নরক সংকেত – ৭

জার্মানির রাজধানী বার্লিনের ঠিক পাশেই পটসড্যাম শহর, এটি নিজেও জার্মানির ব্র্যান্ডেনবার্গ রাজ্যের রাজধানী। বার্লিনের মতো অতটা ঐতিহ্যমণ্ডিত না হলেও চোখজুড়োনো হ্যাভেল নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই শহরে যুগে যুগে প্রচুর বিদেশির আগমন ঘটেছে। ফ্রান্স, রাশিয়া, নেদারল্যান্ড, বোহেমিয়া এবং আরও অনেক দেশ থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতির এবং বিভিন্ন ভাষার মানুষজন এখানে এসে বসবাস করার ফলে এই পটসড্যাম শহরে এখন বৈচিত্র্যমণ্ডিত অনেক ধরনের লোকজনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বিভিন্ন কালচারের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে দারুণ সমস্ত আর্কিটেকচার।

এই পটসড্যাম শহরেই জার্মানির প্রধান পুলিশবাহিনী ফেডেরাল পুলিশের হেডকোয়ার্টার। এমনিতে জার্মানির প্রতিটা রাজ্যের নিজস্ব পুলিশ ফোর্স রয়েছে, তাদের বলা হয় ল্যান্ডপুলিশ। আর এই ফেডেরাল পুলিশবাহিনী কোনো রাজ্যের অধীনে নয়, সারা দেশের নিরাপত্তার দেখভাল করে এরা, তাই এরা সরাসরি ফেডেরাল মিনিস্ট্রির অধীনে।

রোদ ঝলমলে এক সকালে নিজের দপ্তরে বসে ফেডেরাল পুলিশের চিফ পুলিশ কমিশনার অ্যান্টন স্নেইডার মুখে মুখে ডিকটেট করছিলেন, আর তাঁর সেক্রেটারি লিনা ঝড়ের গতিতে ল্যাপটপে টাইপ করছিল।

বাইরে সুন্দর রোদ উঠেছে, তার সঙ্গে হালকা হাওয়াও দিচ্ছে বেশ, মি স্নেইডার পুলিশের দুঁদে বড়োকর্তা হলেও একটু প্রকৃতিপ্রেমিক গোছের, বাইরের লাল হলুদ পাতাওয়ালা বিশাল গাছটার দিকে তকিয়ে মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে পড়ছিলেন তিনি। একটা কবিতার লাইন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল হঠাৎ তারই মধ্যে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গের এই ডিকটেশন দিতে গিয়ে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি।

লিনা একবার একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘স্যার, আগের সেনটেন্সটা শেষ করলেন না তো! ইউ আর কর্ডিয়ালি ইনভাইটেড টু … তারপর?’

মি স্নেইডার তাঁর কবিতায় কী—একটা শব্দের মিল খুঁজছিলেন মনে মনে, লিনার কথায় একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘উফ লিনা! তুমি কি নতুন ঢুকেছ নাকি চাকরিতে? দেখছ আমি ওঁদের ইনভাইট করছি, তাহলে ইনভাইটেড টু আমাদের এই অফিসেই হবে, নিশ্চয়ই আমার বাড়িতে আমি রাষ্ট্রসঙ্ঘের কর্তাদের নিমন্ত্রণ করব না। কমন সেন্সটা অ্যাপ্লাই করো।’

লিনা বকুনি খেয়েও কিছু মাইন্ড করল না। স্নেইডার স্যার একটু এরকমই। মাঝে মাঝেই বেখেয়ালি হয়ে পড়েন। তবে মানুষটা ভালো। কাজ ছাড়াও লেখালেখি নিয়ে থাকেন, আর মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যান, বাক্স—প্যাঁটরা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। বলেন, ওটাই তাঁর অক্সিজেন।

ও মাথা নীচু করে টাইপ করতে লাগল, ‘ওকে, স্যার!’

মি স্নেইডার আবার কবিতার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে ভাবলেন, নাহ! যেটুকু মনে মনে লিখলেন সেটা এইবেলা নোট করে রাখা ভালো। এখন আগামী কয়েকদিন অনেক ইম্পর্ট্যান্ট সব কাজ রয়েছে, মিটিংও রয়েছে কয়েকটা আন্তর্জাতিক কমিটির সঙ্গে, এখন কাব্য করলে তাঁর চলবে না।

তিনি সোজা হয়ে বসে কী—একটা বলতে যাবেন, তার আগেই টেবিলের টেলিফোন বেজে উঠল। লিনা ফোনটা রিসিভ করে কয়েক সেকেন্ড কথা বলেই ফোনটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিল, ‘আপনার আর্জেন্ট ফোন স্যার!’

মি স্নেইডার ফোনটা ধরলেন তাড়াতাড়ি, অনেক স্টেপ পেরিয়ে তাঁর কাছে ফোন আসে, নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু।

লিনা দেখল ফোনটা ধরে শুনতে শুনতে মি স্নেইডারের ভ্রূ দুটো অনেকটা উঠে গেল, হুঁ—হাঁ ছাড়া কিছু বলছেন না, মিনিট পাঁচেক বাদে ফোনটা রেখেই উঠে দাঁড়ালেন। আগে ওঁর বেশ সুন্দর সুঠাম চেহারা ছিল, এখন একটু মোটা হচ্ছেন, উঠে দাঁড়ালে হালকা ভুঁড়ির আভাস পাওয়া যায়।

মি স্নেইডার উঠে কোমরের বেল্টটাকে ঠিক করে নিলেন, সামনের বেলটা দু—বার বাজিয়ে বললেন, ‘লিনা, কোলন ক্যাথিড্রালের সামনে একটা ব্লাস্ট হয়েছে একটু আগে। আমি ফেলিক্সের সঙ্গে একটু বসব। তুমি ওই রাজ্যের ডিফেন্স সেক্রেটারির সঙ্গে আমার একটা মিটিং শিডিউল করো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!’

লিনা উদ্ভ্রান্ত মুখে উঠে দাঁড়াল।

এই দেশেও ব্লাস্ট শুরু হয়ে গেল?

তাও আবার জার্মানির সবচেয়ে নামকরা টুরিস্ট ডেস্টিনেশন কোলন ক্যাথিড্রালে?

ওয়েস্ট ফেলিয়া রাজ্যের রাজধানী কোলন শহরের একদম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রায় ন—শো বছরের পুরোনো এই রোমান ক্যাথলিক চার্চ সারা ইউরোপের সবচেয়ে বড়ো গথিক চার্চ। ওখানকার আর্চবিশপ জার্মানির একজন অত্যন্ত মান্যগণ্য ব্যক্তি, স্বয়ং চ্যান্সেলরও খাতির করে চলেন তাঁকে।

ওখানে হামলা মানে তো বিশাল ব্যাপার!

ও উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, ‘স্যার কতজন মারা গেছে?’

স্নেইডার তাঁর পার্সোনাল ল্যাপটপটা খুলে কাজ করতে করতে বললেন, ‘ক্যাথিড্রালের ভেতরে কিছু হয়নি, বাইরে যে বড়ো দুটো রাস্তার ক্রসিং, সেইখানে একটা বাইকে ব্লাস্ট হয়েছে। বাইকটা চালিয়ে যাচ্ছিল, সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকার সময় কেউ একটা এক্সপ্লোসিভ ছুড়ে দেয় পাশের কোনো গাড়ি থেকে, মুহূর্তের মধ্যে সেটা ব্লাস্ট করে। গ্রেনেড জাতীয় কিছু। পেছনে যে ছিল সে ভীষণভাবে ইনজিয়োর্ড, আর সামনের জন স্পট ডেড। দুজনেই আগের বছর সিরিয়া থেকে এসেছিল, টেম্পোরারি রিফিউজি পাসপোর্ট হোল্ডার।’

লিনা ততক্ষণে ওর ফোনে একটা লাইভ নিউজ চ্যানেল খুলে ফেলেছে।

কোলন ক্যাথিড্রাল এতটাই বিশাল, প্রায় ছ—শো বছর লেগেছিল তৈরি হতে। এখনও সবসময় চার্চের কোনো—না—কোনো অংশে মেরামতি চলতেই থাকে। প্রতিদিন সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার মানুষের ভিড় হয় সেখানে।

ওখানে অ্যাটাক মানে পুরো জার্মানির ইন্টারনাল সিকিউরিটির ওপরেই প্রশ্ন উঠে যাওয়া।

নিউজে দেখাচ্ছে ক্যাথিড্রালের একদিকের বাইরের রাস্তায় একটা বাইক দুমড়ে—মুচড়ে পড়ে আছে, তার পাশে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে রক্ত।

পাশেই একটা আপাদমস্তক কালো পলিথিনে ঢাকা ডেডবডি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

নিউজ অ্যাঙ্কর উত্তেজিতভাবে বলছেন, ‘ইংল্যান্ডের ইসলিংটন, ফ্রান্সের প্যারিস, গ্রিসের কাভালা, ইংল্যান্ডের কিংস্টন এবং আজ জার্মানির কোলন। গত দু—মাসে এই নিয়ে পরপর পাঁচবার ইউরোপের পাঁচটি শহর কেঁপে উঠল বিস্ফোরণে। বিস্ফোরণের তীব্রতা খুব বেশি না হলেও এইগুলোর মধ্যে প্রতিটাই টুরিস্ট স্পট, মারাও গেছেন বিদেশিরাই, ফলে এটাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার গাফিলতি বলেই মনে করছে প্রতিটা সরকার। এই প্রত্যেকটা ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না সেই ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছেন সমগ্র ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। ঘটনাচক্রে এই সপ্তাহেই ফেডেরাল পুলিশের হাইকম্যান্ড বৈঠকে যোগ দিতে আসছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের কিছু শীর্ষ নেতৃত্ব। তার আগেই এই ঘটনা কিছুটা হলেও কি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে? এই ব্যাপারে বৈঠকে বসেছেন দেশের ডিফেন্স মিনিস্টার। ইতিমধ্যেই তিনি ফেডেরাল পুলিশকে জরুরি ভিত্তিতে তদেন্তর নির্দেশ দিয়েছেন।

মি স্নেইডার চোখ কুঁচকে বললেন, ‘আহ লিনা, তোমাকে বলেছি না, কখনো কোনো মিডিয়ার নিউজ শুনবে না? শুনলেও সারমর্ম শুনে বন্ধ করে দেবে। না হলে আমরা নিরপেক্ষভাবে ভাবতেই তো পারব না, জার্নালিস্টদের বলতে থাকা ঘটনাগুলো কল্পনা করেই যুক্তি সাজাতে থাকব, তাই না!’

লিনা মাথা নেড়ে নিউজ চ্যানেলটা বন্ধ করল, ‘ওকে, স্যার! আমি যাচ্ছি।’

স্নেইডারের ফোনে একের পর এক মেসেজ ঢুকছিল, তিনি সেগুলো দেখতে দেখতে ইন্টারকমের ডায়াল ঘোরালেন, ‘মেরি, সব স্টেটের ল্যান্ডপুলিশ চিফদের সঙ্গে আমার একটা ভিডিয়ো কনফারেন্স অ্যারেঞ্জ করো, এক্ষুনি! আর ওই কোলন সিটির চিফকেও ইনক্লুড করো।’

লিনা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিনিয়র ইনস্পেকটর ফেলিক্স ঢুকল।

স্নেইডার ততক্ষণে ডুবে গেছেন কাজে। তিনি কবিতা লেখার ব্যাপারে যতটা দায়িত্ববান,কাজের ব্যাপারেও ঠিক ততটাই। লিনা চলে যাওয়ার পরেও ওই অ্যাঙ্করের বলা কথাগুলো তাঁর মাথায় ঘুরছে। এইজন্যই তিনি পারতপক্ষে খবর শোনেন না। ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে ফেলিক্সের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ফেলিক্স, মেরি কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মিটিং শিডিউল করছে। তুমি আমাকে ততক্ষণ একটা ফাইল বানিয়ে দাও তো আজকের ব্লাস্টের।’

ফেলিক্স বলল, ‘অল রাইট স্যার।’

ফেলিক্স চলে যেতে গিয়েও কিছু ফিরল, ‘স্যার, শুধু কোলন নয়, লাস্ট দু—মাসে ইংল্যান্ডের দুটো টাউন, গ্রিসের কাভালা আর প্যারিসেও ব্লাস্ট হয়েছে। ওগুলোরও বানিয়ে দিচ্ছি।’

মি স্নেইডার চোখ ছোটো করলেন, ‘তুমি কি কোনো নিউজ চ্যানেল শুনে এলে নাকি? আরে, ওগুলো তো আমাদের এক্তিয়ারেই নয়। অন্য দেশ। এমনকী, এই কোলনের ঘটনাটাও ওই স্টেটের পুলিশের আন্ডারে, তবে যেহেতু ডিফেন্স মিনিস্টার বলেছেন তাই আমাদের দিকে ডেলিগেট হচ্ছে।’

ফেলিক্সকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরক্ষণেই মত বদলালেন তিনি, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ওগুলোরও কেস হিস্ট্রি করে নিয়ে এসো। ডিটেইলড ফরেনসিক রিপোর্ট চাই না আমার, পুরো সিনপসিসটা হলেই চলবে।’

ফেলিক্স ঘাড় নাড়ল, ‘ঠিক আছে, স্যার। আরেকটা কথা আপনাকে বলার ছিল। বার্লিন সিটি পুলিশ থেকে একজন কনস্টেবলকে পাঠানো হয়েছে ওই ক্যাসপার ফটোগ্রাফি স্টুডিয়োর গার্ডের পোস্ট—মর্টেম রিপোর্টটা নেওয়ার জন্য।’

স্নেইডার চোখ সরু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন।

ফেলিক্স মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, ‘আপনি চেয়ে পাঠিয়েছিলেন না? স্পেশাল টিম পাঠালেন জিনিসটা পাহারা দেওয়ার জন্য, তবুও তো কিছু করা গেল না।’

স্নেইডার মাথা নাড়লেন, ‘ওহ! সেই চুরির কেস!’

ফেলিক্স বলল, ‘শুধু চুরি নয় স্যার, ওদের ল্যাবের গার্ডটাও তো মার্ডার হয়ে গেল মাঝখান থেকে সিসি ক্যামেরা মনিটরিং—এর লোকটাও তখন ছিল না।’

স্নেইডার বললেন, ‘হুম। ঠিক আছে, তুমি অরিজিন্যাল রিপোর্টটা রেখে একটা কপি দিয়ে দাও ওদের।’

ফেলিক্স ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে স্নেইডার বিড়বিড় করলেন, ‘ওই চুরি যাওয়া জিনিসটাও তো এখনও পাওয়া গেল না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *