লৌহকপাট – ১.৯

নয়

দুর্জয়লিঙ্গের দেশে ঋতুরাজের ভূমিকা নিয়েছেন মহাশীত। সারা বছর তাঁরই অখণ্ড প্রতাপ। মাঝখানে কিছুকাল বিপুল সমারোহে আসর জমিয়ে রাখেন বর্ষা। ঋতুচক্রের বাকী শিল্পী যাঁরা, উইংসের পাশ থেকে একবার করে উঁকি দিয়ে চলে যান। এই সার্জ, ফ্লানেল এবং উলের টুপির বর্ম ভেদ করে তাদের ক্ষণিক আবির্ভাব শুধু বুঝতে পারি, যখন দেখি ম্যাল, বার্চহীল এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনের বেঞ্চিগুলো হঠাৎ ভরে উঠেছে রূপের জলুসে, বেশভূষার বৈভবে এবং হাসি-গল্পের ঝঙ্কারে। দোকানে দোকানে সদ্য সজ্জিত পণ্যসম্ভার; হোটেলে হোটেলে সুপ্তোত্থিত প্রাণ-চাঞ্চল্য। দার্জিলিং নাকি বাঙলা দেশের স্বাস্থ্যনিবাস। কিন্তু স্বাস্থ্য সঞ্চয়ের প্রয়োজন যাদের সবচেয়ে বেশি, তাদের দেখা নেই এর ত্রিসীমানার কোনখানে। এখানে ভিড় করে তারাই, স্বাস্থ্যের ভাণ্ডার যাদের ভরে আছে কানায় কানায়।

কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গের মত দার্জিলিংও জেগে ওঠে বছরে দু-বার। ঘরে-বাইরে উৎসবের সাড়া লাগে, পানভোজন, বিলাস-ব্যসন, পার্টি-জলসার ধুম পড়ে যায়। তারপর কুম্ভকর্ণ আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এই ক্ষণিক আনন্দের ঝলক দু-দিনের তরে আমাদের মনেও রং ধরিয়ে দেয়। দু-দিনের তবে আমরাও অনুভব করি জীবনের স্পর্শ, নিজেকে হারিয়ে ফেলি ইটালিয়ান চেস্টার এবং ফার-কোটের জঙ্গলে, উপভোগ করি অহেতুক হাসি, ‘অমিত উচ্ছ্বাস এবং অর্থহারা ভাবে ভরা ভাষা’।

বৈকালিক আফিস সংক্ষেপে সমাধা করে সেদিন তাই সকাল সকাল বাড়ি ফিরছিলাম। ‘সিজন’ শুরু হয়ে গেছে। দার্জিলিংয়ের পথে-ঘাটে নয়নভুলানো আকর্ষণ। বাড়ি গিয়ে কোনরকমে এক পেয়ালা চা। অতঃপর বেরিয়ে পড়া।

সুপারের বাড়ির ধার দিয়ে পথ। গেটের সামনে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস রয়। চিন্তাক্লিষ্ট মলিন মুখ। চোখে উদাস দৃষ্টি। আমাকে দেখতে পেয়ে একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, এই যে, চৌধুরী। তোমাকে অনেক দিন দেখিনি। ভাল আছ?

—আজ্ঞে, ভালই আমি। আপনাকে কি রকম শুকনো দেখাচ্ছে। অসুখ-টসুক করেনি তো?

—নাঃ। আমি তো ভালই আছি। এসো না? মিস্টার রয় রয়েছেন। তাছাড়া আমাদের ক’জন অতিথিও এসেছে ক’দিন হল।

মিস্টার রয়ের সঙ্গলাভ, কিংবা তাঁর অতিথিবৃন্দের সাহচর্য, কোনোটার জন্যেই আগ্রহ ছিল না। কিন্তু মিসেস রয় যখন ডাকছেন যেতেই হল। সোজা ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেলেন। মিস্টার রয় সরবে অভ্যর্থনা জানালেন এবং আগন্তুকদের সঙ্গে যথারীতি পরিচয় করিয়ে দিলেন। একজন নিঁখুত সাহেবী বেশধারী ভদ্রলোক, দুটি সযত্ন-সজ্জিতা মহিলা। মিস্টার রয়ের ভাই নিকোলাস রয়, ভ্রাতৃবধূ অচলা, ভগিনী মার্গারেট। এছাড়া ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক লুঙ্গিপরা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ—আমাদের রুটিওয়ালা গুঞ্জা হোসেন। তার সঙ্গেই কথা হচ্ছিল। টেবিলের উপর কাগজে মোড়া একখানা পাঁউরুটি লক্ষ্য করলাম।

মিস্টার রয় আমার দিকে ফিরে বললেন, তুমি রুটি নাও কোত্থেকে, চৌধুরী?

আমি উত্তর দেবার আগেই গুঞ্জা হোসেন বলল, আজ্ঞে, ও সাহেবের রুটি আমার দোকান থেকেই যায়। ঐ আটখানা করেই নেন। জিজ্ঞেস করুন।

রয় বললেন, কিন্তু আমার বেলায় তোমার কিছু সুবিধে করে দেওয়া উচিত। ভেবে দ্যাখ, আমি এখানকার সিনিয়র হাকিম, তার মানে ডি-সি না থাকলেই আমি ডি-সি। তাছাড়া আমি জেলখানার বড় সাহেব, সিভিল কোর্টের সাব-জজ এবং ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার। বিপদে আপদে, মামলা-মোকদ্দমায় আমাকে ছাড়া তোমার গতি নেই।

গুঞ্জা হোসেন হাত জোড় করে বলল, আচ্ছা হুজুর, অত করে যখন বলছেন আপনি ঐ ন’খানা করেই নেবেন।

বলেই চলে যাচ্ছিল। মিস্টার রয় বললেন, দাঁড়াও। আর একটা কথা আছে। টাকায় ন’খানা হলে একখানা রুটির দাম কত পড়বে?

রুটিওয়ালা প্রশ্নটার তাৎপর্য বুঝতে না পেরে বলল, আজ্ঞে, আপনি তো আর খুচরা দরে কিনছেন না?

—তবু?

গুঞ্জা হোসেন মনে মনে হিসেব করে বলল, তা সাত পয়সাই পড়বে।

রয় খুশী হয়ে বললেন, সাত পয়সা! বেশ। সেই হিসাবে ন’খানা রুটির দাম পড়ছে তেষট্টি পয়সা। তুমি নিচ্ছ এক টাকা, অর্থাৎ চৌষট্টি পয়সা। তার মানে, প্রতি টাকায় তুমি এক পয়সা করে বেশি নিচ্ছ। ঠিক কি না?

মার্গারেট মস্ত বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, উঃ, মাথা ধরে গেল বাপু তোমার হিসেবের জ্বালায়। সত্যি বলছি, হ্যারল্ড, ম্যাজিস্ট্রেট না হয়ে তুমি যদি মুদীর দোকান দিতে অনেক বেশি উন্নতি করতে পারতে।

রয় ভগিনীর কথায় কান দিলেন না। রুটিওয়ালাকে যে প্রশ্ন করেছিলেন, তারই উপর আর একবার জোর দিয়ে বললেন, ঠিক বলেছি কিনা, বল? প্রতি টাকায় একটা করে পয়সা আমার পাওনা হচ্ছে।

রুটিওয়ালার মুখ দেখে মনে হল, সে চটেছে। গম্ভীর হয়ে বলল, বেশ। ঐ একটা করে পয়সা আপনাকে আমি ঘুরিয়ে দেবো।

রয় হেসে বললেন, না-না। ঘুরিয়ে দিতে হবে না। ওটা আমার হিসেবে জমতে থাকবে। সাত টাকার রুটি যেদিন কেনা হবে, একখানা রুটি আমি বেশি পাবো। এমনি করে প্রতি সাত টাকায় একটা করে ফালতু রুটি। ব্যাস! এবার বুঝলে তো?

গুঞ্জা হোসেন কি বুঝল, সেই জানে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেল এবং এমনভাবে বেরিয়ে গেল, যেন মস্ত বড় একটা বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

সে চলে যেতেই মিস্টার রয় চেঁচিয়ে উঠলেন, ঐ যাঃ! রুটিটা তো নিয়ে গেল না।

চাপরাসীর ডাক পড়ল এবং মিনিট কয়েক পরে সে রুটিওয়ালাকে আবার পাকড়াও করে নিয়ে এল।

রয় বললেন, তোমার রুটি যে ফেলে গেছ, মিঞা সাহেব

—আজ্ঞে, ওটা হুজুরের স্যাম্পুল।

-বেশ; তাহলে ওর দামটাও ঐ হিসেবের মধ্যে রইল। মানে, ঐ সাত পয়সা হিসেবে।

গুঞ্জা হোসেন একগাল হেসে বলল, স্যাম্পুলের তো দাম নেই হুজুর।

মিস্টার রয়ের মুখে খুশির আমেজ ফুটে উঠল। রুটিটার দিকে চেয়ে কি খানিকটা ভাবলেন। তারপর বললেন, এর থেকে একটা গল্প মনে পড়ছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনবে, না বেড়াতে যাবে?

নিকোলাস বললেন, দুটোই করবো। আমরা ডুডুও খাবো, টামুকও খাবো। আপনার আপত্তি আছে মিস্টার চৌধুরী?

বললাম, কিছুমাত্র না। ডুডু এবং টামুকের পরেও যদি কিছু থাকে, তাতেও আমার আপত্তি নেই।

—তোমার ইচ্ছাটা কি, অচলা? ভ্রাতৃবধূর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন মিস্টার রয়।

অচলা মৃদুকণ্ঠে বললেন, গল্প পেলে বেড়ানোটা বাদ দিতেও রাজী আছি আমি।

—আমি বাপু তাতে রাজী নই, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন মার্গারেট, যা বলবে চটপট বলে ফেল। আবার একঝুড়ি অঙ্ক ঢোকাবে না তো গল্পের মধ্যে?

রয় মৃদু হেসে বললেন, না, অঙ্ক নয়, তার বদলে এবার পাবে একঝুড়ি আম; আর তার সঙ্গে অনেকখানি Fun ।

Fun-এর গন্ধ পেয়ে আমরা সবাই আগ্রহ দৃষ্টি ফেললাম বক্তার মুখের উপর। অচলা চেয়ারটা টেনে আর একটু এগিয়ে বসলেন। মিস্টার রয় শুরু করলেন—

তখন সবে নতুন চাকরি; সেটেলমেন্ট ট্রেনিংয়ে যেতে হল দ্বারভাঙায়। মাঠের মধ্যে ক্যাম্প। কতগুলোতে অফিস, কতগুলোতে থাকবার ব্যবস্থা। একদিন বিকেলবেলা নিজের ক্যাম্পে বিশ্রাম করছি। মহারাজার এক ম্যানেজার এলেন দেখা করতে। পেছনে লোকের মাথায় একটা ঝুড়ি। বললাম, ওটা কি ব্যাপার?

ভদ্রলোক বিনয়ের সঙ্গে বললেন, বিশেষ কিছুই নয়। মহারাজাধিরাজ পাঠিয়ে দিলেন। ওঁর বাগানের গোটাকয়েক ল্যাংড়া।

গম্ভীরভাবে বললাম, বাইরে নিয়ে যেতে বলুন। ওসব অভ্যাস আমার নেই।

ম্যানেজার অবাক হয়ে বললেন, কিসের অভ্যাস-

—এই ঘুষ নেবার কথা বলছি।

ভদ্রলোক মনে মনে চটলেন, বোঝা গেল। বললেন, আজ্ঞে ঘুষ দেবার অভ্যাস আমাদেরও নেই। আপনি ভুল করছেন। এটা ঘুষ নয়। এটা হচ্ছে রাজবংশের প্রাচীন প্রথা। রাজপুরুষদের সঙ্গে দেখা করতে এলে খালিহাতে আসতে নেই; মহারাজাধিরাজের মর্যাদায় বাধে।

ভদ্রভাবেই বললাম, Excuse me ম্যানেজারবাবু, যেমন করেই বলুন, আসলে এ-ও একরকম ঘুষ। ইংরেজীতে যাকে বলে illigal gratification. মহারাজাধিরাজকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলবেন, তাঁর এই উপহার আমি গ্রহণ করতে অক্ষম।

ম্যানেজার বোধ হয় অতটা আশা করেননি। খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তার মানে, এই আম ক’টা আপনি নেবেন না?

—না।

-সেটা মহারাজের পক্ষে কত বড় অপমান তা বুঝতে পারছেন?

এবার একটু ঘাবড়ে গেলাম। ঐসব mediaeval যুগের রাজ-রাজড়াদের মর্যাদাবোধটা যেমন অত্যন্ত উঁচু, তেমনি বেজায় ঠুনকো। কখন কিসে যে সেটা ভেঙে পড়ে, কিছুই বুঝবার উপায় নেই।

নিকোলাস বললেন, Excuse me, Harold, ওঁরা না-হয় mediaeval যুগের লোক। কিন্তু একজন আধুনিক যুগের পদস্থ সরকারী ব্যক্তির নীতি-বোধটাও তো কম ঠুনকো নয়। একঝুড়ি আমের ভার সইতে পারলো না?

মিস্টার রয়ের মুখে মৃদু হাসি দেখা দিল। বললেন, একটা ভুল করছ। যে-ব্যক্তির কথা শুনছ, তিনি মোটেই আধুনিক ছিলেন না। সত্যি সত্যি আধুনিক যারা (আমাদের দুজনের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিলেন) তাদের নীতিবোধ যে কিছুতেই টোল খায় না, সেকথা বিলক্ষণ জানি। আমের ঝুড়ি সেখানে বাইরে অপেক্ষা করে না, সুড়সুড় করে সোজা ভিতরে চলে যায়।

—তাতে অন্যায়টা কি, শুনি? আচ্ছা, হলে কি করতেন মিস্টার চৌধুরী? Honestly বলবেন কিন্তু।

আমি চোখের ইঙ্গিতে boss-কে দেখিয়ে বললাম, Honestly বলবার মত সাহস পাচ্ছি কই?

মিলিত কণ্ঠের হাসির রোল উঠল।

মার্গারেট বললেন, তারপর আমের ঝুড়ির কি গতি হল?

রয় বললেন, হ্যাঁ। তারপর ম্যানেজারকে বললাম, দেখুন ম্যানেজারবাবু, মহারাজাধিরাজের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়, তেমন কিছু আমি করতে চাইনে। অথচ সরকারী কর্মচারী হিসেবে আমগুলো গ্রহণ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার চেয়ে আসুন একটা রফা করা যাক। আম আমি নেবোও না ফেরতও দেবো না। Neither accept, nor reject. ইতিমধ্যে আমার Head office-এ সব ব্যাপারটা লিখে দিচ্ছি। গভর্নমেন্টের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আম এখানেই থাক।

ম্যানেজার একটু হেসে বললেন, তাই হোক

তার মুখের ভাব দেখে মনে হল, আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে তাঁর সন্দেহ জেগেছে।

নিকোলাস মৃদুকণ্ঠে ফোড়ন দিলেন, কিন্তু আমাদের কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।

—আমিও তোমার সঙ্গে একমত, যোগ করলেন মার্গারেট, তারপর হেড অফিসে চিঠি লেখা হল বুঝি?

রয় বললেন, হ্যাঁ। চিঠি চলে গেল। দিন দশেক পরে একটা তাগিদও দেওয়া হল। এদিকে আমের অবস্থা বুঝতেই পারছ। ক্যাম্পে টেকা দায় হল। কিন্তু ঝুড়িটা সরাতেও পারি না। ম্যানেজারকে কথা দিয়েছি, Neither accept, nor reject. His Highness the মহারাজার মর্যাদা at stake! এমন সময় উত্তর এল। গভর্নমেন্ট বললেন, সরকারী কর্মচারীর পক্ষে কোন রকম উপহার গ্রহণ নিষিদ্ধ। তবে এই রকম ক্ষেত্রে, অর্থাৎ মানী লোকের মান-মর্যাদা যেখানে জড়িত, সেখানে দু-একটাকা মূল্যের কোন জিনিস গ্রহণ করতে বাধা নেই।

ম্যানেজারকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ঐ আমের দাম কত? তিনি বললেন, দাম আবার কী! আগেই তো বলেছি, ওটা আমাদের বাগানের আম।

—তা হোক, তবু ওর একটা বাজার-দর তো আছে।

ম্যানেজার নাকে কাপড় দিয়ে বললেন, বাজার-দর? বর্তমানে দু আনা; মানে, ঐ ঝুড়িটার দাম।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, বেশ! তাহলে মহারাজাধিরাজকে নমস্কার জানিয়ে বলবেন, তাঁর উপহার আমি সানন্দে গ্রহণ করছি।

.

ওঁদের চায়ের পাট আমি আসবার আগেই শেষ হয়েছিল। এবার বেড়াবার পালা। তারই উদ্যোগ করছিলেন। এমন সময় মিসেস রয় এসে বললেন, চৌধুরী, তুমি যেন চলে যেয়ো না। তোমার চা নিয়ে আসছি। মিস্টার রয় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বেশ, তাহলে তুমি বসো। আমরা একটু ঘুরে আসছি। কি বল? ডোরা রইলেন।

আমি সবিনয়ে সম্মতি দিলাম।

মিসেস রয় নিজের হাতে খাবারদাবার নিয়ে ঢুকলেন। সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে তাঁর দাড়িওয়ালা বয়। বললেন, আজ কিন্তু আমার কেকের ভাণ্ডার শূন্য। কি দিয়ে চা খাবে বল তো?

বললাম, আপনি যা দেবেন, তাই দিয়েই খাবো।

—তাহলে দেখছি শুধু চা-ই আছে তোমার কপালে। আবার যেদিন কেক্ করবো, খেয়ে যেয়ো দু’খানা। খবর দিলে আসবে তো?

বললাম, নিশ্চয় আসবো। খবর দেবার দরকার হবে না।

মিসেস রয় খাবারের ডিশগুলো এগিয়ে এগিয়ে দিচ্ছিলেন। চীজ, বিস্কুট, প্যাস্ত্রী এবং নানা রকমের ফল। প্রচুর আয়োজন। তবু উনি বার বার আপসোস করতে লাগলেন এই বলে যে, কোনটাই ওঁর নিজের হাতের নয়। সেজন্য অবশ্য আমার কোন আপসোস ছিল না। সুখাদ্যের সদ্ব্যবহারে কোনদিন আমার কোন ত্রুটি বা অবহেলা দেখা দিয়েছে, এরকম অভিযোগ আমার ঘোর শত্রুর কাছেও শোনা যায়নি। মিসেস রয় নিঃশব্দে চেয়ে চেয়ে আমার খাওয়া দেখছিলেন। একটি অপূর্ব স্নেহদীপ্ত তৃপ্তি তাঁর চোখে ফুটে উঠল।

কিছুক্ষণ পরে বললেন, তুমি আজকাল আস না কেন, বল দিকিনি? আমি বিদেশী মানুষ, তাই বুঝি পর মনে কর?

আমি একটা মস্তবড় মত্তমানের শেষ টুকরো কোন রকমে গলাধঃকরণ করে বললাম, কিছুদিন আগে হলেও আপনার কথায় আমি প্রতিবাদ করতাম না। একজন শ্বেতাঙ্গী মহিলাকে পর মনে না করা সত্যিই আমার পক্ষে কঠিন ছিল। কিন্তু আজ এ কথা বলতে আমার কিছুমাত্র কুণ্ঠা নেই, আপনাকে দেখবার পর থেকে বুঝেছি, মানুষের পরিচয় তার দেশ বা চামড়ায় লেখা থাকে না।

আমার এই উচ্ছ্বাসের উত্তরে মিসেস রায় হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তোমার পুরো নামটা কী, চৌধুরী?

—মলয়, মলয় চৌধুরী।

—আচ্ছা, সত্যি করে বল তো মলয়, এইমাত্র যা বললে, সেটা কি তোমার একটা সাধারণ মত, না ঐ কথাটাই তুমি একান্ত মনে বিশ্বাস কর?

দৃঢ়ভাবে বললাম, এ আমার অকপট বিশ্বাস, মিসেস রয়।

উনি আর কোনো কথা কইলেন না। একটুখানি অপেক্ষা করে বললাম, আমার ধৃষ্টতা মাপ করবেন। আপনাকে দেখলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। অথচ আপনার সঙ্গে তাঁর তফাত এত যে লোকে আমাকে পাগল বললে আশ্চর্য হবো না। তিনি দেখতে সুন্দর নন; বেশভূষা তাঁর কিছু নেই। লেখাপড়া একেবারেই জানেন না। দূর পল্লীগ্রামে কাটিয়ে দিলেন সারা জীবন। আদব-কায়দার পালিশ তাঁর দেহে বা মনে কোথাও লাগেনি। তবু মনে হয় আপনার সঙ্গে কোথাও তাঁর একটা গভীর ঐক্য আছে।

মিসেস রয়ের মুখে মৃদু হাসি মিলিয়ে গেল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তিনি উদাস কণ্ঠে বললেন, মলয়, তোমার সঙ্গে আমার দেখা এই সেদিন। ঘনিষ্ঠতা যেটুকু, তাও সময়ের দিক থেকে সামান্য। তবু তুমি যে পরিচয় আমার দিলে, এই সাতাশ বছর যাদের নিয়ে ঘর করলাম, তারা কি তার একটা কণাও দেখতে পেল না?

চমকে উঠলাম। প্রগল্ভ মূর্খের মত এই বিদেশিনী মহিলার অন্তরের কোন্ গোপন তারে হঠাৎ আঘাত দিয়ে ফেলেছি! সাবধান হয়ে গেলাম। প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেবার জন্যে বললাম, আমার জন্যে আজ আপনার বেড়ানো বন্ধ হল-

মিসেস অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, না-না, তুমি বোসো। কি বলছিলে? বেড়াতে যাওয়া? আমার তো বেড়াতে যাবার কথা ছিল না।

কুণ্ঠিত হয়ে বললাম, আমি ভাবছিলাম, ওঁরা বেরিয়ে গেলেন, আপনিও যেতেন নিশ্চয়। সারা বিকেলটা একা-একা বাড়ি বসে কাটাবেন?

—একা! উদাস কণ্ঠে বললেন মিসেস রয়, তুমি জান না, মলয়, আমি চিরদিনই একা। I have been alone all my life!

একটু হেসে আবার বললেন, তুমি আমার সন্তানের মত। সব কথা হয়তো তোমাকে বলা উচিত নয়। তাছাড়া তুমি ছেলেমানুষ; সব কথা বুঝবেও না। আজ নিঃসংশয়ে বুঝতে পারছি, আমি ভুল করেছিলাম। This marriage was a mistake!

শিউরে উঠলাম। নিতান্ত সহজ কণ্ঠে এ কী কঠিন কথা উচ্চারণ করলেন মিসেস রয়? সাতাশ বছর বিবাহিত জীবন কাটাবার পর এ কী ভয়ঙ্কর আবিষ্কার! এ কথার মর্ম ভেদ করবার মত না ছিল আমার বয়স, না ছিল বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা। কিন্তু এটুকু নিঃসন্দেহে বুঝেছিলাম, এইমাত্র যা শুনলাম, সেটা একজন অভিমানিনী ক্ষুব্ধা রমণীর ক্ষণিক উচ্ছ্বাস নয়, একটি শান্ত স্থিতধী প্রৌঢ়া মহিলার অন্তরের নিগূঢ় উপলব্ধি।

আমি নিরুত্তর রইলাম।

মিসেস তেমনি অবিচলিত কণ্ঠে বললেন, আমাকে ভুল বুঝো না, চৌধুরী। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আমার নেই। আমাদের দাম্পত্য-জীবনে যে সুখ, যে মাধুৰ্য পেয়েছি, খুব কম মেয়ের ভাগ্যেই তা জুটে থাকে। কিন্তু তবু আমি বিদেশী। মা, ভাই, বোন, ভ্রাতৃবধূ নিয়ে যে সংসার, সেখানে আমার স্থান হলো না।

বিনিদ্র শয্যায় অনেক রাত পর্যন্ত মিসেস ডোরা রয়ের বেদনাহত কণ্ঠস্বর আমার মনের মধ্যে গুঞ্জরণ করে বেড়াতে লাগল। এই শ্বেতাঙ্গিনী মহিলার বিচিত্র জীবন-কাহিনী আমার জানা নেই। যে-বিবাহ আজ তাঁর কাছে একটা মারাত্মক ভুলমাত্র, তার ইতিহাস ও আমার অজ্ঞাত। এইটুকু শুধু কল্পনা করতে পারি, সাতাশ বছর আগে এই ডোরা রয় ছিলেন সুন্দরী তরুণী। দেহে যৌবনসম্ভার, নয়নে তড়িৎ-চমক, অন্তরে উদার আবেগ। জীবনের সেই মহাসন্ধিক্ষণে একদিন সুঠাম-দেহ, মেধাবী যুবক হ্যারল্ড রয়ের সঙ্গে ওঁর প্রথম দৃষ্টিবিনিময়। ঠিক কোনখানে জানি না। হয়তো লন্ডনের কোন নৃত্যগীতমুখর ভোজসভায়, হাইড পার্কের কোন নিভৃত লতাকুঞ্জে, কিংবা স্কটল্যান্ডের সাগরচুম্বিত পর্বতছায়ায়। সেদিন দুজনেরই চোখে ছিল যৌবনের ঘোর, যার মায়ায় মিলিয়ে গেল দেশ, জাতি এবং সমাজের দুস্তর ব্যবধান। ধীরে ধীরে আভাসে প্রকাশে, ভাষা ও ইঙ্গিতে পরিচয় হল অন্তরের সঙ্গে অন্তরের। অশ্রু-হাসিসিঞ্চিত বিরহ মিলনের চিরন্তন পথে সঞ্চারিত হল অনুরাগ। তার পর একদিন বন্ধুসমাজকে সচকিত করে “merrily rang the bells, and they were wed.”

ডোরাকে সেদিন অনেক কিছু ছাড়তে হয়েছিল। জন্মভূমি, স্বজাতি, সমাজ, চিরপরিচিত পরিবেশ। কিন্তু কারো কথাই সে ভাবেনি, পিছনপানে তাকিয়েও দেখেনি একবার। পরম বিশ্বাসে একটিমাত্র মানুষের হাত ধরে সে বেরিয়ে পড়েছিল ঊর্মিমুখর সাগরের পথে, এক অজানা দেশের উদ্দেশে।

সেদিক থেকে মিসেস ডোরা রয় বঞ্চিত হননি। দীর্ঘ দাম্পত্য-জীবনে প্রেমের বন্ধন তাঁদের কোনোদিন শিথিল হয়নি, একথা তাঁরই অকপট স্বীকারোক্তি। তবে কিসের এ দীর্ঘশ্বাস? জানি না। নারীহৃদয়ের লীলাবৈচিত্র্যের সন্ধান আমি পাইনি। কোন মহিলা- রচিত একখানা উপন্যাসের একটি উক্তি মনে পড়ছে। “যতক্ষণ নরনারীর হৃদয়ের মধ্যে সত্যকার প্রেমের যোগ থাকে, ততক্ষণই বিবাহ সার্থক ও সত্য। যে মুহূর্তে প্রেমের মৃত্যু, সেই মুহূর্তেই উদ্বাহ-বন্ধন উদ্বন্ধন হইয়া উঠে—” —বলেছেন জনৈক নারী। এ কথার প্রতিধ্বনি শুনেছি কত শত কণ্ঠে, যে-কণ্ঠ একদিন পেয়েছিল মালার স্পর্শ, তারপর হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখতে পেল, তার ফুলগুলি গেছে, রয়েছে ডোর’। সেই ডোরটাকে সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াবার ব্যর্থতা আর বিড়ম্বনা, সে তো অহরহ দেখতে পাচ্ছি। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, বিবাহ কি শুধু প্রেম? শুধু প্রেম নিয়ে তৃপ্ত হয়েছে কোন নারী তার বিবাহিত জীবনে? ডোরা রয় হননি। তিনি স্বামীপ্রেম পেয়েছিলেন, পাননি স্বামীগৃহ। পেয়েছিলেন হৃদয়লক্ষ্মীর গর্ব, পাননি গৃহলক্ষ্মীর গৌরব। স্বামীর বন্ধুজনের শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন, পাননি তাঁর আত্মজনের বিশ্বাস। স্বামীর কাছে তিনি চিরন্তন প্রিয়সখী, গৃহিণী নন, সচিবও নন। তাই সমস্ত জীবন ধরে এত পেয়েও তাঁর অন্তরের ক্ষুধা মিটল না। অবশেষে একদিন সেই বুভুক্ষা-শীর্ণ অন্তরের রিক্ত রূপ তিনি তুলে ধরলেন বিদেশী বিধর্মী এক অনভিজ্ঞ অর্বাচীনের কাছে, ব্যক্ত করলেন তাঁর জীবনের যেটা সবচেয়ে গোপন আর সবচেয়ে মর্মান্তিক সত্য—This marriage was a mistake.

গভীর রাত পর্যন্ত ভাবতে চেষ্টা করলুম, কেন এমন হল? ডোরা রয়ের এই ব্যর্থতার জন্যে দায়ী কে? তাঁর স্বামী—হ্যারল্ড রয়? তাই বা কেমন করে বলি? তিনি তো তাঁর সমস্ত উন্মুক্ত হৃদয় উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর এই বিদেশিনী পত্নীর কোমল করপুটে। সেখানে তো কোন কার্পণ্য নেই। সেখানে তো কোন ফাঁকি ছিল না। তবে?

আজ মনে হচ্ছে, একটা দিক চোখে পড়েনি হ্যারল্ড রয়ের। তাঁর মনে হয়নি—দয়িতের হৃদয়পদ্ম যত বড় কাম্য বস্তুই হোক, সারাজীবন তাকেই শুধু আঁকড়ে ধরে ভাবলোকে বিচরণ করবার সৌভাগ্য কোন নারীই কামনা করে না। সে চায় জীবনের যজ্ঞশালায় অমৃত বিতরণের আমন্ত্রণ। সে ভার যে পেল না, সংসারের রৌদ্রতাপে ললাটে ফুটল না স্বেদবিন্দু, অঞ্চল রইল ধূলি-মুক্ত, প্রিয়-মুখ-মিলনের স্মৃতিভাণ্ডার তার যত বড়ই হোক, মিসেস ডোরা রয়ের মত একদিন তাকে নিঃশ্বাস ফেলে বলতে হবে, আমি নিতান্তই একা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *