ছয়
অফিস বলতে সচরাচর বুঝি এমন একটা অন্ধকার বন্দিশালা, যার গহ্বরে কলম চলে দশটা থেকে পাঁচটা। সে কলম যারা চালায়, বহু আকাঙ্ক্ষিত দিবা-নিদ্রার সুযোগ তাদের বিরল, অর্থাৎ সপ্তাহান্তে একটি দিন, রবিবারের মধুর মধ্যাহ্নে। জ্যোতিষশাস্ত্রে আমার অধিকার নেই। আমার রাশিচক্রের কোন্ তুঙ্গে কোন্ গ্রহ বা উপগ্রহ অবস্থান করছেন, সে সম্বন্ধেও আমি নিতান্ত অজ্ঞ। তবে সন্দেহ হয়, আমার মর্মস্থানে যিনি অধিষ্ঠিত তাঁর নাম চন্দ্রদেব। তাঁরই দৃষ্টি-প্রসাদে এমন এক স্বর্গে এসে কলম ধরেছি, যেখানে দিবানিদ্রার দৈনন্দিন অবসর। শুধু এই কারণেই চাকরি-জগতে আমরা সার্বকালিক ঈর্ষার পাত্র।
কিন্তু হায়, গোলাপও নিষ্কণ্টক নয়! তাই অন্য দশজন চাকুরেবাবু যখন সূর্যঠাকুরকে অগ্রাহ্য করে ধীরেসুস্থে শয্যাত্যাগ করেন এবং ধূমায়মান চায়ের পেয়ালায় মিলিয়ে দেন নিদ্রাজড়িত প্রথম চুম্বন, কিংবা বাজারের থলিহস্তে দেখেশুনে কলাটা-মুলোটা, মাছের মুড়োটা সংগ্রহ করে গৃহিণীর মুখে ফুটিয়ে তোলেন খুশির ঝলক, আমরা তখন ধড়াচূড়া এঁটে কলম চালাই, লম্বা লম্বা হাই তুলি আর সশব্দে চালনা করি কয়েদীদলন শাসনতন্ত্র তারপর বারোটা-একটায় আসে মধ্যাহ্ন-বিরাম। অতঃপর আহারান্তে নিদ্রাসুখ। নিদ্রান্তে একটা বৈকালিক দ্বিরাগমন আছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে নেই আফিসদুরস্ত তৎপরতা। সেখানে জেলখানার সঙ্গে বৈঠকখানার গলাগলি। রিটার্ন রেজিস্টারের কুইনাইন পিলের উপর তাম্বুল-সিগারেট-খোসগল্পের সুগারকোটিং
বৈকালিক আফিস শুধু আফিস নয়, জেলবাবুদের সান্ধ্য-ক্লাব।
মার্চ মাস যায় যায়। মহাশীত অফিসিয়ালি অবসর গ্রহণ করেছেন কিন্তু সশরীরে বিদায় গ্রহণ করেন নি। সরকারী কাগজ-পত্র থেকে অপসরণ করে ভর করেছেন নিরীহ গৃহস্থের স্কন্ধে। সঙ্গে রয়েছেন প্রচণ্ড পবন। এঁদের সমবেত আক্রমণ রোধ করতে না পেরে সূর্যদেব আশ্রয় নিয়েছেন মেঘের আড়ালে। ঘরে ঘরে ত্রাহি ত্রাহি ডাক পড়ে গেছে। মধ্যাহ্ন-ভোজন কোনরকমে সমাধা করে ডবল লেপের উপর ভুটিয়া কম্বল চাপিয়ে নিদ্রাদেবীর কোমল ক্রোড়ে সবে আশ্রয় নেবার আয়োজন করছি, দুয়ারে ভগ্নদূতের আবির্ভাব।
—”টেলিফু আয়া, হুজুর!”
পড়ে রইল কোমল শয্যার উষ্ণ আলিঙ্গন। টেলিফুকের এক ফুৎকারে উড়ে গেল আসন্ন নিদ্রার মধুর আমেজ।
.
—”হ্যালো?”
মোটা, ভারী, এবং শ্বেত কণ্ঠে উত্তর এল—ডেপুটি কমিশনার কথা বলছি।
—গুড মর্নিং স্যার। আই মিন্—
—লুক হিয়ার। তোমাদের ‘সেল’-এ জায়গা আছে তো? যদি না থাকে, একটা সেল খালি করে ফেল, আর স্পেশাল গার্ড রেডি রাখো।
—এখনি করছি স্যার।
—আধ ঘণ্টার মধ্যেই একজন আসামী যাবে। লোকটা পাগল, Dangerous Luna- tic. বেশী গোলমাল করলে fetters লাগাতে পার। আলাদা রাখবে। See that he does not communicate with anybody.
সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম। খানিকটা কৌতূহলও হল, স্বয়ং বড়কর্তা যার জন্যে এতখানি ব্যস্ত, না জানি সে কী ভয়ঙ্কর জীব!
আধ ঘণ্টার মধ্যেই এসে গেল লোকটা। কোমরে দড়ি, হাতে হাতকড়া। দু-পাশে বন্দুকধারী পুলিস। এই দারুণ শীতে একটা ছেঁড়া পাজামা ছাড়া দ্বিতীয় বস্তু নেই তার দেহে। অনাবৃত পিঠে, বাহুতে, ঘাড়ে এবং প্রায় সমস্ত শরীরে ফুটে উঠেছে মোটা মোটা আঘাতের দাগ। কোনো কোনোটা কেটে গিয়ে রক্ত জমে রয়েছে। কপালের নিচের দিকটা ফুলে উঠে একটা চোখ একেবারে ঢেকে গেছে; উপরের ঠোঁট উঁচু হয়ে নাকের সঙ্গে একাকার।
দুজন পুলিস কোমরের দড়িটা খুলে টানতে টানতে লোকটাকে আমার টেবিলের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। বাকি চোখটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। এ কী রকম ডেঞ্জারাস লুন্যাটিক বললাম, হাতকড়ি খোল দেও।
পুলিস দুজন ইতস্তত করতে লাগল। ওদের ইনচার্জ এগিয়ে এসে বলল, ভারী পাগল আছে, হুজুর।
—জানি। হাতকড়াটা খুলে নাও।
হাতকড়া খোলা হতেই ‘পাগলটা’ ধপাস্ করে বসে পড়ল মেঝের উপর। একবার এদিক-ওদিক চেয়ে শুষ্ক কণ্ঠে বলল, জল। জল আসতেই বাটিটা কেড়ে নিয়ে এক নিশ্বাসে শেষ করেই গড়িয়ে পড়ল সেইখানে। সমস্ত শরীরটা কেঁপে কুঁচকে যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। অফিসে যে কয়েদীটা কাজ করে, ছুটে গিয়ে দুটো কম্বল এনে আপাদমস্তক চাপা দিয়ে দিল। গায়ে হাত দিয়ে বলল, ঈস্, গা পুড়ে যাচ্ছে, স্যার।
হাসপাতালে না পাঠিয়ে সেলেই পাঠাতে হল আসামীটাকে। ডেপুটি কমিশনারের হুকুম। কোনো অবস্থাতেই তার অন্যথা হতে পারে না।
.
অনেক কাজ জমে ছিল; বাড়ি ফিরতে কিছুটা রাত হল। ওভারকোট ছাড়তে যাচ্ছি। কেটা বলল, একজন বাবু এসে বসে আছেন বাইরের ঘরে। মন প্রসন্ন হল না। এই দুর্দান্ত শীতে কোনো রকমে দক্ষিণ হস্তের ব্যাপার চুকিয়ে ফেলে ডবল লেপ আর ভুটিয়া কম্বলের দিকেই সমস্ত দেহমন উন্মুখ হয়ে ছিল। অতিথির আগমন উৎপীড়ন বলেই মনে হল।
বসবার ঘরে ঢুকতেই একটি কাপড়-চোপড়ের বাণ্ডিল কোনরকমে উঠে দাঁড়াল এবং সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। মুখের যেটুকু দৃশ্যমান তার থেকে তার জাতি, ধর্ম বা দেশ সম্বন্ধে কোনো আভাস পাওয়া গেল না। বয়স ছাব্বিশ না ছাপ্পান্ন, সেটাও ধারণার অতীত রয়ে গেল।
বাংলা ভাষায় বললেন, একেবারে জমে গেছি, মশাই। বোধহয় ফ্রিজিং পয়েন্ট পার হয়ে গেছে। একটু চা খাওয়াতে পারেন?
কেটাকে চায়ের হুকুম করে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। আগন্তুক বললেন, কি উদ্দেশ্যে এসেছি, জানতে চাইছেন তো? সে এক দুঃসাহসিক অভিযান। জানা-জানি হলে চাকরি নিয়েও টানাটানি পড়বে। তবু আসতে হল। গৃহিণী একেবারে নাছোড়বান্দা! সে যাকগে। ধনরাজ কেমন আছে, বলুন তো?
—কে ধনরাজ?
—ধনরাজ তামাং। সিংটন টি এস্টেট থেকে যাকে পাগল বলে চালান দিয়েছে। আপনি দেখেননি নাকি এখনো?
—আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?
—এই দেখুন! আসল কথাটাই বলা হয়নি। ঠিকই ধরেছেন। খবরটা চাইবার আগে জানানো দরকার আমি লোকটা কে? পুলিসের সি-আই-ডিও তো হতে পারি। আসলে কিন্তু পুলিস নই, ডাক্তার। ঐ চা-বাগানে চাকরি করছি আজ বাইশ বছর সাত মাস। নাম নিবারণ মজুমদার। বিশ্বাস না হয়, এই নিন—বলে তিনি তাঁর পর্বতপ্রমাণ বস্ত্রস্তূপের কোন এক অজ্ঞাত স্থান থেকে বুক পরীক্ষার যন্ত্রটা বের করে গলায় ঝুলিয়ে দিলেন।
অত্যন্ত বিরল হলেও সংসারে এমন একদল লোক চোখে পড়ে, অপরিচয় বা স্বল্প পরিচয় যাদের অন্তরঙ্গতার পথরোধ করে না। পরকে আপন করতে তাদের প্রয়োজন শুধু ক্ষণিকের দৃষ্টিবিনিময়। এই ডাক্তারবাবুটি যে সেই শ্রেণীর, সহজেই বোঝা গেল। তাই সম্পর্কটাও এক মুহূর্তে সহজ হয়ে গেল। গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে বললাম, সামান্য একটা রবারের নল দেখিয়ে কাজ হাসিল করবেন, অতখানি কাঁচা ঠাওরাবেন না। জানেন তো, জেলের লোক আমরা।
ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন, জানি বৈকি! জানি বলেই তো এত রাত্রে চড়াও হয়েছি। খোঁজখবর না নিয়েই কি আর জেলের গণ্ডীর মধ্যে পা বাড়িয়েছি মনে করেন? আর কিছু না থাক, প্রাণের ভয়টা তো আছে।
হঠাৎ গলা নামিয়ে আর একটু কাছে সরে এসে বললেন, তারপর, খবর কি বল তো ভাই? আছে, না হয়ে গ্যাছে?
বললাম, যা দেখলাম, আজ না হলেও কাল নাগাদ হয়ে যাবে বোধহয়।
ডাক্তার চুপ করে গেলেন। তাঁর মর্কট-মার্কা টুপি আর ভালুক-মার্কা গলাবন্ধের আড়ালে মুখের চেহারাটা চোখে পড়ল না; কিন্তু একটা গভীর নিশ্বাস কানে এল। কেটা চা দিয়ে গিয়েছিল। পেয়ালাটা টেনে নিয়ে তাতেই মন দিলেন।
অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেল। চায়ের পাত্রও একসময়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। হঠাৎ তাঁর স্বর শুনে চমকে উঠলাম। এ যেন আর কেউ। যেন বহুদূরের কোন্ এক দুর্নিরীক্ষ্য বস্তুর দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বললেন, এমনি আর একদিনের কথা মনে পড়ছে। ধনরাজ তখনো সর্দার হয়নি। সামান্য কুলী। এই নর্টনসাহেব ছিল ছোট ম্যানেজার। মজলিশি ছোকরা। ভাল বেহালা বাজাতে পারত। একটা মস্তবড় পিয়ানো ছিল ওর ড্রয়িংরুমে ঢুকে ঠিক ডান দিকে। গানবাজনা উপলক্ষ্য করে সাহেব-সুবোর হৈ চৈ প্রায়ই লেগে থাকতো ওর বাংলোয়। সেদিনকার আয়োজনটা ছিল একটু বড় রকমের। আশেপাশের বাগান থেকে একদল সাহেবমেম তো ছিলই, তা ছাড়া দার্জিলিং থেকে ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিসসাহেবও উপস্থিত ছিলেন। পানভোজনের দেদার বন্দোবস্ত। গোটা কয়েক বাছা বাছা পাহাড়ী মেয়েও মোতায়েন ছিল সাহেবলোগদের ফুর্তি জমবার জন্যে। রাত তখন দশটা। নরক গুলজার। এমন সময় দেখা গেল—সর্বনাশ! মদ ফুরিয়ে গেছে। বিশ্বাসী, পরিশ্রমী এবং বেজায় চটপটে বলে সুনাম ছিল ধনরাজের। বেচারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। টেনে তুলে নিয়ে এল এক খানসামা। যেতে পনের, আসতে পনের—তিরিশ মাইল পথ ঘোড়া ছুটিয়ে সদর থেকে মদ আনতে হবে। সময় দেওয়া হল দু ঘণ্টা। ধনরাজ ছুটল। অন্ধকার রাত, পথ জঙ্গলে ঘেরা। ক্রমাগত চড়াই আর উৎরাই। ফিরে যখন এল রাত একটা বেজে পঁয়ত্রিশ। সমস্ত শরীরে ঘামের জোয়ার খেলে যাচ্ছে। ঘোড়ার মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে ফেনা। ম্যানেজার বেরিয়ে এল টলতে টলতে। চোখে লালপানির ছোপ। জড়িত কণ্ঠে গর্জে উঠল, দেরি কাঁহে হুয়া, উল্লুক?
ধনরাজের কথা বলবার মত অবস্থা নয়। তবু অতি কষ্টে জানাল, রাস্তায় বাঘ বেরিয়েছিল। খানিকটা ঘুরে আসতে হয়েছে।
সাহেব হুঙ্কার দিলেন, চাপরাসী!
চাপরাসী ছুটে এল—হজৌর।
মেরা চাবুক।
চাবুক এল এবং টুকরো টুকরো হয়ে গেল ধনরাজের পিঠে। একজন কুলী ধরাধরি করে ওর অজ্ঞান দেহটাকে আমার হাসপাতালে যখন নিয়ে এল, তখনো ওর মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে।
ডাক্তার থামলেন। বোধহয় দৃশ্যটা তাঁর চোখের উপর ভেসে উঠেছিল! একটু পরে আবার শুরু করলেন—মনে করেছিলাম, মরে যাবে। মরাই বোধ হয় উচিত ছিল। কিন্তু কুলী-মজুরের প্রাণ কি এত সহজে বেরোয়? ক’দিন যেতেই দিব্যি সেরে উঠলো।
আমি বললাম, বেঁচে না উঠলে সাহেবের লাথি আর চাবুক পড়বে কাদের পিঠে?
ডাক্তার হেসে বললেন, ঠিক বলেছ। তাছাড়া বেঁচে উঠবার অন্য প্রয়োজনও ছিল। সেই কথা বলছি।
মাসখানেক পরে হঠাৎ একদিন নর্টনের বাংলো থেকে খবর এল সাহেবের অসুখ। গিয়ে দেখি অবস্থা জটিল। গোটা দুয়েক স্টুলের পরেই পাল্স নেই, চোখ বসে গেছে ইঞ্চি দেড়েক, গলার স্বর ভাঙা। বেপ্যানটা সরিয়ে নেবার জন্যে মেথরটাকে ডাকলাম! সাড়া নেই। তারপর একে একে বয়, বেয়ারা, চাপরাসী, মশালচি, বাবুর্চি—সবগুলোর নাম ধরে ডাকাডাকি করলাম। কোনটাকেই পাওয়া গেল না। বাইরে এসে দেখি, বাড়ি একেবারে ফাঁকা। দাঁড়িয়ে আছে শুধু একটা লোক—ধনরাজ তামাং।
—কিরে? তুই এখানে কি করছিস?
ধনরাজের মুখ শুকনো—সাহেবের নাকি বড্ড অসুখ, ডাক্তারবাবু?
—হ্যাঁ, বড্ড খারাপ অসুখ—কলেরা। তুই চলে যা।
ও চলে গেল। তবে নিজের বাড়ি নয়, সাহেবের শোবার ঘরে। নিজ হাতে সাফ করল কলেরার ময়লা! আর সেবা যা করল সাহেবের বিবি কিংবা মাও বোধ হয় পারত না তার সিকিভাগ!
নর্টন বেঁচে উঠল। ধনরাজ বখশিশ পেল দু-খানা দশ টাকার নোট। সাহেব অত্যাচারী হতে পারে, অকৃতজ্ঞ নয়। বছর খানেকের মধ্যে ওর প্রমোশনও হয়ে গেল—কুলী থেকে কুলীর সর্দার। সেই দিনই দেখা করতে এল। হাতে একটা ছোট ভেড়ার বাচ্চা।
—ওটা কি রে?
ধনরাজ একগাল হেসে বলল, খুকুদিদি খেলা করবে।
—কি আপদ! ওটাকে পুষবে কে?
ধনরাজ শুনল না। ‘খুকুদিদিও’ দেখলাম ঐ লোভনীয় খেলার বস্তুটি ছাড়তে রাজী নয়। মেয়েটাকে কোলে পিঠে করে ঐ একরকম মানুষ করেছিল। বললাম, সর্দার হলি; এবার একটা বিয়ে-টিয়ে কর।
ধনরাজ লজ্জিত হাসি হেসে বলল, মেয়ে কোথায়?
-কেন, এত মেয়ে রয়েছে বস্তিতে?—বলে, দু’চারটা সুশ্রী মেয়ের উল্লেখ করলাম। ওর চোখ ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়ে উঠল। বলল, ওদের নাম মুখে এনো না বাবু। ওগুলোকে ছুঁলে নাইতে হয়। কোথায় ওরা রাত কাটায়, সে তো আমি নিজের চোখে দেখেছি—বলে ম্যানেজারের বাড়িটার দিকে ইঙ্গিত করল। কথাটা যে সত্যি সে আমিও জানি, সকলেই জানে। কিন্তু বস্তি-জীবনের অন্যান্য অসংখ্য উপসর্গের মত এটাও ওরা সবাই মেনে নিয়েছে। এই তুচ্ছ কারণে বস্তির কোনো মেয়েরই বিয়ে আটকে থাকে না। এমনি ধারা ঘৃণার ছাপও দেখা যায় না কোনো কুলী যুবকের চোখে-মুখে।
.
ডাক্তারবাবুর সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল। কেটাকে ডেকে কেসটা আনতে বলে দিলাম। কেটা এলে উনি তার খাঁটি স্বদেশী ভাষায় বললেন, এই ব্যাটা কী চা করেছিস? ও-সব দুধের সরবত তোর বাবুকে দিস। আমি হলাম তোদের দেশের লোক। আমার জন্যে বেশ করে এক কাপ—বুঝলি তো?
কেটা মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে জানাল, সে বুঝেছে।
আমি গম্ভীরভাবে বললাম, আপনার কাছে মাথা ঘোরার ওষুধ আছে তো?
ডাক্তার একটু ব্যস্ত হলেন, কেন? মাথা ঘুরছে নাকি তোমার?
গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বললাম, না, এখন ঘুরছে না। তবে আপনার চা-এর রূপ দেখে ঘুরবে তো। তাই, আগে থাকতেই ব্যবস্থা করে রাখছি।
উনি হেসে উঠলেন—আগে থাকো না, ভায়া, বছরখানেক এই ভুতুড়ে শীতের দেশে! তারপর দেখবো, কার চা দেখে কার মাথা ঘোরে!
আমি সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললাম, থাক। সে-সব পরের কথা পরে হবে। আপনি শুরু করুন।
ডাক্তারবাবু সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, খুকুটার বিয়ে স্থির হল। সপরিবারে দেশে যাবার আয়োজন করছি। ধনরাজ ধরল, সেও যাবে। গিন্নী তো হাতে স্বর্গ পেলেন। জান তো, আমাদের মত চাকরিজীবীদের দেশই হল আসল বিদেশ। আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিকুটুম যাঁরা আছেন, তাঁদের সস্নেহ মূর্তি স্মরণ করলে প্রাণে আর জল থাকে না। ধনরাজের মত কাজের লোক আর সত্যিকার আপনার লোক পেয়ে আমারও বল বেড়ে গেল। সাহেবকে বলে ওর ছুটি করিয়ে নিলাম।
বিয়ের কাজকর্ম মিটে যাবার পরেও দু-দিন আমাকে আটকে থাকতে হল। মা ওকে ছাড়তে চান না। আসবার সময় যখন প্রণাম করল, মা ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘তোর মাকে আমার হিংসে হচ্ছে ধনরাজ। তোর মত ছেলে পেটে ধরেছিল, সে মাগীর তপস্যার জোর আছে।’ আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম। আমার মা মানে—অত্যন্ত সেকেলে গোঁড়া ব্রাহ্মণ বিধবা। আর ধনরাজ তামাং একটা অস্পৃশ্য, অনাচারী পাহাড়ী কুলী।
সপরিবারে ফিরছি। পোড়াদ’ স্টেশনে গাড়ি বদল করে দার্জিলিং মেল ধরবার জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বিরক্তির একশেষ। প্ল্যাটফরমে পায়চারি করে করে সময় আর কাটে না। ওদিকে দোকানগুলোর সামনে কী একটা জটলা হচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে। নেহাত কিছু করবার নেই বলে দেখতে গেলাম। একটু ভিতরের দিকে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল, একটি মেয়ে উপুড় হয়ে এক নেপালীর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আর লোকটা অকথ্য ভাষায় তাকে গালাগালি করছে। তার আস্ফালন কানে এল—পা ছেড়ে দে বলছি, হারামজাদী; আমি কখনো তোকে ঘরে নিতে পারবো না।
মেয়েটি কাতরভাবে বলল, আমি তা হলে কোথায় যাবো?
নেপালীটা মুখ ভেংচে তার বলবার ভঙ্গীটা নকল করে বলল, কোথায় যাবো? কেন, যাদের ঘরে একরাত একদিন কাটিয়ে এলি, তোর সেই—বলে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করল। বেশ একটা হাসির রোল পড়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
ব্যাপারটা মোটামুটি ধারণা করতে অসুবিধা হয়নি। একজন ভদ্রগোছের লোককে জিজ্ঞাসা করে গোটা ঘটনাটাই জানা গেল।
ঐ নেপালী পোড়াদ’ স্টেশনে একটা ছোটখাট চায়ের স্টলের মালিক আর মেয়েটি তার বৌ। মেয়েটার বয়স অল্প এবং দেখতে সুশ্রী। এ অবস্থায় ঐ অঞ্চলে যা সচরাচর ঘটে থাকে, তাই ঘটল। অর্থাৎ পাশের কোন্ গ্রাম থেকে মুসলমান গুণ্ডার দল রাতারাতি হানা দিল দোকানে। মালিক পুরুষমানুষ। কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালাল। মেয়েটাকে নিয়ে গেল মুখ বেঁধে। তারপর একটা রাত আর একটা দিন কোথায় কি অবস্থায় ওর কেটেছিল, সে বীভৎস ইতিহাস খুলে বলবার দরকার নেই। রাত্রির অন্ধকারে কেমন করে ও ছাড়া পেল, কেউ জানে না। বোধ হয় নেহাত দৈহিক কারণে ও-পক্ষের কড়া পাহারা কিছুটা শিথিল হয়ে থাকবে। সেই সুযোগে কোনরকমে অর্থাৎ একমাত্র মনের জোরেই ঐ দেহটাকে টেনে নিয়ে ও ছুটে এসেছে নিজের ঘরে। জানে না, সে ঘর ওর ভেঙে গেছে চিরদিনের তরে।
ডাক্তারবাবুর মৃদু কণ্ঠ আস্তে আস্তে মিলিয়ে এল। দু-মিনিট ছেদ পড়ল তাঁর গল্পে। তারপর আবার শুরু করলেন-
আমাদের দেশের বড় বড় লোকেরা মেয়েদের নাম দিয়েছেন, ঘরণী, গৃহিণী। যাঁরা একটু কবিগোছের, তাঁরা আবার দ’ডিগ্রী এগিয়ে বলেন, গৃহলক্ষ্মী, গৃহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী —এমনি কত কি! এ শুধু মনভোলানো মিছে কথা। গৃহ সেই-ই গড়ে তোলে জীবন দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে; কিন্তু গৃহ তার নয়। গৃহের দেবতা পুরুষ। তাই সে তার প্রিয়তমা গৃহলক্ষ্মীকে কাল গুণ্ডার হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রাণরক্ষা করেছিল, আজ ভাগ্যের হাতে ফেলে দিয়ে ধর্মরক্ষা করল।
ভিড়ের ভেতর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম।…
—মাপ করবেন ডাক্তারবাবু; বাধা দিয়ে বললাম আমি, আপনার সব কথা মেনে নিচ্ছি; তবু বলবো, আমি কিন্তু আপনার মত নিঃশব্দে বেরিয়ে আসতে পারতাম না।
—কি করতে?
—পা থেকে জুতো খুলে ঐ জানোয়ারটার মুখে মারতাম। পারি না পারি, চেষ্টা অন্তত করতাম একবার।
—কী লাভ হত? জুতোটাই তোমার জখম হত। আরেক জোড়া আবার কিনতে হত পয়সা খরচ করে।
আমি একথার জবাব খুঁজে পেলাম না। উনি একটুখানি অপেক্ষা করে বললেন, অনেক দিনের কথা। তখনো এ চুলগুলো বারো আনা পাকতে বাকি। কিন্তু একথাটা বুঝতে বাকি ছিল না যে, সেই নেপালী ছোকরার চেয়েও অনেক বড় বড় জানোয়ার তোমাদের সভ্য-সমাজে অবাধে বিচরণ করে বেড়ায়। তাদের পিঠ আমাদের জুতোর নাগালের বাইরে। ঐ একটা তুচ্ছ চা-ওয়ালাকে মেরে আর কতখানি ক্ষোভ মিটত? তবে, হ্যাঁ! ড্রামাটিক কিছু হতে পারতো হয়তো। তার জন্য চিন্তা নেই। এখন যে দৃশ্যে তোমায় নিয়ে যাচ্ছি, সেটা আরও বেশী ড্রামাটিক।
স্টেশন-মাস্টারের অফিসে এসে একটা সুসংবাদ পাওয়া গেল, গাড়ি ঘণ্টা দুই লেট! মেয়েদের ওয়েটিংরুমে উঁকি মেরে দেখলাম, সকন্যা গৃহিণী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছেন। সময় কাটাবার এই সহজ আর সনাতন রাস্তাটা খোলা থাকতে আমি যে কেন এতক্ষণ এদিক- ওদিক ঘুরে মরছি তার কোনো সঙ্গত কারণ খুঁজে পেলাম না। কম্বল বগলে করে একটা নিরালা গোছের জায়গার সন্ধান করছি এমন সময় মূর্তিমান বিঘ্নের মত ধনরাজ এসে হাজির।
—কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। ও খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, যদি রাগ না কর তো একটা কথা বলি।
—কি বলবি, বল না? রাগ করবো কেন?
—শুয়োরটা তো পালিয়েছে। ওর বাপের ভাগ্যি, আমি একটু পেছিয়ে পড়েছিলাম। দুটো মিনিট আগে আসতে পারলে এক পাটি দাঁত ওর উপড়ে দিয়ে আসতাম!
চোখ দুটো জ্বলে উঠল ধনরাজের। আমি বললাম, থাক। সে বাহাদুরি না দেখিয়ে ভালই করেছ। ওর দাঁত আমাদের কোনো কাজে লাগত না। এখনকার মতলবটা কি শুনি?
-সে তো তুমি বুঝতেই পারছ।
—তা কিছুটা পারছি। কিন্তু ওকে নিয়ে রাখবি কোথায়?
—ঘরেই রাখবো। আর কোথায় রাখবো?
আমি অপলক চোখে চাইলাম ওর দিকে। ও একটু হেসে বলল, ঘরের বৌকে লোকে আর কোথায় রাখে?
—সব ঘটনা শুনেছিস?
—শুনেছি।
এর পরে আমার মুখে আর কথা সরল না। জানি, অন্যের পরিত্যক্তা স্ত্রীকে বিয়ে করা ওদের সমাজে বাধে না। কিন্তু তাই বলে ঐ মেয়ে? ওর সমস্ত ইতিহাস জেনেশুনে? মনে হল, বাধা দেওয়াই আমার কর্তব্য। পথে-ঘাটে এই সব হঠকারিতার জন্যে ওকে একটা কড়া ধমক দেওয়া দরকার। কিন্তু তোমায় সত্যি বলছি ডেপুটিবাবু, ওর চোখের দিকে চেয়ে সুর আমার আপনিই নরম হয়ে এল। না, ঝোঁকের মাথায় বাহাদুরি দেখাবার কোনো লক্ষণ তো সেখানে নেই। এ তো ছেলেখেলা নয়। আমি যা কখনো পারবো না, আমি তো তুচ্ছ, অনেক বড় বড় আদর্শবাদী মহাপ্রাণ যুবক যেখানে পেছিয়ে আসবে, এই কুলীটার কাছে সেটা এতই সহজ!
অনাবশ্যক জেনেও বললাম, ভালো করে ভেবে দেখেছিস?
— দেখেছি!
—ও রাজী হবে?
—তা জানিনে। জিজ্ঞেস করেছিলাম। কথা বলে না, খালি কাঁদতে লাগল।
—ও, তাই বুঝি আমার ডাক পড়েছে? কিন্তু আমার বখশিশ?
ধনরাজ খপ্ করে আমার পায়ের ধূলো মাথায় দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল এক পাশে। মুখে সলজ্জ তার হাসি।
ঘুমের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে ঐ হতভাগাটার সঙ্গ নিলাম। দোকানের সামনে থেকে উঠে গিয়ে একটা গাছের নীচে মেয়েটা বসে ছিল। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ধনরাজ বলল, ডাক্তারবাবু এসেছেন।
সে মুখ তুলে একবার আমার দিকে তাকাল। মুখখানি ভারী মিষ্টি। চোখ দুটো এমন অসহায়, একবার দেখেই কেমন মায়া হল মেয়েটার ওপর। ওদের পাহাড়ী ভাষায় বললাম, তোমার সব কথা শুনেছি। তোমার বাপ আছে কিনা জানি না। আমাকে তুমি তোমার বাপের মতই বিশ্বাস করতে পার। ধনরাজকে দেখিয়ে বললাম, ওকে আমি এতটুকু থেকে জানি; ছেলের মতই জানি। ও যে-কথা তোমায় বলেছে, সেটা তুমি নিজেই ভেবে দেখ। আমি জোর করবো না। কিন্তু এটা জোর দিয়েই বলবো, ওকে বিয়ে করে কোনো মেয়েই কোনদিন দুঃখ পাবে না।
মেয়েটা একবার কি ভাবল। তারপর আমার পায়ের উপর পড়ে বলল, তুমিই আমার বাপ, বাবুজী।
আর কিছু বলতে পারল না। যেটুকু বাকি ছিল, জানিয়ে দিল ওর চোখের জল।
একটা ছোটখাট নাটক করে ফেললাম, কি বল; অবিশ্যি নাটকের আসল হিরো ব্যাটা ধনরাজ। আমি সাইড অ্যাকটর মাত্র—বলে ডাক্তারবাবু হা-হা করে খানিকটা কাষ্ঠ হাসি হাসলেন। আমি তাঁর হাসিতে যোগ না দিয়ে গাম্ভীর্যের সঙ্গেই বললাম, আপনার ‘রোল’টা যে কী, নাটকের শেষ পর্যন্ত না গেলে বুঝতে পারছিনে। অতএব ‘নেক্সট্ সীন প্লীজ’-
ডাক্তারবাবু হাসিমুখে বললেন, আচ্ছা, তাহলে শোনো—
বৌটাকে সুস্থ করে তুলতে লেগে গেল মাসখানেক। বলা বাহুল্য, এ সময়টা ও আমার বাড়িতেই রইল। আমি হাসপাতালে পাঠাতে চেয়েছিলাম। গিন্নী রাজি হলেন না। সমস্ত ভার তুলে নিলেন নিজের হাতে। তবু একবার বোঝাতে চেষ্টা করলুম, হাসপাতালে তো বেশ ভালো ব্যবস্থাই আছে। এ ঝঞ্ঝাট বাড়িতে রাখতে চাইছ কেন?
গৃহিণী সংক্ষেপে বললেন, সে কথা তোমরা বুঝবে না। ‘তোমরা’ কথাটার ওপর বেশ একটু জোর দিয়েই বললেন। জানি না কি তাঁর বক্তব্য। আমার কাছে ওটা হেঁয়ালিই রয়ে গেল। হয়তো—
আমি বাধা দিলাম। এর মধ্যে তো কোনো হেঁয়ালি নেই ডাক্তারবাবু। মেয়েদের এ যে কত বড় লাঞ্ছনা, সে শুধু মেয়েরাই বুঝতে পারে। আমরা বুঝি বুদ্ধি দিয়ে, কিন্তু ওরা বোঝে ওদের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে।
তোমার কথা আমি মেনে নিতাম ভাই, বললেন ডাক্তারবাবু, যদি বুঝতাম মেয়েদের এই চরম লাঞ্ছনা আসে শুধু পুরুষদেরই কাছ থেকে। কিন্তু তা তো নয়। একথা কি শোননি—কত মেয়েমানুষ এই নরকদৃশ্য শুধু যে পাশে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে, তা নয়, নিজে মেয়ে হয়েও আর একটা মেয়ের উপর লেলিয়ে দেয় নিজের স্বামী কিংবা তার সঙ্গী অন্য কোনো জানোয়ার।
বললাম, শুনেছি। সব্যসাচীর কথাটা মনে পড়ছে, গরুর মাংস কসাইখানা থেকে গরুই বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু তবু বলবো, ওরাই সব নয় যে। কল্যাণী ঐ লাঞ্ছিতা পাহাড়ী মেয়েটার সেবার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়ে ওর দুঃখের বোঝাটা একটুখানি হালকা করতে চেয়েছিলেন, তিনিও ওদের জাত। যাক্, তারপর বলুন—
ডাক্তারবাবু শুরু করলেন—ধনরাজ তার বস্তির বাসা ছেড়ে দিয়ে বৌ নিয়ে উঠে গেল পাহাড়তলীর ঐ দিকটায়, চা-বাগানের আওতার বাইরে। বছরখানেক পরে ওদের একটি মেয়ে হল। মেয়ে তো নয়, যেন একরাশ টগর ফুল। ধনরাজ তার নাম রাখল লখিয়া। একটা রাতের প্রলয় বৌটার দেহে যে ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছিল, সারা জীবনে সেটা জোড়া লাগবার নয়। প্রসবের ধকল কাটিয়ে ওঠা কঠিন হল।
এই প্রসঙ্গে একটা জিনিস তোমায় না বলে পারছিনে, ডেপুটিবাবু। আমি ডাক্তার। অনেক সুদক্ষ নার্স নিজের চোখে দেখেছি। আন্তরিক সেবা যে কি বস্তু, তাও দেখবার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু পুরুষমানুষ যে এমনি মায়ের মত নিজের সমস্ত সত্তা ডুবিয়ে দিনের পর দিন রাতের পর রাত সামনে রুগী নিয়ে থাকতে পারে, ঐ ধনরাজটাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। বৌটা যে আরো বছর দুই বেঁচে গেল, সে শুধু ঐ সেবার জোরে, তার জীবনীশক্তির জোরে নয়।
দু’বছরের একটা শিশু নিয়ে ধনরাজ বিব্রত হয়ে পড়ল। আমরা বললাম, বিয়ে কর। মেয়েটাকে তো বাঁচাতে হবে।
ধনরাজ হেসে বলল, ঐ হুকুমটা কোরো না বাবু। তার জিনিস কি আর কারো হাতে তুলে দিতে পারি?
একটা দূর-সম্পর্কের বুড়ী পিসী কোত্থেকে জুটিয়ে নিয়ে এল। সে শুধু দুটো রেঁধে দিত আর মেয়েটাকে আগলে রাখত যতক্ষণ ও কাজ থেকে না ফেরে। মেয়েকে মানুষ করবার সমস্ত ভার নিল ওর নিজের হাতে। যা কিছু রোজগার, সব যায় ঐ মেয়ের পেছনে। সে মিশনারী ইস্কুলে পড়ে। তার রাশি রাশি জামা-কাপড়, খেলনা, পুতুল, প্রসাধনের ঘটা।
কুলী বস্তীতে সবাই ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। ধনরাজ হেসে উড়িয়ে দেয়। হেড-ক্লার্কবাবু বললেন একদিন, ধনরাজের কাণ্ডটা দেখেছেন মশাই! মেয়েটাকে তো ধিঙ্গী করে তুলল। এবার বিয়ে দেবে কেমন করে? ঐ মেমসাহেব তো আর সত্যিই কোনো কুলী-কামিনের ঘর করতে পারবে না?
ব্যাপারটা সত্যিই ভাববার মত। মেয়েটাও দেখতে দেখতে বেড়ে উঠল। নাম লখিয়া। দেখতে সে লক্ষ্মী-প্রতিমাকে হার মানায়।
ধনরাজকে ডেকে বললাম, লখিয়ার বিয়ের কতদূর কি করলি?
ও করুণভাবে বলল, তুমি তো সবই জানো বাবু। হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিত হতে পারি এমন একটা ছেলেও তো দেখছি না এ অঞ্চলে।
—তাহলে কী করতে চাস? মেয়ে বড় হয়ে উঠছে। জায়গা ভাল নয়।
ধনরাজ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সে কি আর জানিনে? কত সাবধানে যে রাখতে হয় মেয়েটাকে!
তারপর একটু কাছে সরে এসে চাপা গলায় বলল, শ’পাঁচেক টাকা জমিয়েছি। সব তো ওরই। শহরে গেলে একটা লেখাপড়া-জানা ভাল ছেলে কি জুটবে না আমার লখিয়ার জন্যে?
দেখলাম প্রস্তাবটা মন্দ নয়। একটা মোটামুটি আলোচনা করে আপাতত স্থির হল, ও মাসখানেকের ছুটির ব্যবস্থা করে লখিয়াকে নিয়ে দার্জিলিং যাবে। ওর এক মাসতুতো ভাই পুলিশে কাজ করে। সেখানে উঠে একটা ভালগোছের নেপালী ছেলের চেষ্টা করা হবে।
এরই দিনকয়েক পরে বিকালের দিকে ম্যানেজার নর্টনসাহেব আমাকে আর হেডক্লার্কবাবুকে সঙ্গে করে বেরিয়েছিলেন পাহাড়তলীর ঐ দিকটা ঘুরে দেখবার জন্যে। ঐ অঞ্চলের খানিকটা জমি সংগ্রহ করে বাগানগুলো বাড়িয়ে তোলার একটা প্ল্যান ছিল। ফিরবার পথে একটা ছোট বাড়ির সামনে দেখলাম একটি পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ে ছাগলকে পাতা খাওয়াচ্ছে।
তার রূপ, তার স্বাস্থ্য, তার সাজপোশাক এবং সব মিলিয়ে বেশ একটা মার্জিত সপ্রতিভ ভাব—ও অঞ্চলে এমন বেমানান যে কারো চোখ না পড়ে পারে না। সাহেব খানিকক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটি কে ডাক্তার?
আমি জবাব দেবার আগেই হেডক্লার্কবাবু বললেন, ধনরাজ তামাং-এর মেয়ে।
সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন, You mean our Dhanraj?
বললাম—হ্যাঁ, আমাদের ধনরাজই বটে।
দিন দুই পরে সাহেব হুকুম দিলেন, ধনরাজকে বস্তিতে উঠে আসতে হবে। তাঁর কুলী-সর্দারকে তিনি বাইরে থাকতে দিতে পারেন না। ধনরাজ রাজী হল না। সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। কয়েকদিন পর ধনরাজ ছুটির দরখাস্ত করল। সেটা সরাসরি না-মঞ্জুর হয়ে গেল।
এরই ঠিক পরের রবিবার। আবার এক পার্টির ব্যবস্থা হল সাহেবের বাংলোয়। নাচ, গান, খানাপিনার বিরাট আয়োজন। বিশেষ অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রিত হলেন নবাগত শ্বেতাঙ্গ পুলিশসাহেব। ধনরাজকে পাঠান হল মদের সন্ধানে। এমন অসময়ে হুকুম এল যে, ফিরতে বেজে গেল রাত বারোটা। বোতলগুলো কোনো রকমে সাহেবের কুঠীতে পৌঁছে দিয়ে সে ছুটল নিজের বাড়ি। গিয়ে দেখল, পিসী কপাল চাপড়াচ্ছে। লখিয়া নেই। বার বার প্রশ্ন করে তার কাছ থেকে এইটুকু শুধু সংগ্রহ করা গেল যে, কতগুলো চাপরাশ – পরা যণ্ডামতন লোক মেয়েটাকে মুখে কাপড় দিয়ে নিয়ে চলে গেছে। ধনরাজ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল সাহেবের বাঙলোয়। বেয়ারা-চাপরাশির বেড়া ডিঙিয়ে একেবারে সোজা হানা দিল নর্টনের বেডরুমে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ধনরাজ তখন সত্যি পাগল হয়ে গেছে। প্রাণপণে কীল, চড় আর লাথি মারছে দরজায় আর চিৎকার করছে, দরজা খোলো, খোলো দরজা!
নটন বেরিয়ে এলেন।
—লখিয়া কোথায়? গর্জে উঠল ধনরাজ। লালপানির কল্যাণে তখন সাহেবের তুরীয় অবস্থা। জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন লখিয়াকো হাম্ সাদি কর লিয়া। I am your son-in- law; হাঃ হাঃ হাঃ-
চোপরাও উল্লুক—বলে ধনরাজ ঝাঁপিয়ে পড়ল তার মনিবের ঘাড়ে এবং উদ্যত নাকের উপর বসিয়ে দিল তার পাহাড়ী হাতের ঘুষি।
মিস্টার নর্টন ভূতলে আশ্রয় নিলেন। শ্বেতাঙ্গের পবিত্র রক্তে কালো-আদমির দেশ ধন্য হল। পুলিশের বড়কর্তা স্বয়ং উপস্থিত তাঁর দলবল নিয়ে। লুণ্ঠিত দ্রব্যের তিনিও একজন অংশীদার। কাজেই পরের দৃশ্যটা অনুমান করতে কষ্ট হবে না। অনুমান কেন? খানিকটা নমুনা তো নিজের চোখেই দেখেছ আজ।
ডাক্তারবাবু সিগারেট ধরালেন। ঘড়ি দেখে বললেন, ঈস্, অনেক রাত করে ফেলেছি। যাও। এবার তুমি খাওগে; আমি উঠি।
আমি হঠাৎ অসংলগ্নভাবে প্রশ্ন করলাম, মেয়েটার কি হল ডাক্তারবাবু?
—তুমিও যেমন। সে খবর রাখে কে? শুনেছিলাম তার নাকি ঘন ঘন ফিট হচ্ছে।
—আচ্ছা, ওকে কি উদ্ধার করা যায় না?
ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়িয়ে আমার দু’কাঁধের উপর দুটো হাত রেখে হেসে বললেন, তুমি সত্যিই ছেলেমানুষ
উনি যাবার জন্যে পা বাড়াতেই আমার যেন হঠাৎ জ্ঞান ফিরে এল। বাধা দিয়ে বললাম, একি? এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছেন? না-না। যা-হোক্ দুটো মুখে দিয়ে শুয়ে পড়ুন। ভোরে উঠিয়ে দেবো।
ডাক্তার আমার একটা হাত ধরে বললেন, সে হবার যো নেই, ভাই। ঘোড়া অপেক্ষা করছে। এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে। ভোরবেলা বাগানে হাজির হওয়া চাই-ই।
চমকে উঠলাম, বলেন কি? এই দারুণ শীতে, এই গভীর রাত্রে—
ডাক্তারের মুখে ম্লান হাসি দেখা দিল, কি করবো, ভাই। চাকরি।
বারান্দায় বেরিয়ে এসে আবার একটা খাপছাড়া প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, ধনরাজকে আসামী করে ওরা মামলা করলে না কেন; ম্যানেজারকে জখম করেছে; মস্ত বড় চার্জ।
ডাক্তার হেসে বললেন, প্রশ্নটা কিন্তু তোমার মত বুদ্ধিমানের ছেলের যোগ্য হল না, ডেপুটিবাবু। মোকদ্দমা চলতে পারে। কিন্তু ধনরাজকে আদালতে দাঁড় করালে লখিয়া তো আর চাপা থাকে না। তার চেয়ে সহজ, নিরাপদ এবং মোক্ষম পন্থা হল ওকে বেমালুম পাগল বানিয়ে দেওয়া।
আমি তর্ক তুললাম, সেটাই কি সহজ পন্থা হল? একটা ভাল মানুষকে পাগল বানাতে হবে, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট তো চাই?
ডাক্তার হো হো করে হেসে উঠলেন। আর কোনো জবাব দিলেন না।
দেখতে দেখতে সেই চলন্ত কাপড়-চোপড়ের বাণ্ডিল পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি নিঃশব্দে সেই দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কে এই লোকটা? অখ্যাত, অজ্ঞাত, ক্ষ্যাপাটে ধরনের চা-বাগানের ডাক্তার। কিন্তু কেমন করে জানি না, আমার মত শিক্ষাভিমানীর মনের কোণে কোথায় একটা দাগ রেখে গেল।
তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
ধনরাজ-কাহিনীর বাকি অংশটা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। গায়ের দাগ মিলিয়ে যেতে তার লাগল প্রায় মাস দুই। সেই সময়ের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ সিভিল সার্জেন বার কয়েক জেল পরিদর্শন করলেন। তারপর একদিন কোর্ট থেকে অর্ডার এল–সিভিল সার্জেনের অভিমত গ্রহণ করে ধনরাজ তামাংকে উন্মাদ সাব্যস্ত করা হল। অবিলম্বে তাকে প্রয়োজনীয় দলিলপত্রসহ রাঁচী মেন্টাল হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হউক। দলিলের মধ্যে একটা দেখলাম পুলিশের রিপোর্ট। পাহাড়ী দারোগা লিখেছেন, তদন্তে জানা গেল ধনরাজ নিয়মিত গঞ্জিকা সেবী। তার পিতৃকুলে একাধিক ব্যক্তির মস্তিষ্ক-বিকৃতির ইতিহাস বিদ্যমান।
অতঃপর হাকিমের আদেশমত আমিই একদিন তাকে পুলিশের হাতে সঁপে দিলাম। দুর্দান্ত পাগল বলে জেল কোডের নির্দেশ অনুসারে গাড়ির একটা গোটা কামরা রিজার্ভ করে দিলাম দার্জিলিং থেকে রাঁচী রোড্।
পুলিসের লোকেরা যখন ওকে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধল, ও একটি কথাও বলল না। শুধু মনে হল, ওর অবসন্ন চোখ দুটিতে ফুটে উঠেছে একটা নিষ্ফল প্রশ্ন—আমার লখিয়া কোথায় রইল?
হয়তো এ সবই আমার কল্পনা কিংবা চোখের বিভ্রম।