লৌহকপাট – ৪.৪

চার

আমার এই পুরনো চিঠির ঝাঁপিটা যখন খুলে বসি, সকলের আগে যে জিনিসটা চোখে পড়ে এবং দেখে বিস্ময় লাগে, সেটা হচ্ছে চিঠিগুলোর বৈচিত্র্য। একটা হাতের লেখা থেকে আরেকটা হাতের-লেখা যেমন আলাদা—কোনোটা বাঁকা ছাঁদের কোনোটা সোজা—সেই লেখার পিছনে যারা রয়েছে, তাদের তফাৎ আরও বেশি। প্রশ্ন উঠবে, তাতে আর বিস্মিত হবার কী আছে? বৈচিত্র্যই তো জীবনের আসল রূপ! জানি। মোহমুদ্‌গরের দর্শনও আমার জানা আছে। এই সংসার শুধু বিচিত্র নয়, ‘অতীব বিচিত্ৰ’! তবু বিস্ময় জাগে বৈকি। ক্ষোভ, দুঃখ, আনন্দ, হিংসায় উদ্বেলিত কত বিভিন্ন রংয়ের, কত মিশ্র’ সুরের মন আমার এই ছোট্ট পেটিকার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে।

নানা পার্থক্য সত্ত্বেও একটি জায়গায় এরা এক—এই নিবন্ধের প্রথমেই যার উল্লেখ করেছি—সকলেরই কিছু জিজ্ঞাসা আছে। যতই ভিতরে ঢুকছি, দেখতে পাচ্ছি, সেটা এদের বহিরাবরণ। তার অন্তরালে আর একটি প্রচ্ছন্ন রূপ আছে—সকলেই কিছু শোনাতে চায়। একে আত্মপ্রচার না বলে বলব আত্মপ্রসার, নিজেকে মেলে ধরা, কিংবা আরেক ধাপ বেশি, খুলে ছড়িয়ে দেওয়া। তার মধ্যে আশ্চর্য বা অস্বাভাবিক কিছু নেই। মানুষ মাত্রেই স্রষ্টা। এক বললেন, আমি বহু হব—এইটাই তো সৃষ্টির মূল তত্ত্ব।

কমবয়সী কয়েদীদের একটা আলাদা জেল আছে। সরকারী সেরেস্তায় তার নাম ‘বস্টাল স্কুল। শুনেছি, তার এক বাতিক-গ্রস্ত সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট (তাঁর নাকি কিঞ্চিৎ লেখক- খ্যাতিও ছিল) গাঁটের পয়সায় একঝুড়ি নোট-বুক আর ডজন কয়েক পেন্সিল কিনে এনে ছেলেগুলোর হাতে হাতে দিয়ে বললেন, ‘এগুলো সরকারী নয়, তোদের নিজের জিনিস। যা ইচ্ছে হয় লিখবি, ছবি আঁকতে চাস আঁকবি, মাস্টারমশাইদের দেখাতে হবে না।’

ছেলেদের আনন্দ দেখে কে! কথাটা যখন উপর-মহলের কানে গেল, একজন কর্তাব্যক্তি কথায় কথায় রহস্যচ্ছলে প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাপার কি বলুন তো? বাছাধনদের বুঝি এখন থেকেই “লেখক” বানিয়ে তুলছে চান?’

‘আজ্ঞে না’, সবিনয়ে উত্তর দিলেন সুপার, ‘লেখক ওরা আগে থেকেই আছে। লেখার কিছু সরঞ্জাম চাই তো, সাধ্যমত তারই যোগান দিচ্ছি।’

কথাটা ও-তরফে ঠিক বোধগম্য হল না দেখে আরেকটু পরিষ্কার করে বললেন, ‘এ দুনিয়ায় লেখক নয় কে স্যার? আপনি, আমি, রাম, শ্যাম, যদু, মধু সবাই বর্ন-রাইটার, এক একটি পকেট-এডিশন রবিঠাকুর। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু লিখছি—কাগজে কলমে পাথরে কিংবা ক্যানভাসে না হোক, মনে মনে, মুখে মুখে। নিজেকে কোনো না কোনো প্রকারে প্রকাশ করে চলেছি। ওরাই বা তার থেকে আলাদা হবে কেন?’

আমার এই পত্রগুচ্ছের যাঁরা লেখক, তাঁরাও নিজেকে প্রকাশ করতে চান। শুধু আমার কাছে নয়, আমার ভিতর দিয়ে, অর্থাৎ আমাকে আশ্রয় করে অপরের কাছে। সে অপর কোথাও ‘অপর-সাধারণ’, কোথাও বা কোনো ‘বিশেষ অপর’, কোনো বিশেষ জন।

অপর্ণা চ্যাটার্জির কথা মনে পড়ছে। সেই ক্লান্তিভারানত মুখখানি শুধু নয়, একটি একুশ-বাইশ বছরের সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে তার বহু-বিড়ম্বিত জীবনের সে কাহিনী জেলখানার অফিসে বসে কখনও করুণ, কখনও উচ্ছল কণ্ঠে আমার কাছে অসঙ্কোচে ব্যক্ত করেছিল তাও নয়, তার চেয়ে বেশি, সেই ঠিকানা-হীন দীর্ঘ চিঠিখানা এই ঝাঁপির কোণে যা সযত্নে তোলা আছে, এবং যার প্রতিটি লাইন নানা কাজের ফাঁকে যখন-তখন আমাকে উন্মনা করে দেয়। সে লিখেছিল, ‘যে-কাহিনী সেদিন আপনার পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলাম, আশা করে বসে আছি, যত তুচ্ছই হোক, আপনার স্নেহবর্ষী লেখনীর মুখে একদিন সে রূপ নেবে। শুধু আশা নয়, এটা আমার শেষ আবেদন।’

সে-কাহিনী আর কেউ পড়ুক না পড়ুক তা নিয়ে তার অণুমাত্র মাথা-ব্যথা ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল একটি বিশেষ মানুষ। শুধু সেই একজনের কাছে নিজের কথাটি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়। আমার লেখার ভিতর দিয়ে ‘একটি বার তাঁর চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো।’ হয়তো এ ছাড়া সেখানে যাবার আর কোনো পথ তার ছিল না। আমার রচনা যে একদিন সেই আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির নজরে পড়বে, এবং তিনি সেটা মন দিয়ে পড়বেন, এ বিশ্বাস তার কেমন করে জন্মেছিল আমি জানি না। যেমন করেই হোক, সেই নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে অপর্ণার মন তাকে বলে দিয়েছিল—সেদিন ক্ষণেকের তরেও তাঁর মনে হবে, যতখানি হেয় বলে একদা তিনি যার মুখ-দর্শন পর্যন্ত করতে চান নি, ঠিক ততখানি হেয় বোধহয় সে নয়।

অপর্ণার অনুরোধ আমি রেখেছিলাম। কিন্তু যে প্রত্যাশা নিয়ে ‘লজ্জার মাথা খেয়ে’ আমার কাছে সে তার ‘শেষ আবেদন’ জানিয়েছিল তা সফল হয়েছে, না আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে, জানতে পারি নি। জানবার উপায়ও সে রাখে নি। নিজের ঠিকানাটা সে ইচ্ছা করেই গোপন রেখেছিল।

অপর্ণা একা নয়। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, জীবনের প্রকাশ্য সড়ক থেকে পিছলে পড়েছিল, এমনি আরও কতজনের মর্মবেদনা এই নানা রঙের নানা আকারের লেফাফাগুলোর মধ্যে সঞ্চিত হয়ে আছে। সে সব আজ থাক। সংসারে একেই তো দুঃখের অন্ত নেই, তার উপরে আর নতুন ভার চাপাতে চাই না। তার চেয়ে এমন দু-একখানা চিঠি খোলা যাক, যাদের বক্তব্যবিষয় পত্র-লেখকের কাছে যতটা গুরুতর, পাঠকের কাছে ততটা নয়। জানি, তার মধ্যেও একটা ট্রাজেডি আছে—আমি যাকে প্রাধান্য দিতে চাই, আপনার চোখে তো অপ্রধান, আমার কাছে যেটা মর্মান্তিক, আপনার মর্মে সে কোনো রেখাপাত করল না। কি করব উপায় নেই। আমাদের সকলের জীবনেই এ ট্রাজেডি অহরহ ঘটছে। বিশেষ করে যারা লেখক। অভিধান ঘেঁটে বাছাবাছা শব্দ জুড়ে একটি হৃদয়দ্রাবী করুণ দৃশ্যের অবতারণা করলাম। আমার চোখে জল এসে গেল, আপনি মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “জলো’ ‘জলো’। মধুর হাস্যরস পরিবেশন করেছি ভেবে আমার মুখ যখন তৃপ্তির হাসিতে উজ্জ্বল, আপনার গোমড়ামুখে হয়তো তার একটি কুঞ্চনও ফুটে উঠল না।

এই চিঠিগুলোর যারা লেখক, তাদের কারও কারও অদৃষ্টেও যদি সেই বিড়ম্বনা ঘটে, আমি নিরুপায়।

এই সাড়ে-চুয়াত্তর-চিহ্নিত বেয়ারিং চিঠিখানাই ধরা যাক। ঠিকানা নেই, কিন্তু চেহারা দেখেই বুঝতে পাচ্ছি—এর উৎপত্তিস্থল মফস্বলের জেলখানা। প্রতি রাত্রে বিভিন্ন ওয়ার্ডে যেসব কয়েদী বন্ধ করা হল, তাদের নাম লিখবার জন্যে মোটা মোটা রেজিস্টার থাকে, যার নাম ‘গ্যাঙ-বুক’। চিঠির কাগজগুলো সেখান থেকে গোপনে সংগৃহীত এবং তারই একটা পাতা আটা-গোলা গঁদে জুড়ে তৈরি হয়েছে খাম। বলা বহুল্য, এ হেন বস্তু প্রকাশ্য রাস্তায়, অর্থাৎ সরকারী সেন্সর-এর ছাপ নিয়ে আসতে পারে নি। এসেছে গোপন পথে, এবং সেইজন্যেই ডবল রেটে ডাক-মাশুল যোগাবার ভারটা আমার ঘাড়ে ফেলা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। কিংবা লেখক হয়তো টিকিটের পয়সাটা কোনো সূত্রে জোগাড় করে থাকবে। চিঠি-পাচারকারী বন্ধুটি—জেলের সিপাই কিংবা কোন্ খালাসী কয়েদী—সেটা পোস্টাপিসকে না দিয়ে চা কিংবা পানের দোকানে ব্যয় করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছিল। আমি যে নিতান্ত নির্বুদ্ধির মতো কয়েক আনা পয়সা খরচ করে ফেললাম, তার কারণ ঐ গ্যাঙ-বুকের ছেঁড়া পাতা। যা কিছু নিষিদ্ধ ও গোপনীয়, যার মধ্যে কোনো রহস্যের গন্ধ আছে, তার দিকেই মানুষের আকর্ষণ। কৌতূহল নামক একটি নিরীহ শব্দের আবরণে ঢাকা দিলেও আসলে এটা লোভ। লোভ মাত্রেই পাপ, তার দণ্ড আছে। সুতরাং ঐ পয়সা ক’টির জন্যে আমার কোনো আপসোস করা চলে না।

সেদিন কিন্তু চিঠিখানা পড়ে সত্যিই বড় আপসোস হয়েছিল। যা আশা করেছিলাম, তার কিছুই পেলাম না। না কোনো চিত্ত-চঞ্চলকারী লোমহর্ষক ঘটনা না কোন পদস্খলিতা নারীর মুখরোচক আত্মকাহিনী, যার সঙ্গে কিঞ্চিত চড়া রঙ মিলিয়ে আমি আমার পাঠক-হৃদয়ে রসসঞ্চার করতে পারি। আজ সেই ভুল-বানানে-ভরা কাঁচা হাতের লাইনগুলো আরেকবার পড়ে মনে হচ্ছে, তা না পারি, পাঠকদের কিছুটা কৌতুকের খোরাক হয়তো যোগাতে পারব। চিঠির লেখক নকুলচন্দ্র সাঁতরা অবশ্য তা চায় নি। তার দুর্ভাগ্যের বর্ণনা দিয়ে শ্রোতার মনে কিঞ্চিৎ দুঃখ বা সহানুভূতির উদ্রেক করাই বোধহয় তার কাম্য ছিল, যদিও স্পষ্ট করে সে-কথা সে কোথাও বলে নি। মনে মনে সেই অভিপ্রায় যদি তার থেকেও থাকে, আমার এবং আপনাদের কুণ্ঠার বা লজ্জার কারণ নেই। আমাদের বেশির ভাগ হাসির উৎস যে অন্যের অশ্রুজল, এ তো অত্যন্ত পুরনো কথা।

দশধারা মোকদ্দমায় নকুল সাঁতরার এক বছর জেল হয়েছিল। চুরি, ডাকাতি, খুন ইত্যাদি মামলায় কোর্ট যে দণ্ড দেন, তার সঙ্গে এই দশধারার মেয়াদের তফাৎ আছে। এটা হল জামিনের বিকল্প ব্যবস্থা। কোর্টের আদেশমত উপযুক্ত জামিন দাঁড় করাতে পারলে আর জেলে যেতে হয় না। বেশির ভাগ আসামীই তা পারে না, নকুলও পারে নি। সুতরাং জেলে গিয়েছিল।

ফৌজদারী আদালত এবং তার সংশ্লিষ্ট মহলে ‘দশধারা’র চলতি নাম—বি. এল. কেস। বি. এল. মানে ‘ব্যাচেলার অব্ ল’ নয়, ব্যাড লাইলিহুড’। জীবিকা-নির্বাহের পথটা যাদের প্রকাশ্য ও সরল নয়, বরং বাঁকাচোরা এবং তমসাচ্ছন্ন চালচলনে চাকচিক্য আছে, কিন্তু তার রসদ-সংগ্রহের সূত্রটির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না, তাদেরই এই বি. এল.-এর খপ্পরে ফেলা হয়। কোনো স্পেসিফিক বা নির্দিষ্ট অভিযোগের প্রয়োজন নেই, প্রমাণ করতে হবে না, অভিযুক্ত আসামী অমুক জায়গায় সংঘটিত অপরাধের জন্যে দায়ী, শুধু দেখাতে হবে তার জীবনযাত্রার মান এবং জীবিকা-সংস্থানের উপায়—এ দুয়ের মধ্যে কোনো সংগতি নেই, সুতরাং ঐ কার্যটির জন্যে তাকে নিশ্চয়ই কোনো অসাধু পন্থার শরণ নিতে হয়। এইটুকু সম্পর্কে নিশ্চিত হলেই হাকিম তাকে দশধারার বঙ্ বা মুচলেকায় বেঁধে জেলে পাঠাতে পারেন।

মনে পড়ছে, আমার এক অধ্যাপক বন্ধু একবার কোনো মহকুমা-আদালতে এই দশধারার বিচার দেখতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলেন। সাক্ষ্যগ্রহণাদি আগেই হয়ে গেছে। সেদিন ছিল সওয়াল জবাব। আসামী পক্ষের উকিল তাঁর ভগ্নীপতি। তিনিই শ্যালককে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন, সম্ভবত দেখাবার জন্যে—ছোট মফস্বল কোর্ট হলেও সেখানকার বক্তৃতার মান কলকাতার অভিজাত কলেজের চেয়ে ন্যূন নয়। বলা দরকার যে, আমার বন্ধুটির পাণ্ডিত্য যতই থাক, চেহারাটা মোটেই পণ্ডিত-জনোচিত ছিল না।

কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টর সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করছিলেন। তাঁর বক্তৃতা শুরু হল। উঠেই নাটকীয়ভাবে কাঠগড়ার দিকে তর্জনী তুলে বললেন, “সাক্ষ্য-প্রমাণাদি উল্লেখ করবার আগে মহামান্য আদালতকে আমি একবার ঐ আসামীর দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ করব। চেহারাটা একবার লক্ষ্য করুন, ধর্মাবতার। কী রকম তেল-চুকচুকে মোষের মতো গায়ের রং, কত বড় বুকের ছাতি, কী জমকালো গোঁফ, সুন্দরবনের বাঘের মতো ভরাট মুখ, ধর্ম্মের ষাঁড়ের মতো গর্দান…। আচ্ছা, এবার একটা ছোট্ট প্রশ্ন—

এই পর্যন্ত এসে একটু থামলেন কোর্টবাবু, ঘাড় ঘুরিয়ে দু-পাশটা একবার দেখে নিলেন। তারপর আসামীর উকিলের দিকে একটা জয়-গর্বিত ভ্রূকুটি নিক্ষেপ করে বললেন, এতবড় একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে কিসের জোরে?

‘অবজেকশন ইওর অনার’—তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন আসামী পক্ষের উকিলবাবু।—’আমার বন্ধু যা বললেন সব অর্থহীন অপ্রাসঙ্গিক।’

হাকিম বক্তার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। তিনি বলে চললেন, সুযোগ্য কোর্ট সাব- ইন্সপেক্টর যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে আমার মক্কেলের চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন, তার থেকে মনে হয় পুলিসের চাকরিতে না এসে তিনি যাত্রার দলে যোগ দিলেই বুদ্ধিমানের কাজ করতেন। দুঃখের বিষয় এটা আদালত। কিন্তু কী বলতে চান তিনি? চেহারাটাই যদি তাঁর মতে আসামীর অপরাধ বলে গণ্য হয়ে থাকে, তাহলে আমার এই অধ্যাপক শ্যালকটিকে কোর্টের সামনে হাজির করছি-

ভগ্নীপতির অতর্কিত আক্রমণে আমার বন্ধুবর হতভম্ব। আত্মরক্ষার উপায় স্থির করবার আগেই উকিলবাবু তাঁকে দু-হাতে টেনে তুলেছেন। পরক্ষণেই হাকিমের সামনে আরও খানিকটা ঠেলে দিয়ে বললেন, ইওর অনার মে কাইগুলি হ্যাভ এ লুক। আসামীর সঙ্গে এঁর কোনো অমিল নেই। একই রঙ একই রকম বুকের ছাতি এবং তেমনি জমকালো গোঁফ। আমার বন্ধু কি বলতে চান, সেই অপরাধে এঁকেও দশধারায় চালান দিয়ে আসামীর ডক্-এ দাঁড় করাতে হবে?

একটা হাসির রোল উঠল। হাকিমকে হাসতে নেই। সময়োচিত গাম্ভীর্য বজায় রেখেই তিনি বললেন, অর্ডার অর্ডার।

যাক যা বলছিলাম। বি. এল. কেসে ফেলবার আগে নকুলকে প্রথমটা ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। তার সঙ্গে আরও আসামী ছিল। মাস তিনেক কোর্টে আনা- নেওয়ার পর এল এই দশধারার অভিযোগ। নকুল লিখেছে, ‘এই নতুন মামলা কি করিয়া চাপিল, আপনাকে বলিয়া দিতে হইবে না। আপনি তো সবই জানেন।’

সব না জানলেও চিঠির ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছি। ডাকাতি প্রমাণ করা বড় শক্ত। রাত্রির অন্ধকারে মুখোশ লাগিয়ে কিংবা রং-চং মেখে মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে একদল লোক যখন হৈ-হল্লা করে বাড়ি চড়াও করে, গৃহস্থ তখন ধন-প্রাণ সামলাবে না চিনতে চেষ্টা করবে এরা কারা? অথচ ডাকাতি-মামলায় জড়াতে হলে যে-সব মাল-মশলার প্রয়োজন, তার মধ্যে প্রথম নম্বর এই সনাক্ত বা আইডেন্টিফিকেশন। যে অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে এই সনাক্ত-কার্যের আয়োজন করা হয় তার নাম টি. আই. প্যারেড। তার ঘটনাস্থল জেলখানা

আমার চাকরি-জীবনের প্রথম দিকে বিভিন্ন জেলে এমনি বহু টি. আই প্যারেডের আয়োজন আমাকেই করতে হয়েছে। যে ক’জন আসামী, তার সাত-আট গুণ অন্যান্য মামলার হাজতীদের সঙ্গে মিশিয়ে তাদের লাইনবন্দী করে দাঁড় করিয়েছি জেলখানার মাঠে। একজন জুনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট এসেছেন ফর্ম এবং অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে। তিনিই অনুষ্ঠানের পুরোধা। তাঁরই নির্দেশে জেলের বাইরে থেকে এক-একজন করে সাক্ষীদের ডাক পড়েছে। সাক্ষী—অর্থাৎ যার বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল, সেই হতভাগ্য গৃহস্থের পরিবারবর্গ। তার মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ দুই-ই আছে। আছে ক্ষীণ-দৃষ্টি বৃদ্ধ, অপোগণ্ড শিশু এবং তরুণী কুলবধূ, যে কোনোদিন জেলে ঢোকা দূরে থাক, ঘরের বাইরে পা দেয় নি। হাতে ও কানে বাঁধা ব্যাণ্ডেজ—বালা এবং দুল ছিনিয়ে নেবার ক্ষতচিহ্ন। আর আছে প্রাপ্তযৌবনা কুমারী মেয়ে, যে গয়না হারায় নি, হারিয়েছে তার চেয়ে অনেক বড় জিনিস—তার দেহের সম্ভ্রম ও শুচিতা।

হাকিম নির্দেশ দিলেন,—কাছে গিয়ে দেখুন, কাউকে চিনতে পারেন কিনা। আমি তাদের মুখের দিকে চেয়ে দেখেছি—সন্ত্রস্ত উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টি, ক’দিন আগে যে দৃশ্য দেখেছে, এখনও বুকে চেপে আছে নাইট-মেয়ার বা শ্বাসরোধকারী দুঃস্বপ্নের মতো। সেই আতঙ্ক ও বিহ্বলতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। সম্পূর্ণ বিভিন্ন এবং ভয়াবহ পরিবেশে এক পলক যাকে দেখেছে তাকে মনে করবার মতো মানসিক স্থৈর্য ফিরে আসে নি। তাছাড়া কাকে চিনবে, কেমন করেই বা চিনবে? জেল-হাজতে জড়ো-করা এই বিভ্রান্তিকর ঘটনার মধ্যে সেই মুখগুলো যদি থেকেও থাকে, এতদিনে সেখানে স্বাভাবিক ও ইচ্ছাকৃত কত অদল-বদল ঘটে গেছে। কারও গালভরা সযত্নলালিত দাড়ি, কারও মাথায় যথেচ্ছ বর্ধিত রুক্ষ চুল। কেউ পাজামা ছেড়ে ধুতি ধরেছে, কেউ বা ধার-করা আলোয়ানে আপাদমস্তক জড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাশছে। কার সাধ্য চিনে বার করে কারা সেই কাল-রাত্রির ধ্বংসলীলার নায়ক? সাক্ষীরা এসেছে আর একবার করে ঘুরে চলে গেছে। কেউ বা এতগুলো চোর- ডাকাতের কাছে ঘেঁষবার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারে নি। কোনো সহৃদয় হাকিমের বারংবার আশ্বাসে ও নির্বন্ধে দু-একজন যদি বা কারও দিকে আঙুল তুলেছে, সে হয় ভুল লোক, অর্থাৎ অন্য মামলার আসামী, নয়তো নিতান্তই অ্যাকসিডেন্টের বলি।

আমি একপাশে বসে বসে দেখছি, আর প্রতিবারেই মনে হয়েছে ফাঁকতালে একটি চমৎকার প্রহসন দেখে নিলাম।

.

নকুল সাঁতরাকে টি. আই. প্যারেডের অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। যথারীতি পাস করে গেছে। খানাতল্লাশে মালপত্রও কিছু পাওয়া যায় নি। আরও তদন্ত দরকার। সাক্ষী খুঁজে পেতে কিংবা তৈরি করতে সময় চাই। যাঁর কোর্টে মামলা, সেই হাকিমটি হয়তো বেয়াড়া ধরনের, বেশি সময় দিতে চান না। তখন পুলিসের হাতে একমাত্র ব্রহ্মাস্ত্র ঐ বি. এল. কেস। কিছুদিনের মতো একবার গেঁথে ফেলতে পারলে তারপর ডাকাতি-মামলার সাজ-সরঞ্জাম ধীরে সুস্থে জোটানো চলবে।

দশধারার সাক্ষী বিশেষ দুষ্প্রাপ্য নয়। হ্যাঁ, লোকটার চলাফেরা সন্দেহজনক, নেশাভাঙ করে, স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়, খায়দায় ভাল, জামা কাপড়ের জলুস আছে, অথচ জমিজমা নেই, রুজি-রোজগারের ব্যাপারটাও রহস্যময়। কখনও রাজমিস্ত্রী, কখনও ছুতোর, কখনও কোন্ চটকলের সর্দার—এসব কথা কোর্টে গিয়ে বলবার মতো লোক জুটে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে এগুলো মিথ্যাও নয়। প্রায় সব গ্রামেই দুজন একজন এই জাতীয় ব্যক্তির দেখা মেলে, যাদের সম্বন্ধে সাধারণ শান্তিপ্রিয় গৃহস্থ নিজেকে ঠিক নিরাপদ মনে করতে পারে না। এখানে-ওখানে চুরি-ছ্যাঁচড়ামি, মাঝে মাঝে দু-একটা ছোটখাটো ডাকাতি, গ্রামাঞ্চলে যা ঘটে থাকে, তার পিছনে যে ঐ ক’টি লোক কলকাঠি নাড়ছে, চাক্ষুষ প্রমাণ না থাকলেও গ্রামবাসীরা সবাই তা জানে এবং বিশ্বাস করে। এহেন চীজ যত দূরে থাকে ততই মঙ্গল। ওদের মধ্যে কারও গায়ে যদি একবার ‘জেলে’র দাগ লেগে থাকে, তাহলে তো অবশ্যই শতহস্তেন—। এই মনোভাবকে কাজে লাগাতে পুলিসের বিশেষ বেগ পেতে হয় না।

নকুলচন্দ্র হয়তো ঐ অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের একজন। কিংবা অন্য কোনো কারণে সে কিঞ্চিৎ আঞ্চলিক বিরাগ অর্জন করেছিল। তারই সুযোগ নিয়ে, গ্রাম্য দশজনের সাহায্যে পুলিশ তাকে দশধারার জালে আটকে ফেলে থাকবে।

আসল কেস অর্থাৎ ৩৯৫ ধারা তখনও চলছে। চৌদ্দদিন অন্তর তারিখ পড়ে এবং নকুলকে তার জেলের পোশাক ছেড়ে জেলখানার ক্লোদিং-গোডাউনে তুলে রাখা তার নিজস্ব সম্পত্তি—ময়লা, ভ্যাপসা গন্ধভরা ধুতি, আর তার উপরে একটা অপেক্ষাকৃত ফরসা কোঁচকানো শার্ট চাপিয়ে লোহার-জাল-দিয়ে-ঘেরা সঙ্কীর্ণ জানালাওয়ালা কয়েদী গাড়িতে একগাদা আসামীর সঙ্গে ঠাসাঠাসি বোঝাই হয়ে কাছারিতে যেতে হয়। সমস্তটা দিন কোর্ট-লক-আপ্ নামক প্রায়-সবদিক-বন্ধ একটা ছোট্ট কামরায় কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে জেল-গেটে। আসামী সেরেস্তার কেরানীবাবু ওয়ারেন্ট দেখে পরের তারিখটা জানিয়ে দেন। নকুল আবার সেই সকালে-ছেড়ে-যাওয়া নম্বর-দেওয়া জাঙ্গিয়া-কুর্তা পরে ধুতি আর কামিজটা গুদামে জমা দিয়ে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে চলে যায়।

এমনি কয়েক মাস যাতায়াতের পর একদিন কেস উঠল এবং কয়েকজন সাক্ষীর জবানবন্দী নিয়ে নিম্ন আদালত তাকে দায়রায় সোপর্দ করলেন। আবার দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা। শেষ পর্যন্ত সেসন্সে, অর্থাৎ জজের আদালতে বিচার শুরু হল। সেখানকার সুবিধা, একবার শুরু হলে শেষ হতে দেরি হয় না। দিনের পর দিন শুনানি চলে। নকুলকে নিয়ে মোট আসামী ছিল আটজন। বিচারে আটদিনও লাগল না। সাতদিনের দিন রায় দিলেন দায়রা জজ। সব আসামী বে-কসুর খালাস।

ডক থেকে নামিয়ে গোটা দলটাকে কোর্ট ইন্সপেক্টরের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। একজন সিপাই প্রত্যেকের হাতে বাড়ি ফিরে যাবার খরচ বাবদ কয়েক আনা করে পয়সা দিয়ে বুড়ো আঙুলের টিপ নিয়ে বলল, যা ব্যাটারা, খুব বেঁচে গেছিস।

সকলে খুশীমুখে চলে গেল, নকুল দাঁড়িয়ে রইল এক কোণে। অন্য সকলের সঙ্গে সে-ও ডাকাতি-মামলায় ছাড়া পেয়েছে, একথা সে জানে। কিন্তু জজসাহেব কি তাকে দশধারার মেয়াদ থেকেও মুক্তি দিয়েছেন? কোর্টের সিপাই অবশ্য তাকেও চলে যেতে বলছে, টিপ নিয়েছে, পয়সা দিয়েছে, তবু কোর্টবাবুকে জিজ্ঞাসা না করে যাওয়াটা বোধহয় উচিত হবে না। কী জানি যদি ওদের ভুল হয়ে থাকে। এমন সময় একজন দারোগা ঘরে ঢুকলেন। এঁকে সে বরাবর কোর্টে হাজিরা দিতে দেখেছে এবং তার দলের আসামীরা চাপা গলায় যখন-তখন তাঁকে বাপান্ত করেছে, তা-ও শুনেছে। ইনিই এই কেসের আই. ও. অর্থাৎ তদন্তকারী পুলিশ-অফিসার। নকুলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ যোগাযোগ ঘটেনি। ইনি যখন তদন্তের ভার নিয়েছেন, তার আগেই সে দশধারায় জেলে আটকে গেল। খালাস পাবার পর যখন সে ডক থেকে নেমে আসছিল, হঠাৎ কানে গেল উকিল বলাবলি করছেন, জজসাহেব তাঁর রায়ে এই আই. ও.-টিকে খুব একহাত নিয়েছেন। তার দলের ক’জন আসামীও এই নিয়ে আনন্দ করছিল। মোড়ল গোছের একজন বলছিল, শালাকে নির্ঘাত ডিগ্রেড করে দেবে দেখিস! কথায় কথায় রুলের গুঁতো, তার মজাটা এবার টের পাবেন বাছাধন

আই. ও. যখন ঘরে ঢুকলেন, নকুল আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, তাঁর মুখখানা আষাঢ়ের মেঘের মতো থমথম করছে। হঠাৎ তার দিকে নজর পড়তেই তেড়ে উঠলেন, তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?

নকুল ভয়ে ভয়ে বলল, আজ্ঞে, আমাকে কি একদম খালাস দেওয়া হয়েছে?

—ন্যাকামি হচ্ছে! মুখ ভেংচে বললেন দারোগাবাবু, ‘আমাকে কি একদম খালাস দেওয়া হয়েছে’? তার মানে, কিছু একটা হাতাবার তালে আছ?

বাবুটি যে কারণে ভিতরে ভিতরে তেতে আছেন, সেটা বুঝতে পেরে নকুলেরও বোধহয় ওঁকে নিয়ে একটু মজা করবার ইচ্ছা হল। বলল, এখানে কী এমন সোনাদানা পড়ে আছে বাবু যে হাতাবো?

—বটে! আবার রসিকতা হচ্ছে! ছাড়া পেয়ে বড্ড তেল হয়েছে দেখছি, বলে হঠাৎ চোখ পাকিয়ে গর্জে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে যে বাক্যটি নির্গত হল, শোনাবার পর নকুলও মেজাজ রাখতে পারল না, বেশ চড়া সুরে বলল, কেন মিছিমিছি মুখখারাপ করছেন? আপনার সঙ্গে তো আমি—

কথাটা শেষ করবার আগেই দারোগাবাবু ‘তবে রে’ বলে পাশের টেবিলে যে রুলটা ছিল, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং নকুল যতক্ষণ প্রাণের দায়ে ঘর ও বারান্দা পেরিয়ে মাঠে গিয়ে না পড়ল, ততক্ষণ সেটা সমানে চালিয়ে গেলেন। ভিতরে অনেক জ্বালা জমে ছিল, তার খানিকটা বোধহয় মিটল।

নকুল লিখেছে, ‘সেদিন দারোগার উপর যত না রাগ হইয়াছিল, তাহার বেশি হইল নিজের উপর। বড় বেশি সাধু হইতে গিয়াছিলাম, হাতে হাতে তাহার ফল পাইলাম। কোনোরকমে উঠিয়া ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরিলাম। কয়েদীগাড়ি তাহার আগেই চলিয়া গিয়াছে।’

পরদিন সন্ধ্যার দিকে পুলিস গিয়ে নকুল, সাঁতরাকে গ্রেপ্তার করল। তার একটু আগেই সে বাড়ি পৌঁছেছে। বৌ দুটো ভাতে-ভাত ফুটিয়ে দেবার আয়োজন করেছিল, তখনও নামানো হয় নি।

অপরাধটা কী? জানতে চেয়েছিল নকুল। পুলিসের জমাদার সরাসরি জবাব দেয় নি, হেসে বলেছিল, ‘ব্যাটা পয়লানম্বর বুরবক! ভাগলিই যদি, দু-দিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে কী হয়েছিল?’ কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া বেঁধে জেল-গেটে যখন নিয়ে গেল, জেলের বাবুরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। একজন এসকেপড্ প্রিজনার, অর্থাৎ, পলাতক কয়েদী এত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে, তাঁরা মোটে আশা করেননি। একটা ছিপে-গাঁথা মাছও তো ছিপওয়ালাকে খানিকক্ষণ ল্যাজে খেলিয়ে হয়রান না করে ডাঙায় ওঠে না!

ল্যাজে না খেলালেও নকুল সাঁতরার একটা কৃতিত্ব আছে। তার এই এসকেপ্ উপলক্ষ করে জেল আর পুলিসে বেশ খানিকটা খণ্ডযুদ্ধ বেধে গিয়েছিল এবং তাতে শেষ পর্যন্ত হার হয়েছিল পুলিসের। ব্যাপারটা ঠিক কী নিয়ে বেধেছিল, নকুল স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। যেটুকু আভাস দিয়েছে, তার থেকেই আমি বুঝতে পারছি।

কোনো উপযুক্ত (আইনের ভাষায় কম্‌পিটেণ্ট) কোর্টের লিখিত নির্দেশ ছাড়া জেল কাউকে আটকে রাখতে পারে না। এ নির্দেশপত্রটির নাম ওয়ারেন্ট। যে-সব লোক বিচারাধীন, অর্থাৎ হাজতবাস করছে, তারা যখন কোর্টে যায় তাদের ওয়ারেন্টও ঐ সঙ্গে পুলিসের জিম্মায় গছিয়ে দেওয়া হয় এবং যখন ফিরে আসে, জেল সেটা বুঝে নেয়। যে লোকের একটা মামলায় মেয়াদ হয়ে গেছে, আরও মামলা রয়েছে, তাদের ওয়ারেন্টের পিঠে জেলকে বেশ স্পষ্ট করে লিখে দিতে হবে—’কনভিক্ট; নট টু বি রিলিজ্‌ড্ ফ্রম কোর্ট’—’দণ্ডিত কয়েদী; সুতরাং কোর্ট থেকে ছাড়া চলিবে না।’ এই উক্তিটির নীচে স্বয়ং জেল-সুপারের সই থাকবে।

নকুল সাঁতরা ছিল এই শেষের দলে। আগে থেকেই সে জেল খাটছিল। সেদিন ডাকাতি-মামলাটা ফেঁসে যাবার পর কোর্ট-পুলিসের হয়তো সেটা খেয়াল হয়নি। তাকেও তার সহ-আসামীদের সঙ্গে বিদায় করে দিয়েছিল। সে বিদায় ‘জেল হইতে বিদায়’ কিনা, ভালো করে জেনে নেবার জম্যে সাঁতরার প্রতীক্ষা এবং তার পরেই আই. ও. বাবুর ‘রুলে’র আক্রমণ।

সন্ধ্যার পর কাছারি-ফেরত আসামীদের সঙ্গে ওয়ারেন্ট মিলিয়ে নিতে গিয়ে জেলের কেরানীবাবু যখন হাঁক দিলেন ‘নকুলচন্দ্র সাঁতরা’, কারও সাড়া পাওয়া গেল না। কে একজন বলল, সে তো খালাস হয়ে গেছে।

—খালাস হবে কি হে! ও তো কয়েদী!

—তাই তো!

জেল থেকে জরুরী চিঠি গেল পুলিসের কাছে—রং রিলিজ ফ্রম্ কোর্ট। দণ্ডিত কয়েদীকে কাছারি থেকে ভুল করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোর্ট-পুলিস কেমন করে জানবে সে দণ্ডিত? কেন, ওয়ারেন্টের পিঠে কী লেখা আছে? কোর্ট-ইন্সপেক্টরের অফিস থেকে প্রতিবাদ এল—ও লেখা প্রক্ষিপ্ত, আগে ছিল না। ঐ দিন খালি ওয়ারেন্ট ফিরে পাবার পর জেল ওটা বসিয়ে দিয়েছে।

এসব বাদানুবাদের ফয়সালা হবার আগেই অবশ্য নকুল সাঁতরার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়ে গেছে।

নকুলের বিরুদ্ধে নতুন মামলা দায়ের হল—এসকেপিং ফ্রম্ ল-ফুল কাস্টডি— আইনসঙ্গত হেপাজত থেকে পলায়ন। যথারীতি চার্জ গঠন এবং অন্যান্য পর্ব শেষ করে হাকিম প্রশ্ন করলেন—তোমার কিছু বলবার আছে?

আসামী যা যা ঘটেছিল তার আদ্যন্ত বর্ণনা দিয়ে গায়ের দাগগুলো যেমনি দেখাতে যাবে কোর্ট-ইন্সপেক্টর হেঁকে উঠলেন, দিস্ ইজ্ ইররেলেভেন্ট ইওর অনার। আসামী যা বলছে, তার সঙ্গে বর্তমান কেসের কোনো সম্পর্ক নেই। সে একজন দণ্ডিত কয়েদী, এবং তার জেলের মেয়াদ শেষ হয় নি। পুলিসের পক্ষে যদি কোনো ত্রুটি হয়েও থাকে, তার সুযোগ সে নিতে পারে না। পুলিসের গাফিলতি দ্বারা, কয়েদী হিসেবে তার যে দায়িত্ব, তার খণ্ডন হয় না। সে দায়িত্ব পালনের একমাত্র পথ ছিল জেলে গিয়ে ধরা দেওয়া, টু সারেনডার অ্যাট্ দি জেল-গেট!

সম্ভবত এই যুক্তি গ্রহণ করেই এস. ডি. ও. তাকে ‘ল-ফুল কাস্টডি’ থেকে পালাবার অপরাধে দু-মাসের জেল দিয়ে দিলেন।

নকুল সাঁতরার শেষ চিঠির শেষ অনুচ্ছেদে একটি প্রশ্ন এবং সেটি আমার উদ্দেশে।

‘না পলাইয়াও যখন পলাইবার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইলাম, তখন পলাইতে আমার কি বাধা ছিল? কী দরকার ছিল. আই. ও. বাবুর রুল্ খাইবার? ইহার পরেও কি আপনি জেলের কয়েদীর সৎ এবং সাধু হইবার উপদেশ দিতে চান?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *