২৪
অগাস্ট ১৯৩৩
অ্যাডলফ ঘরে ঢুকে দেখলেন, ভিক্টর অতিথিদের জন্য ধার্য করা একটা সোফায় একটু জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। পাশে একটা লোক। ভিক্টর ওঁকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে একটা স্যালুট ঠুকল।
অ্যাডলফ কিছু বলার আগে লোকটির দিকে একঝলক তাকালেন। মাঝবয়সি সোনালি চুলের একজন লোক, সম্ভবত চূড়ান্ত অ্যালকোহলিক, মুখের তুলনায় শরীর অত্যন্ত শীর্ণকায় এবং ভগ্ন, ফ্যাকাশে ঠোঁট, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। গায়ের কোটটাও অত্যন্ত মলিন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, রাষ্ট্রপ্রধানকে ঘরে ঢুকতে দেখেও সে বসেই রইল।
অ্যাডলফ ভ্রূ কুঁচকোলেন। যদিও ভিক্টরের উপর ওঁর ভরসা আছে, তবু এই লোকটা বেসিক ম্যানারিজম জানবে না?
তবু তিনি কিছু না বলে বসে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন ভিক্টরের দিকে।
‘স্যার, ইনি রুডলফ গ্যালটন, ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের ছেলে।’
অ্যাডলফ সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন, ‘ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের তো কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না?’
ভিক্টরের হয়ে উত্তরটা এবার রুডলফ নিজেই দিল, ‘ওঁর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর উনি আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন। আমিই এখন ওঁর উত্তরাধিকারী। আইনমাফিক।’
অ্যাডলফ আরও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলেন। তিনি একজনের সঙ্গে কথা বলছেন, এই লোকটা আগ বাড়িয়ে তার মধ্যে কথা বলে তাঁকে অসম্মানিত করছে, তাও আবার কোনো সম্ভাষণ ছাড়াই।
তিনি ভিক্টরের দিকে তাকালেন, ‘আগে তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলে নিতে চাই। রুডলফ গ্যালটন, আপনি একটু পাশের ঘরে গিয়ে বসুন, আমি আপনাকে ডেকে নেব।’ দরজার পেছনে ছায়ার মতো দাঁড়ানো প্রহরীর পেছন পেছন রুডলফ পাশের ঘরে চলে যেতেই ভিক্টরের চোখে চোখ রেখে অ্যাডলফ বললেন, ‘একে দেখে তো কোনো দিক থেকেই কাজের বলে মনে হচ্ছে না, ন্যূনতম সহবতজ্ঞানটুকু পর্যন্ত নেই! এ কাকে নিয়ে এলে ভিক্টর?’ ওদিকের উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই অ্যাডলফ বলতে লাগলেন,’তোমাকে আমি গ্যালটনের ছাত্রমহলে খোঁজ চালাতে বলেছিলাম।’
ভিক্টর দমল না। মহামান্য চ্যান্সেলর পুরোটা শোনার পর তার পিঠ চাপড়ে দেবেন সে ভালোমতোই জানে। সে নম্রভাবে বলল, ‘স্যার, আমি সব খোঁজ চালিয়েছি। ওঁর সব স্টুডেন্ট, বাড়িঘর। ওঁর স্ত্রী তো ওঁর আগেই মারা গিয়েছিলেন, এই দত্তক নেওয়া ছেলেই এখন আসল মালিক। গ্যালটন দেশ—বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন, কোথাও থেকে একে পেয়েছিলেন। দেখেই বুঝতে পারছেন, চরম নেশাখোর। কাজ—টাজও কিছুই করে না, সব সম্পত্তি উড়িয়ে দিচ্ছে।’
অ্যাডলফ বিরক্তভাবে বললেন, ‘সে তো বুঝতেই পারছি! একে দিয়ে কি কাজ হবে?’
ভিক্টর চ্যান্সেলরের বিরক্তি দেখে মনে মনে হাসল কিন্তু বিচলিত হল না।
সে জানে এটা তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো লটারির মতো। লাগলে সে রাজা, না লাগলে তার চান্স শেষ।
পুরো অ্যাচিভমেন্টটা রয়ে—সয়ে জানাতে চায় সে চ্যান্সেলরকে, এটাই তো তার কেরিয়ারের তুরুপের তাস।
সে একটু থেমে বলল, ‘আমি এর সঙ্গে বেশ দোস্তি করে নিয়েছিলাম স্যার। কয়েকদিন ঘুরলাম, খাওয়ালাম—দাওয়ালাম, তারপর বাড়িতেও এন্ট্রি নিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এতদিন ধরে ওই বিষয়ের উপর করা গবেষণার খাতাটা গ্যালটনের স্টাডিরুমের দেরাজে অবহেলাতেই পড়ে ছিল, এমনকী একটা চাবি পর্যন্ত দেওয়া ছিল না। এটা কী করে হয় বলুন তো! কেউ কি কোনো খোঁজই করেনি এই এতগুলো বছরে?’
অ্যাডলফ এবার একটু থমকে গেলেন, ভিক্টর ওই জিনিসটার খোঁজ পেয়েছে তার মানে? কথাটা মনে হতেই তাঁর মনে একটা শিহরন খেলে গেল।
তিনি মনে মনে ভাবলেন, লোকে খোঁজ পাবে কী করে! খোঁজ পেতে গেলে তো জানতে হবে ওই ব্যাপারটা সম্পর্কে। ল্যান্ডসবার্গ জেলে তাঁর ঠিক পাশের সেলে গ্যালটনের ওই পার্সোনাল সেক্রেটারি বন্দি না থাকলে কি আর জানতে পারতেন তিনি?
কথায় বলে, কার ভাগ্যে কে খায়! সেই সেক্রেটারি এখন থুত্থুড়ে বুড়ো, গ্যালটন মারা যাওয়ার পর জার্মানি এসেছিল ভাগ্য পালটাতে, ভাগ্য তার এমনই পালটেছিল যে তাকে জেলেই কাটাতে হল জীবনের শেষ ক—টা বছর, কী করেছিল কে জানে!
অ্যাডলফ নিজে ছিলেন রাজনৈতিক বন্দি, নামেই জেল, তার জন্য আলাদা ঘর, তাঁর আত্মজীবনী লেখার জন্য নিজস্ব টাইপিস্ট, অন্যান্য সুযোগসুবিধা, সবই ছিল। বিকেল হলেই মাঝেমধ্যে সাধারণ বন্দিদের সেলে গিয়ে আলাপ জমাতে চেষ্টা করতেন তিনি, বুঝতে চাইতেন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকা নাতসি পার্টিকে তারা কেমনভাবে দেখছে, কী ভাবছে এই নতুন দল সম্পর্কে। তখনই আলাপ ওই বুড়োর সঙ্গে। বেশিরভাগ বন্দিই মিশত না তার সঙ্গে, ঘরের এক কোনায় চুপচাপ পড়ে থাকত আর নিজের মনেই বকে যেত অনর্গল।
ওর কাছ থেকেই অ্যাডলফ জেনেছিলেন ফ্র্যান্সিস গ্যালটন সম্পর্কে, জেনেছিলেন ইউজেনিক্স কী। এটাও জেনেছিলেন কীভাবে মৃত্যুর কিছুদিন আগে ওই আবিষ্কারটা করেন গ্যালটন।
ভিক্টর ছেলেটাকে অবশ্য এত কিছু জানাবার কোনো মানে হয় না। অ্যাডলফ শুধু বললেন, ‘খোঁজ না—ই করতে পারে। এমন কিছু বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক তো নয়, এত কিছু নিয়ে একসঙ্গে মেতে থাকত যে লোকে ছিটগ্রস্ত ভাবত। ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না, তারপর কী হল বলো।’
ভিক্টর বলল, ‘ওর সঙ্গে দিন পনেরো বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ার পর একদিন ওর বাবার স্টাডিরুমে গিয়ে একটু দেখতেই পেয়ে গেলাম ওই ডায়েরিটা। অন্য সব গবেষণার খাতাগুলোই সুন্দর করে বাঁধানো ছিল, শুধু ওইটাই একটু অগোছালো হয়ে পড়ে ছিল একপাশে।’
অ্যাডলফ তীক্ষ্নস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করে বুঝলে তুমি ওটাই সেই গবেষণার খাতা?’
ভিক্টর বলল, ‘গ্যালটন গবেষণার বিষয়বস্তু সোজাসাপটা ভাষাতেই লিখে গেছেন। একটা নতুন মৌলিক পদার্থ যেটা খোলা বাতাসে কোনো প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করলে তার শরীরের প্রতিটা খারাপ জিন নষ্ট হয়ে যাবে, শুধুমাত্র ভালো জিনগুলোই থাকবে। আর সেটা পরবর্তী প্রজন্মেও এফেক্ট ফেলবে।’
অ্যাডলফ মনে মনে সতর্ক হলেন। ভিক্টর ছেলেটাকে তিনি অশিক্ষিত ভেবেছিলেন। ভেবেছিলেন শুধুমাত্র ওপরে ওঠার লোভে সে সব হুকুম তামিল করবে। কিন্তু এ তো দেখা যাচ্ছে ততটা বোকা নয়। লেখাপড়া জানে বোঝা যাচ্ছে।
অ্যাডলফ পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘মানে, এক্স রে—র মতো করে ঢোকাতে হবে শরীরে?’
উইলিয়াম রন্টজেন এক্স রশ্মি আবিষ্কার করেছেন তাও বেশ কয়েক বছর হল। তিনিও জার্মান ছিলেন। অ্যাডলফের হঠাৎ আবার মনে হল, জার্মান মাত্রই প্রতিভাবান, শুধু এখন উলটোপালটা রক্ত এসে মিশেছে বলে এই সাময়িক অধঃপতন। তাঁর হাত দিয়েই জার্মানি আবার ত্রুটিহীন হয়ে উঠবে। আর তিনি হবেন সেই ত্রুটিহীন মানবশ্রেষ্ঠ জাতির প্রধান।
ভিক্টর বলল, ‘না, ইনজেক্ট করে। বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করবে ওটা। এইটুকু ইংরেজিতে লিখে গেলেও ওই পদার্থ তৈরির প্রসেসটা গ্যালটন লিখে গেছেন গ্রিক ভাষায়, সাবধানতা অবলম্বনের জন্যই হয়তো।’
অ্যাডলফ বললেন, ‘গ্যালটন গ্রিক ভাষাও জানতেন?’
ভিক্টর হাসল, ‘হ্যাঁ, উনি অনেক ভাষা জানতেন। ইংল্যান্ডে গ্রিক ভাষা খুব একটা জানে না লোকে, তাই হয়তো ওতে লিখে গিয়েছিলেন।’ পরক্ষণেই ও বলল, ‘কিন্তু গণ্ডগোলটা হয়েছে, এই জুয়াড়িটা যখন থেকে বুঝতে পেরেছে আমি ওই ডায়েরিটা চাই, তখন থেকেই সে টাকার গন্ধ পেয়ে গেছে। তার বেশি কিছু বোঝার দরকার নেই, টাকা পেলেই হল।’
অ্যাডলফ এতক্ষণ শুনতে শুনতে বেশ প্রসন্ন হচ্ছিলেন ভিক্টরের উপর, এই কথাটা শুনে আবার বিরক্ত হয়ে উঠলেন, ‘এই সামান্য ব্যাপারেও তুমি মুশকিল দেখছ ভিক্টর? সরিয়ে দিচ্ছ না কেন?’
ভিক্টর বলল, ‘অত সোজা নয় স্যার, ও নিজে এরকম হলে কী হবে, ওর পেছনে অনেক লম্বা হাত আছে। দুম করে সরিয়ে দিলে গোলমাল শুরু হয়ে যাবে, গ্যালটন স্যার মারা যাওয়ার আগে ব্রিটিশ সরকার ওঁকে নাইট উপাধি দিয়েছিল, সেই সূত্র ধরে এরও উঁচুমহলে ভালো চেনাজানা আছে। গ্যালটন মারা যাওয়ার পরে সেই কানেকশন ধরে একবার ইলেকশনেও দাঁড়িয়েছিল, হেরে গিয়েছিল যদিও। আর শেষ ক—দিন যেহেতু আমি মিশছিলাম, সেই থেকে আপনার লিঙ্কটাও বুঝতে পেরে যেতে পারে লোকে। ইংরেজ ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টকে তো জানেনই কেমন ধূর্ত! আমার মনে হয় এখনই আপনার ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রকাশ্য গোলমালে জড়িয়ে লাভ নেই! আগে নিজেদের ব্যাপারটা সলভ করাটাই মনে হয় বুদ্ধিমানের হবে।’
অ্যাডলফ চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন, ‘তবে?’
ভিক্টর বলল, ‘টাকাটা দিয়ে দেওয়াই মনে হয় ভালো। হেলথ আদালত তো শুরু হয়ে গেছে, এলিমেন্টটা তৈরি হয়ে গেলেই আমরা হেলথ ক্যাম্প করে প্রত্যেকের ওপর অ্যাপ্লাই করা শুরু করতে পারব।’
হেলথ আদালত কাজ করা শুরু করেছে এক মাস হল। আপাতত রাস্তার মোড়ে, স্কোয়ারের নোটিশবোর্ডগুলোতে অভিনব ধরনের প্রচার শুরু করা হয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফ থেকে, যাতে সাধারণ মানুষের কাছে কোনো ভুল বার্তা না যায়। দুজন ফটোগ্রাফার ফিট করে বড়ো বড়ো জেলগুলোর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ছবি তুলে আনা হয়েছে, তাদের ছবিগুলো একেকটি পোস্টারে ছাপিয়ে সঙ্গে নীচে লেখা হয়েছে,
‘নিজের অপরাধপ্রবণ ঘৃণ্য মানসিকতার জন্য এই লোকটা কোনোদিনও জেল থেকে ছাড়া পাবে না, মানুষের ক্ষতি করেও একে সারা জীবন জেলে পুষতে হবে, এটা সরকারের টাকার অপচয় নয়?’
দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল বা মেন্টাল অ্যাসাইলামের রুগি, যাদের আমৃত্যু সুস্থ হবার সম্ভাবনা নেই, তাদের হুইলচেয়ারে বসা বা বিছানায় শোয়া হৃদয়বিদারক ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে,
‘বংশসূত্রে পাওয়া জিনগত ডিফেক্টের জন্য এই লোকটা কোনোদিনও সুস্থ হতে পারবে না, কিন্তু তার জন্য জার্মানি সরকারের এর সারাজীবনের খরচবাবদ ষাট হাজার মার্কেরও বেশি খরচ হবে, আগেও যেমন হাজার হাজার অসুস্থ মানুষের জন্য হয়েছে। মহোদয় জার্মানিবাসী, এটা কিন্তু আপনারও টাকা!’
শুধু অসুস্থরাই নয়, সমকামীদের ক্ষেত্রেও তাদের জিনগত দোষকেই দায়ী করা হয়েছে।
এই পোস্টারগুলোর ফলে মানুষের মনে কিছুদিন এই প্রশ্নগুলো পাক খাক, এটাই চান অ্যাডলফ। তারপর তিনি সরকারি তরফে এই সমস্ত গুড ফর—নাথিংদের গণহত্যার কথা ঘোষণা করবেন। এর ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে, মানুষ নিজের মনেই নিজে যুক্তি সাজাবে, সত্যিই তো যে কোনোদিনও সুস্থ হবে না, বা যে দাগি আসামি, তার জন্য আমি কেন আমার কষ্টের পয়সা ট্যাক্স দেব! আর তার সঙ্গে খারাপ জিনের জন্যই যে এই বিকৃতিগুলো আসে, জিন পালটালে যে আখেরে মানুষের উপকারই হবে, সেটাও এখন থেকে বুঝতে শিখবে, তাতে গ্যালটনের ওষুধটা অ্যাপ্লাই করলেও অ্যাডলফ জনসমর্থন পাবেন।
অ্যাডলফ মনে মনে পুরোটা ছকে নিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন ‘খুব ভালো ভিক্টর। কিন্তু তুমি আর আমি ছাড়া আর কোনো হেলথ বোর্ডের অফিশিয়াল যেন ওই ইঞ্জেকশনের মানে না জানতে পারে।’
ভিক্টর বলল, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, স্যার। এখন শুধু দরকার একজন গ্রিক জানা বিশ্বস্ত লোক আর কয়েকজন কেমিস্ট যারা ওই প্রসেস অনুযায়ী এলিমেন্টটা তৈরি করবে।’
অ্যাডলফ হঠাৎ চমকে উঠলেন, ‘তার মানেই তো জানাজানি হয়ে যাবে।’
ভিক্টর বলল, ‘এটুকু তো হবেই স্যার, কিছু করার নেই।’
অ্যাডলফ বললেন, ‘শোনো শোনো, কেমিস্টদের ডাকার আগে লোরেঞ্জের সঙ্গে বোসো একবার। ও পুরো লেখাটাকে কোনো কোডে কনভার্ট করে দেবে। আর তার পরেই ডায়েরিটাকে নষ্ট করে ফেলো। কালকের মধ্যে এটুকু আমার কমপ্লিট চাই। তাহলে কেউ হাতে পেলেও বুঝতে পারবে না।’
ভিক্টর মাথা নাড়ল। চ্যান্সেলর যে তাঁর হাইকমান্ডের সঙ্গে গোপন বার্তা পাঠানোর জন্য গুপ্ত সংকেত ব্যবহার করেন, তা একজন কর্মী হিসেবে তার ভালোমতোই জানা। শত্রু দেশ তো দূর, পার্টিওয়ার্কাররাও যাতে সবকিছু জানতে না পারে, সেইজন্যই এই সতর্ক ব্যবস্থা। ওদের মিউনিখের হেড কোয়ার্টারেও প্রায়ই এই ধরনের কোড চালাচালি হয়। আর মি লোরেঞ্জ আছেন এই কোডিং সিস্টেমের প্রধান দায়িত্বে, তিনি অ্যাডলফের রিসার্চ ব্যুরোর মুখ্য ক্রিপটোঅ্যানালিস্ট।
এইরকম কানাঘুসোও ওর কানে এসেছে, মি লোরেঞ্জ নাকি এমন একটা মেশিন বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন যা দিয়ে অটোমেটিক্যালি কোনো মেসেজকে সংকেতে পরিণত করা, আবার সেটাকে সংকেত থেকে মেসেজে কনভার্ট করা যাবে। তার নামও ঠিক হয়ে গেছে, এনিগমা মেশিন।
অ্যাডলফ বলে চললেন, ‘আর যত টাকা লাগছে দিয়ে বিদায় করো একে। আমার কাছে না আনলেও চলত। আমি তোমাকে তো এই ব্যাপারে ফুল অথরিটি দিয়েই রেখেছি।’
ভিক্টর উঠে দাঁড়াল, চলে যাওয়ার আগেও কী—একটা মনে পড়ে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি গ্রিক জানেন তো, স্যার?’
অ্যাডলফ জার্মান ভাষা ছাড়া একটু আধটু ফ্রেঞ্চ আর কাজ চালানোর মতো ইংরেজিটুকু জানেন। তিনি বিস্মিতভাবে মাথা নাড়লেন, ‘না, আমি জানিনা। তুমি জানো না?’
ভিক্টর মাথা নাড়ল, ‘না তো!’
অ্যাডলফ বললেন, ‘তবে?’
ভিক্টর চুপ করে গেল। এত গোপনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন চ্যান্সেলর, এত অল্প সময়ের মধ্যে গ্রিক জানে এমন কাকে জোগাড় করবে সে? জার্মানিতে এই ভাষা জানা লোকের সংখ্যা হাতে গোনা বললেও বেশি বলা হয়।
অ্যাডলফ বললেন, ‘যেভাবে হোক গ্রিক জানা কাউকে জোগাড় করো, অবশ্যই বিশ্বাসী। তার সঙ্গে তুমি আর লোরেঞ্জ বসে কাল কয়েক ঘণ্টায় মিটিয়ে ফেলো ব্যাপারটা। জলদি।’
ভিক্টর চিন্তায় পড়ে যাচ্ছিল। তার এত পরিশ্রম তো ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কালকের মধ্যে কোথায় পাবে সে গ্রিক জানা লোক? মিউনিখে তো কেউ নেই, সময় থাকলে ফ্রেডরিককে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, ওর মা যে গ্রিসের মেয়ে ছিলেন সেটা ও ছোট্ট থেকেই জানে।
এটা মনে পড়তেই ওর মুখ চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
আহা কী আহাম্মক সে, খেয়ালই নেই, ফ্রেডরিক নিজেই তো গ্রিক জানে, খুব ভালো না অবশ্য, তবে পড়তে পারে গড়গড় করে, স্কুলজীবনে অনেকবার গ্রিক গল্পের বই বাড়ি থেকে নিয়ে এসে পড়ে শুনিয়েছে সে। ভিক্টরের কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফ্রেডরিকের নির্বুদ্ধিতার কথা মনে পড়তেই বিরক্ত লাগল, এত বোকা ও জীবনেও দেখেনি। কতগুণ ছিল ছেলেটার। দুটো তিনটে ভাষা জানত, ভালো মাউন্টেনিয়ারিং—এর জ্ঞান ছিল। এসব করেও তো কাটাতে পারত। তা না, ওই অন্ধকার ঘুপচিতে বসে ও যে কোন পাহাড়ে ওঠার প্ল্যান করছে, ও—ই জানে!
মরুক গে! ফ্রেডরিকই তো কাজই করতে পারবে। কী ব্যাপারে, সেটা না জানালেই হল। ভালো টাকা দিয়ে দেবে, মিটে গেল।
ও একটা লম্বা স্যালুট ঠুকল, ‘কালকের মধ্যেই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলছি, স্যার। আপনাকে কাল সন্ধেয় এসে রিপোর্ট করব।’
অ্যাডলফ আঙুল তুললেন, ‘আমিও যাব। জিনিসটা দেখতে চাই একবার।’