একা থাকি।

—তার মানে, কেউ দেখে ফেললে দুর্নাম দেবে, এই তো?

—মিথ্যা দুর্নামের ভয় আমি করি না।

—একদিন কিন্তু করেছিলে। সে যাক। আজ নিশ্চিন্ত থাকতে পার। এ রূপ দেখে সে ভুল কেউ করবে না। বড়জোর ভাববে, ভিক্ষা চাইতে এসেছে কোনও রাস্তার ভিখিরী। আর সত্যিই তাই। একটা ভিক্ষে চাইতে এসেছি তোমার কাছে। বলে সে বসে পড়তে যাচ্ছিল উঠানের এক পাশে।

ব্রহ্মচারী বাধা দিয়ে বলল, বারান্দায় উঠে বোসো। দাঁড়াও। বাড়াল একটা কিছু এনে পেতে দেবার জন্যে।

—বলে ঘরের দিকে পা

—থাক, আর কিছু লাগবে না। এই মেঝেতেই বসছি। একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকতেই পা ধরে যায়।

—সলজ্জ মৃদু হাসির সঙ্গে বলল চণ্ডী।

ব্রহ্মচারীর একবার ইচ্ছা হল, জিজ্ঞাসা করে শরীর এরকম হল কী করে? কী অসুখ করেছিল? তখনই মনে হল করালীর মুখে সেদিন সামান্য যেটুকু জেনেছে তার পরে এ প্রশ্ন নিরর্থক। চণ্ডীই আবার কথা পাড়ল। যেন কতদূর থেকে ভেসে এল তার স্বর—তুমি তো চলে এলে। মাসখানেকের মধ্যে মাও সরে পড়ল। সেই যে বিছানা নিয়েছিল, আর উঠল না। আমার অবস্থা তখনও বাবার নজরে পড়ে নি। মা বলে যেতে পারে নি, হয়তো ইচ্ছা করেই বলে যায় নি। ওই লোকটা এসেছিল বাবাকে পৌঁছে দিতে। তারপর আর নড়তে চায় না। লোকের কাছে বলে বেড়ায়, গুরুকে এই অবস্থায় ফেলে যায় কেমন করে। কিন্তু তার আসল টানটা যে কোথায় আমি প্রথম দিনই টের পেয়েছিলাম। তারই সুযোগ নিলাম। দুর্গা বলে ঝুলে পড়লাম ওই করালীর কাঁধে। তখনও ও সবকিছু জানে না। যখন জানল, লাথি মেরে দূর করে দিতে পারত। কিন্তু দেয় নি। বরং অনেক কিছু করেছে আমার জন্যে, যা আপনার লোকেরা কেউ কোনোদিন করত না।

—জ্যাঠামশাই কোথায় আছেন। চণ্ডী একটু থামতেই প্রশ্ন করল ব্রহ্মচারী।

—কী করে জানব? বাড়ি ছাড়বার পর আর খবর পাই নি। এতদিন কি আর বেঁচে আছেন? থাকলেও কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কোনোদিনই জানতে পারবো না।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে গলাটা একটু ধরে এল। একটুখানি ছেদ পড়ল কথার মাঝখানে তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার শুরু করল : যাক্ যা বলতে এসেছিলাম, শোনো। বুঝতেই পারছ, তুমি হঠাৎ চলে আসবার পর আমাকে জড়িয়ে অনেক কথাই রটেছিল তোমার নামে। করালীর কানেও গিয়েছিল নিশ্চয়ই। নবদ্বীপে এসে আমার আগে ও ই জানতে পারে, তুমি এখানে আছ। মাঝে মাঝে বলতেও শুনেছি তোমার কথা। কিন্তু যে এখানে আসা-যাওয়া করে, ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। হঠাৎ একদিন শুনলাম, আমার নাম করে টাকার জন্যে উৎপাত করছে তোমার ওপর। ছিঃ ছিঃ, কী লজ্জা বল তো?

সদানন্দ প্রতিবাদ করল : না না, উৎপাত করবে কেন? তা ছাড়া টাকা তোমার হয়ে চায় নি।

—আমার হয়ে না চা’ক, টাকার দরকার যে আমার জন্যই, সে কথা নিশ্চয়ই বলেছে। তা হলে আর বাকী রইল কী?

—যেখানে থেকেই হোক, সে দরকারটা যদি আমি জেনে থাকি, সেটা কি তোমার এতই লজ্জার কথা?

হয়তো একটু মৃদু অভিমান প্রচ্ছন্ন ছিল সদানন্দের এই প্রশ্নের অন্তরালে। চণ্ডীর কাছে কি ধরা পড়ে নি? পড়লেও সে জানতে দিল না। স্থির সহজ সুরেই বলল, ঠিকই বলেছ। কারও কাছে হাত পাততেই আজ আর আমার লজ্জা করা চলে না।

কারও কাছে! আহত হল সদানন্দ। কিন্তু কী বলবার আছে? যে দূরে ছিল, সে যদি দূরেই থাকতে চায়, একজনকে সবার থেকে আলাদা করে না দেখতে চায়, নালিশ জানাবে সে কার কাছে? তবু চুপ করে থাকতে পারল না। একটু ক্ষোভের সঙ্গেই বলল, আমার কথাটা তুমি বোধ হয় বুঝতে পার নি।

—বুঝে কি লাভ বলো? সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল চণ্ডী : টাকা তুমি দিতে পার, দেবার ইচ্ছাও হয়তো আছে, কিন্তু নেবারও তো একটা অধিকার চাই। তা যদি থাকত, করালীর আগে আমি নিজেই আসতাম তোমার কাছে। সে যাক গে। আমার আসল কথাটাই যে এখনও বলা হয় নি। তোমাকে কিন্তু শুনতে হবে নন্দদা। বলো, শুনবে?

—আমি তো বুঝতে পারছি না, কী বলবে তুমি! সাধ্যমত হলে নিশ্চয়ই শুনব। চণ্ডী ক্ষণকাল নীরব থেকে বলল, তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।

—চলে যেতে হবে! কেন? অতিমাত্রায় বিস্মিত হল সদানন্দ।

—কারণটা যদি না বলি? না হয় মেনেই নিলে আমার একটা অনুরোধ।

ব্রহ্মচারী নিরুত্তর। মুখ ফুটে দূরে থাক, মনে মনেও বলতে পারল না, বেশ, তাই নিলাম, মেনে নিলাম তোমার কথা।

চণ্ডী কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, যদি জিজ্ঞেস কর, আমি যা বলব, কোনও প্রশ্ন না তুলে চোখ বুজে মেনে নেবার মতো কী পরিচয় আমি তোমাকে দিয়েছি, আমার কোনও উত্তর নেই। না যদি শোনো, তা হলেও আশ্চর্য হব না। শুধু ভেবে দেখতে বলব, বড় রকম কারণ না থাকলে এত রাত্রে এই অনুরোধ নিয়ে তোমার কাছে ছুটে আসতাম না।

সদানন্দ তখনও নির্বাক। কী সে বড় কারণ, এত কথার পর জানতে চাওয়াও যেমন সহজ নয়, না জেনে এই অনুরোধ রক্ষা করাও তেমনই কঠিন। চণ্ডী অনুনয়ের সুরে বলল, যত শীগগির পার তুমি কোথাও চলে যাও নন্দদা। ভগবান তোমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন, যেখানে যাবে, লোকে তোমাকে মাথায় তুলে নেবে। নাম বল, অর্থ বল, কোনো দিকেই কোনও ক্ষতি হবে না।

—লাভ-ক্ষতিটাই একমাত্র জিনিস নয়,—শুষ্ক গম্ভীর সুরে বলল সদানন্দ, তার চেয়েও অনেক বড় জিনিস আছে মানুষের জীবনে। আমার যা কিছু সব এইখানে। নবদ্বীপের কাছে আমি অনেকভাবে ঋণী। হঠাৎ তাকে ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

—সম্ভব নয়? ক্ষীণ নৈরাশ্যের সুরে যেন আবৃত্তি করে গেল চণ্ডী। নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে আর কী করতে পারি আমি?

সদানন্দ একটু ইতস্তত করে বলল, কেন চলে যেতে বলছ জানাতে বাধা আছে কি? তোমার যদি কোনও সুবিধা হয়, তা হলে বরং—

চণ্ডীর মুখে ফুটে উঠল এক মর্মান্তিক হাসি। বাধা দিয়ে বলল, আমার সুবিধা? আর একদিন যে কাউকে কিছু না বলে গভীর রাত্রে চলে গিয়েছিলে, সেও কি আমার সুবিধার জন্যে?

—না, তার মধ্যে নিজের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বলতে পার, পালিয়ে গিয়েছিলাম। অপবাদ, তা সে যত বড় মিথ্যাই হোক, সাহস করে তার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি নি।

—কিন্তু আজ আবার যদি আসে তার চেয়েও বড় কলঙ্কের অপবাদ, তার চেয়েও মিথ্যা, জঘন্য, কুৎসিত?

ব্রহ্মচারী হাসল; নিরুদ্বেগ প্রশান্ত হাসি। অত্যন্ত সহজ সুরে বলল, তা হলেও আজ আর পালাবার প্রয়োজন নেই। মিথ্যার ভয় আমার ঘুচে গেছে।

—তুমি বুঝতে পারছ না নন্দদা,—আর্তকণ্ঠে বলে উঠল চণ্ডী, ওই করালীকে তুমি চেন না। ও মানুষ নয়, সাপ; সাপের চেয়েও নিষ্ঠুর। কখন কোন্ পথে, কী ভাবে যে ছোবল মারবে, স্বপ্নেও ভাবতে পার না।

—সেই জন্যেই কি তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?

-–একে তুমি তুচ্ছ করে দেখো না, নন্দদা। তা ছাড়া—

-–তা ছাড়া কী, বলো?

—বুঝতে পারছি, আমিই বোধহয় ওর অস্ত্র। আমাকে দিয়েই হয়তো শোধ তুলবে তোমার ওপর। নিজে থেকে তোমার অনেক অনিষ্ট করেছি। এতদিন পরে আবার আমার হাত দিয়েই আসবে তোমার চরম ক্ষতি? না নন্দদা, তোমার পায়ে পড়ি, আমার এই শেষ কথাটা রাখো। নবদ্বীপ ছেড়ে চলে যাও তুমি। দেরি করলে হয়তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।

উঠানে নেমে ব্রহ্মচারীর পা দুটো চেপে ধরল। বেদনার্ত চোখ তুলে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। আজ আর সরে গেল না সদানন্দ, পা দুটোও ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল না। কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলল, রাত অনেক হল। এবার তুমি বাড়ি যাও।

—যাচ্ছি, তার আগে তুমি কথা দাও—

—কথা দিতে পারি না। তবে তোমার কথা আমি ভেবে দেখবো।

চণ্ডী আর কোনও কথা বলল না। পা ছেড়ে দিয়ে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে নির্জন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত সদানন্দের বিনিদ্র চোখের উপর জেগে রইল দুঃখে দৈন্যে লাঞ্ছনায় ভেঙে-পড়া একটা কুরূপা নারীমূর্তি, কানে আসতে লাগল তার উৎকণ্ঠায়-ভরা ব্যাকুল আবেদন। অন্তরের তলদেশ থেকে ভেসে এল একটি তিরস্কারের সুর—একদিন যাকে সব দিতে পারতে, আজ তার এই সামান্য কথাটা রাখতে পারলে না! এ ভিক্ষা তো সে নিজের জন্যে চায় নি, চেয়েছে তোমারই জন্যে, তোমারই মঙ্গল কামনায়।

সে স্বর ডুবিয়ে দিয়ে জেগে উঠল ক্ষুব্ধ উত্তর—কিন্তু কেমন করে ভুলি, এই নারীই একদিন চরম অভিশাপ নিয়ে এসেছিল আমার জীবনে! কে সে? তার সঙ্গে কী আমার সম্পর্ক, যে তারই কথায় ছেড়ে যেতে হবে বহু যত্নে, বহু সাধনায় গড়ে তোলা এই যশখ্যাতি, অর্থ, সম্মান, এই বহুবিস্তৃত সামাজিক প্রতিষ্ঠা? এ তো ঠুনকো জিনিস নয় যে, এই মিথ্যা অপবাদের ঘায়ে ভেঙে পড়বে?

তবু ভেঙে পড়ল। কদিন পরে এল সেই দুর্জয় আঘাত। এল ওই চণ্ডীর দিক থেকে, তারই মেয়ের রূপ ধরে। করালী কুণ্ডুর নিপুণ হাতে সাজানো রঙ্গমঞ্চে প্রধান ভূমিকা নিল ওই ময়না। অত্যন্ত অতর্কিতে তারই হাত থেকে ছুটে এল ব্রহ্মচারীর মৃত্যুবাণ। অমোঘ সে অস্ত্র এবং তারই হাতে মরল ব্রহ্মচারী—কলঙ্কময় অপঘাত মৃত্যু। এত বড় প্রতিষ্ঠা এবং এতদিনের সুনাম তাকে বাঁচাতে পারল না। অতবড় গর্ব ও গৌরবের ধন যে নবদ্বীপ, সেও তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এল না।

আমার সরকারী বাসভবনের এক কোণে লিখবার ঘরে বসে ব্রহ্মচারী যখন তার কাহিনী শুরু করে তখনও বেলা আছে। তারপর কখন সেই বেলাটুকু ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, রাত্রি এসেছে, কিছুই বুঝতে পারি নি।

চাকর এসে আলোর সুইচটা টিপে দিতেই হঠাৎ খেয়াল হল, ব্রহ্মচারীর মৃদুকণ্ঠ কখন থেমে গেছে, এবং তার পরেও অনেকক্ষণ আমরা দুজনে অন্ধকারে মুখোমুখি বসে আছি, আলো জ্বালবার কথাটাও মনে হয়নি। এবার নড়েচড়ে বসে ডাকলাম, ব্রহ্মচারী! ক্ষীণ অস্পষ্ট কণ্ঠে সাড়া দিয়ে সদানন্দ মুখ তুলে তাকাল। বললাম, আমার সেদিনের কথাটা তোমার মনে আছে?

ব্রহ্মচারী জবাব দিল না; জিজ্ঞাসা করল না, কোন্ দিনের কথা জানতে চাইছি আমি। তার মুখের উপর ফুটে উঠল একটি পরিম্লান করুণ হাসি, যার অর্থ—প্রশ্নটা কি নিরর্থক নয়? হয়তো আমার কণ্ঠেও সেই বিশেষ দিনটির কোনও স্মৃতি জেগে উঠে থাকবে জেলখানার আফিসে শেষবারের মতো যেদিন ওর সঙ্গে আমার দেখা। বললাম, একটা নির্দোষ মানুষ জেলে পচতে লাগল, এই ভেবে অনেকখানি ক্ষোভ ছিল আমার মনে। তারই খানিকটা প্রকাশ করতে গিয়েছিলাম। তুমি বাধা দিয়ে বলেছিলে, আমি তো নির্দোষ নই। শুনে বড় কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।

—জানি, স্যর্—মাথা নত করে বলল ব্রহ্মচারী, তবু যা সত্য, না বলে আমার উপায় ছিল না।

অতিমাত্রায় বিস্মিত হয়ে বললাম, কোনটা সত্য? কী বলতে চাও তুমি? এ কাহিনী যদি মিথ্যা না হয় –

—কাহিনী আমার মিথ্যা নয়। শেষটুকু শুধু বাকী আছে। তাই বলেই আজকের মতো বিদায় নেবো।

আমি অপেক্ষা করে রইলাম। ব্রহ্মচারী কয়েক মুহূর্ত কি ভেবে নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করল : সাধারণভাবে বলতে গেলে নির্দোষ কথাটার অর্থ—সে দোষ করে নি। আইনের চোখেও তাই। অপরাধ মানে কোনও অপরাধমুলক কাজ। কিন্তু মনুষ্যত্বের দরবারে এইটাই কি দোষ-বিচারের মাপকাঠি? দোষ বলুন, অপরাধ বলুন, তার জন্ম আমার মনের মধ্যে। তাই যদি হয়, যে মুহূর্তে সে জন্মাল, তখন থেকেই কি আমি অপরাধী নই? অপরাধটা আমার কাজের মধ্যে দেখা দেয় নি বলেই সে নেই, দোষের কাজ করি নি বলেই আমি নির্দোষ, –তা কেমন করে বলি?

বললাম, তত্ত্ব হিসাবে কথাটা মন্দ লাগছে না, যদিও বেশ জটিল। ও-সব রেখে বরং আসল ব্যাপারটা খুলে বলো।

—তাই বলব। শুধু একটা দিনের কথা। আমার জীবনের সেই মহাপরীক্ষার দিন।

প্রাতঃস্নান আমার চিরদিনের অভ্যাস। সেদিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি কাপড়-গামছা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছি, উঠোনের কোণে নজর পড়তেই চমকে উঠলাম। কুয়োতলায় বাসন মাজছিল একটি মেয়ে। কখনও দেখি নি, তবু তার দেহের প্রতিটি রেখা যেন আমার চিরজীবনের চেনা। মুখ থেকে আপনা হতেই বেরিয়ে গেল—কে তুমি

—আমার নাম ময়না।

—কার মেয়ে তুমি?

—আমার মায়ের নাম চণ্ডী দেবী।

খুঁটিয়ে দেখতে গেলে মায়ের সঙ্গে মেয়ের মিল বেশী নয়, সে রঙ পায় নি, গড়ন কিছুটা পেলেও, সে রূপ পায় নি। তবু সব মিলিয়ে কী ছিল তার দেহে বলতে পারব না। হঠাৎ যেন বহু বছর পিছনে ফিরে গেলাম। বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো আমার সমস্ত চেতনার মধ্যে জ্বলে উঠল এমনই একটা মুহূর্ত—যেদিন প্রথম দেখেছিলাম ওর মাকে। সেদিনের কথা আপনাকে আগেই বলেছি। নারীদেহের যে তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম সেই প্রথম দিন, যে প্রবৃত্তির তাড়না, তারই তাণ্ডবে মেতে উঠল আমার বার্ধক্যের শীতল রক্ত। তারই জ্বালা বোধহয় ফুটে উঠেছিল আমার চোখের মধ্যে। সেদিকে একবার তাকিয়েই অস্ফুট চিৎকার করে সরে গিয়েছিল মেয়েটা।

নিজেকে কোনোমতে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। দরজার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল করালী। আমাকে দেখেই হেসে উঠল তার সেই পৈশাচিক হাসি—”কি গো ব্রহ্মচারী, নির্জন বাড়িতে কোন্ ধর্ম-চর্চা হচ্ছিল ওই মেয়েটাকে নিয়ে?” চিৎকার করে বলতে গিয়েছিলাম, চুপ করো। পারি নি; জোর পাই নি মনের মধ্যে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে আমার মুখের উপর তর্জনী তুলে গর্জে উঠেছিল লোকটা—বলো, টাকা দেবে কি না? সমস্ত শক্তি দিয়ে বলেছিলাম, না। তারপর কোনেও দিকে না চেয়ে ছুটে চলে গিয়েছিলাম গঙ্গার ঘাটে।

ব্রহ্মচারীর উত্তেজিত কণ্ঠ আবার নীরব হল। কয়েক মিনিট বিরতির পর শুনতে পেলাম তার নিরুত্তাপ ধীর স্বর : তার পরের ঘটনা তো আপনি জানেন। জল থেকে উঠতেই আমাকে গ্রেপ্তার করলেন থানা অফিসার। প্রতিবাদ করি নি। ওদের সেই ভয়ঙ্কর অভিযোগও অস্বীকার করতে পারি নি।

—কেন? সে অভিযোগ তো সত্য নয়?

—না, তা নয়। যে অপরাধে জড়িত হলাম, যে অপরাধ আমার সাব্যস্ত হল আদালতের বিচারে, তা আমি করি নি —

—তবে?

—তবু, নিজের অন্তরের দিকে চেয়ে কেমন করে বলি আমি নির্দোষ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *