নরক সংকেত – ১৭

১৭

প্রিয়ম অফিস থেকে বেরিয়ে রুদ্রকে বারতিনেক চেষ্টা করেও ফোনে পেল না। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। আজ অফিসে এতটাই চাপ ছিল যে প্রিয়ম লাঞ্চ টাইমেও ফোন করার সময় পায়নি। শুধু একটা মেসেজ করেছিল রুদ্র খেয়েছে কি না। তারও কোনো উত্তর নেই।

নির্ঘাত ও অফিসে এসে থেকে ফোন করেনি বলে রেগে গেছে।

প্রিয়ম বেশি চাপ নিল না। রুদ্রর রাগ ও খুব ভালো করেই জানে, একদম সাইন কার্ভের মতো। এই রাগ এই হাসি। যেমন ধুম করে রেগে যায়, তেমনই সেই রাগ গলে জল হতেও সময় লাগে না বিশেষ।

প্রিয়ম আর বেশি ফোন করল না। এখন বার বার ফোন করলে আরও রেগে যেত পারে। তার চেয়ে একেবারে গিয়েই কথা হবে, আর তো পনেরো—কুড়ি মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছে বাড়ি।

বাসে উঠে কানে হেডফোন গুঁজে বব ডিলান শুনতে শুনতে একটু রিল্যাক্স করছিল প্রিয়ম। কাল সারাদিন অনেক ঘোরার প্ল্যান আছে। মাদাম তুসো তো যাবেই, যদি সম্ভব হয় ডার্ডল ডোরটাও চলে যাবে ওখান থেকেই। কতদিন হয়ে গেল লন্ডন শহরে এসেছে, তবু এত পপুলার জায়গাগুলোতে যাওয়াই হয়নি ওর, ইন্ডিয়া থেকে আসা কলিগরা কবে দেখে নিয়েছে সব। সেবার অরিন্দমরা ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কী ঝুলোঝুলি, তিমির তো ফ্ল্যাটেই চলে এল ওকে বগলদাবা করে নিয়ে যাবে বলে।

কিন্তু প্রিয়ম যায়নি।

কেন জানে না, রুদ্রর সঙ্গে ঘুরতে যে আনন্দটা পাওয়া যায়, সেটা অন্য কারুর সঙ্গেই পাওয়া যায় না। ওর গম্ভীরভাবে প্রিয়মকে জ্ঞান বিতরণ করা, পরক্ষণেই কোনো শিশুসুলভ আবদার করা, সব কিছুই প্রিয়মকে আনন্দ দেয়। সেটা রুদ্র ওর স্ত্রী বলে নয়, ওদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব আর বোঝাপড়ার জন্যই। ওর একা একা যেতে ইচ্ছেই করত না, ঠিক করে রেখেছিল রুদ্র এলে একসঙ্গে ঘুরতে যাবে।

আচ্ছা, এর মাঝে একদিন সময় করে স্কটল্যান্ড ঘুরে এলে কেমন হয়? শুনেছে ছবির মতো জায়গা, নির্জন উপত্যকা আর চোখজুড়োনো নৈসর্গিক দৃশ্য।

হঠাৎ একটা ফোন আসতে ওর ঘোরার পরিকল্পনায় ছেদ পড়ল। স্ক্রিনে দেখল ড শ্যুমাখারের নাম ভেসে উঠেছে। রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ও ড শ্যুমাখারের একটু উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ‘আচ্ছা, ম্যাডামকে ফোনে পাচ্ছি না। উনি আমাকে সকালে একবার ফোন করেছিলেন!’

প্রিয়ম একটু অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও একটু আগে ফোন করেছিলাম। পেলাম না। ফোন সাইলেন্ট করা থাকতে পারে।’

ড শ্যুমাখার একটু উদবিগ্ন গলায় বললেন, ‘কিন্তু উনি আমাকে ফোন করে শুধু এইটুকু বললেন যে, ফটোগুলো উনি আমার কাছে দিয়ে দিতে চান, ওগুলো নিজের কাছে রাখা উনি নিরাপদ মনে করছেন না। এইটুকু বলতেই লাইনটা কেটে গেল, তারপর থেকে উনি আর ফোন তুলছেন না।’

প্রিয়ম এবার সোজা হয়ে বসল। রুদ্র ফটোগুলো নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করছে না? কিন্তু কেন?

ও বলল, ‘কখন ফোন করেছিল আপনাকে?’

ওদিক থেকে ড শ্যুমাখারের গলা শোনা গেল, ‘তা ধরুন সকালে সাড়ে এগারোটা নাগাদ।’

প্রিয়মের এবার হঠাৎ টেনশন হতে লাগল। সকাল সাড়ে ন—টায় অফিস পৌঁছোনোর পর থেকে রুদ্রর সঙ্গে ওর আর কথা হয়নি। ওর কোনো বিপদ হল না তো? সংক্ষপে ও ড শ্যুমাখারের ফোনটা ছাড়তে চাইল, ‘আপনি রাখুন। আমি দেখছি।’

ড শ্যুমাখার ফোনটা কাটার আগে বললেন, ‘আমি কি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে আসব এখন? ছবিগুলো হারিয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

ও উত্তর না দিয়ে ফোন করল রুদ্রকে। এবারেও সেই এক জিনিস, রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল।

দেখতে দেখতে বাসও চলে এসেছে ওর স্টপেজে। কোনোমতে বাস থেকে নেমেই প্রিয়ম জোরে জোরে পা চালাল। এখন প্রায় সন্ধে ছ—টা। অন্যদিন দিনের আলো খটখট করে, কিন্তু আজ বেশ নিভু নিভু হয়ে এসেছে চারদিক। ঠান্ডা একটা হাওয়াও বেশ কাঁপুনি দিচ্ছে গায়ে। রাস্তাঘাটও ভেজা ভেজা। এদিকে কি বৃষ্টি হয়েছে এখুনি?

কিন্তু প্রিয়মদের অফিসের ওখানে তো কিছু বোঝা যায়নি।

দ্রুতগতিতে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে ঢুকতে এক মুহূর্তের জন্য উপরের দিকে তাকাল প্রিয়ম, অন্ধকারে কিছুই বোঝা গেল না। বিশাল এই বাড়িটা যেন আকাশের বুক চিরে একটা দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

মাঝে মাঝে ইংল্যান্ডের এই অতিরিক্ত নির্জনতা অসহ্য লাগে প্রিয়মের। ইন্ডিয়ার সেই কোলাহলটাও প্রয়োজন মানুষের জীবনের কখনো কখনো! একটা প্রাণ থাকে যেন সেই হইহইমুখর জায়গায়। এখানে সবকিছুই বড়ো বেশি যান্ত্রিক।

ফ্ল্যাটে পৌঁছে চার থেকে পাঁচবার বেল টিপেও যখন কোনো সাড়া পেল না, তখন বাধ্য হয়ে প্রিয়ম ধাক্কা দিতে লাগল জোরে জোরে। এখানকার দরজার এই একটা সমস্যা। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতর থেকে বন্ধ কি না।

রুদ্র কি বাইরে বেরিয়েছে কোথাও? সেক্ষেত্রে ওর তো এটা মাথায় থাকা উচিত যে প্রিয়ম এখন বাড়ি ফিরবে এবং আর কোনো ডুপ্লিকেট চাবি না থাকায় ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?

প্রিয়মের বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছিল। ও ধাক্কার প্রাবল্য বাড়িয়ে দিল।

আরও দশ থেকে বারোবার জোরে জোরে শব্দ করার পর দরজাটা আলতো ফাঁক হয়ে খুলে গেল। উশকোখুশকো চুলে, ঘুম জড়ানো লাল চোখে রুদ্র উঁকি দিল বাইরে, ‘ওহ তুমি! এসে গেছ! এরকম জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছ কেন? বেল বাজাবে তো!’

প্রিয়মের প্রচণ্ড ইচ্ছে হল রুদ্রর চুলের ঝুঁটিটা টেনে ওর মাথায় জোরে জোরে গাঁটা বসিয়ে দেয় খানকয়েক। অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করল ও, ‘তুমি ফোন ধরছিলে না কেন?’

রুদ্র ভেতরে যেতে যেতে একটা বিশাল হাই তুলল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শুনতেই পাইনি।’

প্রিয়ম এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘সেই সকাল থেকে নাগাড়ে ঘুমোচ্ছ? আমার কথা তো ছেড়েই দিলাম, আমি চিন্তা করলাম কি করলাম না, তা নিয়ে তো তোমার কোনো মাথাব্যথাই নেই জানি, ড শ্যুমাখার ফোন করেছেন, ধরোনি কেন? বেচারি টেনশনে পড়ে ছুটে আসছেন!’

রুদ্র প্রিয়মের জন্য কফি করতে যাচ্ছিল, এবার থমকে গেল একটু, ‘ড শ্যুমাখার এখানে আসছেন?’

প্রিয়ম এবারও কড়া গলায় বলল, ‘আসবেন না? তুমি ফোন করে কী না কী বলেছ ফটোগুলো তোমার কাছে নিরাপদ নয়, আর তারপর থেকেই ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছ।’

রুদ্র কী যেন চিন্তা করছিল, ‘উনি এই ফ্ল্যাটটা চেনেন?’

প্রিয়ম এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম যে ওই টুর্নামেন্টের দিনই ওঁকে পার্ক থেকে আমার অ্যাপার্টমেন্টটা দেখিয়েছিলাম। আর ফ্লোর তো বলেই দিয়েছি, উনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আসছেন।’

রূদ্র এবার চমকে উঠল। ভ্রূদুটোকে সাংঘাতিক রকমের কুঁচকে কী ভাবতে লাগল।

প্রিয়ম এবার একটু অধৈর্য হয়ে বলল, ‘কী হয়েছিল বলবে কি?’

রুদ্র অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘বলছি। আগে ড শ্যুমাখারকে একটা ফোন করে জিজ্ঞাসা করো তো উনি কোথায়?’

প্রিয়মের ভেতরে ভেতরে ভীষণ বিরক্তি লাগছিল, তবু কথা না বাড়িয়ে ও ফোন করল, কিছুক্ষণ কথা চালানোর পর, ড শ্যুমাখারকে এখানে আসার বিবরণ ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে ফোন রাখল ও, ‘উনি সবে বেরিয়েছেন। আসতে তাও আধঘণ্টা মতো লাগবে।’

রুদ্র বলল, ‘গুড! আচ্ছা প্রিয়ম, তুমি বলছিলে না, এখান থেকে স্টেশন খুব কাছে? সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনও ছাড়ে? মানে, প্যারিস বা ইংল্যান্ডের বাইরে অন্য কোনো জায়গায় যাওয়ার?’

প্রিয়ম বলল, ‘এখান থেকে কাছে যে স্টেশন সেটা তো ছোটো একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন, ওখান থেকে দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া যায় না।’ কথাটা বলেই ও খেয়াল করল, রুদ্র একটা মাঝারি মাপের রুকস্যাক লফট থেকে নামিয়ে ফেলল। তারপর আশপাশে পড়ে থাকা কিছু জামাকাপড় ঝড়ের গতিতে প্যাক করতে শুরু করল, তারই মধ্যে ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে কিছু শুকনো খাবারের প্যাকেট নিয়ে এসে চোখের নিমেষে গুঁজে দিল ভেতরে।

প্রিয়ম অবাক হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপারটা কী বলবে একটু খুলে?’

রুদ্র এবার মুখ তুলে তাকাল, ‘এখন অত কথা বলার সময় নেই প্রিয়ম! শুধু এইটুকু বলতে পারি যেভাবেই হোক এখান থেকে আমাদের এখন পালাতে হবে। তুমি চট করে ফ্রেশ হয়ে নাও। দশ মিনিটের মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের।’

‘মানে!’ প্রিয়ম একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল, ‘এই সন্ধেবেলা এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় পালাব? আর কেনই—বা পালাব!’

রুদ্র মাথা নীচু করে গোছাতে গোছাতে বলল, ‘এখানে আমরা একদমই নিরাপদ নই। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হও।’

প্রিয়ম এবার রেগে গেল, ‘তুমি কি আমাকে খুলে বলবে কী হয়েছে আজকে? কেউ কি আজ এসেছিল? তুমি ড শ্যুমাখারকে বলেছ যে ফটোগুলো তুমি নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করছ না? কী হয়েছে? সেরকম কিছু হলে খুলে বলো আমাকে, উনি আসুন, তারপর না হয় আমরা তিনজনে মিলে বসে একটা আলোচনা…!’

রুদ্র এতক্ষণ শান্তভাবে কথা বলছিল, এবার ও একটু উষ্ণভাবে বলল, ‘বললাম তো, তোমাকে আমি পরে সব খুলে বলছি। এখন আমাদের এখান থেকে শিগগিরই পালাতে হবে। তুমি যখন এই ব্যাপারটায় আমাকে জড়িয়েছ, তখন আমি কী করছি বা কেন করছি তার ওপর তোমার কনফিডেন্স থাকা উচিত, তাই না!’

প্রিয়ম এবার চুপ করে গেল, ‘কী করতে চাইছ তুমি এখন?’

রুদ্র বলল, ‘আমি তোমার আর আমার দুজনেরই এক সপ্তাহের মতো জামা গুছিয়ে নিচ্ছি। এখানে থাকা যাবে না কোনোমতেই।’

প্রিয়ম এবার শান্তভাবে বলল, ‘বেশ তো! চলো তাহলে আজকের মতো অরিন্দমদের বাড়ি গিয়ে উঠি। ওদের বড়ো অ্যাপার্টমেন্ট, কোনো অসুবিধা হবে না।’

রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘না। এখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন চলে না? ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে? সেটা কীভাবে ধরব?’

প্রিয়ম বলল, ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন ছাড়ে সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশন থেকে। ইউরোস্টার বা অন্যান্য দেশের ট্রেন ধরতে হলে ওই স্টেশনেই যেতে হয়। সেটা তো এখান থেকে অনেক দূর। এত রাতে কীভাবে যাব!’

রুদ্র রুকস্যাকটাকে পিঠে বেঁধে নিল, ‘ক্যাবে?’

প্রিয়ম বাথরুম লাগোয়া বেসিনটায় মুখে—চোখে হালকা জল দিচ্ছিল, সারাদিন অফিসে একনাগাড়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা, তারপর বাড়ি ফিরে রুদ্রর এই পাগলামি!

ও ক্লান্ত গলায় বলল, ‘কত বিল হবে জানো? সেন্ট প্যানক্রাস যেতে হলে এই হিলিংডনেই একটা ছোটো স্টেশন আছে, সেখান থেকে ট্রেন ধরে যাওয়া যাবে। তার চেয়ে কি এয়ারপোর্ট চলে যাবে?’

রুদ্র দ্রুত গতিতে মাথা নাড়ল, ‘দেখছি। তুমি বেরিয়ে এসো। দরজাটা লক করব।’ কথাটা বলেই ও আর দাঁড়াল না, ঝপাঝপ জুতো পরে দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় ঘরের আলোগুলো নিভিয়ে দিল।

প্রিয়ম কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না, ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে ও বলল, ‘কিন্তু ড শ্যুমাখার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন যে! ওঁর ওই ফটোগুলো কি সঙ্গে করে নিয়ে চলে যাবে নাকি!’

রুদ্র প্রিয়মের কথা শুনতেই পেল না, ঝড়ের বেগে ভেতরে গিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে এল, সেটাকে একহাতে রুকস্যাকে ঢোকাতে ঢোকাতে দরজাটা লক করেই লিফট লবিতে এগিয়ে গেল।

নীচে নেমে ওরা দেখল কেয়ারটেকার লোকটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রিয়ম কিছু বলার আগেই রুদ্র মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘ভালো আছেন? আমরা প্যারিস যাচ্ছি ঘুরতে। ফিরব এক সপ্তাহ বাদে। যদিও ফ্লাইটের আর বেশি দেরি নেই, তবে এখান থেকে তো এয়ারপোর্ট কাছেই, তাই না!’

জন নামে এই লোকটার সঙ্গে খুব হৃদ্যতা না থাকলেও মোটামুটি হাই হ্যালোর সম্পর্ক প্রিয়মের। রুদ্রর কথা শুনে জন বলল, ‘হ্যাঁ, বড়োজোর দশ মিনিট লাগবে বাসে।’ তারপর প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে ফর্মাল একটা হাসি হাসল, ‘ভালো করে ঘুরে আসুন। হ্যাপি জার্নি!’

বাইরে বেরিয়ে যেদিকে বড়োরাস্তা, সেদিকে না গিয়ে উলটোদিকের নির্জন পথ ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। রুদ্র ফোনে জি পি এস অন করেই রেখেছিল, গুগলের দেখানো লোকেশন অনুযায়ী চলছিল। ঘরের ভেতরে একদমই বুঝতে পারেনি বাইরে ভালো ঠান্ডা। সকালের বৃষ্টিটার জন্যই হয়তো তাপমাত্রা আরও কমে গেছে। মোটা পুলওভার ভেদ করে যেন ছুঁচের মতো বিঁধছে ঠান্ডা হিম, দূরে পশ্চিম দিকের আকাশে সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে, শুধু তার কমলা আভাটুকু ছড়িয়ে রয়েছে সারা আকাশটায়।

প্রিয়ম বিশেষ কথা বলছিল না। শুধু একবার অস্ফুটে বলল, ‘এয়ারপোর্ট কিন্তু উলটোদিকে।’

রুদ্র এবার একটু হাসল, বেচারাকে এমন অন্ধকারে রাখাটা ঠিক নয়। সারাদিন এত খেটেখুটে অফিস থেকে এল, এদিকে ধাতানির ভয়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না। কিন্তু কিছু করার নেই, এখন ওকে সব বুঝিয়ে বলে তারপর বেরোতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যেত।

পকেট থেকে ডান হাতটা বের করে ও প্রিয়মের হাতটা ধরল, ‘জানি। হিলিংডন স্টেশন যাচ্ছি। ওখান থেকে সেন্ট প্যানক্রাস। তোমার খিদে পেয়েছে, না? ট্রেনে উঠেই খেয়ে নিয়ো।’

প্রিয়ম চুপ করে রইল। ড শ্যুমাখার ইতিমধ্যে তিন চারবার ফোন করেছেন। ও রিসিভ করেনি। কী বলবে? যে, আপনি এত কষ্ট করে এলেন, আর আমরা একটু ফ্রান্স ঘুরতে চলে যাচ্ছি, এক সপ্তাহ পরে আসুন? রুদ্রর মাথায় কখন কী চাপে কিছুই বোঝা যায় না। জনকে বলল এয়ারপোর্টে যাচিছ, এদিকে চলে এল এইদিকে। কিন্তু প্রিয়মের এখন কিছু বলবারও নেই। এই ব্যাপারটায় তো রুদ্র প্রথম থেকেই ইনভলভ হতে চায়নি, ও—ই একরকম জোর করে ড শ্যুমাখারের সঙ্গে দেখা করিয়েছিল।

এখন মনে হচ্ছে না করালেই ভালো হত।

প্রিয়ম ছোটো একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গে প্যারিস যেতে পারব না বলে এরকম জোর করে বের করে নিয়ে এলে? অফিসে কিছু বলা হল না, কত প্রবলেম হবে জানো?’

রুদ্র চুপ করে হাঁটতে লাগল। এই ব্যাপারটা যে ও একেবারেই ভাবেনি তা নয়, কিন্তু এমন একেকটা সময় আছে যখন দুম করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।

প্রিয়ম আবার বলল, ‘আমার পাসপোর্টটা নিয়েছ?’

রুদ্র মাথা হেলিয়ে শুধু বলল, ‘নিয়েছি।’ তারপর প্রিয়মের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সুইচ অফ করে দিল ও। প্রিয়ম জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে বলল, ‘এটা কিছুক্ষণ বন্ধ থাক। আমারটাও অফ রেখেছি।’

ঘণ্টাখানেক পর ওরা ছোট্ট হিলিংডন স্টেশন থেকে টিউবে চেপে যখন সেন্ট প্যানক্রাসে পৌঁছোল, তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। রুদ্রর জোরাজুরিতেও প্রিয়ম কিছু মুখে দেয়নি, চুপচাপ মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল সারাটা রাস্তা। কথাও বলছে না বিশেষ। রুদ্র বুঝতে পারছিল প্রিয়ম বেশ রেগে গেছে। এমনিতে প্রিয়ম শান্ত হলে কী হবে, একবার রেগে গেলে চট করে স্বাভাবিক হতে চায় না।

ও আর বেশি ঘাঁটাল না। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন ধরার আগে পেট ভরে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। ও প্রিয়মকে বলল, ‘স্টেশনের বাইরে যাবে একবার? খেয়ে আসি কিছু, এসে না হয় টিকিট কাটব?’

প্রিয়ম শুধু বলল, ‘আমার খিদে নেই। তুমি যাবে তো যাও।’ তারপর রুদ্র একদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে দেখে যোগ করল, ‘আর এখানে ব্যাপারটা অত সোজা নয় যে টিকিট কাটলে, আর উঠে পড়লে। তুমি একটা দেশ থেকে বেরিয়ে আরেকটা দেশে যাবে। ইন্ডিয়া থেকে আসার সময় যেরকম সিকিউরিটি চেক, ইমিগ্রেশন পেরিয়ে এসেছ, এখানেও সেগুলো করতে হবে। প্যারিসের ট্রেন কখন আছে দ্যাখো, তারপর টিকিট কেটে ইমিগ্রেশনের জায়গায় যেতে হবে। সব কিছু দুমদাম নিজের মর্জিমতো করলে হয় না।’

রুদ্র এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, এবার মুখ খুলল, ‘বুঝলাম। তা অফিস থেকে ফিরে তো কিছু খাওনি। তাই বলছিলাম, চলো বাইরে থেকে খেয়ে আসি কিছু, তেমন হলে প্যাক করে নিয়ে চলে আসব। সারা রাত ট্রেন জার্নিতে খিদে পেয়ে যাবে তো।’

প্রিয়ম হাত দুটোকে কাঁধের পেছনে আড়াআড়ি রেখে হেলান দিয়ে বসে ছিল, শেষ কথাটাতে ও চমকে উঠে রুদ্রর দিকে তাকাল, ‘সারা রাত? প্যারিস এখান থেকে দু—ঘণ্টা লাগে মাত্র!’

রুদ্র বলল, ‘জানি। কিন্তু আমরা তো পারিস যাচ্ছি না।’

প্রিয়ম বলল, ‘তবে? কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

রুদ্র প্রিয়মের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘জার্মানি। বার্লিন। প্রায় দশ ঘণ্টা লাগবে পৌঁছোতে, যা দেখলাম।’ সরাসরি ট্রেন নেই। ব্রাসেলস হয়ে যেতে হবে।’

প্রিয়ম এবার এতটাই অবাক হয়ে গেল যে কী বলবে বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, ‘মানে?’

রুদ্র প্রিয়মের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তোমাকে সবই খুলে বলব। তুমি আমাকে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছ, সেটা ঠিকভাবে করতে গেলে যদি তুমিই এখন বিরক্ত হও, তাহলে আমি কী করব বলো তো? আর এখন এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছি আমি, মাঝপথে বেরোবার উপায়ও নেই। সব বলছি। আগে চলো বাইরে গিয়ে কিছু খেয়ে আসি। পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর তুমি কল্পনাও করতে পারছ না!’

রুদ্রর গলায় এমন একটা কিছু ছিল যাতে প্রিয়ম আর উপেক্ষা করতে পারল না। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এল রুদ্রর সঙ্গে।

বাইরে বেরিয়ে রুদ্র একটা ফুড কর্নার থেকে কিছু স্যান্ডউইচ আর সসেজ প্যাক করে নিল। ওর নিজের জোরদার খিদে পেয়ে গেছে। প্রিয়মের নিশ্চয়ই আরও বেশি পেয়েছে, কিন্তু এখন গুম হয়ে আছে বলে কিছু বলছে না।

সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনটা নিজেই যেন একটা দর্শনীয় স্থান। একঝলকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা একটা স্টেশন। একটা পুরোনো আমলের হেরিটেজ বিল্ডিংকে যে কত সুন্দরভাবে তার বনেদিয়ানাটাকে মর্যাদা দিয়ে নতুন সুযোগসুবিধার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায়, এই সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনটাই যেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পুরো স্টেশনটার ভেতরের ছাদটা গোলাকৃতি স্বচ্ছ কাচ আর রট আয়রনের রিব দিয়ে তৈরি হওয়ায় কেমন একটা বিশাল মাপের ইগলুর আকার নিয়েছে।

পরিস্কার ঝকঝকে চওড়া প্ল্যাটফর্ম, তাতে একের পর এক ট্রেন ঢুকছে, বেরিয়েও যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে বিশ্বখ্যাত সমস্ত ব্র্যান্ডের আউটলেট সাজানো থরে থরে, ঠিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি শপগুলোর মতো।

রুদ্রর আরও ভালো করে দেখার ইচ্ছে চারদিকটা, কিন্তু মনটা এমন অশান্ত হয়ে রয়েছে, এখন আর এসব দেখার মতো মানসিকতা নেই।

প্রিয়ম আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। রুদ্র ফেসবুকটা খুলল একবার। এখানকার অধিকাংশ পাবলিক প্লেসেই ওয়াই—ফাই ফ্রি থাকে। এই সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনেও তাই। কালকের পর বিভিন্ন গোলমালে ফেসবুক চেক করাই হয়নি। অ্যাপটা খুলতেই গুচ্ছের নোটিফিকেশন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওয়ালে, তার মধ্যে নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও এসেছে।

নোটিফিকেশনগুলো দেখার আগে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের বাটনটা টিপল রুদ্র।

একটাই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখাচ্ছে প্রিয়মকে।

ড সিগমুন্ড শ্যুমাখার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *