দুই
নাম গোলাম মামুদ। চাকরি করেন লীগ সরকারের জেলখানায়। অথচ দাড়ি নেই, লুঙ্গি নেই, পরেন শান্তিপুরী ধুতি। তার পেছনে কাছা, সামনে কোঁচার বাহার। ফল যা হবার তাই হল। স্বজাতি মহলে চাঁই-এর দল চঞ্চল হয়ে উঠলেন। শোনা গেল, এ হেন অনাচার কর্তৃপক্ষের নজরে না এনে তাঁরা কিছুতেই ঠাণ্ডা হবেন না। তাঁর নিজের অফিসেও স্বজাতির দলটাই তখন প্রবল। বলতে গেলে আমিই কেবল বিজাতীয়। তবু তাঁদের চেয়ে আমার উপরেই টানটা যেন বেশী পড়ল জেলর সাহেবের। আমি তাঁর জেলখানার অন্যতম অনুচর, কিন্তু বৈঠকখানার অদ্বিতীয় সহচর। একদিন সেখানে বসেই চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বলে ফেললাম, কাজটা ভালো হচ্ছে না, দাদা।
উনি তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে গড়গড়া টানছিলেন। হঠাৎ না বুঝতে পারার সুরে বললেন, কোন্ কাজটা?
তাঁর সযত্ন-রচিত কোঁচাটা দেখিয়ে দিলাম।
মামুদ সাহেব হাসলেন, এ দিকে দেখছি তোমারও নজর পড়েছে। যাকে বলে, কোঁচায় সর্পভ্রম। কিন্তু যা ভাবছ তা নয়। এর পেছনে একটা মজার ইতিহাস আছে।
—কি রকম? মজার গন্ধে একটু এগিয়ে বসলাম।
—তবে শোন, বলে নলটায় গোটা কয়েক ঘন ঘন টান দিয়ে শুরু করলেন—’বছর পাঁচেক আগেকার কথা। সিউড়ি থেকে বদলি হয়ে এলাম খুলনায়। চার্জ নেবার কদিন পর সন্ধ্যাবেলা বসে বসে ওয়ারেন্ট চেক করছি। হাকিমের নামটায় নজর পড়তেই থেমে গেলাম। এস. বি. সেন। আমাদের সুনীল নয়তো? একসঙ্গে বি. এ. পাশ করেছি। তার কিছুদিন পরেই ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কোথায় চলে গেল। অনেকদিন দেখা নেই। ও-এস.-কে ফোন করে জেনে নিলাম, হ্যাঁ, সুনীলই বটে। বাসার ঠিকানাটাও সংগ্রহ করে ফেললাম।
‘এই যা দেখছ, এইটাই আমার চিরকালের পেটেণ্ট চেহারা। আজন্ম ডিসপেটিক। ভোরে উঠে এক চক্কর না ঘুরে এলে খিদে হয় না।’ পরদিন সকালেই বেড়িয়ে ফেরবার মুখে সুনীলের বাড়িতে গিয়ে হানা দিলাম। চাকর এসে বলল, বাবু এখনও ওঠেন নি। বাড়িতে মেয়ে-ছেলে নেই। ওর শোবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দেওয়া গেল। ভেতর থেকে বিরক্তির সুরে সাড়া এল, কে? জবাব দিলাম না। মিনিট দুই অপেক্ষা করে একবার কড়া নেড়ে দিলাম। দরজা খুলে গেল। সুনীল অসময়ে ঘুমভাঙা রুক্ষ চোখ দুটো একবার আমার দাড়ি থেকে লুঙ্গি পর্যন্ত বুলিয়ে নিয়ে চড়া গলায় বলল, কাল না তোমাকে বলে দিলাম, আণ্ডা আমার চাই না? আবার এসেছ বিরক্ত করতে! আমি কাঁদো-কাঁদো গলায় বললাম, না এসে উপায় কী হুজুর? আপনারা পাঁচজনে দুটো আণ্ডা না নিলে আমার পেট চলে কী করে?
‘আরে, এ যে মামুদ’ —বলেই কোমরের কাপড় সামলাতে সামলাতে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল।
‘বাসায় ফিরে প্রথমেই গিয়ে দাঁড়ালাম আমার শোবার ঘরে বড় আরশিটার সামনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম নিজেকে। তারপর কী মনে হল, বৈঠকখানায় এসেই নাপিত ডেকে পাঠালাম। চেহারাটা খোদার দেওয়া। ওটা তো আর ছাড়া যায় না। ছাড়লাম আমার অনেকদিনের পুরনো সাথী—দাড়ি আর লুঙ্গি।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু দাদা, ওরা আপনাকে অত সহজে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। হয়তো এবার ঐ পাঁচ বছরের অবহেলার শোধ নিয়ে বসবে।’
—দেখা যাক, বলে নলটা আবার তুলে নিলেন মামুদ সাহেব।
যে সময়ের কথা বলছি, তার কিছুদিন পরেই নোয়াখালির রঙ্গমঞ্চে দেখা দিয়েছিল সেই বীভৎস নাট্যলীলা। এটা ছিল তারই মহড়ার যুগ। সুতরাং জাতির বৈশিষ্ট্যের ধ্বজাধারী একদল বীরপুরুষ আচকান আর পায়জামা চড়িয়ে হঠাৎ একদিন হানা দিলেন মামুদ সাহেবের বৈঠকখানায়। ভুল উর্দুর সঙ্গে খাঁটি স্বদেশী খিস্তি মিলিয়ে তাঁর ধুতি আর শ্মশ্রুহীন মুখের বিরুদ্ধে ঘোষণা করলেন জেহাদ। মামুদ দমবার পাত্র নন। নির্ভুল উর্দুতে মোলায়েম সুরে সে জবাব দিলেন, তার মানে হচ্ছে, ওটা তাঁর ব্যক্তিগত রুচির এলাকা, এবং সে জায়গায় অন্যের নির্দেশ বা উপদেশ তিনি অনধিকারচর্চা বলে মনে করেন।
এর মাসখানেক পরেই এল ওঁদের ঈদ্ পর্ব। স্থানে অস্থানে কোরবানির ধুম পড়ে গেল। মামুদের রন্ধনশালায় মাংস জিনিসটা নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু তার জাত সম্বন্ধে বাছ- বিচার ছিল। মুরগী এবং খাসী ছাড়া আর কোন জন্তু সেখানে ঢুকবার অধিকার পায় নি। ব্যাপারটা তাঁর স্বজাতি-মহলে তোলপাড় তুলেছিল। হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই, ঈদের দিন সকালবেলা খান বাহাদুরের কুঠি থেকে কুলির মাথায় বিশাল এক ঝুড়ি এসে হাজির। বিশ-পঁচিশ সের গোস্ত—জেলর সাহেব এবং তাঁর স্বধর্মী সহকর্মীদের জন্যে কিঞ্চিৎ উপহার!
মামুদের আরদালি ছিল ইয়াসিন সেখ। সেই বৃহৎ মাংসখণ্ডগুলোর দিকে একবার তাকিয়েই তাড়াতাড়ি কুলিটাকে সরিয়ে দেবার আয়োজন করছিল। মামুদ বাধা দিলেন। ঐ ইয়াসিনকে পাঠিয়ে জেলের বাগান থেকে আনিয়ে নিলেন দুজন কোদালধারী কয়েদী। বাড়ির পেছনে খানিকটা পোড়ো জায়গা পড়ে ছিল। তারই এক কোণে খোঁড়া হল একটা ছোটখাটো কবর। মাংসের টুকরোগুলো সযত্নে মাটি চাপা দেবার পর, কুলির সঙ্গে যে মৌলভী গোছের লোকটি এসেছিলেন, তাঁর দিকে ফিরে বিশুদ্ধ উর্দু ভাষায় বিনীত কণ্ঠে বললেন মামুদ, খান বাহাদুর সাহেবকে আমার হাজার হাজার আদাব জানাবেন। তাঁর উপহার পেয়ে আমি ভারী খুশী হয়েছি।
এই আদাবের উত্তর কখন কী ভাবে পাঠিয়েছিলেন খান বাহাদুর, সেটা জানবার আমার অবকাশ হল না। তার আগেই এসে গেল বদলির হুকুম।
মাস ছয়েক পরে আদালত থেকে কী একটা মামলায় সাক্ষীর সমন পেয়ে আবার যেতে হয়েছিল সেই পুরাতন কর্মস্থলে। শুনলাম, মামুদ সাহেব তখনো টিঁকে আছেন। কোর্টের কাজ সেরে গেলাম দেখা করতে। খবর পেয়েই ছুটে এলেন বৈঠকখানায়। পরনে শান্তিপুরী ধুতি নয়, হাওড়া হাটের লুঙ্গি; আর চিবুকের তলায় কিঞ্চিৎ নুর। বাঁ হাতটায় একটা ব্যাণ্ডেজ।
বোধ হয় একটু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। উনি ম্লান হেসে বললেন, তোমার কথাই ঠিক হল, মলয়। এরা শোধ নিয়েছে, ভালো করেই নিয়েছে।…সেবার মান রাখতে গিয়ে পোশাক ছেড়েছিলাম। এবার চাকরি রাখতে গিয়ে মান ছাড়লাম।
শেষের দিকে গলাটা কেমন উদাস হয়ে এল। আমি সে প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে বললাম, হাতে কী হল?
—হাতে? ও-ও, সেও এক মজার ব্যাপার। বলছি, বোসো।
মামুদ সাহেব ভিতর থেকে একবার ঘুরে এলেন। তার আগেই এল ঘরের তৈরী সন্দেশ আর চা। মিনিট কয়েক যেতে না যেতেই জমে উঠল আমাদের সেই পুরোনো দিনের আড্ডা। তারই ফাঁকে শুনতে পেলাম ওঁর ব্যাণ্ডেজ-বাধা হাতের কাহিনী!
তিন-চার দিন আগের ঘটনা। তখনও ঠিক ভোর হয়নি। জেলর সাহেবের ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। হঠাৎ কানে গেল একটানা বাঁশির সুর। এ সর্বনেশে বাঁশি তার চেনা। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। দু-তিন মিনিট না যেতেই জেল-গেটে উঠল পেটা ঘণ্টার আর্তনাদ। জেল-অ্যালার্ম! চলতি কথায় যাকে বলে পাগলা ঘণ্টি। হাতের কাছে যা পেলেন, তাই জড়িয়ে নিয়ে ছুটলেন মামুদ। ততক্ষণে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে লাঠি পার্টি আর তার সামনে রাইফেলধারী স্কোয়াড। হুকুম পেলেই ডবল মার্চ করে ঢুকে পড়বে জেলখানায়।
সদলবলে অকুস্থলে গিয়ে দেখলেন মামুদ, যা আশঙ্কা করেছিলেন, ঘটেছে ঠিক তাই। তেরো নম্বরের জানালার শিক ভেঙে উধাও হয়েছে এক ছোকরা কয়েদী। জেলর সাহেবের নাকের উপর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মরচে-ধরা ক্ষয়ে-যাওয়া ভাঙা ডগা মুহূর্তমধ্যে সারা জেল জুড়ে শুরু হল তাণ্ডব। তন্নতন্ন করে খোঁজা হল প্রতিটি বাড়ির কোণ, পাঁচিলের ধার, গাছের ডাল আর নর্দমার তলা। কিন্তু পলাতকের সন্ধান পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল পাঁচিলের গায়ে দাঁড় করানো একটা বাঁশ আর তার পাশে একটা ছেঁড়া কুর্তা।
ছেলেটার নজর আছে, বললেন মামুদ সাহেব। এতদিন থাকল আমার হোটেলে। যাবার সময় বখশিশ দিয়ে গেল গায়ের একটা ছেঁড়া জামা
পাগলা-ঘণ্টি শেষ হবার আগেই এসে পড়লেন জেল-সুপার। পরীক্ষা করলেন ভাঙা শিক আর ছেঁড়া কুর্তা। তারপর চারটে সিপাইকে সাপেণ্ড করে উঠলেন গিয়ে গাড়িতে
চারটে সিপাই! সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন মামুদ সাহেবের প্রতিবেশী এক উকিলবাবু। মিনিট দশেক আগে এসে আমার পাশে একটা চেয়ার দখল করেছিলেন।
মামুদ বললেন, সেইটাই সাধারণ নিয়ম। একটা ‘এসকেপ’ মানেই চারজনের গর্দান।
—তারা সব কারা? জানতে চাইলেন উকিলবাবু।
—এই ধরুন, এক নম্বর—বাবুটি যে-ওয়ার্ড থেকে চম্পট দিলেন, তার ওয়ার্ডার-ইন- চার্জ। দু নম্বর—যেখান দিয়ে তিনি পাঁচিল লঙ্ঘন করলেন, সেই অঞ্চলের ওয়াল-গার্ড। তিন নম্বর হল জানালা-ঠোকাই।
—সেটি আবার কে?—কৌতুককণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন উকিল ভদ্রলোক।
মামুদ হেসে বললেন, জানালা-ঠোকাই চেনেন না! বড় মুশকিলে ফেললেন দেখছি। পরিচয়টা একটু জানিয়ে দাও তো, মলয়। আমি ততক্ষণে মৌতাতটা সেরে নিই। তোমরা তো এ রসে বঞ্চিতই রয়ে গেলে।
গড়গড়ার নলটা মুখে তুললেন জেলর সাহেব। সদ্য-সাজা অম্বুরী তামাকের মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরে উঠল। বললাম, একেবারে বঞ্চিত হই নি দাদা। ঘ্রাণেন কিঞ্চিৎ পাচ্ছি বৈকি। তবে সেটা হয়তো ঠিক অর্ধ-ভোজন নয়।
উকিলবাবুর দিকে ফিরে বললাম, আপনার তো জেলের পাশেই বাড়ি। রোজ দুটো আড়াইটার সময় সারা জেলে একটা শব্দ ওঠে ঠন ঠন ঠন ঠন, ঠক ঠক। কখনও লক্ষ্য করেন নি?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ; মাঝে মাঝে শুনতে পাই বটে। বাড়িতে আমরা বলাবলিও করেছি। কেউ বলতে পারে নি ওটা কী।
—ওটা হচ্ছে লোহার ডাণ্ডা দিয়ে জানালা-দরজার শিক ঠোকার শব্দ। একজন সিনিয়র ওয়ার্ডারের ওপর ঐ দরকারী কাজটার ভার পড়ে। তারই নাম জানালা-ঠোকাই। সন্ধ্যাবেলা ‘লক-আপ’-এর ঠিক আগে তাকে রিপোর্ট দিতে হয় জেলর সাহেবের কাছে, জানালা দরজা সব পরখ করে দেখলাম, ‘সব ঠিক হ্যায়’। এই রকম আর একজন আছে, ঠিক সন্ধ্যার আগে টহল দিয়ে ফেরে সারা জেলখানা। দেখে বেড়ায়, কোথাও পড়ে আছে কিনা বাঁশ, দড়ি কিংবা ঐ ধরনের কোনো মারাত্মক জিনিস। তাকেও রিপোর্ট দিতে হয় লকআপ টেবিলে, তামাম জেলখানা ঘুম্-ঘামকে দেখা। বাঁশ রশি সব বন্ধ হ্যায়।
ঐ হল চার নম্বর, যোগ করলেন মামুদ সাহেব।
সুপার চলে যেতেই শুধু বড় জমারদারকে সঙ্গে নিয়ে জেলের ভিতরটা চুপি চুপি ঘুরে দেখছিলেন জেলর সাহেব। কয়েদীরা তখনও বন্ধ। ফিমেল ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে পথ। হঠাৎ কানে এল কলকণ্ঠের হাসির ঝঙ্কার। কী ব্যাপার? একটু দাঁড়িয়ে গেলেন মামুদ সাহেব। শুনলেন, বলে উঠল কে একটি মেয়ে, কী মুশকিল! কতক্ষণ আর আটকে রাখবে?
—চুপ কর না, ধমকে উঠলেন আরেকজন। কী রকম মজাটা হল, মাইরি! সাহেব থেকে সিপাই সক্কলের মুখ চুন।
—যা বলেছিস ভাই, উচ্ছলিত কণ্ঠ শোনা গেল আর-একটি মেয়ের। ওঃ, যা আনন্দ হচ্ছে! বাহাদুর বটে ছোকরা। একবার দেখতে ইচ্ছে করে, সত্যি।
এর পর যে মন্তব্য শোনা গেল, তার মধ্যে কিঞ্চিৎ আদি রসের আধিক্য। মামুদ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিলেন। কিন্তু ওদের ঐ অহেতুক উল্লাসের নিগূঢ় সত্যটি তাঁর মনের মধ্যে লেগে রইল। যে ছেলেটা পালিয়ে গেছে সে এদের কেউ নয়। তার কোনও পরিচয় এরা জানে না। কখনও দেখে নি, নামও শোনে নি কোনোদিন। পালিয়ে গেছে বলেই আজ সে ওদের আপনার জন। তাদের সঙ্গে এদের একাত্মতা। যে শৃঙ্খলে এরা বাঁধা পড়ে রইল, তারই বন্ধন সে ছিঁড়ে চলে গেছে, অগ্রাহ্য করে গেছে এই পাষাণ- প্রাচীরের অবরোধ, এই সিপাই-শাস্ত্রী-লাঠি-বন্দুকের ভ্রুকুটি। ওদের মনেও লেগেছে সেই মুক্তির বাতাস। সমস্ত জেলের আজ আনন্দের দিন।
গোটা দুয়েকের সময় আবার অ্যালার্ম বেজে উঠল।
—আবার!
মামুদ সাহেব বললেন, কী করা যাবে বল? কপালে দুঃখ থাকলে কেউ খণ্ডাতে পারে না। এবারকার ঘটনাস্থল জেনানা ফাটক। গিয়ে দেখলাম, জনচারেক পড়ে আছে দাঁত লেগে; একদল হাত-পা ছুঁড়ছে, মানে হিস্টিরিয়া; আর বাকীগুলো পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। ডাক্তার বেচারা যে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কার নাকে দিচ্ছে স্মেলিং সল্ট, কারও মাথায় ঢালছে জলের বালতি। ব্যাপার যা শুনলাম, রীতিমতো ভৌতিক কাণ্ড।
শীতের দিন। খোলা উঠানে বসে মেয়েরা তাদের দুপুরের বিশ্রামটুকু সেরে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ একজনের নজর পড়ল কম্পাউণ্ড পাঁচিলের ওধারে একটা ছোট ব্যারাকের ছাদের উপর। সারি সারি মাটির গামলা উপুড় করে বসানো।
গামলা কেন? প্রশ্ন করলেন উকিলবাবু।
দেখছেন না? কোন্ শায়েস্তা খাঁর আমলের বাড়ি। তখন ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা ছিল ছাদ ফুটো করে। সেখান দিয়ে আবার বৃষ্টি আসবে তো? তাই ঐ গামলার ঢাকনা। মেয়েটার মনে হল ওরই ভেতর একটা বড় গামলা বেশ তালে তালে নাচছে।
তোমরা হাসছ, কিন্তু ওর হার্ট বেচারি তখন ফেল করে-করে। বেশ করে চোখ রগড়ে আরেকবার দেখল। নাঃ, ভুল নয়। দু-চার মিনিট বিশ্রাম নিয়ে গামলা-সুন্দরী আবার নৃত্য শুরু করলেন! সবাই জানে, ওটা হচ্ছে কলেরা ওয়ার্ড, আর ওর ঠিক পাশেই হচ্ছে ফাঁসিমঞ্চ, যাকে বলে gallows। কিছুদিন আগেই সেখানে একজনকে ঝোলানো হয়েছে। ব্যাস্ আর যায় কোথায়! মেয়েটির জিব গেল টাকরায় আটকে, চোখ উঠল কপালে আর গলা থেকে বেরিয়ে এল একটা গোঁ গোঁ গোছের বিকট আওয়াজ। তার হাতের ইশারা লক্ষ্য করে আরও দু-চারজন যারা তাকিয়েছিল ঐ দিকে, তারাও এক দফা নাচ দেখে নিল। তারপরে যে কাণ্ড হল, সেটা তোমরা কল্পনা করে নাও, আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। আমার ফিমেল ওয়ার্ডার ডিউটির নাম করে একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলেন। হাঁউমাউ শুনে যখন ঘুম ভাঙল, দেখলেন, situation out of control। তাঁর হাতে তখন একটিমাত্র অস্ত্ৰ—ঐ বাঁশি। তাই প্রাণপণে ফুঁকে দিলেন।
এবার বিশাল বাহিনী নিয়ে হানা দিলাম কলেরা ওয়ার্ডের ফটকে। খালি বাড়ি পড়ে আছে। ছাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এতগুলো লোকের ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল! নৃত্যদর্শনের সৌভাগ্য হল না। ভৌতিক-দুনিয়ার যাঁরা বাসিন্দা, তাঁদের স্বভাব-চরিত্র ঠিক জানা নেই। তাঁরা ভয় দেখান শুনেছি। হয়তো জায়গা বিশেষে ভয় পেয়েও থাকেন। বিশেষ করে জেলখানার পাগলা ঘণ্টিকে কেয়ার করে না এরকম পাগলাভূত পাওয়া দুষ্কর। রিট্রিট করব কিনা ভাবছি, হঠাৎ যেন মনে হল, গামলাটা একটু নড়ছে। সবাই রৈ রৈ করে উঠল; কিন্তু উপরে উঠে ব্যাপারটা পরখ করবার হুকুম যখন দিলাম, সব চুপচাপ। তবে দু-একজন সাহসী মানুষ জেল ফোর্সেও থাকে। তাবই একজন একটা মই লাগিয়ে উপরে উঠে গেল, এবং অনেকখানি দূর থেকে গামলা তাক করে ছুঁড়ে মারল লাটি। গামলাটা ভেঙে যেতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল খালি গা, জাঙ্গিয়া-পরা লিলিকে এক ছোকরা। আমাদের দিকে চেয়েই কেঁদে উঠল ভেউ ভেউ করে।
পুরীর সমুদ্র দেখেছ? তার চেয়েও মহা বিক্রমে গর্জে উঠল আমার ফোর্স।
মইটাকে তৎক্ষণাৎ সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করলাম আর হাবিলদারকে বললাম রিজার্ভ ফোর্স ফিরিয়ে নিতে। নিতান্ত অনিচ্ছায় তারা মার্চ করে চলে গেল। আরদালি, বডিগার্ড, গোছের দু-চারজন যারা রইল, তাদের বিশেষ মারমুখী বলে মনে হল না। এইবার মই লাগিয়ে বললাম ছেলেটাকে নেমে আসতে। সে কি আসতে চায়? ছাদের উপর দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল হাত জোড় করে। জিজ্ঞাসা করলাম, পালিয়েছিলি কেন?
—মেট মারত রোজ।
—কেন?
আর কথা বলে না। দু-চারটা ধমক দিতেই বলল, খারাপ কাজ করতে চেয়েছিল, আমি দিই নি।
অসম্ভব নয়। ছেলেটি দেখতে সুশ্রী। বললাম, এখানে এসে জুটলি কী করে?
সেও এক তাজ্জব কাহিনী। শেষ রাতে শিক ভেঙে তো বেরোল। রান্নাঘরের পাশ থেকে একটা বাঁশও যোগাড় হল। কিন্তু নানা রকম কসরত করেও পাঁচিলে ওঠার সুবিধে হল না। এদিকে ভোর হয়ে আসছে। হঠাৎ কারও নজরে পড়লে পাঁউরুটি বানিয়ে দেবে। তাই ফরসা হবার আগেই কোনও রকমে গা-ঢাকা দিয়ে পাইপ বেয়ে উঠল কলেরা ওয়ার্ডের মাথায় আর আশ্রয় নিল গামলার নীচে। তারপর সাত-আট ঘণ্টা বসে থেকে কোমরে আর পায়ে যখন খিল ধরে গেছে, তখন ওই গামলা মাথায় দিয়েই মাঝে মাঝে উঠে একটু লেফট রাইট করবার চেষ্টা করছিল।
জেনানা ফাটক থেকে একজন যে সেদিকে চোখ দিয়ে বসে আছে, ও কেমন করে জানবে?
অনেক করে ভরসা-টরসা দেবার পর নামতে রাজি হল ছোকরা। মাটিতে পা দিতে যাবে, এমন সময় চোখের পলকে কোত্থেকে ছুটে এল চার-পাঁচজন বীরপুরুষ। একটা নিরীহ ছাগলছানার ওপর লাফিয়ে পড়ল একপাল নেকড়ে। ও ব্যাটাও ওস্তাদ কম নয়। বেটনের বেড়াজাল এড়িয়ে কেমন করে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল এসে আমার পায়ের ওপর। বাঁ হাতটা বোধ হয় একটু বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ তার ওপর সপাং করে উঠল বেটনের ঘা।
জেলর সাহেব আবার গড়গড়ার আশ্রয় নিলেন। বলবার মতো কিছু ছিল না। আমরা- শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম। কয়েক মিনিট পর অনেকটা যেন কৈফিয়তের সুরে বললেন মামুদ, সকালে যাদের সাসপেণ্ড করা হয়েছে ঐ সিপাইটা তাদেরই একজনের ছেলে। ছোকরা মানুষ। নিজেকে ঠিক সামলাতে পারে নি।
বললাম, তা বুঝলাম। কিন্তু আপনার যে সামলে উঠতে বেশ কিছুদিন লাগবে।
—না হে। এমন কিছু নয়। ডাক্তারদের কাণ্ড তো? কেরামতি দেখাবার কোনও একটা সুযোগ পেলেই হল। অফিসে যেতে পারতাম, কিন্তু ঐ হতভাগাটা শুনছি ঘুরঘুর করছে বাড়ির চারদিকে। মতলব মোটেই ভালো নয়।
বলেন কী? রাগে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন উকিলবাবু। মামূদ সাহেবও চড়া গলায় বললেন, তাই দেখুন না! লাঠি ঠুকে নুলো বানিয়ে দিলি। তাতে আশ মিটল না, এবার কপাল ঠুকে খোঁড়া না বানিয়ে ছাড়বে না।
তারপর একটু হেসে স্বর নামিয়ে বললেন, তাই কটা দিন একটু গা-ঢাকা দিয়ে আছি।