নরক সংকেত – ১৮

১৮

অগাস্ট, ১৯৩৩

অ্যাডলফ টেবিলল্যাম্পের আলোয় মন দিয়ে লিখছিলেন। গভীর রাত। এমনিতে খুবই অল্প ঘুমানোর সময় তাঁর, সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুমেই পুষিয়ে নিতে হয় তাঁকে। গ্যাসের ব্যথায় সেটুকুও ভালো ঘুম হয় না প্রায়শই। মেইন ক্যাম্ফ—এর তুমুল সাফল্যের পর আরেকটা বই লেখার কাজে হাত দিয়েছেন তিনি এটা অবশ্য ঠিক বই নয়, তাঁর রোজকার দিনলিপি বলা চলে। এটা প্রকাশ করারও কোনো পরিকল্পনা নেই। বইয়ের মতো অত স্ট্র্যাটেজিকালি না লিখে সারাক্ষণ মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে হেঁটে চলা ভাবনাচিন্তাগুলোকেই এই ডায়েরিতে ধরে রাখছেন তিনি।

বিশেষত ভিক্টর ব্র্যাককে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন সেই ব্যাপারটা। খুব গোপনে রাখলেও একটা তো নোট লিখে রাখা দরকার, তাই এখানেই সেটা একটু একটু করে লিখছেন রোজ।

তাঁর টেবিলের পাশেই বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে ইভা। অ্যাডলফ একবার তাকালেন সেই দিকে। ক্রিম—রঙা রাতপোশাকে হলদে নীল মৃদু আলোয় ইভাকে বেশ মোহময়ী লাগছে। তার পশমের মতো সোনালি চুলগুলো ফুলেফেঁপে পড়েছে কপালের ওপর, গালে নরম আলো যেন পিছলে যাচ্ছে।

এই সময় সব মেয়েকেই কি খুব লাবণ্যময়ী লাগে?

বেশ কিছুদিন হল ইভা এই বাড়িতে চলে এসেছে, কিন্তু ওকে বিয়ে করার ব্যাপারে এখনও মনস্থির করতে পারেননি অ্যাডলফ। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে কাজপাগল নেতা হিসেবেই প্রতিপন্ন করতে চান, সেখানে বিয়ে করে সংসারী হলে তাঁর বিশ্বস্ততায় মানুষ সন্দেহ করতে পারে। ইভা মেয়েটা এমনিতে ভালোই, সে নিজে বিশেষ কিছু দাবি করে না। কিন্তু কয়েক মাস পরে দাবি করলেও করতে পারে, তাই এখন থেকেই সেই পরিকল্পনা করে রেখেছেন অ্যাডলফ।

বাচ্চাটা হলেই এমন কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে, যাতে জার্মানির কেউ তার পরিচয় জানতে না পারে। এখন এইসব বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসারে জড়িয়ে পড়তে একদমই চান না অ্যাডলফ।

তবে তাঁর সন্তান যেন ছোটো থেকেই তাঁর আদর্শে দীক্ষিত হয়, জার্মানিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাঁড় যেন ঠিক সময়ে তাঁর হাত থেকে তুলে নেয়, সেই ব্যাপারে খেয়াল রাখবেন তিনি।

এমন সময় ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল ঘরের টেলিফোনটা।

এই ঘরের টেলিফোনের নম্বর খুব ঘনিষ্ঠ মহল ছাড়া কারুর কাছে নেই। সাধারণত কেউ ফোন করলে সেটা সরাসরি চলে যায় চ্যান্সেলর অফিসের অপারেটরের কাছে, সে প্রয়োজনমতো কল ট্রান্সফার করে বিভিন্ন কর্তার কাছে।

অ্যাডলফ উঠে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভিক্টরের সতর্ক গলা শোনা গেল, ‘হেইল হের চ্যান্সেলর! ভিক্টর বলছি। একজনকে পেয়েছি, আপনার সঙ্গে দেখা করাতে চাই। কবে নিয়ে আসব?’

অ্যাডলফ ভ্রূ কুঁচকে একটু চিন্তা করলেন। এমনিতে আগামী তিন মাসের সমস্ত মিটিং, অ্যাপয়েন্টমেন্টের রেকর্ড রাখে তার ব্যক্তিগত সচিব উইলসন, কিন্তু তাকে তো এখন জিজ্ঞাসা করা যাবে না। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, ‘কাল বেলা এগারোটায় নিয়ে এসো। দেরি হয় না যেন। আমি বারোটায় মিউনিখ বেরিয়ে যাব।’

ভিক্টর সায় দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রেখে চুপিসাড়ে বেরিয়ে এল বুথ থেকে। বুথের লোকটা ঘুমে ঢুলছিল, ওকে একবার আড়চোখে দেখে পয়সাটা নিয়ে নিল। সত্যি, টেলিফোন আসার পর থেকে যে কী সুবিধে হয়েছে। যদিও সরকারি অফিস বা মান্যগণ্যদের দপ্তর ছাড়া কোথাও সেভাবে এখনও টেলিফোন নেই। শুধু গোটা বার্লিন শহরের প্রধান চারটে স্কোয়ারে বসানো হয়েছে, তবু সুবিধে এটাই যে দিনরাত খোলা থাকে।

ভিক্টর দ্রুতগতিতে হাঁটছিল। এত রাত হয়েছে তবু সে এখন বাড়ি যাবে না। এমনিতে এই কয়েকটা সপ্তাহ সে দিনরাত এক করে খেটেছে, গোপনে লন্ডন চলে গিয়ে সেখানে খোঁজখবর চালানো, গ্যালটন নামের ওই বৈজ্ঞানিকের বাড়িতে কারা কারা থাকে, তাদের উপর নজর রাখার জন্য লোক ঠিক করা, ভদ্রলোকের প্রচুর ছাত্র সারা ইউরোপে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে, তাদের ব্যাপারে তথ্য জোগাড় করা। প্রায় কুড়ি পঁচিশ দিন সে ঠিক করে ঘুমোতেই পারেনি। অবশেষে সে যে চ্যান্সেলরের বিশ্বাসের মান রাখতে পেরেছে, এটাই তার কাছে সবচেয়ে বড়ো তৃপ্তির। ডান হাতে ধরা বাক্সটাকে সাবধানে নিয়ে ও হাঁটছিল। খেয়াল রাখছিল সেটা যেন সোজা থাকে। আজ সে তার পুরোনো এক বন্ধুর বাড়িতে যাবে, বেশ কয়েকদিনের খাটুনির পর একটু রিল্যাক্স করতে বড় ইচ্ছে করছে।

ভিক্টর অনেকটা হেঁটে আধঘণ্টার মধ্যে শহরের পশ্চিম প্রান্তে নতুন তৈরি হওয়া ওয়েস্ট এন্ড অঞ্চলে চলে এল। পাশেই ইউ বান অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ের স্টেশন। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সেটাকে এই গভীর রাতে কেমন ঘুমন্ত দৈত্যের মতো দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে ওর অনেক কিছু মনে পড়ে গেল—সেদিনগুলোর কথা, যখন ওরা দুজনে মিলে প্রথম বার্লিনে পা রেখেছিল।

তখন সবে এই মাটির নীচের রেলপথ অর্থাৎ ইউ বান রেলওয়ে তৈরি হয়েছে। ওর স্পষ্ট মনে পড়ল যেদিন প্রথম চেপেছিল ওই ইউ বান ট্রেনে, স্টেশন থেকে কিছুটা বেরিয়েই যখন ধুপ করে ট্রেনটা গর্তে ঢুকে গেল, চারপাশের ঝলমলে আকাশ সরে অন্ধকার টানেলের মধ্য দিয়ে চলতে লাগল ওদের ট্রেন, ওদের দুজনেরই ভয়ে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। ঠিক যেন মনে হয়েছিল ছোটোবেলায় পড়া রূপকথার একটা রাক্ষস গিলে খেয়ে নিল ওদের ট্রেনটাকে। সত্যি, তখন কী বোকা ছিল ও।

আর এখন তো পুরো বার্লিন শহরটাকেই সবদিক থেকে সুন্দরভাবে জুড়ে ফেলেছে এই ইউ বান রেলওয়ে। আগে শুধু এস বান, মানে মাটির উপর দিয়ে চলা সুবার্বন ট্রেন ছিল, তাতেই মানুষ বেশি যাতায়াত করত, কিন্তু ইউ বান শুরু হওয়ার পর এর দ্রুততার জন্যই, বা ঘন ঘন সার্ভিস, মানুষ এটাতেই ভিড় করে বেশি। ভাড়াও বেশ কম।

যুদ্ধের পর আস্তে আস্তে ছন্দে ফিরছে বার্লিন।

স্টেশনটাকে বাঁ—পাশে ফেলে রেখে ও এগিয়ে এল রেইসক্যাঞ্জলার স্কোয়ারের দিকে। আগে এইসব জায়গা কত ঘুরে ঘুরে বেড়াত। এখন পার্টির কাজে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়ে কতদিন যে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া রাস্তায় বেরোয়নি।

রেইসক্যাঞ্জলার স্কোয়ার এই শহরের একটা বিখ্যাত জায়গা। একটা বিশাল বড়ো গোলাকার উদ্যান, তার চারপাশে বৃত্তাকারে রাস্তা, আবার সেই গোল রাস্তাটা থেকে বিভিন্ন দিকে অনেকগুলো রাস্তা বেরিয়ে গেছে শহরের বিভিন্ন অভিমুখে। একটা রাস্তা আবার একপাশে চলে গেছে ইউ বান রেলওয়ে স্টেশনটার দিকে।

ভিক্টর যখন খুব ছোটো, বাবা মায়ের সঙ্গে যখন রাইন নদীর তীরে হারেন বলে সেই জায়গাটায় ছোট্ট বাড়িটায় থাকত, তখন স্কুলে ওদের টিচার একদিন গল্পচ্ছলে পড়িয়েছিলেন এই স্কোয়ার তৈরির কথা। এই ওয়েস্টএন্ড অঞ্চলটা তৈরি করে এই স্কোয়ারটার নাম দেওয়া হয়েছিল চ্যান্সেলরের অফিসের নামে। রেইসক্যাঞ্জলার।

এখন অবশ্য হিটলার চ্যান্সেলর হওয়ার পর বার্লিনের, শুধু বার্লিন কেন গোটা জার্মানি, প্রায় সব শহরেরই অসংখ্য রাস্তাঘাট, স্কোয়ারের নাম পালটে ওর নামে হয়ে যাচ্ছে।

এটারও নাম এখন অ্যাডলফ হিটলার স্কোয়ার।

এখন মনে হয় লোকজনের বাড়ির নামও হিটলারের নাম দিয়ে হবে, গত মাসে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ মারা যাওয়ার পর তো হিটলারই জার্মানির সর্বাধিনায়ক। প্রেসিডেন্ট আর চ্যান্সেলর দুটোই এখন হিটলার, অবশ্য তাতে ভিক্টরেরই সুবিধা।

স্কুলে এই রেইসক্যাঞ্জলার জায়গাটার গল্প শুনে তখন কী কৌতূহল ওদের দুজনের! দুজনে মিলে পরামর্শ করেছিল বড়ো হয়েই ওরা একদিন বার্লিনে পাড়ি জমাবে, তারপর ঘুরে ঘুরে দেখবে সব কিছু তারপর সারাজীবন একসঙ্গে থাকবে। ফ্রেডরিক ওর পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নেবে আর ভিক্টর ছবি আঁকবে, ভরতি হবে নামকরা আর্ট স্কুলে।

চলতে চলতে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করতে করতে নিজের মনেই বিষাদের একটা হাসি হাসল ভিক্টর। মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক! সেই ওরা দুজনে একসঙ্গে বাড়ি ছাড়ল, একসঙ্গে বার্লিন এল, কিন্তু রাস্তা দুজনের আলাদা হয়ে গেল চিরজীবনের জন্য।

ফ্রেডরিকের স্বপ্ন কতটা সফল হয়েছে ও জানে না, তবে ও নিজে যে কতদিন রং তুলি নিয়ে বসেনি! চিত্রশিল্পী হওয়ার ইচ্ছে কবেই লুপ্ত হয়ে গেছে ক্ষমতার লোভের কাছে।

স্কোয়ারটা পেরিয়ে কিছুটা হেঁটেই ও একটা ছোটো গলিতে ঢুকল, এখানে সার সার দিয়ে ছোটো ছোটো বাড়ি, যুদ্ধের সময় জার্মান সেনাদের থাকার জন্য এরকম প্রচুর কলোনি তৈরি করেছিল আগের সরকার। এখন সেগুলো দখল করেছে গরিব খেটে খাওয়া মানুষজন। সেও আগে এইরকমই একটা বাড়ির ঘুপচি ঘরে থাকত, কিন্তু বছর দুয়েক আগে পার্টিতে বেশ উন্নতি হওয়া শুরু হতে ও এখন মিউনিখে একটা সুন্দর বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে গেছে।

ও একের পর এক বাড়ি পেরিয়ে গলির প্রায় শেষের দিকের একটা বাড়িতে ঢুকল। একতলার অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা ঘরের দরজায় আলতো টোকা দিল। একবার, দু—বার। তারপর একটু জোরে, তিনবার।

ওপাশ থেকে একটা ঘুমজড়ানো গলা ভেসে এল, ‘কে?’

ভিক্টর বলল, ‘তোর যুদ্ধে মরা বাপ আমি, হতভাগা! খোল শিগগিরই!’

দরজাটা খুলতেই ও কেকটা উঁচু করে তুলে ধরে ছোটোবেলার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল, ‘হ্যাপি বার্থডে, ভাই! তুই তো আমাকে ভুলেই গেছিস!’

ফ্রেডরিক ঘুম চোখে দরজা খুলেছিল। ভিক্টরকে ও ভোলেনি, ভোলার প্রশ্নও নেই, কিন্তু আজ যে ওর নিজের জন্মদিন সেটা সত্যিই ও ভুলে গিয়েছিল।

ভিক্টর আজ অনেক বড়ো মানুষ, তবু এই ব্যস্ততার মধ্যেও এই সামান্য বন্ধুর জন্মদিন সে মনে রেখেছে?

ফ্রেডরিকের মনটা আনন্দে ভরে উঠল, জড়িয়ে ধরে বন্ধুর পিঠ চাপড়ে দিল দু—বার, ‘আয় ভেতরে। বার্লিন কবে এলি?’

ভিক্টর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘এসেছি একটা কাজে, কয়েকদিন হল। তুই তো ভুলেও একটা খবর রাখিস না! না একটা চিঠি, না দেখা সাক্ষাৎ! এখনও কি ওই বিজ্ঞাপনের প্রেসটাতেই কাজ করছিস?’

ফ্রেডরিক উত্তর না দিয়ে হাসল।

ভিক্টর বলল, ‘বললাম চলে আয় আমার কাছে, ঠিক ঢুকিয়ে দেব একটা—না—একটা কাজে। সেই এক গেঁতোমি নিয়ে পড়ে রইনি!

ফ্রেডরিক বলল, ‘না রে, এখন ভালোই চলছে।’

ভিক্টর বাড়ি নিয়ে মিউনিখে চলে যাওয়ার পরেই ‘স্ট্রেট পাথ’ কাগজে ঢুকেছিল ফ্রেডরিক, সেটা ও ঘুণাক্ষরেও বন্ধুকে জানায়নি। যতই ছোটোবেলার বন্ধু হোক, সে এখন নাতসি পার্টির নেতা, শত্রুর কাগজে কাজ করে এটা জানানোর মতো মূর্খামি কেউ করে?

ভিক্টর মুখটা বেঁকাল সামান্য, কত ভালো চলছে, সেটা ঘরদোর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একটা জরাজীর্ণ ট্রাঙ্ক, পুরোনো একটা চুল্লী, খাট আর টুকিটাকি জিনিস ছাড়া ঘরে কিছুই নেই।

আর কিছু না বলে ওভারকোটেরপকেট থেকে ও একটা বোতল বের করল, ‘তোর হাতের খেল দেখা। বিয়ার এনেছি, জম্পেশ করে বানা তোর সেই বিখ্যাত ককটেল। অনেকদিন খাইনি। আজ একটু জমিয়ে নেশা করব।’

ফ্রেডরিক মৃদু হাসল, ‘আবার সেই মাতলামি করবি! এই বাড়িতে চেঁচামেচি করল কিন্তু অন্যরা অবজেকশন দেয়।’

ভিক্টর মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ‘থাম তো! অবজেকশন, আমাকে? শালা সোজা জেলে ঢুকিয়ে দেব, অবজেকশন দেওয়া পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তুই বানা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *