দশ
সংসার চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে চিরন্তন অসহযোগ। যা চাই তা পাই না; আর যা চাই না বলে তারস্বরে চীৎকার করি, পাওয়ার মধ্যে তারই বোঝা স্তূপাকার হয়ে ওঠে। এ অতি মামুলী কথা, যার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি থেকে রক্ষা পেয়েছে, এমন নরনারীর সাক্ষাৎ মিলবে না কোন দেশে এবং কোন যুগে। এই পুরাতন তত্ত্বের অধুনাতন দৃষ্টান্ত আমরা দুজন— বিখ্যাত জেলর, মৌলবী মোবারক আলি, আর তাঁর অখ্যাত ডেপুটি, বাবু মলয় চৌধুরী।
খানিকটা আগেই বলেছি, স্বদেশীদের কাছে নিজের পরিচয়টা একটু বিশদভাবে দেবার জন্যে মোবারক আলি অনেকদিন থেকে ছটফট করছিলেন। সে বিষয়ে এখানকার ক্ষেত্র অতি সঙ্কীর্ণ। কারণ, প্রথমত সংখ্যায় এঁরা নগণ্য। দ্বিতীয়ত, গোড়াতেই তাঁর ব্যাকরণ- নিষ্ঠার অমর্যাদা আলি-সাহেবের অভিমানকে এতখানি আঘাত দিয়েছে যে, ওঁদের সংস্রব থেকে নিজেকে তিনি একেবারে সরিয়ে নিয়েছিলেন।
এদিকে সমতল ভূমি থেকে নানা সূত্রে নানা রুচিকর খবর প্রতিদিন তাঁর কাছে ভেসে আসছিল। একদিন শুনলাম, কোন্ একটা বড় জেলে এক হাজার ‘স্বদেশীওয়ালা’ তাঁদের সদ্য-লব্ধ দু-হাজার নতুন কম্বল একত্র জড়ো করে খাণ্ডবদাহনের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার একজোড়া করে নতুন কম্বল দাবি করে মাঠের মধ্যে সত্যাগ্রহ করে পড়ে আছেন। স্যাটানিক গভর্নমেন্টের কম্বলগুলোও যে শয়তান, এ-তত্ত্ব অস্বীকার করি না এবং শয়তানকে যে আগুনে পুড়িয়ে মারতে হয়, এ-যুক্তিও অকাট্য। অতএব বহ্ন্যুৎসবের অর্থ বুঝি। কিন্তু আর একজোড়া ‘শয়তান’ দাবি করে আবার সত্যাগ্রহ কেন?
—কেন আবার? গর্জে উঠলেন মোবারক আলি, পিঠ চুলকোচ্ছে, বুঝতে পারছেন না? ওষুধ চাই।
আবার একদিন শোনা গেল, আর একটা কোন স্পেশাল, না সেন্ট্রাল জেলে ভাত- ডালের হোলি চলছে। অন্য উদরে প্রবেশ না করে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে কারাকর্মীদের মাথায় এবং শূন্য থালার সামনে বসে সারিবন্দী রাজবন্দীরা গর্জন করছেন, ম্যায় ভুখা হুঁ!
এর ক’দিন পরেই কোত্থেকে এল এক উড়ো খবর—সেখানে নাকি ‘স্বদেশীবাবুরা সন্ধ্যাবেলায় ব্যারাকে না ঢুকে, চড়েন গাছে এবং গভীর রাত পর্যন্ত আবৃত্তি করেন শিবরামের মহাসঙ্গীত।’ মোবারক বললেন, ‘গুলি খেয়ে গাছের ওপর থেকে পাখি পড়তে দেখেছি। মানুষ কি করে পড়ে, দেখতে ইচ্ছা করে।’ অর্থাৎ ওখানে উপস্থিত থাকলে দৃশ্যটা তিনি স্বহস্তে উপভোগ করতেন।
এই জাতীয় খবর আমাদের স্বায়ুতন্ত্রীর উপর যে আঘাত করত, তার প্রতিক্রিয়া উভয়ের বেলায় ছিল বিপরীত। আমি প্রার্থনা করতাম, এই সব ‘স্বদেশী’-পীঠস্থান থেকে আমাকে রক্ষা করো ভগবান। মোবারকের প্রার্থনা ছিল—হে খোদাতাল্লা, বেশি নয়, শত পাঁচেক বেয়াড়া স্বদেশী আমার হাতে এনে দাও। একবার পরখ করে দেখি, তারা কী রকম চীজ!
