লৌহকপাট – ২.২

দুই

–কেমন লাগছে আমাদের দেশ?

বললাম, মন্দ কি। পাহাড় আছে, সমুদ্রও আছে….

—কিন্তু বাড়াবাড়ি নেই কোনোটারই, যোগ করলেন কবিরাজ মশাই। চারদিকের মাঠঘাট গাছপালার সঙ্গে ওরাও বেশ মিশে আছে। এ জিনিস কিন্তু আপনার দার্জিলিং মুশৌরীতে নেই, পুরী ওয়ালটেয়ারেও পাবেন না। এটা পাবেন শুধু এইখানে, এই চাটগাঁয়, আপনারা যাকে বলেন মঘের দেশ,—বলে একটা বিচিত্র গড়ন নস্যের ডিবা থেকে দুটি ভীম-টিপ উদ্ধত নাসারন্ধ্রে চালান করলেন। আমার চোখের উপর ভেসে উঠল একটি অতি পরিচিত দৃশ্য—আমাদের ম্যাগাজিন সেন্ট্রী গজাধর সিং রাইফেলের নলে গুলি ভরছে।

রক্তিমাভ চোখদুটি আমার মুখের উপর তুলে হঠাৎ যেম ধমকে উঠলেন কবিরাজ, আরে মশাই, এই মঘের দেশেরই একদল ছেলেমেয়ে একদিন বাঘের মতো লড়াই করেছিল আপনাদের ইংরেজ প্রভুর সঙ্গে। কংগ্রেসীবাবুদের নিরামিষ চরকাযুদ্ধ নয়, রীতিমত গোলা-বারুদ-বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ। প্রাণ দিয়েছিল, নিয়েও ছিল। তাদের পেছনে ছিল এই চাটগাঁর ইস্কুলের এক নগণ্য অঙ্কের মাস্টার। প্রতিশোধ নেবার পালা যখন এল, ইংরেজ তাকে ভোলেনি। যথারীতি ধরে নিয়ে ঝুলিয়ে দিল আপনার ঐ জেলখানায়।

কবিরাজমশায়ের উত্তপ্ত কণ্ঠ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন বাইরে অন্ধকারের দিকে। কিছুক্ষণ পরে আবার শুনতে পেলাম তাঁর মৃদু গম্ভীর সুর—যেন কতদূর থেকে ভেসে এল কথাগুলো—চাটগাঁর ‘সূর্য’ অস্ত গেল। সঙ্গে যারা ছিল তারা আজ পচে মরছে দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে কোন্ আন্দামানের অন্ধকূপে। কে জানে, কবে তারা ফিরবে? একেবারেই ফিরবে কিনা, তাই বা কে বলতে পারে?

কয়েকটি নির্বাক মুহূর্ত কেটে যাবার পর অনেকটা যেন আপন মনে বললেন কবিরাজমশাই, তবু বলবো, জেলে গিয়ে ওরা বেঁচে গেছে। দাঁড়িয়ে দেখতে হয়নি তাদের ঐ একটি দিনের দুঃসাহসের কত বড় মূল্য দিয়েছে তাদের দেশ। জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে আপনারা হৈ-চৈ করে থাকেন। কিন্তু খবর রাখেন না, এই চাটগাঁর প্রতি গ্রামে, প্ৰতি শহরে দিনের পর দিন কী পৈশাচিক অত্যাচার চলিয়েছিল একদল জানোয়ার। ডায়ার ওডায়ার নয়, বিদেশী গোরা পল্টন নয়, আমার আপনার জাতভাই তারা। একটা ভদ্র গৃহস্থও রক্ষা পায়নি সে পশুগুলোর হাত থেকে। ছেলেগুলোর গেছে বুকের পাঁজর মেয়েদের গেছে নারী-ধর্ম। আপনারা তো অনেক দেশের ইতিহাস পড়েছেন মশাই,— হঠাৎ দীপ্ত প্রশ্ন করলেন আমার দিকে চেয়ে, দেখেছেন এর তুলনা? স্বাধীনতার দণ্ড আছে জানি, কিন্তু এতখানি বীভৎস দণ্ড পেয়েছে কোনো দেশ, পৃথিবীর কোনো জাত?

সর্বনাশ! কাকে কি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বসলেন কবিরাজমশাই? আমি জেলের লোক। ব্রিটিশ রাজত্বে লীগ সরকারের চাকরি করি। নিছক সন্ধ্যা যাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে খোশগল্পের লোভে পা দিয়েছিলাম প্রতিবেশীর বৈঠকখানায়। এমন কামানের মুখে পড়তে হবে জানলে কখনও আসি? ওঁর তীক্ষ্ণ চোখদুটো তখনও আমার মুখের উপর উদ্যত। সেই দিকে একবার চেয়ে কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম, তারপর, এখানে মাছ-টাছ কি রকম পাওয়া যায় কবরেজমশাই?

—মাছ! চমকে উঠলেন ভদ্রলোক। আস্তে আস্তে তাঁর দৃষ্টি সহজ হয়ে এল। মুখে ভরে উঠল প্রসন্ন সরল হাসি। রাইফেলের নলে আর একবার বারুদ চালিয়ে বললেন, মাছ? হ্যাঁ, তা পাবেন বইকি! সব রকমই পাবেন। তা ছাড়া রয়েছে চাটগাঁর নিজস্ব বস্তু—শুঁটকি আর লইট্টা। রাঁধতে পারলে অতি উপাদেয় খাদ্য।

বললাম, ঐখানেই তো মুশকিল।

—কেন?

—আজ্ঞে, রাঁধতে হলে তাকে ঘরে আনতে হবে তো?

—অসুবিধা কিসের?

—অপরাধ না নেন তো বলি।

—সেকি! অপরাধ নেব কেন! বলুন না?

—আপনাদের পাঁচজনের কাছে সুখ্যাতি শুনে একটু লোভ হল। গেলাম একদিন শুটকির বাজারে। আধসেরটাক মাল বেশ প্যাক করে নিয়ে যখন বাড়ি ঢুকলাম রাত দশটা বেজে গেছে। গৃহিণী ঘুমিয়ে পড়েছেন। মতলব ছিল, সেই ফাঁকে ডাক্তারবাবুতে আর আমাতে বাইরের ঘরে স্টোভ জ্বেলে—

জিনিসটা নামাতে-না-নামাতেই নাকে কাপড় দিয়ে উনি এসে উপস্থিত। হাত দিয়ে পোঁটলাটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, আধমাইল দূরে ফেলে দিয়ে বেশ করে সাবান মেখে চান করে এসো লালদীঘি থেকে। মাথা চুলকে বললাম, তুমি এখনও ঘুমোওনি? উনি যেতে যেতে বললেন, মড়া বেঁচে ওঠে ঐ গন্ধে, আর আমার তো শুধু ঘুম!

কবিরাজমশাই হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা, এ তো গেল শুঁটকি। আর একটার কী খবর?

—আর একটা মানে লইট্টা? সে ইতিহাস আরও করুণ। চাকরটা একদিন পাতায় করে নিয়ে এসেছিল খানিকটা। দেখেই সে কি বমি! খবর পেয়ে ছুটে এলাম অফিস থেকে। একটু সুস্থ হয়ে বললেন, লোকটাকে আজ‍ই তাড়িয়ে দাও। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? ভীষণ রেগে উঠলেন উনি, কেন আবার! কোত্থেকে একদলা গয়ের তুলে এনে বলছে কিনা মাছ! আমি যেন আর মাছ চিনি না?

কবিরাজমশাই সস্নেহে বললেন, এই ব্যাপার! আচ্ছা দাঁড়ান। আপনার মুশকিল আসান করে দিচ্ছি,—বলে অন্দরের দিকে ফিরে হাঁক দিলেন, মিনু, মিনু আছিস?

নেপথ্যে উত্তর এল, যাই বাবা।

মিনিট দুয়েকের মধ্যে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল একটি গৌরী তরুণী। স্বাস্থ্যে এবং বুদ্ধিতে উজ্জ্বল। কবিরাজ বললেন, মিনু, তোমার কাকাবাবুকে প্রণাম কর। আমাদের বিশেষ বন্ধু। জ্ঞানবাবুর জায়গায় এসেছেন –

—জানি, বলে মিনু এগিয়ে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। হাসিমুখে বলল, কাকীমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। জানো বাবা, কাকাবাবু একজন সাহিত্যিক। খুব ভাল লেখেন।

কবিরাজ বিস্ময় প্রকাশ করলেন, তাই নাকি! কই, সেকথা তো এতক্ষণ বলেননি মশাই? আপনি দেখছি একটি বর্ণচোরা আম!

বললাম, কিন্তু বড্ড টক।

—টক না মিষ্টি বুঝতে দিলেন কই? সন্ধ্যা থেকে আমিই তো কেবল আবোলতাবোল বকে মরছি, আর একজন জলজ্যান্ত লেখক চুপ করে বসে আছেন!

বললাম, লেখকরা তো আর বকে না, লেখে।

—আর বাজে লোককে বলতে দিয়ে লেখার রসদ যোগাড় করেন, কি বলেন? বলে হাসতে লাগলেন কবিরাজমশাই।

মিনু বললে, তোমার সামনে কারও মুখ খোলবার উপায় আছে? কি বকতেই পারে!

—তা যা বলেছিস। ওঃ, হ্যাঁ, তোকে যে জন্যে ডেকেছিলাম, কাকীমার সঙ্গে শুধু ভাব করলে হবে না, ওঁকে আমাদের মাছটাছগুলো রাঁধতে শিখিয়ে দাও। তার আগে, মানে কালই, কাকাবাবুকে নেমন্তন্ন করে খাইয়ে দাও তো তোমার দু-একখানা রান্না। জানেন মলয়বাবু, আমার এই মায়ের হাতের শুঁটকির ঝোল আর লইট্টার বড়া একদিন যদি খান, আপনি জীবনে ভুলতে পারবেন না।

—হ্যাঁ, তোমার তো সবই বাড়াবাড়ি,—বলে মিনু ভিতরে চলে গেল। বলে গেল, আপনি উঠবেন না কাকাবাবু, আমি চা নিয়ে আসছি।

মিনু চলে গেলে কবিরাজমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে কদিন হল আপনার?

—মাসখানেক হল।

–দেখুন মজা। পাশাপাশি বাড়িতে থাকি। এদ্দিনে আমাদের পরিচয় সবে শুরু হল। তাও, আপনি দয়া করে এলেন বলে। আর ওদের, মানে মিনু আর কাকীমার অবস্থা দেখুন—বলে ভদ্রলোক আবার তাঁর সেই অট্টহাসির ঝড় তুললেন।

কবিরাজমশাই মিথ্যা বলেননি। আলাপচর্যায় স্ত্রীজাতি চিরকালই অগ্রণী। তার কারণ এ নয় যে সামাজিক সৌজন্যে কিংবা হৃদয়ের ঔদার্যে তাঁরা পুরুষের চেয়ে অগ্রসর। তার কারণ এই যে, বাক্য জিনিসটার গতি পুরুষের বেলায় অন্তর্মুখী আর নারীর বেলায় বহির্মুখী। কথা আমরা হজম করি, ওঁরা বমন করেন। সেই জন্য সংসারে স্ত্রী বক্তা আর পুরুষ শ্রোতা। নারীজাতি দুটি ক্ষেত্রে অমিতব্যয়ী—অর্থ এবং বাক্য, অবশ্য প্রথমটা যেখানে নিজের অর্জিত নয়।

এই কলকাতা শহরেই দেখতে পাবেন, বোস আর বাঁড়ুজ্জে পঁচিশ বছর ধরে পাশাপাশি বাড়িতে বাস করছেন। কিন্তু একে অন্যের সঙ্গে পরিচয় করেননি। প্রতি সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে আটহাতি ধুতির উপর ফতুয়া চড়িয়ে পরস্পর-সংলগ্ন রোয়াকে বসে স্টীলের কাপে চা পান করতে করতে তাঁরা পরস্পরকে নয়নবাণে বিদ্ধ করেন, কিন্তু বাক্য-সূত্রে স্পর্শ করেন না। ছাদের উপরে যান, সেখানকার দৃশ্য অন্যরূপ। সেখানে বোসজায়া এবং বাঁড়ুজ্জে-গৃহিণী মাধ্যাহ্নিক আহারান্তে কিংবা বৈকালিক প্রসাধনের পর নিজের আলিসার পাশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বড়ি আচার দোক্তা এবং সাংসারিক সুখ-দুঃখের বিনিময় করে থাকেন।

রেলে করে যাচ্ছেন কোনো দূরের পথে। আপনি এবং আপনার সহযাত্রী চব্বিশ ঘণ্টা পাশাপাশি বসে নিঃশব্দে কাটিয়ে দিলেন। অপাচ্য রেলওয়ে-উপন্যাস চিবিয়ে, ঘুমিয়ে, হাই তুলে রুক্ষ মাঠের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন করে সময় আর কাটে না। আলাপ করবার ইচ্ছা আছে, কিন্তু বরফ ভাঙতে এগিয়ে এলেন না কেউ। ঠিক পাশে, জেনানা কামরায় চলেছেন আপনাদের ‘সংসারদ্বয়’। তাঁরা কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতেই জমে গেছেন, যেন কতকালের চেনা। দুটো স্টেশন পার হতে না হতেই উভয়েই প্রমোশন পেয়েছেন দিদি থেকে ভাই, এবং ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’র কোঠায়। দুজনেই বলছেন, শুনছেন না কেউ। মিলিত কলকণ্ঠের ঝঙ্কারে ডুবে গেছে রেলগাড়ির হুঙ্কার। জংশন স্টেশনে গাড়ি থামলে আপনি নেমে গিয়ে হেঁকে বললেন, সব গুছিয়ে-টুছিয়ে নাও। আর দুটো স্টেশন বাকি। উত্তর পেলেন না। শুনতে পেলেন, ‘উনি’ হেসে বলছেন ‘তিনি’-কে, দেখলে তো ভাই, কি রকম ব্যস্তবাগীশ মানুষ নিয়ে ঘর করতে হয় আমাকে। দুটো স্টেশন পরে নামতে হবে; এখন থেকেই তাড়া দেওয়া শুরু হল।

তিনি বললেন, আমার উনি আবার এর চেয়েও এককাঠি সরেস। সেবার হল কি জানো ভাই?…

.

মিনু চা নিয়ে এল। সঙ্গে কিঞ্চিৎ ‘ইত্যাদি’। বললাম, শুধু চা-ই বরং দাও আজ। বাকী সব আরেক দিন এসে খাবো। অসময়ে কিছু আমার আবার—

—বেশ তো, বাধা দিয়ে বললেন কবিরাজমশাই, আপনার যা ইচ্ছা করে তাই খান। আমাদের শাস্ত্রে বলে খাওয়া নিয়ে জোর করতে নেই। আচ্ছা দাঁড়ান। একেবারে খালি চা-টা খাওয়া ঠিক হবে না। একটা নতুন উপকরণ দিচ্ছি।

আলমারি খুলে মারবেল আকারের দুটি গোলাকৃতি কালো পদার্থ আমার ডিসের উপর রাখলেন।

মিনু বলল, কি জিনিস চিনতে পাচ্ছেন তো?

একটু লক্ষ্য করে বললাম, কালোজাম বলে মনে হচ্ছে। বহরমপুরে বলে ছানাবড়া। তবে সেগুলো এর চেয়ে বড় বড়।

দুজনের উচ্ছ্বসিত হাসি।

একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, তবে কি নারকেলের নাড়ু?

কবিরাজমশাই বললেন, নাঃ, আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না। এটা হচ্ছে চ্যবনপ্রাশ, বলবীর্য কান্তিবর্ধক, শ্লেষ্মানিবারক।—বলে একটা সংস্কৃত শ্লোক আউড়ে দিলেন।

মিনু বলল, আমার খাবার তো আপনার পছন্দ হল না। এবার খান চ্যবনপ্রাশ দিয়ে চা।

বললাম, তা মন্দ নয়। চায়ের সঙ্গে চ্যবনপ্রাশ; বেশ অনুপ্রাস আছে কিন্তু।

কিছুদিন পরের ঘটনা। কবিরাজমশায়ের বৈঠকখানায় সন্ধ্যাযাপন ইতিমধ্যে প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। মজলিসি লোক। জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতার অন্ত নেই। তেমন অপূর্ব তার রসঘন পরিবেশ। সেটা বোধহয় মাঘমাস। জমাট শীত। সন্ধ্যা থেকে গল্পের আসর যেটা বসেছিল সেটাও কম জমাট নয়। ফাঁকে ফাঁকে চলেছে চ্যবন প্রাশ এবং অন্যান্য উপকরণ-যোগে গরম চা। দ্বিতীয়পর্ব শেষ হবার পর আবার জল চড়বে কিনা জানতে এসেছিল মিনু। একজন পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকলেন, সামনে একটা চেয়ার দখল করে কবিরাজমশায়ের দিকে চেয়ে বললেন, মাপ করবেন। অসময়ে বিরক্ত করলাম। আপনার চাকরটিকে একবার ডেকে পাঠান তো।

কবিরাজমশায়ের বিস্মিত প্রশ্ন—চাকর! মানে বিপিন? তার আবার কি হল?

—দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করবার আছে।

আমার পক্ষে আর বসে থাকা সমীচীন নয়। বললাম, আমি তাহলে উঠি আজকার মতো।

কবিরাজমশাই বললেন, বসুন না একটু।

দারোগাবাবুর দিকে তাকিয়ে অপ্রসন্ন মুখে বললেন, ওয়ারেন্ট-টোয়ারেন্ট আছে নাকি? যে দিনকাল পড়েছে, কাউকে বিশ্বাস নেই মশাই।

—একবার ডাকুন না; বলছি সব।

কবিরাজ অন্দরের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বললেন, বিপিনকে একবার এদিকে পাঠিয়ে দে তো মিনু।

ভেতর থেকে জবাব এল, বিপিন বাড়ি নেই, বাবা।

কোথায় গেল?

—তার মার অসুখ। বিকালের গাড়িতে বাড়ি চলে গেছে।

—ও, তাই সন্ধ্যা থেকে দেখছি না হতভাগাকে।

দারোগাবাবু মৃদু হেসে একটু বিদ্রূপের সুরে বললেন, ভারি আশ্চর্য তো, চাকর ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেল, আর আপনি সে খবরটা রাখেন না।

কবিরাজমশাই স্পষ্টত বিরক্ত হলেন। বললেন, এতে আশ্চর্য কি দেখলেন? চাকর- বাকরের খবর মেয়েরাই রাখে।

—যাক্। আমাদের খবর কিন্তু অন্য রকম। আপনার বাড়িটা একটু সার্চ করতে চাই। এই নিন ওয়ারেন্ট।

কবিরাজের মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, বেশ, করুন।

দারোগাবাবু আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন, আপনি—

পরিচয় দিলাম। উনি আগ্রহের সঙ্গে বললেন, আপনি যখন উপস্থিত আছেন স্যার, witness হিসাবে আমাদের সঙ্গে একটু থাকলে ভালো হয়।

নিতান্ত অনিচ্ছায় হলেও রাজী হতে হল’।

ভিতরে ঢুকতেই জানালা দিয়ে নজর পড়ল বাইরে চারদিক ঘিরে লালপাগড়ির ঘন লাইন। একতলাটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। তারপর আমরা সদলবলে উপরে উঠে গেলাম। খান তিনেক ঘর। প্রথমটায় থাকেন কবিরাজমশাই। পরেরখানা তাঁর ছেলের। বর্তমানে খালি। মালিক বীরভূমের কোন গ্রামে অন্তরীণ। দুটোতেই দস্তুরমতো পুলিশী তল্লাসী শেষ হল। তৃতীয় ঘরের সামনে যেতেই উনি বললেন, এখানে আমার মেয়ে থাকে। এটাও দেখতে চান?

সকুণ্ঠ উত্তর এল দারোগাবাবুর, আজ্ঞে এলাম যখন—

—বেশ। মিনু একটু বাইরে এসো মা। ওঁরা তোমার ঘর সার্চ করবেন। মিনু দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, কেন বাবা?

—বিপিনটা লুকিয়ে আছে কি না, দেখতে চান।

মিনু সেইখানে দাঁড়িয়েই বলল, যা খুশী চাইলেই তো আমরা দিতে পারি না বাবা। ওঁদের না হয় লজ্জা-সরমের বালাই নেই, আমাদের তো মান-সম্ভ্রম বলে একটা কিছু আছে। কি বলেন কাকাবাবু?

বলা বাহুল্য, “কাকাবাবুর” পক্ষে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই নিরুত্তর রইলাম। উত্তর দিলেন পুলিশ অফিসার। বললেন, লজ্জা-সরম আমরাও একদম খুইয়ে বসিনি, মিস্ সেন। কিন্তু লজ্জা করে ঠকার চেয়ে একটু নির্লজ্জ হয়ে যদি জেতা যায়, সেইটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?

—তার মানে?

—মানে, আপনাকে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াতে হবে।

—যদি না সরি?

—আমাদের বাধ্য হয়ে সরাবার ব্যবস্থা করতে হবে, বুঝতেই পারছেন।

—বেশ, তাই করুন।

সহজ কণ্ঠ। কোথাও নেই এতটুকু উত্তাপের আভাস। দারোগার দিকে তাকালাম, এবং তার দৃষ্টি অনুসরণ করে চোখ ফেরালাম মিনুর মুখের উপর। শিউরে উঠলাম। মনে হল, একে আমি কোনোদিন দেখিনি। এ মেয়ে নয়, প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। কোমল নারীদেহ নয়, তার প্রতি অঙ্গ থেকে ঠিকরে পড়ছে ইস্পাতের দীপ্তি এবং দৃঢ়তা। মুহূর্তকাল সেই দিকে চেয়ে নিজের অজ্ঞাতসারে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল ক’টি ভীতিবিহ্বল শব্দ…না-না..

পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। এগিয়ে এসে সহজ ভাবেই বললাম, এটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না মিনু। ওঁরা বাড়ি সার্চ করতে এসেছেন। সঙ্গে ওয়ারেন্ট আছে। তোমার পক্ষে বাধা না দেওয়াই উচিত।

—নিশ্চয়ই, সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানালেন কবিরাজমশাই, তুই সরে আয় মা। করুক ওঁদের যা খুশি।

মনে হল মিনুর চোখেও স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে এসেছে। একবার আমার একবার ওর বাবার মুখের দিকে চেয়ে দরজা ছেড়ে চলে গেল।

দারোগাবাবু সদলবলে ঘরে ঢুকে প্রথমে কোণগুলো দেখলেন। আলনা এবং আলমারির পেছনে উঁকি মারলেন। তারপর খাটের নীচে একবার তাকিয়ে দুজন কনস্টেবলকে হুকুম করলেন, উস্‌মে কোন্ চীজ্‌ হ্যায়, নিকালো!

ওরা নীচে গিয়ে একটা কম্বলে জড়ানো বাণ্ডিল টেনে এনে ঘরের মাঝখানে বসিয়ে দিল। কম্বলটা খুলে পড়তেই কবিরাজমশাই চমকে চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কি! বিপিন!

পরদিন যথারীতি হাজতি আসামী-রূপে বিপিন আমার আতিথ্য গ্রহণ করল। ওয়ারেন্ট পড়ে দেখলাম, নাম রয়েছে সঞ্জয় চ্যাটার্জী ওরফে বিপিন দাস। চার্জ—আগ্নেয়াস্ত্র সহ ডাকাতি। ঘটনাস্থল—উত্তর ভারতের কোনো বড় শহর। কাল বৎসরাতীত। পুলিশের কোনো কর্তাব্যক্তির মুখে শুনলাম, একটি বিশিষ্ট ধ্বংসধর্মী রাজনৈতিক দলের ইনি অন্যতম পাণ্ডা। একাধিক খুন এবং ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। পুলিশ যথারীতি পশ্চাদ্ধাবন করেও বহুদিন একে কবলস্থ করতে পারেনি। হঠাৎ হয়তো শোনা গেল, বৌবাজারের কালু দপ্তরী লেনের মোড়ে ছলিমদ্দি নামে যে দর্জিটি চমৎকার ট্রাউজার কাটে, উনিই হচ্ছেন স্বনামধন্য সঞ্জয় চ্যাটার্জি। পরদিনই দেখা গেল, দোকান বন্ধ, মালিক রাতারাতি উধাও। আবার কিছুদিন পরে খবর দিলে কোনো গুপ্তচর, কুমিল্লার ফৌজদারী আদালতের বটগাছতলায় যে জ্যোতিষী ঠাকুর মামলাকারীদের হস্তরেখা পরীক্ষা করে জয়-পরাজয় নির্ণয় করেন, এবং সোয়া পাঁচ আনার মাদুলি ধারণের ব্যবস্থা দিয়ে বেশ দু-পয়সা পকেটস্থ করে থাকেন, তিনিই হচ্ছেন সঞ্জয়ের নবতম সংস্করণ। ঊর্ধ্বতন মহলে কথাটা পৌঁছবার আগেই জ্যোতিষীর অন্তর্ধান। এমনি একটা কোনো সূত্রে শেষটায় রিপোর্ট পেলেন চিটাগং ডি. আই. জি. যে, এই বহু-বাঞ্ছিত ব্যক্তিটি কিছুদিন হল, কবিরাজ সদানন্দ সেনের বাড়িতে ভৃত্যরূপে অবস্থান করছেন। এ চাকরির গোপন সুপারিশ এসেছে কবিরাজের ইন্টার্নী পুত্রের কাছ থেকে, এবং মঞ্জুর করেছেন তাঁর তরুণী কন্যা।

পুলিশ-প্রধানটি বললেন, শিকার এবারেও ফসকে যেত মশাই, আটকে গেছে নেহাত সরকারের কপালগুণে। সেজন্য অবিশ্যি আমাদের বাহাদুরি কিছু নেই। সংসারে এমন শেকল আছে, যা পুলিশের শেকলের চেয়েও শক্ত। তাতেই শেষটায় জড়িয়ে পড়ল সঞ্জয় চাটুজ্জে। শ্রীমতী মিনু সেনের কাছে সেজন্যে আমরা অনেকখানি ঋণী।

বললাম, কিন্তু আমি যেন শুনলাম, মেয়েটাকে অ্যারেস্ট করছেন আপনারা!

—আমার দারোগাবাবুদের তাই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আইনই তো সব নয়। পুলিস হলেও কৃতজ্ঞতা জিনিসটা আমাদের অভিধানেও আছে। তাই ওদের বললাম, মিনু সেনকে দেবার যদি কিছু থাকে সেটা হাতকড়া নয়, ফুলের তোড়া। তাই নিয়ে হাতজোড় করে ধন্যবাদ জানিয়ে এসো।

একটু বাঁকা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন, কেউ সাহস করছে না এগোতে। কাজটা আমাদের হয়ে আপনিই করুন না। আপনার তো বেশ যাতায়াত আছে শুনতে পাই। শ্রীমতীও নাকি আপনার খুব ভক্ত!… Congratulations! বলে আমার ডান হাতে গোটাকয়েক ঝাঁকানি দিয়ে পুলিশ-প্রধান নিষ্ক্রান্ত হলেন।

সরকারের খাতায় যে পরিচয়ই থাক, জেলের মধ্যে বিপিন দাস একেবারে নির্ভেজাল বিপিন দাস। সেই চাকরদের মতো হাঁটু পর্যন্ত তুলে কোমরে গুঁজে কাপড় পরা। খালি গা, গলায় তুলসীর মালা। চোখে সদা-শঙ্কিত দৃষ্টি। জোড়হাত করেই আছে, জেলর সাহেব থেকে মেট সাহেব পর্যন্ত সবার কাছে। বড় জমাদার মজিদ খাঁ তো হেসেই খুন। এ কী রকম স্বদেশী আসামী! পুলিসের তো খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই! এ নাকি আবার ডাকাতি করে, বোমা ছোঁড়ে, পিস্তল চালায়! যত সব—

তবু পুলিসের রিপোর্ট মতো সেল-ব্লকেই রাখতে হয়েছে বিপিনকে। সেখানে সে সিপাই-জমাদারদের ফাই-ফরমাস খাটে, ইয়ার্ড ঝাঁট দেয়, ঘরে ঘরে জল তোলে, ছোটখাট ‘স্বদেশী’ বাবু বা অন্যান্য ‘ডিভিশন’ বাবু যাঁরা আছেন, তাঁদের কাপড় কাচে, জুতো ব্রুশ করে, বিছানা ঝেড়ে মশারি খাটিয়ে দেয়। বুট পট্টি পাগড়ী খুলে সিপাই বাবাজীরা যখন তাদের দ্বিপ্রাহরিক আয়াস উপভোগ করেন, বিপিন তার সঙ্গে যোগ করে নিপুণ হাতের পদসেবা কিংবা দলাই-মলাই। আয়াস থেকে আসে আরাম, এবং তার থেকে নিদ্রা।

কথাটা আমার কানে গেল, এবং সিপাই-বাহিনীর এই সুখনিদ্রা আমার অনিদ্রার কারণ হয়ে দাঁড়াল। বিপিন সম্বন্ধে তাঁরা যতখানি নিশ্চিন্ত হতে লাগলেন, আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে উঠল ততখানি। আমি যে জানি, দেখে এবং ঠকে শিখেছি, এই শ্রেণীর মহাজনদের এটাই সনাতন-পন্থা। এমনি করে যাদের বশে ওঁদের ওঠা-বসার কথা, তাদেরই একদিন বশ করে কোথা দিয়ে ওঁরা নিঃশব্দে সরে পড়েন, কেউ জানতে পারে না। এর বেলায় যদি তেমন কিছু ঘটে, অর্থাৎ সঞ্জয় চ্যাটার্জি যদি অকস্মাৎ প্রাচীর লঙ্ঘন করেন, আমার চাকরিটিও যে তার সহগামী হবে, তাতে আর সন্দেহ নেই। এতদিনের এবং এত কষ্টের অর্জিত ধন হাতছাড়া হলে, সরকারের হাতে আমারও ছাড়া নেই। অতএব সেই কর্তাব্যক্তিটির শরণ নিলাম। বললাম, এ বোঝা তো আমারও নয় আপনারও নয়। কতদিন আর আমার ঘাড়ে চাপিয়ে রাখবেন? পাঠিয়ে দিন না যাদের জিনিস তাদের কাছে— সেই কোন্ হরিদ্বার না কানপুর। একটু ঘুমিয়ে বাঁচি।

উনি চিন্তান্বিত মুখে বললেন, ঘুম আমারও চলে গেছে, মিস্টার চৌধুরী। খবর পেয়েছি, গোপন পথে চিঠি-চলাচল শুরু হয়ে গেছে।

চমকে উঠলাম, বলেন কি?

—হ্যাঁ, তবে এখনও মনে হচ্ছে একতরফা। শ্রীমান লেখক আর শ্রীমতী পাঠিকা। উল্টো স্রোত যখন বইবে, অর্থাৎ শ্রীমতী যখন লেখিকার রোল নেবেন তখনই ভাবনার কথা। তার আগে যেমন করে হোক্, পাপ বিদায় করতেই হবে। আমার তরফে চেষ্টার ত্রুটি নেই, এটুকু জেনে রাখুন।

বিরক্তির বোঝা নিয়ে ফিরলাম এবং অফিসে এসেই ডেকে পাঠালাম বিপিন দাসকে। সেই গবেটমার্কা চাকরের মুখোশ পরে জোড়হাত করে দাঁড়াল এসে আমার অফিসের জানালায়। জমাদারকে সরিয়ে দিয়ে বললাম, আপনাকে বুদ্ধিমান লোক বলে জানতাম, কিন্তু এসব কি হচ্ছে সঞ্জয়বাবু?

এমনি ধারা সোজাসুজি চ্যালেঞ্জ ও বোধহয় আশা করেনি। তাই প্রথমটা একটু ইতস্তত করল। সে শুধু কয়েক সেকেণ্ড। পরক্ষণেই মুখের উপর যখন দৃষ্টি ফেললাম, বিপিন দাস মিলিয়ে গেছে, ফুটে উঠেছে সঞ্জয় চ্যাটার্জি। মাথাটা একপাশে একটু হেলিয়ে মৃদু হাসির সঙ্গে বলল, আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না জেলরবাবু।

—বুঝতে ঠিকই পারছেন। এ শুধু না বোঝার ভান। নিজে ডুবেছেন, ডুবুন। ঐ মেয়েটাকে ডোবাচ্ছেন কেন? আপনার পথ আর ওর পথ তো এক নয়।

জবাব এল স্থির গম্ভীর কণ্ঠে, এর উত্তর আজ আপনাকে দিতে চাই না, মিস্টার চৌধুরী। যাবার দিন দিয়ে যাবো। আজ শুধু এইটুকু বলবো, আপনি নিশ্চিন্ত হোন। আপনাকে বিব্রত বা বিপন্ন করবার মতো কোনো কিছুই আমি করিনি এবং করবো না।

কোনো কোনো মানুষের কথার মধ্যে যাদু থাকে, গল্পে পড়েছি। কারও কারও বলবার এমন একটা ভঙ্গি আছে, যা শ্রোতাকে মোহগ্রস্ত করে, এটাও ছিল শোনা কথা। আজ দুটোকেই প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করলাম। সেদিন ঘটনার পর থেকে মিনুর উপর মনটা অপ্রসন্ন হয়ে ছিল, হঠাৎ কেমন মায়া হল মেয়েটার উপর।

কবিরাজমশাইয়ের বৈঠকখানায় আমাদের সান্ধ্যআসর সেদিন আপনিই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে আসর যে আবার কোনোদিন খুলবে এ আশাও অবশ্য ছিল না। মেয়েমহলের সম্পর্কটাও অনুরূপ হবে, এটাই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছিলাম। তাই সেদিন সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে যখন দেখলাম আমার রান্নাঘরের বারান্দায় মিনু আর তার কাকীমা বেশ আগের মতোই জমিয়ে বসেছেন, বিস্মিত না হয়ে পারিনি। কিন্তু তার মধ্যে অণুমাত্র পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেল না। আমি বাড়ি ঢুকতেই কলকণ্ঠে বলে উঠল, কই, আপনাকে তো আজকাল আর দেখতে পাই না কাকাবাবু!

ঠিক সহজ ভাবে উত্তর দিতে পারলাম না। আমতা আমতা করে বললাম, বড্ড কাজ পড়েছে কদিন হল।

—হ্যাঁ! সন্ধ্যার পরে আবার কাজ কিসের আপনার?

এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বসবার ঘরে চলে গেলাম। মিনু উঠে এল আমার পেছনে পেছনে। কাছে এসে বলল, বাবা বড্ড মুষড়ে পড়েছেন। আপনি এমনি করে যাওয়া বন্ধ করলে তো চলবে না।

একটুখানি চিন্তা করে বললাম, তুমি আমার ওপর রাগ করোনি মিনু?

—ওমা, রাগ করবো কেন?

—একটু ঘুণাক্ষরেও যদি জানতে পেতাম, তা হলে—

—তাহলে কী? আমাকে সরে যেতে বলতেন না, এই তো? কিন্তু আপনি জানেন না কাকাবাবু, সেদিন আমাকে, আর শুধু আমাকে নয়, পুলিশ যাকে ধরতে এসেছিল, তাকে আপনি কতখানি রক্ষা করেছেন।

—রক্ষা করেছি! আমি?

—হ্যাঁ, আপনি। আমার কি ছাই মাথার ঠিক ছিল? আপনি না বললে আমি দরজা ছেড়ে কিছুতেই যেতাম না। আর ঐ পুলিশের লোকটাও ঠিক তাই চাইছিল।

—বল কি!

—হ্যাঁ। ওর ঐ সাপের মতো চোখদুটোর দিকে একবার তাকিয়ে তা আমি বুঝেছিলাম।

—কিন্তু তুমি ভুল করনি তো?

—না কাকাবাবু, ওখানটায় কোনো মেয়েই কোনদিন ভুল করে না।

আমি চুপ করে সেদিনকার দৃশ্যটার উপর মনে মনে চোখ বুলিয়ে গেলাম। মিনু বলল, ওরা যখন আমার গায়ে হাত দিত, একবার ভেবে দেখুন কি করতেন আপনি, কি করতেন বাবা, আর কি করতো সে, যাকে ধরবার জন্যে ওদের এত তোড়জোড়! তখনও সে খাটের নীচে কম্বল মুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে লুকিয়ে থাকত, এটা নিশ্চয়ই আশা করতে পারেন না। কিন্তু তারপর? মাগো! ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। দারোগার কোমরে পিস্তল ছিল। এতবড় সুযোগ সে নষ্ট করত না।

মিনু চোখ বুজল। তার সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠল কয়েকবার। একবার ভাবলাম বলি, যে পরিণাম কল্পনা করে তুমি এমন করে শিউরে উঠছ, সেটা তো ওঁর জীবনের আকস্মিক ঘটনা নয়, যে-কোনো মুহূর্তেই আসতে পারে।

কিন্তু সেই বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে এই রূঢ় সত্যটা মুখ থেকে বেরোল না।

.

দিন কয়েক পরেই খবর এল বিপিন দাসকে কানপুরে চালান দেবার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে। দিনক্ষণও স্থির হয়ে গেল। যাবার আগের দিন আমার একজন অফিসার এসে বললেন, বিপিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

—বেশ তো, আসতে বলুন।

অফিসারটি একটু ইতস্তত করে বললেন, একা আসতে চাইছে। বলা যায় না হয়তো কনফেশন করার মতলব। অত বড় Inter-Provincial case-এর আসামী, একটু বাজিয়ে দেখবেন স্যার। যদি কিছু বের করা যায়, মোটা রিওয়ার্ডের সম্ভাবনা রইল।’

হেসে বললাম, “তাই যদি হয়, আপনি বঞ্চিত হবেন না, সতীশবাবু।’

ভদ্রলোক চলে গেলেন। ওঁর চোখের ভিতর খুশি আর লোভ একসঙ্গে জ্বল-জ্বল করে উঠল।

বিপিন আমার টেবিলের উপর একখানা খামে-আঁটা চিঠি রেখে বলল, আপনার সেদিনকার প্রশ্নের উত্তর।

শিরোনামটায় চোখ বুলিয়ে বললাম, কি রকম! প্রশ্ন করলাম আমি, আর উত্তর পাবে শ্রীমতী মিনতি সেন?

—চিঠিটা ওরই। কিন্তু দেবার আগে আপনি একবার পড়ে দেখবেন। আসামীদের চিঠি সেন্সর করতে হয় তো, আমার বেলায় সে কাজটা না হয় আপনি নিজেই করলো মিস্টার চৌধুরী, বলে হাসতে লাগল।

চিঠিখানা পকেটস্থ করলাম।

অনেকদিন পরে আবার হানা দিলাম কবিরাজমশায়ের বৈঠকখানায়। নতুন চাকর বহাল হয়েছে। বলল, কাকে চাই?’

—যাকে হোক ডেকে দাও।

—বাবু তো বাড়ি নেই।

—দিদিমণি আছে তো, তাকেই ডাকো।

লোকটা আমার সর্বাঙ্গে চোখ বুলোতে লাগল—সাধুভাষায় যাকে বলে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ। এমন সময় ঘরে ঢুকল মিনু।

—ওমা কাকাবাবু, কখন এলেন? বসুন, চা নিয়ে আসছি।

—চা পরে হবে। তোমার একটা চিঠি আছে।

—আমার চিঠি! কে দিলে?

—পড়লে বুঝতে পারবে।

বন্ধ খামখানা তার হাতে দিলাম। লেখাটার উপর চোখ পড়তেই কে যেন একরাশ সিঁদুর মাখিয়ে দিল গৌরবর্ণ মুখের উপর। আমার দিকে চোখ না তুলেই তাড়াতাড়ি ভিতরে চলে গেল।

চা এল চাকরের হাতে। একটু একটু করে দশমিনিট ধরে কাপটা শেষ করলাম। উঠতে যাবো, এমন সময়ে সে এল। সদ্যধোয়া চোখমুখ লক্ষ্য করলাম। তার উপর একটি চেষ্টাকৃত ম্লান হাসি ফুটিয়ে তুলে চিঠিখানি আমায় দিয়ে বলল, আপনি পড়েছেন?

বললাম, পরের চিঠি; অনুমতি না পেলে পড়ি কি করে?”

~অনুমতি তো লেখকই দিয়ে গেছেন। শুধু অনুমতি নয়, অনুরোধ। আপনি পড়ুন। আমি আসছি।—

বলে বেরিয়ে গেল। চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলাম—

মিনু,

সেদিন তুমি জানতে চেয়েছিলে, আমাদের দীক্ষার মন্ত্র কি? আজ সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আমাদের একটিমাত্র মন্ত্র। তার প্রথম এবং শেষ হল—দেশ। ব্যক্তি আমাদের কাছে মিথ্যা, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ অর্থহীন। বন্ধন নেই, আকর্ষণ নেই। পেছন ফিরে তাকানো আমাদের গুরুতর নিষেধ। তবু যে আজ যাবার আগে নিজের কথা শোনাতে বসেছি, তার কারণ জানতে হলে চিঠিটা তোমাকে শেষ করতে হবে।

মাকে হারিয়েছিলাম যখন আমার বয়স সাত! ভাইবোন কেউ ছিল না। পরের বাড়িতে অনাদরে মানুষ। সংসারের যে একটা কোমল দিক আছে, যেখানে মানুষ ভালবাসে, ভালবাসা পায় তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কৈশোর থেকে আমি বিপ্লবী। যে জীবন বেছে নিয়েছি, তার একটি মাত্র রূপ। সে রূপ কর্তব্যে কঠোর, প্রতিজ্ঞায় নির্মম। স্নেহ প্রীতি দয়া মায়া আমাদের বিদ্রূপের বস্তু। নারী আমাদের কাছে দুর্বলতার প্রতীক। তাকে এড়িয়ে চলতে হবে; এই হল আমাদের creed।

আমাদের জীবনের বেশীর ভাগ কেটেছে পাহাড়ে জঙ্গলে, উন্মুক্ত আকাশ-তলে। শুধু কাজ আর কাজ। দিনরাতগুলো ভারী প্রোগ্রাম দিয়ে ঠাসা। ইঁটের মতো নিশ্ছিদ্র নিরেট। পথে-বিপথে, গৃহ-জীবনের ছায়ায় যখন এসেছি, মেয়েদের কাছে পেয়েছি প্রাণপূৰ্ণ আতিথ্য এবং সাগ্রহ আশ্রয়! পেয়েছি স্নেহ, প্রীতি, শ্রদ্ধা। যাবার সময় দেখেছি কারও ম্লানমুখ, কারও বা চোখের জল। কিন্তু মনের ওপর ছাপ পড়েনি কোনোদিন। সঞ্চয় করিনি কিছুই। যা পেয়েছি দিনান্তে, নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে চলে গেছি। এই ছিল আমার জীবনের ধারা। সে-ধারা বদলে গেল, যেদিন এলাম তোমাদের বাড়ি। তোমার দেখা যখন পেলাম, কি মনে হল জানো? মনে হল, আমার মধ্যে কোথায় একটা অভাব ছিল, এতদিনে সেটা পূর্ণ হল। যা পেলাম, তারই জন্যে যেন অপেক্ষা করেছি সারা-জীবন। সে যেন এক পরম সম্পদ, যে আজ মিটিয়ে দিল আমার সকল দৈন্য, ভরে দিল আমার সকল শূন্যতা।

তবু ভাবছি, এ দেখা যদি আমাদের না হত! আমি যে বিপ্লবী। আমার পথ চিরন্তন ধ্বংসের পথ। সে পথে শুধু রক্ত, শুধু হিংসা, শুধু মৃত্যু। সেখানে তো অমৃতের স্থান নেই। তোলার এ মহাদান সেখানে ব্যর্থ হয়ে গেল, যেমন করে ব্যর্থ হয় মরুভূমির বুকে বৃষ্টিধারা। হৃদয়-পাত্র উজাড় করে যা দিলে তাকে গ্রহণ করবো আমি কি দিয়ে? অঞ্জলিভরে যা নিলাম, তাকে রাখি এমন পাত্র কোথায়?

তোমায় তো বলেছি, মিনু, নেবো বললেই কি সব জিনিস নেওয়া যায়? তার জন্যে সাধনা চাই। সে সাধনা আমি কোনোদিন করিনি। তাই, যে-কথা বারংবার বলেছি, যাবার আগে আর একবার বলে যাই—তুমি যা অকাতরে দিয়েছ তাকে গ্রহণ করবার অধিকার আমার নেই, তার মর্যাদা দেবার যোগ্যতা আমি অর্জন করিনি। যা আমার প্রাপ্য নয়, অনায়াসে পেয়েছি বলেই, তার উপর লোভ করা চলে না। এইখানেই তার শেষ হোক, এই কামনা জানিয়ে গেলাম।

কাল আমি যাচ্ছি।

ইতি—সঞ্জয়

পুনশ্চ—চিঠিখানা তোমার হাতে দেবার আগে মিস্টার চৌধুরীকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করেছিলাম। সম্ভবত সেটা তিনি করবেন না। তোমার পড়া হলে তাঁকে দিও।

—স।

চিঠি শেষ হল। মিনুর তখনও দেখা নেই। অগত্যা আর একবার পড়লাম। ততক্ষণেও সে এল না। পাশের ঘরটা ওর পড়বার ঘর। সেখান থেকে যেন একটা চাপা কান্নার সুর কানে এল। কে কাঁদে? মাঝখানে ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। আমার ঠিক সামনে টেবিলের উপর মাথা রেখে লুটিয়ে পড়ে আছে একটি মেয়ে। একরাশ এলোচুল ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে, ঢেকে গেছে সমস্ত টেবিলখানা। রুদ্ধ কান্নার দুর্বার উচ্ছ্বাসে দুলে-দুলে উঠছে তার দেহ। চিঠিখানা ফিরিয়ে দেওয়া হল না। যেমন নিঃশব্দে এসেছিলাম, তেমনি নিঃশব্দে বেরিয়ে চলে এলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *