এক
কর্ণজননী কুন্তীদেবী তাঁর সদ্যোজাত সন্তানকে সাগর-তরঙ্গে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। মহাভারতের এই করুণ কাহিনী আজও আমাদের অশ্রুসিক্ত করে তোলে। কিন্তু আমাদের মাতৃস্বরূপিণী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর যে শত শত সন্তান প্রসব করেই অকূল পাথারে ভাসিয়ে দেন, তাদের জন্যে এক বিন্দু অশ্রুও দেখা দেয় না কারো চোখের কোণে। যদি দিত, এদের নিয়েই রচিত হতে পারত আর একখানা অষ্টাদশ-পর্ব মহাভারত।
যথানিয়মে আমাকেও আমার স্নেহময়ী Alma Mater গলায় একটা ডিপ্লোমার কবচ ঝুলিয়ে একদিন অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিলেন। ‘দ্বারভাঙ্গার’ জঠর থেকে নিক্ষিপ্ত হলাম ভবসমুদ্রের ঘূর্ণিপাকে। ক্ষুদ্র একটা কেরানীগিরির ভেলা জুটিয়ে দেবার মত না জুটল কোন খেতাবধারী মামা, কোন মুরব্বীকৃতার্থ মেসো কিংবা অন্তত একটি অপুত্রক শাঁসালো- শ্বশুর। সম্বলের মধ্যে ছিল একটা শাদা জীনের প্যান্ট আর নীল-তসরেটের কোট। তারই ঘর্মসিক্ত বক্ষে আশ্রয় নিয়ে ঘাটে ঘাটে ঠোক্কর খেয়ে ভেসে বেড়াতে লাগলাম।
মাঝে মাঝে হাকিম-শিকারের যখন প্রয়োজন হত, সদাশয় সরকার এই সব বুভুক্ষু ভাসমান প্রাণীদের মুখের সামনে গোটাকয়েক Competitive পরীক্ষার টোপ ফেলতেন। ঝাঁকে ঝাঁকে প্রলুব্ধ হত ডিগ্রীধারীর দল। তারপর দেখা যেত, টোপ গিলছে অনেকেই, কিন্তু ডাঙায় উঠছে দু-চারজন—যারা একেবারে নির্জলা ভালো ছেলে; অর্থাৎ পরীক্ষার খাতায় যাদের মোটা নম্বর, কিন্তু পুলিশের খাতায় কোন নম্বর পড়েনি। বন্ধুদের মধ্যে একদল ইতিমধ্যে ডাঙায় উঠেছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ ভরসা দিলেন, কারো হাত থেকে আবার বর্ষিত হল শীতল বারি। তাঁরা বললেন, এ পরীক্ষা নয়, ফাঁদ। চাকরির জন্য চাই একদল তৈলসিক্ত, নস্কন্ধ, বশংবদ গুডবয়। যারা জোয়াল কাঁধে নিয়ে ছুটবে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই মাথাচাড়া দেবে না। সে তুমি পারবে না। এহেন সদ্গুণ যে আমার আছে কিংবা কোনদিন আয়ত্ত হবে, ততটা আত্মবিশ্বাস আমার ছিল না। কিন্তু অ্যাপ্লিকেশন আর ইন্টারভিউ তখন এমন বিস্বাদ হয়ে গেছে যে, নেহাত মুখ বদলাবার জন্যেই সরকারী পরীক্ষার টোপ একদিন গিলে ফেললাম।
শ্রীকান্ত বলে গেছেন, ইংরেজ রাজত্বে ডাক্তারের প্রবল প্রতাপ। কসাইখানার যাত্রীদের পর্যন্ত জবাই হওয়ার অধিকারটুকুর জন্য এদের মুখ চেয়ে থাকতে হয়।
আমি গোলামখানার যাত্রী। অতএব শুধু ‘পিলেগ্ঙ্কা ডগ্দরি’ নয়, তার চেয়েও ভয়াবহ এবং ব্যাপকতর ডাক্তারির জন্য আমার এই তুচ্ছ দেহটার তলব পড়ল সর্বশক্তিমান মেডিক্যাল বোর্ডের দরবারে।
মেডিক্যাল বোর্ড!! জনৈক ভুক্তভোগী ক্ষীণদেহ বন্ধু চোখের জলের ভেতর দিয়ে এ-বস্তুটির নাম দিয়েছিলেন, হাঁড়িকাঠ। তারই স্নেহবেষ্টন কল্পনা করে আমার এই ক্ষীণতর গলদেশ ঘন ঘন শঙ্কিত হয়ে উঠল। বন্ধুরা সান্ত্বনা দিলেন। শুভার্থীরা দিলেন উপদেশ। কেউ বললেন, ডাম্বল ভাঁজ; কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন, হাতী কিংবা বাইসনের চর্বি খাও; কারো বা প্রস্তাব হল—বেড়িয়ে এস কাশ্মীর কিংবা উটকামণ্ড। এদিকে সময় মা চৌদ্দ দিন।
সকলের শেষে এলেন সবচেয়ে যিনি বিচক্ষণ ব্যক্তি—আমার বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার হরি পাণ্ডা। আমার দুরবস্থা দেখে বিস্তর আপসোস করলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, একটা সোজা রাস্তা আছে। কিন্তু সে কি আপনার পছন্দ হবে? আপনারা হলেন সব—
বাধা দিয়ে মিনতি করে বললাম, রক্ষে করুন হরিবাবু; এ বিপদে আপনিই একমাত্র ভরসা।
হরি পাণ্ডা একটুখানি ভেবে চুপিচুপি বললেন, আলুসেদ্ধ খান।
—আলু সেদ্ধ!
স্রেফ আলু সেদ্ধ, আর তার সঙ্গে দুবেলা দুটো ভাত। এক হপ্তা পরে আপনার সমস্ত জামাগুলো যদি না বাতিল হয়ে যায়, আমার নাম হরি পাণ্ডা নয়।
অকূল সমুদ্রে কূল দেখা দিল। পড়ে রইল ডাল তরকারী, মাছ-মাংস, দুধ-ঘি। চৌদ্দ দিন ধরে এক নাগাড়ে চালিয়ে গেলাম ভাত আর আলু সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ আর ভাত।
ম্যানেজারের অশেষ দয়া। মাসের শেষে পুরো বোর্ডিং চার্জ নিয়েই তিনি আমাকে রেহাই দিয়েছিলেন, উপদেশের মূল্য বাবদ অতিরিক্ত কিছু দাবি করেননি।
কিন্তু এত সেবা, এত তোয়াজ সত্ত্বেও শরীর মহাশয়ের মন পেলাম না। তার ওজন আর ছাতির মাপ দুটোই আমার বিরুদ্ধ-সাক্ষীর তালিকায় নাম দেখাল। বোর্ডের মুখ গম্ভীর হল। কিন্তু দমে যাওয়া বলে কোন কথা নেই ডাক্তারের অভিধানে। বিপুল পরাক্রমে আরম্ভ হল পরীক্ষা। তিনজন লড়াই-ফেরতা আই. এম. এস-এর সমবেত আক্রমণে আমার শীর্ণ দেহের যে অবস্থা দাঁড়াল, দুরন্ত ছেলের হাতে সেলুলয়েডের পুতুল পড়লে তারও বোধ হয় অতটা দুর্গতি হয় না। পেট টিপে, বুক ঠুকে, দাঁত টেনে, শুইয়ে, বসিয়ে, গলার মধ্যে ডাণ্ডা চালিয়ে, দৌড়-ঝাঁপ করিয়ে এবং আরো অনেক অসহ্য এবং অশ্লীল প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে (যা ডাক্তারের পক্ষেই সম্ভব) আমাকে যখন তাঁরা মুক্তি দিলেন, মনে হল, চাকরির উপযোগী জীবনীশক্তির পরীক্ষা দিতে এসে তার সবটাই এঁদের হাতে নিঃশেষ হয়ে গেল, চাকরি করবার জন্যে আর অবশিষ্ট কিছুই রইল না। কিন্তু কোন্ পুণ্যবলে জানি না, সম্ভবত হরি পাণ্ডার আলুপিণ্ডের কল্যাণে শেষ পর্যন্ত কসাইখানার কর্তারা প্রসন্ন হলেন। পিঠের উপর দাগ পড়ল—ফিট্।
বৈতরণী কোন রকমে পার হয়ে এলাম। হাকিমির স্বর্গারোহণে আর বাধা রইল না। শুভানুধ্যায়ীরা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বন্ধুদের উৎসাহের মরাগাঙে জোয়ার দেখা দিল। কংগ্রাচুলেশনের তুফান তুলে তাঁরা আমাকে হাবুডুবু খাইয়ে দিলেন। কিন্তু ডাক আসে কই? আমার সে ছাপমারা গদিটা কি শূন্যই থেকে যাবে? দিনের পর দিন চলে গেল। হিজ ম্যাজেস্টিস সার্ভিস-এর বার্তা বহন করে একখানা বাদামী রঙয়ের লেফাফা আর এসে পৌঁছল না।
প্রথমটা ক্ষোভ এবং উষ্মা যতই হোক, শেষ পর্যন্ত সান্ত্বনাই দিলাম মনকে। এ ভালই হল। হাকিমির ‘মোহগর্তে’ না ফেলে ভগবান আমাকে একেবারে লালদীঘির মাঠে এনে ছেড়ে দিলেন। সামান্য ‘দু বিঘার’ পরিবর্তে লিখে দিলেন বিশাল সেক্রেটারিয়েটের ‘বিশ্ব- নিখিল’। আবার শুরু হল অভিযান। জীনের প্যান্ট আর তসরেটের কোটের গায়ে ঘন- ঘন ডাইংক্লিনিং-এর নম্বর পড়তে লাগল।
এমন সময়ে একদিন খবর পাওয়া গেল, বাংলা সরকারের জনৈক মন্ত্রী গুটিকয়েক লোভনীয় চাকরির মেওয়া নিয়ে অপেক্ষা করছেন চট্টগ্রামের কোন টিলার উপর। আমার মত ‘হীরের টুকরো’র দেখা পেলে একটা বড় গোছের মেওয়া যে সঙ্গে সঙ্গে হাতে তুলে দেবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। একটা লম্বা-চওড়া সুপারিশপত্রও সংগ্রহ করা গেল। যিনি দিলেন শুনলাম তিনি মন্ত্রীবরের বিশেষ বন্ধু এবং সে বন্ধুত্ব প্রধানত গ্লাসিক্। অতএব চাকরি সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিন্ত হয়েই ছুটলাম চট্টগ্রাম।
সুদৃশ্য বাংলো। সুবিন্যস্ত পরিবেশ। বিচিত্র-বেশী প্রার্থীর ভিড়। কিন্তু মন্ত্রী-সাহেবের দেখা নেই। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করবার পর আবিষ্কার করা গেল যে তিনি বাংলোসংলগ্ন গোলাপ-বাগিচায় প্রাতভ্রমণ ব্যপদেশে একটি সুরম্য কাচের পাত্রে অর্ধ ফুটন্ত গোলাপের বুকের ভিতর থেকে শিশির সঞ্চয়নে ব্যস্ত আছেন। সেই দিকে চেয়ে মনে হল চৌষট্টি- হাজারি মসনদে বসে এই সব অক্লান্ত-কর্মী মন্ত্রীদের কী কঠোর পরিশ্রমই না করতে হয়!
আরো এক ঘণ্টা কেটে গেল। শেষটায় একরকম মরিয়া হয়েই সেই গোলাপকুঞ্জে অনধিকার প্রবেশ করে মন্ত্রী-বাহাদুরকে কুর্নিশ জানালাম। তিনি সুমাচিত্রিত মদিরাক্ষি বিস্তৃত করে আমার দিকে তাকালেন এবং স-সুপারিশ আবেদনপত্র গ্রহণ করলেন। একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় আমি তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করলাম। মন্ত্রীবর জবাব দিলেন না। মৃদু হেসে আবার শিশির-সংগ্রহেই মনোনিবেশ করলেন।
তৃতীয় ঘণ্টা যখন শেষ হল, মন্ত্রীবরের সেক্রেটারির শরণ নিলাম। আবেদনপত্র সম্বন্ধে প্রশ্ন করতেই গম্ভীরভাবে ইংরাজী ভাষায় জানালেন, ডাকে জবাব যাবে।
চব্বিশ বছর সাত মাস কেটে গেছে। সে ডাক এখনো আসেনি। হয়তো আরো সময় লাগবে।
চাকরি দিন আর না দিন, অযাচিত এবং জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দানে কেউ কার্পণ্য করেন না। রেজিস্ট্রেশন বিভাগের বড়কর্তা বেশ খাতির করে বসালেন। দেশের বেকার সমস্যা, মেয়ের বিবাহে পণপ্রথা, প্রমোশন সম্বন্ধে গভর্নমেন্টের অবিচার ইত্যাদি বড় বড় বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করে অবশেষে বললেন, এক কাজ করুন। চাকরি করে আর কি হবে? তার চেয়ে চিনাবাদামের চাষ করুন না কেন? নিজে হাতে লাঙল না ধরেই তো বাঙালীর এই দুর্দশা। আর দেখুন তো ওদের দেশ। লয়েড জর্জের বাপ জুতো সেলাই করতো। ফোর্ড ছিল মিস্ত্রী। অথচ—
শিক্ষা বিভাগের এক সহকারী অধিকর্তাও একদিন অত্যন্ত ব্যথিত হলেন, যখন শুনলেন যে, আমি একটা সামান্য মাস্টারির জন্যে উমেদার। বললেন, ইয়ংম্যান, মুষড়ে পড়লে চলবে কেন? পল্লীগ্রামে চলে যান। ঘরে ঘরে শিক্ষা বিস্তার করুন। পড়েছেন তো শরৎ চাটুজ্যের পল্লীসমাজ?—বিশ্বেশ্বরী বলছেন, আলো জ্বেলে দে রে রমেশ, আলো জ্বেলে দে।
এখন আমাদের যুবকদের শুধু আলো জ্বালাতে হবে।
আবগারী থেকে পশু-চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য থেকে মৎস্যচাষ—কোন দপ্তরই বাদ দিই না! জুতোর সোল বদল হল তিনবার। তসরেটের নীল কোট হয়ে গেল পাঁশুটে। দুটো অঞ্চল তখনো মাড়াইনি—জেল আর পুলিশ। কেন জানি না, এদের সম্বন্ধে কেমন একটা আতঙ্ক ছিল। কিন্তু মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলা করেন যে মহা জাদুকর, তিনি বোধ হয় মনে মনে হেসেছিলেন, যেদিন হঠাৎ আমন্ত্রণ জানালেন খোদ কারাবিভাগের শ্বেতাঙ্গ ইন্সপেক্টার জেনারেল এক হোমরা চোমরা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আই. এম. এস.। ভয়ে ভয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিনা ভূমিকায় বললেন, তোমার কেসটা দেখলাম। ভেরী স্যাড। যাক। আমি তোমাকে নিতে প্রস্তুত আছি। এই হল চাকরি, এই তার ভবিষ্যৎ বলে চাকরির এমন এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিলেন, যেন ওটা চাকরি নয়, তাঁর বয়স্থা অনূঢ়া কন্যা; আমাকে যোগ্যতম পাত্র মনে করে গছিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। সধন্যবাদ সম্মতি জানিয়ে চলে আসছি; ডেকে ফিরিয়ে বললেন, তোমাকে বড় কাহিল দেখাচ্ছে। You should get a healthy station. দার্জিলিং যাও। কি বল?
প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম হল। আমার মত আনাড়ি রংরুটের কোন একটা সেন্ট্রাল জেলে কয়েক বছর শিক্ষানবিশি করবার কথা। দার্জিলিং-এর মত ছোট জায়গা আমার প্ৰাপ্য নয়।
এক ক্ষান্ত-বর্ষণ শারদ-সন্ধ্যায় শুরু হল অভিযান। চললাম মেঘমায়ার দেশে। যাহোক একটা আশ্রয় জুটল। ক্ষুদ্র হোক, বৃহৎ হোক, একটা অবলম্বন। অবসান হল উদ্বেগময় অনিশ্চয়ের। এসব কথা যে সেদিন মনে হয়নি, তা নয়। কিন্তু সমস্ত ছাপিয়ে মনের মধ্যে জেগে উঠল কেমন একটা ভয়। অপরিচিত ভবিষ্যৎ। ঝাঁপ তো দিলাম। কে জানে কি আছে তার রহস্যময় অন্ধকার গর্ভে?