নিছক নৈর্ব্যক্তিক প্রার্থনায় নির্ভর না করে তিনি শেষ পর্যন্ত কালি-কলমের আশ্রয় নিলেন। লিখিত আবেদনে জানালেন উপরওয়ালার দরবারে, এই সঙ্কটকালে তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি ইংরেজ সরকারের সাম্রাজ্য রক্ষায় নিয়োগ করতে উৎসুক। অতএব তাঁকে কোন বৃহৎ রাজনৈতিক জেলে স্থানান্তরিত করা হোক।
কিন্তু কর্তৃপক্ষের রসজ্ঞান আছে। তাঁর সরব এবং আমার নীরব—কোন প্ৰাৰ্থনাই পূর্ণ হল না। মোবারক রয়ে গেলেন পাহাড়ের দেশে চোর ডাকাত আগলে; আমার ডাক পড়ল এক নির্জলা ‘স্বদেশী’ ছাউনিতে সত্যাগ্রহী দমনের মহান ব্রত স্কন্ধে নেবার জন্যে।
.
দুর্গম জঙ্গলে ঘেরা ডজন খানেক ভাঙা বাড়ি। এককালে ছিল গোলাবারুদের কারখানা। প্রহরে প্রহরে বেয়নেট দেখাত টহলদার প্রহরী, অজ্ঞ পথচারীর প্লীহা কাঁপিয়ে হুঙ্কার দিত—হুকুমদার! কালক্রমে প্রহরী বদল হল। বেলুচ্ রেজিমেন্ট যেখানে ছিল সেখানে দেখা দিল ফেরুপাল। তারাও প্রহর ঘোষণা করে। ‘হুকুমদার’ বলে না, বলে হুক্কা হুয়া।
এক যুগ পরে আজ আবার এল পট-পরিবর্তনের পালা। কোদাল, কুড়ুল, আর শাবলের ঘায়ে ভিটেছাড়া হয়ে গেল শিবরামের দল। নতুন দৃশ্যে যারা অবতীর্ণ, সরকারের চোখে তারাও একজাতীয় জীবন্ত গোলাবারুদ। তাই নতুন করে আবার শুরু হয়েছে সশস্ত্র প্রহরীর টহল-গর্জন; হুঁশিয়ারির সরঞ্জাম এবার ব্যাপকতর।
এই কারখানা থেকে একদিন যে বুলেট বেরিয়েছিল, তাদের খ্যাতি ছিল আন্তর্জাতিক রক্ত-পিছল পথে তারাই করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উদ্বোধন। আজ যেসব বুলেট জড়ো হল এই ভাঙা ঘরের বুকে তাদের পথ রক্তহীন। কে জানে হয়তো এদের হাতে এই পথ বেয়েই আসবে একদিন এই সাম্রাজ্যের উপসংহার।
জঙ্গলের পাশে মাঠ। সেখানে তৈরি হল সারি সারি চালাঘর। শালের খুঁটি খড়ের ছাউনি আর চাটাইয়ের বেড়া। পাঁচিল ছাড়া জেল হয় কেমন করে? কারাগার বলতে প্রথমেই বুঝি কারাপ্রচীর। সে থিওরী বাতিল হয়ে গেল। একটা সূক্ষ্ম কাঁটাতারের বেষ্টনী কোনরকমে আব্রু রক্ষা করে বাঁচিয়ে দিল জেলের মান, মসলিনের ওড়না যেমন করে লজ্জা নিবারণ করে রাজপুত রমণীর। কাস্তেধারী পথচারী কৃষকের দল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আর হাসে। যারা তরুণ, ঠাট্টা করে বলে, এ জেল, না বাবুদের বাগান-বাড়ি? একটু প্রাচীন যারা, সম্ভ্রমের সঙ্গে উত্তর দেয়, এখানে কারা থাকবে জানিস? স্বদেশীবাবুরা। গান্ধী-রাজার লোক। এ তো চোর-ডাকাত নয়, যে পালাবে?
সেটা আমরাও বুঝি। তবু চিন্তিত হলেন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ জেলর মহেশ তালুকদার কিন্তু শ্বেতাঙ্গ ইনস্পেক্টর জেনারেল তাঁর আশঙ্কাকে আমল দিলেন না। বললেন দু-চার- দশটা যদি পালায়, টেক নো নোটিশ। তার বেশি হলে একটা রিপোর্ট পাঠিয়ে দিও আমার অফিসে। তবে rest assured jailor. সে রিপোর্ট তোমাকে দিতে হবে না। এরা পালাবার জন্যে আসেনি।
তার ঘেরা শেষ হতেই শুরু হল বন্যাপ্রবাহ। বড় বড় মোটরযান ভর্তি—আসছে তো আসছেই। যুবক, বৃদ্ধ, প্রৌঢ় ও কিশোর। উচ্ছল হাসি আর প্রদীপ্ত উৎসাহ। আকাশে- বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে বন্দে মাতরম্, মহাত্মা গান্ধীজীকি জয়।
—আজ কত এল?
—তিনশ পঁচিশ।
—মোটে? আমাদের এসেছে চারশ সাতান্ন।
পাশাপাশি দু’জেলের কর্মীদের দিনান্তে দেখা হলে আলাপের বিষয় ঐ একটি। পাকা বাড়িতে থাকেন নেতা এবং উপ-নেতার দল, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী। আর তৃতীয় শ্রেণীর জন্যে খড়ের চালা। তাদের আর শেষ নেই। পাঁচশ, ছশ, আটশ, হাজার, বারোশ। আর যে জায়গা নেই। কে শোনে সেই কথা? বন্যার জল ফেঁপে ফুলে উঠছে প্রতিদিন। ‘এ- যৌবন-জলতরঙ্গ রুধিবে কে?”
কাঁটাতারের গেট। তার সামনেই টালির ঘরে অফিস বসেছে। কাজ চলেছে সকাল থেকে রাত বারোটা। লড়াইফেরতা সুপার, ক্যাপ্টেন ব্যানার্জি। প্রবীণ এবং সুদক্ষ জেলর মহেশ তালুকদার। চারজন তাঁর ডেপুটি। তারপর আছে কেরানীকুল এবং সিপাই-সান্ত্রীর বিশাল বাহিনী। টেবিলে টেবিলে ওয়ারেন্টের হিমালয়, আর ফাইলের পিরামিড। নানা আকারের আর নানা প্রকারের খাতার উপর কলম চলছে অবিরাম। তার সঙ্গে চলছে হাসি, পরিহাস, চা-সিগারেট আর মাঝে মাঝে অফিস-পলিটিক্সের রুচিকর ফোড়ন
—ও বাবা! এ যে সবারই দেখছি rigorous imprisonment, সশ্রম কারাদণ্ড। কি শ্রমটা করছেন এঁরা—অনেকটা আপন মনেই বললে সুধাংশু। আমদানী বইয়ে ওয়ারেন্ট নকল করা তার কাজ।
ডেপুটি জেলর হৃদয়বাবু চা খাচ্ছিলেন। বললেন, কেন, শ্রমটা কম হচ্ছে কোথায়? তোমাদের ঘানিটানা পাথরভাঙা এসব করছে না বটে; কিন্তু ওদের লাইনে ওরা খাটছে সারাদিন।
—যথা?
—যথা, ভোরে উঠেই—মিলিটারি কায়দায় বললেন হৃদয়বাবু—
বাঁয়া ডাহ্ইনা,
বাঁয়া ডাহ্ইনা,
ঘুম্ যাও।
বাঁয় ডাহ্ইনা,
বাঁয়া ডাহ্ইনা,
ঠ্যর্ যাও।
সকলেরই হাতের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। যতীশদা বললেন এধার থেকে, ক্ষেপে গেলেন নাকি হৃদয়বাবু? ওসব কি বলছেন?
হৃদয়বাবু গম্ভীরভাবে বললেন, বুঝতে পারছেন না? প্যারেড; স্বদেশী প্যারেড! আপনারা যাকে বলেন—
Left Right, Left Right
About turn!
Left Right, Left Right
Halt!
হাসির রোল উঠল ঘর জুড়ে। যতীশদা কলকাতা থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জার। ভোরবেলার খবর রাখেন না। সন্দেহের সুরে বললেন, এসব সত্যিই করে নাকি ওরা, না বানিয়ে বলছেন আপনি?
হৃদয়বাবু চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, আপনি ভাগ্যবান লোক, দাদা। রোজ বৌদির হাতে লেহ্য পেয় খেয়ে দশটা-পাঁচটা করছেন। একদিন মশার কামড় খান না আমাদের সঙ্গে এই জঙ্গলে? নিজেই দেখতে পাবেন, বানিয়ে বলছি কিনা। যতীশদা একটা কি বলতে যাচ্ছিলেন, সুধাংশু বাধা দিয়ে বললে, সে থাকগে। আপনি বলুন। এর পরের পর্বটা কি?
হৃদয়বাবু সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, এর পরেই শুরু হল ক্লাস। নিম্ন প্রাইমারি থেকে এম. এ. পর্যন্ত যত রকমের ক্লাস আছে, সব। কতক ঘরে, কতক মাঠে, কতক বা গাছতলায়। এত বড় রেসিডেন্সিয়াল ইউনিভার্সিটি পৃথিবীতে আর কোথাও পাবে না।
—কটা অবধি ক্লাস চলে?
—ঘড়ি ধরে এগারোটা। তারপর স্নান এবং আহার পর্ব। ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম। দুটো থেকে শুরু হবে বক্তৃতা, আলোচনা, ডিবেট, আর তার মধ্যে (গলা খাটো করে বললেন হৃদয়বাবু) কোন কোন ঘরে সিক্রেট মিটিং কিংবা ক্লোজ-ডোর মন্ত্রণাসভা। এই জেলে বসেই ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম তৈরি হচ্ছে, জেনে রেখো।
-তারপর?
—তারপর বিকেলবেলায় খেলাধূলা। দাঁতকপাটি, হাডু-ডু-ডু, দাড়ি-বাঁধা, চোর-চোর। সন্ধ্যার পরে আমোদ-প্রমোদ। ক্যারিকেচার, ম্যাজিক, সাঁওতাল নাচ আরো কত কি! কোনো ঘরে আবার গানের মজলিশও বসে। তার সঙ্গে জলের ড্রাম বা বালতির সংগত।
নিতাই বক্সী নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ আছে কিন্তু লোকগুলো। জেল খেটে দেশোদ্ধার হল, এদিকে ফুর্তির সীমা নেই। আর আমাদের অবস্থা দ্যাখ। কোন্ সকালে এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়েছি। বারোটা বেজে গেল। কখন যে ফিরবো, কে জানে? আর ফিরেও তো সেই লোহাকাটাদের হোটেলের শুকনো ভাত! থালায় ঢাললে ঝন্ঝন্ করে ওঠে, যেন পাথরের টুকরো।
ছোকরামত কে একজন বলল, তার চেয়ে চলুন না, দাদা, গান্ধীজী কি জয় বলে বেরিয়ে পড়া যাক্। লোহাকাটাদের লোহার টুকরোর বদলে দিব্যি দু’বেলা গরম গরম–
—চলিয়ে হুজুর—জমাদার তমেশ্বরনাথ মিশির সেলাম দিয়ে আমন্ত্রণ জানাল। ব্যাপার নতুন কিছু নয়। প্রায় দৈনন্দিন ঘটনা। রন্ধন-যজ্ঞ সবেমাত্র সমাপ্ত হয়েছে। এবার ভোজন-যজ্ঞের উপক্রমণিকা, অর্থাৎ পরিবেশন,—জেলের ভাষায় যাকে বলে ফিডিং প্যারেড়।
নিতাই বকসীর টিফিন ক্যারিয়ারে হোটেলের শুষ্ক অন্ন শুষ্কতর হতে লাগল। টুপিটা তুলে নিয়ে ছুটতে হল অপরের সদ্য-পক্ব অন্ন-বিতরণ-উৎসবে খবরদারি করবার জন্যে। তিনি একা নন। আমরাও সঙ্গ নিলাম, সমব্যথার ব্যথী। ডেপুটি জেলর বাহিনীর এটা হচ্ছে দৈনন্দিন অভিযান। ফল যা হবে সেটাও আমাদের মুখস্থ। বণ্টন ব্যাপারে যথাসম্ভব হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও অন্তত পঞ্চাশজনের ভাত কম পড়বে, যদিও চাল যেটা দেওয়া হয়েছে বরাদ্দমত তার হিসাব নির্ভুল এবং রান্নার ব্যবস্থা ও তত্ত্বাবধানে কোনো ত্রুটি নেই। তারপর হবে একটা নিষ্ফল এনকোয়ারি অর্থাৎ স্বদেশী ক্যাম্পের পাণ্ডাদের সঙ্গে খানিকটা নিরর্থক বাগবিতণ্ডা।
জমাদার বলবে, হামি খোদ দেখেছি, এই পাঁচঠো বাবু দোবার করে ভাত লিয়েছে। স্বদেশীরা গর্জে উঠবেন, মিথ্যা কথা। আমরা ঘোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত ওঁদের কোনো মতে ঠাণ্ডা করে আমাদের রিপোর্ট দিতে হবে—রন্ধনশালার সাধারণ কয়েদীদের অনবধানতাবশত তেইশ সের দশ ছটাক চালের ভাত পুড়ে গিয়ে মনুষ্য-খাদ্যের অযোগ্য হয়ে গেছে। অতএব ঐ পরিমাণ চাউল অতিরিক্ত ইসু করা হউক! অতঃপর বড়সাহেবের হুকুম হবে, তথাস্তু এবং নতুন করে কয়লা পড়বে বয়লারে।
এই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে প্রতিদিন। স্বদেশী নেতারা বলছেন, আমাদের হাতে কিচেন ছেড়ে দিন। সেখানকার সাধারণ কয়েদীদের চালাব আমরা। রসদ হিসাব করে বুঝে নেবো। বাকি দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু কর্তৃপক্ষ রাজী নন। সরকারের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না করে এ ব্যবস্থা চলে কেমন করে? কিচেন আমাদেরই চালাতে হবে। জেল-ম্যানেজমেন্ট সরকারের দায়িত্ব। তোমরা কয়েদী। কয়েদীর হাতে কর্তৃত্ব ছেড়ে দেওয়া যায় না।
মাসখানেক পরে একদিন সকালবেলা রসদ-গুদামের ধার দিয়ে যাচ্ছিলাম। বারান্দায় বসে স্টোর ক্লার্ক সুরেশবাবু হিসাব কষছেন। টেবিলের ওপাশে আরেকখানা চেয়ারে বসে আছেন ও-তরফের একজন ছোট নেতা, বিমল মজুমদার। তাঁর হাতে খাতা পেন্সিল। সুরেশবাবুর হাঁক শোনা গেল—হলুদ ৩৭ সের বারো ছটাক হচ্ছে, বিমলবাবু। আপনার কত হল?
—আজ্ঞে, আমার হচ্ছে তেরো ছটাক।
—বেশ। ঐ এক ছটাক আপনাকে বক্শিশ দেওয়া গেল।
দুজনেই হেসে উঠলেন। যে-সব সাধারণ কয়েদীরা মাল ওজন করছিল, তাদের মুখেও দেখলাম খুশির ঝলক। সমস্ত রসদ কষে, মাল ওজন করে বিমলবাবু কিচেনে নিয়ে গেলেন, কয়েদীর মাথায় চড়িয়ে। শুনলাম, উনিই নাকি এ মাসের মত মেস কমিটির সেক্রেটারি। রন্ধনশালার তদারক করছেন আর একজন। তিনি কিচেন কমিটি। রান্নার চেহারাও দেখলাম বদলে গেছে। জেলের আইনে প্রত্যেক কয়েদীর প্রাপ্য হচ্ছে চার ছটাক সব্জি। এক গাড়ি তরকারী আসে রোজ। আলু, বেগুন, কুমড়ো, পালংশাক, মুলো, বাঁধাকপি আরও কত কি। এই হরেক রকমের জিনিস একসঙ্গে মিলিয়ে একটা উপাদেয় রসায়ন তৈরি হত এতকাল। আজ সেই একই উপকরণযোগে তরকারী হচ্ছে দুটো—আলু আর বাঁধাকপির ডালনা, বাকি সব দিয়ে একটা চচ্চড়ি মত। ডাল আর জলের অসহযোগ আমরা কোনোদিন ঘোচাতে পারিনি। এবারে দেখলাম, তারা বেমালুম মিলে গেছে এবং তার মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে মাছের মাথার ভগ্নাংশ। একমাত্র ভাজা ছাড়া মৎস্যখণ্ডের যে আর কোনো সদ্গতি করা যেতে পারে, রন্ধন কর্তৃপক্ষের সেটা ছিল কল্পনার বাইরে। সেই মৎস্যকেই দেখলাম, কালিয়া-রূপে শোভা পাচ্ছে কয়েদীর থালায়।
‘কিচেন কমিটি’ হেসে বললেন, কি দেখছেন ডেপুটিবাবু; বিধাতা আমাদের রসনা দিয়েছেন দুটো কাজের জন্য—বক্তৃতা আর সুখাদ্যের রসগ্রহণ। প্রথমটা যখন আপনারা গায়ের জোরে বন্ধ করলেন, সে লোকসান তো দ্বিতীয়টা দিয়েই পুষিয়ে নিতে হবে।
আমি বললুম, শুধু পুষিয়ে নেওয়া? বলুন, সুদসুদ্ধ আদায় করে নেওয়া।
‘মেস কমিটি’ হেসে উঠলেন।
ফিরবার পথে ভাবতে ভাবতে এলাম, কার হুকুমে হল এসব? কেউ জানলো না, তবু হয়ে গেল রাতারাতি কর্তৃত্ব হস্তান্তর। আনুষ্ঠানিকভাবে নয়, কতকটা যেন স্বভাবের নিয়মে, আপনি আপনি। কর্তৃপক্ষ দেখেও চোখ বুজে রইলেন, মনে মনে বোধ হয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সব চেয়ে খুশী হলাম আমরা, অর্থাৎ নিতাই বকসীর দল। পঁচা আদমিকা ভাত ঘট্ গিয়া—এই ভয়াবহ রিপোর্ট নিয়ে আর আসে না তমেশ্বর মিশির। এনকোয়ারির দায় থেকে মুক্তি পেয়েছি।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও যায় যায়। জোয়ারের বেগ শেষ হল। দেখা দিয়েছে ভাটার টান। যারা মাঝ-দরিয়ায় তরী ভাসিয়েছিল, ঝড়ঝঞ্ঝার ভ্রুকুটিকে গ্রাহ্য করেনি, তাদের মন আজ ঘরমুখী, তীরের আশ্রয়ের জন্য ব্যাকুল। দেশমাতৃকার দীপ্ত মূর্তি অনেকের চোখেই ঝাপসা হয়ে এসেছে, উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আপন আপন গৃহের রূপ। দেহ ক্লান্ত, মন অবসন্ন, মেজাজ রুক্ষ। প্যারেড, ডিবেট আর ক্যারিকেচার আপনা হতেই বন্ধ হয়ে গেছে। তার জায়গায় এসেছে অসহিষ্ণু বাগযুদ্ধ আর অহেতুক দলাদলি। বাইরের খবর কী? জেলের এই কদন্ন আর কম্বলশয্যা আর কতকাল কপালে আছে? মহাত্মাজী কী বলছেন? কম্প্রোমাইজের কতদূর হল? এই সব প্রশ্ন ঘুরেফিরে গুঞ্জন করছে সবারই মনে মনে।
আফিস চলছে মন্দাক্রান্তা ছন্দে। যেখানে রাত বারোটায় নিঃশ্বাস পড়ত না, সেখানে বেলা বারোটায় নাক ডাকে। আগমনীর পালা অনেক দিন শেষ হয়েছে; এখন চলেছে বিসর্জনের পর্ব। রোজই একদল বেরিয়ে যাচ্ছে জেলের মেয়াদ শেষ করে। বন্ধুরা গেট পর্যন্ত এসে বিদায় দিয়ে যায়। মুরুব্বিরা ভিড় করেন আফিস পর্যন্ত। তারপর পাথেয় নিয়ে চলতে থাকে দর-কষাকষি। খোরাকী দু-দিন হবে, না তিন দিন : নৌকাভাড়া তিন টাকা হবে, না সাড়ে তিন। জেলর মহেশ তালুকদার খাঁটি ব্যুরোক্র্যাট—ইস্পাতের ফ্রেমের উপর কাদার গাঁথুনি। বিনয়ে-সৌজন্যে গদগদ। সাড়ে তিন ঘণ্টা অসীম ধৈর্য নিয়ে বক্তৃতা শুনে যাবেন, কিন্তু টাকার অঙ্ক তিন থেকে সাড়ে তিন হবে না।
ওদিকে স্বদেশী পাণ্ডারাও ইস্পাতের জাত। মাঝে মাঝে যখন সঙ্ঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন ডাক পড়ে আমার। জেলর সাহেবের অনুগ্রহে আমি হচ্ছি তাঁর ভৌগোলিক উপদেষ্টা।
—এই যে মলয়, তুমি তো অনেক কাল কাটিয়েছ ওদেশে। বল তো কুমিল্লা থেকে বদরখালি নৌকাভাড়া কত?
কুমিল্লার সঙ্গে আমার পরিচয় ভূগোলের পাতায়; আর বদরখালির নাম এই প্রথম শুনলাম। তবু বিশেষজ্ঞের গাম্ভীর্য নিয়ে বলতে হয়, বদরখালির কোন্ পাড়ায় বাড়ি আপনার?
খালাসোদ্যত আসামীটি বললেন, দক্ষিণপাড়ায়।
-নৌকো তো ওদিকে সস্তা। কত চাইছেন আপনি?
ভদ্রলোক উত্তর দেবার আগেই, তালুকদার-সাহেব বললেন, উনি তো চার টাকা হেঁকে বসে আছেন। আমার মনে হয়, আড়াই টাকার বেশী লাগবে না।
আমি রায় দিলাম, টাকা তিনেকের মত পড়বে।
যেন সকল সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, এমনিভাবে বললেন মহেশবাবু, ব্যাস; মিটে গেল। মলয়ের যে সব জানা কিনা?
পাণ্ডারা মনে মনে উত্তপ্ত হলেও বাইরে কিছুই বললেন না। খালাসীটি ছেলেমানুষ। মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না। উষ্মার সঙ্গে বলে উঠল, আচ্ছা, স্বরাজ হলে আমাদের হাতেই ক্ষমতা আসবে। তখন দেখবো, কি করে আপনাদের চাকরি থাকে।
তালুকদার মশায় হেসে উঠলেন, বলেন কি? চাকরি থাকবে না? বরঞ্চ মাইনে বেড়ে, যাবে আমাদের। আজ বিদেশী সরকারের পয়সা বাঁচাচ্ছি; তখন বাঁচাবো আপনাদের। –
কিন্তু আমি জানি, তালুকদার-সাহেব কড়াকড়ি যতই করুন, শেষ পর্যন্ত হার হত তাঁরই—অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, ঠিক যেমন করে হারতেন আমাদের আঠারো নম্বর মেসের ম্যানেজার হরিদাসবাবু।
গল্পটা যখন মনে পড়ল, বলেই ফেলি।
অনেক দিন আগেকার কথা। ইস্কুলে পড়ি। থাকতাম এক মেসে। নতুন ঠাকুর বহাল হল—মহাদেব মিশ্র। অতবড় করিতকর্মা লোক সারাজীবনে দ্বিতীয়টি আর দেখলাম না। কামিনীবাবুর আফিস ঠিক সাড়ে আটটায়। আটটা বাজতে পনের মিনিট হতেই খাবার ঘর থেকে হুঙ্কার এল–ঠাকুর ভাত নিয়ে এসো। মাছ সবে কোটা হচ্ছে তখন। কামিনীবাবুর সঙ্গে তার যোগাযোগ শুধু লোলুপ দৃষ্টি আর দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে তার জন্য বরাদ্দ ছিল দু’পয়সার দই, অর্থাৎ মধুপর্কের এক বাটি। হঠাৎ সেদিন দইয়ের বদলে হাতা হস্তে মহাদেবের প্রবেশ। কামিনীবাবু অবাক। ওটা আবার কি?
—আজ্ঞে রামরস।
—রামরস মানে?
মহাদেব হাতা উপুড় করে দিল কামিনীবাবুর পাতে। দস্তুরমতো মাঝের ঝোল। সঙ্গে একটুকরো মাছ। কামিনীবাবুর চোখে আনন্দাশ্রু : সে কি, এরই মধ্যে হয়ে গেল?
—করে ফেললাম একহাতা।
হাঁড়ি নয় কড়া নয়, হাতায় করে রান্না মাছের ঝোল! কামিনীবাবুর কপাল ফিরে গেল সেই দিন থেকে।
দু-দিন না যেতেই মহাদেব গোটা মেসটাকে জয় করে ফেলল। মহাদেব ছাড়া আর কোন বাবুরই চলে না। আস্তে আস্তে বাজারের ভারও এসে গেল তার হাতে। লেখাপড়া সে জানত না। কাগজ-কলমের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। হিসাব সব মুখে মুখে। রোজ সকালে ম্যানেজার হরিদাসবাবু দু-খানা দশ টাকার নোট তার হাতে ধরে দিতেন। সন্ধ্যাবেলা সে খরচ লিখিয়ে হিসাব মিটিয়ে যেত। হরিদাসবাবু খাতা খুলে বললেন বল, মাছ?
—মাছ—আট টাকা এগারোআনা।
হরিদাসবাবু লিখলেন—সাত টাকা বারোআনা।
-পটল?
মহাদেব বলল, পটল—দু টাকা পনেরোআনা।
হরিদাসবাবু লিখলেন—দু টাকা চারআনা।
এমনি করে মহাদেব যা বলত, প্রতি দফায় বেশ কিছু ডিসকাউণ্ট বাদ দিয়ে ম্যানেজার বসাতেন তাঁর খাতায়। লেখা শেষ হলে মহাদেব জিজ্ঞেস করত, কত হল বাবু? হরিদাসবাবু খাতার অঙ্ক যোগ করে বলতেন,—সতেরো টাকা ছ’আনা দু পয়সা।
—কত ফেরত দিতে হবে?
—দু টাকা ন’আনা দু পয়সা।
মহাদেব বিনা বাক্যব্যয়ে দু টাকা ন’আনা দু পয়সা ফেলে দিয়ে চলে যেত। হরিদাস তাকিয়ে থাকতেন। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগত তাঁর হাঁ বন্ধ হতে। যতই কাটুন, সব যেত জলের উপর দিয়ে। দুধে হাত পড়ত না কোনদিন।
গল্পটা একদিন জেলর সাহেবকে শোনালাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর হেসে বললেন, তোমার ঐ হরিদাসের সঙ্গে আমার আসল জায়গাতেই তফাত।
—যেমন?
—তিনি জিতবার চেষ্টা করে ঠকতেন। আমি জিতবার চেষ্টা করি না।
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। মহেশবাবু আর একটু পরিষ্কার করে বললেন, বুড়ো হয়ে গেলাম। জীবনে নিজের রোজগার থেকে দুটো পয়সা কোনো সৎকাজে কারো হাতে তুলে দিয়েছি বলে তো মনে পড়ে না। দৈবক্রমে গৌরীসেনের এত বড় সিন্দুকটা যখন হাতে পড়েছে, তার থেকে দু-চারটা পয়সা যদি ঐ বাপ-তাড়ানো মা-খেদানো ছেলেগুলোর ভোগে লাগে তো লাগুক না, আমার তো কোন লোকসান নেই।