নরক সংকেত – ১৫

১৫

পরের দিন প্রিয়ম অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল।

রুদ্র অনেকক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে আজ, প্রিয়ম ওঠার আগেই ও স্যান্ডউইচ আর কফি বানিয়ে ফেলেছে।

প্রিয়ম বেশ অবাক।

‘দারুণ হয়েছে কিন্তু স্যান্ডউইচটা! চিজ পেলে কোথা থেকে?’ একটা মস্ত কামড় বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল প্রিয়ম।

রুদ্র বলল, ‘কাল ফেরার পথে কিনে এনেছি। পাশেই একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে না?’ বলে ও ট্রলি থেকে প্রিয়মের জন্য আনা কয়েকটা টি—শার্ট বের করল, ‘এই দ্যাখো, এই গুলো নিয়ে এসেছি তোমার জন্য, ক—দিন বেরই করা হয়নি।’

অবশেষে ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়েছে! প্রিয়ম মনে মনে স্বগতোক্তি করল। বলল, ‘হুটহাট করে বেরিয়ে যেয়ো না। এইসব কান্ট্রিসাইডে অতটা সিকিউরিটি নেই, কোথায় কখন কী গণ্ডগোল হবে! পাসপোর্টটাকে সাবধানে রেখো। আর কোনো দরকার হলে জনকে ডেকো।’

কাল রাত থেকেই ভালো বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বাইরে ত্রিভুজ আকৃতির কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত। রুদ্রর গতকাল রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। সারাক্ষণ কী সব স্বপ্ন দেখে যাচ্ছিল, ও নিজে রানি এলিজাবেথের হাত থেকে প্রাইজ নিচ্ছে, ড শ্যুমাখার ওঁর রিমলেস চশমা পরে ছুটে আসছেন, চিৎকার করে কী সব বলছেন, আর লাল কালো বাইকগুলো জাপানি লোকটা ওঁকে আটকাচ্ছে।

ধুর! মাথায় যেন হাজার হাজার জট কিলবিল করছে!

প্রিয়ম বেরোনোর আগে ওকে একটা আলতো চুমু খেয়ে বলল, ‘আজকে কোথাও বেরিয়ো না, কেমন? আমি তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব।’

রুদ্র মাথা হেলাল।

মাঝে মাঝে ওর খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

আজ সারাদিন সত্যিই ও কোথাও বেরোবে না। বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে জানলা নিয়ে বাইরেটা দেখতে যে কী ভালো লাগে! ও দরজাটা বন্ধ করে এসে প্রিয়মের ছোটো টেবিলটাকে টেনে এনে জানলার সামনে রাখল, তারপর ছবিগুলো নিয়ে বসল আয়েশ করে।

কালকের পর থেকে ড শ্যুমাখারের সঙ্গে আর কথা না হলেও ভদ্রলোক মেসেজ করেছেন বেশ কয়েকবার, প্রতিটাতেই ইঙ্গিতে লিখেছেন ফটোগুলো সাবধানে রাখতে, ওঁর ওপর যেকোনো মুহূর্তে অ্যাটাক হতে পারে, আর যদি ওরা জানতে পারে জিনিসটা ওঁর কাছে নয়, রয়েছে রুদ্রর কাছে, ওরা রুদ্রকেও ছাড়বে না, যেকোনো উপায়ে ওটা হস্তগত করার চেষ্টা করবে।

এই ওরা—টা—কারা?

ড শ্যুমাখারের কথা অনুযায়ী কোনো ফার্মা কোম্পানি বা ক্যান্সারের বিভিন্ন থেরাপি যারা সাপ্লাই করে তারা। তাদের এতটা নেটওয়ার্ক থাকবে যে কনস্ট্যান্ট ওঁকে ফলো করে যাবে বা রুদ্রকে?

ও প্রথমে আবার ছবিগুলো নিয়ে বসল, কিছুক্ষণ পর সেগুলোকে একপাশে রেখে ল্যাপটপ খুলল।

কয়েকটা খটকা মাছের কাঁটার মতো গলায় বিঁধে রয়েছে, সেগুলোকে আগে ঘোচাতে হবে।

প্রায় দেড়—দু ঘণ্টা ধরে ইন্টারনেটে অনেক কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করে ওর ঠিক স্বস্তি হল না। বাবাকে একবার ফোন করল, ‘বাবা, দুটো এইচ দেখলে তোমার কী মাথায় আসে প্রথমে?’

বাবা তো অবাক, ‘গিয়ে থেকে কোনো ফোন নেই তোর, প্রিয়মকে ফোন করে জানলাম যে ঠিকঠাক পৌঁছেছিস। আর এখন ফোন করে হঠাৎ দুটো এইচ কেন? কেমন লাগছে বল?’

রুদ্র বলল, ‘খুব ভালো লাগছে, কিন্তু বড্ড ঠান্ডা। এই এখন দুটো সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে বসে আছি। তোমার তো ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রিও একটা পেপার ছিল মাস্টার্সে, বলো না, ডাবল এইচ ফ্রান্সের কোনো হিস্টোরিকাল লোগো কি?’

বাবা ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘ফ্রান্সের?’

প্রায় আধঘণ্টা বাবার সঙ্গে কথা বলে ও উঠে পড়ল।

মাথার মধ্যে কিলবিল করা জটগুলো এখন এদিক—ওদিক ছোটাছুটি করে আরও তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। খটকাগুলো তো দূর হলই না, উলটে বাবা আরও সব অদ্ভুত প্রসঙ্গ তুলে আরও ঘেঁটে দিলেন।

এর মধ্যে বৃষ্টি থেমে তো গেছেই, বরং হালকা রোদও দেখা দিয়েছে। ও ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। এখানকার একটা জিনিস দেখে বেশ হাসি পায়, রাস্তায় লোকজনের বালাই নেই, টুকটাক এদিক—ওদিক হয়তো কাউকে হনহন করে হাঁটতে দেখা যায়, চোখের পলক ফেলতে—না—ফেলতেই সাঁ সাঁ বেরিয়ে যায় গাড়ি, এদিকে রাস্তার দু—ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়ি, যেন মানুষের থেকে এখানে গাড়ি বেশি। অথচ কোনো কান—ওষ্ঠাগত—করা হর্ন নেই, চিৎকার চেঁচামেচি কোলাহল কিচ্ছু নেই।

এখানকার মানুষ নিয়ম মেনেও চলে খুব।

এ ব্যাপারে কাল রাতে খেতে বসে প্রিয়ম একটা দামি কথা বলেছিল, ‘ইন্ডিয়াতে নিয়ম ভাঙাকে বেশিরভাগ মানুষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়, ভাবে ধুর, অমুক মানছে না যখন আমিও মানব না। ফাইন করতে এলে না হয় তাতে কিছু ঘুষ দিয়ে দেব। আর এখানে রুলটাকে অ্যাকসেপ্ট করেই মানুষজন আনন্দ পায়, তাই এদের দেশ এত পরিষ্কার, এত উন্নত।’

হঠাৎ ও দেখল নীচের কার্নিশে কেমন সুন্দর একটা নাম—না—জানা পাখি এসে বসেছে। একটু আগের বৃষ্টিতে তার সারা গা ভেজা, একটুক্ষণ অন্তর একবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে সে, জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে ছোট্ট ছোট্ট পালকগুলো থেকে। কী পাখি এটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, যদিও রুদ্র এমনিতেও তেমন পাখি চেনে না, তবু চড়াইয়ের মতো ছোট্ট কমলা—নীল মেশানো উজ্জ্বল গাঢ় রঙের পাখিটাকে দেখে ভারি কৌতূহল হল ওর, হঠাৎ মনে হল একটা ছবি তুলে গুগলে ইমেজ সার্চ দিলেই তো জানা যেতে পারে পাখিটার নাম!

চট করে মোবাইলের ক্যামেরাটা অন করে রেলিং থেকে আলতো ঝুঁকল ও, আর ওর অতিরিক্ত উৎসাহের জন্যই হোক, কিংবা কোনো ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অ্যালার্মে, পাখিটা ফুুৎ করে উড়ে গেল।

ঠিক তখনই নীচে দাঁড়িয়ে থাকা কালো লাল বাইকটা ওর চোখে পড়ল, এখান থেকে পিঁপড়ের সাইজের মনে হওয়া পাশে—দাঁড়িয়ে—থাকা সেই লোকটাকেও। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল ও এখন ফ্ল্যাটে একা, অমনি নিজের অজান্তেই ওর শিরদাঁড়া বেয়ে কেমন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।

চোখ সরু করে রুদ্র দেখার চেষ্টা করল, লোকটা বিল্ডিং—এর একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে কারুর সঙ্গে কথা বলছে। ওই জন বলে সিকিউরিটি লোকটার সঙ্গে কি? পাশে সেই বিশাল বাইকটা একদিকে হেলে কেমন ক্লান্ত একটা জন্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে।

ও আরেকটু ঝুঁকেও কিছু দেখতে পেল না, তারপর হঠাৎ কী মনে পড়তে ঘর থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে এল।

বাইনোকুলারটা চোখে লাগাতেই পিঁপড়ের মতো লোকটা হঠাৎ কয়েক গুণ বড়ো হয়ে গেল, এখন বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, লোকটা জনের সঙ্গে কথা বলছে। সেদিন সন্ধের আলো—আঁধারিতে বা কালকের বাস থেকে দেখাতে ভালো বুঝতে পারেনি। আজ রুদ্র লক্ষ করল, লোকটা সাইজে ছোটোখাটো, কিন্তু দারুণ গাঁট্টাগোট্টা। একটা খাকি—রঙা প্যান্ট পরেছে, আর ওপরে নীল একটা উইন্ডচিটার। মঙ্গোলয়েড ধাঁচের হলদেটে ফর্সা লোহার মতো কঠিন মুখ, আর চোখ দুটো কমন রোবটের মতো ভাবলেশহীন, নির্দয়। রোদ পড়ে খয়েরি চুলটা চকচক করছে।

ওর বুকের ভেতরটা নিজের অজান্তেই কেমন দুলে উঠল। লোকটা কি জনের কাছে জানতে চাইছে রুদ্ররা কোন ফ্লোরে থাকে?

এই অ্যাপার্টমেন্টটা প্রিয়মদের কোম্পানি থেকে লিজে নেওয়া, আহামরি কিছু সিকিউরিটি নেই এখানে, নাম—কা—ওয়াস্তে ওই জন বলে সিকিউরিটি গার্ডটা থাকে, ওর প্রাথমিক কাজ হল কেউ এলে তার নাম—ঠিকানা একটা রেজিস্টারে নথিভুক্ত করা কিন্তু সে কতটুকু ঠিকমতো নিজের কাজ করে, তা রুদ্র জানে না। কাল যাওয়া বা ফেরা, কোনো সময়েই লোকটাকে ওর চেয়ারে দেখতে পায়নি।

জন কি ওকে আগে থেকেই চেনে? কিন্তু তা কী করে হবে? জন কেন ওকে চিনতে যাবে!

রুদ্র কি একবার প্রিয়মকে ফোন করবে?

ধুর, পরমুহূর্তেই ও মন বদলে ফেলল, প্রিয়ম অফিসে বসে কী করতে পারবে টেনশন ছাড়া?

বুকের ভেতরের শব্দ গুণোত্তর প্রগতিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল, তার মধ্যেই ও দূরবীনের অ্যাপারচারটা সর্বোচ্চ বাড়িয়ে দেখল, লোকটা এদিক—ওদিক একবার তাকিয়ে নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য উপরের দিকে তাকাল, তারপর মাথা নেড়ে ঢুকে এল ওদের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর।

রুদ্রর হঠাৎ মনে হল ওর হৃৎপিণ্ডটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। লোকটা যে ওর কাছেই আসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর আসছে ওই ফটোগুলোর খোঁজে। ড শ্যুমাখার প্রথমে ওকে দিতে চাননি ফটোগুলো, একরকম জোর করেই রুদ্র নিয়ে এসেছে, এরপর যদি ওর কাছ থেকে জিনিসটা খোয়া যায়, ও একেবারেই মুখ দেখাতে পারবে না। এই লোকটা সেদিন ড শ্যুমাখারের সঙ্গে ওদের কথোপকথনের সময় থেকে শুরু করে ক্যাবে ওদের পিছু নিয়ে এই অ্যাপার্টমেন্ট অবধি এসে সব দেখে গেছে।

ওই ফটোগুলোর জন্য এত?

ড শ্যুমাখারা তাহলে ঠিকই বলেছিলেন! এমন মানুষও আছে যারা শুধুমাত্র নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্য মানবজাতির এত বড়ো উপকার চায় না। আর যারা নিজেদের লাভের জন্য মানুষের মৃত্যু চায়, তারা যে প্রয়োজনে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

আলোর চেয়েও বেশি গতিতে রুদ্র চিন্তা করতে লাগল ওর এখন কী করা উচিত। ও কি ওয়েট করবে লোকটা এসে কী বলতে চায় সেটা শোনার জন্য? সেটা কি বড্ড রিস্ক হয়ে যাবে না?

যদি জোরজবরদস্তি করে ফটোগুলো হাতিয়ে নেয়? ড শ্যুমাখারের কাছে ও কী উত্তর দেবে?

না, ও মনস্থির করে ফেলল। লোকটা আসার আগেই ওকে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। কেয়ারটেকারটা যদি বলেও দিয়ে থাকে যে রুদ্ররা এগারোতলায় থাকে, তাহলে লিফটে করে লোকটার আসতে সময় লাগবে বড়োজোর তিন থেকে চার মিনিট।

আচ্ছা, ও কি দরজা খুলবে না? না, সেটা কোনো সলিউশন নয়। দরজা ভেঙে ঢোকাটা এই ধরনের লোকেদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়।

তবে? পুলিশে ফোন করবে?

কিন্তু ড শ্যুমাখার বারবার ব্যাপারটাকে গোপন রাখতে বলেছেন।

ও আর বেশি ভাবল না, চট করে একবার রান্নাঘরে গেল, তারপর ঘরের যে ট্র্যাকসুটটা পরে ছিল, তার ওপরেই একটা জ্যাকেট গলিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে লিফট লবিতে চলে এল। ট্র্যাকসুটের ভেতরের থার্মালে গুঁজে নিল পার্স আর ফটোর এনভেলপটা।

ফোনটা হাতে নিয়ে এই ঠান্ডাতেও ঘামতে ঘামতে ও দেখল এই অ্যাপার্টমেন্টের দুটো লিফটের একটা ধীরে ধীরে গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে উপরে ওঠা শুরু করেছে, এক …. দুই…. তিন। অন্য লিফটটা তেরোতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওটাই সবচেয়ে উঁচু ফ্লোর, এবার ওটা নীচে নামবে। ও যদি লিফটের বোতাম টেপে, কোনটা আগে আসবে? যদি ওই লোকটার লিফটটাই নীচে থেকে আসে।

বোতাম টিপে রুদ্র অপেক্ষা করতে লাগল। উপরের লিফটটা নামতে শুরু করেছে, ওদিকে নীচেরটাও উঠছে পাঁচ, ছয়… সাতে। একবার ভাবল ও কি সিঁড়ি দিয়ে নেবে যাবে? কিন্তু বাঁ—পাশে তাকিয়ে দেখল সিঁড়ির দিকে যেতে গেলে এই করিডরে ওকে অনেকটা হেঁটে যেতে হবে, ততক্ষণে লোকটাকে নিয়ে নীচের লিফটটা এসে পড়বে, আর লোকটা করিডরে নেমে এদিকে তাকালেই ওকে দেখতে পেয়ে যাবে।

তেরোতলা এই বাড়িটার প্রতিটা ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট। হোটেলের কায়দায় তৈরি বলে একটু কোজি টাইপের। এমনি ঠিকঠাক হলেও লিফট দুটো যেন একটু বেশিই স্লো, প্রথম দিন এসেই খেয়াল করেছিল রুদ্র, প্রিয়মকে বলেওছিল কথাটা।

আজ সেটা আরও বেশি করে অনুভব করছিল রুদ্র। একেকটা সেকেন্ড যেন একেকটা ঘণ্টা মনে হচ্ছে।

অবশেষে নীচের লিফটা যখন দশ নম্বর ফ্লোর পেরিয়ে এগারোয় এসে পড়েছে, শুধু দরজাটা খুলতে বাকি, ঠিক তখনই উপর থেকে আসা লিফটটার দরজাটা খুলে গেল। রুদ্র এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ঢুকে পড়েই জিরো টিপল। কোথায় যাবে ও জানে না, তবে আপাতত এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরোতে হবে। জিনিসটা কোনোভাবেই খোয়া যেতে দেওয়া চলবে না।

কিন্তু শেষরক্ষা হল না পুরোপুরি। এই লিফটগুলো এত স্লো, ওর লিফটটার দরজা যখন বন্ধ হতে আর এক ইঞ্চিও ফাঁক নেই, ঠিক তখনই করিডরে বেরিয়ে ওকে দেখতে পেয়ে গেল লোকটা।

এবার লোকটাকে একদম স্পষ্ট দেখল রুদ্র। পিঠে একটা রুকস্যাক জাতীয় ব্যাগ, গায়ে নীল একটা উইন্ডচিটার আর খাকি প্যান্ট। ফর্সা মুখটা লম্বাটে গোছের, হালকা চাপ দাড়ি, ভাবলেশহীন যান্ত্রিক ছোটো ছোটো বাদামি রঙের চোখ। কালো মোটা ভ্রূ দুটো একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকায় নিষ্ঠুরতা যেন একটু বেশি ফুটে উঠেছে সেখানে।

ওকে দেখেই লোকটার চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে উঠলো, কিন্তু এই লিফটের দিকে এগিয়ে আসার আগেই দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।

লিফট নীচে নামতে শুরু করলেও রুদ্রর বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ শব্দটা কমছিল না একটুও। কী করবে ও এখন? মাঝের কোনো ফ্লোরে নেমে পড়বে? হঠাৎ আরেকটা সম্ভাবনার কথা মনে হতেই ও চমকে উঠল। আচ্ছা লোকটার যদি মাথায় একটু বুদ্ধি থাকে, লিফটের চেয়ে বেশি গতিবেগে সিঁড়ি দিয়ে দু—তিন তলা নীচে নেমে গিয়ে সেই ফ্লোরে লিফটের বোতাম টিপলেই রুদ্রর লিফটের দরজাটা খুলে যাবে ওর সামনে। সেক্ষেত্রে?

রুদ্র মাথার দু—পাশটা আলতো টিপে ধরল। উত্তেজিত হলে হবে না, মাথা ঠান্ডা অবস্থায় ভাবতে হবে ওকে। নাহ, ড শ্যুমাখারের উদবেগটাকে ওর আরও সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত ছিল।

আপাতত লিফটটা থামার কোনো লক্ষণ নেই। একদম নীচে চলে যাওয়া ভালো। কোনোমতে কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়েই একটা ফোন করবে ও ড শ্যুমাখারকে। তারপর তেমন হলে ক্যাব নিয়ে ওঁর ক্লিনিকে চলে যাবে। প্রিয়মকেও বলবে অফিস থেকে ওখানে চলে আসতে। একসঙ্গে দুজনে ফিরবে এখানে, তখন নিশ্চয়ই …. রুদ্রর ভাবনায় হঠাৎ বাধা পড়ল।

আড়ষ্ঠভাবে ও দেখল আট নম্বর ফ্লোরে এসে লিফটটা থেমে গেল একটা আলগা ঝাঁকুনি দিয়ে। আর দরজাটা ধীরে ধীরে ফাঁক হওয়া শুরু করতেই ও বাইরের করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা নীল উইন্ডচিটার আর খাকি প্যান্টের লোকটাকে দেখতে পেয়ে গেল।

লোকটার একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা ঠান্ডা চাউনিতে ও কেমন যেন স্থবির হয়ে গেল।

লোকটা একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা ঠান্ডা চাউনিতে ও কেমন যেন স্থবির হয়ে গেল।

লোকটা সোজা লিফটের ভেতর এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল, তারপর একইরকম ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘আই নিড দোজ ফতোজ।’

রুদ্র লোকটার চোখে চোখ রেখে নির্বিকারভাবে বলল, ‘হুইচ ফটোজ?’

লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ইউ নো। দোজ ওল্ড আইস ফতোজ।’

রুদ্র কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর জিনসের পকেটে হাত ঢোকাল।

লিফট প্রায় গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে গেছে।

লোকটা সেইরকম পাথরের মতো চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে।

রুদ্র পকেট থেকে খবরের কাগজ মোড়ানো চিলি পাউডারটা বের করল, তারপর বিদ্যুৎগতিতে বাঁ—হাতে কিছুটা লঙ্কাগুড়ো নিয়েই একটু ঝুঁকে সোজা ছুড়ে দিল লোকটার চোখে, লোকটা প্রথমে ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল, তারপর চাপা একটা আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল লিফটের এক কোণে।

লিফটের দরজা খোলামাত্র তিরবেগে ও ছুটে বেরিয়ে এল লিফট থেকে, ছুটতে ছুটতে গ্যারাজ পেরিয়ে কেয়ারটেকার লোকটাকে দেখতে পেয়েই যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে পকেটে হাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে পড়ল।

এই কয়েক মিনিটের মধ্যে এর থেকে ভালো আর কী অস্ত্র জোগাড় করতে পারত ও? ক্রেডিটটা অবশ্য প্রিয়মেরই প্রাপ্য, এত সুন্দরভাবে সব গুছিলে রাখে রান্নাঘরে!

রাস্তা পেরিয়েই একটা বাসস্ট্যান্ড। সেখানে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে, যাবে পিকাডেলি সার্কাসের ওদিকে। রুদ্র এদিক—ওদিক তাকিয়ে বাসটায় উঠে বসে পড়ল।

উত্তেজনায় ওর ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে, চোখ—মুখ লাল হয়ে গেছে।

বাসের জানলা দিয়ে ওদের কমপ্লেক্সের এন্ট্রান্সটা দেখা যাচ্ছে। বাস স্টার্ট দেওয়ার আগের মুহূর্তে ও দেখল ওই জাপানি লোকটা কেমন টলতে টলতে বেরিয়ে আসছে, চোখে রুমাল, কিন্তু প্রাণপণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। কোনোমতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ওর বিশাল বাইকটার কাছে যেতে যেতেই রুদ্রর বাস পেরিয়ে এল জায়গাটা।

রুদ্র নড়েচড়ে বসল। আশা করা যেতে পারে কেয়ারটেকারটা কিছু বুঝতে পারেনি। এই জাপানি লোকটাও চিৎকার করে ওঠেনি তেমন জোরে, সেটাও ও এক্সপেক্ট করেছিল যে লঙ্কার গুঁড়ো চোখে পড়ে জ্বলে খাক হয়ে গেলেও লোকটা নিজের অস্তিত্ব খুব একটা কাউকে জানাতে চাইবে না।

রুদ্র খুব সাবধানে পকেট থেকে খবরের কাগজের টুকরোটা বের করে যেটুকু লঙ্কাগুঁড়ো অবশিষ্ট ছিল, সেটা আস্তে আস্তে ঝেড়ে ফেলতে লাগল।

কী কাণ্ড! এরকম কী—একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিল না, অনেককাল আগে?

এত উত্তেজনার মধ্যেও হাসি পেয়ে গেল ওর। চোখটা বন্ধ করে নিল, হাওয়ায় যদি উড়ে আসে!

খবরের কাগজটা মোটামুটি পরিষ্কার করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ড শ্যুমাখারের নম্বর টিপল ও, আর তখনই হঠাৎ লোকটার বলা কথাগুলো ওর মনে পড়ে গেল।

আইস ফটো মানে কী? বরফের ফটো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *