লৌহকপাট – ১.১৪

চৌদ্দ

শুনেছি, প্রাণিবিজ্ঞান মতে চিংড়িমাছ মাছ নয়। আমাদের মত অবৈজ্ঞানিক মৎস্যভোজীর পক্ষে ব্যাপারটা চমকপ্রদ সন্দেহ নেই। কিন্তু এর চেয়েও চমকে যাবার কারণ ঘটল, যেদিন শুনলাম, ভূতনাথ দারোগা দারোগা নয়। এ শুধু খবর নয়, এ একটা আবিষ্কার। রাম শ্যাম যদু থেকে আরম্ভ করে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ পর্যন্ত একটা গোটা মহকুমার মুখে যিনি এক ডাকে ‘ভূতনাথ দারোগা’, ভাবিনি সেই স্বনামধন্য পুরুষ একজন তুচ্ছ ডি. এস. পি. মাত্র। সরকারী পরিচয় যে আসল মানুষটির ধার দিয়েও যায় না, তারই আর একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল।

ভূতনাথের দাপটে বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খায়। অর্থাৎ গোরুচোর ফাজলা শেখ আর বাঘশিকারী দুর্দান্ত জমিদার কালু চৌধুরী একই হাত-কড়া পরে, একই দড়ি কোমরে বেঁধে একসঙ্গে কোর্টে আসে যায়। লঘু-গুরু ভেদ নেই ভূতনাথ দারোগার কাছে। তাঁর শুভদৃষ্টি একবার যার উপরে পড়েছে, অর্থ এবং মুরুব্বীর জোর তার যতই থাক, জেলের ঘানির সাতপাক তাকে ঘুরতেই হবে। যত বড় বেয়াড়া, খুঁতখুঁতে কিংবা উদারপন্থী হাকিম আসুন, ভূতনাথের আসামীকে বেকসুর খালাস দেবার মত কোনো ফাঁক পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি।

—খালাস অমনি দিলেই হল? ভূতনাথ বুক ফুলিয়ে বলেন তাঁর ভক্তমহলে, ফৌজদারী মামলা হচ্ছে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়ক। আইন-কানুনের গলিঘুঁজির বালাই নেই, স্রেফ্ ঘটনা সাজিয়ে যাও। Conviction মারে কে? কিন্তু ঘটনা মানে কি? হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন কোনো জুনিয়রকে লক্ষ্য করে; লক্ষ্যটি নেহাত উপলক্ষ। উত্তর দেন উনি নিজেই—ঘটনা মানে যদি বুঝে থাক—যেটা ঘটে, সুবল মিত্তিরের ডিক্সনারি ঘাড়ে করে ইস্কুলমাস্টারি করে খাওগে। পুলিশের চাকরি তোমার চলবে না। যা ঘটে নয়, ঘটনা মানে তোমার সুবিধের জন্যে যা ঘটা দরকার। এই যেমন ধর, বাঘাডাঙ্গার সতীশ কুণ্ডু হঠাৎ টাকার গরমে তেতে উঠেছে। তোমার এলাকায় বাস করে তোমারই সামনে ঘাড় উঁচু করে চলে। জব্দ করতে চাও? ফেলে দাও কোনো খুনী মামলায়।

কোনো ছোকরা প্রবেশনার জিজ্ঞেস করে, কিন্তু স্যর, কাছাকাছি কোথাও খুন তো একটা হওয়া চাই!

—কে বললে খুন হওয়া চাই? খুনের কোনো দরকার নেই; দরকার শুধু একটা লাস। দেশে এত লোক মরছে, আর একটা মড়া যোগাড় করতে পারবে না? আর কোথাও না পাও, হাসপাতালগুলো আছে কি করতে?

প্রবেশনারটি নাছোড়বান্দা। আবার প্রশ্ন করে, মড়া না হয় একটা জোটানো গেল। কিন্তু সেটা যে কলেরায় মরেনি, খুনের লাস, সেকথা প্রমাণ হবে কি করে?

ভূতনাথ তৎক্ষণাৎ জবাব দেন, কেন? ডাক্তার বলে একরকম প্রাণী আছে শোননি কোনোদিন? ওরাই প্রমাণ করবে। ভগবান ওদের হাতে স্প্রীং লাগিয়ে দিয়েছেন; যেদিকে ঘোরাতে চাও ঘুরবে। তবে তার জন্য চাই কিছু তেল।

দু-একজন সিনিয়র গোছের অফিসার মাথা নেড়ে বললেন, ঐ যা বললেন, স্যর। ঐ তেলটাই হল আসল। ঐটি সংগ্রহ করাই একটু মুশকিল।

—কিছু মুশকিল নেই, সঙ্গে সঙ্গে বলেন ভূতনাথ, তেল আপনিই জুটে যায়। খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, সতীশ কুণ্ডুর একটা বিপক্ষ দল আছে নিশ্চয়ই, আর তার কর্ণধার হচ্ছেন জগৎ পাল কিংবা নিরঞ্জন সাহা। ওদের কাউকে শুধু ইঙ্গিতে জানতে দাও, তোমার মতলবটা কি। তেলের পিপে মাথায় নিয়ে ছুটে আসবে। যত খুশী ঢাল। ডাক্তার যদি একটু নজর দেন, আদালতে গিয়ে দেখবে কলেরার পচা মড়ার পেট থেকে বেরিয়েছে বন্দুকের গুলি কিংবা তার বুকে রয়েছে মারাত্মক ছোরার জখম।

এর পরে আর কোনো প্রশ্নেরই অবকাশ থাকে না। তবু স্থূলবুদ্ধি অর্বাচীন পুলিশ- মহলেও থাকে দু-একজন। তাদেরই কেউ একজন বলে বসে, আচ্ছা স্যর, লাস না হয় পেলাম, আর সেটা যে খুন তারও ডাক্তারি প্রমাণ পাওয়া গেল; কিন্তু খুনের সঙ্গে সতীশ কুণ্ডুকে জড়াবার মত সাক্ষী কোথায়?

ভূতনাথ সিগারেটের সঙ্গে উচ্চাঙ্গের হাসি মিশিয়ে বলেন, সাক্ষী তো আকাশ থেকে পড়ে না বাপু, মাঠেও গজায় না। ও জিনিসটা কষ্ট করে তৈরী করতে হয়; আর তার জন্যে চাই মাথায় কিঞ্চিৎ মগজ আর বুকে খানিকটা সাহস।

বলা বাহুল্য, ভূতনাথের ভাণ্ডারে এ দুটি পদার্থের কোনোটারই অভাব নেই। এদের জোরে সাক্ষী তৈরী আর আসামীর স্বীকারোক্তি আদায়, দুটোই তাঁর কাছে জলভাত। প্রথমে তোয়াজ তোষণ, তারপর শাসন গর্জন,–এইসব প্রচলিত পদ্ধতি তো আছেই, এ ছাড়া আছে তাঁর কয়েকটা নিজস্ব পেটেন্ট কবিরাজি মুষ্টিযোগ।

—সাক্ষী কথা শুনছে না?

সহকারী বলেন, না, স্যর।

—কি বলে?

—কিছুই বলে না।

—তোমাদের যা করবার, করেছ?

—সবই তো করলাম।

ভূতনাথ গম্ভীরভাবে ব্যবস্থা করে দিলেন, বৃহৎ যষ্টিমধুচূর্ণ এক পুরিয়া। পুরিয়া যথারীতি সেবন করানো হল। অর্থাৎ একটি মধুবর্ষী বৃহৎ যষ্টি সাক্ষীর পৃষ্ঠদেশে চূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু সে নির্বিকার। ভূতনাথের কাছে রিপোর্ট এল।

—কি, সোজা হল না?

সহকারী হতাশভাবে মাথা নাড়লেন।

—দাও ডোজ তিনেক গুম্ফোৎপাটন রসায়ন। যত নষ্টের মূল ব্যাটাচ্ছেলের ঐ কাইজারী গোঁফ।

একজন কুস্তীগীর হিন্দুস্থানী সিপাহীকে এই মহৎ কার্যে নিয়োগ করা হল। মিনিট পাঁচেক পরেই খবর এল, সাক্ষী তৈরী।

শুধু সাক্ষী-বাগানো নয়, কনফেশন আদায় করতে ঐ একই ব্যবস্থা। কিন্তু দু-একটা দুর্ধর্ষ আসামী কখনো ক্বচিৎ দেখা যায়, যাদের বেলায় গুস্ফোৎপাটন রসায়ন কিংবা শ্মশ্রুছেদন বটিকা হয়তো ‘তেমন কার্যকরী হয় না। এরকম ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োগ করেন তাঁর শেষ এবং মোক্ষম আবিষ্কার—মহানিমজ্জনী সুধা, চপেটাঘাত সহ সেব্য। শীতকালের গভীর রাতই হচ্ছে এই মহৌষধি প্রয়োগের প্রশস্ত সময়। তার উপর স্থানটা যদি পানাপুকুর হয়, ফল অব্যর্থ।

ভূতনাথ ঘোষালের সঙ্গে পরিচয় ছিল না, দেখা হয়ে গেল কার্যসূত্রে। অফিসে বসে কাজ করছি। ভারী জুতোর শব্দে মুখ তুললাম। যে ভদ্রলোক আমার টেবিলের ওপাশে চেয়ারখানা দখল করলেন, তাঁর দৈর্ঘ ছ’ফুট এবং পরিধি তিন ফুটের কম নয়। আমি জিজ্ঞাসু চোখে চাইতেই পাশে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারটি পরিচয় দিলেন—সদর ডি. এস. পি.। ভদ্রলোক টুপিটা খুলতেই মাথাজোড়া বিশাল টাক চক্‌চক্ করে উঠল আমি সসম্ভ্রমে নমস্কার জানিয়ে বললাম, ও আপনিই মিস্টার ঘোষাল? ভারী আনন্দ হল।

—আনন্দ হল! ছাদ-ফাটানো হাসি হাসলেন ভূতনাথ; আমাকে দেখে কারো আনন্দ হয় এই প্রথম শুনলাম মশাই আপনার কাছে। অ্যাদ্দিন তো জানতাম, এ রূপ দেখলে লোকে আঁতকে ওঠে।—বলে পকেট থেকে একটা আধপোড়া মোটা সিগার বের করে ধরিয়ে কড়া ধোঁয়া ছাড়লেন।

ভূতনাথ অত্যুক্তি করেন নি। প্রকাণ্ড একটা খাঁড়ার মত নাক, তার নীচে জমকালো পাকানো গোঁফ, সুগোল রক্তাভ চোখ, পানের রস আর সিগারের ধোঁয়ায় জারিত মোটা মোটা ঠোঁট, গোটাকয়েক গজদন্ত এবং তার তলায় একখানা চওড়া চোয়াল। এ হেন আকৃতি আনন্দদায়ক তো নয়ই, ঘোর আতঙ্কদায়ক। কিন্তু আপনাকে দেখে ভারী আতঙ্ক হল—একথা তো বলা যায় না কোনো সদ্যপরিচিত আগন্তুককে।

সিগারটায় আরো গোটাকয়েক টান দিয়ে সহকারীকে বললেন, কই তোমার কাগজপত্তর বের কর।

সহকারী একখানা কাগজ আমার সামনে রাখলেন—একজন হাজতি আসামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার আবেদন। কাগজটায় চোখ বুলিয়ে দেখছিলাম। ভূতনাথ মাথা দুলিয়ে বললেন, আছে মশাই, আছে। ম্যাজিস্ট্রেটের সই না নিয়ে আসিনি। সে-সব চলত আগেকার দিনে। যখন খুশি দেখা করেছি আসামীর সঙ্গে, দরকার মত বের করে নিয়ে গেছি থানায়, আর পৌঁছে দিয়ে গেছি, যখন সুবিধা। পারমিশন তো দূরের কথা, একটা রসিদ-টসিদও চাননি জেলর-বাবুরা। সেসব দিন আর নেই। আপনারা হলেন নব্যতন্ত্রের অফিসার। আমরাও তাই আট-ঘাট বেঁধেই কাজ করি। কই, আপনার মেট গেল কোথায়? একবার হুকুম করুন, নিয়ে আসুক বদমাশটাকে। এখানকার কাজ সেরে আবার কোর্টে যেতে হবে একবার।

বলে, চেয়ারের উপর বিশাল দেহটা যতখানি সম্ভব এলিয়ে দিয়ে লম্বা হাই তুলে হাতে তুড়ি দিলেন।

আসামীকে আনানো হল। মাথায় ব্যাণ্ডেজ সর্বাঙ্গে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন। দেড়মাস হাসপাতালে থাকবার পর কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়েছে, কদিন হল। মেট এবং আর একজন কয়েদীর কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে এসে বসে পড়ল। ভূতনাথ তার মুখের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বললেন, তুমিই বদরউদ্দীন মুন্সী?

—হ্যাঁ হুজুর। চিনতে পারছেন না?

—চিনবো কেমন করে বল? তোমার কীর্তিকলাপ অবিশ্যি জানতে বাকী নেই। কিন্তু চাক্ষুষ দেখা তো হয়নি কোনোদিন।

—হয়েছে বৈকি। দেখা আমাদের হয়েছে, বড়বাবু। একবার নয়, দু’বার।

—দু’বার! বল কি? আমার তো মনে হচ্ছে না। কোথায় দেখলাম তোমাকে?

প্রথম দেখা আমাদের ছত্রিশ সালে কুড়ুলগঞ্জে ভুবন সার গদীতে। ডাকাতি করে পালাচ্ছিলাম। একেবারে পড়ে গেলাম হুজুরের পিস্তলের মুখে। গুলিও আপনি ছুঁড়েছিলেন। মাথা তাক করেই ছুঁড়েছিলেন। কিন্তু মাথাটা নিতে পারেননি, নিলেন এই কানের পাশ থেকে এক টুকরো মাংস। ভারী আপসোস হল; কানের জন্যে নয়, হুজুরের জন্যে। এমন পাকা হাতের গুলিটা ফসকে গেল।

ভূতনাথ হো হো করে হেসে উঠলেন, ফসকে গিয়ে ভালোই হয়েছিল বলতে হবে। তা না হলে আজ আমাদের দেখা হত কেমন করে? খোদা যা করেন ভালোর জন্যেই করেন, কি বল?

ভূতনাথের সুর হালকা। কিন্তু মুন্সী জবাব দিল গম্ভীর গাঢ় সুরে, আলবত। খোদা যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।

ঘরের হাওয়া যেন হঠাৎ বদলে গেল এবং মিনিট কয়েক কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর ভূতনাথ আবার পূর্বসূত্রে ফিরে গিয়ে বললেন, আচ্ছা, এ তো গেল একবার। আর কোথায় দেখা হল তোমার সঙ্গে?

—ওরই ঠিক একবছর পরে সোনাডাঙ্গার রমেশ ডাক্তারের বাড়িতে। নোটিশ দিয়ে ডাকাতি। একদল পুলিশ নিয়ে আপনি একেবারে রেডি হয়ে গিয়েছিলেন। মতলব ছিল বদর মুন্সীকে ঝাঁকসুদ্ধ ডাঙায় তোলা। কিন্তু দু’চারখানা ল্যাজা চালাতেই ফোর্স আপনার পালিয়ে গেল। হুজুর আশ্রয় নিলেন ডাক্তারের খিড়কির পুকুরে কচুরিপানার তলায়। আমার দলের লোকগুলো জানত, আপনিও সরে পড়েছেন। আমি কিন্তু জলের ওপর হুজুরের ঐ গোঁফজোড়া ভাসতে দেখেছিলাম। হাতে ল্যাজাও ছিল। কাজে লাগাইনি।

একটু থেমে খানিকটা যেন শ্লেষজড়িত সুরে বলল মুন্সী, তাহলেই দেখুন, হুজুর, খোদা যা করেন, ভালোর জন্যেই করেন।

ভূতনাথবাবুর মুখ দেখে মনে হল, তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। মুন্সীও সেটা লক্ষ্য করল এবং চোখে মুখে সামান্য একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, যাক ওসব পুরনো কথা। বাজে বকে খালি খালি আপনার সময় নষ্ট করবো না। এবার হুকুম করুন, গরিবকে হঠাৎ তলব করেছেন কেন?

ভূতনাথ চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগার টানছিলেন। কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার আড়ালে তাঁর মুখখানায় মনে হল আষাঢ়ের মেঘ থমথম করছে। আরও কিছুক্ষণ কালো ধোঁয়ার কড়া গন্ধ ছড়িয়ে, সোজা হয়ে বসে বললেন, দ্যাখ বদরুদ্দিন, দেখা আমাদের হোক আর নাই হোক, দুজনকে যে আমরা ভালোভাবেই চিনি সেকথা তুমিও জান, আমিও জানি। কথার মারপ্যাচ আর বুদ্ধির লড়াই দেখিয়ে লাভ নেই। তোমাকে যা বলবো একেবারে খোলাখুলিভাবেই বলবো। তোমার কাছ থেকেই সেই জিনিসটাই আশা করি।

—মারপ্যাচ আমার মধ্যেও নেই, হুজুর। খুনীই হোক, আর ডাকাতই হোক, বদর মুন্সীর দিল্ সাদা। একথা তার দুশমনরাও অস্বীকার করবে না।

—আমিও সে কথা বিশ্বাস করি, মুন্সী; আর সেই বিশ্বাস আছে বলেই তোমার কাছ থেকে কিছু সাহায্য চাইতে এসেছি।

মুন্সী বিস্ময়ের সুরে বলল, সাহায্য! আমার কাছে?

—হ্যাঁ, তোমারই কাছে। আজ চৌদ্দো বছর ধরে পুলিশ তোমাকে ধরবার চেষ্টা করছে; পারেনি। শুধু পুলিশ নয়, বেসরকারী লোকেরাও কম চেষ্টা করেনি। তোমার দলের পেছনে তাড়া করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত তিনজন লোক প্রাণ হারিয়েছে, জখমও হয়েছে অনেক। কদমতলীর মাঠে তিনশ’ লোকে ঘেরাও করেও শেষ পর্যন্ত তোমাকে আটকাতে পারেনি। সেই বদর মুন্সী কিনা ধরা পড়ল জনকতক কোঁচা-ঝোলানো বরযাত্রীর হাতে, তার একটা ঘুষির মুখে যাদের গুঁড়িয়ে ছাতু হয়ে যাবার কথা! তোমাকে এখানে না দেখলে কথাটা বোধ হয় আমিও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এমনিই হয়ে থাকে। এই দুনিয়ার নিয়ম। মহাভারতে আছে, অত বড় সে সব্যসাচী অর্জুন তিনিও একদিন তাঁর গাণ্ডীবখানা তুলতে পর্যন্ত পারেননি।

বদর মুন্সীর ভারী গলায় উত্তর এল, জানি।

—তাহলেই দ্যাখ, সব নিয়তির খেলা। যা কিছু লম্ফঝম্প, সব দু’দিনের। হঠাৎ একদিন এমনি করে তার শেষ হয়।

একটু থেমে ভূতনাথবাবু তেমনি ধীরে ধীরে বললেন, তুমি সেরে উঠেছ, সুখের কথা একরকম পুনর্জন্মই বলা চলে। ধরে যে তোমার প্রাণ ছিল সেদিন তাই তো কেউ বুঝতে পারেনি।

মুন্সী রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ছিল না হুজুর। প্রাণ ফিরে পেয়েছি জেলর সাহেবের দয়ায়। উনি আমার বাপ, আমার জন্মদাতা—-বলে সে মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে।

ভূতনাথ বললেন, সে সবই আমরা শুনেছি। কিন্তু যে-জীবন তুমি ওঁদের দয়ায় ফিরে পেলে, তার বাকী কটা দিনও বোধ হয় ওঁদের আশ্রয়েই কাটিয়ে দিতে হবে—শুনতে ভালো না লাগলেও, এ সত্যি কথাটা জেনে রাখা ভালো।

মুন্সী হেসে বলল, সেটাও কি আপনি আমাকে মনে করিয়ে দেবেন বড়বাবু? এই জেলের মাটিতেই যে একদিন আমার শেষ ঘুম আসবে, সেকথা আমি জানি। তার জন্যে তৈরিও হয়ে আছি।

ভূতনাথ উদাস কণ্ঠে বললেন, এই যখন পরিণাম, আর সে সম্বন্ধে তোমার মনে যখন কোনো মিথ্যা আশা নেই, তখন আর মায়া কিসের? যাদের সঙ্গে হাতে হাত ধরে একদিন এই পথে পা বাড়িয়েছিলে, তাদের পেছনে ফেলে এলে চলবে কেন? তাদেরও ডাক। সবাই এসে নিজের ভাগ বুঝে নিক।

মুন্সীর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি পড়ল ভূতনাথের মুখের উপর। আস্তে আস্তে তার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল আগেকার সেই শ্লেষ-কুঞ্চিত হাসি। বলল, এই সাহায্যই কি আমার কাছে চাইতে এসেছেন, হুজুর?

—শুধু চাইতে আসিনি মুন্সী, সাগ্রহে বললেন ভূতনাথ, সে সাহায্য পাব বলেই ভরসা করি।

—তাহলে বুঝবো, বদর মুন্সীকে আপনি চিনতে ভুল করেছেন বড়বাবু। আপনার এতখানি দামী সময় অনর্থক নষ্ট হল দেখে আমার আপসোস হচ্ছে।

ভূতনাথের রূপ হঠাৎ বদলে গেল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, তার মানে, তুমি দলের কারো নাম করবে না?

উত্তরে মুন্সী শুধু হাসল একটুখানি। তারপর উঠবার উদ্যোগ করে বলল, হুকুম হলে এবার উঠতে পারি, বড়বাবু। আপনার কাজের ক্ষতি হচ্ছে। সে লোকসান আর বাড়াতে চাই না।….সেলাম, হুজুর।

ভূতনাথ তীব্র শ্লেষের সুরে বললেন, ভূতনাথ দারোগার মুষ্টিযোগগুলো আজও একেবারে অকেজো হয়ে যায়নি, একথা বোধ হয় মুন্সী-সাহেবের স্মরণ আছে!

—নিশ্চয়ই আছে। তবে মুষ্টিযোগের ফল কি সকলের বেলায় সমান হয়, বড়বাবু? বলে, আর একবার সেলাম করে উঠে দাঁড়াল।

মুন্সী চলে যাবার পরেও খানিকক্ষণ ভূতনাথবাবুর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তাঁর মেঘাচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে সহকারীটি বললেন, আমি আগেই বলেছি স্যর, ভাল কথার পাত্তর ও নয়। রীতিমত ওষুধ চাই। সেই ব্যবস্থাই আমাদের এবার করতে হবে। আপনার ‘নিমজ্জনী সুধা’ কয়েক ডোজ পড়লেই বাপ বাপ করে পথে আসবে বাছাধন

ভূতনাথ কটমট করে তাকালেন তাঁর সহকারীর দিকে, অতো সোজা মনে কোরো না। যে লোকটা কনফেশন করে, অথচ আর কাউকে জড়ায় না, সে বড় কঠিন চীজ।

আমি বললাম, আপনার কথায় যদ্দূর বুঝলাম, লোকটা মহাপুরুষ। কিন্তু ধরা পড়ল কেমন করে?

—একেবারে মহাপুরুষের মত, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন ভূতনাথ, ধরা পড়ল, মার খেল ঠায় দাঁড়িয়ে, আর ঐ রকম মার; তারপর করে বসল এক কনফেশন। শুধু ডাকাতি নয়, তার সঙ্গে মার্ডার এবং রেপ। আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটাই যাকে বলে রহস্যময়। যাই হোক, আপনি ঠিকই বলেছেন, লোকটা মহাপুরুষ। কাজেই বেশ একটু কড়া নজর রাখতে হবে। ডানায় যখন একবার জোর পেয়েছে, হঠাৎ কোনদিন বনের পাখি বনে চলে যাবে, টেরও পাবেন না।

সে বিষয়ে জেলের তরফ থেকে হুঁশিয়ারী এবং কড়াকড়ির ত্রুটি ছিল না। ভূতনাথের উপদেশে সেই ব্যবস্থা আর একটু দৃঢ়তর হল।

এই ঘটনার পর মাসখানেক চলে গেছে। মুন্সীকে বিশেষভাবে মনে করবার মত নতুন কিছু ঘটেনি। তারপর একদিন বিকালের দিকে সেল-ব্লকের মেট এসে জানাল, মুন্সী আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

—কেন?

—সে কথা হুজুরের দরবারে নিজেই নিবেদন করতে চায়।

আমার মেটটি কিঞ্চিৎ লেখাপড়া জানে এবং সাধুভাষার উপর তার গভীর অনুরাগ।

বললাম, আচ্ছা ‘লিয়ে’ এসো।

মুন্সী এসে বসল আমার পায়ের কাছটিতে। আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। সে কিছু বলল না, এদিক ওদিক চেয়ে ইতস্তত করতে লাগল। তার উদ্দেশ্য বোঝা গেল। জন দুই কর্মী কার্যসূত্রে আমার অফিসে অপেক্ষা করছিল। তাদের তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে বললাম, বল এবার।

মুন্সী আমার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বলল, বদর মুন্সীর মনের কথা এমন করে কেউ কোনোদিন বোঝেনি হুজুর। আজ আবার এলাম এক নতুন আরজি নিয়ে।

—কি তোমার আরজি?

মুন্সী খানিকটা কি ভাবল। তারপর নিজের দু’খানা হাতের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বলল, গোস্তাকি মাপ করবেন, বড়বাবু। টাকাকড়ি সোনাদানা লোকে যতখানি চায় যতখানি পেলে মনে করে সে বড়লোক, তার চেয়েও অনেক বেশি এই দুটো হাত দিয়েই তো লুটেছি জীবনভোর। কিন্তু কেড়ে যেমন নিয়েছি, উড়িয়েও দিয়েছি তেমনি। পড়ে নেই কিছুই। যাদের কলজের ভেতর থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম তাদের নিঃশ্বাসেই সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আজ তাই মন আমার একেবারে হালকা। একটুখানি বোঝা শুধু রয়ে গেছে; উঠতে বসতে বুক চেপে ধরে। সেইটেই আজ হুজুরের পায়ের উপর ফেলে দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হতে চাই।

কথাটা স্পষ্ট বুঝতে না পেরে আমি নিঃশব্দে অপেক্ষা করে রইলাম।

মুন্সী আরো একটু কাছে সরে এসে হাতজোড় করে বলল, বলতে সাহস হয় না। কিন্তু না বলেও আমার উপায় নেই। হাজার পাঁচেক টাকা আমার লুকনো আছে এক জায়গায় সেটা আমি হুজুরের হাতে দিয়ে যেতে চাই।

সবিস্ময়ে বললাম, আমার হাতে! আমি সে টাকা নিয়ে কি করবো?

—বিলিয়ে দেবেন, যেখানে খুশি। ইচ্ছা হয় কোনো ভাল কাজে খরচ করবেন। তবু মরবার সময় এইটুকু জেনে যেতে পারবো, বদরুদ্দিন ডাকাতের গোটা জীবনটাই বিফলে যায়নি। অনেক দয়াই তো হুজুর করেছেন এই খুনীটাকে। তার শেষ আব্দারটুকু পায়ে ঠেলবেন না।

সহসা উত্তর দিতে পারলাম না। তার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, তার গুপ্তধনের ভার গ্রহণ আমার পক্ষে আইনসঙ্গত নয়, নৈতিক দিক দিয়েও অসঙ্গত। এই জাতীয় অবাঞ্ছনীয় প্রস্তাব তার পক্ষে অন্যায় স্পর্ধা বলে মনে হল। কিন্তু কি দেখেছিলাম জানি না, সেই পরস্বাপহারী নরহত্তার মুখের উপর, কি শুনেছিলাম তার বেদনার্ত ব্যাকুল কণ্ঠে, রূঢ় উত্তর আমার মুখে এসেও আটকে গেল। সোজা জবাবটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, নিজের লোক কি তোমার কেউ নেই যে অতগুলো টাকা বিলিয়ে দিতে চাইছ?

মুন্সী একটু হেসে বলল, নিজের লোক? নিজের লোকের অভাব কি, বড়বাবু? সবাই আছে। তিন-তিনটা বিবি, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী, তাদের আবার ছেলেমেয়ে। না আছে কে? আপনি বলবেন, কেউ তো আসে না একটু খোঁজখবর নিতে? তবু তারা আছে। আরো কিছু টাকা আমার রয়ে গেছে, এ খবরটা জানাজানি হলেই আণ্ডাবাচ্ছা নিয়ে ধন্না দেবে আপনার ঐ জেলের মাঠে। এমন মড়াকান্না কাঁদবে হয়তো আমার চোখেই জল এসে পড়বে। এই বুড়ো বয়সে অতোটা দরদ তো সইতে পারবো না। আপনার লোক মাথা খুঁড়ে মরবে তাও চোখের ওপর দেখতে চাই না। কাজেই আমার এ টাকার কথা তারা কোনোদিন জানবে না।

-বেশ, তাদের না হয় না দিলে। কিন্তু টাকার দরকার তোমার নিজেরও তো কম নয়। অত বড় মামলা তোমার মাথার ওপর।

মুন্সীর মুখে হাসি ফুটে উঠল : আস্তে আস্তে বলল, মামলার হাত থেকে বাঁচবার চেষ্টাই যদি করবো, তাহলে আজ এখানে আসবার কি দরকার ছিল, বড়বাবু?

তা বটে। ভূতনাথবাবুর কথা মনে পড়ল। মুন্সীর এই ধরা-পড়া এবং স্বীকারোক্তির মধ্যে কী একটা রহস্য আছে। সে রহস্য উদ্ঘাটনের কৌতূহল যতই থাক, সে সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করা আমার পক্ষে সমীচীন হবে না বলে চুপ করে রইলাম। মুন্সী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, আরজি আমার মঞ্জুর হল তো হুজুর?

বললাম, তোমার মনের কথা আমি বুঝতে পারছি, মুন্সী। তেমনি তুমিও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, এ বিষয়ে তোমাকে সাহায্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু একটা কথা জানতে চাই। বল তো, তোমার ইচ্ছাটা কি? কাকে তুমি দিয়ে যেতে চাও তোমার এই শেষ সম্বল? কিভাবে, কার হাতে দিলে তুমি শান্তি পাও?

মুন্সী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না। একদৃষ্টে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল শূন্য দেওয়ালের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, আপনি আমার বাপ, আমার জীবনদাতা। আপনার কাছে লুকোবার আমার কিছুই নেই। এ সংসারে একটা মানুষ আছে, যার হাতে এই সামান্য টাকাটা তুলে দিতে পারলে আমার মনের বোঝা নেমে যায়। আমি মহানন্দে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে হাসতে হাসতে চলে যেতে পারি। কিন্তু একথাও জানি সে আমার টাকা পা দিয়েও ছোঁবে না। যে চরম সর্বনাশ আমি তার করেছি, দুনিয়ার সমস্ত টাকা ঢেলে দিলেও তার কোনোদিন পূরণ হবে না।

টেবিলের উপর টেলিফোন ঝঙ্কার দিয়ে উঠল।

—হ্যালো!

কোর্ট থেকে খবর দিচ্ছে, জজসাহেব একটা জটিল মামলার এইমাত্র চার্জ বোঝানো শেষ করেছেন, জুরী মহোদয়গণ দরজা বন্ধ করলেন। কখন খুলবেন, নিশ্চয় করে বলা যায় না। অতএব আসামীদের ফিরতে অনেক রাত হবার সম্ভাবনা।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। জানালা দিয়ে দেখা গেল দূরে আকাশের গায়ে অস্তমান সূর্যের বর্ণচ্ছটা, সেই দিকে চেয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল মুন্সী। আমিও উঠলাম। লক-আপ-পর্বের আয়োজনে অংশগ্রহণ করতে হবে। যেতে যেতে বললাম, আবার কবে আসছ?

আর্দ্র কণ্ঠে উত্তর এল, যেদিন আবার হুকুম পাবো।

কয়েকদিন পরে তেমনি সময়ে সেই জায়গাটিতে বসেই শুনলাম তার অসমাপ্ত আত্মকাহিনী, নরঘাতক দস্যুর বিচিত্র জীবনের এক অপূর্ব অধ্যায়। বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন আকাশে সেদিন বিপুল ঘনঘটা। আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঘন ঘন বিদ্যুৎস্ফুরণ। মনে হচ্ছিল, প্রলয় আসন্ন। সেইদিকে চেয়ে অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে বসে রইল মুন্সী। তারপর ধীরে ধীরে অনুচ্চ গম্ভীর কণ্ঠে বলে গেল তার শত দুষ্কর্মের বিবরণ

আজ এতদিন পরে আমার কণ্ঠে তার পুনরুক্তি করতে গিয়ে মনে হচ্ছে এর চেয়ে হাস্যকর ব্যর্থতা আর হতে পারে না। তবু এইটুকু আমার সান্ত্বনা—নিজের ভাষা ও ভাষ্য দিয়ে তাকে আমি বিকৃত করিনি, ব্যাহত করিনি তার স্বচ্ছন্দ সারল্য। এ কাহিনীর কথা মুন্সীর, সুরও তারই। আমি অক্ষম লিপিকার মাত্র।

মুন্সীর কাহিনী শুরু হল :-

কালীগঞ্জের সীতানাথ দত্তের বাড়িতে ডাকাতি করবো—এটা আমাদের অনেক দিনের ইচ্ছা। লোকটা টাকার কুমির, কিন্তু ভয়ানক ধড়িবাজ। টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি বাড়িতে বিশেষ কিছুই রাখে না, সব থাকে ব্যাঙ্কে। মস্ত বড় কারবার। চারখানা গোরুর গাড়ি। সবগুলো নিজের কাজেই খাটছে দিনরাত। তার একখানার গারোয়ান করে ঢুকিয়ে দিলাম আমাদের দলের এক ছোকরাকে। সেই একদিন খবর নিয়ে এল, দত্তমশায়ের মেয়ের বিয়ে। ঐ একটিই মেয়ে। জামাই আসছে বড় ঘর থেকে। বিয়েতে মস্ত ধুমধাম হবে। বড়লোক কুটুম্ব আসবে অনেক। বিয়ের রাতে হানা দিতে পারলে নগদে গয়নাতে হাজার পঞ্চাশের বুঝ যে পাওয়া যাবে, তাতে আর সন্দেহ নেই। তবে দত্তমহাশয়ের দুটো বন্দুক আছে, হিন্দুস্থানী দারোয়ান আছে। বাড়িতে লোকজনও থাকবে কম নয়। কাজেই আয়োজনটা বড় রকমের হওয়া দরকার। সেদিক থেকে অসুবিধা কিছু নেই। দল ঠিক করে ফেললাম। তা ছাড়া—

এ পর্যন্ত বলে মুন্সী হঠাৎ থেমে গেল। মনে হল ভাবছে, যেটা মুখে এসেছিল, তাকে মুখের বাইরে আনা ঠিক হবে কিনা। একবার আমার দিকে তাকাল এবং পরক্ষণেই যেন সব সঙ্কোচের বাধা ঠেলে দিয়ে বলল, নাঃ, লজ্জা করলে তো চলবে না। এ পাপমুখে সবই যখন কবুল করেছি হুজুরের কাছে, এটাও লুকোবো না।

হুজুর জানেন এক একটা ডাকাতিতে কত বড় বড় গেরস্তকে আমরা পথের ফকির করে ছেড়ে দিই। দশজনে বলাবলি করে, লোকটার কি সর্বনাশ হয়ে গেল! বাইরে থেকে ঐটুকু দেখা যায়, কিন্তু আসল সর্বনাশ যে কদ্দূর গিয়ে পৌঁছায় তার খবর আপনারা রাখেন না। লোকের ধনপ্রাণ কেড়ে নিয়েই আমরা ক্ষান্ত হই না, কেড়ে আনি মান, আর তার চেয়েও বড় জিনিস—মেয়েদের ইজ্জত। বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, আর বৌ-ঝিদের ধর্ম নষ্ট হয়নি এ রকম ঘটনা আমি অন্তত একটাও জানি না। শিকারীর দলে যেমন কতগুলো লোক থাকে, যারা বনবাদাড় ভেঙে পিটিয়ে হৈ-হল্লা করে শিকার ধরবার সুবিধে করে দেয়, আমরাও তেমনি একদল গুণ্ডা নিয়ে যাই, যাদের কাজ হল মারধোর, খুন-জখম আর চেঁচামেচি। এদের নজর রূপোর দিকে যতটা থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে রূপের দিকে। আমরাও তাই চাই। এগুলোকে দিয়ে আমাদের ডবল লাভ। গোটাকয়েক মেয়েমানুষের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে আসল কাজ হাসিল করে নিই; আর ভাগ-বাঁটোয়ারার বেলায় যা হোক কিছু দিলেই চলে যায়। দেখতে ভাল বলে দত্তবাড়ির মেয়েদের নামডাক ছিল। তার ওপর এই বিয়ে উপলক্ষে শহর থেকে যারা আসবে, তারা তো আর এক কাঠি সরেশ। কাজেই গুণ্ডা আসতে লাগল দলে দলে। ওরই মধ্যে থেকে বেছে বেছে একদল জোয়ান ছোকরা ঠিক করে ফেললাম।

শীতের রাত। বারোটার মধ্যেই বিয়ের গোলমাল মিটে গেল। যারা খেতে এসেছিল, সব চলে গেল। বরযাত্রী আর দূরের কুটুম্বরাও সব শুয়ে পড়েছে। এমনি সময়ে আমরা মার মার শব্দে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বাড়িটা ঘিরে ফেলা হল প্রথম চোটেই। খোট্টা দারোয়ানগুলোর কোনো পাত্তাই পাওয়া গেল না। বরযাত্রীদের ঘর বাইরে থেকে বন্ধ করে ঢুকে পরলাম বাড়ির মধ্যে। মেয়েমহলে কান্নাকাটির ধুম পড়ে গেল। বাছা বাছা লোক নিয়ে উঠলাম গিয়ে দোতলায়। বাহাদুর লোক বটে সীতানাথ দত্ত। যেন কিছুই হয়নি, এমনি ভাবে বেরিয়ে এসে বলল, তোমাদের সর্দার কে? মুখে রং-টং মাখা ছিল। এগিয়ে গেলাম। দত্তমশাই বলল এই নাও চাবি। ঐ ঘরে সিন্দুকে টাকা আছে। গয়নাও বেশ কিছু আছে। নিয়ে যাও। কাপড়-চোপড় আছে, তাও নিতে পার। মেয়েদের গায়ে যে সব গয়না আছে, তাও খুলে দেবার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু একটা কথা দিতে হবে।

—কি কথা?

—যদি হিন্দু হও, নারায়ণের দিব্যি, যদি মোছলমান হও, আল্লার দিব্যি, মেয়েদের গায়ে যেন হাত দেয় না কেউ।—বলে এগিয়ে এসে এই হাত দুটো জড়িয়ে ধরে দত্তমশাই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ধরা গলায় বলল, ডাকাতের সর্দার হলেও তুমি মানুষ। আমারই দেশের মানুষ। তোমার ঘরেও মা-বোন বৌ-ঝি আছে। এইটুকু শুধু তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি।

ডাকাতি অনেক করেছি, বড়বাবু। কান্নাকাটিও কম শুনিনি। ও সব আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। কিন্তু দত্তমশায়ের চোখের জলে মনের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। কথা দিলাম। বললাম, গয়নাগাঁটি খুলে দিয়ে মেয়েদের সব একটা ঘরে চলে যেতে বলুন। ওঁদের কোনো বিপদ নেই।

দত্তমশাই চলে গেল। আমি আমার দলবল জড়ো করে হুকুম দিলাম, টাকাকড়ি জিনিসপত্তর যা পাও লুঠ কর। কিন্তু সাবধান, জেনানা হারাম।

কাজ শেষ হতে আধ ঘণ্টার বেশী লাগল না। সবাইকে নিচে যাবার হুকুম দিয়ে ভাবলাম, তেতলাটা একবার নিজের চোখে দেখে আসি। সীতানাথ দত্ত ঘড়েল লোক। কিছু আবার লুকিয়ে-টুকিয়ে রাখেনি তো ওখানে?

তেতলায় একখানা ঘর। অন্ধকার। দরজা বন্ধ। জানালা দিয়ে টর্চ ফেলতেই আলো পড়ল একটি মেয়ের মুখের উপর। চমকে উঠলাম। এ কে? কোত্থেকে এল ও? একেবারে অবিকল সেই। সেই নাক, সেই চোখ, তেমনি জোড়া ভুরুর উপর ছোট্ট একখানি কপাল। আমার কত আদরের নুরু। পরীর মত মেয়ে। আমার ছেলেবেলার দোস্ত ছিল মতীশ; কলেজে পড়ত তখন। সাধ করে নাম দিয়েছিল নূরজাহান। আট বছর আগে এমনি দামী বেনারসী পরিয়ে গা-ভরা জড়োয়া গয়নায় সাজিয়ে মাকে আমার পরের ঘরে পাঠিয়েছিলাম। আর ফিরে আসেনি।

মেয়েটা চীৎকার করে কাকে জড়িয়ে ধরল। টর্চ নিবিয়ে দিলাম। বেশ করে রগড়ে নিলাম চোখ দুটো। এ আমার কী হঙ্ক? কি ভাবছি ছাই-ভষ্ম? কে ঐ মেয়েটা? সীতানাথ দত্তের মেয়ে? ওরই হয়তো বিয়ে হল খানিকক্ষণ আগে। আবার টর্চ জ্বাললাম। ভারী ভারী গয়নার উপর জড়োয়ার পাথরগুলো ঝলমল করে উঠল। হাজার দশেক টাকার মাল। ভাগ্যিস ওপরে এসেছিলাম। দত্তটা এক নম্বর জোচ্চোর। ধমক দিয়ে বললাম, খুলে দাও গয়না। কে যেন মুখ চেপে ধরল। স্বর ফুটল না। নুরুর মুখখানা ভেসে উঠল চোখের ওপর। সেই আট বছর আগে শেষবারের মত দেখা বিয়ের সাজ-পরা নূরজাহান। ঠোঁট দুটো যেন কেঁপে উঠল একবার। কি বলতে চায় সে? এ গয়না আমার নেওয়া হবে না— এই কথাই যেন শুনতে পেলাম তার মুখে!

ফিরে এলাম। সোজা নীচে নেমে গেট পার হয়ে, ছুটলাম মাঠের দিকে। দলের লোকগুলো ঐখানেই কোথাও অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। মনে হল, কে যেন আমার ঘাড় ধরে ঠেলে নিয়ে চলেছে। খানিকক্ষণ ছুটবার পর হঠাৎ থমকে গেলাম। এ কী করছি! মাথাটা কি সত্যিই খারাপ হয়ে গেল? এরকম তো কোনোদিন হয়নি। সীতানাথ দত্তের দুটো মিষ্টি কথা শুনে বদরুদ্দিন ডাকাতের মন ভিজে গেল? কথার খেলাপ করে বসলাম নিজের দলের সঙ্গে! যে লোভ দেখিয়ে নিয়ে এলাম ঐ ছোঁড়াগুলোকে, তার ধারেও তারা ঘেঁষতে পেল না, আর সেটা আমারই জন্যে! এলাম ডাকাতি করতে, ফিরে যাচ্ছি দশ হাজার টাকার গয়না ফেলে রেখে! ভীমরতি আর কাকে বলে?

মাথাটায় বেশ কয়েকবার ঝাঁকানি দিয়ে মনে হল যেন নেশার ঘোর কেটে গেছে। ঢুকলাম আবার দত্তবাড়ির ফটকে। সোজা তেতলায় উঠে গেলাম। ঘর খোলা। টর্চ জ্বেলে যা দেখলাম—

হঠাৎ আবার থেমে গেল মুন্সী। দুটো বড় বড় চোখ শূন্য, বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ঐ ফাঁকা দেয়ালটার দিকে। ঐখানেই যেন ফুটে উঠেছে সেদিনের দেখা কোনো বীভৎস দৃশ্য। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি আবার সহজ হয়ে এল। দেয়াল থেকে চোখ নামিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল, যা দেখলাম আমার কাছে নতুন কিছু নয়, বড়বাবু। সারা জীবন কত দেখেছি। খুন আর বলাৎকার—এই তো আমার পেশা। এই হাতে কত লোকের গলা টিপে মেরেছি, ছোরা বসিয়েছি বুকে, ল্যাজার এক ঘায়ে খতম করেছি, রামদার এক কোপে নাবিয়ে দিয়েছি ধড় থেকে মুণ্ডু। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটেছে। এতটুকু বুক কাঁপেনি। মাথাও ঘোরেনি একবার। মেয়েমানুষের সর্বনাশ? তাও কম করিনি। কত মেয়ে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে, তবু রেহাই পায়নি। কত বড় বড় ঘরের ঝি বৌ এই পায়ের উপর মাথা খুঁড়ে বলেছে, তুমি আমার ধর্মের বাপ, আমি তোমার মেয়ে। হাসি পেয়েছে সে-সব মড়াকান্নার বহর দেখে। কিন্তু আজ আমার এ কী হল? ঘরে ঢুকে যা দেখলাম, মাথাটা ঘুরে গেল। দেয়াল ধরে সামলে নিলাম। দেখলাম দেয়ালের গা ঘেঁষে পড়ে আছে একটি জোয়ান ছেলে। রাজাবাদশার মত রূপ; পরনে বরের পোশাক। বুকের বাঁ দিকটায় বিঁধে রয়েছে একখানা ছোরা। সবটাই বসে গেছে বেরিয়ে আছে শুধু বাঁট। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বাসরঘর আর তার মাঝখান জুড়ে ভেলভেটের জাজিম। রক্তে-ভেজা বিছানার একপাশে অসাড় হয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে মেয়েটা, আর আমারই একটা জানোয়ার—। চুল ধরে টেনে তুললাম শুয়োরটাকে। মুখটা তার ঠুকে দিলাম দেয়ালের গায়ে। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত ছুটল। চারপাঁচটা দাঁত ভেঙে বেরিয়ে গেল। আর দু-এক ঘা খেলেই সাবাড় হয়ে যেত শালা। কিন্তু ছেড়ে দিলাম। ছুঁচো মেরে হাতে গন্ধ করে কী লাভ? লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম বারান্দায়।

ছেলেটির নাড়ী ধরলাম। নাকে হাত দিয়ে দেখলাম। নেই। তারপর এগিয়ে গেলাম তার দিকে। মেয়ে তো নয়, যেন একরাশ কাঞ্চন ফুল। কে বলে নুরু নয়? এই তো আমার নূরজাহান। এত রূপ কি মানুষের হয়? বেহেস্ত থেকে নেমে এসেছে সীতানাথ দত্তের ঘরে। আমারই মেয়ে সে। আজ বিয়ের রাত না পোহাতে আমারই হাত দিয়ে এল তার সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে চরম সর্বনাশ!…

.

কিছুক্ষণ থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বর্ষণ-মুখর বিষণ্ণ সন্ধ্যা। ঘনায়মান অন্ধকারে মুন্সীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। উঠে গিয়ে আলোটা জ্বেলে দিলাম। চমকে উঠলাম। বদর মুন্সীর চোখে জল! না, ভুল করিনি। দুটি রোগপাণ্ডুর গণ্ডের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নির্বাক অশ্রুধারা। বললাম, থাক মুন্সী, এসব কথা বলে আর কি হবে? এতে আজ কারোরই কোনো লাভ নেই। মুন্সী তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল, না. হুজুর, মেহেরবানি করে আর একটু শুনুন। লাভ থাক আর নাই থাক, সব কথা আজ আমাকে বলতেই হবে। আপনাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলবো?

আমি সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারের উপর পা তুলে গুছিয়ে বসলাম। মুন্সী শুরু করল।

ঘরের কোণে একটা সোরাই ছিল। কয়েকবার চোখে মুখে জলের ছিটে দিতে ও চোখ মেলে তাকাল। অনেক বছর আগে আমার নুরুও এমন করে চাইত। কিন্তু কত তফাত! এদিক ওদিক চেয়ে হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠে সঙ্গে সঙ্গে আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। ছুটে বেরিয়ে গেলাম। ডাক্তার! একজন ডাক্তার চাই। ভুলে গেলাম আমি কে, কোথায় যাচ্ছি, ডাক্তার ডাকবার আমার কি অধিকার। শুধু মনে হল ডাক্তার ডাকতে হবে। কিন্তু সে সুযোগ আর হল না। সিঁড়ির মুখেই আটকা পড়ে গেলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, মেয়েটি আমার কেউ নয়। আমি তাদের বাড়ি এসেছি ডাকাতি করতে। আমারই জন্যে আজ একফোঁটা কচি মেয়ে দুনিয়ার সব কিছু হারিয়ে সংসারের বাইরে চলে গেল।

ভূতনাথবাবু মিথ্যা বলেননি, হুজুর, যারা আমাকে ঘিরে ধরেছিল ইচ্ছে করলে তাদের সবগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু হাত আমার উঠল না। কেবলই মনে হতে লাগল, এই শেষ। বদর মুন্সীর কবর খোঁড়া হচ্ছে। গিয়ে শুধু ঘুমিয়ে পড়া। লাঠি, সড়কি, লোহার ডাণ্ডা—অনেক কিছুই চারদিক থেকে এসে পড়ছিল আমার মাথায়, পিঠে, ঘাড়ে। যতক্ষণ পেরেছি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর কখন পড়ে গেলাম। আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান যখন হল, চোখ মেলে প্রথমেই দেখলাম পাশে দাঁড়িয়ে লাল পাগড়ি। একজন মাথায়-রুমাল-বাঁধা দেশী মেমসাহেব ছুটে এল। বুঝলাম, নার্স। কাছে এসে আমার নাড়ী দেখল, তারপর একটা শিশি থেকে খানিকটা ওষুধ গেলাসে ঢেলে আস্তে আস্তে খাইয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে একটু যেন বল পেলাম। অতি কষ্টে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কোথায়?

—এটা সরকারী হাসপাতাল। ডাক্তারবাবুকে ডেকে দেবো?

হাত নেড়ে বললাম, চাই না। হাকিম—হাকিম চাই একজন।

একজন পুলিশের দারোগা এলেন। আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাকিম কেন?

-একরার করবো।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এলেন। তখনো আমার জ্ঞান ছিল, কিন্তু কষ্ট হচ্ছিল খুব। একরারী আসামীর জবানবন্দী—কত ঝঞ্ঝাট, সে তো আপনি জানেন। লিখবার আগে তাকে সাবধান করে দিতে হবে, সময় দিতে হবে ভেবে দেখবার। হাকিমদের কত কি সব নিয়ম আছে। আমি বললাম, ওসব আইনকানুন চটপট সেরে ফেলুন হুজুর। সময় বেশী দিলে এ জীবনে আর সময় হবে না।

বলবার কথা সামান্য। কোনোরকমে থেমে থেমে বলে গেলাম। সবটুকু বোধ হয় বলতে পারিনি। তার আগেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম। তারপর কখন কি করে ওরা আমাকে হুজুরের আশ্রয়ে নিয়ে এল, কিছুই জানি না। সরকারী হাসপাতালের কর্তারা বোধ হয় মনে করেছিলেন, মড়াটা আর তাদের ওপর চাপে কেন? ফেলে দাও জেলের ঘাড়ে। কিন্তু তারা জানত না, এখানে আমার বাবা আছেন। তাঁরই দয়ায় আমার মরা ধড়ে প্রাণ ফিরে এল।

.

মুন্সীর কাহিনী শেষ হল। আমি তার শেষ প্রসঙ্গের জবাব দিলাম। বললাম, এর মধ্যে আমার দয়া তো কোথাও কিছু নেই, মুন্সী। যেটুকু কর্তব্য, তাই শুধু করেছি। বরং কৃতিত্ব যদি কিছু থাকে সেটা ডাক্তারের। সে যাক। একটা কথা শুধু বুঝতে পারছিনে। অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করেছে, এটা নতুন নয়, অদ্ভুত কিছুও নয়। কিন্তু যে-অপরাধ সে করেনি, তারই বোঝা স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে হাকিম ডেকে হলপ করে বলছে, এটা আমি করেছি—এরকম তো কখনো শুনিনি। এর মধ্যে বাহাদুরি থাকতে পারে, কিন্তু একে সৎসাহস বলে না। ডাকাতি তুমি করেছ। তার সমস্ত দায়িত্ব তোমার। কিন্তু ঐ মেয়েটি আর তার স্বামীর উপর যে জঘন্য অত্যাচার ঘটল সেদিন, তার দায়িত্ব তো তোমার নয়। সাধ করে দুটো মারাত্মক মিথ্যা অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফাঁসির দড়ির সামনে গলা বাড়িয়ে দেবার সার্থকতা কোথায়, আমি দেখতে পাইনে।

মুন্সী বিনীত কণ্ঠে বলল, হুজুর জ্ঞানী লোক, আমি মুখ্যু ডাকাত। হুজুরের সঙ্গে তর্ক করা আমার গোস্তাকি। তর্ক আমি করছিনে। কিন্তু একথাও অস্বীকার করতে পারিনে, মেয়েটার কপালে যা কিছু ঘটল, তার সবটুকুর মূলেই তো আমি। ঐ জন্তুটাকে আমিই তো জুটিয়েছিলাম। যে জন্যে জুটিয়েছিলাম, ঠিক তাই সে করেছে। চুক্তির বাইরে সে যায়নি। কথার খেলাপ যদি কেউ করে থাকে, সে আমি। সীতানাথ দত্তের কথায় ভুলে যে হুকুম আমি জারী করেছিলাম, সে অন্যায় হুকুম। ঐ গুণ্ডাটা যদি সে মানা না মেনে থাকে, তার জন্যে তাকে দোষ দিই কেমন করে?

বুঝলাম, মন তার যে পথ ধরে ছুটে চলেছে, আমার ন্যায়-অন্যায়ের শুষ্ক লজিক সেখানে অচল। হয়তো ওর কথাই ঠিক। আর একথাও সত্যি যে, দৈবক্রমে ঐ মেয়েটার মুখে যদি ওর নুরুর মুখের আদল সেদিন চোখে না পড়ত, আজ আমার কাছে বসে বদর মুন্সীর এ কাহিনী শোনাবার কোনো উপলক্ষ ঘটত না। এ সংসারে ঐ নুরুই ছিল তার একমাত্র বন্ধন। সে বন্ধন একদিন অকালে ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যে ক্ষত রেখে গিয়েছিল ঐ দানবপ্রকৃতি দস্যুর বুকের কোণে, সেটা হয়তো চিরদিন তার অগোচরে থেকে যেত। হয়তো চিরদিনই এমনি কত শত সীতানাথ দত্তের মেয়ে তার লোভ আর লালসার আগুনে আহুতি দিয়ে যেত তাদের অনিন্দ্য রূপ, অমূল্য বস্ত্রালঙ্কার, আর অত্যাজ্য সতীধর্ম। কিন্তু তা হল না। বদর মুন্সীর বিচিত্র জীবন-নাট্যে দেখা দিল এক প্রলয়-রাত্রি। আট বছরের ওপার থেকে নববধূ বেশে ফিরে এল তার নূরজাহান। ফিরে এল, কিন্তু বদর মুন্সী তাকে ফিরে পেল না। তার নিজের হাত দিয়েই এল নির্দয় আঘাত। নির্মূল হয়ে গেল ঐ মেয়েটার স্বামী, সম্ভ্রম, তার নারী-জীবনের সমস্ত শোভা ও সম্পদ। নতুন করে মৃত্যু হল নূরজাহানের। আট বছরের পুরানো ক্ষত-মুখ থেকে আজ শুরু হয়েছে রক্তক্ষরণ। নিজেকে নিঃশেষ না করে এ বেদনার উপশম নেই।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ক্ষান্তবর্ষণ আকাশে মেঘাড়ম্বর স্তব্ধপ্রায়’। বদর মুন্সীর সেলের লৌহতোরণ অনেকক্ষণ আগে থেকেই তার জন্যে অপেক্ষা করছে। তার নিশ্চয়ই মনে নেই; আমিও মনে করিয়ে দিইনি। জমাদার কয়েকবার নিঃশব্দে পায়চারি করে গেছে জানালার সুমুখ দিয়ে। এক দুর্দান্ত ডাকাতের জন্যে তাদের উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। তবু উঠব উঠব করেও যেন উঠতে পারছিনে।

মুন্সী আরো কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটিয়ে ধীরে ধীরে বলল, হুজুর ফাঁসির দড়ির কথা বলছিলেন। ও জিনিসটাকে আর ভয় নেই। ফাঁসিতে যাওয়াই আজ সবচেয়ে ভালো যাওয়া। এক নিমিষে সব শেষ। কিন্তু এই তিলে তিলে মরা, এ মরণ তো আর সহ্য হয় না! না, এ আমার আপসোস নয়। জীবনে যা কিছু করেছি, যত পাপ, যত অন্যায়, তার জন্যে আমার দুঃখ নেই। মৌলবী-সাহেবরা যাই বলুন, তার জন্যে তওবা করবারও কোনো চাড় নেই আমার মনে। বুকের ভেতরটা শুধু জ্বলতে থাকে, যখন ঐ মেয়েটার মুখ মনে পড়ে। রাতে ঘুম নেই, দিনে স্বস্তি নেই। সমস্ত শরীরে শুধু জ্বালা। হতভাগীর যা হবার, তা তো হল। তারপর? সারাটা জীবন কেমন করে কাটবে ওর? যে শ্বশুরঘর ও দেখতেও পেল না, সেখানে জায়গা হবে না। বাপের বাড়ির আশ্রয় তাও হয়তো ছাড়তে হবে। আজ না হলেও কাল। বিয়ের রাতে বিধর্মী ডাকাত এসে যার সর্বনাশ করে গেল, হিন্দুর ঘরে সে মেয়েকে কি চোখে দেখেন আপনারা, সে তো আমি জানি। ঐ রকম সব মেয়ের যা গতি, ওকেও কি সেই পথে যেতে হবে? সন্ধ্যার পর সেজেগুজে দাঁড়াতে হবে ঐ বাজারের গলিতে? ওখানে যারা থাকে, তাদের কতজনকে তো আমি জানি। এই রাস্তা ধরেই তারা একদিন ভেসে এসেছিল। ঐ ফুলের মত মেয়ে, কোনো দোষ যে করেনি, দুনিয়ার কোনো পাপের ছোঁয়াচ যার গায়ে লাগেনি, তাকেও গিয়ে পচে মরতে হবে ঐ দোজকের পাঁকের মধ্যে? আমার সর্বস্ব দিয়েও কি তাকে বাঁচাবার উপায় নেই?

এই নিষ্ফল প্রশ্নমালার আমি কি উত্তর দেবো? আমি শুধু নির্বাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম অগ্নিগোলকের মত তার দুটো চোখের পানে। সর্বাঙ্গে অনুভব করলাম তার দাহ। প্রশ্নবাণ নিরস্ত হল। কিন্তু তার উত্তেজিত ভগ্নকণ্ঠের দুঃসহ বেদনা সমস্ত ঘরময় অনুরণিত হয়ে ফিরতে লাগল।

মেয়েটার যে বিভীষিকাময় ভবিষ্যৎ আজ ওর কল্পনায় ভেসে উঠেছে, একদিন যে সে বাস্তবের রূঢ় রূপ ধরে দেখা দেবে না, কেমন করে বলি? কিন্তু সে পরিণাম যদি সত্যি দেখা দেয়, মুন্সী তাকে রোধ করবে কি দিয়ে? কি কাজে লাগবে ওর সযত্ন-সঞ্চিত গুপ্তধন?

একথাটা আমি যেমন করে বুঝেছি, এই বহুদর্শী অভিজ্ঞ দস্যু তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে তার চেয়ে কম বোঝেনি। কিন্তু মানুষের জীবনে বুদ্ধির স্থান কতটুকু? কটা প্রশ্নের জবাব সে দিতে পেরেছে আজ পর্যন্ত? কটা সমস্যার সমাধান? Rational animal বলে মানবজাতির পরিচয় আছে দর্শনের পাতায়। শুনতে পাই, এইটাই নাকি তার বৈশিষ্ট্য। সমগ্র জীব-জগতে মানুষ যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে, তার মূলেও শুনি তার ঐ Rationalism. সেজন্যে গর্ববোধ করতে চান করুন। কিন্তু একথা অস্বীকার করি কেমন করে যে, আমার মধ্যে যতটুকু Rational তার অনেক বেশি animal?

জ্ঞানগর্বী মানুষ এই সহজ সত্যটা মেনে নিতে লজ্জাবোধ করে। বুদ্ধিজীবী বলে তার অহঙ্কারের অন্ত নেই। ন্যায়শাস্ত্রের ধরাবাঁধা ফরমুলা দিয়ে সে বাঁধতে চায় তার দৈনন্দিন কর্মধারা। কিন্তু যখন ঝড় ওঠে কোথায় থাকে তার Logical Syllogism? শতছিন্ন হয়ে যায় তার হিসাবনিকাশের জটিল সূত্র। সেদিন যে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, সে তার মস্তিষ্ক নয়, হৃদয়; হেড নয়, হার্ট—যার রহস্যময় ভাষার কোনো আভিধানিক অর্থ নেই, কোনো থিওরির কাঠামোতেও যাকে বাঁধা যায় না।

মুন্সীর জীবনে ঝড় উঠেছিল। তাই যে প্রশ্ন নির্গত হল তার বিক্ষত বক্ষ আলোড়িত করে, সেও এমনি অর্থহীন। নির্বিকার নিঃশব্দে আমি শুধু তার শ্রোতাই রয়ে গেলাম। তার ব্যাকুল দৃষ্টি তখনো আমার মুখের উপর নিবদ্ধ, সাগ্রহ উত্তর-প্রতীক্ষায় উন্মুখ। আমি দেয়াল-ঘড়িটার দিকে তাকালাম। রাত আটটা বেজে পনেরো। চোখ নামিয়ে তার দিকে ফিরে বললাম, জমাদার দাঁড়িয়ে আছে। তোমাকে এবার বন্ধ হতে হবে, মুন্সী।

.

দিনকয়েক পরে ভূতনাথবাবু আবার এসে উপস্থিত। তেমনি হঠাৎ এবং হন্তদন্ত।

—কি ব্যাপার?

—মুন্সীটাকে একবার আনতে পাঠান তো?

—নতুন করে বাজিয়ে দেখবার মত পেলেন নাকি কিছু?

—একটা দাঁতভাঙা গুণ্ডা ধরা পড়েছে। সন্দেহ হচ্ছে ওরই দলের লোক। দেখি কিছু বলে কিনা। ব্যাটাকে একটু একলা পেলে সুবিধে হয়।

—বেশ তো, তাই হবে।

পাশের ঘরে ঘণ্টাখানেক ধস্তাধস্তি করে ভূতনাথবাবু যখন বেরিয়ে এলেন, তাঁর মুখ দেখে আশান্বিত হওয়া গেল না।

—সুবিধা হল দাদা?

উনি মুখ বিকৃত করে বললেন, কিছু না, কিছু না। Very hard nut মশাই। আমার দাঁত ভাঙল, দাঁত ভাঙাটার কোনো হদিস পাওয়া গেল না।

দাঁতভাঙা লোকটা জেলে এসে গেল তার পরদিন। মুন্সীকে এক সময় ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, এ কি সেই?

মুন্সী খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হুজুরের কাছে লুকোবো না। কিন্তু আর কাউকে তো একথা বলতে পারি না।

মাসখানেকের মধ্যেই মামলা শুরু হয়ে গেল। পুলিশের তৎপরতার ত্রুটি ছিল না। বদরুদ্দিন মুন্সীর সহ-আসামী বলে একদল লোককে গ্রেপ্তার করে চালান দেওয়া হল। তাদের দেখে ওর হাসি আর ধরে না—এরা ছিল নাকি আমার সঙ্গে? কি জানি? ছিল হয়তো আগের জন্মে। এ জন্মে তো কোনোটাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে মুন্সী কোনো উকিল দেয়নি। খুনী আসামী বলে সরকারী ব্যয়ে উকিল নিযুক্ত হল। স্থানীয় বারের একজন উদীয়মান ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার। তিনি এসে পরামর্শ দিলেন কনফেশনটা retract কর। বল, পুলিশের ভয়ে কি বলেছি, মনে নেই। মারের চোটে মাথা ঠিক ছিল না। এ মামলার কিছুই জানি না আমি। ব্যস। বাকীটা রইল আমার হাতে। নির্ঘাত খালাস করে দেবো।

মুন্সী হেসে বলল, ভয় নেই, বাবু। কনফেশন করলেও মামলাটা যাতে অনেকদিন চলে, সে ব্যবস্থাও আমি করে রেখেছি। ফী আপনার মারা যাবে না।

মামলার প্রথম দিন পাঁচটার সময় কোর্ট যখন উঠতে যাবেন, মুন্সী জোড়হাত করে বলল, ধর্মাবতার, আপনার এজলাসে আমাকে যে বসবার অনুমতি দিয়েছেন, তার জন্যে খোদা আপনার মঙ্গল করুন। আর একটা বেয়াদপি মাপ করবেন। বসে বসে আর ঐ একঘেয়ে বক্তৃতা শুনতে শুনতে বড্ড ঘুম পেয়ে যায়। যদি ঘুমিয়ে পড়ি, কসুর নেবেন না।

হাকিম প্রবীণ ব্যক্তি। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেন তার প্রধান আসামীর দিকে। যে-মামলাকে বলা যেতে পারে তার ফাঁসি-মঞ্চের প্রবেশ দ্বার, তার কথা শুনতে গিয়ে ঘুম পেয়ে যায়, এরকম ঘুম বোধ হয় তাঁর দীর্ঘ জীবনে আর কখনো দেখেননি।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন বেলা এগারোটার সময় ভূতনাথবাবুর আবির্ভাব।

—সর্বনাশ হয়ে গেল, মশাই।

—কী হল?

—মুন্সীকে একবার কোর্টে পাঠাতে হবে।

—কোর্টে যায়নি সে?

—না। এই দেখুন না?

মুন্সীর ওয়ারেন্টখানা দেখালেন। জেল-ডাক্তার লিখে দিয়েছেন তার উপর—unfit to attend Court.

বললাম, অসুস্থ হয়ে পড়লে আর কোর্টে যায় কেমন করে, বলুন?

—অসুস্থ মোটেই নয়। আপনি নিজে একবার খবর নিয়ে দেখুন। নিশ্চয়ই এটা কালকের ঘটনার জের।

ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন ভূতনাথবাবু :

মোকদ্দমার উদ্বোধনী বক্তৃতার পর দু’দিন হল সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে! মুন্সী তো প্রথম থেকেই মামলা সম্বন্ধে উদাসীন। যতক্ষণ আদালতের কাজ চলে, কাঠগড়ায় রেলিং- এ হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। কাল যে সব সাক্ষীর জবানবন্দী নেওয়া হল, তাদের মধ্যে একজন ছিল সীতানাথ দত্তের মেয়ে। তাকে যখন নিয়ে আসা হল তখনো ওর যথারীতি নাক ডাকছিল। দু-চারটা প্রশ্ন করবার পর কখন হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ডকের দিকে তাকিয়েই লাফিয়ে উঠল মুন্সী। জবানবন্দীর মাঝখানেই কোর্টের দিকে চেয়ে জোড় হাত করে বলল, গোস্তাকি মাফ করবেন, ধর্মাবতার। আমার একরারনামাটা একবার পড়ে দেখুন। আমি তো কবুল করেছি। সরকার পক্ষের যা কিছু চার্জ, এক কথায় মেনে নিয়েছি সব। তবে আর একে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া কেন? রেহাই দিন ওকে। আমি আবার বলছি, ঐ মেয়েটার চরম সর্বনাশের জন্যে দায়ী আমি। ওর স্বামীকে খুন করেছি আমি, ওদের সর্বস্ব লুট করেছি আমি। আর বলাৎকার? হ্যাঁ, আমি—আমি উঃ—বলে হঠাৎ বুক চেপে ধরে বসে পড়ল। ওদিকে মেয়েটাও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সাক্ষীর কাঠগড়ায়।

আদালত বন্ধ হয়ে গেল। মুন্সীকে তারপর ধরাধরি করে কয়েদীর গাড়িতে করে পাঠানো হল জেলখানায়। মেয়েটাকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। তার জ্ঞান ফিরে আসতে লেগে গেল দু’ ঘণ্টা।

ভূতনাথবাবু বললেন, মেয়েটার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। তবু ডাক্তারের মত করিয়ে কোনো রকমে স্ট্রেচারে করে কোর্টে নিয়ে এসেছি। যেমন করে হোক, তার এভিডেন্সটা আজকার মধ্যে শেষ করতে হবে। এদিকে আসল আসামীই গরহাজির। ওর absence-এ তো trial চলতে পারে না। যেমন করে হোক ওটাকে নিয়ে যেতেই হবে। সবাই অপেক্ষা করছে। কোর্ট বসে আছেন। ট্যাক্‌সি আমার সঙ্গেই আছে। বলেন তো অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থাও করতে পারি।

ডাক্তারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, মুন্সীর আবার কি হল?

ডাক্তার চিন্তান্বিত মুখে মাথা নেড়ে বললেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কাল কোর্ট থেকে ফিরে অবধি খাচ্ছে না, কথা বলছে না। সটান চোখ বুজে পড়ে আছে।

ভূতনাথ গর্জে উঠলেন, বদমাইশি, স্রেফ বদমাইশি, বুঝতে পাচ্ছেন না? মামলাটাকে মাটি করতে চায় শালা। ও জানে, মেয়েটা আজ ফিরে গেলে আর তাকে পাওয়া যাবে না। আমি বললাম, ওর কনফেশনের পরেও কি মেয়েটির evidence একান্তই দরকার?

দরকার বৈকি! কনফেশনের support-এ যদি অন্য evidence না থাকে, ওর মূল্য কতটুকু? এখানে যদি বা সাজা হয়, হাইকোর্টে গিয়ে টিকবে না।

ডাক্তারকে বললাম, কোনো রকমে পাঠানো যাবে না?

—পাল্‌সের যা অবস্থা, ভরসা করি না, স্যর।

ভূতনাথবাবুকে নিরাশ হয়েই ফিরতে হল।

সেইদিন সন্ধ্যাবেলা। জেলের ভিতরকার জনবহুল রাস্তাগুলো শূন্য প্রায়। কয়েদীরা সব চলে গেছে যে-যার ওয়ার্ডে। রন্ধনশালার অহোরাত্র “মচ্ছব” আগলে থাকে যারা, তারাও তাদের কালিঝুলি-মাখা জাঙ্গিয়া কুর্তা ছেড়ে হাতা-খুন্তি আর ডাল-মন্থনের ডাণ্ডা সামলে ক্ষিপ্রহস্তে তৈরি হচ্ছে। জমাদারের দল “গিতি” মেলাতে ব্যস্ত। ডেপুটি-বাবুরা নিজ নিজ এলাকায় টহল দিচ্ছেন। লক্‌আপ্ পর্বের সুশৃঙ্খল সমাপ্তির জন্যে সকলের মনেই উৎকণ্ঠা। আমিও চলেছি সদলবলে। প্রাচীর পরিক্রমা শেষ করে পুকুরধারে এসে পৌঁছেছি, এমন সময় এক ভগ্নদূত এসে “রিপোর্ট” দিল, টোটাল নেহি মিলতা হ্যায়। অজ্ঞাতসারেই কপালটা ঘেমে উঠল। জেলের চাপরাস যার স্কন্ধে, তার কাছে এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর নেই। রুক্ষ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম হতভাগ্য দুর্মুখের দিকে। সে অকুণ্ঠ বিনয়ের সঙ্গে জানাল, একঠো কমতি হুয়া।

লক্-আপ্ ইয়ার্ডে এসে দেখলাম, কারো মুখে সাড়া নেই। সমস্ত ওয়ার্ডগুলো দুবার করে গোনা হয়ে গেছে। ফল এক; অর্থাৎ ‘একঠো কমতি হুয়া’। হিসাবমত হবে ১৩৪৩, হচ্ছে ১৩৪২। সকলেই নিঃশব্দে অপেক্ষমাণ—এবার কি হুকুম হবে। হুকুম হল—Count again. ব্যারাকে ব্যারাকে আবার সাড়া পড়ে গেল। দু’লাইন করে বসল কয়েদীরা। এবার শুধু জমাদার নয়, ডেপুটিবাবুরাও যোগ দিলেন গণনায়। দু, চার, ছয়, আট।…একে একে সবাই আবার ফিরে এল লক্-আপ্ ইয়ার্ডে। মুখ অন্ধকার।

এবার বাকী রইল শুধু একটিমাত্র পথ—চরম এবং শেষ পন্থা, পাগলা ঘণ্টি। একটা টানা হুইসিল। তারপরেই শুরু হবে সর্বব্যাপী তাণ্ডব। লাঠি আর বন্দুক কাঁধে অহেতুক উল্লম্ফন, গোটা পঞ্চাশেক মশাল জ্বেলে সম্ভব এবং অসম্ভব স্থানে নিষ্ফল অনুসন্ধান, প্রাচীর বেষ্টন করে পুলিশবাহিনীর ব্যর্থ আস্ফালন। অতঃপর দীর্ঘ লঙ্কাকাণ্ডের সমাপ্তি। শুষ্ক মুখে নতশিরে ভগ্ন-দূতের পুনঃপ্রবেশ।

—কি বাৰ্তা?

—একঠো কমতি হ্যায়।

বড় জমাদারের দিকে ফিরে বললাম, সবই তো হল। আর কি? এবার শিঙ্গে ফুঁকে দাও-

—মিল গিয়া মিল গিয়া—ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল এক ওয়ার্ডার।

—কোথায়, কাঁহা মিল গিয়া? একসঙ্গে আঠারোটা প্রশ্ন।

–ঐ গাছপর—

গাছপর! সদলবলে এবং সবিক্রমে ছুটলাম সেই দিকে।

হাসপাতালের পিছনে কম্পাউণ্ড পাঁচিলের ধার ঘেঁষে একটা অনেককালের অশ্বত্থ গাছ। তারই ডালপালার ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে আছে দু’খানা পা। এগিয়ে গিয়ে সমস্ত দেহটাই দেখা গেল। ধুতি পাকিয়ে তৈরি হয়েছে লম্বা দড়ি। তার একটা দিক ডালে বাঁধা, বাকি দিকটায় ফাঁস দিয়ে গলায় জড়ানো।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই ঝুলন্ত দেহটাকে নামিয়ে আনা হল। ডাক্তার এসে নাড়ি ধরে মুখ বিকৃত করলেন। জিভ বেরিয়ে এসেছে। চোখ দুটো ঠিকরে পড়ছে। বীভৎস্য দৃশ্য। তবু প্রথম দৃষ্টিতেই চিনতে পারলাম। জমাদারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ঘণ্টি।…

সেন্ট্রাল টাওয়ারের উপর থেকে ‘তিন ঘণ্টি’ জানিয়ে দিল, সব ঠিক হ্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *