ষোলো
দায়রা-বিচারে কাশিম ফকিরের ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল।
সুযোগ্য জজসাহেব বয়সে নবীন নন কিন্তু জজিয়তির আসনে নবারূঢ়। পেছনে রয়েছে মুন্সেফ আর সবজজগিরির সুদীর্ঘ সোপান। ছিলেন ডিক্রি-ডিসমিসের মালিক। জীবন কাটিয়েছেন পাট্টা কবুলিয়ত আর জীর্ণ তমসুকের ধুলো ঘেঁটে। মানুষ যা-কিছু ঘেঁটেছেন, সব ঐ দলিলের মত ঘুণে ধরা-জাল, জোচ্চুরি, ঘুষ আর মিথ্যা সাক্ষ্যের গোপন বিষে ন্যূব্জ-দেহ। সেই সব মানুষ দেখেছেন জজসাহেব। দেখেননি তাজা মানুষ, উচ্ছল প্রাণরসে ভরা মেঠো গেঁয়ো আর বুনো মানুষ, জীবন-মৃত্যু যাদের পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।
খুনীর সঙ্গে জজসাহেবের এই প্রথম পরিচয়, মৃত্যুদণ্ডে এই প্রথম হাতেখড়ি।
সে দণ্ডকে রূপ দিতে গিয়ে শুভ্রকেশ বিচারকের সুদৃঢ় লেখনী হয়তো একবার কেঁপে উঠেছিল। সে কম্পন অনুরণিত হল তাঁর আবেগজড়িত কণ্ঠস্বরে, বিচরমঞ্চের উচ্চাসন থেকে যখন তিনি ঘোষণা করলেন তাঁর ন্যায়নিবদ্ধ কঠোর আদেশ :
…the said Kasim Fakir be hanged by the neck till he be dead… দণ্ডদাতা বিচলিত হলেন, গ্রহীতা রইল নির্বিকার। পরম ঔদাসীন্যে গ্রহণ করল চরম আদেশ। রায় যখন শেষ হল, কাঠগড়ার উপর দাঁড়িয়ে একবার চারিদিকটায় চোখ বুলিয়ে নিল। মনে হল কাকে যেন খুঁজছে তার ব্যাকুল দৃষ্টি। তারপর ধীরে ধীরে নেমে এল রেলিং-ঘেরা কাঠের মঞ্চ থেকে। পুলিশের লোকেরা এসে ফিরে দাঁড়াল। চোখেই পড়ল না। ফিরেও দেখল না অপেক্ষমাণ স্তব্ধ জনতার বিস্মিত দৃষ্টি। নিঃশব্দে এগিয়ে চলল আদালতের বাইরে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে কালো ঘেরাটোপ-ঘেরা কয়েদীর গাড়ি।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন উকিলবাবু। মক্কেলের প্রাণরক্ষার জন্যে প্রাণপণ করেও ফল পাননি। বোধ হয় ইচ্ছা ছিল, গোটাকয়েক দার্শনিক সান্ত্বনা দিয়ে পুরিয়ে দেবেন সেই ব্যর্থতার শূন্য স্থান। কিন্তু মক্কেলের মুখের দিকে চেয়ে তাঁর মুখেও আর কথা জোগাল না। কোনোরকমে ব্যক্ত করলেন নেহাত যেটুকু কাজের কথা—এখানে একটা সই কর তো ফকির। সাতদিনের মধ্যেই হাইকোর্টে আপীল দায়ের করতে হবে।
একটু থেমে অনেকটা যেন আপন মনে বললেন, দেখা যাক আর একবার চেষ্টা করে।
ফকির দাঁড়াল। মুখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত বিকৃত হাসির কুঞ্চন। শুষ্ক কণ্ঠে বলল, কী লাভ বাবু? এখানেও তো কম চেষ্টা করেননি।
.
ফকিরের সঙ্গে আমার দেখা আসাম সীমান্তের কোনো ডিস্ট্রিক্ট জেলে। দেশ ছিল তার ময়মনসিংহ, ইংরেজ-শাসিত বাংলার সবচেয়ে বড় জিলা। বিশাল ভূখণ্ড। শুধু আয়তনে নয়, তার বৈশিষ্ট্য রয়েছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে। দক্ষিণ আর পূবদিক জুড়ে বিস্তীর্ণ সমতলভূমি—ব্রহ্মপুত্র যমুনার অকৃপণ করুণায় শস্যসম্ভারে ঐশ্বর্যময়। রুদ্র বৈশাখের খরতাপে তার মাঠে মাঠে ফাটল ধরে। আষাঢ়ের শেষে সেখানে নেমে আসে বর্ষার প্লাবন। ফেঁপে ফুলে কূল ছাপিয়ে ছুটে আসে দুর্বার-যৌবনা নদী। শ্রাবণে সেই মাঠের বুকে দশ হাত গভীর জলের উপর দিয়ে পাল তুলে যায় সওদাগরী পানসি, ভেসে বেড়ায় অসংখ্য জেলে-ডিঙ্গি। জল শুধু জল। কিন্তু দেখে দেখে চিত্ত বিকল হয় না। তার রূপে নেই বন্ধ্যার রুক্ষতা। তার উপর বিছানো থাকে সুস্পষ্ট শ্যামল আমন ধানের আস্তরণ। বন্যার সঙ্গে তাদের রেষারেষি। জল যদি বাড়ে চার আঙুল ধানের গাছ উঠবে আধ হাত। রুদ্র প্রকৃতির সঙ্গে করুণাময়ী প্রকৃতির দ্বন্দ্ব জয়পরাজয় নির্ভর করে মানুষের ভাগ্যের উপর।
কার্তিকের শেষে এই বিপুল জলরাশি কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় ভোজবাজির মত। দীর্ঘ ধানগাছ লুটিয়ে পড়ে। মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকে সোনার শিষ। তার নিচে যে কোমল মাটি, তার মধ্যেও স্বর্ণ-রেণু, কৃষকের ভাষায় যার নাম পলি। তারই স্পর্শে মেতে ওঠে রবিশস্যের খন্দ, লক্লক্ করে মটরের ডগা, হলুদের নেশা লাগে সর্ষে ক্ষেতে, গুজি তিলের অতসীফুল মনে ধরিয়ে দেয় বৈরাগ্যের ছাপ।
আল বাঁধা নেই, জলসেচ নেই, কাদাঘাঁটা নেই, একটি একটি করে ক্ষীণপ্রাণ ধানের চারা পুঁতে রুগ্ন শিশুকে তিল তিল করে মানুষ করবার দুরূহ সাধনা নেই, জল জল করে চাতকচক্ষে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবার বিড়ম্বনা নেই। মাটিতে কয়েকটা আঁচড় কেটে যেমন-তেমন করে বীজ ছড়িয়ে দিয়ে গান গেয়ে মাছ ধরে আর দাঙ্গা করে দিন কাটায় ময়মনসিহের চাষী। বাকি যা কিছু, সব দেয় নদী, দেয় ব্রহ্মপুত্র আর তার কল্যাণী কন্যা যমুনা। তাই এদেশের নাম নদী-মাতৃক দেশ।
এরা যে পাট জন্মায় তার খ্যাতি আছে ডাণ্ডী আর নিউইয়র্কের বাজারে। এদের বিরুই চালের মিষ্টি স্বাদ আজও লেগে আছে আমাদের মত বিদেশী অন্নভোজীর রসনায়। জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য এবং প্রাকৃতিক ঔদার্য এদের দেহে দিয়েছে স্বাস্থ্যের দৃঢ়তা, মনে এনেছে নির্ভীক সারল্য। প্রাণ দেওয়া-নেওয়া এদের বিলাস। ধন এবং নারী-লুণ্ঠন এদের ব্যসন। এদের পরিভাষায় ‘abduction’ কথাটার প্রতিশব্দ “বউটানা”, অর্থাৎ পরের বৌকে প্রকাশ্যে বাহুবলে টেনে এনে বশ করার নাম নারীহরণ, গোপনে চুরি করে অরক্ষিতা কুমারী কিংবা বিধবার উপর বলপ্রয়োগ নয়। প্রথমটায় আছে হিংস্র পৌরুষ, দ্বিতীয়টায় কামুকের ইতর কাপুরুষতা।.
ময়মনসিংহ গীতিকবিতার দেশ। তারও মূলে আছে প্রকৃতির অজস্র বদান্যতা। বাংলার রত্নভাণ্ডারে বিক্রমপুর দিয়েছে মনীষা, বরিশাল দিয়েছে স্বদেশপ্রেম, আর ময়মনসিংহ দিয়েছে পল্লীকাব্য। এর পথে-ঘাটে, নদীর চরে, আমের বনে, নিরক্ষর কৃষকের গোবর-নিকানো আঙিনায় এখনো ভেসে বেড়ায় নদের ঠাকুর আর মহুয়া বেদেনীর বিরহ-মিলন, লীলাকঙ্কের প্রেমগুঞ্জন, কবি চন্দ্রাবতীর মৌন আত্মত্যাগ।
এই গেল দক্ষিণের রূপ। উত্তরের চেহারা একদম আলাদা। সেখানে নেই দক্ষিণের এই প্রাকৃতিক দাক্ষিণ্য। রুক্ষ বন্ধুর বনভূমি, মাঝে মাঝে অনুচ্চ পাহাড়-শ্রেণী। কৃপণা বসুমতী প্রসন্ন সহাস মুখে বরদান করেন না। বহু খোঁড়াখুঁড়ি করে তবে শস্যকণার সাক্ষাৎ মেলে। এই বিস্তৃত অঞ্চলের একটা অংশ জুড়ে রয়েছে মধুপুরের গড়। এককালে ছিল ভবানী পাঠকের কর্মক্ষেত্র, আজ পুলিশ-ভীত দস্যু-তস্কর এবং ফেরারী আসামীর লীলাভূমি। এরই কোনোখানে জনহীন জঙ্গলে-ঘেরা এক টিলার ধারে ছিল কাশিম ফকিরের আখড়া। পাশাপাশি দু’খানা খড়ের চালা, একটি ভাঙা দরগা, তার চারদিকে ঘিরে ভাঙ্ আর ধুতুরার বন। সম্পত্তির মধ্যে ছিল নাতনীর বয়সী একটি রূপসী স্ত্রী, গোটাকয়েক গোরুছাগল, একপাল মুরগী আর একটি ময়না।
ফকির পঞ্চাশোর্ধ্ব। তার উপরে তার যৌবনের ইতিহাস চিহ্নিত আছে পুলিশের খাতায়। তার এই বনংব্রজেং অর্থহীন নয়। কিন্তু একটি উদ্ভিন্ন-যৌবনা চঞ্চলা নারী কোন্ দুঃখে কিংবা কিসের মোহে সংসারের যা-কিছু আকর্ষণ সব ত্যাগ করে বরণ করেছিল এই নির্জন বনবাস, বেছে নিয়েছিল এক অশক্ত বৃদ্ধের নিরানন্দ সঙ্গ, সে-রহস্য জানেন শুধু তার সৃষ্টিকর্তা।
বৃদ্ধ ফকির দরগার পাশে বসে মালা জপ করে। মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডাকে, কুটী, ও-ও কুটী। কুটীবিবি তখন বন্যা হরিণীর মত চঞ্চল চরণে আপন মনে ঘুরে বেড়ায় উদ্গত শৃঙ্গ, সতেজ ছাগশিশুর সঙ্গে “পৈট্” খেলে—তার মাথা ধরে ঠেলে ক্ষেপিয়ে দেয় আর সে যখন সামনের পা দুটো তুলে শিঙ উঁচিয়ে লাফিয়ে আসে, হাততালি দেয় আর খিলখিল করে হাসে। কখনো মুরগীর পেছনে তাড়া করে বেড়ায়, সুর নকল করে ঝগড়া বাধায় কোকিলের সঙ্গে, কিংবা পোষা ময়নার গলা ধরে ভাব জমায়।
মাঝে মাঝে ফকির সফরে বেরোয়। আলখাল্লা পরে ঝুলি কাঁধে ফেলে একমুখ দাড়ি আর একমাথা পাকা চুল নিয়ে আঁকাবাঁকা লাঠিটা হতে করে যখন বনপথে অদৃশ্য হয়ে যায়, কুটী সেদিকে চেয়ে মুখ টিপে টিপে হাসে। কি ভাবে, কে জানে? ফকিরের ফিরতে মাস কেটে যায়। হাটে হাটে কেরামতি দেখিয়ে বেড়ায়, তাবিজ কবচ দেয়, জলপড়া খাওয়ায়, ঝাড়ফুঁক করে আর সন্ধ্যার অন্ধকারে কোনো একটা আড়াল বেছে নিয়ে নোট ডবলের খেলা দেখায়। দু-টাকা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চার টাকা দেয়, পাঁচ টাকাকেও দশ টাকা করে। তার বেশি যদি কেউ দেয়, ফিরিয়ে দিয়ে বলে আখড়ায় যেও। দরগার সিন্নি লাগবে এক টাকা সওয়া পাঁচ আনা। একা যেও; লোকজন থাকলে হবে না।
তারপর একদিন ফকির ফিরে আসে। ঝোলাভর্তি টাকা সিকি আর বৌ-এর জন্য টুকিটাকি। কুটীর খুশী আর ধরে না।
দু-চার দিন পরেই আসতে শুরু করে নোট ডবলের মক্কেলের দল। ছোটখাট পার্টিকে আমল দেয় না ফকির। কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে ফিরিয়ে দেয়। তিন চার পাঁচ শো নিয়ে যারা আসে তাদের বলে, বসো। রাত এক প্রহরের পর সিন্নি হবে।
প্রহর কেটে যায়। মক্কেলের ডাক পরে দরগার পাশে। ফকির সমাধিস্থ। ক্ষিপ্রগতিতে ঘুরছে তার হাতের তসবী। রাত বাড়তে থাকে। টিলার পেছনে প্রহর জানায় শেয়ালের পাল। নিস্তব্ধ বনালয়ে মাঝে মাঝে শোনা যায় বন্য জন্তুর ডাক। হঠাৎ এক সময়ে কাশিম চোখ মেলে চায়। তসবী কপালে ঠেকিয়ে গাঢ় স্বরে বলে, খোদা মেহেরবান্। দাও, টাকা দাও।
ভক্ত নোটের তাড়া তুলে দেয় ফকিরের হাতে। রুদ্ধশ্বাসে কম্পিত বক্ষে অপেক্ষা করে, কখন সে তাড়া ডবল হয়ে ফিরে আসবে।
—এই নাও সিন্নি।
ভক্ত হাত বাড়িয়ে নেয় দু-খানা বাতাসা, একটু ফল আর এক গেলাস সুস্বাদু শরবত। সমস্ত দিনের ক্লান্তি ও দীর্ঘ অনশনের পর ভারী ভাল লাগে। কিন্তু এ কী! সমস্ত চেতনা যেন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। সর্বাঙ্গ এলিয়ে পড়ছে কেন? চোখ যে আর খুলে রাখা যায় না। ঘুম আসছে। অপার অনন্ত ঘুম। সে ঘুম যেন আর ভাঙবে না।
সে-ঘুম সত্যিই আর ভাঙে না। ঘণ্টাখানেক পরে মাথার দিকটায় স্বামী আর পায়ের দিকটায় স্ত্রী, ভক্তকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়, টিলার পেছনে ঘন জঙ্গলের মধ্যে সেখানে কাটা আছে সুন্দর কবর। অজ্ঞান ভক্তকে তারই মধ্যে ফেলে দিয়ে ফকির কপালের ঘাম মোছে, কুটী হেসে ওঠে কলকণ্ঠে। বনপ্রান্তে ওঠে তার প্রতিধ্বনি। তারপর নিপুণভাবে মাটিচাপা দিয়ে, ঘাসের চাপড়া লাগিয়ে সমস্ত চিহ্ন বিলুপ্ত করে স্বামী-স্ত্রী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে যায়, এবং পাশাপাশি শুয়ে ঘুমিয়েও পড়ে। সকালে উঠে নোটগুলো হাঁড়ি-বন্ধ করে পুঁতে রাখে মাটির তলায়। তারপর বেশ করে জল দেয় ভাঙ্ আর ধুতরা গাছের জঙ্গলে।
এমনি করে বছরের পর বছর নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে মহাসুখে ছিল ফকির দম্পতি। মাঝে মাঝে হতভাগ্য মক্কেলের কোন আত্মীয়-স্বজন যদি আসত তার খোঁজে, ফকির একেবারে আকাশ থেকে পড়ত। সে যে সেইদিনই ডবল নোট ট্যাকে গুঁজে চলে গেল। কি বল, বিবিজান, তাই না? বিবিজান ঘর ঝাঁট দেওয়ার ফাঁকে কিংবা রান্না করতে করতে মুখ টিপে হাসে। বলে, সে তো সেই ক–বে চলে গেছে। ফকির ব্যস্ত হয়ে পড়ে, খোঁজ খোঁজ ভালো করে খোঁজ। বড্ড ডাকাতের উৎপাত এ দিকটায়। অতগুলো টাকা নিয়ে, ঈস্…।
তারপর একদিন এল এক নতুন মক্কেল। বাইশ-তেইশ বছরের জোয়ান ছোকরা। দেহ তো নয়, যেন নিপুণ ভাস্করের হাতে গড়া কালো পাথরের মূর্তি। মাথায় ঢেউ-খেলানো বাবরি চুল। সরু কোমরে আঁট করে বাঁধা লাল চারখানার গামছা। হাতে তেলে-পাকানো বাঁশের লাঠি। চঞ্চল চোখ দুটো দিয়ে উপচে পড়ছে স্বাস্থ্য আর খুশির ঝিলিক। এদিক- ওদিক চেয়ে খুঁজতে খুঁজতে আসছিল ফকিরের আস্তানা। আঙিনার পাশে প্রথমেই চোখাচোখি হয়ে গেল কুটীর সঙ্গে। থমকে দাঁড়াল ছেলেটি। মুখে ফুটে উঠল স-কৌতূহল বিস্ময়ের চিহ্ন। তারপর সেটা মিলিয়ে গেল কৌতুক হাসির কুঞ্চনে। সে হাসির নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি জেগে উঠল কুটী-বিবির অনিন্দ্য ঠোট দু-খানির কোণে। সে শুধু পলকের তরে। তারপর সদা-চঞ্চল চাহনির উপর নেমে এল কালো একজোড়া আঁখিপল্লব। আনত দীপ্ত মুখের উপর দেখা দিল আরক্তিম ছায়া। কিসের ছায়া কে জানে?
ফকির দাওয়ায় বসে তামাক টানছিল, মক্কেল এগিয়ে গিয়ে একটা নোটের বাণ্ডিল তার সামনে ফেলে দিয়ে বলল, পাঁচশ টাকা আছে। গুনে নাও। আর এই নাও তোমার সিন্নির খরচা, এক টাকা সোওয়া পাঁচ আনা, বলে ট্যাক থেকে খুচরো পয়সাগুলো ছুঁড়ে দিল মেঝের উপর। ফকির কথা বলল না। ইঙ্গিতে বসতে বলে হুঁকোটা তুলে দিল শাঁসালো মক্কেলের হাতে। তারপর সিন্নির পয়সা কুড়িয়ে নিয়ে বলল, নোট রেখে দাও। ও-সব কি দিনের বেলায় হয়? জিরোও, তামাক খাও। সিন্নি হবে সেই রাত এক প্রহর বাদে।
বহুকাল পর সেদিন চিরুনি পড়ল কুটীবিবির মাথায়। জটপাকানো অবাধ্য চুলের বোঝা কোনোরকমে বশে এনে খোঁপায় পরল একটি নাম-না-জানা বনফুল। তারপর বেশ করে গা ধুয়ে এল আধ মাইল দূরে এক ঝরণা থেকে। বাড়ি এসে পরল একখানা আসমানী রঙের টাঙ্গাইল শাড়ি। গত ঈদের সময় ফকির এনে দিয়েছিল কোন্ হাট থেকে। দু-বার মাত্র পরেছে কাপড়খানা। ফকির বলেছে চমৎকার মানায় তাকে।
-কই, কোথায় গেলে? মিঞাসাকে কিছু খেতে দাও। কদ্দূর থেকে আসছে বেচারা। বেলা কি আর আছে?
—এখানে পাঠিয়ে দাও। খাবার দিয়েছি, রান্নাঘর থেকে সাড়া দিল কুটী।
কুটী বেরিয়ে এল। হাতে একবাটি দুধ আর একসাজি মুড়ি। একবার চেয়ে দেখল তার অতিথির মুগ্ধদৃষ্টির পানে। একখানা মাদুর বিছিয়ে দিল দাওয়ার উপর। সযত্নে আঁচল দিয়ে মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বসো না?
হোসেনের যেন জ্ঞান ফিরে এল এতক্ষণে। বলল, তুমিও থাক নাকি এই জঙ্গলে? কুটী অবাক–বাঃ, কোথায় থাকবো তবে?
—কী করে এলে এখানে?
কুটী কৃত্রিম কোপ দেখিয়ে বলল, আহা! জানেন না যেন? আমি তো ফরিরসাহেবের বিবি।
—ঐ ফকিরের বিবি তুমি—বলে হো হো করে হেসে গড়িয়ে গেল ছোকরা।
বিবি বিরক্ত হল, হাসছ যে?
—না না, ও কিছু না। এই টাকাটা তুলে রাখো। আমি ফাঁকা থেকে ঘুরে আসি একটু। উঃ কী জঙ্গল! দম আটকে আসছে—বলে দুধটা এক চুমুকে শেষ করে আর মুড়ির সাজিটা কোঁচড়ে ঢেলে চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে গেল।
কুটী নিজ হাতে জবাই করল তাদের সবচেয়ে যেটা সেরা মুরগী। যত্ন করে রাঁধল তার “ছালুন”, আর চমৎকার লাল বিরুই চালের ভাত। ঘন করে জ্বাল দিল নিজের হাতে দোওয়া কালো গোরুর দুধ। সামনে বসে খাওয়াল অতিথিকে। খানিকটা দুধ রেখে উঠে যাচ্ছিল হোসেন, কুটী অনুনয় করে বলল, আমার মাথার দিব্যি, ওটুকুন খেয়ে ফেল।
তারপর একটু মুখ টিপে হেসে তরল কণ্ঠে বলল, একে তো জঙ্গলে এসে মিঞাসাহেবের মনটা পালাই পালাই করছে, তারপর দুটো পেটভরে খেতে না পেলে বাড়ি গিয়ে একঝুড়ি নিন্দে হবে তো আমার?
হোসেন সে প্রশ্নের জবাব দিল না। মুগ্ধ কণ্ঠে বলল, খু-ব খেলাম। এত যত্ন করে সামনে থেকে কেউ কোনদিন খাওয়ায়নি।
কেরোসিনের ঢিবরির মৃদু আলোকে কুটীবিবির মুখখানা স্পষ্ট দেখা গেল না। বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল যে নিঃশ্বাস, তাও সে চেপে গেল।
খাবার পর হোসেন মিঞা বারান্দায় বসে গল্প করছিল ফকিরের সঙ্গে। পাশের চালাটায় নিজে হাতে পরিপাটি করে বিছানা পেতে মশারি খাটিয়ে দিয়ে কুটী এসে বলল, এবার কিন্তু শুয়ে পড়তে হবে। সেই কোন্ দেশ থেকে কত মেহনত করে আসা। এখন কি গল্প করার সময়?
হোসেন চলে গেলে ফকিরের পাশে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত কি ভাবল কুটীবিবি। তারপর দৃঢ় চাপা গলায় বলল, এর বেলা ওসব চলবে না বলে দিলাম।
ফকির লক্ষ্য করছিল সবই। অন্ধকারে চোখ দুটো হিংস্র শ্বাপদের মত জ্বলে উঠল। ব্যঙ্গ করে বলল, বড্ড দরদ দেখছি। এরই মধ্যে এত জমে গেলি?
—মজেছি বেশ করেছি—রুক্ষ কণ্ঠে জবাব দিল কুটী, কিন্তু এর যদি কিছু করতে যাস, তোরই একদিন কি আমার একদিন। মনে থাকে যেন।
ফকির নিজেকে সামলে নিল। আঁচল ধরে টেনে বসাল বৌকে। কণ্ঠে আদর ঢেলে বলল, তোর কথা আমি কোনোদিন ঠেলেছি, না ঠেলতে পারি কুটী? তোকে ক্ষ্যাপাচ্ছিলাম একটু।
বৌয়ের সুন্দর মুখখানা তুলে ধরে বলল, বাঃ, আজকে তোকে যা দেখাচ্ছে কুটী!
এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৃপ্তভঙ্গীতে কুটী উঠে চলে গেল। যতদূর দেখা যায়, পেছন থেকে একজোড়া হিংস্র জ্বলন্ত চোখ তার চলন্ত দেহের উপর আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগল।
গভীর নিষুতি রাত। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ এইমাত্র হেলে পড়েছে দূরে বনের আড়ালে। জীব-জগৎ নিষুপ্ত। জেগে আছে শুধু গহন বন। তার অদ্ভুত রহস্যময় ভাষা শোনা যায় নিস্তব্ধ রাত্রির কানে কানে। ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল কাশিম ফকির। আলগোছে বাঁশের ঝাঁপ খুলে নিঃশব্দে তার ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল। বিছানার এক প্রান্তে নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমিয়ে আছে তার রূপসী স্ত্রী। গাছের আড়াল থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক ম্লান জ্যোৎস্না এসে পড়েছে তার সুপ্ত সুন্দর মুখের উপর। সে মুখে যেন ফুটে উঠেছে কোন্ সদ্যলব্ধ পরম তৃপ্তির আভাস। স্বপ্নাবৃত উন্নত বুকখানা উঠছে, নামছে নিঃশ্বাসের তালে তালে। নিঃশব্দে চেয়ে রইল ফকির। তার কুৎসিত শীর্ণ পেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁতে উঠল ঘর্ষণের শব্দ। কোটরগত চোখ থেকে ঠিকরে পড়ল জ্বালা। শিরাবহুল হাতের শক্ত কাঠির মত আঙুলগুলো দংশনোদ্যত বৃশ্চিকের মত এগিয়ে গেল নিদ্রিতার গলার কাছে। একটিবার টিপে ধরলেই শেষ হয়ে যাবে ঐ বুকভরা নিঃশ্বাসের ভাণ্ডার। তাই যাক্—অস্ফুট গর্জন শোনা গেল ফকিরের ভাঙা গলায়, তাই যাক! দুনিয়া থেকে সরে যাক শয়তানী।….
নিজের স্বর শুনে চমকে উঠল ফকির। হাত গুটিয়ে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এল।
পাশের ঘরে নতুন বিছানার আর নতুন অনুভূতির উত্তেজনায় হোসেনের ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল বারে বারে। ফকিরের হাত তার গায়ে ঠেকতেই ধড়মড় করে উঠে বসল।
—কে?
—আমি, ফিসফিস করে উত্তর এল। সময় হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এস। দরজার পাশে একটা মোমবাতি জ্বলছিল। তার কাছে নিয়ে মক্কেলকে বসিয়ে দিলে মাদুরের উপর। গায়ে মাথায় খানিকটা মন্ত্রপড়া জল ছিটিয়ে দিয়ে বলল, নোট দাও।
—নোট তো বিবির কাছে।
—বিবির কাছে! সেখানে কি করে গেল?
—আমি রাখতে দিয়েছি।
আরেকবার জ্বলে উঠল ফকিরের হিংস্র চোখ দুটো।
—বেশ, এই নাও সিন্নি। খোদার নাম নিয়ে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেল—ভক্তের হাতে তুলে দিল শরবতের গেলাস।
একরাশ কড়া ভাঙ্, আর তার সঙ্গে মেশানো ধুতরার বিষ। অত বড় বলিষ্ঠ ছোকরা আধ ঘণ্টার মধ্যে অসাড় হয়ে গেল। ফকিেেরর জীর্ণ দেহে কোথা থেকে এল অসুরের শক্তি। আলখাল্লা খুলে ফেলে দিয়ে দোহাই আল্লা বলে পা ধরে টেনে নিয়ে চলল হোসেনের নিশ্চল দেহ। বারে বারে বসে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিয়ে কোনোরকমে পৌঁছল গিয়ে টিলার পেছনে। কবর খোঁড়াই ছিল। ঠেলে ফেলতেই গলা থেকে বেরোল অস্ফুট গোঙানির শব্দ। পাগলের মত কোদাল চালাল ফকির। কবর ভরে গেল। গোঙানির আওয়াজ স্তব্ধ হল চিরদিনের তরে। কাশিমের কাজ যখন শেষ হল রাত্রির শেষ প্রহর তখন বিদায়োন্মুখ
কুটীর ঘুম ভাঙল ভোরবেলা কি এক দুঃস্বপ্ন দেখে। তাড়াতাড়ি চোখ রগড়ে বাইরে এসে প্রথমেই ছুটে গেল পাশের ঘরে। এ কি! ঘর যে খালি! ফকির পড়ে ছিল বারান্দায়; ঘুমিয়ে কিংবা ঘুমের ভান করে। ডাকতেই খেঁকিয়ে উঠল, ডাকাডাকি করছিস কেন ভোরবেলা?
—ওকে তো দেখছি না! ব্যাকুল কণ্ঠে বলল কুটী।
—চলে গেছে হয়তো।
—চলে গেছে! আমাকে না বলে?
ফকির আর জবাব দিল না। কুটী উদ্ভ্রান্তভাবে এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াতে লাগল। হঠাৎ নজরে পড়ল শরবতের শূন্য গেলাস। একবার নাকের কাছে ধরতেই সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। এ গন্ধ তো তার অচেনা নয়। ছুটে গেল টিলার ধারে। যেটুকু সন্দেহ তখনো লেগে ছিল মনের কোণে নিঃশেষে উড়ে গেল।
উন্মত্ত আবেগে ছুটে এসে ফকিরের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ল কুটীবিবি। পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে এল কান্না। সে কান্নার যেন আর শেষ নেই। ফকির তাকিয়ে রইল সপচক্ষু মেলে, যেমন করে তাকিয়ে থাকে ব্যাধ, তারই হাতে শরবিদ্ধ যন্ত্রণা-বিহ্বল হরিণীর দিকে।
হঠাৎ কি মনে করে উঠে বসল কুটী। আয়ত চোখের তারায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। পাতলা ঠোট দুটির উপর ফুটে উঠল ক্রূর হাসির বাঁকা রেখা। ঢলঢলে মুখখানা যেন এক নিমেষে কঠিন পাথর হয়ে গেল। চঞ্চলা হরিণী মরে গেল। তার থেকে জন্ম নিল এক ক্রুদ্ধা সৰ্পিণী।
কাশিম বিস্ময়-ভীত দৃষ্টি মেলে চেয়ে দেখল এ রূপান্তর। কিন্তু কণ্ঠ তার নির্বাক। কুটীবিবি সোজা হয়ে দাঁড়াল। কোমরের চারদিকে শক্ত করে জড়িয়ে নিল লুটিয়ে পড়া আঁচল। তারপর স্বামীর মুখের উপর তর্জনী তুলে রুদ্ধশ্বাসে বলল, শোধ নেবো, এর শোধ নেবো আমি।
কাশিমের বিস্ময়ের ঘোর কাটবার আগেই সে ঝড়ের বেগে ছুটে বেরিয়ে গেল।
ফকির ছুটল—কোথায় যাস কুটী? ফের, শোন?
কেউ সাড়া দিল না। মুহূর্তে বনের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল তড়িৎগতি তনুদেহ। বন ছাড়িয়ে মাঠ। মাঠের শেষে আবার বন। গ্রীষ্মের চষা ক্ষেত। মাটি তো নয়, যেন পাথর। কোমল পা দু-খানা রক্তে ভরে উঠল। ফিরেও দেখল না কুটী। ভূক্ষেপ করল না বিস্মিত পথিকের হতবাক কৌতূহল। মাঝে মাঝে শুধু শোনা গেল ক্লান্ত কণ্ঠের ব্যাকুল প্রশ্ন,–কোনো পথচারীকে চমকে দিয়ে—বলতে পার, থানা আর কদ্দূর?
চৈত্রের আকাশ থেকে আগুন ঠিকরে পড়ছে। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যায়। সুগৌল মুখখানায় ফেটে পড়ছে রক্তের আভা। ঘামে ভিজে গেছে সর্বাঙ্গের বসন। কুটীর দাঁড়াবার অবসর নেই। চলছে তো চলছেই।
বাইশ মাইল পথ পার হয়ে থানার মাঠে এসে যখন পৌঁছল, মনে হল তার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। বারান্দায় উঠতে পারল না। অস্ফুট কণ্ঠে একবার শুধু বলল, পানি। বলেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
ডাক্তারের সাহায্যে জ্ঞান ফিরে এল, চোখ মেলেই চেঁচিয়ে উঠল কুটী—খুন, খুন হয়েছে রাউজানের জঙ্গলে। শীগরির চল তোমরা।
চলবার শক্তি ছিল না। সেই রাত্রেই ডুলি চড়ে পুলিশের সঙ্গে ফিরে এল আখড়ায়। কবর খুঁড়ে বের করা হল হোসেনের মৃতদেহ। মনে হল যেন জোয়ান ছেলেটা এইমাত্র ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। একবার ডাকলেই উঠে পড়বে। কুটী চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকের উপর। পরম স্নেহে আঁচল দিয়ে মুখের উপর থেকে মুছে নিল মাটির দাগ। ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ওগো, একজন ডাক্তার ডাক তোমরা। ও মরেনি। একটু ওষুধ দিলেই বেঁচে উঠবে।
পাশের কবরগুলোও খোঁড়া হল। পাওয়া গেল একটা গলিত শব আর দশটা কঙ্কাল।
কথা হচ্ছিল কাশিম ফকিরের উকিল সুজিৎ রায়ের বৈঠকখানায়। ভদ্রলোকের বৃত্তি ওকালতি কিন্তু প্রকৃতি সাহিত্যিক। প্রথমটা তার উপজীবিকা, দ্বিতীয়টা উপসর্গ। মফঃস্ব শহরে মাঝে মাঝে কোনো সাহিত্যিক-যশঃপ্রার্থী স্থানীয় লেখকের ক্লান্তিকর প্রবন্ধ কিংবা নিদ্রাকর্ষক কবিতা পাঠ উপলক্ষ করে সঙ্গতিপন্ন গৃহস্থের বৈঠকখানায় যে সব চা- জলযোগের বৈঠক বসে, এই উকিলবাবুটি তারই একজন অকৃত্রিম সভ্য। ওরই একটা কি অধিবেশনে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। সে-পরিচয় ক্রমশ গাঢ়তর হয়ে বন্ধুত্বের কোঠায় প্রমোশন লাভ করবার আয়োজন করছে, সেই সময়ের কথা। মক্কেলের জন্যে মৃত্যুদণ্ড আর নিজের জন্যে পরাজয় পকেটস্থ করে বাড়ি ফিরেই তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। দেখলাম, উকিল হলেও ঘটনাটা তাঁর বুদ্ধির কোঠা পার হয়ে অন্তরের দরজায় করাঘাত করে ফেলেছে। কোনোরকম ভূমিকা না করেই তিনি কাশিম ফকিরের দীর্ঘ কাহিনী একটানা শুনিয়ে গেলেন। অর্থাৎ, আমি উপলক্ষ মাত্র, কথাগুলো শোনালেন তিনি নিজেকেই।
আমি জেলের লোক। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার ইতিহাস আমার মনের পাতায় দাগ কাটে না। আমি দেখলাম ওর গদ্যময় বাস্তব দিকটা। বললাম, ফকির সাহেবের কল্যাণে আপনার খাটুনি যেটা হয়েছে, সেটা না হয় ছেড়ে দিলাম; খরচ-পত্তর বাবদ উকিলবাবুর পকেটের উপরেও তো চাপ কম পড়েনি। উনি বললেন, ঠিক উল্টো। বরং পারিশ্রমিক বলে পকেটে যেটা এসেছে, তার পরিমাণ, উকিলবাবু সচরাচর যা পেয়ে থাকেন, তার চেয়ে বেশী বই কম নয়।
বিস্মিত হলাম, বলেন কি? কোন্ সূত্রে এল? ফকিরের এতবড় বান্ধবটি কে?
—কেন, ওর বৌ কুটীবিবি?
আমি এমন চোখে তাকিয়ে রইলাম, সাধুভাষায় যাকে বলে বিস্মিত-বিস্ফারিত লোচন।
সুজিতবাবু আরো পরিষ্কার করে বললেন, খরচ-পত্তর তো দিয়েছেই, পাঁচবার দেখা করেছে আমার সঙ্গে।
কৌতূহল দমন করা গেল না। প্রশ্ন করলাম, স্বামী মহাত্মার সঙ্গে দেখা করতে চায়নি?
—না। একদিন তুলেছিলাম সে কথা। মুখ বেঁকিয়ে বলল, ও মুখপোড়াকে দেখে আমার কি হবে? কিন্তু এ কথা সে অনেকবার বলেছে আমাকে, টাকা যা লাগে দেবে! উকিলবাবু, তুমি খালি দেখো, গলাটা যেন ওর বেঁচে যায়।
কিন্তু গলা বাঁচাতে পারলুম না, নিঃশ্বাস ফেলে বললেন সুজিৎবাবু।
উকিলবাবু যখন ছেড়ে দিলেন, তখন রাত এগারোটা। সমস্ত রাস্তাটা ফকির-দম্পতির কীর্তিকাহিনীই মন আচ্ছন্ন করে রইল। একবার ভালো করে দেখতে ইচ্ছা হল লোকটাকে। বাড়ি না ফিরে সোজা জেলের মধ্যে গিয়ে হাজির হলাম।
প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত আসামীর নির্জন কক্ষ—জেলের ভাষায় যাকে বলে ফাঁসি ডিগ্রি বা কণ্ডেড্ সেল। লোহার গরাদে-দেওয়া রুদ্ধ দরজা। তার ঠিক সামনেই জ্বলছে একটা তীব্র লণ্ঠনের আলো। তারই পাশে লাঠিহাতে দাঁড়িয়ে আছে সতর্ক প্রহরী। এই একটি মাত্র কয়েদীর জন্যেই সে বিশেষভাবে নিয়োজিত। তার শ্যেনচক্ষুর প্রখর অবরোধ থেকে একটি সেকেণ্ডের তরেও মুক্তি নেই হতভাগ্য বন্দীর। ডিউটি-অন্তে ও যখন চলে যাবে, ওর জায়গায় আসবে আর একজন। সে গেলে আর একজন। যতদিন না একেবারে মুক্তি হয় ঐ বন্দীর—এই প্রহরীপরিক্রমার বিরাম নেই। এইটাই আইনের বিধান। জানি না, এ বিধান কার রচনা। যারই হোক, ঐ একচক্ষু প্রহরীর মত তিনিও বোধহয় দাঁড়িয়েছিলেন একমাত্র রাষ্ট্রশাসনের বেদীর উপর। ঐ সিপাহীর মত তাঁরও হাতে ছিল সমাজ-স্বার্থের লণ্ঠন। যার জন্য তাঁর বিধান রচিত হল, সেই মানুষটার পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে তিনি তাঁর আইনের একটি ধারাও সংযোগ করেননি। একথা তাঁর মনে হয়নি মৃত্যুদণ্ড যত বড়ই নিষ্ঠুর হোক, এই হুঁশিয়ারির দণ্ড তার চেয়েও নির্মম। ফাঁসিমঞ্চের যে অদৃশ্য ছায়া ঐ লোকটাকে অনুক্ষণ অনুসরণ করছে, দিনরাত্রির কোনো না কোনো ক্ষণে তাকে হয়তো ও ভুলে থাকতে পারে, কিন্তু মুহূর্তের তরেও ভুলতে পারে না এই সদাজাগ্রত প্রখর দৃষ্টির অনুসরণ। সে যে অষ্টপ্রহর নজরবন্দী, তার আহারনিদ্রা শয়ন উপবেশন, তার কর্মলেশহীন দিনরাত্রির ক্লান্তি ও বিশ্রাম, সবারই উপর চেপে রয়েছে এই যে নিরবচ্ছিন্ন সতর্কতার নিশ্ছিদ্র আবরণ, সে কি প্রতি নিমেষেই তার কণ্ঠরোধ করছে না? যে-দুটি দৈনন্দিন জৈব ক্রিয়া দেহী মাত্রেরই অবশ্য-করণীয় অথচ মানুষমাত্রেরই গোপনীয়, তার জন্যেও কি এতটুকু অন্তরালের প্রয়োজন নেই ফাঁসির আসামীর?
শুনেছি, সম্ভাব্য আত্মহত্যার দুর্গতি থেকে রক্ষা করবার জন্যেই মৃত্যু-দণ্ডিতের উপর এই সতর্কতার অভিযান। কিন্তু তার দৈহিক হত্যাটাই বড় হল? আর, এই যে পলে পলে তিলে তিলে আত্মহত্যা করছে তার আত্মা, শ্বাসরুদ্ধ হচ্ছে তার লাঞ্ছিত মনুষ্যত্ব, সে কথাটা কি ভেবে দেখেছিলেন আইন-স্রষ্টা বিজ্ঞের দল?
আর একটু এগিয়ে সামনেটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বালিশশূন্য কম্বল-শয্যার উপর পাশ ফিরে শুয়ে আছে আমার বন্দী Condemned Prisoner কাশিম আলী ফকির। ঘুমুচ্ছে, না জেগে আছে, কে জানে? সে যে আছে, এইটুকুই আমার প্রয়োজন। এইটুকু দেখে এবং আমার বিশ্বস্ত কর্মীর মুখে শুনেই আমি নিশ্চিন্ত। তার মনের খবর আমি রাখি না। রাখবার কথাও নয়। তবু কেন জানি না, কেমন আচ্ছন্নভাবে তাকিয়ে রইলাম ঐ সাড়ে চার ফুট লম্বা শীর্ণকায় লোকটার দিকে। ওর একমাথা চুল, একমুখ দাড়ি, মুদ্রিত চোখের কোণে গভীর বলি-রেখা, শীর্ণ দেহের উপর ঢোলা পোশাক এবং বিশেষ করে ওর ঐ পড়ে থাকবার নিশ্চিন্ত ভঙ্গী—সমস্ত ব্যাপারটা যেন মনে হল হাস্যকর—ইংরেজিতে যাকে বলে funny. এই লোকটা খুন করেছিল? একটা নয়, দুটো নয়, বারোটা খুন!
ফকির আপীল করেনি। তবু আইনের বিধানে মৃত্যুদণ্ডে মহামান্য হাইকোর্টের সম্মতি প্রয়োজন। ক’দিনের মধ্যেই সে সম্মতি এসে গেল—Death sentence confirmed. এর পর রইল প্রাণভিক্ষার পালা। প্রথমে ছোটলাট; সেখানে ব্যর্থ হলে বড়লাট; তিনিও যদি বিরূপ হন, মহামহিম ভারত-সম্রাট। Mercy petition-এর খসড়াও তৈরি হল-
যত্নে রচিত বহু হৃদয়দ্রাবী বিশেষণের একত্র সমাবেশ। কিন্তু ফকির সে আবেদনে টিপসই দিতে রাজী হল না। প্রাণভিক্ষা চায় না সে। অতএব অনাবশ্যক বিলম্ব না করে ফাঁসির দিন স্থির হয়ে গেল। আসামীর কাছে সেটা প্রকাশ করবার নিয়ম নেই।
—কাউকে দেখতে ইচ্ছা করে? সরকারীভাবে প্রশ্ন করা হল ফকিরকে।
একমুহূর্ত কি ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে জানাল—না।
তিন তিনেক পরে বিকাল-বেলা সেলব্লকের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছি, ফকির বসে ছিল তার ‘ডিগ্রির’ দরজার ঠিক পেছনে, মুখ দেখে মনে হল কি যেন বলতে চায়। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবে?
ফকির একটু ইতস্তত করে বলল, এখানে মেয়েছেলে আসতে পারে, বাবু?
-কেন পারবে না? কাউকে দেখতে চাও?
—আমার বিবিকে একবার দেখতে চাই। নাম কুটীবিবি; মধুপুর থানার রাউজান গ্রামে বাড়ি।
সরকারী চিঠি গেল কুটীবিবির নামে। তার নকল পাঠানো হল থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে। বেসরকারী খবর পাঠালাম সুজিৎবাবুর বৈঠকখানায়। তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন এবং দিনসাতেক খোঁজাখুঁজি করে শুষ্কমুখে এসে বললেন, পাওয়া গেল না মলয়বাবু। রায়ের দিনও কোর্টে এসেছিল। কিন্তু হাকিম উঠে যাবার পর বাইরে এসে দেখতে পাইনি।
থানা থেকেও খবর এল, উক্ত ঠিকানায় কুটীবিবি নামক কোন ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেল না।
নির্দিষ্ট দিন এসে গেল। রাত চারটা বাজতেই আসামীকে ডেকে তোলা হল। বড় জমাদার তার সেলের সামনে গিয়ে গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, বেরিয়ে এসো ফকির। গোসল সেরে নিয়ে আল্লার নাম কর।
কাশিম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, যেন কিছুই বুঝতে পারেনি। সেলের দরজা খোলা হল। ফকির জমাদারের মুখের দিকে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যেতে হবে?
এর উত্তরটা বোধ হয় আটকে গেল তেত্রিশ বছরের অভিজ্ঞ কর্মচারী বহুদর্শী চি হেডওয়ার্ডার গজানন্দ সিং-এর মুখে। গোসল বা আল্লার নাম করতে ফকির কোনো উৎসাহ দেখাল না। সেলব্লকের মেট এবং পাহারাওয়ালা এগিয়ে গিয়ে তাকে বাইরে নিয়ে এল। মাথায় কয়েক মগ জল ঢেলে পরিয়ে দিল এক সুট নতুন তৈরি জাঙ্গিয়া কুর্তা। মেট মুসলমান। ফকিরকে পাশে নিয়ে সেই নমাজ পড়ল। ফকির অনুসরণ করল যন্ত্রচালিতের মত।
শেষ ব্যবস্থা তদারক করবার জন্যে সেল-ইয়ার্ডে যখন হাজির হলাম, ঠিক তখনই ফকিরের নমাজ শেষ হয়েছে। এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, সে এল না বাবু?
একমুহূর্ত ভেবে নিলাম। তারপর বললাম, এসেছিল ফকির। কিন্তু তোমার খবর শুনে কেঁদে কেঁদে অফিসের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, এ অবস্থায় ওকে দেখা করতে দেওয়া ঠিক হবে না। ওষুধ-পত্তর দিয়ে সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। ফকির সর্বাঙ্গ দিয়ে শুনে গেল আমার কথার প্রতিটি অক্ষর। তারপর আকাশের দিয়ে চেয়ে অস্ফুটকণ্ঠে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আল্লাহ্। মনে হল এই নিঃশ্বাসের সঙ্গেই যেন বেরিয়ে গেল তার নিভৃত অন্তরের বহুদিন রুদ্ধ কোন বেদনার বোঝা! রাত্রিশেষের ক্ষীণালোকেও স্পষ্ট দেখলাম, মলিন মুখখানা তার এক নিমেষে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শীর্ণ কোটরগত চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা নীরব অশ্রু।
অন্তর্যামী জানেন, ফকিরকে যা বলেছিলাম, তার সমস্তটাই আমার রচনা। কিন্তু ঐটুকু মিথ্যার মূল্যে যে পরম-বস্তু সেদিন পেলাম, তার সঙ্গে বিনিময় করতে পারি সমস্ত জীবনব্যাপী সত্য-ভাষণের বিপুল গৌরব। শুধু কি পেলাম? যে অমৃত তুলে দিলাম এই মৃত্যুপথযাত্রীর হৃদয়পাত্রে, তার মরণজয়ী মাধুর্য আমার জীবনেও অক্ষয় হয়ে রইল।
ফাঁসি-যন্ত্রের চারদিকে কর্মব্যস্ততা চঞ্চল হয়ে উঠল। সুপার-সাহেব এলেন। তাঁর সঙ্গে এলেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। সরকারী ইউনিফর্মে সজ্জিত জেলর এবং সহকারী দল সার বেঁধে এসে দাঁড়ালেন একদিকে। আর একদিকে দাঁড়াল সশস্ত্র রিজার্ভ ফোর্স। চারদিক নিস্তব্ধ। অতবড় জেলের তেরশ চৌদ্দশ লোক যেন রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে আছে প্রত্যাসন্ন কোন্ মহাসংঘটনের প্রতীক্ষায়। অতগুলো ব্যারাক, যেন প্রেতপুরী। কোথাও নেই একবিন্দু প্ৰাণচিহ্ন।
সুপারের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে আসামীকে নিয়ে আসা হল। মাথায় চোখঢাকা টুপি। হাতদুটো পেছনদিকে হাতকড়া দিয়ে বাঁধা। দু-দিক থেকে দুজন সিপাই আস্তে আস্তে তাকে ধরে তুলল ফাঁসি-মঞ্চের উপর। মাথার ঠিক ওপরটাতে একটা লোহার আড়ের সঙ্গে ঝুলছে মোটা ম্যানিলা দড়ির তৈরি ফাঁস। পায়ের নীচে লোহার তক্তা। তার তলায় নাতি- গভীর গর্ত। জল্লাদ তৈরি হয়ে আছে হুকুমের অপেক্ষায়।
সুপারের হাতে ওয়ারেন্ট। গম্ভীরকণ্ঠে পড়ে গেলেন জজের আদেশ। তার বাংলা তরজমা করে শোনালেন রিলিজ দপ্তরের ডেপুটি জেলর। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল রিজার্ভ চীফ্ হেডওয়ার্ডারের অনুচ্চ গম্ভীর কমাণ্ড—Present Arms; নিখুঁত নৈপুণ্যে উদ্যত হল রাইফেলযুক্ত বেয়নেট। চিরবিদায়োন্মুখ বন্দীর উদ্দেশে বন্দিশালার সশস্ত্রবাহিনী জানাল তাদের শেষ সামরিক সম্মান।
রাইফেলের বাঁটের উপর তাদের হাতের শব্দ তখনো মিলিয়ে যায়নি, হঠাৎ চারদিক সচকিত করে স্তব্ধ জেল প্রাঙ্গণের বুক চিরে ফেটে পড়ল এক তীক্ষ্ণ আর্তস্বর—’ছেড়ে দাও, তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাকে ছেড়ে দাও।’ ফাঁসিমঞ্চের উপর থেকে ছুটে পালাতে চাইল ফাঁসির আসামী। দুজন জোয়ান সিপাই তাকে ধরে রাখতে পারে না। জল্লাদ থমকে দাঁড়াল। সুপারের কপালে দেখা দিল কুঞ্চন-রেখা। তাঁর ইঙ্গিতে আরও দুজন সিপাই ছুটে গিয়ে জোর করে তুলে ধরল আসামীর ভেঙে-পড়া কম্পিত দেহ। ক্ষিপ্রহস্তে হ্যাংগম্যান গলায় পড়িয়ে দিল ফার্স এবং মুহূর্তমধ্যে টেনে দিল লোহার হাতল। পায়ের তলা থেকে লোহার পাতখানা নিচে পড়ে গেল। তারই সঙ্গে চোখের নিমেষে গহ্বরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল কাশিম ফকিরের শীর্ণ দেহ। একটা শক্ত মোটা দড়ি শুধু ঝুলে রইল আমাদের চোখের সামনে। একটুখানি কেঁপে উঠল একবার কি দু-বার। তারপর সব স্থির।
.
সকলের মুখেই ঐ এক কথা। এ কী করে বসল লোকটা? গোড়াতে না করল আপীল, না পাঠাল একটা mercy petition, ভেঙে পড়ল শেষকালে একেবারে ফাঁসিকাঠের উপর! ড্রামাটিক কাণ্ড বটে!
ঐ ফাঁসি নিয়েই সেদিন জমে উঠল গল্পের আসর। সিনিয়র অফিসারেরা তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে লাগলেন। বীরেনবাবু বললেন, ফাঁসি তো কতই দেখলাম। টেররিস্টদের কথা বলছিনে। তাঁদের ব্যাপারই আলাদা। তাছাড়া যাদের দেখেছি, সবাইকেই প্রায় ধরে আনতে হয়েছে সেল থেকে gallows অবধি। একটা মুসলমান ছোকরা কিন্তু ভারী বাহাদুরি দেখিয়েছিল সেবার আলীপুর জেলে। আলি মহম্মদ না কি ছিল তার নাম। ঠিক মনে নেই। বড়লোকের ছেলে। বিয়েও করেছিল বনেদী ঘরে। বৌ নাকি ছিল পরমাসুন্দরী। এক মাস না যেতেই দিল তাকে খতম করে।
—খতম করে! কেন?
—কেন আবার? চরিত্রে সন্দেহ। কাঁচা বয়সে যা হয়ে থাকে। যেমন উন্মত্ত প্রেম, তেমনি পলক না ফেলতেই সন্দেহ। অবশ্য ভুল বুঝতেও তার দেরি হয়নি। তখন ছোরাহাতে একেবারে থানায় গিয়ে হাজির। নিজে সে মামলা লড়তে চায়নি। কিন্তু বাড়ির লোক শুনবে কেন? চেষ্টার ত্রুটি হল না। বড় বড় উকিল-ব্যারিস্টার, তদ্বির, সুপারিশ, ধরপাকড়, কান্নাকাটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গলা বাঁচল না।
তার ফাঁসির দিনটা বেশ মনে আছে। সেল থেকে বেরিয়ে এল গটগট করে। বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল gallows-এর ওপর। বড়সাহেব ওয়ারেন্ট পড়ছিলেন! মাঝখানেই বলে উঠল, ওসব রাখো সাহেব। ওয়ারেন্ট তো আগেই শুনেছি। তোমার হ্যাংগম্যানকে ডাক, ফাঁসটা লাগিয়ে দিক—I am ready.
…তারপর একটু থেমে ধীরে ধীরে আপন মনে বলে গেল—এই দুনিয়াতেই কসুর করেছিলাম; এই দুনিয়া থেকেই তার সাজা নিয়ে যাচ্ছি। আমার কোনো আপসোস নেই। আজ ম্যয় বহুৎ খুশ হ্যায়, বহুৎ খুশ হ্যায়।
রাধিকাবাবু প্রবীণ লোক। জুনিয়র বাবুরা চেপে ধরল, আপনি দু-চারটা বলুন, দাদা। আপনার নিশ্চয়ই অনেক ফাঁসি দেখা আছে।
তিনি বললেন, অনেক না হলেও তা দেখেছি বৈকি দু-চারটে। তবে মনে করে রাখবার মত তাজ্জব কিছু ঘটতে দেখিনি। সবগুলোই মামুলি ব্যাপার। সেল থেকে ধরে এনে ঝুলিয়ে দেওয়া। একটা শুধু পেয়েছিলাম, ওরই মধ্যে একটু বিশেষ ধরনের। লোকটার নামও মনে আছে। নিতাই ভটচাজ্। ভয়ঙ্কর মামলাবাজ। পরের পেছনে কাঠি দেওয়াই ছিল তার কাজ। সারাজীবন কত লোকের সর্বনাশ করে শেষটায় নিজেই পড়ে গেল এক মারাত্মক খুনী মামলায়। জমির দখল নিয়ে হাঙ্গামা। ওপক্ষে জোড়া খুন। নাশ গুম্ হয়ে গেল, কিন্তু তার রক্তমাখা কাপড় আর কি সব পাওয়া গেল ভটচাজের ঘরে। দায়রা জজ ছিল এক সাহেব। ফাঁসির order দিয়ে বসল। আপীল লিখেছিল ও নিজেই। অনেক পাকা ব্যারিস্টারের কলম থেকে ওরকম draft বেরোয় কিনা সন্দেহ। কিন্তু কাজ হল না। লোয়ার কোর্টের রায়ই বহাল রইল শেষ পর্যন্ত। গোটা আষ্টেক অগোপণ্ড ছেলেমেয়ে নিয়ে বৌটা প্রায়ই দেখা করতে আসত। অবস্থা এককালে বেশ সচ্ছল ছিল। মরবার আগে তাদের সর্বস্বান্ত করে পথে বসিয়ে গেল।
লোকটা কিন্তু বারবার বলে এসেছে, সে এ মামলার কিছু জানে না, একেবারে নির্দোষ, শত্রুপক্ষের লোকেরা আক্রোশবশত ফাঁসিয়ে দিয়েছে। সত্যি মিথ্যা জানি না। এরকম তো সবাই বলে থাকে। কিন্তু ফাঁসিকাঠের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ মুহূর্তেও যখন ঐ একই কথা সে বলে গেল, সবটাই মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবার মত জোর পেলাম না। ….
রাধিকাবাবু চুপ করলেন। সেই শেষ দৃশ্যটা বোধ হয় তাঁর চোখের ওপর ভেসে উঠেছিল। একটুখানি থেমে আবার শুরু করলেন—আসামী gallows-এর উপর দাঁড়িয়ে। ওয়ারেন্ট পড়া শেষ হয়েছে। হ্যাংগম্যানটাও রেডি। সাহেবের ইঙ্গিতের শুধু অপেক্ষা। সবাই আমরা ঐদিকেই তাকিয়ে আছি। নিঃশ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না। হঠাৎ চমকে উঠলাম নিতাই-এর গলা শুনে। স্পষ্ট জোরালো গলা, না আছে একটু কাঁপুনি, না আছে জড়তা, তোমরা শোনো, বিশ্বাস করো, খুন আমি করিনি। খুন করছ তোমরা। একটা নিতান্ত নিরপরাধ লোককে জোর করে ঝুলিয়ে দিচ্ছ ফাঁসিকাঠে।….
এইটুকু বলেই তার সুর হঠাৎ কেমন নরম হয়ে গেল। যেন প্রার্থনা করছে, এমনিভাবে আস্তে আস্তে বলল, অন্যায় করে, অবিচার করে যারা আমায় বাঁচতে দিল না, কেড়ে নিল আমার অসহায় স্ত্রী-পুত্রের মুখের অন্ন, হে ভগবান! তুমি তাদের বিচার করো।
মজলিসটা বসেছিল ডেপুটিবাবুদের অফিসে। কোণের দিকে নিঃশব্দে বসেছিলেন আমাদের তরুণ সহকর্মী সিতাংশু। ভদ্রলোক একটু ভাবগম্ভীর। সকলের মধ্যে থেকেও কেমন স্বতন্ত্র। সেজন্যে পরিচিত মহলে তাঁর নিন্দা-প্রশংসা দুটোরই কিঞ্চিৎ আতিশয্য ছিল। আজকের ভোরের অনুষ্ঠানে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন, সেটা আমি লক্ষ্য করেছি। আমাদের গল্পের আসরে তিনি উপস্থিত থেকেও যোগ দেননি। হঠাৎ কি মনে হল, ওঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনি বুঝি কোন ফাসি দেখেননি, সিতাংশুবাবু?
উনি একটু চমকে উঠলেন; বোধ হয় বাধা পেলেন কোনো নিজস্ব চিন্তাসূত্রে। তারপর আবেগের সঙ্গে বিনীত কণ্ঠে বললেন, দেখেছি স্যার, একটিমাত্র ফাঁসি দেখেছি। কিন্তু সে ফাঁসি নয়, শহীদ-বেদীমূলে দেশপ্রাণ ভক্তের জীবনবলি। এ প্রসঙ্গে তাঁর কথা উল্লেখ করে তাঁর আত্মার অসম্মান করতে চাই না।
সিতাংশুর এই ভাবাবেগ আমি উপলব্ধি করছি। ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, তাদের জয়গানেও আমি কারো চেয়ে পশ্চাৎপদ নই। সিতাংশুর মত তাদের দু-একজনকে দেখবার সৌভাগ্য আমারও হয়েছে। দেখেছি, মহৎ উদ্দেশ্যে যে-মৃত্যুবরণ তার মধ্যে এক প্রচণ্ড মোহ আছে। সে মোহ যখন মনকে আচ্ছন্ন করে, মৃত্যুর বিভীষিকাও বিলুপ্ত হয়ে যায়। মরণের রূপ তখন ভয়ঙ্কর নয়; মরণ সেখানে শ্যাম-সমান। ফাঁসি-মঞ্চের ঐ লোহার পাতখানার উপর দাঁড়িয়েও তাই তাদের চোখে ভেসে ওঠে গভীর আত্মতৃপ্তি, কণ্ঠে জেগে ওঠে সতেজ গর্ববোধ। তারা জানে, তাদের জন্যে সঞ্চিত রইল দেশমাতৃকার অজস্র আশীর্বাদ আর দেশবাসীর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। ভাণ্ডার তাদের পূর্ণ। তাই উন্নত শিরে, সস্মিত মুখে তারা স্বচ্ছন্দে চলে যায়, কণ্ঠে পরে ম্যানিলা রজ্জুর বরমাল্য। এ তো মৃত্যু নয়, এ আত্মদান, মহত্তর জীবনের মধ্যে পুনরাবির্ভাব। এ মৃত্যু শুধু তার দেশের গৌরব নয়, তার নিজের কাছেও এক মহামূল্য অন্তিম সম্পদ।
কিন্তু সে সম্পদের একটি কণাও যারা পেল না, মৃত্যু যাদের দিয়ে গেল শুধু ক্ষতি, মরণপথে একমাত্র পাথেয় যাদের লজ্জা, গ্লানি আর অভিশাপ, আইনের কাছে, সমাজের কাছে, স্বজন বান্ধব সকলের কাছে যারা কুড়িয়ে গেল খালি নিন্দার পসরা, সেই সব নিঃসম্বল সংসার-পরিত্যক্ত হতভাগ্য নরহস্তার দল মৃত্যুকে গ্রহণ করবে কিসের জোরে? কী অবলম্বন করে তারা পা বাড়াবে মরণ-সাগরের সীমাহীন অন্ধকারে? তাই মৃত্যু শুধু একটিমাত্র রূপে দেখা দেয় তাদের চোখে, সে রূপ বিভীষিকার রূপ। সে রূপ দেখে ফাঁসি-যন্ত্রের উপর কেউ আর্তনাদ করে, কেউ দাঁড়িয়ে থাকে বজ্রাহত মৃতদেহের মতো, কেউ ভেঙে দুমড়ে আছড়ে পড়ে, কেউবা অর্থহীন প্রলাপের আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় গ্রাসোদ্যত মরণের করাল ছায়া।
মৃত্যু-ছায়া যে কি বস্তু, সে তো আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আজ তোমার ফাঁসি—এই সরল ছোট্ট একটি মাত্র বাক্য কেমন করে একটা দৃঢ়কায় সুস্থ মানুষের মুখের উপর থেকে সমস্ত রক্ত মুহূর্তে শুষে নেয়, সে বীভৎস দৃশ্যও আমার চোখে পড়েছে। মৃত্যু আসন্ন, এ কথা তো তার অজ্ঞাত ছিল না। এই দিনটির জন্যেই সে তৈরী হয়েছে বহুদিন ধরে। তবু আসন্ন আর আগতের মধ্যে দুস্তর ব্যবদান। নিশ্চিত হলেও মরণ এতদিন ছিল তার মানশ্চক্ষে। আজ সে সশরীরে উপস্থিত। আজ রুদ্রের অবির্ভাব। তারই নিঃশ্বাসে একটা জীবন্ত মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরে যায়। রক্তমাংসের গড়া জ্যান্ত ধড়ের উপর দেখা দেয় চর্মাবৃত কঙ্কালের মুখ। এ দৃশ্য দেখবার সুযোগ কজনের ভাগ্যে জোটে? সিতাংশুর জুটেছিল, কিন্তু সে দেখল না।
সিতাংশুর সঙ্গে আমার বিরোধ নেই। পুণ্যাত্মা শহীদদের জন্যে রইল আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি। কিন্তু এই পাপাত্মা খুনীদের জন্যে রইল কি? কিছু না। সেখানে আমি রিক্তহস্ত। আমার কাছে, সংসারের মানুষের কাছে কোনো দাবী তাদের নেই। তবু কখনো ক্বচিৎ কোনো সঙ্গিহীন নিরালা সন্ধ্যায়, মন যখন গুটিয়ে আসে একান্ত আপনার মধ্যে, চোখ বুজলে আমি সেই মরণাহত, রক্ত-লেশহীন, ভীতি-পাণ্ডুর শীর্ণ মুখগুলো দেখতে পাই। ভয় নয়, ঘৃণা নয়, কী এক অব্যক্ত মমতায় সমস্ত অন্তর ভরে ওঠে।
।। প্ৰথম পৰ্ব সমাপ্ত।।