৫
সেপ্টেম্বর ১৯৩১, জার্মানি
অ্যাডি, মি হফম্যানের স্টুডিয়োর ওই মেয়েটা এসেছে আবার। আমি বললাম তুমি দেখা করবে না, কিন্তু কিছুতেই কথা শুনছে না। একভাবে বসে আছে নীচে।’ অ্যাঞ্জেলা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে অ্যাডি খেয়ালই করেনি।
সোফায় শরীরের ঊর্ধ্বাংশ হেলিয়ে রেখে মেঝের কার্পেটের ওপর পা দুটোকে এলোমেলো ছড়িয়ে বসে ছিল অ্যাডি। গায়ে কয়েকদিনের পুরোনো রাতপোশাক। সকাল থেকে ওর মন রাগে তেতো হয়ে আছে। অথচ গত ছ—টা দিন ও মুখে কুটোটি কাটেনি। এত ব্যস্ত শিডিউলে অন্য সময় দিনের প্রায় আঠেরো ঘণ্টা ব্যস্ত থাকে ও, কিন্তু কয়েকদিন সব কিছু থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নিয়েছে। চুপচাপ এই ছোট্ট বিছানার পাশের সোফাতেই কাটিয়েছে একভাবে।
কিছুক্ষণ পরে অ্যাঞ্জেলা আবার ভারী গলায় বলল, ‘চলে যেতে বলব তো?’
অ্যাডি উত্তর দিল না। হফম্যান ওর পরিচিত ফটোগ্রাফার, পার্টির মিটিং মিছিলে ছবি তোলে। ইভা বলে নতুন মেয়েটা হফম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ঢুকেছে কিছুদিন হল।
এই অবস্থায় কী চায় সে?
আসছে কেন বারবার?
ও মুখ তুলে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল, ওর উদাস দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রাস্তায়। ওর বাড়ির বাইরে মৃদু কোলাহল শোনা যাচ্ছে, অনেকগুলো জার্মান বুটের সশব্দ পদচারণা শোনা যাচ্ছে।
এত আওয়াজ কীসের?
জার্মানির উত্তর—পূর্বদিকে অবস্থিত এই বার্লিন শহর প্রায় সাতশো বছরের পুরোনো। পত্তনের গোড়া থেকেই যখন যে রাজত্ব চলেছে এই অঞ্চলে, বার্লিন থেকেছে তার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে যুগে যুগে এই শহর সংস্কৃতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান এবং আর্কিটেকচারের ধারক হয়ে থাকলেও মাঝেমধ্যে হিংসার হাত থেকেও রেহাই পায়নি। ষোলোশো আঠেরো সাল থেকে শুরু হওয়া পুরো সেন্ট্রাল ইউরোপে চলা ত্রিশ বছরের বিখ্যাত ধর্মযুদ্ধে তো গোটা বার্লিন শহর প্রায় ধ্বংসই হয়ে গিয়েছিল। অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল অসংখ্য বাড়ি। প্রুসিয়া সাম্রাজ্যের সময় হৃত গৌরব আবার ফিরে পায় বার্লিন।
তারপর ইতিহাসের পাতা উলটেছে সময়ের চাকার সঙ্গে সঙ্গে, এক দল গড়ে তুলেছে নিপুণ ভাস্কর্য, আরেক দল ক্ষমতায় এসে তা গুঁড়িয়ে দিয়েছে নিষ্ফল আক্রোশে।
সবই রিপুর খেলা।
এই বার্লিনকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করার কত স্বপ্নই না দেখেছিল অ্যাডি। নাওয়াখাওয়া ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কর্মযজ্ঞে। এই শহরের জন্য জেল খেটেছে, এই শহরের জন্য দিনের পর দিন গলার শির ফুলিয়ে বক্তৃতা দিয়ে উদবুদ্ধ করেছে জনসাধারণকে। বিশুদ্ধ আর্য জাতির দেশের আদর্শ রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তো সে এই শহরকেই বেছে নিয়েছিল।
কিন্তু এখন আর কিচ্ছু ইচ্ছেই করছে না।
কিছু ভালোই লাগছে না ওর। মনে হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে চলে যায় দূরে কোথাও কোনো শান্ত জনশূন্য প্রান্তরে।
অথচ এই বছরটা ওর খুব ভালোই যাচ্ছিল। ল্যান্ডসবার্গ জেলে বসে লেখা ওর প্রথম বই বেস্টসেলার হয়েছে। মাত্র কয়েক মাসে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। ভালো রোজগার হয়েছে সেটা থেকে। ওর সাধের দলও এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টিতে পরিণত হয়েছে। দেশের তাবড় তাবড় শিল্পপতিরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে ওর পার্টিই দেশের একমাত্র ভবিষ্যৎ, অ্যাডিই দেশের মুখ। তাদের মোটা টাকার ইনভেস্টমেন্টে সদ্য মিউনিখ শহরে পার্টির হেডকোয়ার্টার খোলা হয়েছে, নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রাউন হাউস’।
দেশেও সমর্থকদের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ। তার মূলে অবশ্যই ওর অসাধারণ বাগ্মিতা।
তবু এরই মধ্যে গেলি নেই, এটা যেন এই ছ—দিনেও ও হজম করতে পারছে না। থেকে থেকে মনে পড়ছে সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা, যখন গেলির সঙ্গে মাঠে ছুটতে ছুটতে ও নিজেও প্রাণোচ্ছল কৈশোরে ফিরে যেত, নাম—না—জানা পাখি, প্রজাপতি দেখে আনন্দ পেত নিজের অজান্তেই!
গেলি আর কোনোদিনও ফিরবে না। তাহলে অ্যাডি কী করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে?
অ্যাঞ্জেলা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, উত্তর না পেয়ে সে যখন ঘর থেকে প্রায় বেরিয়ে গেছে, অ্যাডির হঠাৎ মনে হল এই ইভা বলে মেয়েটার সঙ্গে গেলির চোখ দুটোর খুব মিল।
আগে যে—একবার কথা হয়েছিল, তখনও লক্ষ করেছিল, কথা বলার ধরনেও সাদৃশ্য আছে বেশ। শুধু যৌবনে উপনীত হওয়া এই মেয়েটার চেহারায় লাবণ্য আরও বেশি, গেলির মতো কৈশোরের সুপ্ত কুঁড়ি নয়।
ও পিছু ডাকল, ‘অ্যাঞ্জেলা, ওই মেয়েটাকে নিয়ে এসো এখানে।’
অ্যাঞ্জেলা একটু অবাক হল, ‘এখানে? না নীচের কনফারেন্স রুমে?’
অ্যাডি বলল, ‘এখানেই নিয়ে এসো।’
এই ঘরে কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি এখনও অবধি। তার ওপর দু—দিন আগে যখন এই মেয়েটা এসেছিল, অ্যাডি দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
অ্যাঞ্জেলা অবাক হলেও মুখে সেটা প্রকাশ করল না, ‘ঠিক আছে। আমি নিয়ে আসছি।’
অ্যাডির চোখ দুটো খুব জ্বালা করছিল, এমনিতেই সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে মাঝে মাঝেই ওর চোখ থেকে জল পড়তে থাকে, মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ আর এই —কদিনের ক্রমাগত চোখের জলে এ দুটো মনে হয় ভালোরকম অবাধ্যতা শুরু করেছে।
নিজের বিস্রস্ত পোশাকটা একটু গুছিয়ে দেওয়ার জন্য সোফা ছেড়ে উঠতেই বাঁ—পাশে বিছানার ওপর বালিশের ভাঁজে আধশোয়া অবস্থায় রাখা কালকের গোলাপ ফুলটা চোখে পড়ল। ফুলটার কয়েকটা পাপড়িতে কালো ছোপ ধরেছে, সেই পাপড়িগুলো গুটিয়ে ঈষৎ কোঁচকাতে শুরু করেছে।
পাশের হলদেটে সাদা ক্রিম—রঙা সাটিনের ওপর লেসের কাজ করা সুন্দর ফ্রকটার গায়ে সেই কুঁচকোনো পাপড়ির একটা এলিয়ে পড়েছে অবহেলায়, ওই শুকিয়ে যাওয়া ফুলের পাপড়িটা যেন নিঃশব্দে বিদ্রুপ করছে ওই ফ্রকটাকে।
মুহূর্তের মধ্যে অ্যাডির মাথায় যেন আগুন ধরে গেল, রাগে উন্মত্ত হয়ে ও চিৎকার করল,’অ্যাঞ্জেলা! অ্যাঞ্জেলা! ম্যাক্স! সবাই কি মরে গেছ নাকি?’
অ্যাঞ্জেলা ওই মেয়েটাকে নিয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল, হঠাৎ অ্যাডির উন্মত্ত চিৎকার শুনে ত্রস্ত পায়ে দোতলার এককোণের ছোট্ট ঘরটায় গিয়ে ঢুকল। এটা অ্যাডির ঘর নয়, অ্যাডি দোতলার অন্যপাশের সবচেয়ে বড়ো ঘরটায় থাকে, কিন্তু এই কয়েকদিন এখান থেকে একবারের জন্যও সে বের হয়নি।
অ্যাঞ্জেলা ঘরে ঢুকে বিস্মিতভাবে বলল, ‘কী হয়েছে অ্যাডি?’
অ্যাডি ফুলটার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করল, ‘ফুলটা পালটানো হচ্ছে কিনা সেই খোঁজটাও তোমাদের রাখার সময় হয় না? বাসি শুকিয়ে যাওয়া ফুল রেখেছ?’
অ্যাঞ্জেলা দ্রুত গতিতে ফুলটা তুলে নিয়েই বেরিয়ে গেল। মেয়েটা পেছন পেছন এসেছিল, থতোমতো খেয়ে দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে রইল।
অ্যাঞ্জেলা কিছু বলল না। বাইরের মেয়েটার সামনে অপমানে ওর চোখে জল এসে গেছে। অ্যাডি যে বাসি ফুল সহ্য করতে পারে না, সেটা অ্যাঞ্জেলা ছোট্টবেলা থেকে জানে। এমনকী অ্যাডির নিজের মা মারা যাওয়ার সময়েও কফিনের ওপরের স্মৃতিসৌধে দেওয়া প্রচুর ফুলের স্তবকের মধ্যে একগুচ্ছ শুকিয়ে যাওয়া ফুল নিয়ে এরকমই তুলকালাম করেছিল।
কিন্তু এই সময়েও কি ওর সঙ্গে অ্যাডি একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারে না? ও কি এই বাড়ির আর পাঁচটা কাজের লোক? নাকি অ্যাডি নিজে সেটাই মনে করে। ভুলে গেছে যে অ্যাঞ্জেলা ওর দিদি! হোক সৎ, ছোটো থেকে সৎ দিদি বলে কর্তব্যে কোনোরকম গাফিলতি করেছিল অ্যাঞ্জেলা ছোটো ভাইয়ের প্রতি?
আর যে চলে গেছে সে না হয় অ্যাডির বোনঝি, আর অ্যাঞ্জেলার?
অ্যাঞ্জেলার সে নিজের সন্তান!
ওর স্বামী মারা যাওয়ার পর তিলতিল করে বড়ো করা, ওর নিজের শরীরের রক্ত মাংস দিয়ে তৈরি প্রাণবন্ত মেয়েটা মাত্র তেইশ বছরে নিজেকে শেষ করে দিল, মা হয়ে ওর নিজের বুকটা ফেটে যাচ্ছে না?
মনে হচ্ছে না, এক ছুটে গিয়ে অ্যাডির সাধের যে পিস্তলটা দিয়ে ওর ছোট্ট মেয়েটা নিজেকে শেষ করে দিয়েছে, সেই পিস্তলটা দিয়েই অ্যাডির মাথাটা মুহূর্তে এফোঁড়—ওফোঁড় করে দিতে?
মামার ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে! মেয়েটাকে দিনের পর দিন ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখে, একরকম মানসিক রুগী করে তোলার সময় কোথায় ছিল এই স্নেহ?
অবশ্য স্নেহ কত ওর জানা আছে! ভিয়েনায় থাকতে ঘুণাক্ষরেও যদি ও বুঝতে পারত মামা হয়ে অ্যাডির ওই ভালোবাসাটা শুধুই স্নেহ নয়, তার মধ্যে মিশে আছে নিজের বিকৃত লালসা চরিতার্থ করার কাম, মা হয়ে কক্ষনো নিজের মেয়েকে আসতে দিত এখানে অ্যাডির সঙ্গে?
ওর ছোটো বাচ্চাটা!
ফুলদানিটা সাজাতে সাজাতে ও আবার নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত গেলি পালাতে চেয়েছিল এই অভিশপ্ত বাড়ি থেকে, লুকিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল ওর কাছে ভিয়েনায়, কিন্তু অ্যাডির সিকিউরিটিরা কড়া হাতে ফেরত নিয়ে এসেছিল তাকে, আর তরপর অ্যাডি নিজে এসে বন্ধ দরজায় তালা দিয়ে রেখেছিল দিনের পর দিন, সব খবর আছে ওর কাছে।
ভালোবাসা!
অ্যাডি যতই শোকপালন করুক, বাড়ির কোনো কাজের লোকের জানতে বাকি নেই, আর কাজের লোক তো দূর। সারা জার্মানি বলতে গেলে জেনে গেছে তাদের অসামান্য বক্তা, বিখ্যাত নেতার কীর্তি। এমনকী, একটা কাগজ তো পরিষ্কার লিখেছে, ইট’স আ মার্ডার!
হতে পারে গেলি সুইসাইড করেছে, কিন্তু তাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মতো মানসিক অত্যাচার যে করল, সে খুনি নয়?
অনেক… অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করছে অ্যাঞ্জেলা।
এখন মনে হয় কী কুক্ষণে গেলিকে ও আসতে দিয়েছিল এখানে।
ভারাক্রান্ত মনে ফুলদানিটা নিয়ে পর্দা সরিয়ে ঢুকতে যেতেই ও বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গেল। ঘৃণায় কেঁপে উঠল ওর মন।
ঘরের ঠিক সেইখানটায় বেঁকেচুরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অ্যাডি, ঠিক যেখান’টায় ছ—দিন আগে অ্যাঞ্জেলার তেইশ বছরের মেয়েটা নিজের মাথায় নিজেই গুলি করে নিশ্চল হয়ে পড়েছিল।
গভীর অশ্লেষে অ্যাডি চুমু খাচ্ছে মি হফম্যানের স্টুডিয়োয় নতুন যোগ দেওয়া ইভা নামের ওই মেয়েটাকে!