লৌহকপাট – ২.৬

ছয়

হাঙ্গারস্ট্রাইক? হ্যাঁ, তা দেখছি বইকি। দুটো চারটে নয়, দশ বিশটাও নয়, দুশো চারশো। ইংরেজ রাজত্বে দেখেছি সত্যাগ্রহী কংগ্রেস, কংগ্রেস-রাজত্বে দেখলাম সত্যাগ্রহী কমরেডস্। জাত একই, তফাত শুধু বর্ণে। ওঁরা ছিলেন সাদা, এঁরা লাল। উভয় ক্ষেত্রেই অনশন একটা পলিটিক্যাল মহাস্ত্র। লক্ষ্যস্থল সরকার নামক নিরাকার পদার্থ, যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। জেলটা শুধু উপলক্ষ। তবু যেহেতু সে দৃশ্যমান, তাকে ধরা যায় এবং সে ধরে রাখে, প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ যখন বাধে তার সঙ্গেই বাধে। তাকে ঘিরেই চলতে থাকে আঘাত আর প্রতিঘাতের পালা।

হাঙ্গারস্ট্রাইক প্রথমেই যাকে স্ট্রাইক করে সেটা হল জেলের আইন। ‘খাবো না’ বলে মুখভার করলে মায়ের কিংবা প্রিয়ার কাছে সেটা হয়তো অভিমান, কিন্তু জেলের কাছে অপরাধ। জেলকোডের পরিভাষায় তাঁর নাম major offence. অপরাধ মাত্রেরই দণ্ড আছে। আগেকার আমলে যাঁদের দেখেছি, তাঁরা সেকথা জানতেন এবং নিজেরা দণ্ডপাণি না হয়েই দণ্ড গ্রহণ করতেন। তাঁরা বলতেন, বিরোধটা পেয়াদার সঙ্গে নয়, পেয়াদার পেছনে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে যে তাকে চালাচ্ছে তার সঙ্গে। জেল আর তাদের মধ্যে একটা অলিখিত এবং অব্যক্ত বোঝাপড়া ছিল, অনেকটা যাকে বলে mutual understanding. আমি জোর করে মুখ বন্ধ করে থাকবো, তুমি আমাকে জোর করে খাওয়াবে। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই। ঠোকাঠুকি আছে, মন-কষাকষি নেই।

হালআমলে অর্থাৎ ঊনপঞ্চাশী হাঙ্গারস্ট্রাইকের নীতি দেখলাম অন্য রকম। পেয়াদাটাকে যখন হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে, তখন ওর ওপরেই নাও এক হাত। ও যেমন তোমার পোলিটারিয়েট নাকের মধ্যে রবারের নল চালিয়ে দুধ ঢালছে, তুমি ওর বুর্জোয়া কানের মধ্যে বস্তি-নিঃসৃত বাক্য-সুধা বর্ষণ কর! সুযোগ পেলে তোমার হাতুড়ি ও কাস্তে মার্কা বদ্ধমুষ্টি চালিয়ে ওর ঐ পুঁজিবাদী নাকটাকে উড়িয়ে দিতে পার। ঢিল খেয়ে ও যদি পাটকেলটা ছোঁড়ে, তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। প্রপাগাণ্ডার ডাণ্ডা চালিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করবার উত্তম সুযোগ। উনপঞ্চাশ সালের কমরেডি হাঙ্গার স্ট্রাইকের প্রধান তত্ত্ব ছিল এই প্রচার।

মোটামুটি ভাবে হাঙ্গারস্ট্রাইক মাত্রেই একটা শব্দহীন লাউড-স্পীকার। জনগণের কানের পর্দাকে প্রবল বেগে আঘাত করবার মতো এত সহজ আর এমন অব্যর্থ অস্ত্র আর কিছুই নেই। আপনার বক্তৃতা যখন শ্রোতা পায় না, বিবৃতি পায় না পাঠক, কিংবা স্লোগান-মুখর শোভাযাত্রা যখন দর্শক-অভাবে শোভাহীন, তখন আপনার নেতৃত্বরক্ষার একমাত্র পথ,—জেলে গিয়ে হাঙ্গারস্ট্রাইক। দ্রুত বিস্মরণশীল জনতা অন্তত কিছুদিন আপনাকে স্মরণে রাখবে।

কিন্তু অনশন যেখানে নিছক রাজনৈতিক, তার মধ্যে উত্তেজনা যতই থাক রস নেই বিশেষ করে জেলবাবুদের কাছে ওগুলো একেবারে বিস্বাদ এবং বিবর্ণ। তার উদ্দেশ্য থেকে বিধেয়, সবটুকু আমাদের কণ্ঠস্থ। ও-পক্ষের ধরন-ধারণ এবং এ-পক্ষের বচন করণ, সব বিধিবদ্ধ, গতানুগতিক। যে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের ওটা একটা আনুষঙ্গিক উৎপাত মাত্র।

হাঙ্গারস্ট্রাইকের মধ্যে চমক আছে, আছে বৈচিত্রের রং, এবং সেটা দেখা দেয় তখনই যখন ও অস্ত্রটা পড়ে গিয়ে তাদের হাতে, যাদের আমরা বলি সাধারণ কয়েদী। বলা বাহুল্য এটা তাদের নিজস্ব হাতিয়ার নয়। তাদের অস্ত্রশালায় এর স্থান ছিল না কোনোদিন। তারা জানত, লড়াই-এর একমাত্র পথ—শত্রুর উপর লাফিয়ে পড়, উদ্যত হাতিয়ার দিয়ে আঘাত কর তার দেহে। কিন্তু শুধু শুয়ে থেকে আর পড়ে থেকেও যে লড়াই চলে—এমন লড়াই, যার কাছে প্রতিপক্ষের সমস্ত অস্ত্র অকেজো হয়ে যায়, সেটা তারা প্রথম দেখল ‘স্বদেশীবাবু’দের শিবিরে। সেখান থেকেই তাদের দীক্ষা। তারপর স্থানে-অস্থানে এই অপূর্ব অস্ত্র তারা প্রয়োগ করেছে এবং এখনও করছে, কখনও ব্যক্তিগত, কখনও দলগত প্রয়োজনে। তার কাহিনী বিচিত্র।

সাতচল্লিশ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা যখন এল, কোনও একটা সেন্ট্রাল জেলের দীর্ঘমেয়াদী কয়েদীরা বলে বসল, আমরা মুক্তি চাই। যুক্তিটা কি? জানতে চাইলেন কর্তৃপক্ষ। উত্তর অত্যন্ত সরল—অপরাধ যা করেছিলাম সে সেই ব্রিটিশ-রাজত্বে। এতদিন তো তার ফল-ভোগ করলাম। আর কেন? পরাধীন যুগের দণ্ড যদি স্বাধীন যুগেও কায়েম রাখবে, তবে এ স্বাধীনতার মূল্য কি? বলে তারা হুঙ্কার ছাড়ল—এ আজাদি ঝুটা হ্যায়।

সরকার নামক যে একটি নৈর্ব্যক্তিক গোষ্ঠী আছে, সকল দেশে এবং সকল যুগেই তার রসবোধ বড় কম। ‘রিলিজ’-এর বদলে তাঁরা মঞ্জুর করলেন কিঞ্চিৎ ‘রেমিশন’। অর্থাৎ দণ্ডের শেষ না করে, করলেন হ্রাস। পরদিন থেকেই ব্যারাকে ব্যারাকে শুরু হল হাঙ্গার- স্ট্রাইক পর্ব। সারি সারি শুয়ে পড়ল দশ, বারো, বিশ কিংবা পঁচিশ বছরের দল, যাদের বুকের উপর ঝুলছে খুন, রাহাজানি, দাঙ্গা আর নারী-ধর্ষণের চাকতি। স্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা বিস্ময়ের চেয়ে বিরক্ত বোধ করলেন বেশি, তার সঙ্গে বোধহয় কিঞ্চিৎ কৌতুক, এই ভেবে, যে একদা যাঁদের হাতে এঁরা দীক্ষা নিয়েছিলেন আজ তাঁদেরই এঁরা কিঞ্চিৎ শিক্ষা দিতে উদ্যত।

একদিন গেল, দু-দিন গেল, তিনদিনের দিন রঙ্গমঞ্চে দেখা দিল একদল ডাক্তার আর সেই বড় বড় রবারের নল আর বালতি বালতি দুধ, বার্লি, ডিম, কমলালেবু, গ্লুকোজ, আর কি সব ওষুধপত্তর। ফানেল-ভর্তি সেই সব রসায়ন নলযোগে চলে গেল নাসিকা টানেলের মধ্যে। রসনা তৃপ্তি না হোক, উদরপূর্তির তরল ব্যবস্থা। ‘স্বদেশী’ হাঙ্গারস্ট্রাইকের চিকিৎসা-পদ্ধতিও ছিল ঠিক একই রকম। তফাত এই যে, তাঁরা ঐ নলটাকে যথারীতি অস্বীকার করে মাথা-নাড়া দিতেন, আর সরকার পক্ষ থেকে মাথাটা যথারীতি চেপে ধরা হত। কিন্তু তাঁদের এই মন্ত্রশিষ্যেরা এই অনাবশ্যক আবরণটা অতিক্রম করে গেল। মাথা নাড়া আর মাথা ধরার প্রয়োজন রইল না। বরং আরও দু-চারদিন যেতেই দেখা গেল ঐ বালতি আর রবারের নলটির উপর অনশনকারীর আকর্ষণ ক্রমশ দুর্বার হয়ে উঠেছে। নির্দিষ্ট সময়ে তারা দেখা না দিলে সারি সারি চোখগুলো তৃষিত প্রতীক্ষায় দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।

কর্তৃস্থানীয় জনৈক জবরদস্ত উপরওয়ালা একদিন এই দৃশ্য লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “ডাক্তার না এনে তোমাদের আনা উচিত ছিল গোটাকয়েক হান্টার। তাহলে এ দুর্ভোগ আর একদিনও ভুগতে হত না।’ তাঁর পরামর্শ অবশ্য গৃহীত হয়নি। তবু দুর্ভোগ বেশীদিন ভুগতে হল না। আপনা হতেই একদিন দেখা গেল খাদ্যের রূপান্তর ঘটেছে—তরল থেকে কঠিন স্তরে এবং প্রবেশপথ নাসিকা নয়, মুখবিবর।

“দায়মলি”দের* এই দলবদ্ধ অনশনের উদ্দেশ্য যাই হোক, ধরনটা ছিল রাজনৈতিক। অনেকটা সেই স্বদেশীবাবুদের পুরানো রাস্তা। কিন্তু করণ সিং-এর হাঙ্গারস্ট্রাইক একেবারে তার নিজস্ব। উদ্দেশ্যই যে শুধু অভিনব তাই নয়, ধরনটাও নতুন। কতগুলো দুঃসাহসিক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত একটা গ্যাঙ কেস্-এ আরও কয়েকজনের সঙ্গে করণ সিং-এর জেল হল দশ বছর। দলবল থেকে আলাদা করে তাকে পাঠানো হল এক সেন্ট্রাল জেলে। গৌরবর্ণ দেহ, বাঁশির মতো নাক, রুক্ষ আয়ত চোখ। খাবারের থালার দিকে তাকিয়েই ঝাঁঝিয়ে উঠল, লে যাও। নেহি খায় গা।

[* খুন এবং খুন-সহ ডাকাতির অপরাধে যাদের বিশ এবং পঁচিশ বছর জেল হয়, সিপাই-মহলের চলিত ভাষায় তাদের বলে দায়মলি।]

—কেন, খাবে না কেন? জানতে চাইল রন্ধনশালার মেট।

—ইয়ে গোশত্ হালাল হ্যায়।

—তবে কী গোশত্ খাবে তুমি?

উত্তরে সে যা জানাল, তার মানে—জবাই-করা জানোয়ারের মাংস যা বাজারে পাওয়া যায়, তার কাছে শুধু অখাদ্য নয়, অস্পৃশ্য। কোনো দেবস্থানে বলিদত্ত যে পশু তারই মাংস চাই, আর তার সঙ্গে চাপাটি। এই তার দৈনন্দিন খাদ্য। বাজে জিনিস তার রুচবে না। কর্তৃপক্ষ জানালেন, সেটা সম্ভব নয়। বেশ, তাহলে খাদ্যগ্রহণও সম্ভব নয় করণ সিং-এর পক্ষে।

চলল হাঙ্গার স্ট্রাইক এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এবেলা ওবেলা নেজাল ফিডিং। বুঝিয়ে সুঝিয়ে হার মানল জেলের লোক। সুপার এসে যথারীতি ওয়ার্নিং দিলেন। তারপর একটি একটি করে প্রত্যাহার করা হল কারাজীবনের যা কিছু সুবিধা সুযোগ। কেটে নেওয়া হল তার যা কিছু ছিল অর্জিত রেমিশন, বন্ধ হল ভবিষ্যৎ অর্জনের অধিকার। তারপর এল চরম পন্থা। অর্থাৎ আইনভঙ্গের মামলা দায়ের হল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। হাকিম এলেন। কোর্ট বসল সুপারের ঘরে। আসামীর ওঠবার শক্তি নেই। স্ট্রেচারে করে আনা হল হাকিমের কাছে। তুমি দোষী না নির্দোষ—প্রশ্ন করলেন কোর্ট।

আসামী নিরুত্তর! অনেক করে আবার বোঝালেন হাকিম। জেলকোডের নির্ধারিত খাদ্য বর্জন করা গুরুতর অপরাধ। তার জন্য দণ্ড বেড়ে যাবে। করণ সিং মুদ্রিত-চক্ষু, নির্বিকার। ছ’মাস জেল দিয়ে চলে গেলেন হাকিম।

এমনি করে কেটে গেল কয়েক মাস। কেটে গেল বছর। খবর পেয়ে পাঞ্জাবের কোন্ দূর গ্রাম থেকে এল তার বাপ। ক্ষীণদৃষ্টি, ভগ্নদেহ। বয়স পার হয়ে গেছে সত্তরের কোঠা। জেল-ডাক্তার তার কম্পিত শীর্ণ হাতে তুলে দিলেন একটা কমলালেবু। ছেলের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে আস্তে আস্তে বলল বৃদ্ধ, খেয়ে নে। আমি আর কদ্দিন? আর তোকে বলতে আসবো না।

করণ সিং-এর চোখ খুলে গেল। রক্তাভ ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। রুক্ষ-কণ্ঠে বলল, বিরক্ত কোরো না। বাড়ি ফিরে যাও।

—তুই আমার জোয়ান ছেলে না খেয়ে জান দিবি জেলখালায়, আমি বাড়ি ফিরবো কোন্ মুখে? তোর মা থাকলে কি এমন করে ফেরাতে পারতিস তাকে?

ছেলের বুকের উপর ভেঙে পড়ল বিপত্নীক বৃদ্ধ। চারদিকে যারা দাঁড়িয়ে ছিল জেলরক্ষী আর জেলবন্দী, সবারই চোখ সজল হয়ে উঠল। কিন্তু করণ সিং-এর নিমীলিত চোখের কোণে একবিন্দু জলরেখা দেখা দিল না।

ক্ষিতীশ রুদ্র জেলে এসেছিল কোন্ এক দাঙ্গা কেস্-এর আসামী হয়ে। তারপর চার বছর জেল হয়ে গেল। বছরখানেক কেটে যাবার পর হঠাৎ একদিন তার মনে হল একটু চা না হলে জীবন দুর্বহ। তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীদের খাদ্যতালিকায় চা অনুপস্থিত। সেকথা তাকে জানানো হল। উত্তরে বলল ক্ষিতীশ, তা জানি। কিন্তু আমি চা চাইছি on medical ground, অর্থাৎ ওজন কমে গেলে কিংবা শরীর খারাপ হলে যেমন দুধ মাখন কিংবা অতিরিক্ত মাছমাংসের বরাদ্দ করেন মেডিক্যাল অফিসার, তেমনি ক্ষিতীশ রুদ্রের দাবি হল সামান্য এক কাপ চা।

কিন্তু চায়ের অভাবে শরীর তো তোমার খারাপ হয়নি? প্রশ্ন করলেন ডাক্তার। ক্ষিতীশ নিঃশব্দে চলে গেল।

মাসখানেক পরে আবার এল টিকিট নিয়ে। চোখের কোণে কালি পড়েছে, বেরিয়ে এসেছে কণ্ঠার হাড়। ওজন কমে গেছে আট পাউণ্ড। মুখে জয়োল্লাসের মৃদু হাসি। ডাক্তারও হাসলেন, টিকেটখানা চেয়ে নিয়ে কি খানিকটা লিখলেন তার পিঠে। পরদিন সকালে চা-এর বদলে এল এক চার্জ। স্বাস্থ্যের প্রতি ইচ্ছাকৃত অবহেলার অপরাধে সুপারের সামনে হাজির হল ক্ষিতীশ রুদ্র। ব্যাপার শুনে সুপার একটা ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ক্ষিতীশ তার দাবি ছাড়ল না। সেদিন বিকালেই রিপোর্ট দিল বড় জমাদার, ক্ষিতীশ খানা ছোড় দিয়া।’

কয়েদী-মহলে কিঞ্চিৎ কৌতুকের উদ্রেক হল। করণ সিং-এর আচরণে সমর্থন না থাক, সম্ভ্রম বোধের অভাব ছিল না। কিন্তু ক্ষিতীশ রুদ্রের ব্যাপার নিয়ে চলল লঘু আলোচনা। লোকে দেশের জন্যে প্রাণ দেয়, প্রিয়ার জন্যে জান দেয়; সেটা নতুন নয়, আশ্চর্যও নয়। কিন্তু তুচ্ছ এক পেয়ালা চা-এর জন্যে পৈতৃক প্রাণটা বিলিয়ে দিচ্ছে, এত বড় শহীদ এই প্রথম দেখা গেল। ক্ষীতিশের ভ্রূক্ষেপ নেই। মাসকয়েক কেটে গেল ডিম দুধ আর কমলার রস নাসাধঃকরণ করে।

ইতিমধ্যে তার মায়ের কাছ থেকে এল এক চিঠি। এই অহেতুক আত্মহত্যার পথ থেকে নিরস্ত হবার জন্যে নানারকম উপদেশ দিয়ে শেষের দিকে লিখেছেন, ‘মনে রেখো তুমি যেখানে আছ, সেখানে লোকে আরাম করতে যায় না, যায় কৃত অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে। সেকথা ভুলে গিয়ে যারা জেলে গিয়েও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আবদার করে, তারা জানে না যে সেটা বাহাদুরি নয়, নির্লজ্জ কাঙালপনা। তোমার আচরণে তুমি লজ্জিত হবে, তোমার মা হয়ে এইটুকু শুধু তোমার কাছে আশা করি!’

এ চিঠি পাবার পরেও ক্ষিতীশের অনশন অব্যাহত রইল, কিন্তু অবস্থার ঘটল দ্রুত অবনতি। কর্তৃপক্ষ চিন্তিত হলেন। মায়ের কাছে জরুরী তার গেল—তাঁর ছেলের অবস্থা গুরুতর। ইচ্ছা করলে তিনি এসে দেখে যেতে পারেন। তিনি এলেন না। লিখে পাঠালেন : আমি গিয়ে কি করবো! যে-ছেলের কাছে মা-এর চেয়ে চা-এর দাবি বড় তাকে আমার বলবার কিছু নেই।

চিঠিখানা পড়িয়ে শোনানো হল ক্ষিতীশকে। সেদিন বিকালেই আবার খবর নিয়ে এল বড় জমাদার : ‘ক্ষতিশ অন্‌শন্ তোড় দিয়া।

না, আমরণ অনশনের চরম পরিণাম দেখবার দুর্ভাগ্য আমার ঘটেনি। দেখেছি তাদের বৈচিত্র্যময় পরিণতি। কোনোটা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, কোনোটা আংশিক। কোনোটা আপাত-জয়লাভের গৌরব না পেলেও আসন্ন জয়ের পথ খুলে দিয়ে গেছে। কোনোটা আবার শেষ হয়েছে গিয়ে কোনও অপ্রীতিকর সীমানায়, রেখে গেছে শুধু তিক্ত স্মৃতি। যবনিকা যেখানেই পড়ুক এবং যে-ভাবেই পড়ুক, সব চেয়ে খুশী হয়েছি আমরা, অর্থাৎ জেলের লোক। নাকের বদলে মুখের বিবরে এক পেয়ালা ডাবের জল বা কমলার রস ঢেলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আফিসে ফিরে গেছি। মুক্তি পেয়েছি দৈনন্দিন রিপোর্ট পাঠাবার দুরূহ কর্তব্য থেকে। সতত-দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে ডাক্তারবাবুরা।

দীর্ঘ অনশন শেষে কেউ দীর্ঘদিনের জন্যে পঙ্গু হয়ে গেছে, কেউ বা চিরকালের তরে সার করেছে পাকযন্ত্রের বৈকল্য, কারও আবার সারাজীবনের সঙ্গী হয়েছে দুরারোগ্য বাতব্যাধি। অনশন ভঙ্গের অনুরোধ জানাতে গিয়ে কিংবা অবধারিত মৃত্যুর কবল থেকে মানুষকে বাঁচাবার যে প্রাথমিক দায়িত্ব, তাই পালন করতে গিয়ে অভিনন্দন যা লাভ করেছি তাও কৌতুকময়। কেউ দিয়েছেন নীরব ঔদাসীন্য, কারও কাছে লাভ করেছি অকথ্য কটূক্তি এবং ইচ্ছাকৃত অপমান, কারও হাত থেকে পেয়েছি আকস্মিক আক্রমণ। মনে পড়ে একবার কোনও এক রাজনৈতিক দলে কয়েকজন পাণ্ডা কী একটা দাবি জানিয়ে হাঙ্গারস্ট্রাইক শুরু করলেন। বন্ধুরা পালা করে উদয়াস্ত তাঁদের ঘিরে বসে আছেন। ডাক্তার কাছে গেলে তেড়ে আসেন। অন্য কোনও জেল-অফিসার দেখামাত্র একেবারে মারমুখী। এদিকে ওঁদের নাসিকা-ভোজন একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু বন্ধুরা বাধা না দিয়ে ছাড়বেন না। সুতরাং আমাদের একমাত্র পন্থা হল শুভাকাঙ্ক্ষীদের কবল থেকে ওঁদের নিঃশব্দে হরণ করে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।

আর কালবিলম্ব না করে দলবল নিয়ে হানা দেওয়া গেল। কয়েকজন কুস্তিগির সিপাইকে নির্দেশ দেওয়া হল—যাঁরা আক্রমণ করবেন তাঁদের প্রতিরোধ করবার প্রয়োজন নেই, শুধু বাহুবিস্তার করে সস্নেহে আলিঙ্গন করলেই চলবে। ওয়ার্ডের কাছাকাছি যেতেই শুরু হল তর্জন-গর্জন। সে সব অগ্রাহ্য করে স্ট্রেচারগুলো চলে গেল ভেতরে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম একতলার দরজার ঠিক বাইরেটায়। হঠাৎ পাশের অন্য একটা ব্যারাকের দোতলা থেকে চিৎকার করে উঠল একজন সাধারণ কয়েদী, সরে যান, স্যার।’ হুঁশিয়ারিটা কার উদ্দেশ্যে না জেনেই খানিকটা পিছিয়ে গেলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ইঞ্চিতিনেক দূরে সশব্দে ভেঙে পড়ল একটা মাটিভর্তি মস্ত বড় পাতাবাহারের টব। ওটা যে উপরের বারান্দা থেকে আমারই শিরোদেশ লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, সেটুকু বুঝতে দেরি হল না। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝলাম যে সরে যেতে আর এক সেকেণ্ড দেরি হলে আপনাদের আজ এমন জরাসন্ধের কবলে পড়তে হত না।

হাঙ্গারস্ট্রাইক কেন হয়, কোথায় তার মনস্তাত্ত্বিক- পটভূমি—সে-সব তত্ত্ব উদ্ঘাটন করবার মতো সন্ধানী আলো আমার চোখে নেই। দীর্ঘকাল ধরে সাদা চোখে যা দেখলাম, তাতে এই কথাই মনে হয়েছে—সব হাঙ্গার স্ট্রাইকের অন্তরালে একটা সাধারণ সূক্ষ্ম অনুভূতি লুকিয়ে আছে। তার নাম অভিমান। বিচিত্র তার রূপ, বিভিন্ন তার লক্ষ্য। সে অভিমান কখনও রাষ্ট্র বা সমাজ-ব্যবস্থার উপর, কখনও নিজের উপর, কখনও কোনো আত্মজনের উপর, আবার কখনও বা অস্পষ্ট অনির্দেশ্য কোনও আদর্শের উপর। বাড়িতে মা অথবা স্ত্রীর উপর রাগ করে না খেয়ে থাকা আর জেলে সরকার বা তার কোনও প্রতিনিধির উপর রাগ করে না খেয়ে থাকা—তলিয়ে দেখলে এ দুটো একই বস্তু। জাত একই, তফাত শুধু রূপের। এ দুয়ের পেছনে যে ভাবাবেগ তার “কাইণ্ড” এক, তফাত শুধু “ডিগ্রির”।

সব মানুষের মনের মধ্যেই অভিমান আছে। কিন্তু কারাজীবনের আলো-বাতাসে ছড়িয়ে আছে তার পুষ্টির উপাদান। একজন আধুনিক কারাতত্ত্ববিদ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে ক্রিমিনালই হচ্ছে সব চেয়ে বুদ্ধিমান জাত।’ ‘ক্রাইম’-এর পেছনে বুদ্ধির প্রয়োজন, সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্রাইম করবার পর জেলে যখন সে আসে, তার বুদ্ধি-প্রয়োগের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ে। যত দিন যায়, তার মাথার দিকটায় ভাঁটা পড়তে থাকে, জোয়ার দেখা যায় বুকের দিকে। দৈনন্দিন জীবনের যে শক্তি তাকে চালিত করে, তার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তি যতখানি, তার চেয়ে ক্রমশ বাড়তে থাকে হৃদয়বৃত্তি। যুক্তির চেয়ে প্রবল হয়ে ওঠে ভাবালুতা। বৃহৎ জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, ঐ পাষাণ বেষ্টনী ঘেরা ক্ষুদ্র পৃথিবীর মধ্যে বসে বসে তার কেবলই মনে হতে থাকে এ দুনিয়ায় তার কেউ নেই, সংসারে সবার কাছে, সব কিছু থেকে সে বঞ্চিত, সকলের দ্বারা সে বর্জিত। তাই সবার বিরুদ্ধে তার দুরন্ত ক্ষোভ, সকলের উপর তার দুর্জয় অভিমান। কয়েদী জাতটা বুদ্ধিমান, একথা হয়তো সত্য। কিন্তু তার চেয়ে স্পষ্টতর সত্য—তারা অত্যন্ত অভিমানী এবং অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর।

হাঙ্গারস্ট্রাইক অনেক ঘটেছে আমার জীবনে। পিছনের দিকে তাকিয়ে সেইসব অভিমান-ক্ষুব্ধ শীর্ণ মুখগুলো আজ দেখতে পাচ্ছি। সারি সারি শুয়ে আছে হাসপাতালের লোহার খাটে। কেউ বা একান্ত নিঃসঙ্গ—পড়ে আছে কোনও নির্জন সেল-এর সংকীর্ণ অন্ধকারে। কোনোটা ঝাপসা হয়ে গেছে, কোনোটা বা আজও স্পষ্ট।

তারই মধ্যে একখানা বিবর্ণ মুখ যেন জ্বল্ করছে চোখের উপর। মনে পড়ছে প্রথম যেদিন সে এল। কালো ঘেরাটোপঢাকা কয়েদী-গাড়ি থেকে নেমে এসে দাঁড়াল আউটার আর ইনার গেটের মাঝখানে। লম্বায় প্রায় ছ’ফুট, প্রশস্ত বুক, ঈষৎ সোনালী রং-এর কোঁকড়ানো চুল নেমে এসেছে কাঁধের উপর। তার উপরে বিশাল পাগড়ি। আধময়লা জোব্বার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে উজ্জ্বল দেহশ্রী। নামটাও জমকালো সৈয়দ আফজল খাঁ। পাঠান না আফগান ঠিক জানি না। উত্তর পশ্চিম সীমান্তের কোনও প্রান্তে তার দেশ। ওয়ারেন্ট খুলে দেখলাম, ৩৯৬ আই. পি. সি.। ডাকাতির সঙ্গে নরহত্যা। শুনলাম, তিন-চারটা মারাত্মক মামলার সঙ্গে সে জড়িত। তাই কোর্টে যাওয়া-আসার পথে প্রিজনভ্যানের মধ্যেও তার হাতে পড়ল হাতকড়া। একদিন এই নিয়ে লেগে গেল পুলিশের সঙ্গে। হাবিলদার বলল, হাতকড়া খুলে দিলে কোন্ দিন তুমি লাফিয়ে পড়ে ছুট্‌ দাও, কে জানে? —যদি দিই, আটকাতে পারবে? বলে এক দুই তিন ঝটকায় ভেঙে ফেলল হাতকড়া। লাফিয়েও পড়ল না, ছুটও দিল না। শুধু দেখিয়ে দিল, সে সবই পারে। তারপর থেকে কোর্টের পথে তার ডাইনে বাঁয়ে লেগে থাকত দুজন করে রাইফেলধারী গুর্খা।

যেমন বিশাল বপু, তেমনি বিপুল তার দক্ষিণ-হস্তের ব্যাপার। কিন্তু আফজল খাঁর দীর্ঘ হাজতবাসের মধ্যে ওদিকটা নিয়ে মাথা আমাদের ঘামাতে হয়নি। শহরের প্রান্তে ওদের মস্ত বড় ঘাঁটি। সেখান থেকে ওর বন্ধুরা নিয়মিত যোগান দিত ডেকচি-ভর্তি খাসী বা ভেড়ার মাংস, মোটা মোটা ঘৃত-জর্জর চাপাটি আর সেই সঙ্গে আঙুর-আনার-কাজু- মনাক্কার প্যাকেট। বিচারাধীন আসামীর বাইরে থেকে খাদ্য-প্রাপ্তি আইনসিদ্ধ। জেল হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে অধিকার চলে যায়। তখন সে পুরোপুরি জেলের পোষ্য। সুতরাং সাত বছর মেয়াদ নিয়ে যেদিন কোর্ট থেকে ফিরে এল আফজল খাঁ, উভয় দিকেই সমস্যা দেখা দিল।

তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী-খাদ্য তিন প্রকার—বেঙ্গল ডায়েট (দুবেলা ভাত), বিহার ডায়েট (একবেলা ভাত, একবেলা রুটি), আর পাঞ্জাব ডায়েট (দুবেলাই রুটি)।

প্রথামত ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, কোন্ ডায়েট নেবে তুমি?

আফজল খাঁ গম্ভীর ভাবে বলল, আফগান ডায়েট।

ডাক্তারের কোডে এ হেন বস্তুর উল্লেখ নেই। সুতরাং বিকল্প ব্যবস্থা হল—পাঞ্জাব ডায়েট্। ডাক্তারের বোধ হয় মনে হয়েছিল, এই পেশোয়ারী পাহাড়টিকে আর যেখানেই হোক্ অন্নভোজী এলাকায় ফেলা যায় না। আফজল নালিশ জানাতে এল আমার কাছে। সোজাসুজি মন্তব্য করল, আপকা জেলমে ইন্‌সাব্ নেহি হ্যায়।

বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন, কি অবিচারটা দেখলে তুমি?

—আপ্‌কা বেঙ্গল ডায়েট হ্যায়, বিহার ডায়েট্ হ্যায়, পাঞ্জাব ডায়েট্ ভি হ্যায়, আফগান ডায়েট্ কেঁও নেই হোগা?

সঙ্গত প্রশ্ন। জিজ্ঞাসা করলাম, আফগান ডায়েট্ কি পদার্থ খাঁ সাহেব?

—লিখ্‌ লিজিয়ে, বলে একটা দৈনিক খাদ্যতালিকার ফিরিস্তি দিয়ে গেল আফজল খাঁ। “সেরভর দুম্বারা গোশত্‌” বিকল্পে খাসীর মাংস থেকে শুরু করে আটা মাখন দুধ মশলা পেস্তা বাদাম ফলমূল এবং সকলের শেষে এক প্যাকেট সিগারেট যোগ করে যখন থামল, হিসাব কষে দেখলাম, তার দাম কম করে ধরলেও ছ’টাকা বারো আনা। একজন সাধারণ কয়েদীর রোজকার বরাদ্দ শুধু বারো আনা কিংবা তার চেয়েও কম। সুতরাং আফজল খাঁর দাবিপূরণ যে আমাদের শক্তির বাইরে একথা স্পষ্ট করেই জানাতে হল। সেও ঠিক তেমনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে গেল যে, এ ছাড়া এবং এর চেয়ে কম কোনও খাদ্য সে গ্রহণ করবে না।

শুরু হল হাঙ্গারস্ট্রাইক।

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমার হাসপাতাল পরিক্রমার পালা। অন্য সব ওয়ার্ড থেকে দূরে এক কোণের দিকে আফজল খাঁর ছোট ঘরটিতে গিয়ে দেখলাম, তার নাসিকা- ভোজনের আয়োজন চলছে। একটা বেশ বড় বালতি ভরা দুধ। ডিম কমলালেবু ইত্যাদির পরিমাণটা রীতিমত রাজসিক। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাঙ্গারস্ট্রাইকের রুগী আপনার কজন?

—আজ্ঞে একজন, বলে ডাক্তার একটু হাসলেন। কৌতূহল হল। দাঁড়িয়ে গেলাম খানিকক্ষণ। ‘ফিড’ শুরু হল। একটা বড় জগে করে ফানেলের মধ্যে মিশ্র রসায়ন ঢালা হচ্ছে, আর দুটো নল বেয়ে সেটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে উন্নত নাসারন্ধ্রে। এক একটা জগ শেষ হয়, আর চেঁচিয়ে ওঠে আফজল, আউর দেও। জগ ভরতে যেটুকু দেরি তার মধ্যে আবার হুঙ্কার দেয়, আউর দেও। এমন করে গোটা বালতিটা নিঃশেষ হয়ে গেল।

আফজল খাঁর অনশন যে একটা ক্ষণস্থায়ী খেয়াল, সে বিষয়ে আমাদের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। আমার অফিসারদের মতে, যে-লোক সারাজীবন ধরে শুধু মণ মণ মাংস চিবিয়ে এসেছে, সে নাক দিয়ে দুধ গিলে কতদিন থাকবে? পেটের ক্ষিদে না হয় মিটল, দাঁতের ক্ষিধে মেটাবে কি দিয়ে? কিন্তু দেখলাম, আমরা ভুল করেছি। মাস কেটে গেল। আস্তে আস্তে শয্যার সঙ্গে মিশে গেল সেই বিশাল দেহ কিন্তু মন রইল অটল। পুরোপুরি আফগান ডায়েট না হলেও, স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে, তার কাছাকাছি খাদ্য-তালিকা মঞ্জুর করা অসম্ভব হবে না, এ রকম একটা আভাস তাকে দেওয়া হয়েছিল। কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।

একদিন কী একটা প্রয়োজনে বিকালে একবার যেতে হয়েছিল জেলখানায়। হাসপাতালে যখন পৌঁছলাম, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আফজল খাঁকে দেখে যাবার ইচ্ছা হল। একটা কম পাওয়ারের বাতি জ্বলছে তার ছোট ঘরটিতে। সেই মৃদু আলোয় তার রক্তহীন মাংসবিরল দীর্ঘ দেহটার দিকে চেয়ে শিউরে উঠলাম। ধীরে ধীরে খাটের পাশে যে চেয়ারখানা ছিল তার উপর গিয়ে বসলাম। একবার শুধু সে তার নিষ্প্রভ চোখদুটি মেলে আমার দিকে তাকাল। তারপর পড়ে রইল তেমনি নিস্পন্দ নিথর মৃতদেহের মতো। মনটা কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। মৃদুকণ্ঠে ডাকলাম, খাঁ সাহেব!

—সাব্!

—এমনি করে জান দিয়ে কী লাভ?

—এ জান রেখেই বা লাভ কি? ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিল আফজল!

চমকে উঠলাম। তবে কি আত্মহত্যার পিছনে আর কোনও নিগূঢ় কারণ আছে? আফগান ডায়েটটা শুধু অভিনয়? বললাম, এ কথা কেন বলছ? সাতটা বছর কতটুকু সময়? দেখতে দেখতে চলে যাবে। জোয়ান বয়স তোমার। নতুন করে ঘর বাঁধবে। গোটা জীবনটাই তো সামনে পড়ে আছে।

ক্ষীণ আলোকে মনে হল তার বিবর্ণ ওষ্ঠের কোণে যেন জেগে উঠল একটুখানি মৃদু হাসির আভাস। তেমনি ধীরে ধীরে বলল, ঘর আমার ভেঙে গেছে বাবুসাব!

—তোমার বাপ মা আছে?

—যখন দেশ ছেড়েছি, তখন ছিল। তারপর কি হয়েছে, জানি না।

—জেনানা?

—না সাহেব, সাদি হয়নি আমার।

—যাকে চেয়েছিলে তাকে পাওনি বুঝি?

আফজল খাঁ এ প্রশ্নের উত্তর দিল না। শোনা গেল মৃদু দীর্ঘনিঃশ্বাসের ক্ষীণ শব্দ। তারপর উদাস কণ্ঠে বলল, সে সব ব্যাপার ঢুকে-বুকে শেষ হয়ে গেছে। আজ নতুন করে সে কথা তুলে কোনও লাভ নেই।

বললাম, সংসারে কিছুই কোনোদিন চুকে যায় না আফজল খাঁ। ভাঙাগড়াই হচ্ছে দুনিয়ার নিয়ম। যাক্ রাত হল, এবার আমি উঠি।

আফজল খাঁ শীর্ণ হাতখানা কপালে ঠেকিয়ে সেলাম করল। আর কোনও কথা বলল না।

দিনতিনেক পরে সন্ধ্যেবেলা আমার বাংলো সংলগ্ন বাগানে একটা বাঁধানো চত্বরের উপর বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বর্ষণ-সিক্ত গাছপালার উপর সন্ধ্যার করুণ ম্লানিমা। সেদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, চারদিকে যা কিছু দেখছি, সব যেন কোনও প্রচ্ছন্ন বেদনার অদৃশ্য সূত্র দিয়ে গাঁথা। আলো নেই, আশা নেই; সংসারের আসল রূপ এমনি অশ্রুসজল।

টেলিফোন বেজে উঠল। আশ্চর্য ব্যাপার! জেলর জানাচ্ছেন আফজল খাঁ আমার দর্শন প্রার্থী। ‘আজই?’ ‘হ্যাঁ।’

সেই ছোট্ট ঘরখানায় স্তিমিত আলোয় বসে অনেকক্ষণ ধরে শুনে গেলাম আফজল খাঁর ক্ষীণ কণ্ঠের গুঞ্জরণ। বিশেষ কোনও ভূমিকা দিয়ে শুরু হয়নি তার কথা। আমার অনুচরদের যখন ঘর থেকে সরিয়ে দিলাম সে বলল, আপ্ জেহল্কা বড়া সাহেব, ম্যায় আপ্‌কা কয়েদী—

বাধা দিয়ে বললাম, আজকের সন্ধ্যাটা অন্তত সে ব্যবধান আমাদের না-ই বা রইল খাঁ সাহেব।

এর পরেই আর কিছু না বলে সে সোজা চলে গেল তার কাহিনীতে।

সৈয়দ বংশের ছেলে। ঘরে খাবার-পরবার অভাব নেই। আফজল ছেলেবেলা থেকেই একটু খেয়ালী এবং বেপরোয়া। রূপ এবং স্বাস্থ্য—এর কোনোটাতেই খোদা তার বেলায় কার্পণ্য করেননি। তাছাড়া তার রাইফেলের নিশানা ছিল নির্ভুল এবং শিকারের নেশা দুর্নিবার। রুক্ষ, কঙ্করময় তাদের দেশ। কোথাও নেই একবিন্দু শ্যামলিমা। তবু অদ্ভুত মায়া ছিল তার সেই দেশের ওপর। বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে তার ভারি ভাল লাগত। এমনি এক উদ্দেশ্যবিহীন পথচলার ফাঁকে খেজুরবনের ছায়ায় তার সঙ্গে দেখা। মাথায় জলের ঘড়া। ফিরছিল দূরের কোনও ঝরনা থেকে। আওরত; কিন্তু রক্ত-মাংসের নয়। বাস্ত্রাই গোলাপের কোমল পাপড়ি দিয়ে তৈরি তার দেহ। আর মুখখানা? আফজলের মনে হল, সেটাও ঠিক মুখ নয়, একটি সদ্য-স্ফুট শিশিরধোয়া রক্তগোলাপ। প্রথম দিন কোনও কথা হয়নি। হয়েছিল শুধু ক্ষণিকের দৃষ্টিবিনিময়। চোখের ভিতর থেকে এক ঝলক বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিয়ে ঘাঘরা দুলিয়ে সে উঠে গেল চড়াই পথ বেয়ে। আফজলও ফিরে এল, কিন্তু সে শুধু তার দেহ। তার সবটুকু দিল্ সে রেখে এল ঐ ঢালু পাহাড়ের বাঁকে।

তারপর আবার দেখা হল। তারপর আবার এবং তারপরে বারংবার। পরিচয় হল। আস্তে আস্তে হল প্রাণ দেয়া-নেয়া। আসমানী—(নামটা আমার দেওয়া নয় বাবু সাব বলেছিল আফজল, ওর বাপ-মা-ই রেখে গিয়েছিল। তা না হলে ঐ নামেই ডাকতাম আমি। সে তো দুনিয়ার নয়, আসমানের)—আসমানী কুমারী নয়, এক বৃদ্ধ রু সর্দারের বিবি। সমস্ত দিন তার সেবা করে তার রূঢ় গঞ্জনা সয়ে সয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল একটু আলোর জন্যে, একটু হাওয়ার জন্যে। খোদা মেহেরবান্। তার জীবনের সেই আলো আর হাওয়া নিয়ে এল আফজল। ওর প্রশস্ত বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কোমল কণ্ঠে বীণার মৃদুতান তুলে এই ভাষায় সে কথা বলত। ঊষর উদাস মাঠের দিকে চেয়ে নিঃশব্দে শুনে যেত আফজল, শুধু কান দিয়ে নয়, সমস্ত অন্তর দিয়ে।

একদিন কি খেয়াল হল আফজলের। বলে উঠল, ‘চল, তোমার সর্দারকে দেখবো।

–কেন, সর্দারনীকে দেখে বুঝি আশ মিটছে না? চোখের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল আসমানী।

–এইটুকুতে কি আশ মেটে আসমান? গাঢ় স্বরে বলল আফজল। সবটুকু না পেলে দিল্ ভরে না, শুধু হাহাকার করে বুকের ভেতরটা।

কাছে টেনে নিয়ে আসমানীর মাথাটা সে চেপে ধরল বুকের উপর, যার ভিতরে তোলপাড় করছে তাজা রক্তের ঢেউ। আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শুষ্ক স্বরে বলল আসমানী, কিন্তু আমার যে হাত পা বাঁধা আফজল। এর বেশী তো আমার দেবার কিছু নেই।

টস্ করে মুক্তাধারার মতো ঝরে পড়ল চোখের জল। আতর-মাখা রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিল আফজল। হাত বুলিয়ে দিল আনার ফুলের মতো কোমল পেলব দুটি রক্তাভ গণ্ডে।

একদিন সত্যিসত্যিই সর্দারকে দেখতে গেল আফজল। বারান্দায় খাটিয়ার উপর পড়ে আছে একটা বিপুল মাংসপিণ্ড। যেমন কুৎসিত, তেমনি অসভ্য লোকটা। ওকে দেখেই রুখে উঠল, কে তুমি? কি চাই? তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ও, তুমিই আমার সুন্দরী বিবির রোশনাই দেখে মেতে উঠেছ। সুবিধা হবে না, মিঞা সাহেব। এক দিন স্রেফ পুড়ে মরবে। তার চেয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। বেঘোরে প্রাণটা দিয়ে লাভ কি?

আফজলের কানে এর একটা কথাও যায়নি। সে দাঁড়িয়েছিল আচ্ছন্নের মতো। এরই সঙ্গে ঘর করে আসমানী! ঐ কদাকার দেহটার পরিচর্যা করবার জন্যেই কি খোদা তাকে আসমান করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন?

ফিরবার পথে আসমানীর সঙ্গে দেখা। কি একটা বলতে গেল আফজল, কিন্তু গলায় তার স্বর ফুটল না। আসমানীর মুখে ম্লান হাসি। বলল, দেখলে আমার ঘর?

—এ ঘর ভেঙে তোমায় বেরিয়ে আসতে হবে আসমানী, চল আমরা কোথাও পালিয়ে যাই। চলে যাই কোনও দূর দেশে। কেউ জানবে না, কেউ আমাদের খোঁজ পাবে না।

–তোমায় তো বলেছি আফজল, সে উপায় আমার নেই। ঐ বুড়ো যদ্দিন বেঁচে থাকবে, এখান থেকে আমার নড়বার পথ বন্ধ।

—কেন?

—আমার বাবা যে আমাকে ঋণের দায়ে বাঁধা দিয়ে গেছে ঐ সুদখোর লোকটার কাছে। যতদিন ও ছেড়ে না দেয়, ওর সংসারে থেকেই সে ধার আমাকে শুধতে হবে।

এ সমস্যার হঠাৎ কোনও সমাধান আফজলের চোখে পড়ল না। কিন্তু তার বুকের মধ্যে বিঁধে রইল আসমানীর সেই অসহায় করুণ মুখখানা। সমস্ত চেতনার মধ্যে জেগে রইল শুধু একটি কথা—যেমন করেই হোক আসমানীকে বাঁচাতে হবে।

কিছুদিন কেটে গেল। পর পর ক’দিন নির্দিষ্ট গোপন স্থানে আসমানীর দেখা পাওয়া গেল না। দুশ্চিন্তা হল আফজলের। অসুখবিসুখ করেনি তো? পরদিন আবার গিয়ে উঠল সেই সর্দারের বাড়ি। আসমানীর কোনও সাড়া নেই। ওকে দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল বুড়ো সর্দার, আবার এসেছিস শয়তান?

—কেন মুখ খারাপ করছ খালি খালি? ঝাঁঝিয়ে উঠল আফজল,—আসমানী কোথায়?

—ওঃ, বড্ড দরদ দেখছি, বিকৃত কণ্ঠে বলল সর্দার। তারপর গর্জে উঠল! আসমানী কোথায় তা জেনে তোর কি হবে রে কুত্তা?

—খবরদার! গাল দিও না বলছি, রুখে উঠল আফজল।

—তবে রে হারামীকা বাচ্চা!

খাটিয়ার পাশে ছিল নাগরা। তারই একপাটি তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল আফজলের দিকে। জুতোটা সজোরে গিয়ে লাগল ঠিক তার মুখের উপর। আফগান রক্ত টগবগ করে উঠল। এক মুহূর্ত কি ভাবল আফজল খাঁ। তার পর ছুটে গেল বাইরে। দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো ছিল তার গুলি-ভরা রাইফেল। তুলে নিয়েই টেনে দিল ট্রিগার। অব্যর্থ সন্ধান।

কিছুক্ষণ যেন সম্বিৎ হারিয়ে ফেলেছিল আফজল। তারপর দেখল, খাটিয়ার উপর পড়ে আছে সর্দারের রক্তাক্ত অসাড় দেহ। তার উপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে আসমানী। তার বুকের বসন ভিজিয়ে দিয়ে বয়ে চলেছে রক্তের ধারা।

হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। তীরোজ্জ্বল কালো চোখের তারা থেকে ঠিকরে পড়ল অগ্নিশিখা! তীরের মতো ছুটে এল তীক্ষ্ণ স্বর—নির্লজ্জ, কাপুরুষ! মনে করেছ, আমার স্বামীকে খুন করলেই আমি তোমার হাতে ধরা দেবো। এই ছিল তোমার মতলব, না?

শান্ত অনুনয়ের সুরে বলল আফজল, বিশ্বাস কর আসমানী। কোনও মতলব নিয়ে আমি আসিনি। আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে চাই। কিন্তু তার জন্য তোমার স্বামীকে খুন করবো, না-না। শুধু অপমান সইতে না পেরে রাগের মাথায় –

—বেরিয়ে যাও, ক্রুদ্ধা নাগিনীর মতো গর্জে উঠল আসমানী, বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। খুনী, ডাকু, শয়তান…

সেইদিন কাউকে কিছু না বলে দেশ ছেড়ে হিন্দুস্থানের পথে বেরিয়ে পড়ল আফজল খাঁ।

আফজল ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ দম নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘আসল কথা কি জানো সাহেব, নিজের মনটাকে বুঝতে পারেনি আসমানী। ঐ বুড়ো জানোয়ারটাকে সে যে কতখানি ভালবেসেছিল সেটা প্রথম জানতে পারল তখন, যখন তার বুকের পাশ দিয়ে বিঁধে গেছে আমার রাইফেলের গুলি।

শহরের উপকণ্ঠে ওদের যে-দলটা ছিল, জেল হবার পরেও তারা মাঝে মাঝে দেখা করতে আসত আফজল খাঁর সঙ্গে। ইদানীং আর আসেনি। হয়তো তারা উঠে গেছে অন্য কোথাও। কিংবা হয়তো দেখা করার প্রয়োজন আর নেই। আফজল খাঁর ঘরে সেই সন্ধ্যাটি যেদিন কাটিয়ে এলাম তার ক’দিন পরেই একজন দর্শনপ্রার্থী এসে উপস্থিত হাঙ্গারস্ট্রাইক যারা করে বাইরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নিষিদ্ধ। সুতরাং মোলাকাতের আবেদন সরাসরি অগ্রাহ্য হবার কথা। তবু লোকটাকে ডেকে পাঠালাম। চেহারা এবং পোশাক দেখে মনে হল সে পাঠান। বলল, আফজল ওর ছেলেবেলার দোস্ত, দূর সম্পর্কের আত্মীয়তাও আছে কিছু, পাশাপাশি গ্রামে বাড়ি। জেলের মধ্যে না খেয়ে আছে, এই খবর পেঁয়ে দেশ থেকে ছুটে এসেছে ওকে একবার দেখবার জন্যে। এবার ‘হুজুর মেহেরবানি’ করে—তার বক্তৃতা শেষ হবার আগেই তার চোখের দিকে চেয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, আসমানীকে চেনো?

লোকটার মুখে পড়ল বিস্ময়ের ছায়া। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল, চিনি। কিন্তু হুজুর তাকে—

—কোথায় আছে সে?

—আছে আমাদের দেশেই। আগের মরদটা খুন হবার পর নিকা করেছে তারই এক চাচাতো ভাইকে।

আমাকে নীরব দেখে যোগ করল, সেই শয়তানীটার জন্যেই তো দোস্তকে দেশ ছাড়তে হল। একদিন খুব ভাব ছিল দুজনের। তারপর কি যে হল ওরাই জানে, হঠাৎ রটিয়ে দিল, তার বুড়ো সর্দারকে নাকি খুন করেছে আফজল।

লোকটা কিছু কিছু উর্দু জানে। আর একটু কাছে ডেকে নিয়ে বললাম, দ্যাখ খাঁ সাহেব, তোমার দোস্তের অবস্থা ভালো নয়। বাঁচবার আশা নেই বললেই চলে। কিন্তু জেলের মধ্যে যারা খানা ছেড়ে দেয়, বাইরের লোকের সঙ্গে তাদের দেখা করবার হুকুম নেই। তোমার বেলায় সে হুকুম আমি দিতে পারি—

খাঁ সাহেব কৃতজ্ঞতায় গলে গিয়ে বলে উঠল, হুজুর কা মেহেরবানি।

বললাম, কিন্তু সে মেহেরবানি আমি দেখাতে পারি শুধু এক শর্তে।

শর্তের বর্ণনা দিলাম! শুনে মুখ চুন হয়ে গেল পাঠান সর্দারের। মাথা নেড়ে বলল, একথা আমি বানিয়ে বলব কেমন করে? এর কোনোটাই যে সত্যি নয়।

গম্ভীরভাবে বললাম, বেশ, না বলতে পারো বলো না। তোমার দোস্তের সঙ্গে এ জীবনে আর দেখা হল না।

কিছুক্ষণ আপনমনে কি ভাবল পাঠান। তারপর বলল, আমি রাজী।

আমি নিজেই তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম। হাসপাতালের সেই ঘরটিতে। ঘরে ঢুকবার আগে আর একবার স্মরণ করিয়ে দিলাম সেই শর্তের কথা-দেখো খাঁ সাহেব, জবান দিয়েছ। কথার খেলাপ যেন না হয়।

—কভ্‌ভি নেহি—দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর করল পাঠান।

ভাষাহীন দুটি ঘোলাটে চোখ দিয়ে দোস্তের মুখের দিকে চেয়ে রইল আফজল। যেন ঠিক বুঝতে পারছে না। পাঠানের চোখদুটো ছলছল করে উঠল। কান্নাবিকৃত কণ্ঠে বলল, নিজের হাতে কেন জান দিচ্ছিস, দোস্ত? এই দেখবো বলেই অতদূর থেকে ছুটে এলাম? কি জবাব দেবো তোর মার কাছে? সে বুড়ী যে—

গলায় একটা কাশির শব্দ তুলে আর একবার জানিয়ে দিলাম আমার শর্ত। চকিতে আমার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে আবার সে চোখ ফেরালো দোস্তের মুখের উপর। বলল, তোর আসমানী যে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে গেল, আফজল।

—কি বললি? যেন কবরের ভিতর থেকে উঠে এল ভগ্নস্বর। নিষ্প্রভ চোখের তারায় ফিরে এল এক ঝলক প্রাণের জ্যোতি; মরণাহত মুখে একবিন্দু রক্তের আভাস। আর একটু কাছে সরে গিয়ে বলল পাঠান সর্দার, তুই তো চলে এলি, দোস্ত, আর আসমানী আজও তোর পথ চেয়ে বসে আছে। নিকে করবার জন্যে কত সাধাসাধি। খানদানি ঘরের কত জোয়ান ছেলে। ফিরেও দেখল না। তার মুখে শুধু ঐ এক কথা—সে ফিরে আসুক আর নাই আসুক, তার জন্যেই আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।

আফজলের চোখ ছাপিয়ে শীর্ণ গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুধারা। বুকের অন্তস্তল থেকে বেরিয়ে এল গভীর নিঃশ্বাস। শীর্ণ হাতখানা বাড়িয়ে বাল্যবন্ধুর একটা হাত ধরে বলল, সেই এলি, আর কদিন আগে এলি না কেন দোস্ত? বড্ড দেরি হয়ে গেছে ভাই, বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

এবার এগিয়ে এসে বললাম আমি, কে বললে দেরি হয়ে গেছে? আমি বলছি তুমি বেঁচে উঠবে। আবার দেশে ফিরে যাবে। যাকে চাও, তাকে নিয়েই ঘর বাঁধবে।

—হ্যাঁ সাহেব, সেই দোয়া কর। আমি বেঁচে উঠতে চাই,—তীব্র আগ্রহের সুরে বলল আফজল;-আমার তো মরলে চলবে না। দাও তোমাদের কি খাবার আছে!

সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবার পর আফজল খাঁকে যখন হাজির করা হল হাঙ্গার স্ট্রাইকের মতো মারাত্মক অপরাধের দণ্ড গ্রহণ করবার জন্যে, সে হঠাৎ ছুটে এসে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার হাতে যা কিছু শাস্তি আছে সাহেব, সব মাথা পেতে নেবো। ডাণ্ডা বেড়ি, খাড়া হাতকড়া, ডিগ্রি বন্ধ, যা তোমার ইচ্ছে। শুধু যে-কটা রোজ মাপ পেয়েছি, সাত বছরের সাজা থেকে সেটুকু যেন কেড়ে নিও না। যত তাড়াতাড়ি পার, আমাকে যেতে দাও। তুমি তো সবই জানো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *